আপিস কথা (৫)
মৃগাঙ্ক মজুমদার
৯
(আগের অংশ) মাথা ভনভন করছে সকাল থেকে নকুড়ের। আপিসে ঢুকে ফাইল খুলেছে কি খোলেনি, দু’সারি দুরের চেয়ার থেকে আপিসের অন্যতম বয়স্ক লোকটি এসে প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে মাথা খেয়েছে। মূল বক্তব্য তেমন কিছু না আবার দেখতে গেলে অনেক কিছু। বার বার সেই কথা মনে পড়ছে আর সাথে এইটাও মনে আসছে যে সব আপিসেই এই ধরনের এক পিস নমুনা থাকে। মানুষকে ‘নমুনা’ তখনই বলে লোকে যখন তার সাথে সাধারণ নিয়মকানুনের মিল থাকে না। এদের আপিস নিয়ে আজবরকমের আনুগত্য আর অধিকার থাকে। সঙ্গে থাকে তাদের অভিজ্ঞতা কত, তাই নিয়ে ঝালাই।
ঝালাই মানে, হয় পুরনো কথা আর অভিজ্ঞতা কুড়িয়ে বাড়িয়ে রাং ঝাল না হয় ধানাই পানাই। বিরক্তি চরমসীমায় পৌঁছে গেলেও এদের কথার মধ্যে কথা বলা যায় না। তা হলেই সেটা আরো বাড়তে থাকে। তার পর জ্বলতে থাকে। আর কিছু করার থাকে না, এক স্বর্গীয় স্মিত হাসি মুখের কোণায় ঝুলিয়ে ঝুল মার্কা জ্ঞান আর কথা শুনতে হয়। আর তার ফল এই মাথা ভর্তি ব্যাথা। নকুড়ের একটাই দোষ ছিল এর মধ্যে, যে আপিসে ঢোকার সময় লিফটে সে বলেছিল আপিসের কাজ সবাই ঠিক করে বোঝাপোড়া করে করা উচিত আর আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পুরোনোদের খাপ খাইয়ে নেওয়া উচিত যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ব্যস, আর কে দেখে। নকুড়ের নিজের নিজেকে দেওয়া আপিসের নীতিবাক্য – সদা সর্বদা ভাবিয়া নিজের মুখ আর চিন্তা প্রকাশ করিবে নইলে মাথাব্যাথা নানা বেশে আসতে পারে আস্ত আতঙ্ক হয়ে।
শুরুটা সেই আপিস প্রাজ্ঞ খুবই সাদামাটা ভাবে করেছিলেন। যাকে বলে হাড় তেঁএটে হারামি যারা সব ঘাঁতঘোঁত জেনে হাল্কা করে লাথ মারে, তাতে ব্যাথা পুলিশের কম্বল ধোলাইয়ের মত লাগে অথচ মুখ থেকে একটুকুও আওয়াজ বের করা যায় না বা কোনো প্রমাণ দেখানো যায় না। তা তিনি সকালে এসে ‘কী, কেমন আছ, কাজ কীরকম হচ্ছে, চাপ কীরকম’ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি নানারকমের খেজুর বেচলেন। আর তারপরেই ধীরে ধীরে ঢুকে পড়লেন তার নিজের অভিজ্ঞতার জগতে। নকুড় বেয়ারার দিয়ে যাওয়া চা ঠান্ডা করতে দিয়ে হাঁ করে বাধ্য হয়ে শুনতে বাধ্য হয়েছিল কথাগুলো। তার নির্যাস খানিকটা এইরকম –
- উনি চোখের সামনে দেখেছেন কী ছিল আর কী হল,
আজকালকার ছেলেমেয়েদের কাজের প্রতি যত না দরদ, তার চেয়ে বেশি দরদ চাকরি ছেড়ে চাকরি নতুন চাকরি খুঁজতে,
- ওঁর যা অভিজ্ঞতা, তার দাম আজকের প্রজন্ম বুঝবে না। আর নতুন প্রজন্মকে বোঝানো মানে উলুবনে মুক্ত ছড়ানোর মত ব্যাপার (নকুড় মনে মনে ভাবল, তাহলে নকুড় এতক্ষ্ণ ধরে কানপেতে আর কাজ ছেড়ে করছেটা কি? এককথায় হাঁকিয়ে দিলেই তো পারে!)
- প্রযুক্তির পেঁয়াজি সবসময় ভালো না, আপিসের কাজে মানুষের অবদান কমে যাচ্ছে ( ঠিক এই জায়গাটা শুনে নকুড়ের কিছু অশিক্ষিত আর তথাকথিত বামপন্থীদের কথা মনে পড়ল যারা চর্চা ভুলে নিজেদের কার্যসিদ্ধির জন্য সবকিছুকে সবার আগে বাদ দিয়ে দেন। আর তার সঙ্গে সঙ্গে আছে কিছু সুবিধাবাদী রাজনৈতিক আর ধর্মগুরুরা যারা বাসের কন্ডাকটরের মত বলেন, পিছনের দিকে এগিয়ে যান !
- নকুড়ের এখনো কিছু বোঝারই সময় হয়নি, আপিসের কাজ বুঝতে আর আপিসকে বুঝতে হলে চুল পাকিয়ে ফেলতে হবে ওঁদের মতো আর অবশ্যই আপিস রাজনীতি আর গুজবের সান্নিধ্যে কাটাতে হবে।
- উনি খুবই প্রতিভাবান ছিলেন, আপিস ঠিক বুঝতে পারেনি কদর করেনি না হলে আজ আরো উঁচুতে উঠতে পারতেন তাই উনি চান ওনার থেকেও লোকে শিখুক, কীভাবে ভুলগুলো না করা যায় ( নকুড় এইখানে এসে হতভম্ব)।
- বুঝলে কি না, এখানে অনেক কিছু জানার আছে। তোমরা কতটাই বা জানো, এই আপিসে থেকে থেকে হাড় পেকে গেল আমার। কিছু দরকার টরকার পড়লে এসো, বুঝিয়ে দেব।
শেষের দিকে নকুড়ের মাথায় আর কিছু ঢুকছিল না। মুখ দিয়ে হুঁ, হ্যাঁ বের করাও বন্ধ করে দিয়েছিল। বাকি কোনওদিকে মন তো দুরের কথা, নিজের অবস্থান আর অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান হয়ে পড়েছিল। ভেবেই যাচ্ছিল -এঁর কি মাঝ বয়েসজনিত সমস্যা আছে! নাকি অতিরিক্ত কমপ্লেক্স-এ ভোগা এক মানুষ! এই ভাবতে ভাবতে মাথা ধরাটা আরো জাঁকিয়ে বসেছিল। এখন তা প্রায় চুড়ান্ত পর্যায়ে। এখন ভাবছে, বাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়বে কি না হাফডে ছুটি মেরে! কিন্তু সমস্যা একটাই। এ তো আর সরকারী আপিস না যে ছুটি বল বা ডুব- মেরে দিলেই হল। এখানে ছুটির হাজার ফ্যাকড়া।
মাথা ধরে নকুড় কফি ভেন্ডিং মেশিনের দিকে হাঁটা দিল।
১০
ছুটির এক চিরকালীন সর্বগ্রাহীতা আছে। বিশেষ করে যারা আপিসে কাজ করে তাদের কাছে তো বটেই। তবে সব আপিস তো আর ইশকুল নয় যে কিছু ঘটল আর ট্যাং ট্যাং করে ছুটির ঘন্টা পড়ল। আপিসে না আছে রেইনি ডে, না আছে কোনো মহান মানুষের জন্ম বা মৃত্যুদিনে ছুটি। শেষের ব্যাপারটা অবশ্য কিছু আপিসে- মানে বিশেষ করে সরকারী আপিসে।
সরকারী আপিসের কাজ করার আনন্দের কথা নকুড় ছোটবেলা থেকে আজকের দিন অবধি শুনে এসেছে। শুনে শুনে মনে হয় রূপকথার গপ্প শুনছে। এইসব শুনতে গেলে আসলে বর্ষাকালে প্রায় চা, তেলেভাজা আর মুড়ি নিয়ে বসতে হয় সন্ধ্যেবেলায়। এদের কথা নিয়ে চর্চা খবরের কাগজ থেকে গপ্পের বই, জীবনমুখী গান থেকে সিনেমা - সবেতে বহুবার বহুভাবে বলা হয়েছে। তাতে এদের নিজগর্বে মন এবং মুখ দুইই প্রফুল্লিত হয়েছে।
মানে বেশীরভাগ সরকারী আপিসের বাবুরা আপিসের কাজটাকে বেশ কিছু সেশন বা পর্বে ভাগ করে নিতেন ( কেউ কেউ এখনো নেন) যেমন-
১) আপিস পদার্পণ পর্ব – দূরে বা কাছে যেখানে থেকেই আসুন না কেন এদের আপিসে এসেই হুড়মুড়িয়ে আপিসের ফাইলে মুখ গোঁজার ইচ্ছে থাকে না। এদের আপিসে পা দেওয়া মানে দু এক কাপ চা, খবরের কাগজের শিরোনাম নিয়ে গুলতানির জন্য প্রস্তুত করা নিজেকে ইত্যাদি ইত্যাদি।
২) পর্যালোচনা পর্ব – দেশ আর দশের হাল হকিকত খোঁজ খবর নেওয়া, আপিসের চারপাশে কিছু চলছে কি না সেই নিয়ে একটু হাল্কা রস চড়ানোর চেষ্টা ইত্যাদি।
৩) পারিবারিক পর্ব – এখানে কার ছেলে কি করল, কার বাড়িতে কি ঢুকল, কোথায় পুজোর ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া, ভালো স্কুল কলেজ ইত্যাদি।
৪) পাওনা গণ্ডা পর্ব - মানে আপিসের বেতন, পদোন্নতি, পি এফ, গ্র্যাচুইটি, পে কমিশন।
৫) আন্দোলন পর্ব – এখানে উদ্দেশ্য সবার মোটামুটি একই থাকে, কিন্তু মতের অমিল প্রচুর তাই ইউনিয়নও প্রচুর। অতএব মাঝখান থেকে মজা দেখে সরকার বাহাদুর।
৬) টিফিন পর্ব – এখানেও বেশ মিল বেশির ভাগেরই। তবে কি না আপিস অনুযায়ী একটু রকমফের হয়ে থাকে। শহরে আপিস হলে সেখানে কিছু লোক আপিসের আশে পাশে ‘খাও গলি’ খাও রাস্তা’ ইত্যাদিতে ঢুকে পড়বেন বা বাড়ি থেকে আনা খাবার সাঁটাবেন। আর শহরতলী বা গ্রামে আপিস হলে তেনারা আপিস প্রায় বন্ধ করে বাড়ি চলে গিয়ে খেয়ে ভাতঘুম দিয়ে আবার ফিরে আসেন পড়ন্ত বেলায়। তবে শহরতলীর দিকে বা গ্রামের দিকের আপিসের যারা নিত্যযাত্রী,তাঁদের অতসুখ মেলে না। কিন্তু মধ্যাহ্ন ভোজনের সময়টা তাঁরাও নানা ভাবে দীর্ঘায়িত করে নেন।
৭) কর্ম পর্ব – এইটা হচ্ছে ম্যানেজ দেওয়া পর্ব। সংখ্যালঘু কিছু বাদ দিলে বেশীরভাগই কাজ কম কাত বেশী-তে বিশ্বাস করেন। তা সে কাত ঘুমে কাতও হতে পারে আবার নানা চিন্তায় কাতও হতে পারে। আর এর কিছুই যদি না হয় তো পড়ে রইল ঘুসের জন্য হাত কাত করা।
তবে ইদানীং প্রযুক্তির ঠেলায় নাভিশ্বাস উঠছে সবার। কারণ ফাঁকি মারার জায়গা কমে যাচ্ছে। আপিস কেটে সংস্কৃতি উদ্ধারের কাজে যাওয়াতেও ভাঁটা পড়ছে। সকাল বিকেল আঙুলের ছাপ নিয়ে আপিসে ঢোকা আর বেরোনোতে সব ফন্দি ফিকির আর ফাঁক ফোঁকর ঢাকা পড়ছে। এত কিছু করতে হচ্ছে দেখেই বার বার পাওনা ডিএর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আগে তো তবুও একটা পেনশন বলে নিশ্চিন্ত আয়ের ব্যাপার ছিল অবসরের পরে এখন সেখানেও কাঠি করছে, সরকারে যে আসছে সে।
নকুড় ভাবে, সেই রূপকথার দিনগুলো তো তার আর কোনদিনও হবে না! এমনিতেই বেসরকারি, তায় কোনো রকমে পি এফটা দিচ্ছে, পেনশনের বালাই নেই এদিকে কাজের পাহাড়। সরকারি আপিসের লোকজন তো বেশ ছিল। কিন্ত নিজদের পায়ে কুড়ুল তারা নিজেরাই মেরেছে।
ওই যে কথায় আছে, ”চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়...”
(পরের অংশ)
লেখক পরিচিতি: মৃগাঙ্ক একটি যাযাবর বোহেমিয়ান পাখির উড়ান জীবন। বিজ্ঞাপনী ভাষা লিখে আর বলে তার পেট ভরে। আর্ন্তজালের রাজ্যে হানা তার ট্যাঁক ভরানোর জন্য। হাওয়ার প্রবল টানে গতিপথ বহুবার বদলালেও লক্ষ্য স্থির। একদা ভারতের রাজধানী বঙ্গদেশের কলকাতাতে হলেও প্রবাসী তকমাতেই জীবন কেটেছে আর কাটছে। লেখালিখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক বহু বছর ধরে। আগ্রহ নাটক, সিনেমা, কবিতা, সাহিত্য, রান্না, ছবি তোলা, বিনা প্রস্তুতিতে বেরিয়ে পড়া মন চাইলে, বই পড়া আর প্রিয় পরিবার এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানো।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.