প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

দ্বারকানাথের মৃত্যুমুখোশ (শেষাংশ)

(প্রথমাংশ) মধ্যবিত্ত বাঙালীর মনে দ্বারকানাথের ভাবমূর্তি একপেশে বা গতানুগতিক। একজন খ্যাতনামা বাঙালী সাহিত্যিককে সম্প্রতি জিজ্ঞেস করেছিলাম, রবীন্দ্রনাথের লেখায় দ্বারকানাথের কোন উল্লেখ নেই কেন? তিনি ফস করে জবাব দিয়েছিলেন তার কারণ দ্বারকানাথ ছিলেন দুশ্চরিত্র। বিলেতে তাঁকে প্রতি মাসে নাকি এক কোটি টাকা পাঠাতে হত দেবেন্দ্রনাথকে। সত্যিই কি তাই? তিনি আরো বললেন যে, কলকাতার Sans Souci থিয়েটারের অভিনেত্রী এস্টার লীচ ও তারঁ কন্যার সঙ্গে দ্বারকানাথের খুব সখ্যতা ছিল। এই ব্যাপার নিয়ে বেশ মুখরোচক কুৎসা রটীয়ে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথের বন্ধু রামমোহনের দত্তকপুত্র রাজারাম। ১৮১৪ সালের জুন মাসে এক চিঠিতে তিনি এসবের বিবরণ জানান জ্যানেট হেয়ারকে।)

সুদর্শন ও তীক্ষ্ণাধী দ্বারকানাথের প্রতি অনেক মহিলা যদি আকৃষ্ট হয়ে থাকেন, তাতে আশ্চর্য হবার খুব কারণ নেই। আর যদি তিনি দুশ্চরিত্র হয়ে থাকেন, তাহলে কেমন করে পেয়েছিলেন সে যুগের মনীষীদের যথা রামমোহন রায়ের ভালোবাসা ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অগাধ শ্রদ্ধা? কৃপালানির বইতে উদ্ধৃত হয়েছে ক্ষিতীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগরের মন্তব্য, “I know Dwarkanath very well. What is said against him is sheer columny.” অথচ দ্বারকানাথের সম্বন্ধে এই ধরণের বিকৃত ধারণা খুবই প্রচলিত আছে।

দ্বারকানাথের সঙ্গে অনেক মহিলার বন্ধুত্ব ছিল। কেউ কেউ তাঁকে অন্তরঙ্গতার সঙ্গে ‘Dwarky’বলেও সম্বোধন করতেন। Charlotte Harvey নামে এক মহিলা তো বিয়ের আগে অন্ততঃ একবার নৈশভোজ করতে চেয়েছিলেন। ১৮৩৭ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর একটি চিঠিতে লিখেছিলেন, “I trust however to be able to dine with you once before I am married. Believe me, always and even to be your sincere and I dare not say further.” এইসব ঘটনা সে যুগে হয়তো ঠাকুর পরিবারকে বিব্রত করেছিল। এজন্যেই বুঝি ডেথ সার্টিফিকেটে উল্লিখিত জেমিমা পাইন সম্পর্কে দ্বারকানাথের জীবনীকাররা (কিশোরীচাঁদ মিত্র, কৃষ্ণ কৃপালানি প্রমুখরা) কেউই কোন উচ্চবাচ্চ্য করেন নি। কে ছিলেন এই জেমিমা পেইন যিনি মৃত্যুর সময় তাঁর কাছে ছিলেন? যাঁকে সাক্ষী ধরা হয়েছে “Jemima Payne, present at death, 32 Albemerle Street” – অর্থাৎ যাঁর ঠিকানা দ্বারকানাথের সঙ্গে এক? এমন হতেই পারে যে তিনি সেই হোটেলের কর্মচারী বা ম্যানেজার ছিলেন। প্রশ্ন হতে পারে পরে তাহলে তাঁর কোন উল্লেখ নেই কেন? (প্রসঙ্গতঃ রামমোহন যখন মৃত্যুশয্যায়, সেই সপ্তাহে তাঁর ঘর থেকে কে ঢুকছেন বা কে বেরোচ্ছেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ রয়েছে তাঁর জীবনীকারদের লেখায়, তাঁর ডাক্তারের রোজনামচায়।) একথাও জানা যায় যে দ্বারকানাথ Claret বা অন্যান্য সুরাপান করতেন। তাই বলে কি তাঁকে দুশ্চরিত্র বলাটা আজকের দিনে অহেতুক নয় কি?

এবার দ্বারকানাথের ভোগবিলাসী আচরণ, বেহিসেবী খরচা, সাহেবদের নিয়ে খানাপিনা এবং বিশৃঙ্খল ফূর্তির প্রসঙ্গে আসা যাক। দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে জানা যায় যে উক্ত কারণগুলির জন্যে দ্বারকানাথের শেষ জীবনে কার-টেগোর কোম্পানি দেউলিয়া হবার উপক্রম হয়। এই কোম্পানি লাটে ওঠার পর মহর্ষি লিখলেন, “বিষয়সম্পত্তি সকলি হাত হইতে চলিয়া গেল। যেমন আমার মনে বিষয়ের অভিলাষ নাই, তেমনি বিষয়ও নাই; বেশ মিলিয়া গেল।“ অথচ পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া দুটি জমিদারী ছাড়াও তাঁর নিজের অর্জিত দুটি জমিদারীর ট্রাস্ট ডিড রেখে গিয়েছিলেন দ্বারকানাথ। বিরাহিম্পুর, পাণ্ডুয়া, কালীগ্রাম ও শাহজাদপুরের জমিদারীগুলি বহু পুরুষ ধরে ঠাকুর পরিবারের স্বচ্ছলতা বজায় রেখেছিল।

সেকারণে দ্বারকানাথ জমিদারীর সঙ্গে ঋণভার রেখে গিয়েছিলেন একথা অনস্বীকার্য্য। কিন্তু এখানেও দেখা যায় দেবেন্দ্রনাথের অতিরঞ্জন। তিনি বলেছেন যে ১৮৪৮ সালে কার-টেগোরের দেনা ছিল এক কোটি টাকা আর পাওনা ছিল সত্তর লক্ষ অর্থাৎ ত্রিশ লক্ষ টাকার ঘাটতি। অথচ সিদ্ধার্থ ঘোষের গবেষণা থেকে জানা যায় যে কোম্পানীর মোট দেনা ছিল ২৫ লক্ষ ৮৬ হাজার টাকা; আর সমস্ত সম্পত্তি ও অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ২৯ লক্ষ ২ হাজার ৯৫০ টাকা। (১৮৪৮ সালের ৫ ই এপ্রিল বেঙ্গল হরকরা পাতায় প্রকাশিত এই তথ্য।) দেবেন্দ্রনাথ আরো লিখেছেন, ব্যক্তিগত ঋণশোধের জন্যে দ্বারকানাথ ট্রাস্ট ডিডের সম্পত্তিও হস্তান্তর করতে রাজী ছিলেন। কিন্তু দ্বারকানাথের অভিজ্ঞ ব্যবসায়ী পার্টনার গর্ডন এবং ইয়ং জানতেন ট্রাস্ট ডিডের সম্পত্তিতে এইভাবে হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকারই ছিল না দেবেন্দ্রনাথের। তদুপরি ক্লিং-এর লেখা থেকে জানা যায় গর্ডন এবাং স্টুয়ার্ট উভয়েই দেবেন্দ্রনাথ, নগেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে সম্পূর্ণ আপোস–মীমাংসার সুযোগ দিয়েছিলেন। সিদ্ধার্থ ঘোষ লিখেছেন, “কার-টেগোর কোম্পানীর অবস্থা মোটেই শোচনীয় ছিল না... ঠাকুর পরিবারের সংস্রবচ্যুত হয়ে গর্ডন-স্টুয়ার্ট কোম্পানী নামে ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত ব্যবসা চালিয়ে যান।”

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে মহর্ষি পরবর্তীকালে জমিদার হিসেবে যথেষ্ট বৈষয়িক বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন। তাহলে দ্বারকানাথের মৃত্যুর পর কার-টগোর বা ইউনিয়ন ব্যাংক চালানোর ব্যাপারে তাঁর এত অনীহা কেন দেখা গিয়েছিল? এর উত্তর পাওয়া যায় ঠাকুর পরিবারের-ই ক্ষিতীন্দ্রনাথের লেখায়, “একটি বৃহৎ কারবার চালাইতে গেলে যে বুদ্ধি, দূরদর্শিতা এবং সর্বোপরি যে সংযম আবশ্যক, সত্যের অনুরোধে চলিতে বাধ্য দেবেন্দ্রনাথ প্রমুখ তিন ভ্রাতার কেহই প্রাপ্ত হন নি। পরিশ্রম করিয়া, মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া অর্থোপার্জনে তাঁহারা তিনজনেই অসমর্থ ছিলেন বলিলে অত্যুক্তি হইবে না...। দেবেন্দ্রনাথ আসলে শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন। বেশ চুপচাপ বসিয়া দর্শনশাস্ত্র আলোচনা করিবেন, আর নির্ঝঞ্ঝাটে প্রয়োজন মত টাকাকড়ি জমিদারী হইতে আসিলেই দেবেন্দ্রনাথ সুখী।“

দেবেন্দ্রনাথের প্রতি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অটল আনুগত্যসম্পন্ন। অথচ চরিত্রের দিক থেকে তাঁর মিল ঠাকুর্দার সঙ্গেই বেশী। কৃপালানি লিখেছেন,

“…Rabindranath was not so orthodox a Brahmo as to despise all who, like Dwarkanath, believed in orthodox forms of Hindu worship; his novel ‘Gora’ and many other writings bear ample testimony to his intellectual liberality; he was not an ascetic and did not disdain or look down upon worldly mindedness. In fact, he believed, despite his personal inhibitions, in a full-blooded love of life. Why then did he fail to appreciate and admire his grandfather to whom he owed not merely the material ease of his existence, but not a little of his versatility, his whole-some love of life, his love of music, the arts and the theatre, his comprehensive outlook, his universal-mindedness, not to speak of his love of foreign travel?” _তিনি আরও বলেছেন যে, “had Rabindranath taken the pains to study his grandfather’s life and activities, his generous impulses and humanitarian deeds, he would have grown to understand and admire him.”

একাধিকবার লণ্ডনে গেলেও একবারের জন্যেও তিনি কেনসাল গ্রীনে ঠাকুর্দার সমাধিস্থলে গিয়েছিলেন বলে জানা যায় না। কাজেই যখন জানতে পারি যে কার-টেগোরের আর্থিক সংকটের বিষয় অতিরঞ্জন, গর্ডন-ইয়ং-এর ভূমিকা প্রতিকূল মন্তব্য ইত্যাদি দেবেন্দ্রনাথের কীর্তিকলাপ নিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করার রাস্তা তিনি বন্ধ করে দিয়ে গেছেন, তখন খুব আশ্চর্য হই না। স্বয়ং ক্ষিতীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “ইহার (কার-টেগোর) সম্বন্ধীয় কাগজপত্র পূজ্যপাদ রবীন্দ্রনাথের কর্তৃত্বে এবং তাঁহার আদেশে দগ্ধীভূত হওয়ায় এই কারবার কত বিস্তৃত ছিল এবং কী রূপে পরিচালিত হইত তাহার বিবরণ উদ্ধার করিবার কোন আশা নাই।” মূল্যবোধের যে সংকটের তাগিদে ১৯০৫ সালে রবীন্দ্রনাথ এই কাণ্ডটি করেন ব্লেয়ার ক্লিং বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর “Rabindranath’s Bonfire” প্রবন্ধে। ক্লিং-এর মতে এটি কবির আবেগ ও অনুভূতির ওপর ভিত্তি করে এক emotional প্রতিক্রিয়া। কিন্তু ক্ষিতীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যাটিও যে সমানভাবে প্রযোজ্য তাতে লেখকের সন্দেহ নেই।

সিদ্ধার্থ ঘোষের মতে দ্বারকানাথের প্রতি রবীন্দ্রনাথের মনটি বিষিয়ে দেন দেবেন্দ্রনাথ। ঠাকুর্দার মৃত্যুর ১৭ বছর পরে রবীন্দ্রনাথের জন্ম; তিনি কখনোই দ্বারকানাথের সংস্পর্শে আসেন নি। অথচ তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা সত্যেন্দ্রনাথের ছিল ঠাকুর্দার প্রতি সম্পূর্ণ অন্য মনোভাব। অসাধারণ মেধাবী সত্যেন্দ্রনাথ এক সুকঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রথম ভারতীয় আই সি এস হন – একথা সর্বজনবিদিত। বিলেতে প্রশিক্ষণের সময়ে তিনি দেবেন্দ্রনাথের কবল মুক্ত অবস্থায় ঠাকুর্দার স্মৃতির সঙ্গে বিজড়িত বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেন। এই সময়েই তাঁর শিশুপুত্র টোবির ঠাণ্ডা লেগে মৃত্যু ঘটে এবং তাকে দ্বারকানাথের কবরের কাছেই সমাহিত করা হয়। (জ্ঞানদানন্দিনীর স্মৃতিকথায় এই ঘটনা জানা যায়, যদিও বর্তমান লেখক বহু চেষ্টা করেও এর সঠিক স্থান নির্ণয় করতে পারেন নি।) ঠাকুর্দার প্রতি বিদ্বেষ থাকলে নিশ্চয়েই এরকম হতে দিতেন না।

সত্যেন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল ১৮৪২ সালে, অর্থাৎ যে বছর দ্বারকানাথ তাঁর প্রথম ইউরোপ সফর সেরে দেশে ফেরেন। তাঁর বয়স যখন চার বছর, সেই সময়ে দ্বারকানাথ দ্বিতীয় ও অন্তিমবারের জন্য ইউরোপ ভ্রমণে বেরোন। শিশুমনে হয়তো প্রশ্রয়পূর্ণ ঠাকুর্দার কিছু স্মৃতি রয়ে গিয়েছিল। ঠাকুরবাড়িতে তিনিই দ্বারকানাথের পরে প্রথম কালাপানি পার হন। হয়তো সে কারণেই তিনি ঠাকুর্দার প্রতি সমবেদনা অনুভব করতেন। নিজের বুদ্ধি ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দরুণ তিনি দ্বারকানাথের স্বতন্ত্র মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এছাড়া বিলেতে পৌঁছনোর পর পরই তাঁর একটি অভিজ্ঞতা হয়। সে সম্বন্ধে নিজে কিছু না বললেও তাঁর সুহৃদ মনমোহন ঘোষের লেখা একটা চিঠিতে এই ঘটনাটা জানতে পারি। এর আগেই উল্লেখ করেছি যে দ্বারকানাথের বৈশিষ্ট্যহীন সমাধিটি কেনসাল গ্রীনে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ওখানে সমাহিত ৫০ জন বিখ্যাত মনীষীদের মধ্যে দ্বারকানাথের নাম নেই। বস্তুতঃ, ১৯ শে মে, ১৮৮২ সালে জ্ঞানেন্দ্রনাথকে লেখা মনমোহনের বিরক্তি, ক্রোধ ও নৈরাশ্য স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। এই চিঠির কিছু অংশ নীচে উদ্ধৃত করছি। মনে রাখতে হবে যে চিঠির বিষয় হচ্ছে মনমোহন ঘোষ ও সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কেনসাল গ্রীন প্রথমবার দর্শনের অভিজ্ঞতা।

“The very name of the place will of course fill your heart with a sort of melancholy reverence in the great man that sleeps there his eternal sleep. The very sight of the tomb, though it excited feelings of reverence for the dead man who lay underneath, at the same time made us uneasy not knowing how to reconcile the description we had heard at home from what we saw. We were both disgusted to see the imposition that has been practiced by those who had hands in the matter. We had heard that there was a handsome tomb with an inscription in Bengalee but we found out that all this was utter and sheer fabrication and downright falsehood. It is nothing but a mere block of stone (not marble) about 3 cubits in length with no inscription except the following words:

‘D.T.
Dwarkanath Tagore of Calcutta
Absit: 1st August, 1846’

These were the only letters miserably engraved on the piece of stone, which is surrounded by an iron chain, and has 4 cypress trees almost dying. In its side we saw several other tombs and beautiful monuments, but all the time we were uneasy, owing to the thought that came to our mind, viz. that the great man whose example we had followed in coming to England, and to whom only we were indebted for that visit, was occupying a most insignificant tomb, while those who were his courtiers lying under beautiful marble tombs with handsome inscriptions on them. I have been told that your uncle (Maharshi) had to pay thousands of Rupees for that tomb. I learnt it did not cost more than 2 pounds or Rs. 20. In short it was the most ugly tomb we saw in the whole country … will you relate all these to our uncle and with my best respect tell him that I am quite disgusted with this treacherous affair … you can ask him to let us know without delay whether he should like to have his father’s tomb changed and a worthy inscription placed in it and what amount of money he will like to spare for the purpose. If he will decide soon and let us know by the middle of July, we can have a new tomb erected in the 1st August the anniversary.”

এই সনির্বন্ধ অনুরোধের কোন উত্তর মেলে নি দেবেন্দ্রনাথের তরফ থেকে। তবে এই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সত্যেন্দ্রনাথ আসল ব্যাপারটা বিশেষতঃ দেবেন্দ্রনাথের অতিরঞ্জন আর দ্বারকানাথের স্মৃতিকে খাটো করার প্রয়াস নিশ্চয় বুঝেছিলেন।

কেনসাল গ্রিনে দ্বারকানাথের সমাধির সামনে লেখক

পিতার প্রতি দেবেন্দ্রনাথের মনোভাব কেন এতটা প্রতিকূল হয়েছিল? তাঁর লেখায় এ বিষয়ে স্ববিরোধের অনেক পরিচয় পাওয়া যায়। আশ্চর্য্য বিষয় এই যে দ্বারকানাথ ও দেবেন্দ্রনাথ দুজনের আদর্শ চরিত্র বলতে দ্বারকানাথের মা অলকাসুন্দরী (আসলে মাসি, তিনি দ্বারকানাথকে দত্তক নিয়েছিলেন) এবং রাজা রামমোহন রায়। অথচ তাঁদের প্রভাবে কী করে এঁরা দুজনে দুই বিপরীত পথের দিশারী হলেন? খুব কাছের থেকে দেখা কোন এমন কী ঘটনা ঘটেছিল যার জন্যে দেবেন্দ্রনাথ তাঁর পিতার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হন? ১৮৩৩ সালে রামমোহন যখন চরম আর্থিক সংকটের সম্মুখীন এবং ম্যাকিন্টশ কোম্পানীর কাছে তাঁর টাকা পয়সা আটকে ছিল, সে সময়ে দ্বারকানাথ কেন তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন নি কেন? কেন তিনি ম্যাকিন্টয়াশ কোম্পানীর যাবতীয় সম্পত্তি কিনতে ব্যস্ত ছিলেন? তিনি কি রাজা রামমোহনের দুরাবস্থার কথে জানতেন না? নাকি সেই মূহুর্তে ভোগবিলাসে, সুন্দরী রমণীর সাহচর্যেয় এত বিভোর ছিলেন যে খেয়াল হয় নি! অথচ রাজার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে শিশুর মত কেঁদেছিলেন এবং পরে ব্রিস্টলে তাঁর স্মৃতির উদ্দ্যেশ্যে প্রিন্সেপকে দিয়ে নির্মাণ করিয়েছিলেন এক চমৎকার স্মৃতিসৌধ। এসব কাণ্ডকারখানা কি ছিল দ্বারকানাথের এক গভীর অপরাধবোধের অভিব্যক্তি? এসব কাছের থেকে দেখেই কি ব্রাহ্মধর্মের ধারক-বাহক ও রামমোহনের মানসপুত্র দেবেন্দ্রনাথের মনে তাঁর পিতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বাসনা প্রবল হয়ে উঠেছিল?

হয়তো বা মৃত্যুর তিনদিন আগে অলকাসুন্দরীকে গঙ্গাযাত্রায় (তাঁর ধর্মান্ধ মাতা দিগম্বরী দেবীর প্রভাবে?) নিয়ে যাওয়ায় ঘোর মনোমালিন্য ঘটেছিল পিতার সঙ্গে? দ্বারকানাথ তখন উত্তর ভারত সফর করছিলেন। একুশ বছরের নাতির কাছে মিনতি করেছিলেন অলকাসুন্দরী। আরো বলেছিলেন দ্বারকানাথ উপস্থিত থাকলে এরকমটা কখনোই হতে দিতেন না। ঠিক বোঝা যায় না, কী কারণে প্রিয় ঠাকুমার কথায় কর্ণপাত করে নি দেবেন্দ্রনাথ। ফিরে এসে এই খবর পেয়ে দ্বারকানাথ যে পুত্রের এরকম অর্বাচীনতায় অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন তা অনুমান করা যায়। কারণ পরবর্তীকালে দিগম্বরী দেবী যখন মরণাপন্ন অসুস্থ হন তখন গঙ্গাযাত্রা করতে দেন নি দ্বারকানাথ। বরং শেষ মূহুর্ত পর্য্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা করিয়েছেন।

“Rabindranath's Bonfire” প্রবন্ধে ক্লিং লিখেছেন,

“The source of Debendranath's antipathy could well have been his identification with his mother’s shame and embarrassment over his father's behavior. This feeling would have been strong enough to last a lifetime.” তিনি আরও লিখেছেন, “The women of his household could not tolerate the slightest deviation from orthodoxy. When he returned from Europe in 1842 and refused to undergo the purification ritual, they considered him defiled and exiled him to a separate building in Jorasanko compound. The young Debendranath, brought up in women’s quarters of Jorasanko, was raised in gossip and inuendos about his father's relationships with European women.”

সিদ্ধার্থ ঘোষ আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, “ম্লেচ্ছ আচরণের জন্যে স্বামী সহবাসে অসম্মতি জানিয়েছিলেন বলে দ্বারকানাথ-পত্নীর হিন্দু-সাত্বিকতা প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনার পর খ্যাতি-প্রতিপত্তির শিখরবাসী হয়েও দ্বারকানাথ যখন তাঁর বৈঠকখানা বাড়িয়ে নিজেকে সরিয়ে আনেন, স্ত্রী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে, তখন সেটা গুণ হিসেবে ধরা পড়ে না আমাদের মধ্যবিত্ত মননে। দিগম্বরী দেবী শুধু টাকার প্রয়োজনে স্বামীর সামনে এসে দাঁড়াতেন, তারপর ঘড়া ঘড়া গঙ্গাজল ঢেলে শুদ্ধ করতেন নিজেকে।”

দ্বারকানাথ প্রজাবৎসল ছিলেন না। তাঁকে নিপাট ভালো মানুষ বলেও ভাবা সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর গুণ ছিল অনেক। সিদ্ধার্থ ঘোষ লিখেছেন, “এই বিপুল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে আছেন মাঝারি উচ্চতার, পেলব চেহারার একটি মানুষ – দ্বারকানাথ ঠাকুর আর তাঁর ম্যানেজিং এজেন্সি সংস্থা – ‘কার-টেগোর অ্যাণ্ড কোম্পানী’। সময়টা ১৮২০ থেকে ১৮৪৬, যে পর্বে কলকাতায় একটা মিনি-ইণ্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন প্রায় ঘটতে চলেছিল। সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদ ও সামাজিক হিত সাধনে রামমোহনের অনুরাগী ও সহযোদ্ধা দ্বারকানাথ। আধুনিক চিকিৎসা ও ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী। অন্ধ ও কুষ্ঠারোগাক্রান্তের হিতার্থী, কলকাতা নগরে উন্নতিকামী জাস্টিস ফর পিস, একাধিক সংবাদপত্রের স্বত্ত্বাধিকারী, মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতা অর্জনে প্রয়াসী, কলকাতা থিয়েটার ও চারুকলা সংস্থার পৃষ্ঠপোষক। দ্বারকানাথের চেয়ে রোমাঞ্চকর ব্যক্তিত্ব উনবিংশ কেন বিংশ শতাব্দীতেও বিরল।

১৯৪৩ সালে ইংরেজ সাংবাদিক এইচ এন ব্রেলস্ফোর্ড শিল্পপতি জামশেদজী টাটার প্রসঙ্গে লেখেন,

“Why are the Tatas unique or nearly so? Where were the enterpreneurs of the same calibre whether Indians or Englishmen who should have been doing what they did and much more of the same kind fifty or sixty years earlier?”

এর প্রত্যুত্তরে ব্লেয়ার ক্লিং দেখিয়েছেন যে জামশেদজীর আবির্ভাবের ষাট বছরেরও বেশী আগে সেই caliber-এর ব্যক্তিত্ব ছিলেন দ্বারকানাথ। উপরন্তু দ্বারকানাথের সমস্ত কাজ একটি জীবনে এক হাতে করা। তিনি নাসেরওয়ানজীর মতো কর্মদক্ষ পিতার পথনির্দেশ পান নি, আবার দোরবজীর মতো সুযোগয় পুত্রও পান নি তাঁর বাণিজ্যিক সাম্রাজ্যকে চিরস্থায়ী করার জন্যে। পান নি ঠাকুর পরিবারের মহিলাদের শ্রদ্ধা ও সহায়তা। এখানে উল্লেখ্য টাটা পরিবারে মহিলারা জামশেদজীর পুত্রদের শিক্ষা দিয়েছিলেন তাঁকে শ্রদ্ধা করতে, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে – এর নজির পাওয়া যায় ক্লিং-এর লেখায়।

এহেন দ্বারকানাথকে আমরা ভুলে গেলাম কি করে? কোথায় বা গেল সেই মৃত্যুমুখোশ? দেবেন্দ্রনাথ, নগেন্দ্রনাথ, নবীনচন্দ্র, কিশরীচাঁদ মিত্র – কারো লেখা থেকে এ বিষয়ে কিছু জানা যায় না। সংরক্ষণের ব্যাপারে আমাদের জাতিগত স্বভাবটাই দুর্বল। কিন্তু অবজ্ঞা, অবহেলা, ইতিহাসবোধের অভাব কোন শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছলে এরকম মূল্যবান জিনিস বেমালুম হারিয়ে যায়? ১৯ শে মে, ১৮৪৬-এর পর দ্বারকানাথ আর কোন চিঠি লেখেন নি এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তাঁকে ঘিরে নাবালক নগেন্দ্রনাথ ও নবীনচন্দ্র ছাড়াও অনেক বিচক্ষণ লোকজন ছিলেন, যেমন তাঁর চিকিৎসক ডা; মার্টিন। তাঁদের কাউকে কোন নির্দেশ দেন নি দ্বারকানাথ? তিন বছর আগে উইলের কোন পরিবর্তন করার কথা কি তাঁর মাথায় আসে নি? নাকি এই সমষ্টিগত স্মৃতিবিলোপ কারো আদেশে ঘটেছিল? অথবা সেইসব কাগজপত্র রবীন্দ্রনাথের আদেশে দগ্ধীভূত দলিল দস্তাবেজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত?

আক্ষরিক অর্থে যে মৃত্যুমুখোশটি অন্তর্হিত হয়েছে, তা ছাড়াও এখানে ভাবার্থে একটি মৃত্যুমুখোশ বর্তমান, যার অন্তরালে নির্বাসিত আসল দ্বারকানাথ। সেই মুখোশ উন্মোচন করে নতুন করে তাঁর মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। Mysticism থেকে দূরে সরে আসা, শিল্পায়ন ও বিশ্বায়নে অগ্রণী দেশ আজকের ভারতবর্ষে হয়তো দেখা যাবে যে প্রথম ‘multinational entrepreneur’ হিসেবে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কবিগুরুর চেয়ে কিছু কম নয়।*

অনিরুদ্ধ সান্যাল

সহায়ক গ্রন্থাবলীঃ
১) কিশোরীচাঁদ মিত্র, ‘দ্বারকানাথ ঠাকুর’, ১৯৬২
২) ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী’, ১৩৭৬
৩) ব্লেয়ার বি ক্লিং, “পার্টনার ইন এম্পায়ারঃ দ্বারকানাথ টেগোর এণ্ড দ্য এজ অফ এণ্টারপ্রাইজ ইন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’, ১৯৭৭
৪) সিদ্ধার্থ ঘোষ, ‘প্রিন্স দ্বারকানাথ’, দেশ পত্রিকা, ১২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৪
৫) ব্লেয়ার বি ক্লিং, ‘দ্য টাটাস এণ্ড দ্য টেগোরস’ টোনি স্টুয়ার্ট সম্পাদিত ‘শেপিং বেঙ্গলী ওয়ার্ল্ডস, পাবলিক এণ্ড প্রাইভেট’, মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি, ১৯৮৯
৬) ব্লেয়ার বি ক্লিং, ‘রবীন্দ্রনাথ’স বনফায়ার’, ভবতোষ দত্ত সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর কমেমোরেটিভ ভল্যুম’, বিশ্বভারতী প্রেস, ১৯৯০
৭) টাইমস অফ লণ্ডন, আগস্ট ৫ ও ৬ সংখ্যা, ১৮৪৬
8) কৃষ্ণ কৃপালানি, ‘দ্বারকানাথ টেগোরঃ এ ফরগটন পাইওনিয়ার’, ন্যাশেনাল বুক ট্রাস্ট অফ ইণ্ডিয়া, ১৯৮০

* এই লেখাটি আগে উত্তর আমেরিকার স্তবক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।


(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।