বাংলা কবিতার এক প্রাথমিক পাঠ

কবিতা
লেখা হয় দুই উপায়ে, ছন্দের সাথে অথবা ছন্দ ছাড়া। অধিকাংশ বাংলা
কবিতা লেখা হয় ও হয়েছে ছন্দের ব্যবহারে, এবং বাংলার ভান্ডারে রয়েছে
বিবিধ ছন্দ-রতন। মনোহরণ উদাহরণ দিয়ে সেইসব ছন্দ ও তাদের রূপ ও
রীতি পাঠকের কাছে পেশ করার উদ্দেশ্যে এই রচনার আয়োজন। কবিতা ভালবাসেন
এমন অনেকের ছন্দকে আলাদা করে জেনে নেয়ার সুযোগ হয়নি। বর্তমান লেখক
তাদের একজন। ছন্দ না জানায় ভালোলাগা কবিতাও পুরোপুরি বোঝা হয় না।
মুশকিল দূর করার ইচ্ছেয়, ছন্দ নিয়ে পড়াশুনো করার এক পরিকল্পনাকে
মনে ধরে রেখেছি অনেকদিন। ইদানিং কালে সংকল্পটি কাজে রূপায়ণ করায়
আমার কবিতা শিক্ষার রূপান্তর ঘটে। সেই শিক্ষা লিপিবব্ধ হয়েছে এই
লেখায়। আশা করছি লেখাটি পড়তে গিয়ে, কিছু পাঠক ছন্দকে জানবার সু্যোগ
পাবেন আর একবার।তথ্যমূলক
এই লেখার প্রস্তুতি হয়েছে কিছু বই, প্রবন্ধ ও ব্যক্তির সহায়তায়।
কৃতজ্ঞতার সাথে তাদের পরিচয় দেয়া হয়েছে রচনার শেষ অংশে। ছন্দ-জড়িত
উপকরণদের লক্ষণ বোঝাতে গিয়ে এদের সাহায্য বিশেষ ভাবে কাজে এসেছে।
চলতি
ধারণায় ছন্দ বিষয়টি শক্ত এবং ব্যাকরণের আওতায় পড়ে। কলেজে বাংলা
অনার্স প্রোগ্রামের ছাত্রছাত্রীরা শেখে ছন্দের রীতি নীতি। আর সবার
জন্য থাকে “নিজে শেখ”। সেই আগ্রহ মেটানর অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা হল
- আমার মত সাধারণ পাঠকের সুবিধার্থে, ছন্দের শিক্ষাকে পাঠ্য-পুস্তকের
চৌহদ্দি থেকে মুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে। প্রস্তাবটি পুরোনো, এবং
তাকে কার্যকর করতে গিয়ে কিছু সাহিত্য পত্রিকায় ছন্দ-জড়িত প্রবন্ধের
প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু সে সংখ্যা অল্প। পত্র-পত্রিকার সম্পাদকেরা
সমর্থন করলে এই জাতীয় রচনার প্রকাশ আরো অধিক সংখ্যায় হতে পারে,
এবং লাভ সর্বজনের। ম্যাগাজিনে স্থান পাওয়ার উদ্দেশ্যেই বর্তমান
লেখার সৃষ্টি। আশা থাকছে ছন্দকে সহজ ভাবে বোঝাতে গিয়ে আরো লেখক
ছোট বড় লেখা লিখবেন, এবং সমবেত প্রচেষ্টায় ছন্দ সবার জন্য সহজগম্য
হয়ে উঠবে।
শুরুতে
রচনার ছকটি জানিয়ে রাখি। বিষয়গুলি উপস্থাপন করা হয়েছে পরিচ্ছেদ
তথা সেক্শন্(section) দিয়ে ভাগ ও সূচীযুক্ত (indexed) করে। এজন্য
পাঠকের সুবিধে হবে এক-এক বিষয়কে খুঁজে নিতে ও এক বিষয় থেকে অন্য
বিষয়ে চলে যেতে। প্রথম পরিচ্ছেদে রয়েছে কবিতার ও ছন্দের সংজ্ঞা
সম্পর্কিত কয়েক কথা। যে সব উপকরণ দিয়ে ছন্দের নির্মাণ হয় তাদের
পরিচয় দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে। ছন্দের রীতি ও রূপ সম্পর্কিত মূল আলোচনা
রয়েছে তৃতীয় ও চতুর্থ সেক্াশনে।
১।
ছন্দের সংজ্ঞা
কবিতার
সংজ্ঞা নিয়ে খোঁজ করলে জানা হয় কবিতা কল্পনামূলক, প্রকাশ করে লেখকের
অনুভব ও আবেগ। সাহিত্যের অন্যান্য ধারার তুলনায় সে অনেক স্বাধীন,
চরিত্র বা প্লটের বাঁধন থেকে মুক্ত। যে অনুভূতি ও কল্পনা প্রকাশ
পায় কবিতায়, তাদের মনে করা হয় কবিতার মর্ম। বিমূর্ত সে চেতনার
রূপ দেয়া হয় শব্দ চয়নে ও ধ্বনি বিন্যাসে, এক-এক পঙ্ক্তি লেখার
মাধ্যমে। সে কাজের অন্যতম উদ্দেশ্য, কবিতায় শ্রুতিমধুরতা আনা।
শব্দদের স্বর-সঙ্গতি কবিতায় সৃষ্টি করে শ্রুতিনির্ভর এক তরঙ্গ,
যার নাম ছন্দ। তরঙ্গায়িত সে ধ্বনির আবেদন মনকে স্পর্শ করে, কবিতা
পড়ার সময়ে যখন কান দিয়ে (শুনে) পড়াই প্রধান কাজ।
মনোরম ছন্দে বহু কবিতা লিখেছিলেন শ্রী সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, এবং
বিশেষ খ্যাতি পেয়েছিলেন ছন্দের যাদুকর নামে। তার লেখা কবিতা ‘পাল্কীর
গান’। নিচে কবিতাটির অংশ বিশেষের উদ্ধৃতি করা হল তিনটি আলাদা কলামে।
পাল্কী
চলে! |
ময়রা মুদি
|
আসছে কা’রা’ |
পাল্কী চলে!
|
চক্ষু মুদি’ |
হন্ হনিয়ে? |
গগন-তলে |
পাটায় বসে |
হাটের শেষে |
আগুন জ্বলে! |
ঢুলছে ক’ষে। |
রুক্ষ বেশে |
----------- |
----------- |
ঠিক দু’পুরে |
|
|
ধায় হাটুরে!
|
অংশগুলি
পড়তে পড়তে অনুভব হয় এক ধ্বনি-তরঙ্গের। সে কানে আনে এক আওয়াজ, যা
পাল্কী কাঁধে চলতে গিয়ে বেহারারা করে শরীরে দোলা দিয়ে। কবিতার
চিত্র, কোন গাঁয়ে এক রোদ জ্বলা দুপুরে প্রায় নিশ্চল জীবন। তাতে
গতি আনে পাল্কী বাহক বেহারা আর হাটুরে, যাদের চলা হন্ হনিয়ে। আমাদের
চেতনায় অনায়াসে জায়গা করে নেয় চলার সেই ধ্বনি।
কোন
শিল্প প্রদর্শনে থাকে ভাব (content) আর গঠন (form)। কবিতার ক্ষেত্রে
ভাব ও গঠন বোঝায় কি বলা হবে এবং কোন ভাবে বলা হবে। ছন্দ দেখায়
বলার ধরন আর গঠনের পরিকল্পনা। যে নকশায় শব্দ ও সহযোগী ধ্বনি সাজান
হয় এক-এক ছত্রে, তার ছাঁদ বা প্যাটারন্ (pattern) কে বলা হয় ছন্দ।
ছন্দোবদ্ধ রচনায় প্যাটারনটির ব্যবহার হয় সমান ভাবে। ছন্দে লেখার
বিপরীত রীতিতে তৈরী হয় মুক্তছন্দের বা ফ্রি ভার্সের কবিতা, যার
গঠনে শৃঙ্খলা বা প্যাটারন্ মানা হয়না কিন্তু ধ্বনিমাধুর্য রাখা
হয় বিশেষ যত্নে।
বাংলায় ‘শব্দ’ দুই অর্থ বোঝায়, কথা (word) ও ধ্বনি (sound)। এই
লেখায় শব্দ কথাকে বুঝিয়েছে।
সঙ্গীত
ছন্দোবদ্ধ, যাতে থাকে সুর, তাল ও প্রয়োজন মতো কথা। সঙ্গীতে সুরের
ছন্দ মুখ্য, কথার ছন্দ গৌণ। কবিতার ছন্দ, কথার উচ্চারণে। সঙ্গীতে
‘সুরধ্বনি সাজান হয় পরিমিত ও নির্দিষ্ট প্যাটার্নে্’, যার নাম
তাল। কবিতায় ‘শব্দ সাজান হয় পরিমিত ও নির্দিষ্ট প্যাটার্নে্’,
যার নাম ছন্দ। তাল এক নির্দিষ্ট জায়গা থেকে শুরু করে, এক সময় মাফিক
চলন শেষ করে, আবার সেই জায়গায় ফিরে আসে। কবিতায় ছন্দের গতিও থাকে
এক সময় মাফিক চলনে। দেখা যাচ্ছে তাল যে কাজ করে সঙ্গীতে, ছন্দ
সে কাজ করে কবিতায়।
ছন্দের
উপযোগিতা বলতে বোঝায় শুনতে ভালো লাগা, সহজে মনে রাখা ইত্যাদি।
এসব গুণের প্রমাণ মেলে, যখন দেখি শিশু বয়সের শোনা ছড়া ও নার্সারি
রাইম্ মনে আসে স্বচ্ছন্দে। সহজে মনে পড়ে ছোট বয়সে পড়া কিছু বাংলা
কবিতা- শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমাদের ছোট নদী’, উপরের ‘পাল্কী
চলে’ প্রভৃতি। নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, ছন্দের দৌলতেই এদের ধ্বনি
মাধুর্য স্মৃতির মাঝে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
‘ছোট
খোকা বলে অ আ, শেখেনি সে কথা কওয়া’ দিয়ে যে বইটির শুরু, রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের লেখা ‘সহজ পাঠ’, তার সহায়তায় শুরু হয়েছিল আমাদের অনেকের
বাংলা শেখা। সে বইয়ের কবিতা “আমাদের ছোট নদী”। মিল ও চিত্রময়ী
বর্ণনার গুণে, সে নদীর কথা মনে থাকে সহজে। জানবার ইচ্ছে হয়, কোন
ছন্দে কবিতাটি লেখা হয়েছিল? কবিতাটির প্রথম অংশ-
আমাদের ছোট
নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
কবিতাটির
ছন্দকে জানার চেষ্টা হয়েছে ছন্দ-রীতির আলোচনায়, তৃতীয় পরিচ্ছেদে।
২।
ছন্দের উপকরণ
ছন্দের
উপকরণ বলতে বোঝায় ধ্বনি, বর্ণ, দল, মাত্রা, যতি, পর্ব, পদ, মিল
প্রভৃতি যাদের দিয়ে তৈরী হয় ছন্দের রীতি ও রূপ।
২-১
ধ্বনি ও বর্ণ
ছন্দ
কানে শোনার জিনিস। তাকে চিনতে গিয়ে শুনতে হয় শব্দের মধ্যবর্তী
ধ্বনিদের, বুঝতে হয় তাদের গুণগত রূপ, এবং সেই বিচারে আশ্রিত ধ্বনির
উচ্চারণকে জানা আবশ্যক। অনেক ক্ষুদ্র শব্দের উচ্চারণেও শোনা হয়
ধ্বনিগুচ্ছ। তাদের বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় উচ্চারণ কার্যকর হচ্ছে
এক ধ্বনির সাথে অন্য ধ্বনি জোড়া দিয়ে। আশ্রিত ধ্বনি বলা হয় প্রধান
ধ্বনির সহযোগী ধ্বনিকে।
ধ্বনির
লিখিত রূপ বর্ণ বা হরফ। স্বরবর্ণ শোনায় স্বরধ্বনি। অ থেকে ঔ পর্যন্ত
এগারটি স্বরবর্ণের নয়টি মৌলিক স্বরধ্বনি। বাকি দুই স্বরধ্বনি ঐ
এবং ঔ যাদের উচ্চারণ হয় ধ্বনি মিশ্রণে। ঐ (অ+ই) এবং ঔ (ও+উ) কে
যুগ্মস্বর (dipthong) বলে জানা হয়।
ব্যঞ্জনবর্ণের
উচ্চারণ হয় স্বরধ্বনির আশ্রয় নিয়ে। উচ্চারণে ‘ক’ হয় ক্+অ, ‘গ’
হয় গ্+অ, ইত্যাদি। অ-ধ্বনি ছাড়া ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ হয় দুভাবে।
প্রথম উপায়, ব্যঞ্জনধ্বনির শেষে অধিক ঝোঁক বা চাপ দেয়া। ঝোঁকটা
লক্ষ করান হয় শব্দ শেষের বা মাঝখানের ব্যঞ্জনবর্ণর নিচে হসন্ত
চিহ্ন ্ দিয়ে। উচ্চারণে ্ চিহ্ন শোনায় ‘হসন্ত’ ধ্বনি। যেমন: ভাগ্,
ধিক্, নক্শা, রাইম্ ইত্যাদি। দ্বিতীয় উপায়, অনেক শব্দর শেষ ব্যঞ্জনবর্ণর
উচ্চারণে সহযোগী অ-ধ্বনিকে বাদ দেয়া। যেমন: কাজ, যে ‘কাজ+অ’ নয়;
এবং তল, যে ‘তল+অ’ নয়।
এক
বর্ণ অন্য বর্ণের সাথে যুক্ত হলে আশ্রিত বর্ণের আকৃতি সংক্ষিপ্ত
হয়ে যায়। স্বরবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপকে বলা হয় ‘কার’, যেমন আ= া,
ই = ি, উ = ু প্রভৃতি। নিয়মটির ব্যতিক্রম হল অ-স্বরবর্ণ, যার ‘কার’
চিহ্ন নেই। একাধিক ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্ত হয়ে সৃষ্টি করে যুক্তবর্ণ,
যার মধ্যে বর্ণেরা সংক্ষিপ্ত আকার নেয়। যুক্তবর্ণের নমুনা: ল্ক=[ল+ক],
শ্ব=[শ+ব] ও ন্দ=[ন+দ]। ‘য’ ও ‘র’ অন্য ব্যঞ্জনবর্ণের সাথে যুক্ত
হয়ে যে সংক্ষিপ্ত রূপ নেয় তাকে বলা হয় ‘ফলা’। যেমন: ‘ন্য’ তে য-ফলা
এবং ‘ম্র’ তে র-ফলা।
বর্ণের
যুক্ততায় ধ্বনির পরিবর্তন হয়। যুক্তবর্ণের ধ্বনি, হসন্ত ধ্বনি
প্রভৃতির বিচারে স্থির হয় আশ্রিত ধ্বনির সঠিক উচ্চারণ।
২-২
সিলেবল্ ও দল
শব্দের
উচ্চারণ ও বানান ভিন্ন ভাবে হয়। কোনো কথার উচ্চারণ সঠিক কিনা সেটার
বিচার হয় চলিত উচ্চারণের ধারায়। কথিত হয়ে শব্দ যে আকৃতি নেয় তাকে
দেখা হয় ফোনেটিকস্ (phonetics) এর পদ্ধতি অনুসারে, যে কাজে শব্দ-ধ্বনিদের
ছোট ছোট টুকরোয় ভাগ করে অংশগুলিকে সিলেবল্ (Syllable) নাম দেয়া
হয়। যেমন কোকিল শব্দর উচ্চারণ হয় দু-ভাগে, ‘কো’ এবং ‘কিল’। এরকম
প্রতি শব্দ আমরা ভাগ-ভাগ করে উচ্চারণ করি, আর প্রতি ভাগ এক সিলেবল্।
শব্দকোষ অনু্যায়ী- একটি শব্দকে কথিত করার সময়ে, জিহ্বা এক জায়গায়
স্থির রেখে উচ্চারণের স্বল্পতম চেষ্টায়, শব্দর যে অংশটুকুর ধ্বনি
শুনতে পাওয়া যায় তাকেই সিলেবল্ বলা হয়।
শব্দ
উচ্চারণের এই স্বল্পতম চেষ্টায় স্বরধ্বনির উপস্থিতিই লক্ষ্য করা
যায়। উচ্চারণে কোকিল হয়ে যায় কো ৹ কিল। কো এবং কি শোনায় ‘ও’ আর
‘ই’ স্বরধ্বনি। এখানে বুদবুদ ৹ চিহ্ন দিয়ে সিলেবল্ দের দেখান হল।
এক শব্দে যত সিলেবল্ আছে সে সংখ্যার হিসেব হয়, এই ৹ চিহ্নদের সংখ্যা
গুণে ও সাথে এক যোগ দিয়ে। সেমত, কো ৹ কিল শব্দে আছে দুটি সিলেবল্।
সিলেবয়ল্
বলতে যা বোঝায় বাংলায় দল কথাটি তাদের জানায়, সেহেতু সিলেব ল্
আর দল সমার্থক। অ, আ, সে, এই, কিল ইত্যাদি এক দল। আমি, তুমি ও
সখা শব্দ গুলিতে দুই দল। কবিতা (ক ৹ বি ৹ তা) দেখায় তিন দল। যুক্তবর্ণময়
শব্দে দলের নমুনাঃ ছন্দ (ছন্ ৹ দ), শব্দ (শব্ ৹ দ) ও রবীন্দ্রনাথ
(র৹ বীন্ ৹ দ্র ৹ নাথ)। ক্রমিক ভাবে এদের উচ্চারণ করলে শোনা হয়
দুই, দুই ও চার দলকে।
দল দুই রকম, মুক্তদল ও রুদ্ধদল। যে দলের শেষে আশ্রিত ধ্বনি নেই,
তাকে মুক্তদল (Open Syllable) বলা হয়। যেমন- অ, আ, ক, খ, সা, রে
প্রভৃতি। মুক্তদলের উচ্চারণ হয় মুখ খুলে এবং মুক্ত কথাটি সে অবস্থা
বোঝায়। মুক্তদলে থাকে মৌলিক স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণ।
যে দলের শেষে আশ্রিত ধ্বনি থাকে সে রুদ্ধদল (Closed Syllable)।
যেমন- এক, কাজ, গান, তল, এই, বউ, শক্, ধিক্, প্রভৃতি। আশ্রিত ধ্বনির
উৎস ব্যঞ্জনবর্ণ বা স্বরবর্ণ হতে পারে। রুদ্ধদলের উচ্চারণ টেনে
করা সম্ভব নয়, আশ্রিত ধ্বনিতে সে ফুরিয়ে যায়। উচ্চারণ শেষে মুখ
বন্ধ হয়ে যায়, এবং ‘রুদ্ধ’ কথাটি সে অবস্থা বোঝায়।
২-৩
মাত্রা
মাত্রা
সময়ের এক একক (unit), যার মাপে গোনা হয় ধ্বনিগুচ্ছের উচ্চারণ কাল।
কবিতায় এক সারির মধ্যকার যে ধ্বনিপ্রবাহ, তার ক্ষুদ্রতম অংশের
উচ্চারণে যে সময় লাগে সেটা হল মাত্রা। সঙ্গীতেও মাত্রার সংজ্ঞা
এক রকম, ধ্বনির ছোট্ট এককের প্রক্ষেপে যে সময় নেয়া হয় তার পরিমাপক।
যদি বলা হয় এক ও দুই মাত্রার ধ্বনি, তখন প্রথম ধ্বনির উচ্চারণ
হবে দ্বিতীয়টির অর্ধেক সময়ে। কবিতার ছন্দ হয় নানা ধাঁচে, এবং তাদেরকে
মাত্রা সাজানোর এক-এক কাঠামো বলে মনে করা হয়।
ইতিপূর্বে
তাল ও ছন্দের পরিচয়ে বলা হয়েছে, কবিতায় যাকে বলা হয় ‘ছন্দ’ সেইই
সঙ্গীতের ‘তাল’। একই রচনাকে কবিতা হিসেবে পড়ার ছন্দ আর গানে গাওয়ার
তাল একেবারে আলাদা হতে পারে। কবিতাকে সঙ্গীতে রূপ দেয়া হয় তার
শব্দদের উপর সুর বসিয়ে। তখন সুরের নমনীয়তায় কবিতার ছন্দ যায় বদলে।
সুর-বিন্যাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গীতরূপের তালকে বাঁধা হয়। বাংলায়
বহু রচনা আছে যাদের প্রথম প্রকাশ কবিতায়, কিন্তু তাদের গীতরূপের
পরিচয়ই প্রধান। দৃষ্টান্তঃ ভারতবর্ষের জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় স্তোত্র্র
(‘বন্দে মাতরম্’), উপরোক্ত ‘পাল্কীর গান’, নজরুল ইসলামের ‘দুর্গম
গিরি কান্তার মরু’ ইত্যাদি। সবকটি নমুনায় গীতের তাল ও কবিতার ছন্দ-জনিত
তাল ভিন্ন।
২-৪
দল ও মাত্রা
একটি
শব্দ যখন কথিত হয়, তার এক-এক দলকে উচ্চারণ করতে যে সময় লাগে, সেই
সময়কে বলা হয় দলের মাত্রা। দলের মাত্রামূল্য ধার্য হয় তার আলাদা
উচ্চারণে। শব্দের উচ্চারণ-কাল নির্ণয় করা হয় তার মধ্যবর্তী দলেদের
মাত্রামূল্য যোগ দিয়ে। কোকিল শব্দের উচ্চারণে, দুটি দল ‘কো’ এবং
‘কিল’ চিহ্নিত হয়েছিল। যদি ধরা হয় দল দুটির মাত্রা ১, তাহলে বুঝতে
হবে এদের উচ্চারণ-কাল সমান সমান এবং শব্দটি ২-মাত্রার।
বলার
ভঙ্গিতে ও উচ্চারণে ধরা পড়ে দলের সংকোচন ও প্রসার, এবং সেই গুণ
অনুযায়ী তার মাত্রা নির্ধারিত হয়। মুক্ত বা রুদ্ধ দু’প্রকার দলই
সংকুচিত ভাবে উচ্চারিত হতে পারে, এবং তখন তাদের বলা হয় হ্রস্বদল
(short syllable)। উচ্চারণ সংকুচিত করার অর্থ তাকে হ্রস্ব (ছোট)
মাপে প্রক্ষেপ করা। রুদ্ধদল প্রসারিত ভাবে উচ্চারিত হলে, তাকে
দীর্ঘদল (long syllable) বলা হয়। দীর্ঘ নামটি উচ্চারণের প্রসারকে
বোঝায়। সতর্ক হয়ে উচ্চারণ করলে বোঝা যায় দলের সংকোচন (হ্রস্বতা)
ও প্রসারণ (দীর্ঘতা)।
মুক্তদলের উচ্চারণ সব সময় সংকুচিত, তাই এর মাত্রা এক। সংকুচিত
রুদ্ধদলের ধ্বনিও এক মাত্রার এবং প্রসারিত রুদ্ধদলের ধ্বনি দুই
মাত্রার। রুদ্ধদল কখন সংকুচিত বা কখন প্রসারিত হবে, সেটা নির্ভর
করে শব্দের মাঝে তার স্থান অনুযায়ী। এনিয়ে বলা হবে ছন্দ-রীতির
আলোচনায়, সেক্শন্-৩ এতে।
২-৫
যতি
কবিতার
কোনো পঙ্ক্তি বা গদ্যের কোন বাক্য পড়ার সময়ে, একটানা ভাবে উচ্চারণ
করে যাওয়া সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে থামতে হয়, নিঃশ্বাস নেয়ার সুবিধায়
অথবা অর্থকে স্পষ্ট করায়। কবিতা পড়ার কালে, সেই বিরতি (pause)
দেয়ার জায়গা করে দেয় ছেদ ও যতি। বাক্যের বা বাক্যাংশের অর্থ ফুটিয়ে
তুলতে যেখানে থামতে হয়, তার নাম ছেদ বা ভাবযতি। পড়ার সুবিধায় বা
ছন্দের প্রয়োজনে যে বিরতি দেয়া হয় তাকে বলা হয় ছন্দোযতি (caesura),
সংক্ষেপে যতি। যতি প্রধানত তিন রকমঃ পূর্ণযতি, অর্ধযতি ও লঘুযতি।
ছন্দ বিশ্লেষণে ও আবৃত্তি করে পড়ায়, যতিদের চিহ্নিত করার গুরুত্ব
বিশেষ রকম। কবিতায় পূর্ণযতি, অর্ধযতি ও লঘুযতি দ্বারা অংশ বিশেষের
সীমা নির্ধারিত হয়, এবং সে অংশগুলি যথাক্রমে পঙ্ক্তি, পদ ও পর্ব।
পরবর্তী তিন সেক্ষশনে রয়েছে এদের কথা। এক এক যতি ভিন্ন ভিন্ন
মাপের বিরতি কার্যকর করে, এবং তাদের খুঁজে নিতে হয় সতর্ক ভাবে
পড়ার মাধ্যমে। যতিদের নির্দিষ্ট চিহ্ন না থাকায় ছন্দ বিশ্লেষণের
সময়ে, আনুমানিক ও সুবিধা-জনক চিহ্ন দিয়ে তাদের দেখান হয়।
২-৬
পঙ্ক্তি ও পূর্ণযতি
ছন্দোবদ্ধ
রচনা পড়ার সময়ে, যেখানে যেখানে জিহ্বা পূর্ণ বিশ্রাম নেয় সেই সব
জায়গায় পড়ে পূর্ণযতি। এই যতিতে যে অংশ নির্ধারিত হয় তার নাম পঙ্ক্তি।
পূর্ণযতি প্রতি সারির শেষে পড়তে পারে, বা একের বেশি সারির পরেও
পড়তে পারে। যেমন,
সার্থক
জনম আমার জন্মেছি এই দেশে।
(‘স্বদেশ
- ২৪’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
এখানে
সারির (লাইনের) শেষে পড়েছে ছেদ বা ভাবযতি, আর সেখানেই পড়েছে পূর্ণযতি।
আরেক উদাহরণে,
দেখা হয়
নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।
(‘স্ফুলিঙ্গ
- ১৬৪’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
চতুর্থ
সারির শেষে পড়েছে পূর্ণযতি। এখানকার বিরতি যথেষ্ট জন্য পূর্ণযতির
সাথে পড়েছে দাঁড়ি (full stop)। বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণতা পেয়েছে
সেখানে এবং সৃষ্টি হয়েছে এক পঙ্ক্তি। ঘুরিয়ে বলি, পঙ্ক্তি বোঝায়
সে অংশের শেষটা যেখানে বাক্য পুরোপুরি প্রকাশ করে ভাবকে। এক পঙ্ক্তিতে
এক বা একাধিক সারি থাকতে পারে। ছন্দ বিশ্লেষণের সময়ে, রোমান (Roman)
হরফ I কে ব্যবহার করা হয় পূর্ণযতির নির্দেশক হিসেবে। এমত ভাবে
এই লেখাতে, I চিহ্ন দিয়ে বোঝানো হয়েছে পূর্ণযতিকে।
২-৭
পদ
পঙ্ক্তির
মাঝখানে পূর্ণযতির চেয়ে কম বিরতির জায়গাতে পড়ে অর্ধযতি। এর দ্বারা
পঙ্ক্তি ভাগ হলে পাওয়া যায় পদ। ছন্দ বিচারে, অর্ধযতি বা পদ কে
চিহ্নিত করা যেতে পারে দুই লম্বা দাগে (||)। যেমন,
মিলের চুমকি
গাঁথি || ছন্দের পাড়ের মাঝে মাঝে I
অকেজো অলস বেলা || ভরে ওঠে সেলাইয়ের কাজে। I
‘আরোগ্য
- ২৮’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অর্ধযতি
পড়েছে ‘গাঁথি’ ও ‘বেলা’ র পরে, দুই-দাগ || চিহ্নিত দুই জায়গায়,
এবং পূর্ণযতি পড়েছে I চিহ্নিত দুই জায়গায়। দাঁড়ি কাজ করছে দ্বিতীয়
পঙ্ক্তির শেষে, যেখানে বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ হয়েছে। উচ্চারণ
করে পড়ার সময়ে বোঝা হয়, অর্ধযতি থেকে যে বিরতি তার মেয়াদ পূর্ণযতির
সময় থেকে কম; এবং পূর্ণযতির জন্য যে বিরতি, তার মেয়াদ দাঁড়ির বিরাম
সময় থেকে কম।
উপরের দৃষ্টান্তটিতে ছন্দে কবিতা-লেখা ও সেলাইয়ের কাজ তুল্য মূল্য
শিল্প-সৃষ্টির মান পেয়েছে, রবীন্দ্রনাথের কলমে। উপমা দিয়ে ছন্দ
তৈরী করার উপায়ও কবি জানিয়ে দিলেন।
পদ-যতির
আরেক উদাহরণ,
এ কেবল
| দিনে রাত্রে || জল ঢেলে | ফুটা পাত্রে ||
বৃথা চেষ্টা | তৃষ্ণা মিটা | বারে। I
কহিলা ‘দে : খিতে হবে || কতখানি | দিলে তবে ||
ভিক্ষাঝুলি | ভরে একে | বারে’। I
(‘প্রতিনিধি’,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
এই
চার সারিতে রয়েছে দুটি পঙ্ক্তি। দাঁড়ি অনুসারে পূর্ণযতি পড়েছে
‘মিটাবারে’ ও ‘একেবারে’ শব্দ দুটির পর। অর্ধযতি পড়েছে প্রতি পঙ্ক্তিতে
দুবার, দুই-দাগ চিহ্নিত স্থানে। চিহ্নটি লক্ষ্য করে প্রতি পঙ্ক্তিতে
পাওয়া যায় তিনটি পদ। লাইন কটিতে ব্যবহার হয়েছে এক লম্বা দাগের
(|) ও এক (:) চিহ্নের, যাদের সম্বন্ধে বলা হবে পরের দুই সেক্লশনে।
ছন্দের
এক পঙ্ক্তিতে যতগুলি পদ থাকে সেই অনু্যায়ী পঙ্ক্তির পরিচয় হয়।
দুই পদ দিয়ে গঠিত পঙ্ক্তির নাম দ্বিপদী। পঙ্ক্তিতে তিন পদ থাকলে
সে হয় ত্রিপদী, আর চার পদেতে সে হয় চৌপদী। এক পদ নিয়েও তৈরী হয়
পঙ্ক্তি, যার নাম একপদী। উপরে প্রথম উদাহরণটি দ্বিপদী ও দ্বিতীয়টি
ত্রিপদী (‘আরোগ্য’ ও ‘প্রতিনিধি’)। চৌপদী পঙ্ক্তির দৃষ্টান্ত
রয়েছে সেক্শন্৩ এর শুরুতে।
২-৮
পর্ব
লঘুযতির
মেয়াদ অর্ধযতির তুলনায় কম। লঘুযতি দ্বারা পর্ব নির্দিষ্ট হয়, সেজন্য
পর্বযতি নামেও তার উল্লেখ। ছন্দ-সৃষ্টির প্রাথমিক কাজ পর্বের সুষম
গঠনে, এবং লঘুযতির খোঁজ করে চেনা হয় পর্বকে। এক অর্ধযতি থেকে,
কিংবা চরণের প্রান্ত থেকে, পরবর্তী যতি পর্যন্ত অংশ হল এক পর্ব।
ধরা যাক এক চমৎকার দৃষ্টান্ত,
মুক্তবেণীর
| গঙ্গা যেথায় || মুক্তি বিতরে | রঙ্গে
আমরা বাঙ্গালী | বাস করি সেই || তীর্থে—বরদ | বঙ্গে। I
(‘আমরা’,
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)
যতির
চিহ্ন অনুসরণ করলে, থেমে থেমে পড়ার ব্যপারটা ধরা পড়ে সহজে। সেমত
প্রতি সারি ভাগ করে পাওয়া হয়েছে চারটি পর্ব, যেগুলি নির্দিষ্ট
হয়েছে লঘুযতিতে এবং তাদেরকে বোঝান হয়েছে এক-দাগ দিয়ে (|)। ‘মুক্তবেণীর’,
‘গঙ্গা যেথায়’, ‘মুক্তি বিতরে’ প্রভৃতি ধ্বনিগুচ্ছ পূর্ণ পর্ব।
দুই-দাগ (||) দিয়ে দেখান হয়েছে অর্ধযতি। এক-এক বাক্যাংশ রয়েছে
এক-এক সারিতে, পূর্ণযতি কার্যকর হয়ে সৃষ্টি করেছে একটি পঙ্ক্তি,
এবং তাকে বোঝানো হয়েছে I চিহ্ন দিয়ে। মূল-পর্বর চেয়ে ছোট মাপের
যে পর্ব থাকে পঙ্ক্তির শেষে তাদের বলা হয় ভাঙ্গা-পর্ব। ‘রঙ্গে’
ও ‘বঙ্গে’ হল সেই রকম পর্ব। কবিতা পড়ার সময়ে, লাইনের শেষে পৌঁছে,
দম নেয়ার ফুরসত জোগায় ভাঙ্গা-পর্ব।
পর্ব চিনতে গিয়ে লঘুযতিকে অনুসরণ করার সাথে সাথে, সারির অংশগুলির
মাত্রা-সমতাও দেখা হয়। কারণ পর্বে পর্বে মাত্রা সমান সংখ্যায় থাকে।
পর্ব তৈরির ছাঁচ কে বলা হয় ছন্দের চাল। সেই ছাঁচে সাজান শব্দ-ধ্বনির
মাত্রাসংখ্যা দিয়ে চালের উল্লেখ করা হয়।
২-৯
যতিলোপ
যতির
প্রসঙ্গে তিন প্রধান যতির উল্লেখ হয়েছে। এরা সব সময় প্রত্যাশিত
জায়গায় স্পষ্ট ভাবে পড়ে না। ছন্দে যতির অভাবকে বলা হয় যতিলোপ।
পূর্ণযতির লোপ হয় প্রবহমান ছন্দে, যেখানে ভাব অনুযায়ী যতি পড়ে
এবং তার উদাহরণ মেলে অমিত্রাক্ষর ছন্দে। অর্ধযতিলোপের প্রয়োগ সাধারণত
দেখা যায় না। যতিলোপের ব্যবহারে লঘুযতিলোপের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি।
কারণ পর্ব চিনতে গিয়ে জানার প্রয়োজন লঘুযতি কোথায় পড়ছে, এবং সাথে
জানতে হয় কোথায় লঘুযতিলোপ ঘটছে। এই লেখায় কিছু উদ্ধৃত কবিতার অংশে
লঘুযতিলোপকে দেখা গিয়েছে, এবং তাদের দেখান হয়েছে (:) চিহ্ন দিয়ে।
উপরে ২-৭ সেক্োশনে, পদের দ্বিতীয় দৃষ্টান্তর তৃতীয় সারি-
কহিলা ‘দে : খিতে হবে || কতখানি | দিলে তবে ||
এখানে
লঘুযতিলোপ ঘটেছে ‘দেখিতে’ র মাঝে এবং সেখানে পর্বের ভাগ হয়েছে।
সারিটিতে পাওয়া হয় চার পর্ব ও দুই পদ। প্রথম সারিরগঠনও সেই ছকে,
এবং symmetry (প্রতিসাম্য) বজায় রয়েছে প্রথম ও তৃতীয় সারির মধ্যে।
লঘুযতিলোপ আবার দেখা গিয়েছে সেক্শন্৩-২, ৪-১ ও ৪-৩ এর উদ্ধৃতিতে।
২-১০
স্তবক
স্তবক
গঠিত হয় দুই বা আরো বেশি পঙ্ক্তি নিয়ে। স্তবক ছন্দের বৃহত্তম
একক, বিপরীতে মাত্রা ছন্দের ক্ষুদ্রতম একক। একটি স্তবকে কবিতার
মূল ভাবের এক অংশের প্রকাশ হয়, অন্য একটিতে পরিবেশিত হয় ভাবের
আরেক অংশ, এবং সেই মত এগোয় কবিতার রচনা। পঙ্ক্তির সংখ্যা অনুসারে
স্তবকের বিভিন্ন নাম হয়, যেমন- দ্বিক, ত্রিক, চতুষ্ক, ইত্যাদি।
নিচের দুই দৃষ্টান্তে:
দ্বিক
(Couplet) :
স্ফুলিঙ্গ
তার | পাখায় পেল || ক্ষণ কালের | ছন্দ I
উড়ে গিয়ে | ফুরিয়ে গেল || সেই তারি | আনন্দ I (‘লেখন – ৭’,
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
চতুষ্ক
(Quatrain) :
ফুলে ফুলে | ঢ’লে ঢ’লে
|| বহে কিবা | মৃদু বায়, I
তটিনী হিল্ | লোল তুলে || কল্ লোলে চ | লিয়া যায়। I
পিক কিবা | কুন্ জে কুন্ জে || কুহু কুহু | কুহু গায়, I
কি জানি কি | সের লাগি || প্রাণ করে | হায় - হায়। I (‘কাল
মৃগয়া’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
২-১১ মিল
ছন্দের
আলোচনায় মিলের কথা ওঠে প্রথমে। মিল কবিতায় আনে গতি ও ‘শুনতে ভালো
লাগা’ নামের কাঙ্ক্ষিত গুণ। দুই বা ততোধিক শব্দ সারি বা পঙ্ক্তি
শেষে যখন একই ধবনির পুনরাবৃত্তি করে, তখন সেই মিলকে বলা হয় অন্ত্যমিল।
কবিতায় অন্ত্যমিল থাকলে, তাদের মিত্রাক্ষরের কবিতা নামেও আখ্যা
দেয়া হয়। মধ্যমিল সৃষ্টি হয় সারির ভিতরে, পর্বে বা পদে, যখন এক
রকম ধ্বনির বা ধ্বনিগুচ্ছের ব্যবহার একই ধ্বনির পুনরাবৃত্তি করে।
মধ্যমিলের ব্যবহারে ‘শুনতে ভালো লাগা’ গুণের বিশেষ বৃদ্ধি হয়।
মিল দেয়ার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন রয়েছে উপরের চতুষ্কটিতে। এতে সুর দিয়ে
রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেছেন সেই অতুলনীয় গান। চতুষ্ক গঠনের এক ধারা
(AAAA) অনুসারে স্তবকটির তৈরী, যাতে একই ধ্বনির অন্ত্যমিল পড়ে
প্রতি পঙ্ক্তির শেষে। এখানে সেটা আয়-তে। মধ্যমিল আছে পঙ্ক্তিগুলির
পর্বে পর্বে, পদশেষের মিল প্রথম ও দ্বিতীয় পঙ্ক্তির প্রথম দুই
পদে। ফলস্বরূপ, অনুপ্রাসের ছড়াছড়ি সর্বত্র।
এখনকার কালের কবিতায় মিলের ব্যবহার দেখানর উদ্দেশ্যে, এক উদাহরণ
নেয়া হল তরুণ ও জনপ্রিয় এক কবির লেখা থেকে।
বিন্দুমাত্র ভয় নেই
| ইন্দুমাত্র উঠেছে আকাশে ||
সিন্ধুমাত্র জল, তাতে | দিনদুয়েক চান করা যাবে I
তারপর রহস্য শেষ | রেশনের চাল মাসে মাসে... ||
সুরায় ফুরাবে ইচ্ছা | (সে নেহাত পাত্রের অভাবে) I
(‘রসদ’,
শ্রীজাত)
স্তবকটি
দেখায় তিন জাতীয় মিলের - আদ্য, মধ্য ও অন্ত্য। যুক্তবর্ণের ধ্বনিগুচ্ছ
‘বিন্দু’ ও ‘ইন্দু’ আনে মধ্যমিল, প্রথম সারিতে। "সিন্ধু"
(মাত্র)-র সঙ্গে "দিনদু" (য়েক) শোনায় আর এক মধ্যমিল,
দ্বিতীয় সারিতে। ‘বিন্দু’ ও ‘সিন্ধু’ দেখায় আদ্যমিল, প্রথম ও দ্বিতীয়
সারির গোড়ায়। অন্ত্যমিল পড়েছে প্রথম ও তৃতীয়, এবং দ্বিতীয় ও চতুর্থ
সারিতে। সবের মাঝে মধ্যমিল বিশেষ চমৎকারিত্ব দেখায়।
২-১২ লয়
ছন্দ-বিচারে,
ধ্বনির গতিকে বলা হয় লয় (tempo)। কবিতার প্রথম স্তবক বা চার লাইন
পড়লেই বোঝা যায় ধ্বনিদের কোন বেগে সাজান হয়েছে, এবং তার থেকে ঠিক
করতে হয় কবিতাটির আবৃত্তি হবে ধীরে, দ্রুতভাবে বা মাঝামাঝিতে।
গতির এই আপাত হিসেবে তিন লয়ের নাম দ্রুত, মধ্যম ও বিলম্বিত।
চলবে
দেবব্রত
ভৌমিক
লেখক
পরিচিতি: দেবব্রত ভৌমিক পেশায় কেমিক্যাল ইন্জিনীয়ার, গবেষক ও
প্রযুক্তিবিদ। উচ্চশিক্ষার উদ্দ্যেশে মার্কিন দেশে আসা। ছাত্রাবস্থার
পালা শেষ হওয়ার পর, দেশে ফেরা হয়নি। নিউ ইয়র্ক ও নিউ জার্সী অঞ্চলে
সময় কেটেছে। জন্ম খাস কলকাতায়, কৈশোর ও প্রথম যৌবন কেটেছে সেই
মহানগরে। তিন দশক সময় পার করেও, “তোমাকে চাই, তোমাকে চাই” বলে
কলকাতার জীবনকে মনে মনে ডাক দিয়ে থাকেন।