প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সমাজ ও সংস্কৃতি - পুরাণ কাহিনি

মার্চ ৩০, ২০১৫

 

অমর-কথা (২)

পল্লব চট্টোপাধ্যায়

(৫)

(আগের অংশ) দিবা তৃতীয় প্রহরের শেষে শিষ্য ভরদ্বাজের সাথে শাস্ত্রালোচনা করতে করতে ঋষি বাল্মীকি একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলেন, এমন সময় পিঠে কিসের যেন ছোঁয়া লাগায় তিনি চোখ মেললেন। হঠাৎ পিছন থেকে একটি কন্ঠস্বর শোনা গেল, ম্লেচ্ছভাষায় কারা যেন বলছে-
‘আরে আরে রাক্ষস-যুগল- রাবণ ও কুম্ভকর্ণ নরমাংসভোজী
এবে আর রক্ষা নাই , মিলিত একত্রে হেথা রাম ও লক্ষ্মণ!’
তাঁকে আর পশ্চাৎ ফিরতে হলনা, ভরদ্বাজের হাসিতেই বুঝলেন এই যুগ্ম-ভ্রাতার পরিচয়।
- বৎস লব-কুশ, এই চিত্রকূটে বৃথা তোমরা রাক্ষস খুঁজছ, এখন এই আর্যভূমে তো নয়ই, লঙ্কার রাক্ষসকুলও ভদ্রসমাজে পরিণত হয়েছে । তা তার শাস্তি কি বুড়োমানুষটিকে পেতে হবে ? –মৃদু হাসলেন বাল্মীকি ।
-না মাতামহ, রাক্ষস চাই নে, আপনি তাদের গল্পটা শেষ করুন - দুই ভাই বলল ।
-তাহলে যাও, মা সীতাকে ডেকে নিয়ে এস, তাঁরই আগ্রহে ত কাহিনী এগোচ্ছিল । সীতাদেবি আসার কথা শুনে শিষ্য বিদায় নিলেন। অনন্তর ঋষি রক্ষঃকাহিনীর ক্রমপর্যায় শুরু করলেন।

- সুকেশের কাহিনী বলছিলাম, এই সুকেশের বল-বৈভব ও ধর্মে মতি দেখে গন্ধর্বশ্রেষ্ঠ বিশ্বাবসু নিজকন্যা লক্ষ্মীসমা দেববতীকে তুলে দেন তার হাতে । মাল্যবান, সুমালী ও মালী নামে তাঁরা তিন পুত্রের জন্ম দেন । তাঁরা  তিনজনেই অগাধ উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, তাই অজেয়-অমরত্ব বরের জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করেন । ব্রহ্মা তখন তুষ্ট হয়ে তাঁদের বর দেন যে তাঁদের ভাইদের মাঝে সম্প্রীতি চিরকাল থাকবে এবং তাঁরা ব্রহ্মা বা ব্রহ্মাসৃষ্ট যে কোনও প্রাণী দ্বারা অজেয় ও অবধ্য থাকবেন । একে প্রায় অমরত্বই বলা যায় । তাঁরা খুশী হয়ে এবার দেব-স্থপতি বিশ্বকর্মাকে ধরলেন তাঁদের বাসস্থানের জন্য কোনও দুর্গম স্থানে একটি সুরম্য রাজধানী ও সুবিশাল সৌধ প্রতিষ্ঠা করে দেবার জন্যে ।
বিশ্বকর্মা তাঁদের বললেন, দক্ষিণ সমুদ্র-তীরে ত্রিকূট পর্বতেরও দক্ষিণে আছে  জলবেষ্টিত পার্বত্য প্রদেশ লঙ্কা। সেখানে সুবেল নামক পর্বতের সুউচ্চ শৃঙ্গে আমি দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশে শত যোজন দীর্ঘ ও ত্রিশ যোজন প্রস্থের এক বিশাল নগরীর সৃষ্টি করি। এই নগরীর অভ্যন্তরে স্বর্ণ-মণি-মাণিক্য খচিত উৎকর্ষে শ্রেষ্ঠ অসংখ্য প্রাসাদ আমি নির্মাণ করি। এ স্থল দেব-দানবের পক্ষেও দুর্গম, কিন্তু কোনও কারণে দেবরাজ সেখানে না থাকতে পারায় সবই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। অতএব হে রাক্ষসকুলতিলক ভ্রাতৃত্রয়, তোমরা সপরিবারে ও সবান্ধবে সেখানে বিরাজ করতে পার। অতঃপর মাল্যবান, মালী ও সুমালী সমস্ত রাক্ষস-সমাজকে এই সুবর্ণলঙ্কায় আনয়ন করে সদর্পে রাজত্ব করতে লাগলেন।
অনন্তর এই তিন ভাইএর বিবাহ হয় নর্মদা নাম্নী গন্ধর্বীর তিন কন্যার সাথে। তারপর মাল্যবান লাভ করেন বজ্রমুষ্টি, বিরূপাক্ষ আদি সাত পুত্র ও অনলা নামে কন্যা, সুমালীর ঘরে আসে প্রহস্ত, অকম্পন আদি দশ পুত্র ও রাকা, কৈকসী আদি চার কন্যা। মালী লাভ করেন অনল, অনিল, হর ও সম্পাতি নামে চার পুত্র যাঁরা পরবর্তীকালে বিভীষণের মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন।
- আর রাবণ? সীতা জিজ্ঞাসা করেন।
- না, রাবণ এঁদের সাথে সম্পর্কহীন না হলেও রাক্ষসকুলের কেউ নয় বললেই চলে। এই তিন ভাই ব্রহ্মার বরে বলীয়ান হয়ে দেব, দানব, যক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নর, মানুষ, ঋষি-মুনি সবার উপর অত্যাচার শুরু করেন। ইন্দ্রাদি দেবতাও তাঁদের হাতে পরাজিত হন। তাঁরা তখন মহাদেব শিবের কাছে আসেন। শিব তাঁদের বলেন- হে দেবগণ, এই রাক্ষসদের পিতা সুকেশের উপর আমার অনুগ্রহের কারণে তার পুত্রেরা আমার অবধ্য। তবে ব্রহ্মার বরে এরা তাঁর সৃষ্ট কোনও শত্রুর দ্বারাও পরাজিত বা নিহত হবে না। তাই একমাত্র বিষ্ণু, যিনি স্বয়ং ঈশ্বর, যিনি ব্রহ্মাসৃষ্ট জীব নন, তাঁকে তোমরা অনুরোধ করে দেখতে পার।
অতঃপর দেবতারা বিষ্ণুর নিকট গেলেন। তিনি সকলের দুঃখের কাহিনী শুনে অবশেষে রাক্ষস-বধে রণভূমিতে অবতীর্ণ  হওয়ার আশ্বাস দান করলেন।
এদিকে গুপ্তচরের মাধ্যমে লঙ্কায় খবর পৌঁছে গেছে যথাসময়ে। মাল্যবান বললেন, ভ্রাতৃগণ, এই দেবতাদের কথায় শ্রীবিষ্ণু, যাঁর সাথে আমাদের কোনও শত্রুতা নেই, কেন যুদ্ধ করবেন বুঝলাম না। তবে আমরাও ত্রিলোকে অপরাজেয়। বিষ্ণু কিছু করার আগেই চল আমরা ঐ দেবতাদের নাশ করে আসি। এই বলে তাঁরা দেবতাদের সাথে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। দেবতারা ত্রাহি ত্রাহি করছেন, এমন সময়ে গরুড়ে আরোহণ করে নারায়ণ স্বয়ং অবতীর্ণ হলেন রণক্ষেত্রে । বেশ কয়েকদিনের ভয়ঙ্কর যুদ্ধের পর বিষ্ণুর সুদর্শনে মালীর মাথা স্কন্ধচ্যুত হয় । তখন অন্য দুই ভাই সভয়ে লঙ্কায় পালিয়ে আসেন। কিন্তু বিষ্ণু গরুড়ারোহণে সেখানেও তাদের পশ্চাত-ধাবন করেন। আরও কয়েকমাসের ভয়াবহ যুদ্ধের শেষে মাল্যবান লঙ্কার দুর্গম প্রাসাদে ও সুমালী সসৈন্যে পাতাল রাজ্যে আত্মগোপন করে রক্ষালাভ করেন।
- কি অদ্ভুত এই কাহিনী পিতঃ, সীতা বলেন। নাঃ, আজ আপনার সন্ধ্যাহ্নিকের সময় হল, কাল সবটুকু শুনিয়ে তবে আপনার বিশ্রাম।
- বৎসে, ঋষি স্মিতহাস্যে বললেন, এই রামায়ণের কোনও বিতর্কিত অংশই তোমার অনুমোদন ব্যতিরেকে আমি জনসমক্ষে প্রচার করব না, এরূপ মনস্থ করেছি, তাই তুমি বললেও আমার পরিত্রাণ নেই।    

(৬)

পরদিন প্রত্যুষে আশ্রমবালকেরা বিদায় নিতেই ঋষি বাল্মীকি ডেকে পাঠালেন লব-কুশ ও জানকীকে ও শুরু করলেন তাঁর অসমাপ্ত উপাখ্যান।
- বিষ্ণুর ভয়ে সুমালী অবশ্য বেশীদিন রসাতলে লুকিয়ে থাকতে পারলেন না। তাঁর কনিষ্ঠা কন্যা কৈকসী তখনও অনূঢ়া। সুমালী তাকে নিয়েই মনুষ্যলোকে দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। একদিন অকস্মাৎ তিনি পুষ্পক-বিমানে অধিষ্ঠিত যক্ষরাজ কুবেরকে যাত্রা করতে দেখলেন। তিনি চলেছিলেন তাঁর পিতা পুলস্ত্য-সুত বিশ্রবা মুনির সাথে সাক্ষাৎ করতে। দেবতাদের ন্যায় রূপবান ও সুর্যের সমান তেজস্বী কুবেরকে দেখে তাঁর মনে হল যে কি এমন কর্ম করা যায় যাতে এরূপ তেজস্বী পুরুষ রাক্ষসবংশেও জন্মাতে পারে। তিনি কৈকসীকে ডেকে বললেন, মা, তোমাকে এই অসাধ্যসাধন করতে হবে। স্বয়ং ব্রহ্মার পুত্র পুলস্ত্যর সন্তান ঋষি বিশ্রবা, তাঁকে তুমি নিজে গিয়ে পতিরূপে কামনা কর। আমি নিশ্চিত, তোমাদের পুত্র যে হবে তার তেজে কুবেরের গৌরবও ম্লান হয়ে যাবে।
- পিতঃ, আমি যে এখনও আঁধারেই আছি। ঋষি বিশ্রবার সম্বন্ধে কিছু জানাবেন না? সীতা বলে উঠলেন।
- ওহো বৎসে, তাই তো, একেই বোধহয় বলে,’মুনীনাঞ্চ মতিভ্রমঃ’। তাহলে শোনো। সত্যযুগে পুলস্ত্য নামে প্রজাপতি ব্রহ্মার এক সন্তান ছিলেন। তিনি মহাজ্ঞানী, মধুর স্বভাব এবং সর্ব-গুণের অধিকারী ছিলেন। আজীবন ব্রহ্মচর্যের পালনকারী এই ঋষি তপস্যার জন্যে সুমেরু পর্বতের উপত্যকায় রাজা তৃণবিন্দুর আশ্রমে গিয়ে থাকতে লাগলেন। সেই স্থান আবার এত সুন্দর আর নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার ফলে এত মনোরম ছিল যে সেখানে চিরবসন্ত বিরাজ করত এবং ঋষি, নাগ ও রাজকন্যারা সম্বৎসর সেখানে খেলা করে বেড়াতেন, পুলস্ত্যের তপেরও তাতে বিঘ্ন ঘটত। একদিন তিনি অঙ্গনাদের উদ্দেশ্য করে ক্রোধবশে বললেন, তাঁর দৃষ্টির সম্মুখে যে নারী আসবে, সেই গর্ভবতী হয়ে যাবে। তাতে বেশ কাজ হল। মেয়েদের আসা-যাওয়া বন্ধ হল, ঋষিরও সাধনা নির্বিঘ্নে চলতে থাকল।
ইতিমধ্যে একদিন তৃণবিন্দুর সুন্দরী কুমারী কন্যা আশ্রমে এসেছেন। তিনি শাপের কথা না জেনে মুনির দৃষ্টিগোচর হওয়ামাত্র তাঁর শরীরে গর্ভলক্ষণ প্রকট হল। রাজা তৃণবিন্দু পড়লেন বিপদে। শেষে তাঁর প্রার্থনায় ঋষি পুলস্ত্য কন্যাটিকে সমাজ ও লোকলজ্জার কথা ভেবে বিবাহ করলেন ও অচিরে তাঁদের বিশ্রবা নামে পুত্রের জন্ম হল। অনতিকাল মধ্যেই মহাতপস্বীরূপে বিশ্রবা পরিচিত হলেন ও ঋষিশ্রেষ্ঠ ভরদ্বাজ তাঁর কন্যা দেববর্ণিনীকে তাঁর হস্তে সমর্পণ করলেন।
এই বিশ্রবার ঔরসে ও দেববর্ণিনীর গর্ভে জন্ম হয় কুবেরের। তিনি যৌবনে কঠিন তপস্যা করেন যার ফলে ব্রহ্মা স্বয়ং তাঁর কাছে আসেন । ব্রহ্মার বরে কুবের চতুর্থ লোকপাল নিযুক্ত হন ও তাঁর কাছে থাকে স্বর্গের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব। সাথে তাঁকে ‘পুষ্পক’ নামে একটি অশেষগুণসম্পন্ন স্বয়ংক্রিয় আকাশযানও উপহার দেওয়া হয়।
- পিতঃ, এই লোকপাল কি বস্তু? সীতা প্রশ্ন করেন।
- বৎসে, এ এক বিতর্কের সৃষ্টি করলে তুমি । ‘লোক’ বলতে আমরা বুঝি ধরাতল ও তদূর্ধ্বে সাতটি ও নিম্নে পাতালের সাতটি মিলিয়ে চতুর্দশ । আবার ‘দিক’ বলতে বোঝায় পূর্ব-পশ্চিমাদি দশটি । শাস্ত্রের বর্ণনানুসারে পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণে অধিষ্ঠিত হয়ে যাঁরা এই চতুর্দশ-ভুবন শাসন ও নিরীক্ষণ করতেন সেই তিন দিক্‌পাল ছিলেন যথাক্রমে ইন্দ্র, বরুণ ও যম। কিন্তু তাঁরা লোকপাল নামেই পরিচিত হতেন। এখন উত্তরের জন্য ব্রহ্মা কুবেরকে চতুর্থ লোকপাল নিযুক্ত করলেন ও সেইসাথে তাঁকে দিলেন যাবতীয় ধনের দায়িত্ব। ততদিনে বিষ্ণুর ভয়ে মাল্যবানও লঙ্কাপুরী থেকে পাতালে পালিয়ে সুমালীর সাথে যোগ দিয়েছেন। তাই পিতার নির্দেশে দক্ষিণ সাগরতীরে পর্বতশৃঙ্গে অবস্থিত সেই পরিত্যক্ত বিশাল পুরীর মাঝে ধনলোকপাল বৈশ্রবণ কুবের বিরাজিত হলেন। প্রায় সহস্র রাক্ষস তখনও সেখানে বাস করতেন। তাঁরা নূতন শাসকের আগমনে সভয়ে পালাচ্ছিল, কুবের তারের অভয়দানপূর্বক সেখানেই থেকে যেতে অনুরোধ করলেন । ক্রমে আরও কিছু পলাতক রাক্ষস সেখানে ফিরে এলো ও কুবেরের সুশাসনে সুখে বাস করতে লাগলো। তা, মা সীতে, এই হল পুলস্ত্য-বিশ্রবা-কুবের বৃত্তান্ত। ঐ দেখ বালকেরা পেটে হাত বুলোচ্ছে । এখন তোমার প্রাথমিক কর্তব্য তোমার নিজের ও অসমবয়সী তিনটি সন্তানের ক্ষুন্নিবৃত্তি।
ইশারা বুঝে স্মিত হেসে জানকী উঠলেন, লব-কুশ মায়ের পিছু নিল।

(৭)

বেলা তৃতীয় প্রহরে সীতাকে একা দ্রুত পদচারণায় আসতে দেখে ঋষি বাল্মীকি একটু অবাক হয়ে বললেন, কি সংবাদ বৎসে, পুত্রেরা কোথায়? আজ রাবণের উপাখ্যান শোনাব বলে বসে আছি, তাদেরই তো বেশী আগ্রহ থাকার কথা এ বিষয়ে!
- না তাতঃ, সীতা বললেন, আমার কিছু প্রশ্ন ছিল রাবণ ও ইন্দ্রজিতকে নিয়ে যা হয়ত লব-কুশের পক্ষে না শোনাই ভাল। গল্পটা তো তারা জানেই, বাকীটুকু আমি পরে তাদের বুঝিয়ে বলে দেব।
- তথাস্তু। তাহলে রাবণের বৃত্তান্তে আসি আগে, পরে তোমার কৌতূহলের আবসান ঘটানো যাবে। হ্যাঁ, সুমালী আর তাঁর কন্যা কৈকসীর কথা আজ সকালে শুরু করেছিলাম, সেখানেই আমাদের এখন ফিরতে হবে। সুমালী বললেন, বৎসে কৈকসী, আমি নিশ্চিত, বিশ্রবা মুনি যদি তোমাকে পত্নীরূপে গ্রহণ করেন, তোমাদের ভাবী পুত্র রূপে-গুণে-শৌর্যে-বীর্যে নিঃসন্দেহে কুবেরকে অতিক্রম করবে। ঋষি বিশ্রবা কখনও কাউকে বিমুখ করেন না, তাই আমার ইচ্ছা, তুমি স্বয়ং তাঁকে আত্মনিবেদন কর।
ঋষি বিশ্রবা তখন সায়ংকালীন অগ্নিহোত্রে মগ্ন, কৈকসী তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে আত্মপরিচয় দিলেন। ঋষি ধ্যানযোগে সবই জানতে পারলেন। তিনি বললেন, ভদ্রে, তুমি যা চাও তা পাবে, আমি তোমাকে গ্রহণ করব। কিন্তু তুমি এক দারুণ দুঃসময়ে এসেছ। এর ফলে তোমার গর্ভে যে সন্তানেরা আসবে তারাও তদনুরূপ হবে, সে ফলাফলের জন্যে প্রস্তুত থাকো।
ফলে ঋষির ঔরসে জন্ম হলেও তাঁদের জ্যেষ্ঠপুত্র রাবণ ভীষণাকৃতি রাক্ষসরূপে জন্ম নিল। তার দশ মুন্ড ও দ্বাবিংশ সংখ্যক হাত থাকায় দশগ্রীব নামে তার পরিচয় হল। তার জন্মের সময় রাক্ষস-পিশাচ-অসুর ও দানবকুল উল্লাস করে উঠল, দেবতারা রক্তবৃষ্টি করলেন পৃথিবীতে । ভয়ংকর ধূলিঝড়ে দিবাকর প্রচ্ছন্ন হলেন ও প্রলয়ংকর ভূমিকম্প হতে লাগল। কৈকসীর  মধ্যম-পুত্র কুম্ভকর্ণ ও কন্যা সুর্পণখাও মাতৃকুলের অনুরূপ হয়ে জন্ম নিল, রাক্ষসরূপে। তখন কৈকসী কেঁদে বিশ্রবাকে বললেন, দেব, আপনার মত ব্রহ্মজ্ঞানীর ঔরসে পরপর রাক্ষস-সন্তান শোভা পায় না। তখন ঋষি বললেন, ঠিক বলেছ, অশুভকাল অতিক্রান্ত, তোমার কনিষ্ঠ সন্তান পরম ধার্মিকরূপে জগতে খ্যাত হবে। অতঃপর জন্ম হয় ধর্মাত্মা বিভীষণের, যাঁর জন্মকালে শঙ্খধ্বনি হয় ও দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করেন।

- পিতঃ, এই রাবণের দশমুণ্ড ও বিশহস্ত আমি শুনেই এসেছি, সীতা বললেন, কিন্তু দণ্ডকারণ্যে হরণকাল থেকে অসংখ্যবার তিনি আমার সমীপে এসেছেন, আমি তো একমুণ্ড ও দুইবাহুই দেখে এসেছি। তবে শুনেছি যুদ্ধকালে তিনি কিছু কৃত্রিম মুণ্ড ও হস্ত ধারণ করতেন শত্রুকে ছলনা করার জন্যে, কথাটা কি ঠিক?
- এ বিষয়ে আমিও কোনও ব্যুৎপত্তি পাই নি, বৎসে, তবে তুমি যা বলছ তাই হয়ত ঠিক। একত্রে দশমুণ্ড দেখে শত্রু বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে, কোনটি প্রকৃত বুঝতে না পেরে বারংবার কৃত্রিম মস্তক কেটে ফেলবে, পরমুহূর্তেই যা আবার সহজেই সংযোজিত হয়ে যাবে। হয় তাঁর বাকী অষ্টাদশ হাত কৃত্রিম বা হয়ত তিনি এত দ্রুত শরসন্ধান ও অস্ত্রক্ষেপণ করতে পারতেন, যে তাঁর অসংখ্য হাত আছে এরূপ প্রতীত হত । যাইহোক, অতিশয়োক্তি হলেও রূপকার্থে আমি এরূপ দেখিয়ে হয়ত ভুল কিছু করিনি। কিন্তু এই কি তোমার সেই বিতর্কিত প্রশ্ন যার ভয়ে তুমি একাই এলে আজ এখানে? মনে তো হয় না!
-আপনার সন্দেহ অমূলক নয়। আমার প্রশ্ন অন্যত্র। আপনি রামের চরিত্রচিত্রনে কোনও ত্রুটি রাখেন নি। কিন্তু তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর এবং সমদর্শী নামে প্রসিদ্ধ হলেও অন্যের প্রশংসা শুনে তাঁকে মাঝে মাঝে ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়তে দেখেছি, এমনকি সে প্রশংসা তাঁর ভাইদের হলেও। বনবাস শেষে অযোধ্যা ফেরার পর পূজ্য ঋষিগণ ইন্দ্রজিৎকে রাবণ অপেক্ষাও অধিক পরাক্রমশালী বলায় তিনি তা ঠিক সহ্য করতে পারেননি, কারণ ইন্দ্রজিৎ লক্ষ্মণ দ্বারা নিহত হয়েছিল। আপনি শ্রীরামের মুখে নানা অলংকারশোভিত বাক্যবিন্যাস বসিয়ে তা ঢাকার চেষ্টা করেছেন এক্ষেত্রে, এতে কি সত্যের অপলাপ হয় নি? অপরাধ নেবেন না, আমি আপনার মূর্খ সন্তান, আরো বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এরকম জোড়াতালি দেওয়া হয়েছে, আমি লক্ষ্য করেছি।
- হুঁ, তোমার কথা বিবেচনা না করে উপায় নেই। তবে সে কথায় পরে আসছি। রাবণদের তিন ভাইএর তপস্যার প্রসঙ্গটা আগে শেষ করে নিই। কথিত আছে তাঁরা সহস্রাধিক বৎসর ধরে তপস্যা করেন ও ব্রহ্মা তাঁদের তপস্যায় তুষ্ট হয়ে বর দিতে চাইলে রাবণ ব্রহ্মাকে বলেন-
“ভগবন্‌ প্রাণীনাং নিত্যং নান্যত্র মরণদ্বয়ম্‌।
নাস্তি মৃত্যুসমঃ শত্রুঃ অমরত্বমহং তৃণং।।“
- অর্থাৎ প্রাণীদের মৃত্যুভয় সর্বদা যেরূপ উদ্বিগ্ন করে তোলে তা অদ্বিতীয়, মৃত্যুর ন্যায় অন্য শত্রু নাই, অতএব হে দেব, আমি অমরত্ব চাই।
কিন্তু ব্রহ্মা তাঁকে বললেন পূর্ণ অমরত্ব চেয়ে পাওয়ার বস্তু নয়, অন্য কিছু চাও। তখন রাবণ বললেন-
“সুপর্ণনাগযক্ষাণাং দৈত্যদানবঃরক্ষসাম।
অবধ্যোহং প্রজাধ্যক্ষ দেবতানাং চ শাশ্বতঃ।।“
অর্থাৎ, হে প্রজাপতি, গরুড়, সর্প, যক্ষ, দৈত্য-দানব ও দেবতা দ্বারা আমাকে অবধ্য থাকার বর দিন। মানুষ ও অন্য প্রাণীদের তো আমি তৃণবৎ জ্ঞান করি। ব্রহ্মা বললেন তথাস্তু। তারপর তিনি গেলেন বিভীষণের কাছে। বিভীষণ দুটি বর চাইলেন- দারুণ বিপত্তিকালেও যেন তিনি ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট না হন এবং প্রয়োজনে বিনা শিক্ষায় যেন ব্রহ্মাস্ত্রেরও প্রয়োগ করতে পারেন। ব্রহ্মা অত্যন্ত খুশী হয়ে তাঁকে বলেন, বৎস, রাক্ষসকুলে জন্মেও তুমি যে ধর্মনিষ্ঠতার পরিচয় দিয়েছ, তা অতুলনীয়। আমার বরে তুমি চিরকাল অমর হয়ে ধর্মপালন ও ভূ-সম্পদের রক্ষা করবে।

এইবার ব্রহ্মা তপোরত কুম্ভকর্ণের দিকে এগোতেই দেবতারা বিপদ গণলেন। কুম্ভকর্ণ বিশালবপু ও অসীম বলশালী, এরপর ব্রহ্মার বর পেলে সে একাই সমস্ত সৃষ্টি ছারখার করে দিতে পারে। তাঁদের অনুরোধে দেবী সরস্বতী তখন তাঁর জিহবায় অধিষ্ঠান করেন। ব্রহ্মা যখন বলেন, বৎস বর চাও, তাঁর হয়ে সরস্বতী বলেন, আমি যেন বর্ষাধিকাল ধরে নিদ্রিত থাকি। ব্রহ্মা খুশী হয়ে বলেন, বেশ, তাই হোক।  

(৮)

কৈকসীর পুত্রদের ব্রহ্মার থেকে বরপ্রাপ্তির বিষয়টি শুনে আনন্দে পাতালদেশ থেকে ছুটে এলেন মাতামহ সুমালী তাঁর পুত্র-অমাত্যদের নিয়ে। এতদিনে বুঝি দেবতাদের ভয়ে লুকিয়ে থাকার দিন শেষ হল। তিনি উৎফুল্ল হয়ে রাবণকে রাক্ষসজাতির অধিপতি ঘোষণা করে কুবেরের হাত থেকে লঙ্কাপুরীর অধিকার ফিরিয়ে নিতে উৎসাহিত করলেন। তাঁর কথায় প্রভাবিত হয়ে রাবণ দূতরূপে জ্যেষ্ঠ মাতুল ও সুমালীর প্রধানামাত্য প্রহস্তকে পাঠালেন লঙ্কায় কুবেরের কাছে। তিনি কুবেরকে অনুরোধ করলেন লঙ্কাপুরী দশগ্রীব রাবণের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য, কেননা এ পুরীর মূল অধিকারী রাক্ষসেরা। কুবেরের আপত্তি ছিল না, তবু তিনি গেলেন পিতার সাথে পরামর্শ করতে। বিশ্রবা বললেন, ব্রহ্মার বরে গর্বিত উদ্ধত দশানন এ নিয়ে তাঁর কাছেও অনুযোগ করায় তিনি তাকে ধবংস হওয়ার শাপ দিয়েছেন, এখন আর এ নিয়ে কথা না বাড়ানোই ভাল। অতএব কুবের লঙ্কা রাবণকে হস্তান্তর করে রাজ্যপাট তুলে নিয়ে চলে গেলেন কৈলাসে, মন্দাকিনীর তীরে নবনগরী অলকাপুরী নির্মাণ করে বসবাস করতে লাগলেন। এদিকে রাবণ স্বর্ণপুরী লঙ্কায় রাক্ষসজাতির অধিপতিরূপে বিরাজিত হলেন।
ইতিমধ্যে তিনি ভগ্নী সুর্পনখার বিবাহ দিয়েছেন বিদ্যুৎজিহ্ব নামে রাক্ষসের সাথে। তারপর একদিন তাঁর আলাপ হল দিতিপুত্র স্থপতি ময়দানবের সাথে। তাঁর সঙ্গে ছিল তাঁর ও হেমা নামে অপ্সরার কন্যা মন্দোদরী। তাঁর অনুরোধে রাবণ মন্দোদরীর পাণিগ্রহণ করলেন। তারপর লঙ্কায় ফিরে এসে দৈত্যরাজ বলির দৌহিত্র ও বৈরোচনের পৌত্র বজ্রজ্বালার সাথে কুম্ভকর্ণের ও গন্ধর্বরাজ শৈলুষের কন্যা সরমার সাথে বিভীষণের বিবাহ করান। তারপর একদিন মেঘবৎ গর্জন করে রাবণ-পুত্রের জন্ম হল। প্রভূত আদরের সাথে রাক্ষসরাজপুত্রের নাম রাখা হল মেঘনাদ। এই পুত্রই বয়ঃকালে ইন্দ্রকে পরাজিত করে ইন্দ্রজিৎ নাম অর্জন করেন।
ইতিমধ্যে সীতাকে হাসতে দেখে ঋষি তার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। তিনি বলেন, পিতঃ, সরমাদিদি একদিন কথায় কথায় তাঁর জন্মের গল্প বলছিলেন। তিনি গন্ধর্বরাজকন্যা, জন্ম হয় মানস সরোবরের তীরে। জানেন তাঁর জন্মের সময় হঠাৎ সরোবরের জল বাড়তে থাকায় তাঁর মা ধমক দেন- ‘সরো মা বর্ধত’, তার থেকে তাঁর নামকরণ হয় ‘সরমা’।
- বাঃ মজার গল্প তো। ঠিক আছে, এটাও রামায়ণের অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া যাবে, বাল্মীকি বললেন। তাহলে মা, এরপর রাবণ তো অসীম বলবীর্য লাভ করে স্বর্গমর্ত্য দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন। তখন তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা ধনপতি কুবের দূত পাঠিয়ে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়। দূতকে তৎক্ষণাৎ বধ করে রাবণ মনস্থ করেন চার দিকপালকে পরাজিত করে তিনি একা ত্রিলোকের অধীশ্বর হবেন। প্রথমে তিনি কুবেরের যক্ষালয়ে সসৈন্য উপস্থিত হলেন। যক্ষদের বলও কিছু কম ছিল না। বিশেষতঃ কুবেরের কাছে ছিল বিশ্বকর্মারচিত দিব্য বিমান পুষ্পক। কিন্তু ব্রহ্মার বরে বলীয়ান রাবণ বহুবর্ষব্যাপী যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত কুবেরকে পরাজিত করে তাঁর অগাধ ধনসম্পত্তি ও পুষ্পকবিমানটি লুন্ঠন করে নেন।
- এদিকে রাবণ ফেরার পথে এক মনোরম স্বর্ণের শরবন মুগ্ধ হয়ে দেখছেন, হঠাৎ পুষ্পক সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে। এক দৈত্যাকার বানরের মত মুখবিশিষ্ট জীব এসে নন্দী নামে পরিচয় দিয়ে তাঁকে সেই মুহূর্তে সেখান থেকে চলে যেতে বলেন, বলেন হরপার্বতী সেখানে ক্রীড়ারত। বানরসদৃশ মুখ দেখে রাবণ তাঁকে উপহাস করায় নন্দী ক্রোধভরে অভিশাপ দেন, রে রাক্ষস, এই বানরেরাই এককালে তোর সবংশে মৃত্যুর কারণ হবে। রাবণ তাঁর শাপে বিচলিত না হয়ে ক্রোধে বললেন, এই পর্বত আমার বিমানের গতি রোধ করেছে, আমি একে উৎপাটিত করব। এই বলে তিনি কৈলাশ পর্বতের মূল ধরে কিছুটা ওঠাতেই শিব তা বুঝতে পেরে পায়ের অঙ্গুষ্ঠের চাপে সেটিকে আবার বসিয়ে দেন, সেই সাথে চাপা পড়ে যায় রাবণের সবকটি আঙ্গুলও। রাবণ ত্রিলোকবিদারী চিৎকার করে ওঠেন ও শিবকে সন্তুষ্ট করার মন্ত্র জপ করতে থাকেন। শিব শেষে তুষ্ট হয়ে পা সরিয়ে নেন ও বলেন, দশানন, যে অভ্রভেদী রব তুমি তুলেছ, তাতে ত্রিভুবন চকিত হয়ে গেছে, আজ থেকে  লোকে তোমাকে রাবণ বলেই জানবে। এছাড়া তিনি তাঁকে চন্দ্রহাস নামে এক দিব্য তরবারিও দান করেন। জনশ্রুতি আছে যে হিমালয়েরই এক অরণ্যে রাবণ একদিন দেখেন ব্রহ্মর্ষি কুশধ্বজের কন্যা বেদবতীকে, যিনি ভগবান বিষ্ণুকে লাভ করার জন্যে গভীর কৃচ্ছ্রসাধন ও তপস্যায় রত ছিলেন। কামোন্মত্ত রাবণের হাত থেকে রক্ষা পেতে তিনি অগ্নিতে প্রাণাহুতি দেন ও রাবণকে শাপ দিয়ে যান পরজন্মে তিনি অযোনিজন্মে রাবণের মৃত্যুর কারণ হবেন। যদি এ উপাখ্যান সত্য হয় তবে পরিস্থিতি অনুযায়ী তুমিই সেই বেদবতী মা সীতা, তুমি ধরিত্রীকন্যা, এ জন্মে বিষ্ণুসদৃশ রামকে লাভ করেছ ও রাবণের বধের কারণও হয়েছ।
- কি জানি দেব, একে লাভ করা বলে কিনা। তবে যে কটা দিন তাঁর সাথে কাটিয়েছি, তা স্বর্গের থেকে কম কিছু ছিল না, সীতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন।

(ক্রমশঃ)


লেখক পরিচিতি - জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিহার (অধুনা ঝাড়খন্ডের) ধানবাদ কয়লাখনি ও শিল্পাঞ্চলে, সেখানে 'নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধান' হলেও বাংলা ও বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল একসময়। ১৯৮২ সালে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে পেট্রোলিয়াম লাইনে চাকুরী, বর্তমানে কুয়েত অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত। শখ-গান-বাজনা আর একটু-আধটু বাংলাতে লেখালেখি। কিছু লেখা ওয়েব ম্যাগাজিনে (ইচ্ছামতী, আদরের নৌকো ও অবসর) প্রকাশিত ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।