প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

প্রসঙ্গ: পরশুরাম (১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯)

(আগের অংশ) পরশুরামের প্রকাশিত বইয়ের সালতারিখ মিলিয়ে দেখলে কয়েকটা ব্যাপার নজরে আসতে বাধ্য। তাঁর প্রথম বই গড্ডলিকা প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে, সাড়াজাগানো বই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এর প্রশংসা লিখেছিলেন প্রবাসী পত্রিকায়। 'শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড', 'চিকিত্‍‌সা সঙ্কট', 'লম্বকর্ণ', 'ভুশণ্ডীর মাঠে'-- এই চারটি গল্প প্রতিটি নিটোল মুক্তো; আর গুণে একটু খাটো একটি নাটক, 'মহাবিদ্যা'। সবকটি গল্পের বর্ণনা সাধুভাষায়, সংলাপ চলিত ভাষায়। এই মিশ্রণটা ভালোই লাগে, এমনকি আজকের দিনেও ভালো লাগে। প্রথমটি তীব্র শ্লেষ, দ্বিতীয়টিও তাই, যদিও ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণতাটা কম। অন্য দুটোয় ঝলমলে কৌতুক, ব্যঙ্গের খোঁচা যদি থাকেও তার জ্বালাটা নেই বললেই চলে। "ভুশণ্ডীর মাঠে" গল্পের গঠনকৌশল চমকপ্রদ। গল্পগুলোর চাকায় কৌতুকের তেল পড়েছে, তারা যেন গড়িয়ে চলে যায়, মাঝে মধ্যে শ্লেষ থাকা সত্ত্বেও পাঠককে টক্কর খেতে হয়না কোথাও। বিশের দশকে সেটা ইংরেজ শাসনের যুগ, ভেতরে ভেতরে যতোই অসন্তোষ থাকুক না কেন, বাঙালী তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে "খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা" খেয়ে , এ্যালোপ্যাথি থেকে হাকিমী সব চিকিত্‍‌সা মেনে নিয়ে, "জন্তুর বাগান, জাদুঘর, হগ সাহেবের বাজার" ঘুরে। আর তাঁর চরিত্রচিত্রণ! সে সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরী ভারী খাঁটি কথা বলেছেন:

"এতে যাদের সাক্ষাত্‍‌ পাই, তারা সব আমাদের চেনা লোক। পরশুরামের ছবি আঁকার হাত অতি পরিষ্কার। তিনি দুচারটি টানে এক একটি লোককে চোখের সমুখে খাড়া করে দেন। তাঁর ছবিতে রেখা ও বর্ণের বাহুল্য নেই। তাঁর হাতের প্রতি রেখাটি পরিস্ফুট, প্রতি বর্ণটি যথোচিত। এই সেহাই-কলমের কাজ কিসে উজ্জ্বল হয়েছে জানেন? -- হাসির আলোকে।"

এই সোনার অঞ্জলিতে আর একটি উপাদান সোহাগার মতো, সেটি হোলো যতীন্দ্রকুমার সেনের ছবি। রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া গেলো:

"লেখার দিক্‌ হইতে বইখানি আমার কাছে বিস্ময়কর, ইহাতে আরো বিস্ময়ের বিষয় আছে, সে যতীন্দ্রকুমার সেনের চিত্র। লেখনীর সঙ্গে তুলিকার কী চমত্‍‌কার জোড় মিলিয়াছে, লেখার ধারা রেখার ধারা সমান তালে চলে, কেহ কাহারো চেয়ে খাটো নয়।"

এর তিনবছর পরে প্রকাশ "কজ্জলী"র, সবদিক থেকেই "গড্ডলিকা"র যথার্থ উত্তরাধিকারী, বেশী বই কম নয়। ধর্মবিশ্বাস ভাঙিয়ে ফাটকা খেলার বদলে আছে ধর্মবিশ্বাসের সুযোগে গুরুগিরির জোচ্চুরি ("বিরিঞ্চি বাবা")। "ক্যাদার চাটুজ্যে" দুবার দেখা দিলেন ("দক্ষিণ রায়" ও "স্বয়ম্বরা") তাঁর দলবলকে সঙ্গে নিয়ে। সেই প্রাক্‌স্বাধীনতা মন্থর পরিবেশটাও আছে ("ডিনার সার অ্যাট শিকোহাবাদ" -- কচি সংসদ্‌"), আছে সাধু-লঘু ভাষার সেইরকমই সংমিশ্রণ। এই প্রথম এক অসাধারণ পৌরাণিকীর দেখা পাওয়া গেলো ("জাবালি"), তার সংলাপও সাধুভাষায়, সেখানে আমাদের চেনা প্রবাদের সাধুরূপের দমফাটা হাসি। এ বইয়ের নাটকটায় ("উলট পুরাণ") অবিমিশ্র হাসি, রাজার জাত ইংরেজ আর নেটিভ ভারতীয়-- উভয়কে নিয়েই তীব্র শ্লেষ। এবং অবশ্যই যতীন্দ্রকুমার সেন।

পরের সঙ্কলনটি ("হনুমানের স্বপ্ন ইত্যাদি গল্প") ছাপা হয়ে বার হোলো ১৯৩৭ সালে, যদিও তার ওজনদার লেখাগুলো সব ১৯২৯-৩০ সালে রচিত। শুরুতেই পৌরাণিকী ("হনুমানের স্বপ্ন"), "জাবালি" গল্প ছিলো দেবদ্বিজের ভণ্ডামির ওপর নির্মম কশাঘাত, এটাতে নারীজাতির চাপল্য আর অব্যবস্থিতচিত্ততা নিয়ে বিদ্রূপ; তেজ কম, কৌতুক বেশী। চাটুজ্যে আছেন তিনবার ("গুরুবিদায়"-- সলম্বকর্ণ, "মহেশের মহাযাত্রা"-- "ভুশণ্ডীর মাঠে"র অনুসারী, কিন্তু ভূতেরা আরো কায়াময় এবং চাটুজ্যে নায়ক নন, তিনি কেবল গল্পকার, আর "রাতারাতি", ব্যঙ্গ আর কৌতুক মেশানো এক প্রেমের গল্প)। তিনটি ছোটো ছোটো এক-দেড়পাতার চমক-সমাপ্তি, সারপ্রাইজ এন্‌ডিঙের গল্প আছে, ও হেনরীর এ ধরণের যে কোনো গল্পের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। ভাষারীতি আগের দুটো বইয়ের মতো। এ পর্যন্ত সবই আগের মতো, যতীন্দ্রকুমারও আছেন পূর্ণগৌরবে। এই গল্পগুলির পরে ১৯৩২ সালে লেখা একটা গল্প যোগ হয়েছে ("প্রেমচক্র"), নিছক মজার গল্প, আধুনিক-পৌরাণিক মেশানো, যথারীতি পরশুরামের যাদুর ছোঁয়াচ আছে। তফাত্‍‌ হোলো এই প্রথম পরশুরাম পুরোপুরি চলিত ভাষা ব্যবহার করলেন এবং যতীন্দ্রকুমারের ছবি আর নেই, তার বদলে আছে পরশুরামের নিজের আঁকা কিছু কার্টুন গোছের ছবি। যতীন্দ্রকুমারের ছবির কোনো বিকল্প নেই দেখে এর পর থেকে পরশুরাম ছবি দেওয়াই ছেড়ে দিলেন, কিন্তু ছাড়লেন না চলিত ভাষা। তিনি আর সাধুভাষায় গল্প লিখলেন না। বইটা ছাপা হোলো আরো পাঁচবছর পরে। কেন? ১৯৩২ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর নেবার পর রাজশেখর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান সংস্কার সমিতির কাজে জড়িয়ে পড়লেন, চলন্তিকা অভিধান প্রকাশ করলেন ১৯৩৭ সালে। আমাদের মনে হয় যে এসময়ে তাঁর অন্য কোনো দিকে নজর দেবার সময় বা ইচ্ছে, কোনোটাই ছিলো না। তাছাড়া সমিতির কাজকর্ম আর অভিধান প্রণয়ন তাঁকে চলিত ভাষার খুব কাছে এনে দিলো, চলিত ভাষাই ততদিনে চালু হয়ে গেছে তাই সেখানেই পরশুরাম থানা গাড়লেন। প্রমথনাথ বিশীর মতো আমরাও পরশুরামের প্রথম তিনটি বইয়ের সেই সাধু-চলিত মেশানো ভাষাকে ভুলতে পারিনা, প্রমথনাথের মতে তো এই কথ্যভাষা ব্যবহারের কারণে তাঁর পরের গল্পগুলো ম্লানতর। আমরা তা মানতে পারলাম না, পরশুরামের ভাষারীতির তুলনা নেই, তা সে সাধু, কথ্য বা মিশ্রিত, যাই হোক না কেন। তবে মিশ্রিতটায় যে ডুডু আর তামাক, দুয়েরই রস পাওয়া যায় সেটা ঠিক। আর পরশুরামের প্রয়োগকৌশলে গরহজম হবার ভয় নেই এটাও ঠিক। প্রসঙ্গত, এই বইটির পরের সংস্করণে ১৯৪২-৪৩ সালে লেখা আরো দুটি পৌরাণিক গল্প যোগ করা হয় ("দশকরণের বানপ্রস্থ" আর "তৃতীয়দ্যূতসভা")।

এই বই প্রকাশের পর তেরো বছর পরশুরামের অজ্ঞাতবাস। রাজশেখরের নয় কিন্তু, তিনি পূর্ণমহিমায় তাঁর অনুবাদ ও প্রবন্ধের সাহিত্যকৃতি প্রকাশ করে চলেছেন। সে সবের পাট চুকিয়ে পরশুরামকে আবার মঞ্চে ফেরত আনলেন ১৯৫০ সালে, "গল্পকল্প" বইতে। তারপর ১৯৫৯ সাল অবধি আরো পাঁচটা বই-- ধুস্তুরীমায়া, কৃষ্ণকলি, নীল তারা, আনন্দীবাই, চমত্‍‌কুমারী, প্রতিটির নামের শেষে "ইত্যাদি গল্প"। মজার কথা এই যে এবার রাজশেখরের অজ্ঞাতবাসের পালা। "বিচিন্তিতা" আর "চলচ্চিন্তা"-- দুটি প্রবন্ধ সঙ্কলন ছাড়া রাজশেখরের আর কোনো বই বেরোয়নি এই সময়। রাজশেখরের নিজের কথার জের টেনে বলা যায় যে তিনি গম্ভীর (রাজশেখর) তো গম্ভীর, আর ঠাট্টাবাজ (পরশুরাম) তো ঠাট্টাবাজ-- চরিত্রের এই দুই দিক মিলতে দিতেন না বা পারতেন না। শোনা যায় ব্যক্তিগত জীবনে রাজশেখর খুব রাশভারী প্রকৃতির লোক ছিলেন, হাসতেন কদাচিত্‍‌। তাঁর "গোপনবাসীর" লেখা পড়েও তিনি যদি না হেসে থাকতে পারেন তাহলে তো তাঁকে পুরস্কার দেওয়া উচিত।

প্রায় দুদশকের ব্যবধানে সেই গড্ডলিকা-কজ্জলীর জগতে আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের আগুনে সারা পৃথিবী পুড়েছে, মানুষের ওপর মানুষের অমানুষিক অত্যাচার মানুষের অনেক পুরনো বিশ্বাসের ইমারত ধ্বসিয়ে দিয়েছে, মানবসভ্যতার অনেক আদি প্রশ্নকে আবার নতুন করে জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন হয়েছে। ইংরেজ বিদায় নিয়েছে, আমরা ছিলাম খাঁচার পাখী, ইংরেজ "রাজ"-এর আফিমের মৌতাত ভেঙে আমাদের খোলা আকাশে ওড়বার আহ্বান এসেছে, তার সঙ্গে তত্‍‌সংশ্লিষ্ট সংশয়, সন্দেহ আর ভয়ের পশরা নিয়ে। দেশভাগ হয়েছে, তার ক্ষত থেকে রক্তপাত বন্ধ হয়নি। রাজশেখরের বয়স আর জ্ঞান বেড়েছে, বেড়েছে তিতিক্ষা।

"গল্পকল্প" বইয়ের নামেই পরিচয়, কল্পজগতের ঘটনা নিয়ে প্রায় সবকটি গল্প, কিন্তু আর একটা বৈশিষ্ট্য নজরে না এসেই পারেনা। সেটি হোলো এই বইয়ের বেশীর ভাগ গল্পই গল্পের খোলস পরে তত্ত্ব আর তথ্যকথার সমাহার। এর আগে "জাবালি"-তে সামান্য তত্ত্বকথা ছিল, "দশকরণের বানপ্রস্থে" পরশুরাম জীবনদর্শনের সামান্য মোকাবেলা করেছিলেন। এইরকম গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি প্রাচীন বা অধুনা, মানবদর্শন বা দেশের অবস্থা নিয়ে তর্কের অবতারণা করতেন, নানা মুনির নানা মতামত শোনাতেন এবং নিজের চিন্তার হদিশ রেখে যেতেন-- বেশীর ভাগ সময়েই রঙ্গব্যঙ্গের আড়ালে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, পরশুরাম ছদ্মনামে যখন তাঁর প্রথমদিকের লেখাগুলো ছাপা হতে আরম্ভ করলো, তখন তাঁর ব্যঙ্গের শাণিত কুঠারকে অবতার পরশুরামের কুঠারের সঙ্গে তুলনা করা হোতো, সেই পরশুরাম কুঠারাঘাতে একুশবার পাপী ক্ষত্রিয়দের বধ করে পৃথিবীর বোঝা হালকা করেছিলেন। এই তুলনাটা প্রথম মনে এলেও, একটু তলিয়ে দেখলে অন্য একটা উপমা মনে আসে, যেটা রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন কুঠার অস্ত্রটা "রূপধ্বংসকারীর, রূপসৃষ্টিকারীর নহে। পরশুরাম নামটা শুনিয়া পাঠকের সন্দেহ হইতে পারে যে লেখক বুঝি জখম করিবার কাজে প্রবৃত্ত। কথাটা একেবারেই সত্য নহে।" তারপর বলেছেন যে পরশুরামের লেখায় ভাঙাচোরার আওয়াজ যদি কিছু আমরা শুনতে পাই তা সে ভাস্করের পাথর খোদার আওয়াজ। আমরা যখন প্রথম পরশুরামের লেখা পড়তে আরম্ভ করি তখন ওই কুঠারের উপমাটাই মনে আসে। তারপর জানা যায় যে ওসব পুরাণ-টুরান কিছু নয়, পরশুরাম ছিলেন রাজশেখরের বাড়ীর স্যাকরা, ছদ্মনামটি সেখান থেকেই নেওয়া। প্রথমে একটু আশাভঙ্গ হলেও পরে মনে হয় পরশুরামের অনেক লেখার আওয়াজকে স্যাকরার ঠুকঠাক বলেও দেখা যেতে পারে। পরশুরাম তাঁর চিন্তাভাবনার খাঁটি সোনাকে তাঁর সূক্ষ্ম ব্যঙ্গের হাতুড়িটি দিয়ে কুশলী শিল্পীর মতো খোদাই করে আমাদের যা উপহার দিয়েছেন তা সাত রাজার ধন অলঙ্কার।

বাকী ছেষট্টিটি কাহিনী (অর্থাত্‍‌ পরশুরামের সোনার তরীর দুই তৃতীয়াংশ ফসল) আছে বাকী পাঁচটি বইতে, ১৯৫২ সাল থেকে মোটামুটি প্রতি দুবছরে একটা করে প্রকাশিত। যতীন্দ্রকুমার নেই, এ যে কতো বড়ো শূন্যতা তা যাঁরা স- ও বি-যতীন্দ্র বই না দেখেছেন তাঁরা ঠিক বুঝবেন না। পরশুরাম যে যে বিষয় নিয়ে গল্প লিখে থাকতেন, সেই সেই সব বিষয়ই আছে-- পৌরাণিক, আধুনিক, তত্ত্বমূলক, প্রেম. কল্পজগত্‍‌, ব্যঙ্গ, শুধুই গল্প। ব্যঙ্গের ঝাঁজ কমে এসেছে, মানুষের দৌর্বল্য সম্পর্কে পরশুরাম আরো সহনশীল হয়েছেন, বেশী মন দিয়েছেন গল্প শোনাতে, তার মধ্যে রঙ্গব্যঙ্গের ফোড়ন, একেবারে পাকা রাঁধুনীর মতো। পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে, কেউ কেউ বলেন শেষ দিকের এই গল্পগুলির শ্লেষ তীব্রতর। তবে এটা মানতে হয় যে পরশুরামের বাউণ্ডারী মারার পরিসংখ্যানটা কমে এসেছে। প্রথম তিনটি বইয়ের একুশটি গল্পের মধ্যে অন্তত পনেরোটি আসল মুক্তোর দেখা পাওয়া যায়, সেই অনুপাতমতো চললে পরের কাহিনীগুলির মধ্যে থেকে আটচল্লিশটি পাবার কথা, এবং তা নেই। তার কারণ আছে অনেক, এক তো আমাদের মতো ছাপোষা মানুষদের কাছে তত্ত্বকাহিনীর (পরের রচনাগুলির বেশ বড়ো অংশ) অ্যাপিল কম, এদিকে প্রথম তিনটিতে পরশুরাম আমাদের ঝাল খাওয়ার যে অভ্যাস করে দিয়েছিলেন তার কল্যাণে গভীরতর অনুভূতির রচনা, সূক্ষ্মতর স্বাদের রান্না বিস্বাদ লাগতে পারে। তবে পরশুরামের নাম করলে প্রথমেই "গড্ডলিকা-কজ্জলী"র কথা মনে আসতে বাধ্য-- এ তথ্যটা এড়াবার উপায় নেই। প্রসঙ্গত, রাজশেখর বসু তাঁর দীর্ঘ জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন, তার বেশীর ভাগই-- যথা জগত্তারিণী পদক, পদ্মভূষণ এবং কোলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি লিট উপাধি-- রাজশেখরের অনুবাদসাহিত্য, প্রবন্ধ ও ভাষা নিয়ে তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ কৃতির জন্য বলে আমাদের অনুমান। জীবনের শেষদিকে "কৃষ্ণকলি" ও "আনন্দীবাঈ" বইয়ের জন্য যথাক্রমে রবীন্দ্র ও এ্যাকাডেমী পুরস্কার -- সে দুটি কিন্তু সর্বাংশে পরশুরামের প্রাপ্য, অন্য কাউকে তার ভাগ দেওয়া চলবে না। ব্যঙ্গ রচনাকে সাহিত্যজগতে সাধারণত সামনের সারিতে আসতে দেওয়া হয় না, অবশ্যই ন্যায্য কারণে, সে দিক থেকে দেখলে পরশুরামের এই পুরস্কার দ্বারা স্বীকৃত কৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতেই হয়।

রাজশেখর ছিলেন রসায়নবিজ্ঞানী, কর্মজীবন কেটেছে তারই সুষ্ঠু প্রয়োগের কাজে। সে পর্ব শেষ হবার পর হলেন ভাষাতত্ত্ববিদ্‌, কিছু মাত্রায় ভাষাবিজ্ঞানী বললেও চলে। অর্থাত্‍‌ তাঁর মন বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সত্যসন্ধানী। সেই মনন থেকে তাঁর মানসপুত্র পরশুরামকে দিয়েছিলেন যুক্তি-তর্ক-বাস্তব-সত্যের জগত্‍‌, নিছকই ভাবাবেশের জগত্‍‌ নয়, পরশুরামের লেখা পড়তে গেলে এ কথাটা মনে রাখা প্রয়োজন। পরশুরামের সব কাহিনীরই এই ভিত্তি. কোথাও কম, কোথাও বেশী। প্রথম পর্বে মানব্চরিত্রের দৌর্বল্য নিয়ে যুক্তিপ্রধান শ্লেষের প্রকাশ বেশী, প্রশ্রয় কম, পরের পর্বে মানবচরিত্রের সস্নেহ ব্যাখ্যানই বেশী, বিদ্রূপ কম। দুইই সমান উপভোগ্য। আশ্চর্যের কথা এই যে তাঁর ব্যঙ্গ বিদ্রূপ কিন্তু কখনো আমাদের মনে এমন জ্বালা ধরায় না যাতে আমরা তাঁর কুশীলবদের ঘৃণা করতে আরম্ভ করি। তার একটা কারণ হতে পারে যে প্রায় সব চরিত্রই আমাদের অল্পবিস্তর চেনা, কাজেই সব ঘটনাই মোটামুটি চরিত্রানুগ, তাতে আঁত্‍‌কে ওঠার মতো কিছু হয় না। আরেকটা কারণ এই যে তাঁর তত্ত্বমূলক কাহিনীগুলোতে তিনি প্রায় সবসময় তর্কের মোটামুটি দুদিকই দেখিয়েছেন, অর্থাত্‍‌ বিদ্রূপ যদিও বা থাকে, অসূয়া কিন্তু নেই। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হোলো তাঁর লেখার প্রসাদগুণে তাঁর লেখা খুব স্বচ্ছন্দে, খুব নিশ্চিন্তে পড়া যায়-- বেশীর ভাগ সময়েই একটু মুচকি হাসি নিয়ে, মাঝে মাঝে দুয়েকটা দমফাটা হাসির উপাদান, কিছু গল্প পড়া শেষ হলে বই বন্ধ করে কিছু সময় মনে মনে একটু বিশ্লেষণ। মনে হয় সময়টা ভালোই কাটলো। বাংলা সাহিত্যে তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী যদি থাকতো তো ভালো হোতো তাহলে। তা নেই, তাই আমরা পরশুরামের লেখাই আবার পড়ি।

তাঁর লেখা অক্লেশে আবার, বারবার পড়া যায়।

পরশুরামের গল্পের বই:

গড্ডলিকা (১৯২৪): চিকিত্‍‌সা সঙ্কট, ভুশণ্ডীর মাঠে, মহাবিদ্যা, লম্বকর্ণ, শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড।
কজ্জলী (১৯২৭): উলট পুরাণ, কচি সংসদ, জাবালি, দক্ষিণ রায়, বিরিঞ্চিবাবা, স্বয়ম্বরা।
হনুমানের স্বপ্ন ইত্যাদি গল্প (১৯৩৭): উপেক্ষিত, উপেক্ষিতা, গুরুবিদায়, তৃতীয় দ্যূতসভা, দশকরণের বানপ্রস্থ, প্রেম্চক্র, পুনর্মিলন, মহেশের মহাযাত্রা, রাতারাতি, হনুমানের স্বপ্ন।
গল্পকল্প (১৯৫০): অটলবাবুর অন্তিম চিন্তা, গামানুষ জাতির কথা, চিরঞ্জীব, তিন বিধাতা, পরশপাথর, ভীমগীতা, রাজভোগ, রামরাজ্য, শোনা কথা, সিদ্ধিনাথের প্রলাপ।
ধুস্তুরীমায়া ইত্যাদি গল্প (১৯৫২): অক্রূর সংবাদ, অগস্ত্যদ্বার, গন্ধমাদন বৈঠক, ধুস্তুরীমায়া, নবজাতক, ভরতের ঝুমঝুমি, যদু ডাক্তারের পেশেণ্ট, রটন্তীকুমার, রামধনের বৈরাগ্য, রেবতীর পতিলাভ, লক্ষ্মীর বাহন, ষষ্ঠীর কৃপা।
কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প (১৯৫৩): আতার পায়েস, একগুঁয়ে বার্থা, কৃষ্ণকলি, জটাধর বকশী, পঞ্চপ্রিয়া পাঞ্চালী, নিরামিষাশী বাঘ, নিকষিত হেম, বরনারীবরণ, বালখিল্যগণের উত্‍‌পত্তি, ভবতোষ ঠাকুর, সরলাক্ষ হোম।
নীল তারা ইত্যাদি গল্প(১৯৫৬): জটাধরের বিপদ, জয়হরির জেব্রা, তিরি চৌধুরী, তিলোত্তমা, দ্বান্দিক কবিতা, ধনুমামার হাসি, নীলতারা, নীলকণ্ঠ, নিধিরামের নির্বন্ধ, মাঙ্গলিক, শিবলাল, শিবামুখী চিমটে, স্মৃতিকথা।
আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্প (১৯৫৭): অদল বদল, আনন্দীবাঈ, কামরূপিণী, কাশীনাথের জন্মান্তর, গগন চটি, চাঙ্গায়নী সুধা, চিঠিবাজি, ডম্বরু পণ্ডিত, দুই সিংহ, নির্মোক নৃত্য, নবজাতক, বটেশ্বরের অবদান, বদন চৌধুরীর শোকসভা, যযাতির জরা, রাজমহিষী, সত্যসন্ধ বিনায়ক।
চমত্‍‌কুমারী ইত্যাদি গল্প(১৯৫৯): উত্‍‌কণ্ঠা স্তম্ভ, উত্‍‌কোচ তত্ত্ব, কর্দম মেখলা, গণত্‍‌কার, গুপি সাহেব, গুলবুলিস্তান, চমত্‍‌কুমারী, জয়রাম জয়ন্তী, দাঁড়কাগ, দীনেশের ভাগ্য, প্রাচীন কথা, ভূষণ পাল, মাত্‍‌স্য ন্যায়, যশোমতী, সাড়ে সাত লাখ।

সুমিত রায়, নিউ জার্সি, মে ২০১৩

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।