প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

প্রসঙ্গ: পরশুরাম (১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯)

(আগের অংশ) পরশুরাম ছোটো গল্প লিখেছেন, ছোটো গল্পে জটিল চরিত্রসৃষ্টির সময়ই পাওয়া যায় না, তার ওপরে তা যদি ব্যঙ্গাত্মক রচনা হয় এবং লেখক যদি রঙ্গের দিকেই বেশী নজর দেন। তা সত্ত্বেও পরশুরাম অন্তত দুটি-- একটু আফিঙের ঘোরে থাকলে তিনটি-- চরিত্র বাংলা সাহিত্যকে দিয়ে গেছেন যারা নিঃসন্দেহে আফিংখোর ব্রাহ্মণ কমলাকান্তের সঙ্গে একসারিতে বসতে পারে। পরশুরাম এঁদের একাধিক কাহিনীতে উপস্থিত করেছেন, তাই আমরা তাঁর শত গল্পের মনে রাখার মতো শতাধিক চরিত্রের চেয়ে এঁদের পরিচয় পেয়েছি একটু বেশী। প্রথমেই নাম করতে হয় "ক্যাদার চাটুজ্যে"-র, গড্ডলিকা বইয়ের "লম্বকর্ণ" গল্পে তাঁর প্রথম পরিচয় পেলাম আমরা, খুব ফলাও করে নয় যদিও, বংশলোচনবাবুর পরিবার ও আড্ডাধারীদের সঙ্গে। তবে সেখানেই শিকারী বেড়ালের গোঁফের দেখা একটু পাওয়া গেলো যখন তিনি আমাদের মজিলপুরের ভুটে ছাগলের গল্প শোনালেন। তারপর "দক্ষিণ রায়", "স্বয়ম্বরা" আর "মহেশের মহাযাত্রা"-তে আবার দেখা, প্রথম ও তৃতীয়টিতে কেদার চাটুজ্যে হলেন মূল গায়েন, আর দ্বিতীয়টির নায়ক বলা যায় নির্দ্বিধায়। "গুরুবিদায়" গল্পে চাটুজ্যে আরো উপযুক্ত প্রাণীকে পাদপ্রদীপ ছেড়ে দিলেও পরের কাহিনী "রাতারাতি"-তে আবার প্রায় পূর্ণগৌরবে প্রতিষ্ঠিত। চাটুজ্যে হলেন ভুয়োদর্শী, বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ চাটুজ্যে কুলতিলক, বঙ্কিম-শরতের এক দলের লোক, সাপ-বাঘ-ভূত-হনুমান এমনকি পুলিসকোর্টের উকিল, সবাইকে কলা দেখিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত "দেহযষ্টি"-শালিনী মেমসাহেবের ভ্রূকুটিতেও ভয় পাননি, সগর্বে ঘোষণা করেছেন "আই কেদার চাটুজ্যে, নো জু গার্ডেন", এবং ফলং মেমসাহেবের কাছ থেকে মেমজনোচিত পুরস্কারও পেয়েছেন। মোটামুটি সাত্ত্বিক নিয়মে চলেন, শাস্ত্রের বিধান আছে জেনেই ম্লেচ্ছের হাতে চা খান; পাঁঠার মাংসে আপত্তি নেই যদিও। গোঁফদাড়ি কামিয়ে চেহারায় তরুণ, আর তারুণ্য তাঁর মনেও, তরুণদলের ডেপুটেশনের তিনিই ঘাবড়ে না গিয়ে মুখপাত্র হতে পারেন । নাড়ীজ্ঞান আছে, পুঁথি সংগ্রহ করেন, সর্বজ্ঞ লোক, বকুলাল দত্তের জীবন, মনন ও পরিবর্তনের অপার্থিব কাহিনী জেনেছেন এবং জানিয়েছেন। দোষের মধ্যে জিগীষা দেবীকে জিঘাংসা দেবী বলে ফেলেছিলেন, আর মৃত্যুমুখ থেকে ফেরত আসা বংশলোচন বাবু ও তাঁর স্ত্রী মানিনী দেবীর পতিসেবার পথে প্রতিবন্ধক হয়ে উপস্থিত ছিলেন ( "মানিনী বলিলেন '... আঃ, চাটুজ্যে মিন্‌সে নড়ে না' ")। তা এ সব সামান্য বিচ্যুতি ধর্তব্যের মধ্যে আনা ঠিক হবে না।

পরশুরামের কৃপায় আরেকটি প্রাণী আমাদের চেতনায় প্রবেশ করেছে কেদার চাটুজ্যের সঙ্গেই, সে মানুষ নয়, সে একটি ছাগল। তার যৌবনোদ্গমের কালে যখন সে অজাতশ্মশ্রু তখন সে আমাদের দেখা দিয়েছে, কোথা থেকে সে এলো তার কোনো হদিশ নেই, প্রয়োজনও হয়নি। দেখা দিয়েই সে আমাদের মন না কাড়ুক, আমাদের নজর কেড়েছে তার ভোজনচতুরতা দেখিয়ে। সে কড়া গোটা দুই বর্মা চুরুট খেয়েছে, চামড়ার সিগার কেস চাখতে তার আপত্তি নেই, সে সংস্কারমুক্ত। সে মানবচরিত্র বোঝে, খুঁজে পেতে শান্তপ্রকৃতির বংশলোচনবাবুকেই সে মুরুব্বি পাকড়েছে। তার অদম্য জ্ঞানস্পৃহা, সেকারণে তিন অধ্যায় গীতা খেয়েছে, অবশ্য রেড়ির তেল অনুপান দিয়ে, কেরাসিন ব্যাণ্ডের সব বাজনা চেখে দেখে তাদের স্বরূপ জানতে চেয়েছে। পার্থিব লোভ তাকে স্পর্শ করে না, "লব্বই টাকার লম্বরী লোট" সে হেলায় খেয়ে ফেলে। সবচেয়ে বড়ো কথা যে সে উপকারের প্রতিদান দিতে জানে। শুধু একবার নয় দু-দুবার সে বংশলোচনবাবুর হয়ে লড়েছে-- প্রথমবার বিদ্যুত্‍‌স্পৃষ্ট বংশলোচনের উদ্ধারের পথিকৃত্‍‌ হয়ে, আর দ্বিতীয়বার বংশলোচনের ধূর্ত প্রতিদ্বন্দ্বী গুরুদেব খল্বিদং স্বামীকে আসনচ্যুত করে। প্রসঙ্গত, দুবারই বংশলোচনের ফেঁসে যাওয়া দাম্পত্যজীবন রিপু হয়েছে এই লম্বকর্ণের কারণে। এমন প্রাণীর জাতীয় পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিলো, কিন্তু তাকে যে গুলিকাবাব হতে হবেনা এই আশ্বাসে সে কেমিক্যাল সোনা বাঁধানো শিং নিয়েই খুসি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে নিয়ে "লম্বকর্ণ পালা" যাত্রা লিখেছিলেন।

দুঃখের কথা এই যে যে পরশুরামের সাহিত্য্কৃতির দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবার আগে লম্বকর্ণকে সঙ্গে নিয়ে চাটুজ্যে বিদায় নিয়েছেন। সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন বংশলোচনবাবুর বৈঠকখানা, আড্ডা, আর সব মিলিয়ে এক নিস্তরঙ্গ, নিশ্চিন্ত, মন্থর জীবনযাত্রার পরিবেশ। নাক সিঁটকোবার কিছু নেই, এ হোলো ইংরেজী শাসনের আফিমি মৌতাত, যদিও তলায় তলায় তখন আমরা পরাধীন দাস ছাড়া আর কিছুই নয়। পরের পর্যায়ে আমরা অবশ্য পেয়েছি জটাধর বকশীকে-- তিনবার, যথাক্রমে "জটাধর বকশী", "জটাধরের বিপদ" ও "চাঙ্গায়নী সুধা"-তে। জটাধর বকশী বাকচতুর জোচ্চোর, কিন্তু তার লোভ মাত্রাতিরিক্ত নয়। যা রয়সয়, এই একটু চপ কাটলেট, পান, তামাক-- প্রথম দুবার একবার সাড়ে চোদ্দো আনা, একবার সাড়ে ন'টাকা, আর শেষবারে একটু বড়ো কোপ, তা প্রায় পঁচাত্তর টাকা মত-- তাই নিয়েই সে খুসি। তার বদলে সে যা দিয়ে গেছে তা যে কোনো বেস্ট সেলার উপন্যাসের মোকাবেলা করতে পারে-- প্রথমটি এক রোমাঞ্চকর ভূতের গল্প, দ্বিতীয়টিতে একটু পরকীয়ার ছোঁয়াচ দেওয়া প্রেম ও তজ্জনিত গণ্ডগোল, তা নিয়ে দস্তুরমতো বাংলা সিনেমা করা যায়। ক্যালকাটা টি ক্যাবিনের আড্ডাধারীরা সে কথা বোঝেন, বুঝেই তাঁরা জটাধরকে মাপ করে দিয়েছেন। আর শেষবার দিয়েছে স্বয়ং কানু মহারাজের সৃষ্টি এক স্বর্গীয় পানীয়, তার মধ্যেকার পোয়াটাক ইলেক্‌ট্রিসিটির দামই মাগ্‌গি গণ্ডার বাজারে পঁচাত্তর টাকা হতে পারে। ক্যালকাটা টি ক্যাবিনের প্রবাসী পেন্‌সনভোগী বুড়ো, ব্যাঙ্কের কেরাণী-আদি মানুষদের তরঙ্গহীন "শুধু দিনযাপনের শুধু প্রাণধারণের গ্লানি"-ময় জীবন যে জটাধরের উপস্থিতিতে সমৃদ্ধ হয়েছে এ কথা কিন্তু আমাদের মানতেই হবে।

এই তিন মূর্তি, এবং তাঁদের পার্শ্বচরদের ছাড়া আরো চারজনকে পরশুরাম একাধিক গল্পে এনেছেন। তাঁরা হলেন আধপাগল সিদ্ধিনাথ, বন্ধুপত্নীদত্ত উপাধি বকবক্তা, তিনি একবার দেখা দিয়েছেন পলেমিসিস্ট হয়ে ("সিদ্ধিনাথের প্রলাপ") আরেকবার নিছক গল্পবক্তা ("তিলোত্তমা"); সবজান্তা পিনাকী সর্বজ্ঞ ("দ্বান্দ্বিক কবিতা" ও "নিকষিত হেম") শ্রোতা, কিন্তু খুব দামী শ্রোতা, ঠিকঠিক প্রশ্ন তুলে গল্প চারিয়ে রাখেন; বিচক্ষণ নাগরিক সুশীল চন্দ্র চন্দ, দক্ষিণ কোলকাতার লেক অঞ্চলে কিছু পাগল-ছাগলদের সঙ্গে তাঁর দৈবগতিকে দেখা হয়ে যায় ("অক্রূরসংবাদ" ও "নীলকণ্ঠ"): এবং "প্রখ্যাত গ্রন্থকার এবং বাণীর একনিষ্ঠ সাধক, অর্থাত্‍‌ পেশাদার লেখক" বটেশ্বর সিকদার, যিনি ধনী কিন্তু "একগুঁয়ে কঞ্জুস লোক" বলে বদনাম আছে ("বটেশ্বরের অবদান" ও "দুই সিংহ") । বটেশ্বর ব্যতিরেকে অন্যরা যে গল্পে আছেন সেখানে তাঁদের কাজ গল্পটি চালু রাখা মাত্র, তার বেশী নয়, কাজেই এঁদের চরিত্রে খুব একটা চমক নেই। এছাড়া আছেন অসংখ্য চরিত্র যাঁরা পরশুরামের শিল্পের যাদুতে খুব সামান্য সময় এসেই চোখ ধাঁধিয়ে মনে চিরকালের জায়গা করে নেন। তাঁদের সবায়ের তালিকা দেওয়া সম্ভব নয়, সেখানে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারও আছে, তবে কয়েকজনের নাম তাঁদের খ্যাতি যাচাই করার জন্য লেখা গেলো। শ্যামানন্দ ব্রহ্মচারী ও গণ্ডেরিরাম তো মিছিলে সবার আগে, কিন্তু তাঁদের পিছনেই আছেন "পাড়ার বিচক্ষণ কোবরেজ" তারিণী স্যান। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে "খুলনের যন্তিবাবুর" ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ালো তা জেনে নেবার ইচ্ছে আছে। আছেন খাঁটি মোগলাই রক্তের যথার্থ উত্তরপুরুষ মৌলবী ম্রেদম খাঁ ওরফে বছিরুদ্দি তাঁর আব-এ-জমজমের শিশি নিয়ে; যাদব ডাক্তারের শ্যালক নকুড়, ভাগনে কেষ্টর কল্যাণে নকুড়মামা বলেই তাঁর খ্যাতি, দার্জিলিং ভ্রমণে তাঁর সমূহ অনীহা। আর সেখানকার বোদাকে কি বাদ দেওয়া যায়? যশোমতী জিগীষা দেবীর পেছনের পুরুষ সুষেণ, তিনি বীরবংশের ছেলে, তাঁর তুতো ভায়েরা সব কালজয়ী কীর্তিমান।

সুমিত রায়

(পরের অংশ)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।