প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

প্রসঙ্গ: পরশুরাম (১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯)

(আগের অংশ) অধুনা, পৌরাণিক আর কল্পকাল -- পরশুরামের গল্পের কাল বিবেচনা করলে এই তিনটি শুদ্ধ বা মিশ্ররূপে পাওয়া যাবে। রাজশেখর বসু সংস্কৃতজ্ঞ, পুরাণ ও প্রাচীন সাহিত্যে তিনি পোক্ত হবেন, এটা আশা করা যায়। পরশুরাম সেই জ্ঞানের পুরো সুবিধে নিতে ছাড়েননি, কেননা আমাদের আজকের জীবনে পৌরাণিক ঘটনার বিন্যাস করলে ব্যঙ্গ আর রসিকতার একটা সহজ উত্‍‌স খুলে যায়, এটা তাঁর জানা ছিলো। এবং পৌরাণিকীর-- তা সে সেকালেই হোক বা দুইকালেই হোক-- এই সরস ব্যবহার বাংলা সাহিত্যে আর কেউ করেননি এক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া। তবে শরদিন্দু উপন্যাসও লিখেছেন, তাছাড়া তাঁর লেখা কৌতুকাবহ হলেও ব্যঙ্গাত্মক ছিলো না। গনতি করে পরশুরামের পৌরাণিকী পর্যায়ে চব্বিশটি মতো গল্প পাওয়া যাচ্ছে, যদি "কাশীনাথের জন্মান্তর" আর "তিলোত্তমা"-কে এই পর্যায়ে ফেলা যায় এবং আরব্যোপন্যাসের কালকে পৌরাণিক বলতে দেওয়া হয় (পুরাণ না হতে পারে, পুরান বটে)। তার মধ্যে সাতটি -- কর্দম মেখলা, অগস্ত্যদ্বার, ডম্বরু পণ্ডিত, পঞ্চপ্রিয়া পাঞ্চালী, বালখিল্যগণের উত্‍‌পত্তি, যযাতির জরা ও রেবতীর পতিলাভ-- একেবারে খাঁটি পৌরাণিক কাহিনী, কৌতুকস্নিগ্ধ পরিবেশন, পড়েই ভুলে যাওয়া যায়। বাকীগুলির ন'টিতে তিনি সেকাল আর একাল মিশিয়েছেন, পুরাণের চরিত্র আর আধুনিক সমস্যার সমাহার। এদের বেশীর ভাগই পূর্বোক্ত তত্ত্বপ্রধান পর্যায়ে পড়ছে-- যথা গন্ধমাদন বৈঠক, তিন বিধাতা, রামরাজ্য। "তিলোত্তমা" আর "ভরতের ঝুমঝুমি"ও একটু খতিয়ে দেখলে সেই দলে-- প্রথমটিতে তাঁর গুরু পুরাণকাহিনী বলে সিদ্ধিনাথের আধুনিক মোহটি ভঙ্গ করেছেন, পরেরটিতে দুর্বাসা তাঁর অদম্য ক্রোধের উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে যখন শেষ পর্যন্ত শকুন্তলার খোকা ভরতরাজার উপহার ঝুমঝুমিটি খুঁজে পেলেন তখন ভারত ভাগ হয়ে গেছে, ঝুমঝুমি ভেঙে দুভাগ করা ছাড়া উপায় নেই। ৫,৫৫৫ বছর বয়সী "চিরঞ্জীব" বিভীষণ লঙ্কুস্বামী নাম নিয়ে তাঁর কীর্তির, বিশেষত বহু বিবাহের, থুড়ি বহুবার একবিবাহের কথা বলে আজকের দিনের ট্রেনে সহযাত্রীদের কাছে কল্‌কে পেলেন না। "প্রেমচক্র" কাহিনীতে পৌরাণিক গল্প নিয়ে এ যুগে নাটক করে দেখাবার কৌশল বলা আছে, পৌরাণিক কাহিনীটিও মন্দ নয়। "স্মৃতিকথা"র পৌরাণিক গল্পটি বলার আগে সব তথ্য আধুনিক বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করে নেওয়া হয়েছে, যাতে লেখককে তথ্যগত ভুলের দায়ে না পড়তে হয়।

বাকি আটটির চরিত্র সব পৌরাণিক (একটি আরব্যোপন্যাস-পৌরাণিক), কিন্তু ঘটনাগুলি সম্পূর্ণ পরশুরামের সৃষ্টি এবং প্রায় সবগুলিই অনবদ্য। সেগুলির স্বপক্ষে পরশুরাম যে সব সাফাই দিয়েছেন তাও অনবদ্য। "[রামায়ণে] যাহা নাই তাহা নিম্নে বর্ণিত হইল" (জাবালি), "কালিদাস আর ব্যাসদেব [মেঘদূতের যক্ষ সম্পর্কে] যা অনুক্ত রেখে গেছেন... এখন উদ্ঘাটন করছি" (অদল বদল), "ব্যাসদেব মহাভারত থেকে তৃতীয়দ্যূতপর্বাধ্যায়টি কেন বাদ দিয়েছেন তা বলা শক্ত" (তৃতীয়দ্যূতসভা), "...কিঞ্চিত্‍‌ অদলবদল করিয়া বলিতেছি" (পুনর্মিলন)। বাকী তিনটিও যে কপোলজিহ্ব, টাং ইন চিক, রচনা তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। "জাবালি" গল্পের প্রথম ভাগটি বাল্মীকির রচনা, পরশুরামের পরিবেশন, দ্বিতীয় ভাগ পরশুরামের নিজস্ব। এই গল্পে গাধার টুপি পরলেন দেবতা আর ঋষিরা, বোঝা গেল প্রথম তিন রিপু নিয়েই তাঁদের কারবার এবং আসনচ্যুত হবার ভয়ে তাঁরা নিতান্ত অদৈবিক কাজকর্মেও রাজী- যথা জাবালির ধ্যানভঙ্গের জন্য মধ্যবয়সী অপ্সরা পাঠানো, ঋষিদের ক্যাঙারু কোর্টে জাবালিকে দোষী সাব্যস্ত করা ইত্যাদি। আফিঙের ঘোরে জাবালি যমপুরীতে গিয়ে দেখলেন যে পাত্রের "তপ্ত তৈলে ইন্দ্রাদি দেবগণ মধ্যে মধ্যে অবগাহন করিয়া থাকেন, নিরন্তর অগ্নিপ্রয়োগে ইহার তলদেশ ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়াছে।" চাবুক! "অদল-বদল"তে মহাভারত ও প্রচলিত পুরাণের তিনটি চরিত্রকে পরশুরাম চমত্‍‌কার কৌশলে জড়িয়ে দিয়েছেন-- একটি ইন্দ্রসভা থেকে বিতাড়িত যক্ষ (ইনি কালিদাসের মেঘদূতের যক্ষ এমন ইঙ্গিত আছে), একটি হলেন নপুংসক শিখণ্ডী এবং তৃতীয়টি শ্রীরাধার স্বামী আয়ান ঘোষ। পাঠক-পাঠিকা ভেবে দেখুন যে আমরা রাধার শাশুড়ী এবং ননদের দেখা বহুবার পেলেও কর্তা আয়ান ঘোষের দেখা পাই না কেন? রাধাকৃষ্ণকে নিয়ে ব্যঙ্গ সবায়ের ভালো নাও লাগতে পারে অবশ্য, তাঁদের কাহিনীর প্রথম পর্ব নিয়ে খুসি থাকতে হবে। আমরা মানুষেরা যে সৌন্দর্য নিয়ে এতো লাফালাফি করি তার গভীরতা ত্বকের নীচে পৌঁছোয় না, বিউটি ইজ ওনলি স্কিন ডীপ-- এই তত্ত্বটাই অপূর্ব সুন্দর রূপক করে বলা হয়েছে "নির্মোক নৃত্য" গল্পে। সেখানে উর্বশী হলেন সৌন্দর্যের প্রতীক আর ইন্দ্রিয়জয়ী কুতুক ঋষি হলেন সত্যের। এর মধ্যেও পরশুরাম ব্যঙ্গের প্রয়োগ ভোলেননি-- "উর্বশীর লাঞ্ছনা দেখে... অপ্সরার দল আনন্দে করতালি দিলেন"। "তৃতীয় দ্যূতসভা"তে আমরা মহাভারতের চেনা চরিত্রদেরই দেখলাম, তবে পরশুরামের লেখনীতে সবাইকে অল্পাধিক কাছে থেকে, অর্থাত্‍‌ স্পষ্টতর দেখা গেল। "বলরাম কিঞ্চিত্‍‌ মত্ত অবস্থায় ছিলেন", "ধর্মরাজের শাস্ত্রজ্ঞান অগাধ, কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানের কিঞ্চিত্‍‌ অভাব দেখা যাচ্ছে"। হনুমান অমরত্ব পেলেন কোথা থেকে, "হনুমানের স্বপ্ন" গল্পে তারই হদিশ দেওয়া হয়েছে. সে গল্পের সঙ্গে রাজা চঞ্চরীক আর ঋষি লোমশও জড়িয়ে পড়ে কাহিনীর ভার আর ধার দুইই বেড়েছে। বক্তব্য স্ত্রীজাতির চাপল্য ও অশাস্ত্রীয় ব্যবহার এবং দাম্পত্যতত্ত্ব। লোমশ ঋষির একশো স্ত্রী, তারা "নিরন্তর কলহ করে... পরস্পরকে চর্মচটিকা পেচকী ছুছুন্দরী প্রভৃতি ইতর নামে সম্বোধন করে এবং আমাকে ভল্লুক বলে"। এ হোলো সবে কলির সন্ধ্যে। এখানকার বরবানরী "লীলাকদলী" হাতে কুঞ্জে বিহার করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই দুর্বিনীতা বানরীকে বশে আনতে মহাবীরও অপারগ, পূর্বপুরুষদের পিণ্ডদানের জন্য তাঁকে অমর হতে হোলো। গল্পটির ছত্রে ছত্রে কৌতুক, মাঝে মাঝে মর্মভেদী ব্যঙ্গ।

"গুলবুলিস্তান" গল্পের (গল্পের নামটা লক্ষ্যণীয়; প্রসঙ্গত পারস্যের কবি সাদীর বিখ্যাত সঙ্কলনের নাম "গুলিস্তান") অন্য নাম "আরব্যরজনীর উপসংহার", সেটি নাকি উজবেকীস্থানে সম্প্রতি আবিষ্কৃত একটি প্রাচীন পুঁথির থেকে পাওয়া। "বিচক্ষণ পণ্ডিতেরা বলেন, এই নবাবিষ্কৃত পুঁথির কাহিনীই অধিকতর প্রামাণিক ও বিশ্বাসযোগ্য, নীতিসংগতও বটে।" এই "নীতিসংগত" কথাটা দরকারী। আরব্যোপন্যাসে দুই সম্রাট ভ্রাতা, শাহ্‌রিয়ার আর শাহ্‌জমান, নারীবিদ্বেষীর চরম, মিসোজিনিস্ট, রোজ একটি করে বিবাহ করতেন আর সকালে সেই হতভাগিনীর মুণ্ডচ্ছেদ করতেন। অভাগা মেয়েদের এই নির্যাতন পরশুরামের পছন্দ নয় তাই এই উজবেকী পুঁথির মাধ্যমে তিনি তাদের গুলবুলিস্তানে পাঠালেন, সেখানকার দুই শাহজাদী উত্‍‌ফুল আর লুত্‍‌ফুলকে উপভোগ করার জন্য। সেখানে পৌঁছে তাঁরা দুই বোনকে বিয়ে করার পর যখন স্বমূর্তি দেখাতে গেলেন তখন শাহজাদীরা আগেকার দুর্বিনীত স্বামীদের ছিন্ন মুণ্ডের সংগ্রহ দেখিয়ে চরিত্রশুদ্ধির জন্য তাঁদের কারাবদ্ধ করলেন। পাঁচ বছর পরে চিত্তশুদ্ধি হবার পর পারস্যে ফিরে এসে শাহজাদারা দেখলেন তাঁদের সর্বস্ব গেছে। নারীনির্যাতক পুরুষদের এমনতরো শাস্তির ব্যবস্থা পরশুরামের আরো কয়েকটা গল্পে পাওয়া যায়। "অগস্ত্যদ্বার" গল্পে কলিঞ্জরপতি কনকবর্মা প্রতিবেশী বিদর্ভরাজ্যের রানী বিংশতিকলার কাছে এমনভাবেই নাজেহাল হলেন। ছোট্টো গল্প "উপেক্ষিত"-তে মদগর্বী কোফ্‌তা খাঁ শাহজাদী জবরউন্নিসার ওপর বলপ্রয়োগ করতে এসে নিজেই প্রাণ হারালেন। "ষষ্ঠীর কৃপা"-য় কামাতুর গোকুলবাবু যখন শুধু সন্তানসম্ভবা করে করেই তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ হলেন, তখন জগতের মায়েদের দেবী ষষ্ঠীঠাকরুণ শাপ দিয়ে গোকুলবাবুকে হুলো বেড়াল করে মাতৃতান্ত্রিক মার্জারজগতে পাঠিয়ে দিলেন।

এই পুরুষশাসিত জগতে অসহায়া নারীদের অবস্থা নিয়ে আরো দুটি কাহিনী আছে। প্রথমটি "চমত্‍‌কুমারী"। সেখানে বক্রেশ্বর দাস আই সি এসের স্ত্রী মনোলোভাকে এক দুর্ঘটনার পর যখন সার্কাসের স্ট্রংম্যান গগনচাঁদ বাড়ী পৌঁছে দিলেন তখন পরপুরুষ স্ত্রীকে স্পর্শ করেছে বলে বক্রেশ্বরের বিশেষ গাত্রদাহ। বক্রেশ্বরকে শিক্ষা দেবার জন্য গগনচাঁদ তাকে একটু জখম করে গেলেন এবং স্ত্রী চমত্‍‌কুমারীকে, "দি গ্রেট মরাঠা সার্কাসের বল্‌বতী লল্‌না", পাঠিয়ে দিলেন বক্রেশ্বরকে পাঁজাকোলা করে বাড়ী পৌঁছে দিতে। তাঁর স্ত্রী পরপুরুষকে স্পর্শ করবে, এতে গগনচাঁদের কোনো আপত্তি দেখা গেলো না আর চমত্‍‌কুমারীর দাক্ষিণ্যে বক্রেশ্বর তো বিহ্বল, তিনি যে পরনারীর স্পর্শ পেলেন তাতে আপত্তি করা চলবে না। কেবল মনোলোভার সময়েই যত গোলমাল। আর আছেন কুঞ্জের মা ("প্রাচীন কথা-- মধু-কুঞ্জ সংবাদ") "লম্বা চওড়া মহিলা... মাথায় কাপড় না থাকারই মধ্যে", তিনি এসে তাঁর ছেলেকে বেধড়ক মেরে অজ্ঞান করে দেওয়ার অপরাধে ছাত্রসূদন মধুমাস্টারকে কান ধরে থাপ্পড় লাগান। এদিকে আবার পরে বিয়ের আসরে পরিত্যক্তা একটি মেয়ের ভবিষ্যতের কথা শুধু ভেবে বিনা প্রস্তুতিতে এবং কুঞ্জ ও তার বাবার আপত্তি নস্যাত্‍‌ করে কুঞ্জের সঙ্গে মেয়েটির বিবাহ দেন, যদিও মেয়েটি ছিলো মধুমাস্টারের বোন। তিনি প্রাতঃস্মরণীয়া। পুরাকালের নারীবিদ্বেষীরা পরশুরামের হাতে প্রমাণ সাইজ শাস্তি পেলো, সেটা ভালো লাগলো, কিন্তু আমাদের কালে হয় নিছক কল্পনার বেড়ালত্ব ("ষষ্টীর কৃপা") নয় দুটি থাপ্পড়, এটা একটু চোখে লাগে।

সুমিত রায়

(পরের অংশ)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।