প্রসঙ্গ:
পরশুরাম (১)
(২) (৩)
(৪) (৫)
(৬) (৭) (৮)
(৯)
(আগের
অংশ) পরশুরাম গল্প লিখেছেন অনেক জাঁরের, কিছু বেশী, কিছু
কম, কিছু ভালো, কিছু মন্দ, কিছু হাসির, কিছু জ্ঞানের। কিন্তু
তাঁর সব লেখাতে যেটি ধ্রুবক, তা হোলো তাঁর ভাষা, আসলে তার থেকেও
বেশী, প্রসাদগুণ। অলঙ্কারশাস্ত্রে প্রসাদগুণ বলতে বোঝায় ভাষাপ্রয়োগের
সেই গুণ যা পড়লেই পাঠকের চিত্ত আকর্ষণ করে। পরশুরামের ভাষা ঝরঝরে,
স্বচ্ছ, বলিষ্ঠ, বহমান। ভাষা প্রয়োগের সব দিক খতিয়ে দেখলে--
শব্দচয়ন, বাক্যবিন্যাস, উপমার ব্যবহার, গল্পের রসের মাপসই ভাষার
প্রয়োগ-- সবতাতেই পরশুরাম ভাস্বর। এমন যাদুকর ভাষারীতির একটা
মুস্কিল আছে, তা হোলো যে মোড়কের মোহে মুগ্ধ হয়ে অনেকসময় যা মোড়া
আছে তার দিকে পুরো নজর যায় না। রবীন্দ্রনাথে এই যাদু ছিলো। পরশুরাম
পড়তে পড়তে আমরা ভুলে যাই যে তাঁর বহু চরিত্র অতি দুর্বলভাবে
চিত্রিত, যদিও রঙ্গব্যঙ্গ মুখ্য হবার যথার্থ কারণেই, রোমান্সের
মিষ্টি ছোঁয়াটার ঠিক মর্যাদা দিতে পারিনা, যথা "বিরিঞ্চিবাবা"।
আরো যেমন: "শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড"-এ ধর্মবিশ্বাস
ভাঙিয়ে টাকা করবার প্ল্যানটি কিন্তু বাঙালী শ্যামানন্দের উদ্ভাবন।
তবে অর্থমূল্যে তাঁর দৌড় পনেরো হাজার টাকা, তার বেশী জোর তাঁর
কলজেয় নেই। সেই আইডিয়া ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকায় দাঁড়
করাবার জন্য দরকার পড়লো মাড়োয়ারী গণ্ডেরিরামের। পরশুরাম সত্যদ্রষ্টা,
এ ব্যাপারটা আজও ঘটছে। তবে গল্পটি প্রথম পড়ার সময় এই সত্যটি
খুব কম লোকের কাছেই প্রতিভাত হবে, দুতিনবার পড়া চাই।
তাঁর প্রথম গল্প ১৯২২ সালে
যখন প্রকাশিত হয় তখন প্রমথ চৌধুরীর "বীরবলী" চলিত
ভাষার আন্দোলন প্রবল, যদিও সব বিশিষ্ট সাহিত্যিক তাতে যোগ দেন
নি। পরশুরামও সেইমতোই গোড়ার দিকের গল্প লিখলেন সাধু ভাষায়। কিছু
কাহিনী পুরো সাধুভাষায় (যথা "হনুমানের স্বপ্ন"), কিছুতে
বর্ণনা সাধুভাষায় কিন্তু সংলাপ চলিতস্য চলিত (নজরে পড়ার মতো
প্রয়োগ "দক্ষিণরায়", সেখানে প্রায় সব গল্পটাই কেদার
চাটুজ্যের জবানীতে), থেকে থেকেই সাধু আর চলিতের অপূর্ব গুরুচণ্ডালী।
"হলা দগ্ধাননে নির্ল্লজ্জে ঘেঁচী", "শ্যামাঙ্গী,
চঞ্চলা, চকিতমৃগনয়না টেবো টেবো গাল"। বহু প্রচলিত প্রবাদ
"শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল, চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা"র আর্ষপ্রয়োগ
"শৌণ্ডিকের সাক্ষী মদ্যপ, তস্করের সাক্ষী গ্রন্থিচ্ছেদক"
যে সাধুভাষার গুণে কৌতুককর, তা এমন করে পরশুরাম ছাড়া আর কে আমাদের
জানাতে পারতেন। এই যে পাশাপাশি তত্সম শব্দে ভরা সাধুভাষার
গাম্ভীর্য আর তার পাশেই নিতান্ত ঘরোয়া চলিত ভাষার চটুলতা এবং
কখনো কখনো দুটির ভূমিকা সম্পূর্ণ উল্টে দেওয়া-- এ সবই কুশলী
হাস্যরসিকের হাতের নিপুণ কাজ, ভাষাতত্ত্ববিদ্ রাজশেখরের কাছে
এ ছিলো জলভাত। "হনুমানের স্বপ্ন" বইয়ের শেষ দিকের
দুতিনটে গল্প থেকে অবশ্য পরশুরাম সাধু ভাষা ব্যবহার একেবারে
ত্যাগ করলেন, সাল ১৯৩২। আর ফিরে গেলেন না। প্রমথনাথ বিশীর মতে
"এই একটি কারণে [বাহন কথ্যভাষা] পরশুরামের শেষ ছয়খানি গল্পগ্রন্থ
কিছু পরিমাণে ম্লান"। তার কিছুটা মানতে আমরা রাজী আছি,
সব না হোক, উত্তরপর্বের কিছু গল্প-- যথা "ধুস্তুরীমায়া"
বা "লক্ষ্মীর বাহন"-- পড়তে পড়তে আমাদের মনে হয়েছে
যে সেগুলো যদি ওই প্রথমদিকের ভাষায় লিখতেন তাহলে জমতো বেশী।
শব্দ প্রয়োগ, চাই কী মাঝে
মাঝে শব্দ তৈরীতেও পরশুরাম অতুলনীয়, তার অনেক্গুলো বাংলা ভাষার
মধ্যে পাকাপাকি ঢুকে গেছে। তার কিছু উদাহরণ দেখা যাক: সদ্যোজাত
অ্যাটর্ণি, গিন্নীভজা, চাঙ্গায়নী সুধা, পোয়াটাক ইলেক্ট্রিসিটি,
করুণ বিশ্বলুট ভাব, ঔদরিক ঔদার্য, মুরগীর ফ্রেঞ্চ মালপো, মাস্কিউলার
মদ্দা হাত, সাহিত্যিক গুণ্ডা, পরিমার্জিত মিথ্যে, ফরিদপুরী উর্দু,
সতীসাধ্বী বারাঙ্গনা, কাগমার্গ, ভেজিটেবল সু, রামচন্দ্রী স্বামী,
সব হেঁ হেঁ-- এরকম আরো কয়েক ডজন না খুঁজেই মনে পড়ে যাবে। বিদেশী
শব্দেও-- ঘুত্ মর্নিং, দিল গিরিফতার, ডণ্ডা খিব। কুক্কুটাণ্ড-বিবর্ধন-পরীক্ষা-সংস্থা-আযুক্তক
ভেবে দেখুন। রাজশেখর ভাষাবিদ, তিনি অভিধান লেখেন, তাঁর পক্ষে
এমন বিশেষ্য-বিশেষণ জোড়া লাগানো সহজসাধ্য কিন্তু পরশুরামের নৈপুণ্যে
এদের যথাস্থানে প্রয়োগটি একেবারে অনবদ্য-- সেখানে আর কোনো শব্দের
কথা চিন্তাই করা যা না।
পরশুরামের আরেক বৈশিষ্ট্য
ছিলো নামামৃত নিষ্কাশনে। গল্পের পাত্রপাত্রীদের এমন নাম দিতেন
যে তা চরিত্রোপযোগী নাম না নামের দায়ে বদ্ধ চরিত্র তা ধরা মুস্কিল
হোতো। বিদেশী, বিশেষত ইংরেজী নামকরণে পরশুরামের এই মুন্সিয়ানাটি
খুলেছে সবচেয়ে বেশী। তার কারণ বোধহয় ইংরেজী পদবীর বৈচিত্র্য
বেশী, তাতে মেঘের আড়ালে থেকে প্রয়োগ করা ব্যঙ্গের শর তীক্ষ্ণতর
হয়। আর বাংলা হরফে বাংলা উচ্চারণে সে নাম লিখলে মজাও জমে আরো
বেশী। তার কিছু উদাহরণ: 'গামানুষ জাতির কথা' গল্পে অনতিসমৃদ্ধ
রাষ্ট্রের প্রতিনিধি কাউণ্ট নটেনফ (not enough), বৃহত্তম সাম্রাজ্যের
প্রতিনিধি লর্ড গ্র্যাবার্থ (grab earth), মোটা গোঁফওলা জেনেরেল
কীপফ (keep off); 'উলট পুরাণ'এর গবসন টোডি (Toadie, বোধহয় হবসন-জবসনের
ভাই), স্যার ট্রিক্সি টার্ন্কোট(tricksy, turncoat) ইত্যাদি।
কেরাসিন (Crashing?) ব্যাণ্ড। লোকের ধর্মবিশ্বাস ভাঙিয়ে খাওয়ার
ব্যবসার হেড আপিস জুডাস লেনে। জবরদস্ত রাজকুমারী জবরুন্নিসাকেও
ভুললে চলবে না। তিনি দিলতোড়বাগে বসে কোফ্তা খাঁর দিল গিরিফতার
করেন।
বাংলা বা সংস্কৃত নামাবলী:
কেরাসিন ব্যাণ্ডের লাটুবাবুর জিভের জড়তার সুযোগ নিতে গিয়ে তাঁর
যন্ত্রীবর্গ সব ন-কারাদ্য। কচিসংসদের সভ্যবর্গ প্রাচীন পন্থা
বিবর্জন করে অতি মোলায়েম সব নাম নিলেন-- লালিমা পাল (পুং) তো
প্রবাদপ্রতিম। গণ্ডেরিরাম বাটপাড়িয়া - বাটপাড়িয়া নিয়ে কোনো সংশয়
নেই, তবে হিন্দি শব্দ গণ্ডেরির অর্থ আখের টুকরো (চলন্তিকা),
এ নিয়ে কৌতূহল রইলো। আদরে পদী আর অনাদরে ঘেঁচী ডাকার নাম যথাক্রমে
স্পন্দচ্ছন্দা আর ঘৃতাচী। নন্দকে বিয়ে করে যতীন্দ্রকুমার সেনের
ছবির ক্যাপশন সার্থক করার জন্য মেয়ে ডাক্তার মল্লিকের নাম নিতে
হোলো বিপুলা। শুকনো পুঁথিপত্তর ঘেঁটে থিসিস লিখতে যে চায় তার
নাম চিমেশ মিত্তির। ছুঁচলো মুখ, খাড়া খাড়া কান 'পলিটিক্যাল পরিব্রাজক'
হলেন রামগিধড় শর্মা; না হয়ে উপায় নেই, তিনি ব্যাঘ্রপার্টির সেক্রেটারি
যে। ঘরের শত্রু বলে বিভীষণ বদনাম করে ফেলেছেন, তাই কলিযুগে নাম
নিতে হোলো লঙ্কুস্বামী। ফিলিম কোম্পানীর নাম যদি নয়নসুখ, তার
মালিকের নাম লগনচাঁদ ছাড়া আর কিছু হতেই পারেনা। বেঘোরে মৃত্যু
হলে বাঁচাবেন বিঘোরানন্দ, বিঘোর বাবা। রটন্তীকুমার নামটির মধ্যে
রটন্তীকালী পূজোর জন্মতিথি তো রইলোই, তার সঙ্গে চরিত্রানুযায়ী
রটাই ডাকনামটি পাওয়া গেলো ফাউ। কালো মেয়ে কালিন্দীর শাশুড়ীর
নাম ফুগ্গা, হিহি, এদিকে আবার তার পুণ্যির পথের কাঁটা হয়ে তার
শ্বশুরগুষ্টি নাম নিয়ে বসে আছে ফেষ্টদাসী, ফালিদাস, ফ্রীধর,
ফরস্বতী। সর্বজ্ঞ পদবীর মর্যাদা রাখতে পিনাকীবাবুকে সবজান্তা
বনতে হোলো, ঘোর তার্কিক প্রেমসিন্ধুর পদবী খাণ্ডারী, বুদ্ধি
খাটিয়ে জীবিকা অর্জন করার দায়ে সরলচন্দ্র সোম হলেন সরলাক্ষ হোম।
বটুক সেন তার অনেকদিনের বন্ধু, সে আবার ডাক্তার। মাংসের কাটলেট
ভেজে আনলেন কামরূপের মেয়ে মায়াবতী মর্দরাজ ও তাঁর কন্যা মোহিনী
("কামরূপিণী")। দেবকী বোসের ছবিতে দশ লাখ টাকা পর্যন্ত
খরচ করতে পারেন নেবুচাঁদ নাজার, তার পেছনে কোনো দেওয়ালের লিখন
কাজ করছে কিনা তা জানা যায়নি। তালিকায় কিছু নিশ্চয় বাদ পড়লো।
ও হ্যাঁ, দধিমুখ, মসীপুচ্ছ
ইত্যাদি পোষাকী নাম হেলায় বিসর্জন দিয়ে ছাগল নাম নিলো লম্বকর্ণ।
তার অন্য কোনো নাম কি ভাবা যেতে পারে!
সুমিত
রায়
(পরের
অংশ)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।