প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সেকাল - একাল থেকে দূরবীণে (৮) (আগের অংশ)

বছর যায়, বছর আসে: দীর্ঘ দগ্ধ দিন, আরাম নাহি যে জানে রে

বাংলা নতুন বছর শুধু একটি দিনের জন্য-- পয়লা বৈশাখ। তার পর আমরা ভুলে যাই নতুন বছরের সাল, দিন, মাস। কত বাংলা সন প্রশ্ন ক'রলে ইংরাজী সালের সঙ্গে ৭ যোগ ক'রতে হয়। আবার সব চয়ে মুস্কিল মাসের হিসেব রাখা-- এক-একটি মাসের দিন সংখ্যা এক এক রকম, সে ভারী ফেসাদ।

বাংলা বছরের আগমনী হ'ত বাড়ীতে পঞ্জিকার আগমনে চৈত্র মাসে, অর্থাত্‍‌ মার্চ মাসে। এখন পঞ্জিকা কেবল আসে যে সব বাড়ীতে প্রাচীন দিনের মা-রা আছেন, বিশেষ ক'রে বিধবা হ'লে, তিথি দেখতে; তখন অধিকাংশ বাড়ীতেই পঞ্জিকা কেনা হ'ত। ফুল বা পূর্ণ পঞ্জিকা হ'ত দু ইঞ্চির ম'ত মোটা, যার এক-চতুর্থাংশ ভর্তি থাকত নানা রকমের বিজ্ঞাপনে। সে বিজ্ঞাপনও ছিল বাহারের। শশীভূষণ প্রভাপদ দে ('আঃ কতবার ব'লব বাসনগুলো শশীভূষণ প্রভাপদ দের দোকান থেকে কেনা'), বৃহত্‍‌ রাক্ষসী লাল মুলা, মুক্তকেশী বেগুন, গ্লোব নারসারী ইত্যাদি। সবার উপর দিয়ে যেত 'মরা মানুষকে বাঁচাইবার উপায়'-- বড় বড় আধ ইঞ্চি হরফে লেখা, তার পরেই ক্ষুদে ক্ষুদে, প্রায় পড়া যায় না, হরফে লেখা থাক'ত-- "আবিস্কৃত হয় নাই সত্য, কিন্তু যাঁহারা দীর্ঘ কাল নানা বিধ ব্যাধিতে ভুগিয়া জীন্মৃতবত্‍‌ সজ্জাশায়ী হ'ইয়া পড়িয়া আছেন, আমাদের ইলেকট্রিক সলিউসন নিয়মিত সেবনে নবজীবন পাইবেন" ইত্যাদি এবং বিফলে মূল্য ফেরতের গ্যারাণ্টী সমেত। আর থাকত বিভিন্ন লটারী ও প্রায় নিখরচায় মনোহারী জিনিষ পাওয়ার প্রলোভন, যার বেশীর ভাগ ঠিকানা থাক'ত জলন্ধর সহরের। এই সব বিজ্ঞাপনের একটি মোক্ষম উদাহরণ পরিমল গোস্বামী দিয়েছিলেন যুগান্তর বা আনন্দবাজার পত্রিকায়। 'মাত্র পঁচিশ টাকায় বইসকিল'-- দেখে এক পাঠক মানি-অর্ডারে টাকা পাঠালেন, জবাবে একটি ছোট্ট প্যাকেটে এসেছিল বাইশ-টি কিল (পেরেক)।
বৈশাখ মাসের পয়লা তারিখে সন্ধ্যাবেলায় পাড়ার প্রতিটি দোকানে থাক'ত লিখিত ও অলিখিত নিমন্ত্রণ। দোকানে দোকানে খরিদ্দারের ভীড় লেগে যেত। দোকানে ঢুকলেই গোলাপ জল দিয়ে অভ্যর্থনা। তার পর সরবত, সিঙারা, চানাচুর, মিষ্টি, চা ইত্যাদি। দোকান থেকে বেরোনোর সময় নলের ম'ত পাকানো বাংলা ক্যালেন্‌ডার। বেরোনোর আগে বয়স্ক খরিদ্দার নগদ পয়সায় কিছু কিনতেন। কিশোর বা শিশুরা অভিভাবকের সঙ্গে না গেলে কোন রকম অর্থনৈতিক দয়িত্ব ছাড়াই আপ্যায়নের স্বাদ পেত।

নতুন বছরের বৈশাখ মাসে পাড়ার লাইব্রেরীগুলির দায়িত্ব ছিল পয়লা বৈশাখ খুব ভোরে প্রভাত ফেরী করা, রবীন্দ্রজয়ন্তী ক'রা ও এই দুইয়ের মাঝে একটি প্রবন্ধ ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন ক'রা। পাড়ার উঠতি ও প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা নিজের নিজের দক্ষতা পেশ ক'রার সুযোগ পেত। উঠতি প্রতিভারা হয়তো সামনের সারিতে বাবাকে ব'সে থাকতে দেখে ঘাবড়িয়ে গিয়ে পরের লাইনটা ক'রেই জিভ কেটে শুধরে নিত।
বাজারে প্রথমে আ'সত কাঁচা এবং পরে পাকা আম। একটি বিশেষ মিষ্টি আম 'বোম্বাই আম' নামে পরিচিত ছিল, যা এখন আসে না। হয়তো হিমসাগর আমটিই তখন ঐ নামে পরিচিত ছিল। আর একটি অপূর্ব জিনিষ একেবারে গৃহশিল্প ছিল। সেটি হ'ল কাঁচা আমপোড়ার সরবত। দিনের রান্না হ'য়ে গেলে উনানে (যা এখন কোন বাড়ীতেই নেই) আম ফেলে দেওয়া হ'ত। ঢিমে আঁচে সেটি তিন চার ঘণ্টায় তৈরী হ'য়ে যেত। তার পর সেটি একটি কাপড়ের উপর ঘসে ঘসে তার ক্কাথ বা'র করা হ'ত একটি বড় বাটিতে। যথোপযুক্ত পরিমাণ চিনি দিয়ে জলের সঙ্গে মিশিয়ে পরিবেশন ক'রা হ'ত। এখন এই সরবত দোকান থেকে কিনতে হয় বা রেস্তোরাঁতে গিয়ে খেতে হ'য়। কিন্তু সেই রকম স্বাদ পাই না।

কালবৈশাখী এখন আর ঘন ঘন আসে না। কালবৈশাখীর ঝড় আর কোন কোন দিন শিলাবৃষ্টি অত ঘন ঘন আর দেখি না। আমার মনে আছে একবার বি.ই. কলেজে পড়ার সময় এপ্রিল মাসের শেষার্ধে প্রায় রোজই কালবৈশাখী হানা দিয়েছিল। শ্লথগতিতে দিনগুলি এগিয়ে যেত গরমের ছুটির দিকে। গরমের ছুটিতে অনেকেই দেশের বাড়ীতে যেত, যেমন আমি ও আমার দাদারা যেতাম আসানসোলে মামাবাড়ীতে।
তাপে সব জিনিষই দৈর্ঘে বাড়ে, দিনই বা বাদ যায় কেন। তাতে অসুবিধা এই যে সময় বাড়'ল কিন্তু কাজের কিছু নেই। স্কুল-কলেজে টানা লম্বা ছুটি। আবার বি.ই কলেজে যখন পড়েছি, তখন এপ্রিল মাসেও ক্লাশে যেতে হ'ত না, ব'লা হ'ত প্রিপারেশন লিভ অর্থাত্‍‌ পরীক্ষার প্রস্তুতি। আবার বি.ই. কলেজে ছুটির কোন হোম ওয়ার্ক থাকত না, যা স্কুলে থাক'ত। কিন্তু সেই হোম ওয়ার্ক আর কত টুকু ব্যস্ত রাখ'তে পারে। ফলে দীর্ঘ দগ্ধ দিন আর কাটত না।

পুষ্পেন্দু সুন্দর মুখোপাধ্যায়

(চলবে)

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।