আপিস কথা (৪)
মৃগাঙ্ক মজুমদার
৭
(আগের অংশ) আপিসে কাজ করা এক জিনিস আর আপিসের লোকেদের নিয়ে কাজ করা আরেক জিনিস। এক এক জন এক এক রকমের ওস্তাদ, আর তাদের মার এক এক রকমের। তবে হ্যাঁ, শেষ রাতে মারার মত কেউ সাধারণত থাকে না আর যদিও বা থাকে তারা খুবই দুর্লভ। আসলে আপিসে ভোজবাজির চেয়ে কাঠিবাজি বেশি চলে আর তাতে ওস্তাদেরা তাদের নিজেদের কেরামতি দেখাতে ব্যস্ত থাকেন। ওস্তাদদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা চলে- তারা কত বেশি হারে কাঠি করতে পারলেন। আপিসের মধ্যে এই নিয়ে ক্রিকেটের মতো কখনো টি টোয়েন্টি, কখনো একদিনের ম্যাচ আর কখনো টেস্ট ম্যাচের মত সেশন বাই সেশন ধরে চলতে থাকে। তবে জেতে তারাই, যারা কাঠির থেকে ভালো বাঁশ দিতে পারে। এই কাঠি যে কখন কীভাবে আসবে, কেউ বলতে পারে না। তবে কি না, সব আপিসের কিছু ভালো উপাদান থাকে যারা নতুনদের আগে থেকে ইশারা বা নানাভাবে বুঝিয়ে দেয়। আর আরো সুরক্ষিত হতে চাইলে আপিসের মধ্যে কোন একটা গোষ্ঠীতে যোগ দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়।
এই গোষ্ঠী বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রভাবে আচ্ছন্ন হতে পারে বা শুধুমাত্র আপিসের নিজেদের ল্যাজ বাঁচানোর রাজনীতির খেলাতে মেতে থাকে। এদের উদ্দেশ্য এমনিতে যাই হোক না কেন, কিছু সময় সঙ্গে থাকলে একটা বল -ভরসা পাওয়ার আশ্বাস জাগে আপাতনিরীহ চাকুরিজীবিদের মনে। মুশকিল হয় তখনি, যখন এদের মধ্যে কেউ কেউ খালি নিজেদের আখেরটাই দেখে আর ‘পরের ছেলে পরমানন্দ যত উচ্ছন্নে যায় তত আনন্দ’ বলে দায় এড়ায়।
নকুড় মদনার কেবিনে যাওয়া থেকে ফিরে আসা ইস্তক আপিসের লোকজন চাতক পাখির মত মুখ হাঁ করে বসে ছিল, যদি কিছু ‘ব্রেকিং নিউজ’ পাওয়া যায়। এদের কাছে যে কোন খবরই সারাদিনের মুখ চালানোর উপাদান। যত না কাজ তার থেকে বেশি অকাজের কথা। তবে এদের স্বপক্ষে একটাই কথা বলার আছে। সেটা অবশ্য ডাক্তারি নিদান। সেখানে বলা আছে- রিসার্চে দেখা গিয়েছে যে যারা গসিপ করে তাদের হৃদরোগের সম্ভাবনা খুবই কম। অতএব স্বাস্থ্য বাঁচাতে গসিপই একমাত্র উপায়। আর আপিসের বসেদের অর্থাৎ কিনা এই ধরনের বড়বাবুদের কেবিনে ঢোকা প্রায়শই জেলের কালকুঠরিতে ঢোকার মত হয়ে থাকে। মাঝে মধ্যেই জবাই ইত্যাদির খবর আসে, আর সেখানে নকুড়ের মত নবাগত কেউ ঢোকা মানেই কিছু নতুন রসের উপাদান।
আপিসে ঢোকা অবধি এই সব কেবিন কাহিনি আশেপাশের লোকজন মানে সহকর্মীদের মুখে শুনে এসেছে, যা কিনা যে কোনো রহস্য রোমাঞ্চ গল্পকে বলে বলে হার মানিয়ে দেবে। আর এই ‘ভিতরের খবর’ দেওয়ার বিশেষ লোকেরা হল বেয়ারা বা পিওন গোত্রের কর্মচারীরা, যারা নানা ছলছুতোয় কেবিনে ঢোকে আর ফাইল নিয়ে যাওয়া আসা, চায়ের কাপ দেওয়া ছুতোনাতাতে কান খাড়া করে রাখে আর চোখটাও সজাগ রাখে। যতটুকু সময় পায় এরা, তার মধ্যেই মুচমুচে খাস্তা খবর তৈরী করে ফেলে পরিবেশনের জন্য। আর কেবিনের দরজার বাইরে সার করে রাখা উদগ্রীব চোখ-মুখ-প্রাণ গুলো হাপুস হুপুস করে চাটতে থাকে খবরগুলো পাতে পড়া মাত্র।
নকুড়ের এই যাত্রা তেমনকিছু ঘটেনি খালি কিছু ফাইলের তথ্য বদলে দিতে বলেছে মনসা আর এই তথ্যগুলো সবার উপরই প্রভাব পড়বে। কারণ এখন সবাই বাইরে মাইনে বাড়ার আশা নিয়ে আকাশ পাতাল এক করে দিচ্ছে।
এমনিতেই ফিনান্সিয়াল ইয়ারের আগে নকুড় আপিস জয়েন করেছিল বলে এই বছর তার মাইনের কোনোরকমের বাড়বৃদ্ধির আশা নেই। খালি চিনচিনে ভয়, কোন ভুলভাল না হয় আর সামনের বছরের অ্যাপ্রাইজালটাতে কোন জল না পড়ে। এবছরের মার্চের পর থেকেই সারা আপিস জুড়ে যেরকম ভনভনানি আর গুনগুনানি বেড়েছিল তাতে কাজের কথা ভুলে নকুড় সারাক্ষ্ণ কান খাড়া করে শুনে যেত ব্যাপারটা আসলে কি?
সরকারী আপিসের বছরে একবার একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় বাড়ে আবার তাদের ফি বছর পুজো বা দীপাবলীর আগে বোনাসও হয় কিন্তু বেসরকারী আর মাল্টিন্যাশানালে যারা কাজ করে তাদের সবেধন নীলমনি এই আর্থিক বছর শেষের অ্যাপ্রাইজাল বা কাজের হিসাবনিকাশ যার ওপর ভিত্তি করে দেনাপাওনার হিসেব হয়। সেই হিসেবের আগে আর পরে আপিসের অবস্থা দেখার মত হয়, সারা আপিস জুড়ে একটাই গানের সুর ভেসে বেড়ায় খালি কথা গুলো বদলে যায়, “ আল্লা টাকা দে, প্রমোশন দে, মাইনে বাড়িয়ে দে, আল্লা মাইনে বাড়িয়ে দে”। সারাক্ষণ আস্তে, জোরে, ফিসফাসে, গজল্লাতে একটাই বিষয় ঘুরে বেড়ায়, ‘কী হবে এবারে? বাড়বে তো কত! আর না বাড়লেই বা কী করা হবে?’ এর সঙ্গে শুরু হবে সংসার আর সরকারের সাতকাহন।
সংসারে খরচা বাড়ছে আর সরকার ট্যাক্স বাড়াচ্ছে আর এই সাঁড়াশি চাপে যে ছাপ পড়ছে পকেটে, সেটা কী করে সামলানো যায় তাই নিয়ে কাজের ফাঁকে, কী বোর্ডের চাপে আর ফাইলের ভাঁজে ভাঁজে বিস্তারিত হতে থাকে। এই সময় আপিসের মধ্যে কিছু নিউজ এজেন্সীর বাড়বাড়ন্ত দেখা যায় যারা প্রতিদিনের মাইনে সংক্রান্ত কিছু গুজব আসল খবরের মত করে রোজের আবহাওয়া দপ্তরের মত পরিবেশন করে। সেই খবরের উপর ভিত্তি করে আপিসের তাপমাত্রা বাড়ে কমে। যাদের যাদের হিসাবের সঙ্গে পুরোটা মেলে তাদের উচ্ছ্বাসেরর সীমা-পরিসীমা থাকে না বলাই বাহুল্য। কিন্তু যাদের আংশিক মেলে বা মেলে না, তাদের গজগজানি শুনলে মনে হতেই পারে শ্রমিক বিদ্রোহের নতুন অধ্যায় লেখা হতে চলেছে। তবে কিনা বেশির ভাগটাই ফাঁকা আওয়াজে পর্যবসিত হয়। কারণ, ওই কাঠিবাজি।
যে যাই মুখে বলুক একজনের উন্নতি বুকে পাথর চেপেও বেশিরভাগ লোকই মেনে নিতে পারে না। এটা প্রায় সেই ছোটবেলার অঙ্কের উপপাদ্য প্রমাণিতর মত। তাই মুখে হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা বললেও একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে দাবী দাওয়া আদায় করার থেকে যা পেয়েছি তাই দিয়ে চালিয়েনি। বেশি বললে যদি চাকরিটাই না থাকে। আর আপিসের ম্যানেজমেন্টও জানে সেই কথা। অতএব সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে নিজেদর মধ্যে ম্যানেজমেন্টের শ্রাদ্ধ করে অপার প্রশান্তি লাভ করে চিত্ত প্রফুল্লিত করে কাজে মনোনিবেশ করেন। থাকার মধ্যে রয়ে যায় ‘গসিপ’।
৮
আপিসের প্রেমের গসিপ তো থাকেই, তার সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা গসিপ চলতে থাকে- কে বসের চামচা আর কে কাজ করে অথচ দাম পায় না। এই চিরন্তন আলাপচারিতা নিয়েই একটা আপিস দিন-মাস- বছর গুলজার আর গুজরান করে। তাই কে কার বসের কত কাছে যেতে পারে সেই নিয়ে নানা প্রতিযোগিতা চলে। বিশেষ করে সেই বস যদি ‘তেলে’ চলেন, তবে। তবে কিনা নকুড় আপিসেরই বিজ্ঞজনদের কাছে শুনেছে বসেদেরও নানান প্রজাতি হয়।
সুকুমার রায় খালি একপ্রকারের বসের অর্থাৎ কিনা বড়বাবুর কথা শুনিয়েছেন কিন্তু তার বাইরেও যে বহু প্রজাতি বিদ্যমান আর বহুল্ভাবে আপিস সংস্কৃতির সঙ্গে বহমান তা অনেকেরই অজানা। আর নকুর তো সবে ঢুকেছে আপিসে। মদনার মত তেঁএঁটে বস যেমন আছে, একটু ভালো করে খুঁজে দেখলে নিতান্ত ভালমানুষ বসও আছে । এই কথা শোনার পর নকুড়ের হঠাৎ করে ভক্তি জেগে উঠেছিল। মনে মনে ক্যালেন্ডারে দেখা ঠাকুর দেবতাদের কাছে সে প্রায় মানতই করে বসল যে ভালো বস দিলে তাদের হয়ে সে একাই ডবল মাটন ডবল এগ রোল খেয়ে নেবে। মানে, ঠাকুরকে দেওয়া সব প্রসাদ তো শেষমেশ মানুষেরই পেটে ঢোকে। তা নকুড় না হয় সোজাসুজি খেয়েই নিল। কুচো নকুলদানা, বাতাসা বা গুজিয়ার চেয়ে তো ভালরে বাবা। যাই হোক, নকুড় শুনছিল ‘বসেদের প্রকারভেদ’ অনেকটা সেই স্কুলে জীবনবিজ্ঞানের বইতে পড়া উদ্ভিদ, বা প্রাণীদের প্রকারভেদের মত।
এই বসেদের হাতেই আছে চাকুরিজীবনের উন্নতির চাবিকাঠি। তাই যার কাছে যতরকমের তেলের খনি আছে বা ভবিষ্যতে খনন করে তেল পাওয়ার সম্ভাবনা আছে তাদের প্রায় সবাই লেগে যায় তেলের যোগান দিতে। কিছু অন্যচরিত্র থাকে, তবে তা এক আঙুলের কর গুনে বলা যায়। দশটা আঙুলও লাগে না। নকুড় রোজ শিখছে আর ভাবছে এটা কীভাবে সে প্রয়োগ করবে!
নকুড়ের মধ্যবিত্ত বাঙালি মানসিকতা। যেখানে ঘাড়ে ধরে তাকে মূল্যবোধের মূল্য শেখানো হয়েছে। তার ওপরে সে না ডাকাবুকো, না তার দু’কান কাটা। অতএব বসেদের প্রজাতি শুনেই ক্ষান্ত দিতে হয় তাকে। হাজার হোক, বিজ্ঞজনের কথা ফেলা তো যায় না।
তা আপিসে নানারকম বসেদের কথা শুনে নকুর হিজিবিজি যেসব নোটস নিয়েছিল, সেগুলো ডিকোড করলে অনেকটা এইরকম দাঁড়ায় -
বসেদের মধ্যে
বসেদের এই দশাবতার ছাড়াও আরো কিছু ছড়ানো ছিটানো উদাহরণ আছে যেমন ‘বকা বস (খালি বকবক করে যান)’; ‘ন্যাতানো বস ( এনার নিজের কোন জোর নেই যে কেউ এসে ধমকে চমকে যেতে পারে)’ ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।
এত রকম বসের কথা নকুড় তার প্রথম চাকরিতেই শুনতে পাবে আশা করেনি। এই আপিসে যতগুলো ডিপার্ট্মেন্ট আছে, আর সেগুলোয় যারা যারা বসে আছে তাদের কে দেখে মিলিয়ে নেবার ইচ্ছে জাগে নকুড়ের মাঝে মাঝে। তবে কিনা, তাদের হাতেই তো সেই অ্যাপ্রাইজালের চাবিকাঠি, ওরা নকুড়ের বস না হোক, কাঠি তো করতে পারে মদনাকে বলে। আর মদনার মাথা ঘুরে গেলে সামনের বছরের অ্যাপ্রাইজালে জল পড়ে যাবে নকুড়ের।
অতএব আপিসের বিজ্ঞদের কাছ থেকে আরো কিছু জ্ঞানের আলো পাবার আশা নিয়ে নকুড় বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। কাল আবার অনেকগুলো বড় কাজ। কী সব টেন্ডার আর ভেন্ডর নিয়ে মাতামাতি! কাল এসেই দেখা যাবে’খন...
(পরের অংশ)
লেখক পরিচিতি: মৃগাঙ্ক একটি যাযাবর বোহেমিয়ান পাখির উড়ান জীবন। বিজ্ঞাপনী ভাষা লিখে আর বলে তার পেট ভরে। আর্ন্তজালের রাজ্যে হানা তার ট্যাঁক ভরানোর জন্য। হাওয়ার প্রবল টানে গতিপথ বহুবার বদলালেও লক্ষ্য স্থির। একদা ভারতের রাজধানী বঙ্গদেশের কলকাতাতে হলেও প্রবাসী তকমাতেই জীবন কেটেছে আর কাটছে। লেখালিখি ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক বহু বছর ধরে। আগ্রহ নাটক, সিনেমা, কবিতা, সাহিত্য, রান্না, ছবি তোলা, বিনা প্রস্তুতিতে বেরিয়ে পড়া মন চাইলে, বই পড়া আর প্রিয় পরিবার এবং পরিবারের সাথে সময় কাটানো।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.