প্রসঙ্গ:
পরশুরাম
(১) (২) (৩) (৪) (৫) (৬) (৭) (৮) (৯)
কৈশোর পার হবার পর যখন বড়োদের
শারদীয়া পত্রিকা পড়ার অনুমতি থেকে পাওয়া গেলো, তখন থেকেই দেখেছি
যে নামকরা সাহিত্য পত্রিকায় সম্পাদকীয় আর রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রের
পরেই প্রথম গল্পটি যাঁর, তিনি পরশুরাম। নৈবেদ্যের চূড়ায় সন্দেশটির
মতোই। সেই লেখার প্রসাদগুণে বাকী নৈবেদ্যের চাল কিছু পচা হলেও
খাওয়া যেতো, যদিও প্রায় অর্ধশতাব্দীর পশ্চাত্দৃষ্টিতে মনে হয়
আজকের তুলনায় সেকালে পচার ভাগ কিছু কমই থাকতো। এ সুখ অবশ্য খুব
বেশী দিন সইলো না, কলিযুগের পরশুরাম অমরত্ব লাভ করেননি। তারপর
অনেক লেখক এলেন গেলেন কিন্তু পরশুরামের সেই স্টাইলে সেই রঙ্গব্যঙ্গের
কারিগর আর কেউ এলেন বলে তো মনে পড়ছে না।
রাজশেখর বসু (১৮৮০-১৯৬০)
নিজের নামে ও পরশুরাম ছদ্মনামে, দুভাবেই লিখেছেন। স্বনামে যা লিখেছেন
তা বেশ গেরেম্ভারী ব্যাপার। তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বানান
সংস্কার সমিতির হোতা ছিলেন, সেই সমিতির গবেষণা ও আলোচনার ফলের
ওপর ভিত্তি করে 'চলন্তিকা' বাংলা অভিধান প্রণয়ন করেন, তা আজও পূর্ণগৌরবে
প্রচলিত। আর করেছিলেন কিছু সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদ বা গদ্যে
সারানুবাদ-- মেঘদূত, বাল্মীকি রামায়ণ, মহাভারত, ভগবদ্গীতা এবং
হিতোপদেশের গল্প। প্রতিটিই অনবদ্য-- নির্মেদ সারসঙ্কলন, ঝরঝরে
গদ্য, প্রচলিত অন্যান্য অনুবাদের সঙ্গে তুলনায় এক সম্পূর্ণ অন্য
জাতের রচনা। বেশ কিছু প্রবন্ধের বই আছে-- লঘুগুরু, বিচিন্তা, চলচ্চিন্তা,
এবং মৃত্যুর পরে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু রচনা নিয়ে
'প্রবন্ধাবলী'।
রাজশেখর বসুরা চার ভাই, রাজশেখর
দ্বিতীয়। বড়ো ভাই শশিশেখর একটা রঙ্গব্যঙ্গের কলাম লিখতেন রবিবারের
ইংরেজী কাগজে, পরে রবিবাসরীয় 'যুগান্তর' পত্রিকায়। সেগুলো পরে
এক সংগ্রহে ছাপা হয়েছে, পড়ে মজা পাওয়া যায়, যদিও তাতে আদিরসের
ভাগটা একটু বেশী বলে কেউ কেউ মনে করেন। সবচেয়ে ছোটো ভাই গিরীন্দ্রশেখর
নামকরা মনোবিজ্ঞানী আর তাঁর ছোটোদের জন্য লেখা অন্তত একটা মারাত্মক
মজার বই ("লালকালো") আছে। রাজশেখর বড়ো হয়েছেন বিহারে,
কলেজ থেকে কোলকাতায়। শিক্ষায় ও পেশায় রসায়নবিদ্, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের
আহ্বানে এককালের নামকরা বেঙ্গল কেমিক্যাল কোম্পানীতে যোগ দিয়ে
সেখানেই সারা কর্মজীবন, এমনকি অবসর নেবার পরের সময়ও কাটিয়ে গেছেন।
পরশুরাম নামের আড়ালে রাজশেখর
ছিলেন এক গল্পকার। উপন্যাসে তিনি হাত দেন নি। তাঁর মৃত্যুর পর
একটা কবিতাসংগ্রহও প্রকাশ করা হয়েছিল, না করলেও কিছু এসে যেতো
না। তিনি নাকি বলতেন "আমি যখন ঠাট্টা করে কিছু লিখি তখন 'পরশুরাম'
বলে লিখি। আর যখন 'গম্ভীর' হয়ে লিখি তখন নিজের নামে লিখি।"
কথাটা সম্পূর্ণ সঠিক বলা যাবেনা কেননা চাপল্যের কোনো স্পর্শ নেই
এমন বেশ কিছু মনে রাখার মতো গল্পও পরশুরাম লিখেছেন। নয়খানা সঙ্কলন
গ্রন্থে প্রকাশিত সাতানব্বইটি গল্প আর মৃত্যুর পরে উদ্ধার করা
আরো তিনটি -- এই পুরোপুরি একশো গল্পের ডালি পরশুরামের। নটি বই
প্রকাশের কালানুক্রমে-- গড্ডলিকা, কজ্জলী, হনুমানের স্বপ্ন, গল্পকল্প,
ধুস্তুরীমায়া, কৃষ্ণকলি, নীলতারা, আনন্দীবাই, চমত্কুমারী (তৃতীয়
এবং শেষের পাঁচটির নামের সঙ্গে 'ইত্যাদি গল্প' লেজুড় আছে)। প্রথম
গল্প "শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড"-এর প্রকাশ ১৯২২
সালে, দুবছর পরে আরো কিছু গল্প নিয়ে প্রথম বই "গড্ডলিকা"।
ইস্কুলে বাংলা মাস্টারমশায়দের প্রিয় "অশুদ্ধ" বানান
ছিলো এটি -- গড্ডালিকা। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বইটি প্রমাণ সাইজের
এক আলোড়ন তুলেছিলো। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, যিনি "কর্মবন্ধনের
পাক পাছে বাড়িয়া যায়" এই ভয়ে বইয়ের সমালোচনা করা বন্ধ করেছিলেন,
তিনিও বইটির ছোটোখাটো এক সমালোচনা লিখে "ঝোঁকের মাথায় নিয়মভঙ্গ
করিয়া ভীত" হলেন। প্রসঙ্গত এ নিয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র
ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কৌতুকাবহ কিছু চিঠি চালাচালি হয়, প্রফুল্লচন্দ্রের
অনুযোগ যে তাঁর সযত্নে নির্বাচন করা রসায়নবিদ্ পরশুরাম রবীন্দ্রনাথের
প্রশ্রয় পেয়ে প্রফুল্লচন্দ্রকে "অসহায় ত্যাগ করিয়া"
সাহিত্যকর্মেই ব্যাপৃত হয়ে যাবেন।
এই বইটি প্রকাশের আগে বা
সেই সময়ে বাংলা সাহিত্যে প্রাপ্তবয়স্কভোগ্য হাস্যরসের ইতিউতি কিছু
নমুনা পাওয়া গেলেও বড়াই করার মতো তেমন কিছু দেখা যায় না। হুতোম
প্যাঁচার নক্শা ছিল, বঙ্কিমচন্দ্র গুটিকয়েক ব্যঙ্গাত্মক লেখা
লিখেছিলেন, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বা যোগেন্দ্রচন্দ্র বসুর
নাম তো আজ আর শোনাই যায় না। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় অবশ্যই ছিলেন
তাঁর অদ্ভুত রস নিয়ে, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় কয়েকটি মৃদু হাস্যরসের
গল্প লিখেছিলেন। আর বুদ্ধিদীপ্ত তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের পসরা সাজিয়ে
ছিলেন প্রমথ চৌধুরী, বীরবল। এঁদের কাউকেই পরশুরামের পূর্বসূরী
বলা ঠিক হবে না, পরশুরামের শৈলী একেবারেই তাঁর নিজস্ব। তাঁর পরে
বনফুল বা বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় এবং অন্যান্যরা কৌতুককাহিনী লিখেছেন
কিন্তু পরশুরামের সেই অম্লমধুর শাণিত ব্যঙ্গকৌতুকের স্বাদ আর পাওয়া
গেলো না। আমার মনে হয় আমাদের বাংলা বইয়ের সীমিত বাজারে হাস্যরসিক
হয়ে অন্নসংস্থান করা দুষ্কর। তাই আমরা পি জি ওডহাউস বা নিদেনপক্ষে
জেরোম কে জেরোমও পেলাম না।
সুমিত
রায়
(পরের
অংশ)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর
ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর
নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।