প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ফুলের উপত্যকা (ভ্যালি অব্‌ ফ্লাওয়ার্স)

-১-

হিমালয়ের গহনে অনেক উপত্যকা ও অধিত্যকা আছে, যেখানে বরফ গলে গেলেই বছরে কয়েকমাস ঘাসে ভরে যায় এবং ফুলে ফুলে ছেয়ে যায়। তার পর আবার বরফে ঢেকে যায় এবং তা গলে যাবার পর আবার ঘাস ও ফুলে ভরে যাবার জন্যে। সম্ভবত হিমালয় সৃষ্টির কাল থেকেই এই ঘটনা রাত আর দিনের মতো ঘুরে ফিরে নিয়ম মাফিক হয়ে আসছে। তাহলেও এই সমস্ত অধিত্যকা ও উপত্যকার মধ্যে কিছু এমন জায়গা আছে যেখানে ফুলের সংখ্যা আর তার বিভিন্নতার প্রাচুর্য অতুলনীয়।
এই যে সাময়িক ঘাসে ঢাকা জায়গা, তা বহু যুগ থেকেই প্রধানত ভেড়ার চারণ ভূমি হিসাবে ব্যবহার হয়ে থাকে। সেখানে যখন ফুল ফোটে, সেই ফুল যে তারা খুবই কম অংশ নষ্ট করতে পারে তাই নয়, বরন তাদের বর্জ্য পদার্থ পরবর্তী বছরে গাছের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার হয়। এই ঘাসের চারণভূমি গুলো কাশ্মীরে মার্গ (যেমন গুলমার্গ, সোনামার্গ ইত্যাদি) আর হিমাচল আর উত্তরাখণ্ডে বুগিয়াল (যেমন বৈদিনি বুগিয়াল, আলি বুগিয়াল ইত্যাদি) বলা হয়ে থাকে। সুইটজারল্যান্ড আর অস্ট্রিয়ার আল্পস পর্বতেও এই ধরনের চারণ ভূমি তৈরি হয়, সেখানে এগুলো য়্যাল্পাইন মিডো নামে বিখ্যাত।
ভারতের উত্তরাখণ্ডে ভিউন্দর বুগিয়াল আর সিকিমের ইয়ুমথামের কাছে যে ইয়ুমথাম উপত্যকা আছে সেখানে ফুলের সংখ্যা ও বিভিন্নতা জগতে আর কোথাও অলব্ধ। দুটিকেই ফুলের উপত্যকা বলা যায়, কিন্তু পৃথিবীতে “ফুলের উপত্যকা” বা “ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স” বলতে ভিউন্দর উপত্যকাকেই বোঝায়।

প্রাচীন কাল থেকেই ভিউন্দর উপত্যকায় মানুষ চারণের কাজ করে আসছে অর্থাৎ, মানুষ এর অবস্থানের কথা জানতো এবং স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রাকৃতিক ফুলের বাগানও দেখেছিলো। সম্ভবত কর্নেল এডমন্ড স্মাইথই প্রথম কোনও বিদেশি যিনি এই উপত্যকায় এসেছিলেন ১৮৬২ সালে। তবে ভারতের বাইরে এই উপত্যকার পরিচয় ব্রিটিশ পর্বতারোহী ফ্রাঙ্ক এস স্মাইথ ১৯৩৮ সালে দেন তাঁর রচিত বই “The Valley of Flowers”-এ। অবশ্য ১৯৩১ সালে তিনি এবং আরও কয়েকজন ব্রিটিশ পর্বতারোহী এবং ভোটিয়া ও নেপালি শেরপাদের সঙ্গে কামেট পর্বত আরোহণ করার পর ১৯৩২ সালে “Kamet Conquered” বই প্রকাশ করেন। এই বইএ আর. এল. হোল্ডসওয়ার্থ, যিনি দলের সঙ্গে উদ্ভিদবিদ্যাবিশারদ হিসাবেও সঙ্গী হয়েছিলেন, লিখছেন,

“The Bhyundar Valley, which lies between these two (Bhyundar Kanta Pass leading to the Khanta Khal Pass, the first a glacier pass of nearly 17,000ft., the second consisting of grass and scree at about 15,000ft.), is a valley of astonishing beauty, containing the richest flora, both in respect of variety and luxuriance, that we had ever seen. ”

এই জায়গার ফুলের সম্পর্কে তিনি আরও লিখেছেন,

“Of the plants I have mentioned, almost all are either not in cultivation, or else extremely rare. It is true, of course, that I discovered no new species, but it is by no means impossible that new species exist there and await discovery.”

আর ১৯৩৮ সালের বইএ স্মাইথ বলেন,

“It was my privilege to undertake this work and the reader, while remembering, and I hope generously, my ignorance, must judge for himself whether the Bhyunder Valley deserves its title the Valley of Flowers. Others will visit it, analyse it and probe it but, whatever their opinion, to me it will remain the Valley of Flowers, a valley of peace and perfect beauty where the human spirit may find repose.”

আমি খুবই সাধারণ ভ্রমণার্থী, তা সত্ত্বেও আমার অভিজ্ঞতার বর্ণনা এই পরিপ্রেক্ষিতে না করে পারছি না। স্মাইথের বক্তব্যের শেষ অংশের বিষয়ে বলি। আমরা যখন এই উপত্যকার এক বিশেষ জায়গায় পৌঁছেছিলাম, আমার স্ত্রী ভারতী সেই জায়গাকার দৃশ্য দেখে মোহিত ও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে একটি গান গেয়ে উঠেছিল। গানটি হলো নজরুলের, “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।” আমার অবশ্য মনে হয়েছিল আনমনে নিশ্চয় তিনি খেলেননি। ঠিক জায়গায় আমি আপনাদের সেই বিশেষ স্থানের সম্পর্কে যথাযথ বর্ণনা করার চেষ্টা করবো।

যাই হোক, স্মাইথকে এই উপত্যকার কথা বিশ্বে প্রচার করার শ্রেয় দেওয়া হয়, কিন্তু হোল্ডসওয়ার্থই স্মাইথকে এই উপত্যকার বিশিষ্টতার পরিচয় দেন। “Valley of Flowers”-এই স্মাইথ লিখছেন,

“Dense mist shrouded the mountainside and we had paused, uncertain as to the route, when I heard R. L. Holdsworth, who was a botanist as well as a climbing member of the expedition, exclaim: “Look!” I followed the direction of his outstretched hand. At first I could see nothing but rocks, then suddenly my wandering gaze was arrested by a little splash of blue, and beyond it were other splashes of blue so intense it seemed to light the hillside.”

এবং এমন ভাবেই ফুলের উপত্যকা স্মাইথের মনে জায়গা করে নিলো এবং তিনি পরে এর পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে উঠবার ব্যবস্থা করলেন।

-২-

গত ২০০৭ সালের জুলাই মাসে আমরা প্রথম বার সেই ফুলের উপত্যকা বা ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স গিয়েছিলাম। অবশ্য আমি নিজে উপত্যকা বা ভ্যালিতে পৌঁছাতে পারিনি, এই জাতীয় উদ্যানের প্রবেশ দ্বার থেকে প্রায় ১.৫কিমি এগিয়ে হাঁটুতে বাতের ব্যথার কারণে আমি একাই ফিরে আসতে বাধ্য হই। বাকিরা উপত্যকায় ঘুরে এসেছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই মনে খুবই দুঃখ পাই। এর পর অনেক চেষ্টায় বাতের ব্যথা কিছুটা সারাতে সক্ষম হই। তাই আবার ২০০৯ সালে জুলাই মাসে এক দিন রাতে দুন এক্সপ্রেসে হরিদ্বারের উদ্দেশে রওয়ানা দিই, দেখি এবার সেই 'নন্দন কানন' দেখতে পাওয়া সম্ভব হয় কি না এই ভেবে। ফুলের উপত্যকাকে ‘নন্দন কানন’ বলবার একটা বিশেষ কারণ আছে, তবে আপাতত সেই বিষয়ে কিছু না বলে পরবর্তী সময়ের জন্যে সেই ব্যাখ্যা তুলে রাখলাম।

তৃতীয় দিন সকালে যথারীতি প্রায় ৪ ঘণ্টা দেরি করে দুন এক্সপ্রেস হরিদ্বার পৌঁছলও। অতএব ওখান থেকে সেই দিনই বদরীনাথ বা গোবিন্দঘাট এমন কি যোশিমঠ পৌঁছবার বাসও আর পাওয়া গেল না। অবশ্য নিজেরা গাড়ি ভাড়া করে চলে যাওয়া সম্ভব ছিল কিন্তু গাড়ি ভাড়া যাতায়াতের জন্যে দিতে হয়, অর্থাৎ দ্বিগুণ। তাই আমরা তা না করে কিছু পরে ছাড়বার হৃষীকেশ প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চাপলাম। এই ট্রেনও যথারীতি এক ঘণ্টার যাত্রা পথে ১১:৩০এ পৌঁছানোর বদলে প্রায় বেলা ১৩:১০মিনিটে হৃষীকেশ পৌঁছলও। কাজেই এখানে চলে এসেও সেইদিন আর আমরা আমাদের প্রাথমিক গন্তব্যের দিকে এগোতে পারলাম না। অগত্যা হৃষীকেশের ট্যুরিস্ট গেস্ট হাউসে উঠলাম। গেস্ট হাউসের ভিতরে ঢুকে এর ব্যবস্থাপনা দেখে আমার মনে হলো এটা নিশ্চয় উত্তরাখণ্ড ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের পরিচালিত নয়। পরে দেখলাম বাইরে লেখা আছে Run by HNB Garhwal University, Unit of Uttarakhand Tourism। এ ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত লাগলো যে, উত্তরাখণ্ডের শ্রীনগরে স্থাপিত হেমগতি নন্দন বহুগুনা গাঢ়ওয়াল বিশ্ববিদ্যালয়, যেটি এক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, হৃষীকেশে ট্যুরিস্ট গেস্ট হাউস পরিচালনা করছে? এখানে একটা বড় ঘরে আমাদের ১০জনকার জায়গা হয়ে গেল আর দরাদরি করে মোট মাত্র ৬০০ টাকায় রফা হলো। উত্তরাখণ্ডের আরও উত্তর দিকে পাহাড়ে যাবার জন্যে বাস স্ট্যান্ডের পাশেই এই গেস্ট হাউস, তাই পর দিন ভোর বেলাই আমাদের বাস ধরতে কোনও অসুবিধে হবে না বলে মনে খুব আনন্দ হলো। আমরা পর দিন সকাল ৬টার বাসে গোবিন্দঘাট যাবার জন্যে সিট বুক করে নিলাম। জন প্রতি ২৫০ টাকা বাস ভাড়া গোবিন্দঘাট পর্যন্ত। তখন কে জানতো যে আমাদের ভাগ্যে এই বাসে যাওয়া হবে না লেখা আছে?
এর আগের বারে যখন ফুলের উপত্যকা বা ‘নন্দন কানন’ যাবার জন্যে এসেছিলাম, দুন এক্সপ্রেস মাত্র ঘণ্টা দেড়েক দেরিতে হরিদ্বার পৌঁছেছিল। তাই খুব অল্প সময় পরেই যোশিমঠ যাবার বাস পেয়ে গিয়েছিলাম স্টেশনের সামনে থেকেই আর আমরা ঝির ঝিরে বৃষ্টির মধ্যেই বাসে উঠেছিলাম।

বিকেল বেলা আমরা সকলে গঙ্গার ধারে গেলাম। উদ্দেশ্য, গঙ্গারতি এখানেও হয় কি না দেখা। আগে দেখেছি হৃষীকেশে গঙ্গার অপর পারে গীতা ভবনের কাছেই গুরু শ্রীশ্রীরবিশঙ্কর পরিচালিত ‘পরমার্থ নিকেতন’ আশ্রমে এক অভিনব প্রকারের বেশ সুন্দর গঙ্গারতি। এই পারেও গঙ্গারতি হলো, তবে তা খুবই সাধারণ মানের। যাই হোক, আমরা সেই গঙ্গারতি দর্শন ও উপভোগ করে ফেরার পথে রাতের খাওয়া সাঙ্গ করে আমাদের গেস্ট হাউসের ঘরে চলে এলাম।
একটা বেশ মজার ব্যাপার না জানিয়ে থাকতে পারছি না। আরতি চলার আগে গঙ্গার ধারে মাইক-এ ঘোষণা করা হচ্ছিল, অবশ্যই হিন্দিতে, ‘আরতি চলাকালীন গঙ্গায় স্নান করবেন না।‘ বেশ কয়েক বার এই ঘোষণা করা হচ্ছিল কিন্তু প্রত্যেক বারই ‘করবেন না’ কথাটার সময় মাইক থেকে এক অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছিল বলে কথাটা একদম বোঝা যাচ্ছিল না।

বিকেলের দিকে আকাশে মেঘ জমতে আরম্ভ করেছিল। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বৃষ্টি শুরু হল এবং তার বেগ ক্রমশ: বাড়তে থাকলো। বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত তো ছিলই। গভীর রাতে বৃষ্টির বেগ কমেনি ঘরের ভিতর থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছিল। ভোর ৪টের সময় বিছানা ছেড়ে উঠলাম। আমার সহযাত্রী-যাত্রিণীরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাদের না জাগিয়ে ঘরের বাইরে বেরোলাম। বৃষ্টির কারণে বাস স্ট্যান্ডের আলো ঝাপসা লাগছে। গেস্ট হাউসের সামনের পথ দিয়ে ভীষণ গতিতে বৃষ্টির জল বয়ে যাচ্ছে। এই প্রথম মনে হল যে তাহলে কি আমরা আজ বেরোতে পারব না? আমার হঠাৎ মনে পড়ল উমাপ্রসাদবাবুর লেখা (হিমালয়ের পথে পথে, লোকপাল নন্দনকানন, পৃ-৩৬, মিত্র ও ঘোষ, কলিকাতা, ১৪১০),

“রাত্রিতে হঠাৎ ঘুম ভাঙল। বাইরের ঘরের ছাদের উপর মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ার শব্দ হচ্ছে। ---
কখন রাত্রি ভোর হয়েছে জানা নেই। বেলা আটটা বাজে। --- বৃষ্টি তেমনই চলেছে। শ্রাবণের ধারার মত। অক্লান্ত, অঝোরে। ---
বাইরে বেলা গড়িয়ে যায়। তবুও আকাশে আলো খোলে না। নিবিড় কালো নিশ্ছিদ্র নিখিল।”

তাঁর এই অবস্থা হৃষীকেশে অবশ্য হয়নি, হয়েছিল আরও এগোবার পর, গোবিন্দঘাটে। এই উদ্ধৃতি থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে তাঁর যাওয়া সেদিন হয়নি। আমাদের কি সেই অবস্থাই হবে? আমরা কি যাত্রা আরম্ভ করতেই পারবো না?

ঘরে ফিরে এসে প্রাতঃকৃত্য সারলাম। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেও দেখলাম কেউই জাগেনি। কয়েকজনকে ডেকে তুললাম এবং আমি আমার ফুলপ্যান্টের পায়ার নিচের দিক গুটিয়ে, রেনকোটের লোয়ার ও আপার পরে তার সঙ্গে ছাতাও মাথায় দিয়ে গেস্ট হাউস থেকে জলের স্রোত অতিক্রম করে বাস স্ট্যান্ডের শেডের তলায় ঢুকলাম। তখনো বৃষ্টির বেগ কিছুমাত্র কমেনি। শেডের তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকে ঘুমাচ্ছে, আর কিছু মানুষ বাইরে বৃষ্টির দিকে উদাস ভাবে তাকিয়ে আছে। আমি বাস স্ট্যান্ডের পিছন দিক দিয়ে ঢুকেছিলাম কেননা আমাদের গেস্ট হাউস ওই দিকেই। এবার সামনের দিকে চলে আসলাম। সামনের দিকে বেশ চওড়া রাস্তা এবং সেখানে সার দিয়ে অনেক বাস দাঁড় করানো রয়েছে, সবই ফাঁকা। আমাদের বাসের নম্বর জানা ছিল। শেডের তলা থেকেই আমাদের বাসের নম্বর খোঁজার চেষ্টা করলাম। দেখতে পেলাম না। অগত্যা শেডের বাইরে যেতে হলো। সেখান দিয়ে তীব্র বেগে জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। আমি জলের তলের উপর পা ফেলে মাটিতে পা রাখলাম। জলের তীব্র স্রোতের কারণে আমার পা কিছুটা দূরে মাটিতে পড়ল। মাটি বলতে আমি সিমেন্টে বাঁধানো জায়গা বোঝাতে চেয়েছি। সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। রাস্তা ও বাস স্ট্যান্ড চত্বরের মাঝে এক বেশ গভীর নালা গত কাল দেখেছিলাম, এখন রাস্তা, নালা ও স্ট্যান্ডের চত্বর সব মিলে মিশে এক নদীতে পরিণত হয়ে গেছে। এগোতে ভয় হতে লাগলো। আমার সামনেই এক মধ্য বয়স্ক দম্পতি এগোচ্ছিলেন রাস্তার দিকে। হঠাৎ দেখলাম যে ভদ্রমহিলা জলের সঙ্গে একেবারে সমান্তরাল ভাবে ডুবে গেলেন, অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই স্রোতের কারণে ভেসে উঠেই দাঁড়িয়ে পড়লেন, তিনি নালায় পড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর খুবই কষ্ট হলো কিন্তু আমার একটা উপকার হলো, আমি নালার অবস্থিতি বুঝতে পেরে গেলাম। নালা পার করে রাস্তায় নেমে অনেক খোঁজা খুঁজি করে আমাদের ফাঁকা বাস দেখতে পেলাম। তখন ৫:৩০ আর আমাদের বাস ছাড়বে ০৬:০০। ভেবে পাচ্ছিলাম না যে কি করে ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে আসবো এবং বাসের মাথায় তুলবো। প্রায় ১৫ মিনিট পরে বাসের চালককে পেলাম। তিনি বলেই দিলেন যে এই অবস্থায় বাসের ছাদে মাল তোলার লোক পাওয়া যাবে না। এর পর চালক যা বললেন, তাতে আমার চিন্তা আরও বেড়ে গেল। তিনি বললেন যে গত কাল রাত থেকে যে পরিমাণ বৃষ্টি সমানে পড়েই যাচ্ছে, তাতে তিনি নিশ্চিত যে স্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে ৫কিমি পথও বাস চালিয়ে যাওয়া যাবে না। তিনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাস সেখানেই রেখে কোনও এক জায়গায় চলে যাবেন আর যাত্রীরা কোথাও মাথা গোঁজবার জায়গাও পাবে না। তিনি আমাকে বললেন যে ওই বাস-কম্পানির পরের দিনের বাসে আমাদের টিকিট পরিবর্তন করে নেওয়া উচিত হবে। তিনি অবশ্য এই স্ট্যান্ডে ০৬:৩০ পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। ইতিমধ্যে এই বাসের কোন যাত্রীই এসে পৌঁছায়নি।

এই শুনেই আমি তাড়াতাড়ি করে গেস্ট হাউসে আমাদের ঘরে চলে গেলাম। সেখানে দেখি অনেকেই তখনো তৈরি হয়নি। আমার কথা শুনে সকলকারই মত হলো যে ওই দিন আর যাওয়া সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে বৃষ্টি পড়া কিছুটা কম হয়েছে। আমি আবার বাসের কাছে এলাম। দেখলাম কিছু যাত্রী বাসে বসে আছে আর বাস স্টার্ট করছে। আমার সামনে দিয়েই আমাদের বাস, স্ট্যান্ড ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এইবার আমার আর এক চিন্তা হলো, টিকিট পরিবর্তন করা।
কিছুক্ষণ আগে গেস্ট হাউসে যাবার সময় বাসের টিকিট কাউন্টার ফাঁকা দেখে গিয়েছিলাম। এখন দেখলাম সেখানে লোক রয়েছে। তাকে আমাদের অবস্থা বোঝালাম আর আমাদের টিকিট দেখালাম। টিকিট পালটাবার ব্যাপারে কোনও অসুবিধা হবে না বলেও আমাকে যা জানালো আমার চিন্তা বেড়েই গেল। শুনলাম যে আমায় সরকারি বুকিং কাউন্টারের লোক হয়েও বেসরকারি বাসের টিকিট দিয়েছে। আমার অবশ্য তাতে কোনও আপত্তি নেই তবে একমাত্র সেই বুকিং ক্লার্কই আমার টিকিট পরিবর্তন করে দিতে পারে। সেই ক্লার্ক নাকি নিজের ইচ্ছা মতো ডিউটিতে আসে, তাই সে কখন কাজে আসবে আর যাবে কেউ বলতে পারে না। অর্থাৎ আমাকে তার জন্যে হাঁ করে অপেক্ষা করতে হবে। আমার অবস্থা দেখে দয়া পরবশ হয়ে সেই ক্লার্কের ফোন নম্বর দিলো। তাকে ফোন করে আমাদের ব্যাপার বলতে প্রথমে আমরা ভুল করেছি ওই বাসে না যাত্রা করে বলল আর বিরক্তি প্রকাশ করল। টিকিট পরিবর্তনের কথাটা এড়িয়ে যেতে চাইল, শেষে তার ডিউটিতে আসার একটা সময় আমাকে জানালো এবং আমাকে তখন দেখা করতে বলল। আমি ব্যাপারটা যাতে অনেকে জানতে পারে সেই জন্যে কাউন্টারে গিয়ে পরিস্থিতি জানিয়ে দিলাম। অবশ্য বুঝলাম যে ঘটনাটা অনেকেই জেনে গেছে।
তাঁর জানানো সময় থেকে আরও দু ঘণ্টা পরে তিনি বাস স্ট্যান্ডে উপস্থিত হলেন। আমি বুঝতে পারলাম যে ইতি মধ্যে এই ঘটনা অনেকে জেনে গেছে তা তিনিও জানতে পেরেছেন। তাই আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে কিছু পরে টিকিট পালটে দেবেন বলে কথা দিলেন আর বেশ কিছু সময় পরে আমার গেস্ট হাউসের ঘরে গিয়ে পরিবর্তিত টিকিট দিয়ে এলেন পরের দিন ভোর ০৪:৩০-এর সরকারি বাসের।

অনেক পাঠক এতক্ষণ আমার এই যাত্রা শুরুর আগের কথা পড়ে হয়ত ধৈর্যহারা হয়ে গেছেন আর মনে প্রশ্ন জাগছে এই বর্ণনার প্রয়োজনীয়তার। আবার অনেকে হয়ত ভাবছেন জুলাই মাসে তো বৃষ্টি হবারই কথা তা হলে দুবারই আমারা কেন জুলাই মাসেই যাত্রার ব্যবস্থা করেছিলাম। এবার আমি পাঠকের কাছে কিছুটা সময় চেয়ে নিচ্ছি এই দুই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যে।

আজকাল বাজারে প্রচুর সংখ্যক ভ্রমণ পত্রিকা পাওয়া যায়। সেগুলোতে ভ্রমণ সাহিত্য থাকে না, থাকে বিভিন্ন ভ্রমণের পথনির্দেশ বা গাইড, কোথায় কি করে যাবেন আর কি দেখবেন, কোথায় কি খেতে পাবেন আর কোথায় থাকবেন তার একটা সারণি বা টেব্‌ল আকারে না লিখেও টেব্‌ল। আর ভ্রমণের স্থানের বর্ণনায়, প্রায় সবই ‘অভূতপূর্ব’, ‘দারুণ সুন্দর’ , বা ‘চোখ ফেরানো যায় না।’ কিছুদিন আগে একটা লেখায় পড়লাম ‘যদি স্বর্গ থাকে তো এখানেই,’ লেখিকা এই মন্তব্যে উদ্ধৃতির চিহ্নও ব্যবহার করেননি বা এ কথার প্রথম ব্যবহারকারী কে তাও বলেননি। হাস্যকর কথা এই হলো যে উনি যে সময়ের বর্ণনা করেছেন তখন এত বেশি মেঘ থাকে যে দূরের দৃশ্য দেখার কোনও সম্ভাবনাই থাকে না। আর তিনিও মেঘে ঢাকা আকাশের কথাই লিখেছিলেন। লেখিকার বর্ণিত জায়গায় আমি গেছি, ওখান থেকে যেমন নৈসর্গিক দৃশ্য দেখা যায়, তা যে কোনও পাহাড়ি জায়গা থেকে প্রায় ওইরকমই দৃশ্য দেখা যায়। অবশ্য যে অন্য জায়গায় দেখেনি, তার কাছে দৃশ্য অভূতপূর্ব হতেই পারে। আসল কথা, লেখিকা না দেখেই এই কথা লিখেছেন। এই তো হলো তথা কথিত ভ্রমণ কাহিনিতে ভ্রমণের বর্ণনা। যাই হোক, কটা লেখায় থাকে যে রাস্তায় কোন পরিস্থিতিতে পড়তে পারেন আর কি করে তার থেকে উদ্ধার পেতে পারেন বা লেখক/লেখিকা কোন অদৃষ্টপূর্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন আর কি করে তার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন? এটাই হলো কারণ, যাত্রার পূর্বের ইতিহাসেরই বর্ণনায় এতটা সময় নিয়েছি। তা ছাড়া ঘটানাটা কি নিজ মূল্যেই বর্ণনযোগ্য নয়?

ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স বা ফুলের উপত্যকা দেখবার সময় মে মাসের শেষ থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফুল ফোটে। প্রত্যেক জাতির ফুল ফোটার একটা নির্দিষ্ট সময় কাল আছে। জুলাই মাসের মাঝ থেকে অগাস্ট মাসের মাঝ পর্যন্ত সবথেকে বেশি সংখ্যক ফুল ফোটে। তাই ওই সময়েই এই উপত্যকায় যাওয়ার জন্যে সকলেই চেষ্টা করে। এই সময়টা বর্ষার সময় এবং তাই এই যাত্রা করতে গেলে হাতে অবশ্যই বেশি দিন সময় রাখতে হবে, কেননা বর্ষা ও ধসের কারণে রাস্তা অনেক সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে, ফলস্বরূপ যাত্রীরা এক জায়গায় আটকে পড়তে পারেন।

-৩-

পরের দিন অর্থাৎ, ২১শে জুলাই আমাদের যাত্রা আরম্ভ করতে পারা গেল। তবে বাস ভোর ৪:৩০-এ ছাড়ল না, ছাড়ল ৫:০০টার সময়।
আমরা আশঙ্কা করছিলাম রাস্তায় বেশ কিছু জায়গায় গত কালকের বৃষ্টির কারণে ধস নেমেছে নিশ্চয় এবং আমাদের যাত্রা বেশ বাধা পাবে। আমাদের আশঙ্কা অমূলক প্রমাণ করে রাস্তা বেশ পরিষ্কার পাওয়া গেল এবং সকাল ৬:৪৫ মিনিটেই আমরা প্রায় ৭০কিমি পথ অতিক্রম করে দেবপ্রয়াগ (৬১৮মি.) পৌঁছে গেলাম। এখানে বাস কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো যাত্রীদের প্রাতরাশ করার সময় দিয়ে। এখানে গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ থেকে নেমে আসা ভাগীরথীর সঙ্গে শতোপন্থ হিমবাহ থেকে উদ্ভূত ও বদরীনাথ হয়ে আসা অলকানন্দা মিশছে। এর পর আমাদের জানা গঙ্গা হয়ে নেমে যাচ্ছে। আমরা সেই সঙ্গম দেখতে নিচে নামলাম না, ওপর থেকেই দেখলাম। যদিও ওপর থেকে, অর্থাৎ রাস্তা থেকে খুবই সুন্দর এই দুই নদীর সঙ্গম দেখা যায়।

এখানে বাজারে বেশ ভাল সিঙ্গাপুরি কলা, এখানে অবশ্য বোম্বাই কলা বলে, ভুসাওল অর্থাৎ প্রধানত বম্বের দিক থেকে চালান আসে বলে, ৩০ টাকা দর্জন। এই কলা আমাদের ওখানে এখন ২০-২২ টাকা। (পাঠক নিশ্চয় আমাদের ভ্রমণকাল মনে করবেন) ৯টার সময় আরও ৭২ কিমি দূরের শ্রীনগর (৯৭৩মি.) পৌঁছে বেশ কিছুক্ষণ বাস, তেল নেবার জন্যে অপেক্ষা করলো তেলের জন্যে পাম্পে বিরাট লাইন পড়েছিলো বলে। ড্রাইভার আমাদের গাড়ি থেকে নামতে দিলো না। শ্রীনগর, পৌরি জেলার সদর। এ এক বিরাট ও প্রাচীন শহর। বেশ জমজমাট। দেবপ্রয়াগের থেকে কিছুটা উঁচুতে অবস্থিত হলেও ওখান থেকে বেশি গরম। অলকনন্দার ধারে এর অবস্থিতি। দৈর্ঘ্য অনেকটাই। শহরের নৈসর্গিক সৌন্দর্য বেশ সুন্দর। পাহাড়ের কোলে অথচ রাস্তা উঁচু-নিচু নয়। শহরে ঢোকার মুখে অলকনন্দা নদী মনে হয় যেন নদী নয়, এক বিরাট দৈর্ঘ্যের হ্রদ। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় (আগেই এর কথা বলা হয়েছে) আছে।

শ্রীনগর থেকে বেরিয়ে প্রায় ১১:০০টার সময় আরও ৩৪কিমি দূরের রূদ্রপ্রয়াগ (৮১০মি.) পৌঁছলাম। এখানেও দুই বিখ্যাত নদীর সঙ্গম, কেদারনাথের কিছুটা উত্তরে স্থিত চোরাবালি তাল, যার আধুনিক নামকরণ করা হয়েছে গান্ধি সরোবর, সেখান থেকে কেদারনাথ হয়ে আসা মন্দাকিনী, অলকনন্দার মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। সঙ্গমের উপরে রূদ্রনাথ শিবের মন্দির। সঙ্গমের ধারে সন্ধ্যায় আরতি দেখবার মতো। রূদ্রপ্রয়াগও প্রাচীন শহর। বহুদিন এইখানেই বাস রাস্তার ইতি হতো। এইখানেই বদরিনাথ ও কেদারনাথ, এই দুই শৈলতীর্থে যাবার রাস্তারও সঙ্গম। কেদারনাথের রাস্তা সোজা উত্তর দিকে আর বদরিনাথ যাচ্ছে পূর্ব দিকে। এ ছাড়া আরও একটা রাস্তা অল্প দূরে কেদারনাথের রাস্তা থেকে বেরিয়ে উত্তর-পূর্ব গিয়ে পার্শ্ববর্তী জেলা চামোলির সদর, গোপেশ্বর হয়ে বদরীনাথের রাস্তায় নন্দপ্রয়াগের কিছুটা উত্তরে মিশছে। রূদ্রপ্রয়াগ এই নামেরই জেলার সদর।

রুদ্রপ্রয়াগের রাস্তা বেশ সংকীর্ণ, তাছাড়া রাস্তায় গাড়ির ভিড়ও বেশি। মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে ধীরে ধীরে বাস শহর ছেড়ে এগিয়ে গেল। অল্প পরেই নাগরাসু বলে এক জায়গায় বাস দাঁড়ালো। রাস্তার দুই ধারেই বেশ কয়েকটা বড় বড় খাবার হোটেল। আর রয়েছে এক গুরদ্বারা, বেশ বড় চত্বর নিয়ে। সেখানে প্যান্ডেল বাঁধা, লোক-জন অনেক ঘোরা-ঘুরি করছে। লাউড স্পিকারে বেশ উচ্চ স্বরে গুরবানি শোনানো হচ্ছে। শুনলাম সেখানে হেমকুন্ড যাত্রীদের জন্যে লঙ্গর চলছে। হৃষীকেশ থেকে দুজন বেশ বয়স্ক সর্দারজি আমাদের বাসে ছিলেন। তাঁরা আমাদের ওখানেই প্রসাদ পেতে বললেন। আমরা বেশির ভাগ অবশ্য এক হোটেলে ঢুকলাম, দুপুরের আহার সারার জন্যে। বাসের কন্ডাক্টর বাস দাঁড় করিয়ে আমাদের লাঞ্চ সারার জন্যে বলেছিল। আমি আর আমার স্ত্রী ভারতী শুধু ভাত আর দই নিলাম, এক প্লেট করে। তাতেই আমাদের দুজনার ভালই আহার হলো, মাত্র ৪৫ টাকায়।

বাসের সমস্ত যাত্রীদের আহারও বেশ তাড়াতাড়ি শেষ হলো, তাই মাত্র ২৫ মিনিট পরেই ১২:১০ মিনিটে কর্ণপ্রয়াগের উদ্দেশে বাস এগোতে লাগল। আমাদের বাসে আমরা ১০ জন আর দুই সর্দারজি ছাড়া সকলেই বদরীনাথের যাত্রী। গত পাঁচ দিনের পর আজই বদরীনাথের রাস্তা ধসের কারণে বন্ধ থাকার পর খুলেছে। ধস অবশ্য পান্ডুলেশ্ব্বরেরও পরে হয়েছিল, কাজেই গোবিন্দঘাটে যাবার কোনও অসুবিধে ছিলনা।

এর পর আমরা গৌচর, কর্ণপ্রয়াগ ও নন্দপ্রয়াগ হয়ে চ্‌মোলি (৯৭৫মি.) পৌঁছলাম প্রায় ২টোর সময়। কর্ণপ্রয়াগের একটু আগেই রাস্তা পূর্ব থেকে দিক পালটে উত্তর-পূর্বে ঘুরে গেছে। চ্‌মোলি থেকে আবার উচ্চতাও বেশ তাড়াতাড়ি বেড়ে গিয়ে মাত্র ১৭ কিমি এগিয়েই পিপলকোটিতে ১২৪৬মি. হয়ে গেছে। চ্‌মোলি থেকে মাত্র ৩৫ মিনিট সময় নিয়ে ২:৩০ মিনিটেই বাস এখানে এসে গেল। হেলং ইত্যাদি পার হয়ে সেই বিখ্যাত যোশিমঠ পৌঁছলাম ৪টায়। এ পর্যন্ত যে দূরত্ব আমরা এসেছি তার মধ্যে এখানকার উচ্চতাই সব থেকে বেশি, ১৮৭৫মি.। এর পর আমরা আবার নিচের দিকে নেমে যাবো খুবই তাড়াতাড়ি ১২কিমি দূরের বিষ্ণুপ্রয়াগে ১৩৭২মি. উচ্চতায়।

যাই হোক, এখন কেন এই যোশিমঠ বিখ্যাত একটু জেনে নেওয়া যাক। অলকনন্দার গভীর খাতের পাশেই এই প্রাচীন শহর। যোশিমঠ ঢোকার মুখে খাতের বিপরীত পারের পাহাড়ের গায়ে হাতির মাথার সঙ্গে সদৃশতা লক্ষ করা যায় বলা হয়। অবশ্য আমি চেষ্টা করেও সেই অপার্থিব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে পারিনি। অষ্টম শতাব্দীর শেষে যোশিমঠে আদিগুরু শঙ্করাচার্য এসেছিলেন এবং এক গুহায় তপস্যায় বসেছিলেন। এখানেই তিনি তাঁর চার মঠের অন্যতম, জ্যোতির্মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অনেকে অবশ্য বলেন যে এই জ্যোতির্মঠ তিনি নাকি বদরীনাথে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যোশিমঠের সেই মঠ এখনো পুরোপুরি কার্যরত। শুনেছি মাঝে উনবিংশ শতাব্দীতে কিছু সময়ের জন্যে এই মঠ মঠাধ্যক্ষের পদের জন্যে একাধিক দাবিদারের মধ্যে ঝগড়ার কারণে বন্ধ ছিল। গত বার, আপনাদের আগেই বলেছি যে হরিদ্বার থেকে সোজা যোশিমঠে এসেছিলাম, তখন এবং পরেও একবার শঙ্করাচার্যের তপস্যার গুহা ও মঠ দেখে গেছি। মঠে আবাসিক ছাত্রদের বেদাভ্যাস করতে দেখেছি এবং সেই অবস্থায় তাদের ও মঠের ভিডিও ছবি নিয়েছি।

হৃষীকেশ-বদরীনাথ রাস্তা দক্ষিণ থেকে উত্তর বরাবর যোশিমঠকে মাঝামাঝি দুই ভাগে ভাগ করেছে। জোতীর্মঠ রাস্তার পূর্ব দিকে কিছুটা উঁচুতে। মঠের সামনেই আদিগুরুর তপস্যার গুহা। রাস্তার পশ্চিম দিকে কিছুটা নিচেতে প্রাচীন মন্দির, নৃসিংহদেবের। মন্দির চত্বরে অবশ্য আরও অনেক দেবী-দেবতার মন্দির আছে। এই মন্দির আর এক কারণে বিখ্যাত, এখান থেকেই শীতের সময় বদরীনাথদেবের পূজা হয়। বদরীনাথ সশরীরে অবশ্য এখানে আসেন না। তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে তাঁর অগ্রজ, উদ্ধবের এক মূর্তি ও কুবেরের মূর্তি এই মন্দিরে স্থাপন করা হয়। অবশ্য এও বলতে শুনেছি যে এঁরাও সশরীরে আসেন না। ঠিক কি, নিজে না দেখার করণে বলতে পারছি না। শীত কালে বদরীনাথের পূজা সম্পর্কে আর এক মন্দিরও নিজ দাবী উপস্থিত করে আছে। পান্ডুকেশ্বরের যোগধ্যনবদরী মন্দিরেও এই পূজা করা হয় বলে মন্দিরের কাছে লেখা আছে। আমি এই মন্দিরের প্রধান পূজারিকে নৃসিংহদেবের মন্দিরের দাবীর কথা বলতে তাঁর বক্তব্য যে তাঁরাই ঠিক বলছেন, যোশিমঠের কথা ঠিক নয়। আমাদের কোন চিন্তা করবার দরকার নেই, আমরা মন্দির দর্শন করতে এসেছি, মন্দির দর্শন করি। তবে আজ আমরা মন্দির দর্শন করছি না। যেহেতু বাস এখানে দাঁড়িয়েছে, এখানকার স্মৃতি কিছুটা রোমন্থন করলাম।

যদিও আগেও লোকে সেখানে যেতো, কিন্তু ইদানীং ১৪ কিমি দূরের আউলি (২৫১০-৩০৪৯মি.) যাওয়ার রেওয়াজ অনেক বেড়ে গেছে, বিশেষ করে যখন এই উপত্যকা বরফে সম্পূর্ণ ঢেকে যায়। আউলি আসলে এক চারণ ভূমি, আউলি বুগিয়াল। যোশিমঠ থেকেই এখানে যেতে হয়। রোপ-ওয়ে ৪কিমি. দৈর্ঘ্যের। বলা হয় যে এশিয়ার দীর্ঘতম। নেপালের মনোকামনা মন্দিরে যাবার জন্যে এক রোপ-ওয়ে আছে। সেখানে বলে সেটাই নাকি এশিয়ার দীর্ঘতম। সিমলার কাছে কুফরি, বা কাশ্মীরের গুলমার্গ ছাড়া এখানেও ইদানীং স্কি করার জন্যে প্রচুর ট্যুরিস্ট আসছেন শীতকালে। আউলি থেকে নন্দাদেবী ও ত্রিশূল শীর্ষের দৃশ্য অপূর্ব।

যোশিমঠ থেকে তপোবন যাওয়া যায়। দূরত্ব প্রায় ১৫ কিমি। তবে গোমুখ ছাড়িয়ে যে তপোবন আছে, তা বেশি বিখ্যাত।
এখানে প্রায় ৪৫ মিনিট বাস অপেক্ষা করল, তার কারণ গেট বন্ধ। এই পদ্ধতি জখন থেকে এই রাস্তায় গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে তবে থেকেই চলে আসছে। প্রথমে রাস্তা সংকীর্ণ ছিল এখান থেকে বদরীনাথ পর্যন্ত। তখন রাস্তায় গাড়ি দু দিকে এক সঙ্গে চলতে দেওয়া হতো না। সময় ঠিক করা থাকতো কোন কোন সময়ে কোন দিক থেকে গাড়ি চলবে। একেই বলা হতো গেট। এখন যদিও রাস্তা অনেক চওড়া হয়েছে, তা হলেও এই এলাকা ভীষণ ধস প্রবণ এবং একপাশে গভীর খাত, তাই সেই পদ্ধতি এখনো বন্ধ করা হয়নি। যাই হোক, বিকাল ৪:৪৫ মিনিটে আমাদের বাস, রাস্তা খালি পেল আর উত্তর দিকে এগোতে আরম্ভ করলো।

প্রথমেই সমানে রাস্তা নিচে নামতে লাগলো। ১২ কিমি এগিয়ে একেবারে অলকনন্দার ধারে বিষ্ণুপ্রয়াগে (১৩৭২মি.) নেমে এলো। এখানে এককালে নদী ভীষণ উত্তাল এবং ভীম বেগে বয়ে যেতো। এখন নদী বাঁধে বাঁধা পড়েছে, তাই এক শান্ত সরোবরে পরিণত হয়েছে। জল-বিদ্যুৎ প্রকল্প গড়া হয়েছে, ফলে চারিদিকে বিজলি বাতি জ্বলতে পারছে। প্রয়াগ মানেই সেখানে দুই নদীর মিলন হয়েছে। এখানে বাঁধের কাছেই নিতি গিরিপথ থেকে নেমে আসা ধৌলিগঙ্গা অলকনন্দায় মিশে গেছে। এর পর কিছুটা দূর পর্যন্ত অলকনন্দার ধারা বিষ্ণুগঙ্গা নাম ধারণ করেছে।

আমরা এ পর্যন্ত পাঁচটি প্রয়াগ (দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, কর্ণপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ ও বিষ্ণুপ্রয়াগ) পার করে এসেছি। এই প্রয়াগগুলোকে সমষ্টিগতভাবে পঞ্চপ্রয়াগ বলা হয় এবং হিন্দুদের ধার্মিক জীবনে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। প্রত্যেক প্রয়াগের ধারে হয় শিব-মন্দির নয় বিষ্ণুমন্দিরের অবস্থান। দুইয়ের অবস্থানও বিচিত্র নয়। সাহসী ও ধার্মিক ভক্তরা এই সব সঙ্গমে স্নান করা বিশেষ পুণ্যের কাজ মনে করেন। খুবই সাহসের প্রয়োজন এই সমস্ত সঙ্গমে স্নান করতে, কারণ এখানে নদী প্রচণ্ড গতিশীল ও উত্তাল থাকে।

এখান থেকে এগিয়ে মাত্র ৭ কিমি দূরেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্থান গোবিন্দঘাট (১৮৩০মি.) পৌঁছে গেলাম ঠিক ৬টার সময়। সারা রাস্তায় কোথাও বৃষ্টি পায়নি, কিন্তু এখানে গত বারের মতোই ঝির ঝিরে বৃষ্টির মধ্যে আমরা বাস থেকে নামলাম।

-৪-

বাস থেকে নেমেই তাড়াতাড়ি করে বর্ষাতি ও ছাতা (হাঁ, দুইই আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম) বের করে, বেশ কষ্ট করেই যে যার মালপত্র নিয়ে অলকনন্দা নদী আমাদের ডান দিকে রেখে, অর্থাৎ পূর্ব দিক বরাবর হাঁটতে আরম্ভ করলাম। ওইখান থেকে আমাদের লক্ষের দিকের ছবি নিলাম (চিত্র-১, বাস-স্ট্যান্ড থেকে গুরদ্বারার দিকের দৃশ্য)।

চিত্র-১, বাস-স্ট্যান্ড থেকে গুরদ্বারার দিকের দৃশ্য

বেশ কিছু বছর আগে এইটাই বদরীনাথ যাবার রাস্তা ছিল। এখন রাস্তা একটু উপর দিয়ে এগিয়ে গেছে, আর এই রাস্তাটা গোবিন্দঘাটের গুরদ্বারা আর অন্যান্য আবাস স্থলের জন্যেই রয়েছে। পোর্টার ছিলো, কিন্তু বৃষ্টি ও আমাদের মালপত্রের সংখ্যা দেখে লাগাম ছাড়া দর হাঁকলো। রাস্তা অনেকটাই, ৫০০ মিটারের বেশি। আমাদের লক্ষ, গোবিন্দঘাট গুরদ্বারা। গত বারে সেখানেই উঠেছিলাম এবং সেখানে বিনা ভাড়ায় বাথরুম সংলগ্ন বেশ ভালই ঘর পেয়েছিলাম।
কিছুটা এগোতেই অলকনন্দায় লোকপাল-হেমকুন্ড থেকে উদ্ভূত লক্ষ্মণগঙ্গা নদী দক্ষিণ দিক থেকে লাফাতে লাফাতে এসে মিশছে। লাফাবার কারণ হলো লক্ষণগঙ্গা কিছুটা উঁচু গিরিখাত থেকে তুলনায় নিচুতে প্রবাহিত অলকনন্দায় মিলিত হচ্ছে।
বিশেষ করে বেলা শেষে পৌঁছবার কারণে এবার দেখলাম ভীষণ ভিড় গুরদ্বারায়। অন্যান্যদের বসিয়ে রেখে আমি একলাই গুরদ্বারার অফিসে ঘরের ব্যবস্থা করতে গেলাম। আমাদের ১০ জনকার জন্যে যে ঘর দেওয়া হলো, সেই ঘর দেখতে গেলাম। ঘরের অবস্থান বেশ ভালো, গুরু গ্রন্থসাহেব যে হলঘরে রাখা, অর্থাৎ গুরদ্বারার প্রধান ঘরের লাগোয়া ঘর। কিন্তু সেই ঘরের লাগোয়া বাথরুম নেই ও সেই ঘরে ছয় জনের এক শিখ পরিবার আগে থেকেই রয়েছেন আর আমাদের ১০ জনের জন্যে পাঁচটি ম্যাট্রেস মেঝেতে পাতা। হ্যাঁ, গুরদ্বরার কোনও ঘরে অবশ্য খাট থাকে না। আমি বুঝলাম আমরা এই ঘরে থাকতে পারবো না, কেননা দশজন ঢোকাই এখানে অসুবিধে। আমাকে ঘর দেবার সময় বলে দিয়েছিলো যে পরিবার নিয়ে থাকার মতো ওই একটাই ঘর খালি আছে। আর এই সময়ে কোন যাত্রী ঘর ছাড়ার কথা নয়, কেননা যাত্রীরা হেমকুণ্ড থেকে এখনই ফিরছেন। কাজেই আমি ওখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে হোটেল খুঁজতে লাগলাম। সমস্ত হোটেল ভরা আর না হলে অত্যধিক দামি। শেষ পর্যন্ত মেহতা গেস্ট হাউসে চারটে বাথরুম সংলগ্ন ঘর প্রত্যেকটা ৫৫০ টাকা দিন প্রতি ব্যবস্থা করতে পারলাম। তার পর সকলকে নিয়ে এসে ভাগাভাগি করে ঘরে ঢুকলাম।
ঘর বেশ ভালই যদিও একটু ছোট। আমাদের ঘরের সামনে বারান্দা আর সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে নিচেই প্রচণ্ড গর্জন সহ তীব্র বেগে অলকনন্দা ছুটে দক্ষিণ দিকে চলেছে। বাঁদিকে গুরদ্বারার সাত তলা বিশাল বাড়ি (চিত্র-২, গোবিন্দঘাটে গুরদ্বারা ও অলকনন্দার ওপর লোহার ঝোলা সেতু) একেবারে প্রায় নদীর ওপর থেকেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।

চিত্র-২, গোবিন্দঘাটে গুরদ্বারা ও অলকনন্দার ওপর লোহার ঝোলা সেতু

পাহাড়ের পাথরের উপরে গড়া হয়েছে, আমাদের এখানকার মতো মাটিতে হলে অনেক কাল আগেই নদী ধুয়ে নিয়ে যেতো। তবে পাহাড়ে এত উঁচু বাড়ি, কেমন যেন চোখে লাগে। গুরদ্বারার লাগোয়াই অলকনন্দার উপর ওপারে যাবার ঝোলা ব্রিজ। স্মাইথও এই ব্রিজের কথা লিখেছেন, তবে মনে হয় তার পর এর সংস্কার অথবা পরিবর্তন হয়েছে। কারণ তিনি এর খুবই করুণ অবস্থা দেখেছিলেন। এখন এর অবস্থা মোটামুটি ভালই।

নদীর ওপারেই পাহাড় দূরকে ঢাকা দিয়ে দিয়েছে। এই পাহাড়ের গা বেয়ে নদীর সমান্তরাল পায়ে চলা পথ এবং পাহাড়ের সঙ্গেই লক্ষ্মণ গঙ্গা বরাবর অলকনন্দাকে পিছনে রেখে দক্ষিণ দিকে ক্রমশ: মিলিয়ে গেছে। প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে তবে পায়ে চলার রাস্তা বরাবর বৈদ্যুতিক আলো, সোলার সেলের। সেই আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যাত্রীর সারি, বেশির ভাগ যাত্রী পায়ে হেঁটে আসছে। কিছু যাত্রী ঘোড়ায়। সকলেই নেমে আসছে। রাস্তার যে আলো, আগেকার অভিজ্ঞতা থেকে জানি তা বেশি দূর পর্যন্ত নেই। বৃষ্টি এখনও পড়ছে, অবশ্য পরিমাণ খুবই অল্প। জানি না কাল সকালে আমরা আকাশের অবস্থা কি রকম পাবো। গত বার হাঁটবার আগের দিনের ভোর থেকে মুষল ধারায় বৃষ্টি পড়েছিলো, তাই আমাদের যাত্রায় বেরোতে খুবই দেরি হয়ে গিয়েছিলো।

আপনারা যদি মনে করে থাকেন যে যাত্রীরা সব ফুলের উপত্যকা দেখে ফিরছে, তা কিন্তু ঠিক নয়। এদের মধ্যে ১% যাত্রীও সেই উপত্যকা দেখতে যাননি। ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স পৃথিবীতে বিখ্যাত হবার প্রায় একই সময়ে প্রচারিত হয় দশম শিখ গুরু গোবিন্দ সিং-এর পূর্ব জন্মের তপস্থলি, লোকপাল হ্রদ যা ফুলের উপত্যকার কাছেই অবস্থিত। এই গোবিন্দঘাট অভিমুখী যাত্রীরা প্রায় সকলেই সেই হ্রদ, যাকে এখন হেমকুণ্ড নাম দেওয়া হয়েছে, দর্শন করতে গিয়েছিলেন। আমরা যে জায়গায় এসেছি, অর্থাৎ গোবিন্দঘাট, তাও বেশ নতুন জনপদ, যখন থেকে শিখ যাত্রীরা হেমকুণ্ড যেতে আরম্ভ করেছেন তখন থেকেই এই জায়গা অর্থাৎ অলকনন্দা ও লক্ষনগঙ্গার সংগমস্থলের নাম গোবিন্দঘাট বলে পরিচিত হয়ে উঠেছে। স্মাইথ যদিও ১৯৩৭ সালে দ্বিতীয়বার ফুলের উপত্যকায় যাবার সময় এই জায়গা দিয়েই গিয়েছিলেন কিন্তু তিনি এখানকার কোনও নাম উল্লেখ করেননি। উমাপ্রসাদবাবুর লেখায় এই প্রসঙ্গে কিছু কথা আছে। ‘হিমালয়ের পথে পথে’-র ‘লোকপাল নন্দনকানন’ অংশে উনি লিখছেন,

“ঘাট-চটী ও পাণ্ডুকেশ্বরের মাঝপথে-অর্থাৎ দুদিক থেকেই এক মাইল দূরে-পথের পাশে একটি ছোট ঘর। আজ কয় বছর আসা-যাওয়ার পথে উৎসুক নয়নে দেখতে যাই। চোখে পড়ে, কেমন করে ছোট ঘর ধীরে ধীরে বড় হয়। একতলার উপর দোতলা ওঠে। মাথার ওপর গম্বুজও তৈরী হয়।-----
ক্রমে ক্রমে যাত্রাপথের মুখে-এই ‘গোবিন্দ-ঘাট’ গড়ে উঠল। গুরুদ্বারা জাগল-নবীন তীর্থ-পথের তোরণ
হয়ে সুন্দর একটি ধর্মশালাও তৈরী হল।---”

এই লেখা ১৯৬২ সালের। তিনি সম্ভবত এর দুই-এক বছর আগেই ফুলের উপত্যকায় গিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে আমার অগ্রজ এই পথে নন্দনকানন গিয়েছিলেন। তিনি দেখেছিলেন তখনও গোবিন্দঘাটের গুরদ্বারা সংলগ্ন ধর্মশালার নির্মাণ কাজ চলছে। আর আমরা ২০০৭ দেখেছি ও ২০০৯ সালে দেখছি যে এই ধর্মশালার উন্নতিসাধন সমানে চলেছে। যাই হোক, আগেই অবশ্য বলেছি, পাহাড়ে এই ধরনের বিরাট বাড়ি, কেমন যেন বেমানান। তবে হেমকুণ্ড যাবার পথের যা কিছু উন্নতি সাধন হয়েছে, তা এই শিখ তীর্থ যাত্রীদের জন্যেই। হেমকুণ্ড আর নন্দনকাননের ১৩কিমির কিছুটা বেশি পথ একই। এই দূরত্বের পরই রাস্তার পশ্চিম দিকে নন্দনকাননের প্রবেশ পথ, আর হেমকুণ্ডের রাস্তা ওইখান থেকে উত্তরে আরও ৫কিমি এগিয়ে গেছে।

আমি আপনাদের মেহতা গেস্ট হাউসের বারান্দায় দাঁড় করিয়ে সামনের দৃশ্য সম্পর্কে বলতে বলতে পুরানো কথা বলা আরম্ভ করেছিলাম। আর একটা বিষয়ের কথা বলে আবার সামনের দৃশ্যের বর্ণনায় ফিরে যাব। এই লেখার প্রায় প্রথম দিকে ফুলের উপত্যকাকে নন্দনকানন বলার পিছনে কারণের কথা পরে বলবো বলেছিলাম। সেই কাহিনির কথা এবার বলি। সম্ভবত ১৯৫০ সাল নাগাদ বুদ্ধ বসু নামে এক পর্যটক ভুইন্দর উপত্যকার সাদা-কালো চলচ্চিত্র তুলে এনে প্রায় সারা ভারতে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে সর্বসাধারণদের দেখাতেন। আমার মা এই চলচ্চিত্র দেখেছিলেন। বুদ্ধবাবুই এই উপত্যকার নাম ‘নন্দন কানন’ রেখেছিলেন। সেই চলচ্চিত্রের কি হলো বা সেই বুদ্ধবাবু সম্পর্কে কোনও খবর আমি কিছু জানতে পারিনি। উমাপ্রসাদবাবুও এনার কথা বলেছেন। শুনেছি যে এই চলচ্চিত্র নাকি তাঁর তোলা নয়, তাঁকে স্মাইথ দিয়েছিলেন। এই কথারও কোন প্রমাণ অবশ্য আমি পাইনি। তবে তা না হবারই সম্ভাবনা বেশি কারণ স্মাইথের ভ্রমণ কাল ১৯৪০-এর আগে আর বুদ্ধবাবুর সম্ভবত ১৯৫০-এর আশপাশে।

এবার মেহতা গেস্ট হাউসের বারান্দায় আপনাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসি। নদীর এপারে বারান্দার ঠিক নিচে বেশ কিছু গাছপালা রয়েছে, তার মধ্যে একটা ফল ধরা আখরোট গাছও আছে (চিত্র-৩, গেস্ট হাউসের নিচে আখরোট গাছ)।

ডান দিকে একটু নিচেতে এক বাড়ির বেশ বড় ছাদ, তার ওপর অসংখ্য মোটর সাইকেল আর কিছু স্কুটার দাঁড় করানো (সম্ভব হলে চিত্র-১ expand করে এই দ্বিচক্রযান রাখার জায়গা দেখতে পারেন)। এগুলো সবই হেমকুণ্ডের শিখ তীর্থযাত্রীদের। গত বার এখানে কয়েকজন যুবক তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। তারা বেশ ৬/৭ জন বন্ধু মিলে কানপুর থেকে এসেছিল। অধিকাংশ অবশ্য পাঞ্জাব, হরিয়াণা, গুজরাট, রাজস্থান ও দিল্লি থেকে আসেন।
ইতিমধ্যে প্রায় রাত ৯টা বেজে গেল। আমরা নিচের রেস্তোঁরায় রাতের খাবার খেয়ে পরের দিনের যাত্রার কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

যে সমস্ত জিনিসপত্র না নিলেই নয়, সেগুলো পিঠের বা কাঁধে নেবার মতো ব্যাগে ভরে আলাদা করে নেওয়া হলো। অন্যান্য জিনিস তালা দেওয়া বাক্সে ও ব্যাগে ভরে গুরদ্বারার ক্লোক-রুমে রেখে দিলাম। গোবিন্দঘাটে ক্লোক-রুম কেবল মাত্র গুরদ্বারাতেই আছে। কোনও হোটেলে আছে বলে শুনিনি, অন্তত মেহতা গেস্ট হাউসে নেই। গুরদ্বারায় সকলকেই ক্লোক-রুমে জিনিস রাখতে দেয়, এবং তা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে। ব্যবস্থা খুবই ভাল ও বিরাট। আমার মনে হলো অন্তত ২০,০০০ মানুষের জিনিস-পত্র রাখার মতো জায়গা আছে। এই সুযোগে জানাই যে গুরদ্বারায় যাত্রীদের ব্যবহারের জন্যে অতিরিক্ত কম্বল এক অফিস ঘর থেকে দেওয়া হয়ে থাকে। সেই ঘরে প্রচুর কম্বল ঘরের মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত ঠাসা দেখেছিলাম। প্রশ্ন করে জেনেছিলাম যে ২০,০০০ কম্বল রাখা আছে এবং জুন মাসে এত বেশি সংখ্যক যাত্রী আসেন এবং শীতের কারণে কোন কোন দিন সব কটা কম্বলই ব্যবহার হয়। গত বার যখন আমি এখানে রাত্রিবাসের কারণে কম্বল নিতে গিয়েছিলাম, কেবল মাত্র আমার নাম আর পশ্চিম বঙ্গ থেকে আমি এসেছি এই কথা তাঁদের নথিভুক্ত করতে দেখে আমি প্রশ্ন করেছিলাম যে যদি কোনও যাত্রী কম্বল ফেরৎ না দিয়ে চলে যান তা হলে কি করেন। তাঁদের উত্তর ছিল, “এয়সা কভী নহি হুয়া, ভলা হী ইয়াত্রী কম্বল ওয়াপাস ন কিয়ে হোঁ, লেকিন ওয়ে রুম মে হী পড়ি রহতি হয়। অরে ওয়ে অপনা সামান হী নহী লে যা পাতেঁ হয় তো ক্যা কম্বল লে যায়েংগে।”

কেন জানিনা বেশিরভাগ সময়ে যতই চেষ্টা করি, ভোর বেলায় আমাদের যাত্রা শুরু করা হয়ে ওঠে না। এই দিন বেশ ভোরেই আমরা ঘুম থেকে উঠলাম কিন্তু কেমন ভাবে যে সময় কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। বারান্দা থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম যেন যাত্রীদের মিছিল চলেছে। তার আগেই অলকনন্দার গভীর গর্জনের মধ্যেও যাত্রীদের ‘সত্‌ শ্রী আকাল’, ‘ওয়াহে গুরু’ ইত্যাদি ধ্বনি দিতে দিতে যাত্রা শুরু করার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। হোটেলের বারান্দায় এসে নদীর অপর পারে যাত্রীদের মিছিলের ভিডিও নিলাম ।

আমরা নিজেদের সঙ্গে রাখবার জন্যে যা নিলাম, তার সবটাই যে আমরা নিজেরা বইতে পারব হাঁটার সময়, তা কিন্তু নয়। তাই একজন পোর্টার সঙ্গে নেবার চেষ্টা করলাম, অলকনন্দার ওপর সেতু পার করার পর। সেতুর আগেই ঘোড়া বা পোর্টারের নেবার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু এখানে যাত্রীর ভিড় বেশি থাকার জন্যে পোর্টার পাবার অসুবিধে হচ্ছিল বলে আমরা সেতু পার করে চলে এলাম। এখানে এক পোর্টার পাওয়া গেল যে আমাদের ৮জনের মোট ৬টি ব্যাগ নিয়ে যাবে ৬০০ টাকায়। অচিন্ত্য (পাল) তার রুক-স্যাক নিজেই পিঠে নিয়ে যায়, অমরনাথেও সে তাই করেছে আর আমার ভগিনীপতি কমল আমাদের ব্যাগের মধ্যে তার অতিরিক্ত জিনিষ দিয়ে ব্যাগের সংখ্যা কমিয়ে দিলো। শেষ পর্যন্ত আমাদের হাঁটা আরম্ভ হলো ২২শে জুলাই, ২০০৯, সকাল ৯:১৫ মিনিটে। আকাশে মেঘ, যদিও মনে হলো বৃষ্টি নামার আশু সম্ভাবনা নেই।

আপনারা জানেন যে আমাদের গন্তব্য ফুলের উপত্যকা, কিন্তু কোন রাস্তায় হাঁটবো? অর্থাৎ কতটা হাঁটবো, বা কতটা দূরে এখান থেকে আমাদের সেই গন্তব্য স্থল, তা কিছুই আপনাদের জানানো হয়নি। মনে মনে চলুন না আমাদের সঙ্গে, তা হলেই জানতে পারবেন সব কিছু। ফুলের উপত্যকা ও তার আশ-পাশের এলাকা নিয়ে একটি মানচিত্র এই পথ বুঝতে সাহায্য করবে (চিত্র- ৪, জাতীয় উদ্যানের মানচিত্র, চিত্র-৫, অনেকটা এলাকা নিয়ে মানচিত্র)। চিত্র-৪-এ মানচিত্রের নিচের দিকে ঘাঙরিয়া থেকে পথ আর চিত্র-৫-এ একেবারে সেই যোশিমঠ থেকে প্রথমে গাড়িচলা পথ ও পরে হাঁটা পথ দেখানো আছে।

চিত্র- ৪, জাতীয় উদ্যানের মানচিত্র

চিত্র-৫, অনেকটা এলাকা নিয়ে মানচিত্র

(চলবে)

পরের পাতা

ড. শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।