প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

আসুন, (আমরি) বাংলা ভাষায় কথা বলি

["মহারাজ-- পুনশ্চ শ্রবণ করুন। যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহারকালে আপন অঙ্গুলিকে ঘৃণা এবং কথপোকথন কালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা, তিনিই বাবু"-- বাবু: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়- লোকরহস্য]

আগের কিস্তিতে দেখেছি কী ভাবে সাম্প্রতিক কালে ইংরাজী শব্দ কথপোকথনকালে (এমন পাঠকও থাকতে পারেন যিনি এই শব্দের মানে যে 'কথাবার্তার সময়' বুঝবেন না কেবল অভ্যাসের অভাবে) আমাদেরই প্রশ্রয়ে ঢুকেছে। এই রকম ভাবে প্রচলিত হিন্দী ভাষাও প্রায়ই প্রকাশ পায় আমাদের কথাবার্তায়। যেমন 'লাগু' এই শব্দটি দূরদর্শনের কল্যাণে ইদানীং প্রায়ই শুনতে পাই effective - শব্দটির প্রতিশব্দ হিসাবে; যদিও 'চালু' বা 'শুরু' শব্দ বাঙলা ভাষায় আছে; এবং সঠিক প্রতিশব্দ (ভাবগত ভাবে) 'বলবত্'। এবং আরও মজার কথা হ'ল দূরদর্শনে, বিশেষ ক'রে জাতীয় দূরদর্শন চ্যানেলে খবর পাঠ করার সময় যে হিন্দী ভাষা ব্যবহার হয় তা তত্সম ও তত্ভব শব্দ ব্যবহারের ফলে অনেকটাই বাঙলা ভাষা ঘেঁসা। আরও বেশ কিছু হিন্দী শব্দ প্রায়ই শোনা যায়, যেমন 'সন্নাটা' বা 'শুনশান' যদিও 'নির্জন' শব্দটি বহুদিন আগে থেকেই আমাদের ব্যবহৃত। আবার এও দেখা যাচ্ছে বাঙলা ভাষায় স্বীকৃত তথা অভিধানে অন্তর্ভুক্ত বিদেশী জাত শব্দের বদলে মূল বিদেশী শব্দের আমদানী --যেমন 'আজব'- এর জায়গায় 'আজীব'' অথচ 'চলন্তিকা' খুলে দেখছি 'আজীব' (এটি একটি তত্সম শব্দ) শব্দের অর্থ 'বৃত্তি', 'ব্যবসায', 'জীবিকা' ইত্যাদি। 'দেখাশুনা' করতে আজকাল মন ওঠে না-- তার বদলে 'দেখভাল' করি। মুঘল, পারসিক ও আফগান শাসনের ফলে এদেশে বহু বিদেশী শব্দ আগে থেকেই আছে, কিন্তু আমাদের পরিচিত ও ব্যবহৃত শব্দের বদলে নতুন করে অন্য ভাষার শব্দ আনা খুব একটা প্রয়োজনীয় কি?

এ ছাড়াও আর একটি উত্পাত বেশ কিছুদিন ধরে চলছে; সেটি হ'ল শব্দের অশুদ্ধ প্রয়োগ। এই ব্যাপারটির রকমফের আছে। একরকম অশুদ্ধ হ'ল অশুদ্ধ বিশেষণ। এর একটি বহু পরিচিত উদাহরণ-- 'ভীষণ'। প্রায়ই শুনতে হ'চ্ছে 'এই গানটা আমার ভীষণ ভালো লাগে। এদের কে বোঝাবে ভীষণ শব্দ একটি গুণগত বিশেষণ (পরিমাণগত নয়)-- এর সঠিক অর্থ 'ভীতিপ্রদ' বা 'ভয়ংকর'। যাকে ভালো লাগে তাকে ভীষণ লাগবে কেন তা আমরা ভেবে দেখি না কথা বলার সময়। কারও আবার 'অদ্ভুত সুন্দর' লাগে কোন গান বা দৃশ্য। প্রচণ্ড গরম' বা 'প্রচণ্ড ঝাল' বুঝি, কিন্তু 'প্রচণ্ড সুন্দর' কেন হ'বে? আর এক রকমের অশুদ্ধ প্রয়োগ হ'ল শব্দকে অকারণ দীর্ঘায়িত করা-- যেমন ধরুন বলতে চাই 'ফল হিসেবে'-- বললাম বা লিখলাম 'ফলশ্রুতি হিসেবে'। এতে ভাবের গুরুত্ব কিচুই বাড়ল না' কিন্তু অকারণ একটি ভুল শব্দ প্রয়োগ করলাম; কারণ, 'ফলশ্রুতি' শব্দের অভিধানগত অর্থ (চলন্তিকা) 'কোনও পূণ্যকর্ম ক'রলে যে ফল হয় তা' শোনা বা তা'র বিবরণ'। 'চলন্ত' একটি স্বীকৃত শব্দ; কিন্তু তার বদলে সংস্কৃত শব্দ লেখা হ'বে ভেবে 'চলমান' লেখা ভুল হ'বে, কারণ সংস্কৃত ভাষায় 'চলমান' শব্দ হ'তে পারে না।'আগেই ভাবা উচিত ছিল' না ব'লে (অথবা লিখে) 'পূর্বাহ্ণেই ভাবা উচিত ছিল' ব্যবহার ক'রলে তা অশুদ্ধ হ'বে, সংস্কৃত ভাষা হ'বে না, কারণ, 'পূর্বাহ্ণ' শব্দের সঠিক অর্থ 'সকাল বেলা'। ভুল ব্যাপারটা জ্ঞানী ঋষিদের আর্ষপ্রয়োগের জন্যই তোলা থাকুক-- 'Most unkindest' কথা বার্ত্তায় সর্বদা চালালে আমরা কিছু শেকসপীয়র হ'য়ে যাব না।

বাঙলা ভাষার অধোগতির আর একটি কারণ হ'ল সাধারণ কথাবার্ত্তাতেও আড়ম্বরপ্রিয়তা- অকারণ আড়ম্বর প্রিয়তা। এই বিষয়ে রাজশেখর বসুর লেখা 'ভাষার মুদ্রাদোষ ও বিকার' প্রবন্ধ থেকে তুলে দিচ্ছি:
"(ভাষার) এই আড়ম্বরের প্রবৃত্তি এখনও (প্রচুর) আছে। অনেক বাক্যে অকারণে শব্দবাহুল্য এসে পড়েছে। লেখকরা (এবং সাধারণ কথা বলার সময়েও) এইসব সাড়ম্বর বাক্য প্রয়োগ করেন। "সন্দেহ নাই' -- এই সরল প্রয়োগ প্রায় উঠে গেছে, তার বদলে চলছে - 'সন্দেহের অবকাশ নাই'। 'চা পান' বা 'চা খাওয়া' চলে না, 'চা পর্ব' লেখা হয়। 'মিষ্টান্ন খাইলাম' স্থানে 'মিষ্টান্নের সদ্-ব্যবহার' করা গেল। ---- শব্দের অপচয় ক'রলে ভাষা সমৃদ্ধ হয় না।, দুর্বল হয়। যেখানে 'ব্যর্থ হ'বে' লিখলেই চলে সেখানে দেখা যায় 'ব্যর্থতায় পর্যবসিত হ'বে'।"

এটা ঠিকই ভাষা মনের ভাব প্রকাশের বাহন, লেখায় বা বলায়। স্থানের প্রভেদে সাধারণ কথাবার্ত্তার প্রভেদ দেখা যায়। তবে একটা ব্যাপারে একমত হওয়া যায় যে নগর-কেন্দ্রিক সমাজে, যেখানে স্বীকৃত শিক্ষার সার্বিক প্রসার আছে এবং সাহিত্য তথা শিক্ষার ভাষা সকলের পক্ষেই এক হ'বে (যেমনটি স্বামী বিবেকানন্দ ব'লে গেছেন-- কলকাতার ভাষা)। তথাকথিত অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত যাঁরা গ্রামে বা মফস্বলে থাকেন তাঁরা বিদেশী শব্দের প্রভাব থেকে মুক্ত হ'লেও নগরের শিক্ষিতরা বিদেশী শব্দ ব্যবহার এড়িয়ে চ'লতে পারেন না। কিন্তু তাঁরা যে ইংরাজী ভাষাতে বেশ পোক্ত তার খবরও নেই। গত কাল The Telegraph সংবাদ পত্রেপ্রকাশিত প্রতিবেদন পড়ে বেশ চমকিত হ'য়েছি। লেখা হ'য়েছে যে আই আই টি (যা নাকি ভরতের একটি সেরা বিদ্যালয়) থেকে পাশ ক'রা ইন্‌জিনিয়ার্দের অনেকেই absurd, exhaust এই সব অতি সাধারণ শব্দের মানেও জানেন না। এই রকম কোন ছাত্রকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন--'তাইতো রে, তোর তো খুব মুশকিল হ'লো। তুই ইংরিজীটাও শিখলি না এদিকে বাঙলা ভুলে গেলি'।

তবে এই অন্ধকারের মধ্যেও কিছু আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। বেশ কিছু দিন হ'ল কয়েকটি প্রচলিত শব্দ বা বাক্যাংশ, যাকে আমরা 'phrase' ব'লে থাকি, নতুন ভাবে প্রয়োগ হচ্ছে, এবং চমৎকার ভাবে প্রয়োগ হচ্ছে। নীচে তার কয়েকটি উল্লেখ ক'রছি

'এক ঘর', 'ব্যাপক', 'ঘটনা', 'চমকানো, 'কচি ক'রে' বা 'ছোট্টো ক'রে'

ভবিষ্যতে আরো এইরকম সঠিক ও চমকপ্রদ শব্দ ব্যবহারের অপেক্ষায় থাকব।

(সমাপ্ত)

পুষ্পেন্দু সুন্দর মুখোপাধ্যায়

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।