আসুন,
(আমরি) বাংলা ভাষায় কথা বলি ১ ২
[ইংরেজী অতি সমৃদ্ধ ভাষা।
মাতৃভাষার অভাব পুরণের জন্য সাবধানে ইংরেজী থেকে শব্দ আর ভাব
আহরণ করলে কোনও অনিষ্ট হবে না। কিন্তু যা আমাদের আছে তাকে অবহেলা
করে যদি বিদেশী শব্দ বা বাক্যের নকল চালানো হয়, তবে অনর্থক দৈন্য
প্রকাশ পাবে এবং মাতৃভাষা বিকৃত হবে।-- বাংলা ভাষার গতি: ইংরেজীর
প্রভাব-- রাজশেখর বসু: পরশুরাম গ্রন্থাবলী, তৃতীয় খণ্ড, বিচিন্তা]
আমার মা অনেক প্রবচন আমাদের
বলতেন। তার মধ্যে একটি গল্প ছিল, যেমন গল্প হয় যার একটি নীতিগত
উপদেশ থাকে। সেটি এই রকম।
এক জঙ্গলে অনেক গাছ ছিল
ছোট বড় মিলিয়ে। তাদের সমাজ ছিল-- সমাজের একটি প্রবীণ মোড়ল গোছের
গাছও ছিল। সকলেই তার কথা খুব মানত। সেই বনে কোনও কাঠুরিয়া আসে
নি গাছ কাটতে। তা একদিন এক ব্যবসায়ী এলো দলবল নিয়ে। সে নাকি
ইজারা নিয়েছে গাছ কেটে কাঠ চালান দেবে বলে। তাদের কথাবার্তা
গাছেরা সবই শুনছে, বুঝতেও পারছে। ফলে মতলবটাও বুঝতে পারল। হায়,
হায় কী হবে এখন? মোড়ল বলল এখনই ভয় পাবার কিছু নেই। তা তাদের
দলবল গাছ কাটার চেষ্টা করছে লোহার দা' দিয়ে-- কিন্তু তাতে কাঠের
কোনও হাতল নেই। ফলে সুবিধা হ'ল না। তার পর একদিন গাছ কাটতে কাঠুরেরা
নিয়ে এলো কুড়াল, যার হাতলটা কাঠের। মোড়ল বলল-- এইবার আমাদের
মরণ; যখন আমাদের জ্ঞাতিই এসেছে আমাদের নির্মূল করার কাজে।
কথাটা নতুন ক'রে আমার মনে
আসে, ততদিনে আমার মা গত হয়েছেন, বছর তিন বা চার আগে-- কোনও একটি
দূরদর্শন অনুষ্ঠানে প্রয়াত মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর একটি কথায়।
তিনি বলেছিলেন যে বাঙলা ভাষা খুব দ্রুত অবলুপ্তির দিকে যাচ্ছে
(ঠিক এই শব্দগুলি নয়, তবে ভাব মোটামুটি একই)-- বাঙলা ভাষায় ব্যবহৃত
শব্দ খুব কমে যাচ্ছে। কথাটা খুবই ভেবে দেখার। বাঙলা ভাষার প্রতি
আমাদের দরদ শুধু বাঙলা লিপিকে নিয়ে, যার প্রকাশ আমরা দিই দোকানের
সাইনবোর্ডে ইংরাজী হরফে (বা অন্য ভাষার হরফেও) লেখা শব্দগুলির
উপর কুশ্রী ভাবে আলকাতরা লেপে দিয়ে-- এবং তাতে হয়তো বাঙলা শব্দও
ঢেকে যাচ্ছে শুধু ইংরাজী হরফে লেখা আছে ব'লে। আমরা, বিশেষ ক'রে
তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালীরা, ভেবেও দেখছি না কী ভাবে আমাদের ভাষা
মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে (যেমন ভাবে সংস্কৃত ভাষা মৃত হয়ে
গেছে) শব্দের অব্যবহার, কু-ব্যবহার ও অপব্যবহারের ফলে। এবং এর
অনেকটাই হচ্ছে আমাদের অভ্যাস বা অনভ্যাসের ফলে। ভারতবর্ষের অন্য
ভাষাভাসীরা কিন্তু নিজের ভাষা সম্বন্ধে আমাদের চেয়ে বেশী সচেতন।
প্রথমে দেখি বাঙলা ভাষার
বদলে অন্য ভাষার শব্দ কী ভাবে আমাদের মুখে চলে আসে (ব্যাপারটা
অনেক দিন ধরেই হচ্ছে) আমাদের অজানিতে শুধু কু-অভ্যাসের ফলে।
তা আজ থেকে প্রায় পঞ্চান্ন বছর আগের কথা-- শিবপুর বেঙ্গল ইঞ্জিনীরিং
কলেজে পড়ি-- হঠাত্ একটি আড্ডায় আমাদের শখ হ'ল ইংরাজী শব্দ ব্যবহার
না করে শুধু বাঙ্লা ভাষায় একটানা কথা বলতে হবে। চটজলদী একটা
প্রতিযোগিতা হয়ে গেল সেইখানেই এবং পুরস্কার যে একটিও ইংরাজী
শব্দ শেষ পর্যন্ত ব্যবহার না করবে এক গোছা দামী সিগারেট পাবে।
অনেকটা musical chair, যেমন কেউ একটি ইংরাজী শব্দ ব্যবহার করবে
বাদ পড়ে যাবে। খেলা চলছে, একটি একটি করে প্রতিযোগী খসে পড়ছে।
একজন ছাড়া যখন আর সকলে বাদ হয়ে গেল, যে টিকে গেল, উত্তেজনায়
বলে ফেলল 'আমি ফার্ষ্ট'-- হায় রে 'প্রথম' শব্দটা মুখে এল না।
সেটা, যতদূর মনে পড়ছে,
জানুয়ারী মাস- 2008 সাল। কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশমতো ময়দানে
আর বইমেলা করা যাবে না। কিছু লোকের মাথায় যেন বাজ পড়েছে-- এ
তো গ্রন্থ তথা সাহিত্যের অপমান! টিভি চানেলে আলোচনার আসর বসে
গেছে (ইচ্ছে করেই দূরদর্শন শব্দটি ব্যবহার করলাম না, কারণ দূরদর্শন
একটি বিশেষ চ্যানেলের নাম)-- আসর আলো করে বসে আছেন দিক্পাল
সাহিত্যজীবি, শিক্ষাজীবি, (কু)রাজনীতিজীবি- সমুদয়। একজন, খুব
বেশী হ'লে দুজন ছাড়া সকলের বক্তব্যই এ ঘোর দুর্দিন। একজন প্রসিদ্ধ
সাহিত্যজীবি কথায় কথায় 'problem' শব্দটা ব্যবহার করলেন, প্রত্যহিক
সমস্যাসঙ্কুল জীবনের মধ্যে 'সমস্যা' শব্দটা তাঁর ঠোঁটের ডগায়
এল না। আরও অনেকেই অল্পবিস্তর মাঝে মাঝেই ইংরেজী শব্দ ব্যবহার
করলেন যদিও যুত্সই বাঙলা শব্দ আছে।
ভেবে দেখুন আমরা কত ইংরেজী
শব্দ ব্যবহার করি সাধারণ বিষয়েও। যে সব শব্দ, তা বিশেষ্য হোক,
বিশেষন হোক, অব্যয় হোক বহুকাল ধরে বাঙলা ভাষায় চলে আসছে প্রাত্যহিক
জীবনে- সাহিত্যে- সংবাদে তার বদলে আমরা ইংরেজী শব্দ প্রয়োগ করি।
একমাত্র ক্রিয়াপদগুলির বেলায় বাঙলা আমল পায়। আমরা 'breakfast'
করি 'জলখাবার' ভুলেই গেছি। আমদের 'বর' বা বউ (বধু) হয় না-- থাকে
'husband' বা 'wife'। (এমন কি যে সব মহিলারা পুরুষের উপর অর্থনৈতিক
নির্ভরশীলতা ঘৃণা করেন তাঁরাও খেয়ালে রাখেন না 'husband' শব্দের
অভিধানগত প্রতিশব্দ 'প্রতিপালক'।) হাজার হোক, 'after all' না
বললে কি করে বোঝাই আমরা শিক্ষিত। 'ইতিমধ্যে' বললে কি শ্রোতা
বুঝবে 'already' বলতে চেয়েছি। 'এসো' বা 'আসি' এই দুটি শব্দের
বদলে 'easily' অর্থাত্ 'সহজে' মুখে আসে 'bye' (ভেবে দেখি না
'goodbye' শব্দের মধ্যে 'God be with you' জড়িয়ে আছে তাই 'bye'
বললে শিক্ষার ধোবিছাপ দেখানো যায় আর নিরীশ্বরবাদীর চেয়ে 'atheist'
অনেক বেশী সম্মানজনক অর্থাত্ 'respectable', ভগবানের প্রশ্নই
আসে না God তবু ঠাঁই পেতে পারেন দূরে।)
কেউ যেন মনে না করেন আমি
ইংরেজী ভাষার বিরোধী। বাঙলা ভাষায় বিদেশী শব্দ ক্ষেত্রবিশেষে
থাকতেই পারে। ভাষা, এবং তার অন্তর্গত- ব্যবহৃত শব্দ, ভাবের আদান
প্রদানের সাধন। আমাদের জীবনে যা প্রয়োজনীয় ভাবে আছে তার একটা
নাম থাকে। যে জিনিষ আমাদের কাছে বাহির থেকে এসেছে তার নাম এবং
নামবাচক শব্দটি বাইরে থেকে আসবে স্বাভাবিক ভাবে; এতে কোন বিবাদ-
বিরোধ নেই। Police তো ইংরেজ শাসনের ফল তাই শব্দটাও আমাদের কথা-বার্তায়
ঢুকে গেল-- বানানটাও আমাদের মত করে নিলাম 'পুলিস'। সেই রকম ইংরেজ
শাসনপ্রথার আমদানী 'hospital' আমাদের জীবনে ঢুকেছে হাসপাতাল
হয়ে। অফিস, স্কুল, কোর্ট, প্যারেড ইত্যাদি বহু শব্দই আমাদের
জীবনে এসে বাসা বেঁধেছে আমাদের ঠোঁটের ডগায়। এসব শব্দ বাঙলায়
পরিভাষিত করতে গেলে 'লাগে রহো মুন্না ভাই' চলচিত্রটির নায়ক মুন্নার
মতো বিপত্তি হবে-- শাগরেদ (ফারসী শাগির্দ্ শব্দের অভিশ্রুতি)
সারকিট তাকে পরামর্শ দিয়েছিল, "একদম বিনম্র কে সাথ বাত
করনা"। মুন্না বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, "এ শালা
বিনম্র কোন হ্যায় রে?" জবাবে সারকিট বোঝালো, "হিন্দী
মে বোলে তো পোলাইট"। পাটনার রিক্সাওয়ালার কাছে 'সচিবালয়'
শব্দের চেয়ে অনেক সহজবোধ্য 'সেকরটরিয়ট'। কিন্তু 'আচরণবিধি' বোঝানোর
জন্য 'code of conduct' বলার কোন বিশেষ প্রয়োজন আমি দেখি না--
কারণ মহাভারতের যুগেও আচরণবিধি ছিল, কৌরব পক্ষের প্রধান সেনাপতি
ভীষ্ম কুরুক্ষেত্রে মহাযুদ্ধ শুরু হবার আগে যুদ্ধকালীন আচরণবিধি
বেঁধে দিয়েছিলেন যাতে যুদ্ধকালে কেউ অনভিপ্রেত (অর্থাত্ undesirable)
অধর্মযুদ্ধ না করে।
এবারে প্রাত্যহিক জীবনে
কয়েকটি এইরকম অপ্রয়োজনীয় ইংরেজী শব্দ ব্যবহারের উল্লেখ করে ইতি
টানব। কিছুদিন আগে একটি টিভি চ্যানেলে আলোচনা হচ্ছিল-- বিষয়
কলেজগুলিতে ছাত্রসংসদের পরিচালন সমিতির নির্বাচনের ব্যাপারে
কলকাতা হাই কোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশ (অনুষ্ঠানটির নাম ছিল
campuss- এ কমিশন)। অংশ নিয়েছিলেন একজন উপাচার্য, দুজন অধ্যক্ষ
ও একজন শিক্ষাবিদ। পনেরো মিনিটের মধ্যে আমি কযেকটি এইরকম শব্দ
ব্যবহার টুকে নিয়েছিলাম:
'আচরণবিধি'- র বদলে code
of conduct
'বিশেষ করে'- র বদলে particularly
'অন্য ভাবে'- র বদলে অন্য angle থেকে
'অনভিপ্রেত' না বলে বললেন 'undesirable'
'কী করে সামলাবেন' না বলে বললেন 'কী করে address করবেন
'আরও ভালো হবে' বলতে পারতেন , বললেন' 'আরও improve করবে
'হস্তক্ষেপ' না বলে বললেন intervention
আরও বেশ কিছু এইরকম ইংরেজী
মেশানো বাঙলা ছিল, সব লিখতে গেলে আমাকে মহাভারতের গনেশের মতো
চার হাতে লিখতে হতো। তঁদের আলোচনার মধ্যে বেশ কিছু ইংরেজী শব্দ
ছিল যে সব ব্যাপার এবং তাদের নামবাচক শব্দ ইংরেজ রাজত্বের ফল
এবং স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলি মূল ইংরেজী শব্দ রাখলে ভালোই হবে,
যথা F.I.R.', constitution, section ইত্যাদি।
ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করে
প্রাঞ্জল করার চুড়ান্ত উদাহরণ পেয়েছিলাম আমাদের এক শিক্ষকের
কাছে-- বলেছিলেন, 'আমি আপনাদের টিচার হিসেবে বলছি না, as a friend
হিসেবে বলছি।
মৌচাকে ঢিল মেরে তো বসেছি
(একটা কী hornet's nest.. ইত্যাদি কথা আছে না?), এখন প্রাণ তথা
মান নিয়ে সটকে পড়ি এ যাত্রা। সম্পাদক মহাশয়ের অনুমতি পেলে আবার
আসব এই আসরে এই বিষয় নিয়ে।
পুষ্পেন্দু
সুন্দর মুখোপাধ্যায়
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)