প্রসঙ্গ:
পরশুরাম (১)
(২) (৩)
(৪) (৫) (৬)
(৭) (৮)
(৯)
(আগের
অংশ) কল্পকাল, কল্পজগত্ আর কল্পবিজ্ঞান-- সবই ব্যঙ্গকৌতুকের
উর্বর ক্ষেত্র, গল্পের চরিত্র, ঘটনা ও বাঁধুনিতে অনেক স্বাধীনতা
নেওয়া যায়। পরশুরাম তার সুযোগ নিতে ছাড়েন নি। আমরা ভৌতিক জগত্কে
এই দলে ফেলবো, তাহলে পরশুরামের এই জাঁরের প্রথম গল্পটিই ("ভুশণ্ডীর
মাঠে") সর্বকালের সেরা ভৌতিক কৌতুককাহিনী বলা যেতে পারে।
গল্পের তিন ভূতই আমাদের চেনা লোক হতে পারে। স্বভাব যায় না ম'লে--
শিবু এখনো টিকিতে ফুল বাঁধে, নাদু মল্লিক এবং কারিয়া পিরেত ধূমপান
করে, পেত্নী গোবরজল ছড়া দেয়। পরশুরাম সালতামামি করে যখন তাদের
প্রত্যেকের জীবনকথা বলছেন তখন সরল পাঠক বুঝতে পারছে না কীরকম
সুচতুর কৌশলে তিনি গল্পের বিস্ময়কর সমাপ্তিটি ছকে রাখছেন। প্রেততত্ত্বের
সংক্ষিপ্তসারটি উপরি পাওনা। ভূতের কথাই যখন উঠলো তখন "মহেশের
মহাযাত্রা'র কথা বলতেই হয়। বিজ্ঞানী পরশুরাম মহেশের মাধ্যমে
গাণিতিক পন্থায় ভূতের অনস্তিত্ব প্রমাণ করলেন, তারপর মোটামুটি
ভূতেই মহেশকে খেলো। এই গল্পটি ১৯৩০ সালে লেখা। এই গল্পে মহেশের
অন্তিমযাত্রার যা বর্ণনা, ১৯৯০ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত "ঘোস্ট"
ছবিতেও দেখি সেই ব্যবস্থা, প্রেতলোক তাদের নিজেদের কালো পোষাক
পরা বাহন লাগিয়ে নিয়ে চলে গেলো। আধিভৌতিক জগতের তুলনায় ভৌতিক
জগত্ আরো স্থিতিশীল, এটা বোঝা যাচ্ছে। "বদন চৌধুরীর শোকসভা"তে
যমদূতসহ দুই ভূত উপস্থিত। স্বর্গত বদন চৌধুরী জীবদ্দশায় সমাজহিতৈষী
বলে খ্যাত ছিলেন, তাঁর শোকসভায় যথারীতি স্তাবকবর্গ এসে তাঁর
অবিমিশ্র স্তুতি শোনালেন, হেজিওগ্রাফি যাকে বলে। এদিকে পরশুরাম
সেখানে প্রেতদের উপস্থিত রেখেছেন, তারা ওসব শোক-টোকের ধার ধারেনা,
কাউকে পরোয়াও করে না, তারা সভাস্থ কিছু লোকের ওপর ভর করে জানাল
যে বদন চৌধুরী প্রদীপটির নীচে অনেক অন্ধকার। তারপর দুই প্রেতে
ঝগড়া, পাল্টা, তস্য পাল্টা, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, অতি নোংরা ব্যাপার।
এমন করে জল যখন অনেক ঘোলা হোলো তখন যমদূতেরা ভূতেদের ফেরত নিয়ে
গেলো। আমরা যথারীতি পেলাম ব্যঙ্গ খচিত এক সুন্দর গল্প, তাতে
প্রেতলোকের বর্ণনা আছে, নাচগান সহযোগে শোকসভার কথা আছে, ফাঁপা
স্তাবকতার বিবরণ আছে আর স্তুতির আড়ালে আসল চরিত্র লুকোনোর হদিশও
দেওয়া আছে। এই অন্ধ স্তাবকতার ব্যাপারটা আমাদের সমাজে খুব প্রচলিত,
কাজেই এখানে পরশুরামের ব্যঙ্গের তীর সরাসরি লক্ষ্যভেদী।
অন্য চারটি কল্পবিজ্ঞানের
গল্প তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গবাহী। "গামানুষ জাতির কথা" গল্পের
শুরু যখন তখন আণবিক বিস্ফোরণে মনুষ্যজাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। দৈবক্রমে
কয়েকটি ইঁদুর বেঁচে গেছে কিন্তু গামা রশ্মির প্রভাবে তারা মানুষের
সব লক্ষণ পেয়ে মানুষই হয়ে গেছে, তবে বিবর্তন ঘটেছে মাত্র তিরিশ
বছরেই। এবং গল্পের লুপ্ত মানবসমাজে যেমনটি হয়েছিল, তেমনই তাদের
প্রকৃতি, চরিত্র, সমাজব্যবস্থা, রাজনীতি, সবকিছুই বিবর্তিত হযেছে।
সেই রকমই জ্ঞানবুদ্ধি, বিবাদবিসংবাদ, যুদ্ধবিগ্রহ, অত্যাচার
অনাচার-- বেশী বই কম নয়। তারপর তাদের সব রাষ্ট্রনায়করা একত্র
হলেন গামানুষ জাতির উন্নতির জন্য কী কর্তব্য তা স্থির করতে।
কুশীলবদের মধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর রাষ্ট্রনায়ক ও অন্যান্য
মহাপুরুষদের সনাক্ত করা যায় সহজে। পরশুরামের শ্লেষ এখানে মর্মঘাতী।
শেষে যেমনটি আশা করা যায়, তাঁদের আলোচনাও সত্বর হট্টগোল ও ঝগড়ায়
পরিণত হোলো এবং শেষ পর্যন্ত আর এক বোমার বিস্ফোরণে তাঁদের পঞ্চত্ব
প্রাপ্তি ঘটলো। মোদ্দা কথা এই যে লোভ-মদ-মাত্সর্য, এ তিন রিপুর
আক্রমণ অবধারিত, তা সে মানুষ হয়েই হোক বা "গামানুষ"
হয়েই হোক। মঙ্গল গ্রহের উন্নত সভ্যতার প্রতিনিধি "মাঙ্গলিক"
ধরাধামে এসে আমাদের জীবনযাত্রার বহু গলদ দেখিয়ে দিলেন-- যথা
পরিচ্ছন্নতার অভাব, "এই গুমট গরমে কোন আক্কেলে জামা কাপড়
পরে আছ?", পুং ও স্ত্রী লিঙ্গভেদ, স্বৈরতন্ত্র বা লোকতন্ত্র--
দুটিই দুর্বল রাষ্ট্রনীতি। উন্নতি সাধনের উপায়ও বাত্লালেন,
চুল কামিয়ে ফেলা, দিগ্বসন ধারণ, লিঙ্গসমীকরণ এবং মোক্ষম দাওয়াই
রাষ্ট্রশাসনের ভার নির্দ্বিধায় মাঙ্গলিকদের হাতে সমর্পণ। অর্থাত্
পরশুরাম দেখাচ্ছেন যে লোভ-মদ-মাত্সর্যের প্রভাব মঙ্গল গ্রহেও
পৌঁছে গেছে।
"উলট পুরাণ"কে
ঠিক গল্প বলা যায় না, নাটকের রূপে একটা স্কেচ বলা চলে। কল্প
নিশ্চয় কিন্তু বিজ্ঞান আছে না বলে যুক্তি আছে বলাটা ঠিক হবে।
তার গোড়ার কথাটা খুব চমকপ্রদ-- ইংরেজ ভারত জয় না করে ভারত যদি
ইওরোপ দখল করতো তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়াত। তারপর আয়নায় প্রতিফলনের
ব্যাপার, থ্রু দি লুকিং গ্লাস, কৌশলী যুক্তিবিদের হাতে ধাপে
ধাপে এগিয়ে গেছে। প্রতি পদে ইংরেজদের বিদ্রূপ করা হয়েছে কিন্তু
ভারতবাসীদের প্রতি যে শেল হানা হয়েছে তা আরো মর্মান্তিক। ঘোড়দৌড়
(সতীদাহ?) বন্ধের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন পাদ্রীরা, গবসন টোডি খাঁসাহেব
(রায়সাহেব?) উপাধি পাবার জন্য রীতি মাফিক তদ্বির করছেন, লণ্ডনে
বিরাট রাজসূয় যজ্ঞ চলছে (দিল্লী দরবার?), সরকারি চাকরীর লোভে
ট্রিক্সি টার্নকোটের রাজদ্রোহমূলক জ্বালাময়ী বক্তৃতার সুর পাল্টে
যাচ্ছে, এদিকে জার্মান প্রিন্স ভারতীয় আফিমের নেশায় বুঁদ। উড়িয়া
পুলিস আছে, আছে আনন্দ নাড়ুর বিজ্ঞাপন আর সুভাষিতের ছড়াছড়ি--
"মেডিটেরেনিয়ান... মেতিপুকুর, সুইট্সারল্যাণ্ড ছছুরাবাদ"
...। নাটকের চরিত্রগুলি সব খাঁটি টাইপ চরিত্র কিন্তু মজাটা আসছে
তাদের জাতি উল্টে যাওয়া থেকে। ১৯২৭ সালে "কজ্জলী"
বইতে গল্পটির প্রকাশ, তখন ভারত পরাধীন, এই ব্যঙ্গের চাবুক তখন
ছালমাস কেটে হাড়ে গিয়ে লাগবার কথা। ব্যঙ্গের সেই ঝাঁজ আজ কমে
এলেও কৌতুকের সুস্বাদ কিন্তু আজও ষোলোআনা। চতুর্থ গল্প "গগন
চটি"তে কোনো অপার্থিব উপস্থিতি নেই, এ শুধু মানবজাতিকে
নিয়েই লেখা, এবং সার্থক ব্যঙ্গরচনার মাপকাঠিতে পরশুরামের সর্বোত্কৃষ্ট
বলা যায় নিঃসন্দেহে। কক্ষবিচ্যুত এক খণ্ডগ্রহ হঠাত্ কাছাকাছি
এসে পড়াতে পৃথিবী ধ্বংসের সম্ভাবনা বেড়ে গেলো। সাধারণ মানুষ
আবুবকর দরজি ভাবলে এটি তো রাজাদের ওড়ানো ফানুস, ভক্তিমতী ভুবনেশ্বরী
দেবী বললেন যে ভগবান কিছুতেই মানুষকে প্রলয়ে লোপ করাতে পারবেন
না। তাঁরা ভয় পেলেন না। কিন্তু যাঁরা অসাধারণ অর্থাত্ শাসকবর্গ
বা ধর্মগুরু, তাঁরা মৃত্যুভয়ে সব কুকর্মের স্বীকার গেলেন। পাকিস্তান
বললে "হিন্দি পাকী ভাই ভাই, লেকিন আগে কাশ্মীর চাই।"
তারপর প্রাকৃতিক নিয়মে গগন-চটি সরে গেল, রাষ্ট্রপুঞ্জ তাঁদের
স্বীকৃতি সব প্রত্যাহার করে পূর্বাবস্থায় ফিরে গেলেন-- "মান
ইজ্জত্ ধূলিসাত্" করে। প্রথম তিনটি গল্পের ব্যঙ্গকৌতুক
একটু কষ্টকল্পিত এবং মেকি মনে হতে পারে, কিন্তু সরাসরি মানুষকে
জড়িয়ে বলা শেষ গল্পটিতে এই কৌতুক এবং ব্যঙ্গ তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির
ফল, রসে ভরপুর ও মনোহর।
আরো ছটি গল্প-- ধুস্তুরীমায়া,
পরশ পাথর, যদুডাক্তারের পেশেণ্ট, একগুঁয়ে বার্থা, শিবামুখী চিমটে,
ষষ্ঠীর কৃপা-- অতিপ্রাকৃত বা নিছকই আজগুবি ঘটনার ওপর ভিত্তি
করে লেখা। এর প্রথম তিনটি কাহিনীতে অভিনবত্ব আছে, ব্যাপারও বেশ
ঘোরালো। "ধুস্তুরীমায়া"র দুই বুড়োর অন্তত একজন (উদ্ধব)
যৌবন ফিরে পেয়ে কিছু ফুর্তি করে নিতে চান, আরেকজন সঙ্গ দিতে
রাজী। ধুতরো ফলের নেশায় তাঁদের কী অভিজ্ঞতা হোলো তারই গল্প।
ব্যঙ্গ এলো যখন দোকানদার উদ্ধব যৌবন লাভ করে বিবাহের বিজ্ঞাপন
দিয়ে ভাবী পাত্রীকে, যিনি আবার নাকি রাজকুমারী, ইন্টারভিউ করতে
গেলেন-- সমাজের দুই তলার লোকের অতি মজাদার সঙ্ঘর্ষ। উদ্ধব আবিষ্কার
করলেন যে তাঁর প্রাচীন মন নিয়ে এই আধুনিক জগতে নতুন করে শুরু
করা তাঁর পোষাবে না, আর তাঁর কুরূপা রূঢ়ভাষিণী বহুদিনের গিন্নিই
এখনো তাঁর প্রাণেশ্বরী। অতএব তাঁরা ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরে
এলেন। এই বুড়োবয়সের ভালোবাসার ছবিটি ভারী মিষ্টি। পুরনো-নতুনের
এই যে তফাত্ এ তো রঙ্গব্যঙ্গের খনি। পরশুরাম অন্যত্রও এর ব্যবহার
করেছেন। গল্পের গতি কোথাও শিথিল হতে দেননি, ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী
এনেছেন গল্পের মায়াটিকে কায়েম করতে। আমরা ধাঁধায় পড়ে যাই যে
পুরো কাহিনীটাই কি ধুতরো প্রসাদাত্, না বোধহয় কেননা তাহলে
দুই বুড়োর অভিজ্ঞতা এমন মিলে যাচ্ছে কি করে; নাকি এ সত্যি ঘটনা।
আর পরশুরামের ট্রেডমার্ক অট্টহাস্যের কুচিতে ভরপুর-- "মাগী
রাঁধে যেন অমৃত", "মার্গিতব্যা থেকে মাগী হয়েছে?",
"সায়ংকালীন কোষ্ঠশুদ্ধি করলে.. মাথা মুছে সরে বসলেন"
ইত্যাদি। পরেশবাবু "পরশ পাথর" কুড়িয়ে পেয়ে ভেবেছিলেন
সোনা তৈরী করে ভাগ্য ফিরিয়ে ফেলবেন, কিন্তু পৃথিবীতে দাম না
দিয়ে পাওয়া যায় না কিছুই, শেষ পর্যন্ত সোনার দাম "এখন সাড়ে
চার আনা ভরি", পরেশবাবুর দুঃখ আর ঘুচলো না। মানুষের লোভ
নিয়ে ব্যঙ্গ আছে আর আছে এক ছোটো প্রেমের গল্প, সরাসরি পরশ পাথরের
সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়, কিন্তু পরশুরাম চমত্কার
কৌশল করে দিয়েছেন দুটি কাহিনী জুড়ে । "যদু ডাক্তারের পেশেণ্ট"
গল্পেও এই মুন্সীয়ানা দেখা যাচ্ছে। সেখানে একদিকে মৃতসঞ্জীবনী
আদি ঘোর তন্ত্রের ব্যাপার, আরেক দিকে এক অবৈধ প্রেম আর প্রতিহিংসার
কাহিনী। পরশুরামের হাতে এসে এরা মিলে গেল জোড়ের কোনো চিহ্ন না
রেখে, আসল মজাটি বাকী রেখে গেলো গল্পের শেষ লাইনটির জন্য। এদিকে
আবার কথকের চরিত্র -- "বয়স নব্বই... মাঝে মাঝে খেয়াল দেখে
আবোল-তাবোল বকেন" -- গোড়াতেই জানিয়ে পরশুরাম কাহিনীর সত্যতা
সম্পর্কে আমাদের সন্দেহের অবকাশ করে দিলেন।
এদের তুলনায় বাকি তিনটি
গল্প সাদামাটা বলতে হয়। "একগুঁয়ে বার্থা"তে বার্থা
গাড়ীই ভূত, তাকে "রম" খাওয়ালে সে মাতাল হতে পারে,
কিন্তু তার প্রভুভক্তি ছিলো অপরিসীম, যখন প্রভুহত্যার প্রতিশোধ
নিলো তখন সে কিন্তু মদ ছোঁয়নি। স্টিভেন কিঙের সাম্প্রতিক উপন্যাস
"ক্রিস্টিন"এ এমনি এক গাড়ীর গল্প আছে তবে সে ব্যাপার
আরো অনেক ঘোরালো। "শিবামুখী চিমটে" আরব্য উপন্যাসের
গল্পের ছায়ায়, তাতে বাহবা বলার কিছু নেই, কেবল পঁচিশ বছর বয়সের
অরক্ষণীয়া সরসী পিসির জন্য মন খারাপ লাগে। এ গল্পের "আলাদিন"
ছোট্টো ঝিণ্টুর সঙ্গে আমরাও মনে মনে বলি আর যাই আকাশকুসুম হয়ে
উড়ে যাক না কেন, পিসির বিয়েটা যেন শেষ পর্যন্ত ঘটে। "ষষ্ঠীর
কৃপা" গল্পের শেষে কামুক ভণ্ড এক প্রৌঢ় ব্রাহ্মণ তার স্ত্রীনির্যাতনের
উপযুক্ত শাস্তি পেল দেখে ভালো লাগে, আরো ভালো লাগে এই দেখে যে
যিনি শাস্তি দিলেন সেই দেবী ষষ্ঠী করুণাময়ী, বৃদ্ধের খাওয়াপরার
অন্তত কিছু ব্যবস্থা করতে ভুললেন না।
সুমিত
রায়
(পরের
অংশ)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।