প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

প্রসঙ্গ: পরশুরাম (১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯)

(আগের অংশ) পরশুরামের তীক্ষ্ণতম ব্যঙ্গকাহিনী বোধহয় "মাত্‍‌স্য ন্যায়"। গণপতি মাত্‍‌স্য সমাজের সদস্য, আড়কাঠিও বটে। এই সমাজের মন্ত্র "মনুষ্যরূপী মত্‍‌স্যকে খুবলে খেতে হবে"। তারা হিসেব করে বার করেছে যে, যে কুকর্মে ধরা পড়ার এবং শাস্তি পাবার সম্ভাবনা যতো বেশী, সে কুকর্মে লাভও ততোই বেশী। তবে এই ক্রমবর্ধমান লাভের পথে হাঁটি হাঁটি পা পা করে প্রবেশ করে আস্তে আস্তে গতি বাড়ানোই প্রশস্ত। গণপতির প্ররোচনায় তার বন্ধু দিবাকর সমাজের সদস্য হয়ে আস্তে আস্তে জটিল থেকে জটিলতর কুকর্মে যেতে যেতে একদিন ধরা পড়ে জেলে গেলো। দুবছর পরে জেল থেকে বেরিয়ে রজনীকান্ত নাম নিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে সে উঠলো মাত্‍‌স্য সমাজের শীর্ষে। এখন "... তাঁর মতন ক্ষমতাশালী লোক আর কেউ নেই।" লেখাটির প্রতি ছত্রে আজকের সমাজকে পরশুরাম চাবুক মেরেছেন, কৌতুকের স্নিগ্ধতা অনুপস্থিত। এমনকি কাহিনীর শেষেও অন্যায় আর অশুভের হাত থেকে নিষ্কৃতির কোনো ইঙ্গিত তিনি দেন নি। এটা পড়ে মনে হয় এখানে অনেকদিনের জমাট ক্রোধ আর বিরক্তির বিস্ফোরণ, ঠিক পরশুরামের স্টাইল এটা নয়। এতোটা তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ না হলেও "সাড়ে সাত লাখ" গল্পে যে ব্যঙ্গের চাবুক আছে তা প্রণিধানযোগ্য। দুই ভাই সাড়ে সাত লাখ টাকা (পঞ্চাশের দশকে এ অনেক টাকা) কোনো সত্‍‌কাজে ব্যয় করতে চায়, কোথায় এবং কী ভাবে, তারই পরামর্শ নিতে তারা মহাপণ্ডিত ডঃ প্রেমসিন্ধু খাণ্ডারীর (পদবীটি লক্ষ্যণীয়) দ্বারস্থ হয়েছে। গল্পটার প্রায় অর্ধেক জুড়ে কীভাবে টাকাটা তারা পেলো তার কথা বলা হয়েছে, সেটা মামুলি। প্রেমসিন্ধু চরমবাদী, পলেমিসিস্ট অফ পলেমিসিস্টস্‌, গল্পের সারটা হোলো এ প্রসঙ্গে তাঁর যুক্তি ও উপদেশ। ধর্মসংস্থা যথা মঠ, সেবাশ্রম, উদ্বাস্তুকল্যাণ, স্কুল বা কলেজ, সরকার, রিসার্চ ল্যাবরেটরি, আতুরাশ্রম-- সব প্রস্তাবই একে একে খারিজ হোলো প্রেমসিন্ধুর যুক্তিতে, প্রতিটির পিছনে অবশ্যই লুকানো আছে পরশুরামের ব্যঙ্গের অমোঘ শর। দেখা গেলো প্রেমসিন্ধু ম্যালথাসিয়ান আদর্শে বিশ্বাসী, তাঁর মতে সমাজের জঞ্জাল আর আগাছা উত্‍‌পাটন করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণই মানবজাতির কল্যাণের জন্য আশু আবশ্যক। তার জন্য জনমত গড়ে তুলতে হবে এবং টাকাটা সেই উদ্দেশ্যে খরচ করাটাই হবে বাঞ্ছনীয়। ভায়েরা শেষ পর্যন্ত রীতিগত দানখয়রাতেই টাকাটা খরচ করতে মনস্থ করলো, এটুকু শান্তি। এই কাহিনী লেখার কালে ভারতে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল অতএব প্রেমসিন্ধুর শেষ যুক্তি গ্রহণযোগ্য না হলেও বিষয়টি তত্‍‌কালীন সময়োপযোগী। ব্যঙ্গের খোরাকটা তো আছেই।তাঁর প্রথম যুগের লেখা "মহাবিদ্যা" নাটিকায় সমাজে অসাধুতার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, আসলে মহাবিদ্যাটি চুরিবিদ্যা এই বুঝিয়ে। কিন্তু সে নাটকে কৌতুকের ভাগ বেশী, এমন যুক্তিনির্ভর নয় আর তিক্ততাও কম। "উত্‍‌কোচ তত্ত্ব"-এ গল্প বেশী, তত্ত্ব কম। ধর্মভীরু জেলা জজ লোকনাথ পাল ঘুষের ওপর বই লিখবেন, তার নোট লিখছেন, "স্পষ্ট ঘুষ, প্রচ্ছন্ন ঘুষ আর নিষ্কাম উপহার-- এদের প্রভেদ নির্ণয় সকল ক্ষেত্রে করা যায় না।" তারই উদাহরণ হিসেবে লোকনাথ যে এমনই এক প্রচ্ছন্ন ঘুষের ব্যাপারে জড়িত হয়ে পড়ছিলেন তারই কথা লেখা হয়েছে। বুদ্ধি খাটিয়ে লোকনাথ সে ফাঁড়া কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন, গল্পের এখানেই শেষ।

পরশুরামের কিছু কাহিনী আছে যাতে তিনি শুধু একটি চরিত্রেরই ছবি এঁকেছেন, অবশ্য দিব্যদৃষ্টিমান গল্পলেখককে বাদ দিলে । একজন হলেন "অক্রূর সংবাদ"-এর "বাতিকগ্রস্ত" অক্রূর, যিনি চাকরবাকরদের হেলান দেবার বদভ্যাস ছাড়াবার জন্য সারা বাড়ীতে গ্রামোফোনের পিন লাগিয়ে রাখেন। তিন রকম -- কর্তা প্রবল, গিন্নি প্রবলা বা দুজনের প্রাবল্যই সমান-- বিয়ে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। আছেন কাশীনাথ ("কাশীনাথের জন্মান্তর"), তিনি তাঁর সাবেকি কালের মূল্যবোধ নিয়ে পুনর্জন্ম গ্রহণ করে নতুন জমানার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারলেন না কিছুতেই। আমার ঠাকুরদাও পুনর্জন্ম নিলে এমনটিই করতেন। "ভূষণ পাল" ফাঁসির আসামী, মরার আগে সে তার যত্‍‌সামান্য সম্পত্তির ব্যবস্থা করে যেতে চায়, কেবল সে ব্যবস্থা আমাদের প্রচলিত রীতিমাফিক নয়, সে ব্যবস্থাটি ভূষণের হিসেবমতো। ভূষণের যুক্তি যে কুযুক্তি নয় তা শেষ পর্যন্ত আমাদের মানতেই হয়। নীলকণ্ঠ তবলদারের ("নীলকণ্ঠ ") সঙ্গে আমাদের পরিচয় তিনি যখন লেকে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছেন। জানা গেলো লোকটি অতি সরলচিত্ত, মানুষকে নিঃসর্তে বিশ্বাস করে ফেলেন এবং লোকে নানারকমভাবে তার সুবিধে নেয়, যেমন একবার তাঁর বিয়ে দিয়েছিলো এক ছোকরার সঙ্গে, এমন কী বিষেও ভেজাল দিয়েছে। সাবডেপুটি ভবতোষ ("ভবতোষ ঠাকুর) আত্মস্থ নির্বিরোধী লোক, রিটায়ার করার পর "কেবল পড়েন আর ভাবেন"। তাঁকে ধরে বেঁধে লোকেরা গুরুঠাকুর বানিয়ে দিল। তাঁর কাছে এখন লোকে আসে জ্যোতিষগণনা করাতে, সোনা তৈরী করতে বা পুত্রশোকে সান্ত্বনা পেতে। ভবতোষ এসব কিছুই পেরে ওঠেন না, শুধু শোকার্ত বাবামাকে সহজ উপদেশ দেন, "সকলের দুঃখ বোঝার চেষ্টা করো, তাতে নিজের দুঃখ কমবে।" এ ধরণের ঠাকুরে ভক্তদের ঠিক পোষায় না। প্রায় সবকটিতেই দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রে একজন সরল মনের গোবেচারা মানুষ, পৃথিবীর জটিল নিয়মকানুন মেনে চলতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছেন। বলা বাহুল্য পরশুরামের সমর্থন বা সস্নেহ প্রশ্রয় তাঁদেরই দিকে।

শ্লেষ কম, কৌতুক বেশী এমন চরিত্রচিত্রও আছে কিছু। "গুপী সায়েব" খাঁটি বাঙালী, শোলার টুপি পরে চলাফেরা করে তাই সায়েব। তার লেখাপড়া বেশী দূর নয় তবে সে খুব পরোপকারী, শখ করে লোকের ফরমাশ খাটে, যেমন একবার এক ঘোর শৈবের জন্য তারাপীঠ থেকে পাখি এনে দিয়েছিল যে পাখি "তারা তারা বল্‌ শালারা" পড়তো। এই গুপীর নানা কীর্তিকলাপ, যথা বই ধার নেওয়া বা পকেটমারের উত্‍‌পাত বন্ধ করতে কাঁকড়াবিছের ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে কাহিনী, কিন্তু তার মধ্যেই তখনকার লীগ মন্ত্রীসভার আমলে কাজীর বিচার নিয়ে ব্যঙ্গ স্থান পেয়েছে, পরশুরামের গল্পে যেমনটি আশা করা যায়। "উত্‍‌কণ্ঠা স্তম্ভ", অর্থাত্‍‌ এ্যাগনি কলাম মারফত্‍‌ প্রাণতোষ বা পানুর সঙ্গে আমাদের পরিচয়। সে একটি চীজ বটে, বাপের তহবিল থেকে টাকা চুরি করে পাড়ার একটি মেয়েকে ফুসলিয়ে নিয়ে বোম্বাই পালায়, সেখানে মেয়েটির গহনা চুরি করে ভাগে আবার। আরো কিছু কীর্তির পর শেষ যখন তার দেখা পাই তখন সে সিংগাপুরে মিস ফুক-সানকে ভজাচ্ছে। "গণত্‍‌কার" গল্পটি যাঁর নামে সেই মীনেন্দ্র মাইতি মিনাণ্ডার দি মাইটি নাম নিয়ে জ্যোতিষের ব্যবসা চালান। গল্পে তাঁর প্রকাশ্যে দেখা পাওয়া যায় না, যা জানতে পারি তা মীনেন্দ্রের এক পাওনাদারের বয়ানে। জ্যোতিষ, জ্যোতিষী এবং তাদের খদ্দেরদের নিয়ে পরশুরাম কিছু কৌতুক করে যান। "জয়রাম জয়ন্তী" এই একই ধাঁচের কৌতুক রচনা শতজীবী জয়রাম নন্দীকে নিয়ে। জয়রাম বয়সের তুলনায় ভালোই আছেন, পেটুক কিন্তু পেটরোগা, "মাঝে মাঝে স্মৃতির ওলটপালট হয়"। তাঁরই শততম জন্মদিনের রঙীন গল্প, জয়রাম আমেরিকানদের সহ্য করতে পারেন না, তিনি চান ইংরেজরা আবার এদেশে ফিরে আসুন, আবার স্বর্ণযুগ হোক। এই নিয়ে সামান্য শ্লেষ। এই ধরনের গল্পের সমাহার তাঁর শেষ গল্পের বই "চমত্‍‌কুমারী ইত্যাদি গল্প"-তেই বেশী, এটা লক্ষ্য করা গেলো, তার তাত্‍‌পর্য কিছু আছে কিনা জানা নেই।

পরশুরাম হাস্যরসিক, মুখ্যত ব্যঙ্গ, কৌতুক আর রসিকতা নিয়ে তাঁর কারবার। কৌতুকের বর্ণালীর বিস্তার একদিকে মুচকি হাসি চাই কী প্রচ্ছন্ন হাসি থেকে বিষম খাওয়ার হাসি, তার থেকে আরো এগিয়ে তীব্র ব্যঙ্গের চাবুকের জ্বালায় দাঁত খিঁচনো হাসি। বেশীর ভাগ সময়েই পরশুরাম হলেন মুচকি হাসির জোগানদার, পাতায় পাতায় ছত্রে ছত্রে মুচকি হাসির খোরাক। তাঁর সব গল্পেই অল্পবিস্তর এই ধরণের রসিকতা পাওয়া যাবে, "ভূষণ পাল" গল্পটি বোধহয় একমাত্র ব্যতিক্রম। ও আরেকটা কথা, পরশুরাম মধ্যে মধ্যে বিষম খাবার মতো হাসিও লুকিয়ে রাখেন, তাই চা মুখে নিয়ে পরশুরাম পড়লে বিপদ হতে পারে। 'আচ্ছা পিসীমা তুমি ঋষি খেয়েছ?', 'হয়, হয় zPান্‌তি পার না', 'একটা জোলাপ দিলে হয় না', 'কেন, ননির বুঝি আর কাঁচা ঘাস হজম হয় না', 'বাঁদিপোতার গামছা খাটো করে পরা', 'লালিমা পাল (পুং)', 'এ সাহেবঅ, ওপাকে যিব তো ডণ্ডা খিব', 'হনুমান বলিলেন -- চোপ', 'ভূত জবাব দিলে - সেকেণ্ড ইয়ার সার', 'জিগীষা দেবী ডাকিলেন -- সুষ্‌ সুষ্‌', .'বোধহয় শালা লুট লিয়া বাজাচ্ছে', 'মাগী রাঁধে যেন একেবারে অমৃত' ...। আর তালিকা বাড়াবার দরকার নেই, পাঠক-পাঠিকা তাঁদের নিজেদের পছন্দসই দমফাটা হাসির উদ্ধৃতি জুড়ে নিতে পারেন। ব্যঙ্গের ব্যাপারেও পরশুরাম চরমপন্থী নন, সেই ব্যঙ্গের লক্ষ্য যদি কোনো গোষ্ঠী না হয়। এবং সেখানেও পরশুরাম সংযত, যা বলা যেতে পারতো, তার কম বলে ইঙ্গিতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাঁর অনেক গল্পেই তিনি ব্যঙ্গ করেছেন যাদের তারা অনেকেই আমাদের রোজকার চেনা মানুষ, তাদের দশা, দুর্দশা নিয়ে হাসতে পারি, হাসতে হাসতে দুয়োও দিতে পারি কিন্তু ঠিক ঘৃণা করতে পারিনা। পরশুরাম এমনটাই চেয়েছেন, তাঁর উদ্দেশ্য সাধারণ মানবজাতির এবং সমাজব্যবস্থার ভুল দেখানো, ব্যক্তিগত আক্রমণ বা ভেন্‌ডেটা নয়। অনেক পণ্ডিত বলে থাকেন যে হাসির আড়ালে একটু অশ্রু প্রচ্ছন্ন না থাকলে ঠিক সাহিত্য হয় না। এ কথাটা না মানলেও শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যে পরশুরামের রচনায় এই অভাবটা আমাদের দেখিয়েছেন, তার সত্যতাটা মানতে হবে। আসলে পরশুরাম হলেন বাস্তবমুখী উচ্ছ্বাসবিরোধী লেখক, তাঁর গল্পের চরিত্রের প্রকাশ যুক্তি -- এবং অযুক্তির-- আলোয়। খুঁজলে অবশ্য দুয়েকজায়গায় অশ্রুর আভাস পাওয়া যাবে, অতিপ্রচ্ছন্ন। যেমন "সত্যসন্ধ বিনায়ক"-এর পরিণতিতে। অথবা "দাঁড়কাগ"-এর কালো মেয়ে তমিস্রা, যে মূর্খ কাঞ্চন মজুমদারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেল বটে কিন্তু ঘরণী হবার ঘর না পাওয়ার দুঃখ নিয়েই তাকে থাকতে হবে বোধহয়। "কৃষ্ণকলি"-র মা মারা যাবার পর সে ভেসে যেতে পারতো কিন্তু সেই খেটে খাওয়া গরীব মানুষদের সমাজেরই মুড়িউলী তাকে দয়া করে টেনে নিলো ঘরের বৌ করে, কেমন সুন্দর সহজ সমাধান। আমরা পেলাম একটি নিটোল গল্প, তাতে বালবিবাহের আইনভঙ্গ হলেই বা কী হোলো।

সুমিত রায়

(পরের অংশ)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।