পশ্চিমবঙ্গের
কৃষি-অর্থনৈতিক সমস্যা: একটি স্মৃতিনির্ভর পরিক্রমা
(দ্বিতীয় অংশ)

ভূমি-সংস্কার
ও পরিবর্তন: (প্রথম অংশের জন্য এইখানে ক্লিক
করুন)
স্থায়ী বামফ্রণ্ট শাসন এবং
আপেক্ষিক ভাবে সফল ভূমি-সংস্কার প্রচেষ্টার আগে রাজ্য কৃষির সংক্ষিপ্ত
বিবরণকে ভূমিকা হিসেবে উপস্থাপন করতে হল এই কারণে যে কৃষিতে উৎপাদনী
অগ্রগতি বা তার অভাব কতটা কৃৎকৌশলগত আর কতটা প্রাতিষ্ঠানিক (টেকনোলজি
বনাম ইনস্টিটিউশানাল) তার আলোচনা ১৯৭০-৮০ দশকের মতো আজও প্রাসঙ্গিক।
এই বিষয়ে ৭০-৮০ দশকে বিশেষজ্ঞদের তীব্র বিতর্কের কালেই বর্তমান
লেখকের মতো অনেকেই বলার চেষ্টা করেছিলেন যে, বিষয় দুটি পরস্পরবিরোধী
নয়, সম্পূরক সম্পর্কে বাঁধা। শ্রমজীবী-উত্পাদক কৃষকের উৎপাদনী
ক্ষমতা পূর্ণতর ব্যবহারের স্বার্থেই ভূমি-সংস্কারের মতো প্রাতিষ্ঠানিক
ব্যবস্থার পরিবর্তন পূর্ব শর্ত হিসেবে কাজ করে। একে অপরের সঙ্গে
সম্পূরক সম্পর্কে বাঁধা। এই সম্পর্কের এক দিকে থাকে কর্ষক কৃষিজীবীর
জমি এবং তার শ্রম ও উদ্যোগে উৎপন্ন ফসলের ওপর তার অধিকার। এগুলির
জন্য দরকার সহায়ক প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ। অন্যদিকে অবশ্যই প্রয়োজন
উপযুক্ত সেচব্যবস্থা। বিদ্যুত্, সার, বীজ, কীটনাশকের সংযোগ। কৃষির
জন্য উত্পাদনী রসদ সংগ্রহের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা।
সবুজ বিপ্লবী কৃষি রূপান্তর
পর্বে (১৯৭০-৮০) এই বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আরও দুটি প্রাসঙ্গিক তাত্বিক
তর্ক জমে ওঠে। প্রথমটি হল উৎপাদন বা উৎপাদনশীলতার সঙ্গে চাষের
জমি বা জোতের আয়তনের সম্পর্ক যাকে পেশাগত ভাষায় 'স্কেল বিতর্ক'
বলা যায়। দ্বিতীয়টি হল, কৃষিতে পরিবর্তনের চরিত্র নিয়ে। আমাদের
কৃষির সামান্ততান্ত্রিক/ আধা-সামন্ততান্ত্রিক চরিত্র কি পাল্টাচ্ছে?
কৃষির ধনতান্ত্রিক বিকাশ কতটা ঘটছে বা ঘটতে পারছে? কৃষিতে ধনতান্ত্রিক
বিকাশের বিচার, পরিমাপ ও বিশ্লেষণের মানদণ্ডগুলি কী কী? ভারতীয়
কৃষিকে কি এখন ধনতান্ত্রিক বলা চলে? দ্বিতীয় বিষয়টি এখন অনেকটা
গুরুত্ব হারালেও প্রথম বিষয়টি অর্থাৎ চাষে/জোতের আয়তনের প্রশ্নটির
প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে বলেই বর্তমান লেখকের বিশ্বাস। অতীতের আলোচনাটির
প্রেক্ষিত ছিল এই যে বড় জমির মালিকানা যদি ভূমিহীন / আধা-ভূমিহীনদের
বণ্টন করা হয়, তবে জোত ছোট হবার কারণে উৎপাদনশীলতা কমে যাবে। কৃষিক্ষেত্র
থেকে মোট উৎপাদন কমে গিয়ে জাতীয় অর্থনীতির অগ্রগতি ব্যাহত করবে।
যেসব বিশেষজ্ঞরা কেন্দ্রীভূত জমির মালিকানার বিরুদ্ধে এবং ক্ষুদ্রতর
কর্ষক কৃষকদের জমির অধিকারের স্বপক্ষে স্বভাবতই তাদের তরফে প্রমাণের
চেষ্টা হয় যে, ভারতীয় কৃষির ক্ষেত্রে জমি পুনর্বণ্টন বিরোধী যুক্তি
ধোপে টেঁকে না। একর প্রতি উত্পাদনের ক্ষেত্রে ছোট কৃষকের ছোট জোতের
উৎপাদনশীলতা কম, ক্ষেত্রেসমীক্ষা থেকে এমন সাক্ষ্য মিলছে না। শুধু
তাই নয়, ছোট কৃষকদের শ্রম-নিবিড়তার কারণে একর প্রতি উৎপাদনশীলতা
বেশি এমন সাক্ষ্যের অভাব নেই। দেশের যেসব অঞ্চলে সামন্ততান্ত্রিক/
আধা-সামন্ততান্ত্রিক ভূমি সম্পর্ক প্রবলতর সেইসব অঞ্চলে মোট গড়
জমির পরিমান যাই হোক না কেন, বাস্তবে কৃষিকর্মটি সম্পন্ন হয় ছোট
ছোট ভাগেই। কারণ বড় জমির মালিকরা ছোট কৃষককে দিয়ে নানা শর্তে (ভাগচাষ-সহ)
চাষ করার ফলে সেক্ষেত্রে বড় জোতের কোনও বাড়তি সুবিধা পাওয়ার সম্ভাবনা
থাকে না। তাছাড়া প্রকৃত কর্ষকের সীমিত অধিকারের কারণে উদ্যোগের
অন্যান্য উপকরণের ঘাটতি থেকে যায়। অন্যদিকে পাঞ্জাব-হরিয়ানার মতো
মূলত ধনন্তান্ত্রিক প্রথায় চাষের ক্ষেত্রেও উচ্চতর উত্পাদনশীলতার
মূল কারণ জমি বা জোতের পরিমান নয়, সমগ্র অঞ্চলের উন্নত কৃষি পরিকাঠামো
(বিপুল কেন্দ্রীয় বিনিয়োগের ফল) এবং যথোপযুক্ত রসদ সরবরাহের জন্য
মূলধন (ঋণ-সহ) প্রয়োগ ক্ষমতা। এই বিতর্ক সূত্রে উল্লেখ করা হয়তো
অপ্রাসঙ্গিক নয় যে, ভারতের অন্যান্য খাদ্যাভাবগ্রস্থ অঞ্চলের জন্য
পরিসেবক মূল্যে খাদ্য সংগ্রহের কেন্দ্রীয় সরকারি ব্যবস্থা সমগ্র
অঞ্চলের উদ্বৃত্ত উৎপাদনকারী ধনী কৃষককে প্রবল সাহায্য করেছে।
কৃষিতে ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের লাভজনকতাকে সুনিশ্চিত করেছে। কৃষিপণ্যে
(এক্ষেত্রে খাদ্যশস্যের) উৎপাদনের দাম ওঠা পড়ার ঝুঁকিকে কার্যত
গ্যারাণ্টি বা বিমার কাজ করেছে।
রাজ্যে কৃষির বিবর্তন:
এতক্ষণের আলোচনার অনেকটাই
ভারতীয় কৃষির সমস্যায় চলে গিয়েছিল। এই পরিক্রমাটুকু করতে হল এই
কারণে যে স্বাধীনোত্তর ২০ / ৩০ বছর ধরে এ রাজ্যের কৃষির পশ্চাত্পদতা
এবং দেশের অন্য কিছু অঞ্চলের আপেক্ষিক অগ্রগতির প্রকৃতি ও কারণ
নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। সেই বিষয়ে কিছুটা আলোচনা ছাড়া
রাজ্যে কৃষির রূপান্তরের কার্যকারণ ও রূপ বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ থেকে
যায়।
এ রাজ্যের কৃষির কোন কোন
বৈশিষ্ট্যের জন্য তথাকথিত সবুজ বিপ্লবী মডেলটির সাফল্য সীমিত হতে
বাধ্য তার আভাস আমরা আগেই দিয়েছি। এ বিষয়ে প্রচেষ্টা একেবারেই
হয় নি এমনও নয়। সত্তর দশকেই রাজ্য কংগ্রেসি শাসনের অবসানের কিছু
আগে মূলত পান্নালাল দাশগুপ্ত ও তাঁর কিছু সহযোগী বিশেষজ্ঞদের উদ্যোগে
সিএডিপি (পরে সিএডিসি) প্রকল্প চালু হয়। এই প্রকল্পে সবুজ বিপ্লবী
(আইএডিপি) মডেলটিকেই রাজ্যের কিছু বাছাই অঞ্চলে সীমিত ভাবে প্রয়োগের
চেষ্টা হয়। লক্ষ্য ছিল ভূমি-সংস্কার বা ভূমি-সম্পর্কের কোনও পরিবর্তন
ছাড়াই কিছুটা উন্নত পরিকাঠামো এবং আধুনিকতর কৃত্কৌশল প্রয়োগ করে
রাজ্য কৃষি পশ্চাত্পদতাকে দূর করার। কয়েকটি বাছাই অঞ্চলের কৃষির
জন্য কিছু উন্নত দ্বীপ সৃষ্টি করে রাজ্যের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার
রূপান্তর ঘটানো। এই পরীক্ষার কিছু সদর্থক ফলাফল থাকলেও সার্বিক
সাফল্য আসে নি।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কৃষিতে
পরিবর্তন অনেকটা দেরিতে এসেছে বলা যথেষ্ট নয়। পরিবর্তনের চাপ এবং
তার প্রকৃতি দুটোই একেবারে আলাদা। এই ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার
প্রভাব বা দেশের নানা অঞ্চলের কৃষিতে ধনতান্ত্রিক বিকাশের প্রভাব
বড় ভূমিকা নিতে পারে নি। এ রাজ্যের কৃষি অর্থনীতির পরিবর্তনে অনেক
বড় ভূমিকা পালন করেছে রাজনৈতিক-সামাজিক সংগ্রাম মারফত প্রথমে গ্রামীণ
ও পরে রাজ্যন্তরে ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন। রাজ্যের কৃষি ব্যবস্থার
বিবর্তনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একটি অপ্রচলিত এবং অস্বস্তিকর প্রতিপাদ্য
উপস্থাপনের ঝুঁকি নেওয়া উচিত কিনা এ বিষয়ে মত পার্থক্য এমন কী
আপত্তিও স্বাভাবিক। তথাপি লেখকের জ্ঞান ও অনুভূতির বিষয়টির উল্লেখ
অনিবার্য হিসেবেই দেখা দিচ্ছে। তাই এড়ানো কঠিন। রাজ্য প্রশাসনিক
ব্যবস্থা-সহ সামগ্রিক সমাজব্যবস্থায় ভারসাম্যের পরিবর্তনের ফলে
উত্পাদন ব্যবস্থায় বড় মাপের সূচনার কথা বলতে সমাজবিজ্ঞানী বিশেষত
মার্কস্বদী ভাবনায় প্রভাবিত সুপরিচিত 'ভিত্তি বনাম প্রকার' বা
'পরিকাঠামো' (বেস্ বনাম সুপারস্ট্রাকচার)-এর পারস্পরিক ভূমিকা
ও অগ্রাধিকারের বিষয়টি নিয়ে পরিচিত আলোচনা ও বিতর্ক এসেই পড়ে।
উত্পাদন ব্যবস্থার বিবর্তনে অন্তর্নিহিত শ্রেণী দ্বন্দের নিয়ামক
ভূমিকার প্রসঙ্গটিও উঠে পড়তেই পারে। এই ধরণের কঠিন ও বহুচর্চিত
তাত্বিক সমস্যায় আলোকপাত করার উদ্দেশ্য এই আলোচনা নয়। বর্তমান
লেখকের কাছে আলোচ্য প্রতিপাদ্যটই এসে পড়েছে নেহাতই রাজ্য-কৃষিনীতির
পরিবর্তনের পরম্পরাটি বোঝার তাগিদে।
নব্য কৃষির প্রেক্ষাপট:
পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ও কৃষকের
চরম সংকট ধরা পড়েছিল ঔপনিবেশিক শাসনের শেষের দিকেই। ক্রমবর্ধমান
সংকটের মর্মান্তিক পরিণতি হিসেবে দেখা দিন পঞ্চাশের মন্বন্তর (ইং
১৯৪২ - ৪৩) । অল্প কয়েক মাসের মধ্যে অনাহারে মৃত্যু ঘটল বিভিন্ন
হিসেব অনুযায়ী ৩০ থেকে ৫০ লক্ষ গ্রামবাসীর, যার বিপুলাংশই ছিল
এক কালের অন্নদাতা কৃষক ও কৃষিজীবী মজুর। এই ব্যাপক অনাহার-মৃত্যুর
জন্য খাদ্য উত্পাদন-ঘাটতি নয়, দরিদ্রতর কৃষক ভাগচাষি খেতমজুরের
হাতে শস্য না থাকা এবং ক্রমবর্ধমান বাজারদামে খাদ্য সংগ্রহের অক্ষমতাই
যে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছে সে সত্য সমসাময়িক রাজ্যবাসীর জানা
থাকলেও সারা বিশ্বের কাছে বিশেষত বিশ্বের সংবেদনশীল বুদ্ধিজীবীর
মানসে তা গেঁথে দিতে সাহায্য করেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য
সেন। পঞ্চাশের মন্বন্তরের কার্যকরণ বিশ্লেষণ সূত্রেই যে বিশেষ
বিষয়গুলি সামনে এসে পড়ে তার মধ্যে একদিকে যেমন রয়েছে ঔপনিবেশিক
শাসকদের চূড়ান্ত জনবিরোধী নীতি পরম্পরা তেমনই অন্যদিকে দেখা গেল
দেশীয় মজুতদার-জোতদার-চোরাকারবারীদের সর্বনাশা ভূমিকা। ভূমিহীন/প্রায়
ভূমিহীন, কৃষিজীবীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তখন 'ভাগচাষ' শর্তে
কৃষিজমির প্রায় ৩০ শতাংশ চাষ করে। উত্তরবঙ্গে তারা 'আধিয়ার' (৫০:৫০
বা অর্ধেক ভাগের জন্য), দক্ষিণ বঙ্গে বর্গাদার/ভাগচাষি নামে পরিচিত।
বিশেষ ঐতিহাসিক কারণে উত্তরবঙ্গ এবং সমুদ্রের নিকটবর্তী দক্ষিণবঙ্গ
(সুন্দরবন সন্নিহিত দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা এবং দক্ষিণ মেদিনীপুর)
এই ভাগচাষ নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা ব্যাপকতর হয়। ভাগচাষ চালু থাকার
পূর্বশর্ত হল এমন আঞ্চলিক পরিবেশ যেখানে মূলধন বিনিয়োগ না করে
শুধুমাত্র মৌসুমী বৃষ্টিপাত এবং ভাগচাষির পরিবারিক শ্রম ও হাল-বলদের
সাহায্যেই এক ফসলি আমন চাষ বহাল থাকে। অর্থাত্ বিনা বিনিয়োগে জমির
মালিক (এ ক্ষেত্রে জোতদার) কম উৎপাদনী চাষে উৎপন্ন ফসলের (মূলত
ধান) অর্ধেকের মালিক হয়ে থাকে। এই ধরণের চাষ ব্যবস্থায় প্রত্যাশিত
ভাবেই জোতদারির সঙ্গে যুক্ত হয় মহাজনি ব্যবস্থাও। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই
ঋণদাতা মহাজনও জোতদাররা। তারাই ভাগচাষিদের দেড়া বা ডবল সূদে ‘বাড়ি
’ দিত। এ ছাড়াও ছিল নানা ধরণের 'আবওয়াব'-এর দাবি। বছরের ফসল জোতদারের
ঘরে তুলে সব ধরণের দাবি মিটিয়ে ভাগচাষিকে কার্যত নিঃস্ব অবস্থায়
পরবর্তী দিনগুলির জন্য নতুন বাড়ি বা 'ঋণ' নিয়ে ঘরে ফিরতে হত। চিরস্থায়ী
জমিদারি কৃষি ব্যবস্থায় বহুতল পরগাছা শোষকদের একেবারে নীচের তলায়
কর্ষক কৃষিজীবী তখন চালিয় যাচ্ছিল ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষি; বর্গাদার
এবং ভূমিহীন খেতমজুর হিসেবে। অ্যাকাডেমিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের
জন্য ছোট চাষি, বর্গাদার ও খেতমজুরকে আলাদা আলাদা ভাবে বিচারের
প্রয়োজন হলেও বাস্তব জীবনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলি সম্মিলিত
শ্রমজীবী মানুষের বিভিন্ন রূপ। অত্যন্ত ছোট মাপের নিজ জমির মালিক
চাষিকেও ভাগচাষ এবং অসময়ে খেতমজুরিতে অংশগ্রহণ করতে হয়। দুর্ভিক্ষের
কালে মর্মান্তিকভাবে প্রত্যক্ষ হল কী ভআ তৎকালীন বাংলার (দেশভাগ
পূর্ববর্তী) কার্যত ৪০/৪৫ শতাংশ দরিদ্র কৃষককে নিরন্ন রেখে ফসল
কেন্দ্রীভূত হচ্ছে মুষ্টিমেয় জোতদার ও ভূস্বামীর হাতে। সেই ফসলই
চলে গেল শহরের মজুতদারদের হাত ঘুরে চোরাকারবারিদের হাতে। এই প্রতিক্রিয়ারই
মর্মান্তিক পরিণতি হল গ্রামের কৃষিজীবীর লাখে লাখে গ্রাম ছেড়ে
শহরে এসে ফ্যান ভিক্ষা এবং ফুটপাথে মৃত্যু এবং অপুষ্টিজনিত মহামারী।
বর্গাদারি ও তেভাগা
বাংলার কার্যত বন্ধ্যা এবং
ক্রমাগত অবক্ষয় লাঞ্ছিত কৃষি-অর্থনীতিতে চূড়ান্ত বঞ্চনাজনিত যে ক্ষোভ
জমা হচ্ছিল তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটল ১৯৪৫ - ৪৬-এর তেভাগা আন্দোলনে,
যা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছিল প্রথমে উত্তরবঙ্গে ও পরে দক্ষিণবঙ্গের
জেলাগুলিতে। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই এমন একটা শক্তিশালী অভ্যুত্থান
কেন স্তিমিত হয়ে গেল তার ইতিহাস জড়িয়ে আছে ১৯৪৬ - ৪৭-এর দেশভাগের
বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যার আলোচনা এই প্রবন্ধের বাইরে
রাখাই সংগত।
প্রধানত সর্ব ভারতীয় ক্ষমতার
রাজনীতির দায়ে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশ ও বঙ্গ দ্বিভাগের কারণে
'তেভাগা' আন্দোলন তার স্বাভাবিক পরিণতি না পেলেও পরবর্তী রাজ্য
রাজনীতি ও সমাজজীবনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে গেল। গ্রামীণ মানুষ
বিশেষত দরিদ্রতর কৃষক শ্রমজীবীর স্বার্থ ও সংগ্রাম রাজ্যের আর্থ-রাজনৈতিক
চেতনায় স্থান করে নিতে পারল। পশ্চিমবাংলার ভূমি-সংস্কার প্রচেষ্টা
শুরুর আগেই উপস্থিত হল (১৯৫০-এ) তত্কালীন রাজ্য অর্থমন্ত্রী বিমলচন্দ্র
সিংহের বর্গাদারি ব্যবস্থার ওপর অতি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট। দুই
মহাযুদ্ধের অন্তর্বর্তী ব্যাপক কৃষি সংকটের কাল থেকেই বাংলাদেশের
চাষব্যবস্থার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এমন তথ্য প্রধানত ইংরেজ জেলা
প্রশাসকরে রিপোর্ট থেকে পাওয়া গেলেও প্রধানত মধ্যস্বত্বভোগী জমিদার
ও রায়ত স্বত্বাধিকারী জোতদারদের চাপেই বঙ্গীয় প্রজাসত্ব আইন (১৮৮৫)-এর
কোনও সংযোজনেই বর্গাদারিকে এবং বর্গাদারদের আইনি মর্যাদা দেওয়া
যায় নি। ১৯৪০-এর 'ইশা রিপোর্ট' নামে খ্যাত একটি নমুনা তদন্ত মারফত
সমস্যাটি পরিমাপের চেষ্টা হয়েছিল মাত্র। এই তদন্তের ফলে কোনও আইন
পরিবর্তন হয় নি। দেশভাগ ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ঠিক আগে তত্কালীন
প্রধানমন্ত্রী সুরাওয়ার্দি একটি বিলের খসরাও প্রচার করেন। তেভাগা
দাবীকে মাথায় রেখে এই বিলে ভাগচাষইদের অধিকার কিছুটা স্বীকৃত ছিল
বলে শোনা যায় (এই বিলের কোনও খসরা লেখকের দেখার সুযোগ হয় নি)।
দেশভাগের ডামাডোলে সে বিল অচিরেই ধামাচাপা পড়ে যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতটি
মনে রাখলে রাজ্য অর্থমন্ত্রী বিমলচন্দ্র সিংহের বর্গাদারি ব্যবস্থা
সংক্রান্ত রিপোর্টটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে স্বীকার করতেই
হয়।
যেহেতু বর্গাদারি অতীতে কখনও
আইনি অস্তিত্বের স্বীকৃতি পায় নি, জমির রেকর্ডে স্থান পায় নি,
তাই এর বিস্তার এবং বাংলাদেশ (পরে পশ্চিমবঙ্গে)-ব্যাপী বর্গাদারের
সঠিক সংখ্যা নিরূপণ খুবই কঠিন। ইশাক নমুনা তদন্ত জমির পরিমাণের
কিছুটা আন্দাজ (১৫ - ২০ শতাংশ) দিলেও বর্গাদার-এর সংখ্যা নিরূপণের
চেষ্টা করে নি। এই পর্বের সংখ্যাগত হিসেবের একমাত্র ভিত্তি হল
রয়্যাল কমিশন অফ এগ্রিকালচার (১৯৪০)-এর কাছে উত্থাপিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক
কৃষক সভার একটি প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনে তত্কালীন বাংলাদেশে ৪০/৫০
লক্ষ বর্গাদার কৃষিকর্মে নিযুক্ত বলে দাবী করা আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য
যে অপারেশন বর্গার আগে ২০ - ২৫ লক্ষ বর্গাদার রয়েছে এমন হিসেবের
পেছনেও কৃষক সভার সাক্ষেযের অনুমানটি কাজ করেছে বলে এই লেখকের
বিশ্বাস।
পঞ্চাশের মন্বন্তরে ৪০/৫০
লক্ষ মানুষের অনাহারে মৃত্যু যেমন বাংলার কৃষি সংকটের গভীরতা ও
ব্যাপকতার নিদর্শন, তেমনই মন্বন্তরের অব্যবহিত পরেই তেভাগা আন্দোলনের
ব্যাপকতা ও তীব্রতা সংকটদীর্ণ কৃষককুলের এক বৃহত্ অংশের মরণপণ
প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ প্রচেষ্টা - একথা বোঝা কঠিন নয়। এই আন্দোলন
শুধুমাত্র বর্গাদার বা ভাগচাষি নয়, তা যে তত্কালীন বাংলার আধা-সামন্ত্রতান্ত্রিক
ভূমি বন্দোবস্তের সবচেয়ে নীচের তলায় পিষ্ট সমগ্র ভূমিহীন/প্রায়
ভূমিহীন কৃষিজীবী মানুষকেই প্রবল ভাবে নাড়া দিয়েছিল তার অভ্রান্ত
সাক্ষ্য রয়েছে এই আন্দোলনে পুলিশি সংঘর্ষে নিহত শহিদদের তালিকায়।
শুধুমাত্র তত্কালীন দিনাজপুর জেলার খাঁপুরের সংঘর্ষে নিহতের সংখ্যাধিক
ছিলেন পেশায় খেতমজুর।
বাংলার অতি পচনশীল আধা সামন্ত্রতান্ত্রিক
ভূমিব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ 'তেভাগা'-র দাবি ও সংগ্রামকে উপলক্ষ
করেই বিস্ফোরিত হল কেন, এমন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে মনে হয় যে ১৭৯৩-এর
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা জমিদারি ব্যবস্থা প্রায় এক শতক পেরিয়ে
যখন প্রজাসত্ব আইন(১৮৮৫)-এর দ্বারা কিছুটা পরিবর্তিত হল তারপর
থেকেই প্রজাস্বত্বের আওতার বাইরে গড়ে ওঠা ভাগচাষ নির্ভর জোতদারিই
হয়ে উঠল বিনিয়োগবিমুখ এবং সম্পূর্ণ পরশ্রমনির্ভর শোষণের উন্মুক্ত
ক্ষেত্র। খাজনা এবং 'আবহাওয়াব' মারফত শোষণের হারও ছিল তীব্রতম।
সারা বছর চাষে শ্রম এবং সীমিত সাধ্যের রসদ এবং উদ্যোগ নিয়োগ করেও
গ্রাসাচ্ছাদনে অপারগ ভাগচাষির বঞ্চনা ছিল তীব্রতম। পরিমাণগত ভাবে
এই ধরণের কৃষক সংখ্যাধিক না হলেও গুণগত ভাবে হয়ে উঠেছিল সমগ্র
ব্যবস্থাটির অপদার্থতার দর্পণ স্বরূপ। আর হয়তো এই কারণেই তেভাগার
আংশিক দাবি নিয়ে সংগ্রাম সমগ্র গ্রাম সমাজের নীচের তলায় দাবানলের
রূপ নিতে চলেছিল। আর সেই কারণেই তেভাগা আন্দোলনের তাত্ক্ষণিক সীমা
পেরিয়ে তার লম্বা ছায়া স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবঙ্গের সমাজ-রাজনীতিকেও
প্রভাবিত করল। (পরের অংশ)
নৃপেন
বন্দ্যোপাধ্যায়