সেকাল
- একাল থেকে দূরবীণে (১) (সূচী)
একদিন-প্রতিদিন
(সকাল আর দুপুর)
আমার বাড়ির ঢিলছোড়া দূরত্বে
একটি পুলিশ থানা হয়েছে। সেখানে অষ্টপ্রহর থানার জন্য বরাদ্দ
করা আধুনিক গাড়ী (তা প্রায় সাত-আটটা হ'বে) মজুদ থাকে; তবে টহল
দিতে তারা রাস্তায় ঘোরাঘুরিও করে। আসামী বা সম্ভাব্য দুস্কৃতিকারী
নিয়ে আসা বা নিয়ে যাওয়ার জন্য ভ্যান, বেতারবাহী গাড়ী (wireless
van) পুলিশের কাজের কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু আজ থেকে 75 বছর
আগে অবস্থা কি রকম ছিল? আমার পিতৃদেবের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার
স্মৃতি কথা থেকে দেখা যাক--
-- "খবর যতটুকু
আভাষে জানতে পারলাম, আমার ইনস্পেক্টরবাবুর এক ইনফর্মার সেইদিনই
গোপনে তাঁকে খবর দিয়েছে- সেই দিনই রাত্রে কুখ্যাত ভূপতি রায়ের
এক দস্যুদল বর্ধমানের মেমারি- শক্তিগড় অঞ্চলে কোথাও ডাকাতির
অভিযানে বেরুবে।.... আমাদের পুলিশ পার্টিকে ছোট ছোট দলে ভাগ
করে মেমারি- শক্তিগড় অঞ্চলের বিভিন্ন দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।
সেটা ১৯৩৭- ৩৮ সাল। তখন মফস্বল পুলিশের যানবাহন ও দ্রুত সংবাদ
প্রেরণের খুবই দুরবস্থা। না ছিল টেলিগ্রাম বা বেতার (wireless)
ব্যবস্থা- না ছিল দ্রুত যানবাহন। কুইক মার্চ ছাড়া এতগুলি লোকের
অন্য কোন ভাবে যাওয়া কল্পনাও করা যেত না। কোনও রকমে দু একটি
যাত্রী বাস আমাদের বাহিনীকে সম্ভাব্য সব জায়গায় পাহারা দিতে
পৌঁছে দেবার জন্য যোগাড় হলো"
আমার জীবন কেটে গেছে কলকাতায়--
একেবারে শৈশবের (যখন আমার বয়স চারের মধ্যে) কয়েকটা বছর, কলেজে
পড়ার আবাসিক জীবনের ছয় বছর এবং কর্মজীবনের সাত বছর (যখন আমি
ভারতের বিভিন্ন জায়গায় নির্মানকর্মে ব্যাপৃত) বাদ দিলে পুরো
জীবনটাই কেটেছে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কলকাতায়। এই মোটামুটি দীর্ঘ
কালে কলকাতা শহরকে কিরকম বিবর্তন তথা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে
দেখলাম তারই কিছু বিবরণ লেখার কথা মাথায় এল। নেই কাজ, তো খই
ভাজ!
উপরের ইতিহাসটি অবশ্য
আমার জন্মের আগেকার। তবে আমার জ্ঞানোদয়ের পর থেকে, মানে ১৯৪৪
সাল থেকে আজ পর্যন্ত বেশ ভালই পরিবর্তন হয়েছে কলকাতার-- কখনও
দ্রুত বেশীটাই ধীরে। ধরা যাক এই শহরটার নামের কথাটা-- আমাদের
ছোট বয়স থেকে এই কয়েক বছর আগে পর্যন্ত মুখের কথায় 'কলকাতা' বললেও
লেখার সময় লিখতাম 'কলিকাতা', ইংরাজীতে লেখার সময় 'Calcutta'।
এখন সবেতেই কলকাতা বা 'Kolkata'।
১৯৪৪ সাল থেকে দেখে আসছিলাম, তা বালিগঞ্জেই হোক বা মোমিনপুরে
হোক, সকালে ঘুম ভাঙে অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে প্রচারিত প্রভাতী অধিবেশনের
শুরুতে সেই মাদকতাপূর্ণ পণ্ডিত রবিশংকরের রচিত, যন্ত্রসঙ্গীতে।
এখন তা আর পাওয়া যায় না। তখন বেশীর ভাগ বাড়িতে রেডিয়োই ছিল না,
পাশের বাড়ির রেডিয়ো থেকে ভেসে আসতো সেই সুর। যাদের বাড়ি বড় রাস্তার
উপরে, তারা দেখতে- শুনতে পেত রাস্তায় কর্পোরেশনের ঝাড়ুদার ঝাড়ু
দিয়ে যচ্ছে রাস্তায়- দুই হাতে ঝাড়ুর সাফাই চলেছে; তার কিছু পরেই
আসত হোস পাইপ দিয়ে রাস্তা ধোয়ার পালা। যারা তখনও ঘুম থেকে ওঠে
নি, এই আওয়াজে তাদেরও ঘুম ভাঙত। আজ কোথায় সেই রাস্তা ধোয়ার রেওয়াজ!
'ভোর হোলো, দোর খোলো খুকুমণি
ওঠো রে' এবং ঘুম থেকে উঠেই কলতলায় ছোটো দাঁত মাজতে-- বুরুশ বলতে
তর্জনীর ডগা আর মাজন বলতে বেশীর ভাগ বাড়েতেই উনুন থেকে বার করা
ছাই, কোন কোন বাড়িতে ডেনটনিক টুথ পাউডার। টুথ পেষ্ট এবং টুথ
ব্রাশের চলন তখন অপ্রতুল আর এখন সব ঘরেই। বেশীর ভাগ বাড়িতেই
থাকত চারিদিকে ঘর তথা বারান্দা দিয়ে ঘেরা এক ফালি চৌকো কলতলা
যার এক কোণায় চৌবাচ্ছায় ধরা থাকত জল, টাইমের জল। ওয়াশ বেসিনের
পাট ছিল না সম্পন্ন উচ্চ পদাধিকারী সরকারী অফিসারের বাড়িগুলি
ছাড়া। এখন ছোট ছোট বাথরুমে বেসিন, তদুপরি শেল্ফে ঝুলন্ত নানা
সাইজের ও রঙের টুথব্রাশ, পাশে লম্বমান টুথপেষ্ট।
উঠ শিশু মুখ ধোও, পড় নিজ
বেশ, আপন পাঠেতে মন করহ নিবেশ। (ছোটো বয়সের দেখা- শেখা কবিতা,
জানি না এ সব এখন আছে কি না) কিন্তু তার আগেও একটা অবশ্য কর্তব্য
ছিল-- জল খাবার। এখন আর জল খাবার নেই হয়ে গেছে breakfast। জল
খাবার বলতে বেশীর ভাগ বাড়িতে ছিল হাতে গড়া রুটি (অবশ্যই মায়ের
হাতের স্নেহ-পরশ মাখা, তবে সম্পন্ন গৃহে ঠাকুর এসে যেত এবং সেই
জলখাবারও বানাত) সাথে আলু ছেঁচকি বা গুড়। প্রাতর্ভ্রমণের রেওয়াজ
ছিল না, স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা করাটা ছিল না। কেউ মারা গেলে
তবে হয়ত জানা যেত বহুমুত্র (অর্থাত্ ডায়াবেটিস) ছিল না নিমুনিয়াতে
গেল। তবে গড় আয়ু এখনকার তুলনায় কমই ছিল। যদিও আমার মাতামহ ১০২
বছর বেঁচেছিলেন, যে আয়ু তাঁর কোন সন্তান পায় নি। যা হোক, পাঁউরুটি
ছিল যা মাখন বা জেলী সহকারে চলত কোন কোন বাড়িতে। sliced bread
দেখিনি, বাড়িতেই লম্বা ছুরীতে কাটা হত। গ্রেট ইষ্টার্ণ, ইস্ট
ইন্ডিয়া বা ফির্পো-- এই সব বেকারী বানাত। উপরটা পোড়া মাটির রঙ
একটু শক্ত আর মাঝখানে দুধের মত সাদা। তিন রকম সাইজ ছিল-- ফুল,
হাফ আর কোয়ার্টার। যতদূর মনে পড়ে ফুল সাইজ রুটির উপরের ক্রাষ্টে
আধ ইন্চি চওড়া এক ইন্চি লম্বা সুস্বাদু একটা টুকরো লেপে দেওয়া
থাকত যাকে আমরা বলতাম টিকেট আর কে সেটা খাবে তাই নিয়ে দস্তুর
মতন মারামারি হত।
ততক্ষণে সব বাড়ীর রান্নাঘরে
জানলা দিয়ে বেরুচ্ছে ধোঁয়া গলগল করে। প্রথমটা কালো সাদা মেশান,
পরে মোটামুটি সাদা। উনান দুরকম-- এক রান্নাঘরে একটি দেওয়ালে
লাগান, কোন জানলার নীচে, যাকে পাতা উনান বলত, আবার কোন কোন ঘরে
তোলা উনান, যাকে এদিক-ওদিক ব'য়ে নিয়ে যাওয়া যায়। তোলা উনান ধরিয়ে
বাড়ীর বাইরে রেখে দেওয়া হ'ত, যতক্ষণ পর্যন্ত ধোঁয়া বেরুত। উনান
ধরানর একটা প্রক্রিয়া ছিল। প্রথম আগের রাত্রে নিভিয়ে দেওয়া উনানের
তলার গর্ত থেকে সমস্ত ছাই বার ক'রে নেওয়া হ'ত। সেই ছাই আবার
দু'রকম বা তিন রকম কাজে লাগত-- দাঁত মাজা, যা আগেই বলেছি, বাসন
মাজা আর মাছ কাটা। তার পর প্রথমে গোবরের শুকনো ঘুঁটে ছোট টুকরো
ক'রে উনানের তলার দিকে লোহার সিকের (আজকালের মাপে পাঁচ বা ছয়
'সেন্টি মীটার' ব্যাস) উপর থরে-থরে সাজান হ'ত। সিকগুলি উনানের
দেওয়ালে গাঁথা থাকত উনানের জমি থেকে কিছুটা উপরে। ঘুঁটের উপর
কিছুটা কেরোসিন তেল (সেই কেরোসিন, যা নিয়ে লীলা মজুমদার 'দিনে
দুপুরে' বইয়ে লিখেছেন-- কেরোসিন কেরোসিন, কেরোসিনের সুবাতাসে
মহাপ্রাণ খইসে আসে। খাও খাও ভইরে টিন-- কেরোসিন কেরোসিন।) ঢালা
হ'ত। সেই সময়, অর্থাত্ দ্বিতীয় বিশ্বমহাযুদ্ধ থামার পরে পারে
কিছু কিছু দৈনন্দিন প্রয়োজনের জিনিষ চাল, কেরোসিন, কয়লা অপ্রতুল
হ'লেও পাওয়া যেত। যা হোক, এর পর একটি পুরান খরর কাগজের একটি
পাতা মুচড়িয়ে, তার আগায় আগুন দিয়ে, অবশ্যই টেক্কা মার্কা বা
ঘোড়ার মাথা মার্কা দেশলাই দিয়ে ধরিয়ে, উনানের তলার একটি ফুটো
দিয়ে গলিয়ে ঘুঁটের তলায় আগুন ধরান হ'ত। এর পর আগুন ভালো করে
ধ'রে গেলে সাইজ করা কয়লা ঢালা হ'ত।
শুরু থেকে বেশ ভালো মতন
উনান ধরা অর্থাত্ গনগনে আঁচ উঠতে প্রায় আধ ঘণ্টা মতন সময় লাগত।
অবশ্য কয়লা যদি কাঁচা, মানে খুবই নিকৃষ্ট মানের নন-কোকিং কয়লা
হ'ত তলার গর্ত দিয়ে প্রাণপণ বাতাস ক'রেও এক ঘণ্টা মতন লেগে যেত
আর রান্নার পাচক ম'শাই বা বাড়ীর গৃহিণী মুণ্ডুপাত করতেন কয়লা
ডিপো মালিকের। প্রায় প্রতি পাড়াতেই কয়লার ডিপো ছিল যেখানে কয়লা
পাওয়া যেত-- দাম ছিল দু'টাকা মণ। এক মণে ৪০ সের-- এক সের মানে
এক কিলোর সামান্য কম। মাঝে মাঝে কয়লা অপ্রতুল হ'লে গুঁড়ো কয়লা,
যা অপেক্ষাকৃত সস্তা ছিল, কিনে তা দিয়ে গুল (এই গুল ব্রজদা'র
গুল নয় যা দিয়ে গুল্প হ'ত) বানান হ'ত। গুল বানানোর একটা প্রক্রিয়া
ছিল। গুঁড়ো বলতে একেবারে গুঁড়া নয় (ছেলে বেলায় পূর্ববঙ্গীয় প্রতিবেশীদের
মুখে ছড়া শুনেছি-- অরস্ মানে গুড়া যে গুড়ায় ঘাস খায়, সোলজার
মানে গুড়া, যে গুড়া কিল্লায় থাকে আর পাউডার মানে গুড়া, যে গুড়া
গুড়া গুড়া) ছোট ছোট চিপস সাইজের। সেই গুঁড়া কয়লা অল্প জল দিয়ে
ভিজিয়ে শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পিণ্ড বা রাজভোগ সাইজের মতন গোল্লা
বানিয়ে বাড়ীর ছাদে বা উঠানে রোদে শুকান হ'ত, অবশ্যই একটি পুরান
খবরের কাগজের পাতার উপর বিছিয়ে। ভাল রৌদ্র হলে তিন চার ঘণ্টায়
তৈরী হয়ে যেত আত্মাহুতি দেবার জন্য। এই কাজটা ছিল ছুটির দিনের
বরাদ্দ। কাজের শ্রমিক ছিল বাড়ীর গৃহভৃত্য, সাথে সহায়ক আমাদের
মতন কচি-কাঁচারা। কাজটা হ'ত দুপুরের খাবার পর এবং রৌদ্রে দিয়ে
পাহারা দিতে হ'ত কাগের উপদ্রব থেকে বাঁচাতে বা বৃষ্টির ছাট থেকে
বাঁচাতে।
জলখাবারের পাট মিটলে অল্পই
সময় থাকত পাঠের জন্য। তাও ছল ছুতা করে বই-খাতা গুছাতে বেশ কিছু
অতিরিক্ত সময় লাগিয়ে দেওয়া যেত এটা খুঁজে পাচ্ছি না বা পাশের
বাড়ীর মন্টুর কাছ থেকে অঙ্কের খাতা ফেরত আনতে। সেই সময়টাতে বাড়ীর
বড় ছেলেরা বাজার যেত মাছ, সবজী ইত্যাদি আনতে। প্রায় প্রতিটি
সংসারেই একজন কম বয়সের কাকা-মামা থাকতেন, তা বেকারই হোক বা চাকরীরত
হোক, তাদের উপরেও এই দায়িত্ব বর্তাত। যা হোক এবার ছোট কলতলায়
স্নান কর'তে। বাড়ীর মহিলা তথা মেয়েরা এবং বড় পুরুষেরা দরজা দেওয়া
কলঘরে যেতেন, আর আমাদের মতন কচি-কাঁচারা কলতলায় যেত। আগেই বলেছি
কলতলায় একটি চৌবাচ্ছায় জল ধ'রে রাখা হ'ত স্নান, মুখ ধোয়া ইত্যাদির
জন্য। সপ্তাহে একটি ছুটির দিনে চৌবাচ্ছা পরিস্কার করা হ'ত। চৌবাচ্ছাতে
মাঝে মঝে জ্যান্ত মাছ যথা কই, সিঙ্গী, মাগুর ইত্যাদি রাখা হ'ত
ভবিষ্যতে সদ্গতির অপেক্ষায়। তপন সিনহা তাঁর 'গল্প হ'লেও সত্যি'
ছায়াছবিতে অতি বাস্তব ছবি উপহার দিয়েছেন সেকালের কলতলার, মায়
আছাড় খাওয়া পর্যন্ত দেখিয়েছেন। ষোল কলা পূর্ণ হ'ত যদি মগের ফুটো
দেখাতেন। এই ফুটো প্রায় প্রতি মগেই হয়ে যেত ঠিক হাতলটির কাছে,
ফলে ডুবিয়ে জল ধরে মাথার উপর ঢালার আগেই জল আদ্ধেক হ'য়ে যেত।
স্নান হয়ে গেলে ভাত খাওয়ার
পালা, এক বা দুই টুকরো মাছ সহযোগে| কিছুটা নাকে মুখে গোঁজার
ব্যাপার ছিল| একটা ব্যাপার এখন কিছুতেই বুঝতে পারিনা| টাইম ম্যানেজমেন্ট
কি করে হ'ত এবং সেটা দুপক্ষেরই-- যারা খেত তারা সকালের জলখাবার
খেয়ে (কেউ কেউ আবার চা-ও খেয়েছে এর আগে), স্নান ক'রে ভাত খাওয়া
সেরে স্কুলে কি করে ঠিক সমযে পৌঁছানো যেত আর অপর পক্ষে কি করে
সব আয়োজন করে ফেলত| এ ছাড়া টিফিন (ঠাকুমা-দিদিমা-পিসীরা টিপিন
ব'লতেন) নামক বস্তুটি তৈরী ক'রে ছোট বাকসে ভরে দেওয়ার ব্যাপার
আছে| মনে এও রাখতে হ'বে স্কুল-পড়ুয়া আছে, কলেজ-ছাত্র আছে এবং
চাকরী-জীবি বা ব্যবসায়ী আছে|
বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে স্কুল
হাঁটা দূরত্বের মধ্যে ছিল| ছাত্র এবং শিক্ষক দুপক্ষই হেঁটে আসত|
তবে কলেজ সব সময় পাড়ায় হ'ত না| কলেজের সংখ্যা কম ছিল এবং ছড়িয়ে-ছিটিয়ে|
আর অফিস যাত্রীরা যেতেন বাসে বা ট্রামে, যারা ধনী তাঁরা অবশ্যই
যেতেন নিজ বা কোম্পানীর বা সরকারী গাড়ীতে| আমি অবশ্য ট্রামে
বা বাসে যেতাম দাদাদের সঙ্গে| বাসের একটিই শ্রেণী ছিল এবং গদী-ওয়ালা
সিট ছিল| ট্রামের ক্ষেত্রে সেকেণ্ড ক্লাশে| ট্রামের দুই শ্রেণীর
মধ্যে সিটের তফাত্ ছিল শুধু রং-এর-- সেকেণ্ড ক্লশে ছিল কাঠের
সিট স্বাভাবিক রং-এর তবে গদী ছাড়া আর ফার্স্ট ক্লাশে গদী থাকলেও
তা কাঠের মতন শক্ত তবে সবুজ রং-এর| ট্রামে বা বাসে বেশ ভীড় হ'ত
তবে ঝুলে কেউ যেত না| আর বাচ্ছারা বসার সিট পেয়ে যেত-- তখন মহিলা
আর (এমন কি) কিশোর- এই দুই শ্রেণীকে সবাই সিট ছেড়ে দিত, জানলার
দিকে উদাস মুখ ফিরিয়ে থাকত' না|
আমাদের স্কুল, সাউথ সুবারবান
(ব্রাঞ্চ), ছিল ১১০ নম্বর ল্যান্সডাউন রোডে, হাজরা রোডের ক্রশিং-যের
কাছেই। এখন সে রাস্তার নাম হ'য়েছে শরত বোস সরণী। উস্তাদ গুলাম
আলীর একটি গজল আছে- 'রাস্তে ইয়াদ নহি, রাহনমা ইয়াদ নহি'-- কে
জানে এই সব রাস্তার নাম পালটিয়ে যাচ্ছে দেখেই বোধ হয় গেয়ে রেখেছেন।
সেই রাস্তা ধরে উত্তরে এগিয়ে গেলে পদ্মপুকুর ইনষ্টিটিউসন, আর
দক্ষিণে কিছুটা এগিয়ে রাসবিহারী এভিনিউ-এর দক্ষিণ দিকে দেশপ্রিয়
পার্ক পার্কের ঠিক বিপরীতমুখী তীর্থপতি ইন্ষ্টিটিউসন। আমাদের
স্কুলবাড়ীটি ছিল তিনতলা, পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা অংশ আর তার সমকোণে
দুই দিকে দুটি উইং, ইংরেজী U- অক্ষরের মতন। ক্লাশ থ্রী থেকে
ক্লাশ টেন, প্রতি ক্লাশের দুটি বা তিনটি সেকশন। কমবেশী আটশ'
ছাত্র পড়ত। সম্প্রতি শুনেছি সেখানে স্কুলের ছাত্রের সংখ্যা কমে
শিক্ষকের চেয়ে কমে এসে ঠেকেছে এবং স্কুলটি বোধ হয় উঠে যাবে।
স্কুলের পাশেই উত্তর দিকে ছিল ইষ্ট ইণ্ডিয়া বেকারী যেটির কথা
আগে লিখেছি। সেখান থেকে দুপুরবেলা পাঁউরুটি বেক ক'রার প্রাণকাড়া
গন্ধ আসত আর জিভে জল এসে যেত। স্কুল বসত সকাল সাড়ে দশটায় আর
ছয়টি (ক্লাশ নাইন ও টেনের ক্ষেত্রে সাতটি) পিরিয়ড হ'ত, প্রতিটি
৪০ মিনিটের। প্রথম ৪ পিরিয়ডের পর ২০ মিনিটের টিফিন হ'ত। আমাদের
বাস ছিল মোমিনপুরে, সেখান থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় ৬ কি.মি.
কিন্তু দু দফায় দশ মিনিট করে( বাসা থেকে বাসস্টপ পর্যন্ত আর
বাসস্টপ থেকে স্কুল পর্যন্ত) হেঁটেও ৩০ মিনিটে স্কুলে পৌঁছে
যেতাম ১০-টায় বাসা থেকে বেড়িয়ে। রাস্তায় এখনকার মত যানবাহনের
ভীড় ছিল না। বাস ও ট্রাম খুব ঘন ঘন চলত।
পুষ্পেন্দু
সুন্দর মুখোপাধ্যায়
(পরের
অংশ)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।