প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

প্রসঙ্গ: পরশুরাম (১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯)

(আগের অংশ) পরশুরামের গল্পাবলীকে কয়েকরকম ভাবে সাজানো যায়। এক হোলো গল্পের প্রকৃতি বিচারে-- প্রেম ও রোমান্স, ব্যঙ্গ ও কৌতুক, তত্ত্বমূলক, মানবচরিত্র, ফ্যান্‌টাসি ইত্যাদি। এবং এদের বিভিন্ন মাত্রায় মিশ্রণ, যথা রোমান্স ও কৌতুক। আরেকরকম হোলো গল্পের স্থান-কাল বিচারে-- আধুনিক, পৌরাণিক, কাল্পনিক, সর্বকালিক। এছাড়া শাস্ত্রোক্ত নবরস বিচার তো আছেই, যার আদিরসটি ঠিক পুরো মাত্রায় না পাওয়া গেলেও স্নিগ্ধতর শৃঙ্গাররস হিসেবে পরশুরামের লেখায় দেখা যায়। তত্ত্ব কথা বলেছেন তাঁর বেশ কিছু গল্পে, কয়েকটি আছে কথোপকথনের (অ্যারিস্টোটলের ডায়ালগ মনে পড়তে পারে) ছদ্মবেশে, কিছু নীতিকাহিনী প্যারাব্‌ল্‌, কিছু আছে ব্যঙ্গের আড়ালে লুকিয়ে, কিছু পৌরাণিক বাহনে, কিছু কল্পকালে। দুয়েকটা গল্প ছাড়া ব্যঙ্গ কিন্তু তাঁর সব গল্পে হাজির, কম বা বেশী।

রাজশেখর ছিলেন একাধারে বিজ্ঞ ও বিজ্ঞানী। কাজেই তাঁর তত্ত্বসমৃদ্ধ রচনাগুলিতে যুগপত্‍‌ যুক্তি আর তর্ক পাবার কথা এবং তা পাওয়াও যাচ্ছে। যেহেতু গল্পচ্ছলে বলা, সেহেতু সব বক্তব্যই এসেছে গল্পের কোনো চরিত্রের মুখ দিয়ে, কাজেই এর কোনটি যে পরশুরামের নিজস্ব মত তা বোঝা কঠিন। ওস্তাদের মার শেষ রাতে, অর্থাত্‍‌ শেষ কথাটি পরশুরামের ব্যক্তিগত মত, এটা মাঝে মধ্যে অনুমান করে নেওয়া যায়। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যা, তা হোলো পরশুরামের এই পরিবেশনায় তর্ক থাকলেও বিসংবাদ, পলেমিক্‌স্‌ প্রায় অনুপস্থিত, যে একআধ জায়গায় দেখা যায় (যথা সিদ্ধিনাথের প্রলাপ), সেখানে আছে চোখে আঙুল দেবার কারণে। কাহিনীর মূল বিষয় নিয়ে সমবেত চরিত্রের প্রত্যেকের বিভিন্ন মতামত আছে, পরশুরাম অতি যত্নে সবায়ের মত প্রকাশ করেছেন, যুক্তির ভিত্তি দেখিয়েছেন। এবং খোলা মনে সবায়ের কথা শুনলে কিন্তু মনে হয় যে কোনোটাই একেবারে ফেলনা নয়, তাই অবিসংবাদিত মীমাংসা সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে পরশুরাম বলছেন, বাপু হে, দেখতেই পাচ্ছো যে এ প্রশ্নের মীমাংসা এখনই তোমার খুসিমতো হবেনা, হয়তো কখনো হবে, হয়তো কখনোই হবে না -- "কাল নিরবধি এবং পৃথিবী বিপুলা"-- অতএব ক্ষান্ত দাও। একটু অন্যভাবে বললে, "পাপপুণ্যের দোলাচলে স্বল্প কালে স্বল্প স্থানে মানবসভ্যতার উত্থানপতনটা দুঃসহ লাগতে পারে কিন্তু বিরাট দেশকালের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে গড়পড়তা গতিটি উপরমুখী, তাতেই চলবে"। এর মধ্যে দুয়েকবার মনুষ্যজাতি বা তদ্ভবেরা লোপ পেলেও পেতে পারে, যেমনটি "গামানুষ জাতির কথা" গল্পে বলা আছে, তা সত্ত্বেও।

"তিন বিধাতা" গল্পে ব্রহ্মা, জেহোভা বা গড আর আল্লা একত্র হয়েছেন জগতে যাতে শান্তি আসে তার উপায় বার করতে। ব্রহ্মা বয়োজ্যেষ্ঠ, তাই মোটামুটি সভাপতির ভূমিকায় আছেন। তা এঁরা পৃথিবীতে শান্তি আনবেন কী, নিজেরাই পরস্পরের ওপর দোষারোপ করে ঝগড়া করতে লাগলেন। যেমন গডের অনুযোগ যে স্বর্গোদ্যানে হবা অর্থাত্‍‌ ইভকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়াবার দোষ আসলে আমাদের বাসুকি নাগের। বাসুকি জবানবন্দীতে স্বীকার গেলো। তিনজনের এই আলোচনা যখন অচল অবস্থায় পৌঁছোচ্ছে তখন এক প্রস্তাব নিয়ে শয়তানের আবির্ভাব। জগতের সব ধনী মানী লোকেরা চান স্বাধীন কর্ম করতে, তাতে যদি পাপপুণ্যের একটু এধার ওধার হয় তাহলে তাঁরা মন্দির-মসজিদ বানিয়ে, দান-খয়রাত করে সব মানিয়ে দেবেন। এখন কতো পার্সেন্ট, তাই নিয়ে কথা। একশো পার্সেন্টের কমে ব্রহ্মা রাজী নন, তাঁর মন্ত্র তো "মা ফলেষু কদাচন" , কিছু মুনাফা না পেলে শয়তানও ছাড়বে না, ইতিমধ্যে দেখা গেলো গড এবং আল্লা, দুজনেই অকুস্থল ত্যাগ করেছেন। শয়তানের প্রতি ব্রহ্মার শেষ উক্তি, বত্‍‌স, নির্বিঘ্নে তোমার মক্কেলদের নরকস্থ করো, তারপর একদিন আমি আবার নতুন করে মানুষ সৃষ্টি করবো। এখানে গড আর আল্লার যুক্তি আছে, আছে ব্রহ্মার পাল্‌টা যুক্তি, ধৈর্য আর সংযমের কথা, আর আছে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের কড়া মশলা। "ভীম গীতা" গল্পে কৃষ্ণকে ভগবদ্‌গীতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেছেন মধ্যম পাণ্ডব ভীম, তিনি সোজা কথার মানুষ। তাঁর কাছে ঐসব নিষ্কাম ধর্ম আদি কোনো কাজের কথা নয়, তিনি তক্তা ধরেন আর পেরেক মারেন। তার স্বপক্ষে যুক্তিও দেখালেন, অকাট্য যদি নাও হয় একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। ঋষি পরশুরামের নির্দেশে পুরাণের সাতজন অমর (পরশুরাম, হনুমান, বিভীষণ আদি) একত্র হলেন, উদ্দেশ্য সেই একই, অর্থাত্‍‌ পৃথিবীর অধঃপতন নিরোধ করা ("গন্ধমাদন বৈঠক")। তর্ক শেষ পর্যন্ত এসে দাঁড়ালো হিংসা আর অহিংসা, যুদ্ধ আর ধর্মযুদ্ধের মধ্যে-- খানিক তুমুল বলা যেতে পারে, বদমেজাজী বলে পরশুরামের (পৌরাণিক) খ্যাতি আছে। ব্যাসদেব ছিলেন ঠাণ্ডা মাথার লোক, তাঁর মতে অতো উত্তেজিত হবার কারণ নেই, "সৃষ্টির ক্রিয়া মন্থর", কিন্তু যথেষ্ট সময় দিলে আবার সত্যযুগ ফিরে আসবে। তাতে অবশ্য পরশুরামের মতি পরিবর্তন হোলো না তিনি বিষ্ণুর কাছে আর এক অবতারের দরবার করতে চললেন। "রামরাজ্য" গল্পে প্ল্যান্‌চেটে মিডিয়াম মারফত্‍‌ হনুমান এলেন, দেশ যে দিন দিন উত্‍‌সন্ন যাচ্ছে তার প্রতিকার কী, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে। তাঁর কাছ থেকে রামরাজ্যের যা সংজ্ঞা পাওয়া গেলো সেটি "ওয়ান পার্টি ঋষিতন্ত্র"। আমরা সাধারণ লোকেরা ভাবতাম কারুণিক একচ্ছত্রত্ব, বেনেভোলেন্ট ডিক্টেটরশিপ, সেটা ঠিক নয়। ভূতচক্রের কিছু লোকদের কাছে মহাবীরের প্রেস্‌ক্রিপশন পছন্দসই হোলো না, তারা মারপিট করতে লাগলো আর সেই সুযোগে হনুমান বিদায় নিলেন, যাবার আগে একটি প্রাপ্য লাথি কষিয়ে । এই ধরনের রচনা সবচেয়ে বেশী পাওয়া যাচ্ছে তাঁর "গল্প-কল্প" বইতে, সেটি ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয়। অর্থাত্‍‌ ভারত সবে স্বাধীন হয়েছে তখন, কাজেই তাঁর লেখায় তখনকার প্রশ্ন আর সমস্যার প্রতিফলন হিসেবে এইসব বিষয় পাওয়া যাবারই কথা।

"শোনা কথা" গল্পে পৌরাণিকদের দেখা নেই, যুযুধানেরা সবাই বিংশ শতাব্দীর লোক, পাড়ার পার্কে রাজাউজির মারেন, কিন্তু গল্পের চলনটা একইরকম-- রামরাজ্য, কংগ্রেস, কম্যুনিস্ট, ইংরেজ শাসন এইসব নিয়ে মীমাংসাহীন তর্ক। সম্প্রতি একটি বাংলা ব্লগে ঠিক এমনটিই দেখা যাচ্ছে, অর্থাত্‍‌ ষাট বছরেও আমরা এই নিরর্থক তর্কের ব্যাপারে কিছুমাত্র এগোতে পারলাম না। "শোনা কথা" যদি তাত্‍‌ক্ষণিকের তর্ক হয় তবে "দীনেশের ভাগ্য"-এর মীমাংসাহীন তর্ক ধ্রুপদী, অর্থাত্‍‌ ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়ে। তিন তার্কিক-- "জয়গোপাল নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব,... জীবনকৃষ্ণ গোঁড়া পাষণ্ড নাস্তিক,.... গোলোকবিহারী হচ্ছেন আধা-আস্তিক আধা পাষণ্ড।" ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে দুই চরমপন্থীর কাছ থেকে তাঁদের যা যুক্তি শোনা গেলো তা আমাদের পরিচিত। মধ্যপন্থীর কথায় "হরেক রকম ভগবান আছেন, কতক মানি কতক মানিনা", এবং তারই জের টেনে তিনি ত্রিগুণাতীত ভগবানের সংজ্ঞা দিয়ে তর্কে ইতি টানলেন। পরে জয়গোপালের শ্যালক দীনেশের ভাগ্য নিয়ে আলোচনায় বসে তাঁদের যুক্তির প্রয়োগ দেখা গেলো। দীনেশের বয়স পঞ্চাশ, সে অতি দুর্ভাগা, "এক মাসের মধ্যে স্ত্রী আর বড় বড় দুটি ছেলে কলেরায় মারা গেল, ... গচ্ছিত টাকাও উবে গেল"। কিন্তু মাস দুইয়ের মধ্যে দীনেশের আবার একটি বিয়ে হোলো, সে উপলক্ষ্যে সে কিছু টাকাও পেলো। তার ওপরে স্ত্রী তোতলা, "মহা ভাগ্যের কথা, চোপা শুনতে হবে না।" এই ব্যাপারে তিন তার্কিকের একজন খুঁজে পেলেন শ্রী হরির অপার করুণা, একজন দেখলেন ভবিতব্যের একচোখোমি আর আরেকজন ও তর্কের ধারেই গেলেন না, তিনি দেখলেন দীনেশ সুখী হয়েছে, "... জগদানন্দ মোদক খাচ্ছে, তার মুখে বোকা বোকা হাসি ফুটেছে।" পাঠক পছন্দমতো উপসংহার বেছে নিতে পারেন তবে পরশুরামের পক্ষপাত যে ওই মধ্যপন্থীর প্রতি, সেটা বেশ বোঝা যায়। সোমনাথের স্ত্রী আসন্নপ্রসবা ("নবজাতক"), তখন বাড়ীতেই প্রসব হোতো। বাইরের ঘরে স্বজনবর্গ রাজা-উজীর মারছেন। শাস্ত্রজ্ঞ সত্যার্থী মশায় মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বিবর্তন নিয়ে শাস্ত্রে কী বলে তা জানালেন, বায়োলজিস্ট দিলেন প্রাণীবিজ্ঞানসম্ম্ত ব্যাখ্যা, দুয়ের মধ্যে মিলের থেকে অমিলই বেশী। এমন সময় জাতকের কান্না শোনা গেলো। সত্যার্থী আশীর্বাদ করলেন জাতক যেন পরব্রহ্মপ্রাণ হয়, আরেকজন চাইলেন সোমনাথের পুত্র যেন "মান্যগণ্য স্বনামধন্য পরিপূর্ণ পুং পুরুষ" হয়, কম্যুনিস্ট চাইলেন সে যেন "কায়মনোবাক্যে রাষ্ট্রবিধির বশবর্তী হয়"। বলাই বাহুল্য এর কোনোটাই সবায়ের মনোমতো হোলো না। তখন উপস্থিত কবি সব কচ্‌কচি বাদ দিয়ে স্বাগত জানালেন তাকে-- কবীর, টেনিসন ও রবীন্দ্রনাথের কবিতা উদ্ধৃত করে। মিষ্টিমুখের কথা দিয়ে সভা শেষ। একই ঘটনার তিনচার রকমের ব্যাখ্যা পাশাপাশি পড়তে ভালো লাগে, ভালো লাগে যুক্তিপূর্ণ আলোচনা, আরো ভালো লাগে নবজাতকের কবিতায় প্রশস্তি দিয়ে সমাপ্তিটি।

এসব হোলো সমষ্টিগত তত্ত্ব। ব্যষ্টিগত তত্ত্বেও পরশুরামের কলম চলেছে। "দশকরণের বানপ্রস্থ" এক পৌরাণিক পটভূমিকায় এক সর্বকালিক জীবনদর্শনের কথা-- "যত জীব আছে সব মিলে আমি"। মরণ ও তার পরের কথা নিয়ে বলেছেন "অটলবাবুর অন্তিম চিন্তা"য়। একটু অন্য মোড়কে পাওয়া যাচ্ছে নিধিরামকে ("নিধিরামের নির্বন্ধ"), তিনি "সচ্চরিত্র, বুদ্ধিমান, দেশহিতৈষী লোক, কিন্তু অত্যন্ত খুঁতখুঁতে"। মৃত্যুর পরে বিধাতার কাছে তাঁর আরজি, পৃথিবী রক্ষা করার জন্য কিছু করবার। মুস্কিল হোলো যে বিধাতা যে প্রস্তাবই দেন, নিধিরাম তাতে কিছু না কিছু খুঁত বার করেন। শেষে বিধাতা নিধিরামকেই আবার ফেরত পাঠালেন মানুষকে সুমন্ত্রণা দেবার জন্য। নিধিরাম কিছু যদি করতে পারেন তো ভালোই, না পারলেও বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোনো ক্ষতি হবে না-- লেখক পরশুরামের যেটি মত। এঁর মতোই আরেকজন "অসামান্য, মহাত্মা গান্ধীর মতনই একগুঁয়ে সত্যাগ্রহী" ছিলেন বিনায়ক ("সত্যসন্ধ বিনায়ক"), মিথ্যার সঙ্গে আপোস না করার লড়াই-- "যুগে যুগে অবতারদেরই যা করবার কথা"-- চালিয়ে তিনি প্রাণ হারালেন। এই সুযোগে বিনায়কের সঙ্গে কথোপকথনের ছলে আমরা কেমন করে মিথ্যের সঙ্গে আপোস করে থাকি তা দেখিয়ে কশাঘাত করে গেলেন পরশুরাম।

সুমিত রায়

(পরের অংশ)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।