পশ্চিমবঙ্গের
কৃষি-অর্থনৈতিক সমস্যা: একটি স্মৃতিনির্ভর পরিক্রমা
পশ্চাৎপট
কৃষি-অর্থনীতির আলোচনা বাঙালী
অর্থনীতিবিদ মহলে দীর্ঘকাল ব্রাত্য ছিল। পঠন-পাঠন এবং গবেষণার
ক্ষেত্রেও কৃষি-অর্থনীতির স্থান ছিল বেশ নীচে। যতদূর জানি কলকাতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির স্নাতকোত্তর স্তরে কৃষি-অর্থনীতির জন্য
বিশেষ দুটি পেপারের প্রবর্তন হল গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে। এই অবহেলার
কারণ হিসেবে দুটি কথা বিশেষভাবে মনে হয়। প্রথমটি মূলত সমাজতাত্বিক।
বাঙালী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বহুদিনই জমি-জমা, কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন।
এই বিচ্ছেদ অনেক বেশি বেড়ে গেল দেশভাগের ফলে। বাঙালী হিন্দু শিক্ষিত
মধ্যবিত্তের একটি বড় অংশের দুর্বল গ্রামীণ সম্পর্কের সম্পূর্ণ
অবসান ঘটল। দ্বিতীয় কারণটি বোধহয় এই যে, স্বাধীনোত্তর দেশ পুনর্গঠনের
পরিকল্পনায়কৃষির ভূমিকার গৌণতা। দেশ পুনর্গঠনের যে শক্তিশালী পরিকল্পনার
যুগ শুরু হল দ্বিতীয় পাঁচসালা পরিকল্পনা বা নেহরু-মহলানবীশ পরিকল্পনার
হাত ধরে - সেই ছকেও কৃষির ভূমিকা ছিল গৌণ। হয়তো যুক্তিসংত কারণেই
জোর পড়েছিল ভারী ও বুনিয়াদী শিল্প উত্পাদনের পরিকাঠামো গঠনের দিকে।
দ্বিতীয় পরিকল্পনার মধ্যবর্তী কাল থেকেই কৃষি উত্পাদন বিশেষত খাদ্য
উত্পাদনের ঘাটতি যে সংকট সৃষ্টি করল, তারই ধাক্কায় পরিকল্পনা রূপায়ণে
অসুবিধার পাশাপাশি গতিমুখেরও পরিবর্তন শুরু হল কিছুটা অনিবার্য
ভাবেই। ভিত্তি তৈরি হল তথাকথিত 'সবুজ বিপ্লবী' ভাবনাচিন্তার। কৃষি-অর্থনীতির
সমস্যাগুলো নিয়ে গভীরতর ভাবনাচিন্তার শুরুরও এইটিই কাল। কেন্দ্রীয়
কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রকের উদ্যোগে দেশের নানা প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত
হল বেশ কয়েকটি কৃষি-অর্থনীতির গবেষণা কেন্দ্র। অন্যদিকে ভারতের
উন্নয়ন ও বিকাশের পথসন্ধানে আগ্রহী ও অংশীদার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের
একটি উল্লেখযোগ্য অংশও কৃষি-অর্থনীতি সমস্যা বিশ্লেষণী গবেষণায়
মনোনিবেশ করা শুরু করলেন। বিষয়টি দেশের আর্থ-সামাজিক চিন্তা ও
গবেষণার মূল মঞ্চে স্থান পেল। কিন্তু এই পর্বেও পশ্চিমবঙ্গ রয়ে
গেল পেছনের সারিতেই। কারণ সবুজ বিপ্লবের নামে কৃষি উন্নয়নের যে
ধারার প্রবর্তন শুরু হল, তার কেন্দ্রে রয়েছে স্বত্ববান, ধনী চাষির
উৎপাদনী উদ্যোগ, যার প্রেক্ষাপটে থাকল ভাখরা-নঙ্গলের মতো বছরভর
(মৌসুমী নয়) সেচবাহিত একলপ্তে বড় বড় খণ্ডের চাষের জমির মালিকানা;
সরকারি ভর্তুকিতে বিদ্যুৎ, সার, কীটনাশক এবং যন্ত্রপাতির সাহায্য।
বিশেষ ঐতিহাসিক কারণে এই ধরণের চাষের ভিত্তি কিছুটা তৈরি ছিল দেশের
রায়তওয়ারি অঞ্চলগুলির অংশবিশেষে, যার মধ্যে পাঞ্জাব-হরিয়ানা অগ্রগণ্য।
সমগ্র পূর্ব ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের কৃষি দেড় শতকের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের
দায়ে অবক্ষয়িত। দেশভাগ আপেক্ষিক ভাবে অল্প জমির ওপর জনসংখ্যার
চাপ প্রবলভাবে বাড়িয়ে তুলেছে। জমিদার / জোতদার বা মধ্যসত্বভোগী
অধ্যুষিত কৃষিতে বিনিয়োগ বহুকালই নিঃশেষিত। রাজ্যের কৃষিজমির বিপুলাংশই
মৌসুমী বৃষ্টি নির্ভর অনিশ্চয়তার শিকার। শ্বাধীনোত্তর কালের দামোদর-ময়ূরক্ষী-কংসাবতী
জাতীয় নদী পরিকল্পনাগুলিরও উৎস পশ্চিমবঙ্গ-বিহারের মালভূমিতে বৃষ্টিপাত
নির্ভর, কেবল তুষারসেবিত চিরশ্রোতা বা স্থায়ী জলরাশিই নয়। আধা-সামন্ত্রতান্তিক
ব্যবস্থার নিগড়ে বাঁধা এই রাজ্যে স্বত্ববান ধনী চাষির উদ্যোগকেন্দ্রিক
সবুজ বিপ্লব অধরাই থেকে গেল। সত্তরের দশক পর্যন্ত রাজ্যের কৃষি
উৎপাদনী হারের অগ্রগতি নানা টোটকা দাওয়াইয়েও দুই শতাংশের বেশি
তোলা যাচ্ছিল না। এই পর্বের আলোচনায় পাঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষকদের
চমকপ্রদ সাফল্যের জয়গান গাইতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের উদ্যোগবিমুখ
মানসিকতাকেই আপেক্ষিক পশ্চাত্পদতার কারণ হিসেবে দেখাতে শুরু করল।
যদিও বর্তমান লেখকের মতো অনেকেই ক্ষেত্রসমীক্ষালব্বì তথ্য থেকেই
জানাচ্ছিলেন যে, বর্ধমান-বীরভূমের সীমিত সেচসেবিত অঞ্চলের শস্য
উত্পাদন হার (ধান এবং গমের ক্ষেত্রে) পাঞ্জাবের লুধিয়ানার তুলনীয়।
আশির দশকে এ রাজ্যের কৃষির উন্নতির হারে যে পট-পরিবর্তন ঘটল, তার
কার্যকারণ ভিন্নতর। সে বিষয়ে আমরা একটু পরে আলোচনা কোরব।
সবুজ বিপ্লব ও পশ্চিমবঙ্গ
সত্তর দশকের সবুজ বিপ্লব
রণনীতি ও কৃত্কৌশলের কোনও প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের কৃষিতে পরে নি এ
কথা বলা ঠিক নয়। প্রথমে গম এবং পরে উচ্চ ফলনশীল ধানের কিছু উত্পাদন
এ রাজ্যেও শুরু হয়, কিন্তু পূর্বে আলোচিত কারণেই সীমিত থাকে এ
রাজ্যের সেচসেবিত (সরকারি ও বেসরকারি) অঞ্চলগুলির মধ্যেই। উচ্চ
ফলনশীল গমের বীজ উদ্ভাবন ও স্থায়ীকরণ (stabilization) আগে হয়।
পরে আসে ধানের সাফল্য। বিষয়টির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয় এমন
পাঠকদের জানানো দরকার যে, উচ্চ ফলনশীল বীজনির্ভর উৎপাদন বৃদ্ধির
জন্য বিশেষ প্রয়োজন একদিকে যেমন উপযুক্ত বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদি,
অন্যদিকে তেমনই দরকার নিয়ন্ত্রিত সেচ ও পর্যাপ্ত সূর্যকিরণ। এই
শর্তগুলি পূর্ণ হলে তবেই বর্ধিত উৎপাদনের পেছনের জৈব-প্রক্রিয়াগুলি
সার্থকভাবে পালিত হয়। নির্দিষ্ট বিজ্ঞানটি না জেনেও অভিজ্ঞতার
ভিত্তিতেই বাংলার কৃষক উপলব্বিì করে যে, বর্ষাকালে মাঠ ভাসানো
সেচ এবং প্রধানত মেঘলা আকাশের নীচে যে চাষটি সম্পন্ন করতে হয় (আমন)
তার তুলনায় শীতে বপন করে গ্রীষ্মের শুরুতে কেটে ফেলা 'বোরো' চাষে
উৎপাদনী সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর সেই কারণেই যে কৃষক আমন
চাষে প্রথাগত পদ্ধতি অবলম্বন করে যাচ্ছিল তারাই বোরো চাষের জন্য
উচ্চ ফলনশীল বীজ ও পদ্ধতি অবলম্বন শুরু করে। কিন্তু আগেই উল্লেখ
করেছি যে, উচ্চ ফলনশীল বোরো চাষের অন্যতম শর্ত হল নিয়ন্ত্রিত সেচ।
তাই এই চাষ শুরু হল শীত-গ্রীেäমও কিছুটা জল পাওয়া যায় এমন খাল
/ নলকূপ সেবিত অঞ্চলে। আলোচিত সীমাবদ্ধতার কারণেই সত্তর দশক পর্যন্ত
উচ্চ ফলনশীল বোরো চাষের প্রসার রাজ্যের কৃষিজমির শতকরা ১৫ শতাংশ
অতিক্রম করতে পারে নি। আর সেই কারণেই আধুনিকতর উত্পাদন পদ্ধতি
সম্পর্কে যথেষ্ট পরিচিতি ও আগ্রহ থাকা সত্বেও গড় উত্পাদনের শ্লথতাকে
সম্পূর্ণ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছিল না। রাজ্যের মোট ধান চাষের সিংহভাগই
জুড়ে থাকছিল বৃষ্টি-নির্ভর প্রথাগত পদ্ধতির আমন চাষ। আমনের উত্পাদন
বিঘা প্রতি ৮ - ১০ মন। বোরোর ফলন ছিল ২০ - ২৫ মন। এরই পাশাপাশি
বলা দরকার যে, বোরো চাষ যেহেতু মূলধন নিবিড়, তাই সীমিত থাকছিল
অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন উত্পাদকের মধ্যে। শীত-গ্রীেäমর জন্য গরিবের
জমি মৌখিক ঠিকা নিয়ে একত্র অরে 'বোরো ঠিকা '-র চলও হল এই সময়েই।
এইখানে বলে রাখা ভাল যে, উচ্চ ফলনশীল চাষ এবং বোরো চাষের ক্ষেত্রে
এই অবস্থায় অনেকটাই পরিবর্তন হতে শুরু করল ১৯৮০-র দশকের শুরু থেকেই।
নৃপেন
বন্দ্যোপাধ্যায়
(পরের অংশের জন্য এখানে
ক্লিক করুন)