ছবিতে
কামারপুকুর ও জয়রামবাটি (আগে
যা প্রকাশিত হয়েছে)
২৬.
শ্রীশ্রীমা ও ডাকাতবাবা
শ্রীশ্রীমা
একবার জয়রামবাটি থেকে দক্ষিণেশ্বরে যাবার
পথে ডাকাতের হাতে পড়েছিলেন। এ ঘটনার বিবরণ
যেমন রোমাঞ্চকর তেমনি কৌতূহলোদ্দীপক। ঘটনাটি
সংক্ষেপে এই রকম:
একবার কোন এক উৎসব উপলক্ষ্যে কয়েকজন যাত্রী
গঙ্গাস্নান করার উদ্দেশ্যে কামারপুকুর থেকে
কলকাতার পথে যাত্রা করেন। শ্রীমাও তাঁর
ভাসুরপো ( শিবরাম ) এবং ভাসুরজীকে ( লক্ষীমণিদেবী
) সঙ্গে নিয়ে তাদের সঙ্গী হন। শ্রীমার উদ্দেশ্য
ছিলে কলকাতায় গিয়ে তিনি দক্ষিণেশ্বরে যাবেন
এবং সেখানেই থেকে যাবেন। তখন পায়ে হেঁটেই
সকলে যেত। কামারপুকুর থেকে যাত্রা করে আট
মাইল দূরে আরামবাগে তারা দুপুরের মধ্যেই
পৌঁছে যান। এর পরেই বিখ্যাত তেলোভেলোর মাঠ।
জায়গাটি ডাকাতদের আড্ডা বলে কুখ্যাত। এ
পথে সকলে দল বেঁধে যেতেই চেষ্টা করত। আরামবাগে
পৌঁছে যেহেতু হাতে অনেক সময় ছিল, তাই সকলে
স্থির করেন তারা তখনই রওনা হয়ে দিনের আলো
থাকতেই তেলোভেলোর মাঠটি ছাড়িয়ে যাবেন। শ্রীমা
নিজের অসুবিধা হবে জেনেও সকলের চলার পথে
বাধা সৃষ্টি করতে চাইলেন না। এগিয়ে যাওয়াই
ঠিক হল। শ্রীমা কিছুক্ষণ পরেই পিছিয়ে পড়তে
শুরু করেন এবং সঙ্গীদের দেরী হয়ে যাবে বলে
মা তাদের এগিয়ে যেতে বলেন। তারা দ্রুতপায়ে
চলে মাকে ফেলে চলে যান। শ্রীমা একা চলতে
থাকেন। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। কিছু
পরে কোঁকড়া চুল ও কালো চেহারার একজন লম্বা
লোক লাঠি কাঁধে করে শ্রীমার সামনে এসে হাজির
হয় এবং কর্কশ গলায় মা কোথায় যাচ্ছেন জানতে
চায়। কিন্তু হঠাৎ লোকটা হাঁ করে মার দিকে
তাকিয়ে থাকে এবং খুব নরম সুরে বলে, "ভয়
নেই। আমার সঙ্গে একজন মহিলা আছে। সে পিছিয়ে
পড়েছে। এখনই চলে আসবে।" মহিলাটি এলে
মা বললেন, "আমি তোমাদের মেয়ে। তোমাদের
জামাই দক্ষিণেশ্বরে থাকে। তোমরা আমাকে তার
কাছে পৌঁছে দেও।" সেই সরল প্রাণের
একান্ত নির্ভরতা দস্যুদম্পতির মন ছুঁয়ে
গেল। তারা শ্রীমাকে সে রাতের মত তাদের আশ্রয়ে
নিয়ে রাখে এবং পরদিন সকালে বাগদিনী তার
স্বামীকে বাজারে গিয়ে মাছ ও সব্জী আনতে
বলে। রান্না করে মাকে খাইয়ে তারা যখন তৈরী
তখন শ্রীমায়ের সঙ্গীরা মাকে খুঁজতে খুঁজতে
সেখানে এসে হাজির হন। সেই ডাকাতবাবা ও ডাকাত
মা শ্রীমার সঙ্গে তারকেশ্বরের পথে অনেক
দূর অবধি যায় এবং মাঠ থেকে কড়াইশুঁটি তুলে
বাগদিনী কাতর গলায় বলে, "মা সারদা,
রাত্রে যখন মুড়ি খাবি তখন এগুলো দিয়ে খাস।"
পরে শ্রীমাকে অনেকে সেই রাত্রে ডাকাতের
হঠাৎ মনের পরিবর্তন সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলেন।
শ্রীআশুতোষ মিত্র প্রণীত 'শ্রীমা' গ্রন্থে
ডাকাতের ঘটনা এইভাবে লেখা হয়েছে - শ্রীমা
বলিতেছেন, "লোকটা জাতে বাগদী, ডাকাতের
মতো রুক্ষ গলায় জিজ্ঞাসা করলে,'তুই কে ?'
আর আমার পানে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।"
যাঁহার সহিত শ্রীমায়ের কথা হইতেছিল, সেই
ভক্ত মায়ের কথা শুনিয়া জানিতে চাহিলেন,
"ডাকাত আপনার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে
কি দেখছিল ?" শ্রীমা -" পরে বলেছিল,
কালীরূপে না কি দেখেছিল।" ভক্ত - "তাহলে
আপনি কালীরূপে তাকে দেখা দিয়েছিলেন ? লুকোবেন
না, মা, বলুন।" শ্রীমা - "আমি
কেন দেখাতে যাব। সে বললে, সে দেখেছে।"
ভক্ত - "তা হলেই হল - আপনি দেখিয়েছিলেন।"
শ্রীমা (সহাস্যে) - "তা তুমি যাই বল
না কেন ?"
এই
ডাকাতের নাম সাগর সাঁতরা এবং তার স্ত্রী
মাতঙ্গিনী। এই ঘটনার পরে সাগর আর কখনও ডাকাতি
করে নি। পরে তারা কয়েকবারই দক্ষিণেশ্বরে
গিয়েছে এবং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের আশীর্বাদ
লাভ করে ধন্য হয়েছে। তাদের দুই ছেলে বিহারী
ও মেহারী শ্রীমায়ের কাছে মন্ত্রদীক্ষা লাভ
করে। ১৯১০ সালের এপ্রিল মাসে সাগর সাঁতরা
বেল গাছ থেক্লে পড়ে মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে
মারা যায়। তেলুয়া ও ভালিয়া ( সংক্ষেপে তেলো
ও ভেলো ) দুটি পাশাপাশি গ্রাম। দুই গ্রামের
মধ্যবর্তী মাঠই তেলোভেলোর মাঠ। এখানে আসতে
হলে বাসে করে ভালিয়া বাস স্টপে নামতে হয়।
ভালিয়ার পাশ দিয়েই বাস রাস্তা গিয়েছে। এখানেই
ডাকাত কালীর মন্দির। মন্দিরটি কিন্তু ডাকাতদের
দ্বারা নির্মিত নয়। আনুমানিক ১৭০০ শকাব্দে
তান্ত্রিক রমাকান্ত সরকার এটি নির্মান করেন}
এখানেই পুজো দিয়ে ডাকাতরা ডাকাতি করতে যেত।
মন্দিরের পাশেই একটা বড় মাঠ ও কয়েকটি প্রাচীন
বট ও অশ্বত্থ গাছ রয়েছে। এই মাঠটিই তেলোভেলোর
মাঠ।
ভালিয়া
বাসস্টপের পাশেই শ্রীশ্রীসারদামাতার মন্দির।
১৯৬১ খৃষ্টাব্দের ১৮ই মার্চ বেলুড় মঠের
তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক স্বামী বীরেশ্বরানন্দ
মহারাজ মন্দিরটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন
করেন। মন্দিরের পাশের একটি ঘরে একটি ডাকাতের
প্রতীকী মূর্তী তৈরী করা হয়েছে। ভালিয়া
গ্রাম থেকে আনুমানিক ১ মাইল দূরে তেলুয়া
গ্রাম। এই দুই গ্রামের যোগাযোগকারী রাস্তাটি
খুবই প্রাচীন। এই রাস্তা দিয়ে চলার সময়েই
শ্রীমা ডাকাতের হাতে পড়েছিলেন।
তেলুয়া
গ্রামে একটি রক্ষাকালীর মন্দির আছে। জয়রামবাটি
শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ
স্বামী শিবরূপানন্দজী মহারাজ ২০০৮ সালের
১৮ই জুন মন্দিরটির দ্বারোদঘাটন করেন। কাছেই
তেলোর চটিতে ডাকাত সাগর সাঁতরা ও স্ত্রী
মাতঙ্গিনী শ্রীমাকে যেখানে সেই রাত্রে আশ্রয়
দিয়েছিল, সেখানে গ্রামবাসীদের উৎসাহে ও
জয়রামবাটির মাতৃমন্দিরের প্রাক্তন অধ্যক্ষ
স্বামী পরমেশ্বরানন্দজীর ( কিশোর মহারাজ
) প্রচেষ্টায় ১৯৭২ খৃষ্টাব্দের ১৭ই মে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ
সারদা মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।
১৯৭৭ সালের ৩রা মে জয়রামবাটি মাতৃমন্দিরের
অধ্যক্ষ স্বামী গৌরীশ্বরানন্দজী মহারাজ
মন্দিরটির দ্বারোদঘাটন করেন এবং পরমেশ্বরানন্দ
মহারাজ মূর্তী প্রতিষ্ঠা করেন। পাশেই তেলোভেলোর
চটিতে রামকৃষ্ণ সারদা সেবাশ্রমটি ১৯৬৫ সালের
১৪ই মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
৭৬
নং চিত্র
৭৭
নং চিত্র
৭৮
নং চিত্র
৭৯
নং চিত্র
৭৬
নং চিত্রে তেলোভেলোর মাঠ ও কয়েকটি বহু প্রাচীন
গাছ দেখা যাচ্ছে। ৭৭ নং চিত্রে মাতৃমন্দির
সংলগ্ন একটি প্রাচীন বটগাছ। ৭৮ নং চিত্রে
ভালিয়ায় মাতৃমন্দির এবং বর্তমান পূজারী
সনৎ কুমার চক্রবর্তীকে দেখা যাচ্ছে। ৭৯
নং ছবিটি মাতৃমন্দির সংলগ্ন কক্ষে একটি
ডাকাতের প্রতীকী মূর্তী।
৮০
নং চিত্র
৮১
নং চিত্র
৮২
নং চিত্র
৮৩
নং চিত্র
৮৪
নং চিত্র
৮৫
নং চিত্র (ছবির লেখাগুলো পড়তে চাইলে ছবিতে
ক্লিক করুন)
৮০
নং চিত্রের মন্দিরটিই ডাকাত কালীর মন্দির।
মন্দিরের পূজারী পূজা সেরে বেড়িয়ে আসছেন।
পাশে তেলোভেলোর মাঠ। ৮১নং চিত্রের রাস্তাটিই
ভালিয়া থেকে তেলুয়া গ্রামের দিকে গিয়েছে
এবং এই রাস্তাতেই শ্রীমা ডাকাতের হাতে পড়েন।
ভালিয়া থেকে তেলুয়া যাবার পথের পাশে একটি
সর্ষেক্ষেত ৮২ নং চিত্রে দেখা যাচ্ছে। ৮৩
নং ছবিটি তেলুয়া গ্রামের রক্ষাকালীর মন্দির।
৮৪নং ছবিটি তেলোভেলোর চটিতে রামকৃষ্ণ সারদা
সেবাশ্রম ও ৮৫ নং ছবিতে দেখা যাচ্ছে তেলোভেলোর
চটিতে রামকৃষ্ণ সারদা মন্দির।