সেকাল
- একাল থেকে দূরবীনে (৯)
(সূচী)
বছর
যায়, বছর আসে: বরষা ভরসা দিল(?)
'রবিকরে জ্বালাতন আছিল সবাই,
বরষা ভরসা দিল আর ভয় নাই|'--
কথাগুলি নর্মাল স্কুলের শিক্ষক সাতকড়ি দত্ত মহাশয় কেন যে বালক
রবীন্দ্রনাথকে কবিতার পাদপূরণের জন্য বলছিলেন জানি না| কলকাতা
এবং তার আশেপাশে বর্ষাকালকে কেউ খুব ভালবাসে ব'লে আমার মনে হয়
না, এক কয়েকটি কবি ছাড়া| তাও সে সব ছিল আগেকার দিনের ব্যাপার
যখন কবিরা বর্ষাকালের প্রকৃতিপ্রেমে মোহিত হ'য়ে থাকত| নারায়ণ
গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদার মতে-- কবিরা মনিষ্যি নয়; তারা গরমের
দুপুরে ঘরের জানালা বন্ধ ক'রে লেখে 'বাদলরাণীর
নূপুর বাজে তালপিয়ালের
বনে'| গরম কালে লেখে যাতে বর্ষাকালে ছেপে বেরোয়|
সাধারণ
মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর কাছে ক'লকাতার বর্ষাকাল মানেই ছিল কেরানীভেজা
বৃষ্টি, নিয়ম ক'রে অফিস থেকে ফেরার সময় বৃষ্টি| খুব বাস্তব চিত্র
(চলচ্চিত্র) দেখেছি 'পরশপাথর' ছায়াছবিতে পরেশবাবু কার্জন পার্কের
উত্তর-পশ্চিম কোণে ব'সে আছেন ভেজা এবং 'বাপদশার' ছাতার পাশে,
কখন বৃষ্টি থামবে এই অপেক্ষায়| যখন চাকরী সুবাদে নেতাজী সুভাষ
রোডের অফিসে যেতাম, দেখেছি অফিসপাড়ার বহু কর্মচারী হেঁটে, পুরোটা
না হ'লেও বেশ কিছুটা পথ হাঁটতেন বাড়ী ফেরার জন্য| (প্রসঙ্গত
মনে পড়ে গেল অফিস থেকে ফেরার সময় হেঁটে এসপ্লানেড আসতাম ম্যাডান
স্ট্রীটের 'রক্সী' সিনেমা হল বাড়ীর দোতলায় 'ইঞ্জিনিয়ারস ক্লাবে';
তখন দেখেছি কার্জন পার্কের উত্তর-পশ্চিম কোণে পায়ে হাঁটার রাস্তার
দুই পাশে মাটির তলা দিয়ে সুড়ঙ্গ ক'রে প্রায় এক-দেড় ফুট লম্বা
ধেড়ে ইঁদুরের দল এদিক থেকে ওদিক গিয়ে মাঠে বিচরণ ক'রছে পরশুরামের
'শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড' গল্পে বর্ণিত ইঁদুরের মতন--'আশ্রমমৃগের
ন্যায় নিঃশঙ্ক'| ইঁদুরের পাল কি এখনও আছে?)
বর্ষাকাল
মানে অবশ্যই দাবদাহের হ্রাস, চারপাশে সবুজের প্রাচুর্য, সূর্যের
ক্বচিৎ দর্শন| এসব এখনও আছে, আগেও ছিল| তফাৎ হ'ল, আগে ক'লকাতার
বুকে গাছের দেখা মিলত অধিক সংখ্যায়, যা এখন প্রায় অদৃশ্য হ'য়ে
গেছে| বকুল গাছ, শিউলি গাছ, কদম গাছ এখন সেই সংখ্যায় দেখা যায়
কি? ক'লকাতার একটি পাড়ার নাম বকুলবাগান, সেই নামে একটি রাস্তাও
ছিল, এখনও আছে হয়তো সেই নাম; কিন্তু সেই গাছগুলি আছে কি? বহুকাল
সে পাড়া থেকে উঠে এসেছি, যেখান থেকে বকুলবাগান রোডের দূরত্ব
ছিল একশ' ফিটের মধ্যে| জল আগেও জমত রাস্তায়, তবে কয়েকটি রাস্তায়|
মনে
পড়ে যখন মোমিনপুর থেকে ল্যানসডাউন রোডে স্কুলে যেতাম|-- বিকেলে
বাড়ী ফেরার সময় প্রায়ই দেখতাম ব্রনফিল্ড রোডে জল জমে আছে| হাফ
প্যান্ট আর কতই বা গুটনো যায়| কোমর না ভিজলেও হাঁটুর উপর পর্যন্ত
জল থাকতই| এখনকার সঙ্গে তফাৎ হ'ল, জল বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত
না| কয়েক ঘণ্টা পরেই নেমে পরিষ্কার হ'য়ে যেত রাস্তা| মোমিনপুরে
একজন বয়স্ক ব্রজদা' বা টেনিদা' থাকতেন| তিনি ছোটদের গল্প ব'লতেন
কেমন ক'রে মির্জাপুর রোডের মেস থেকে ডালহৌসী স্কোয়ার পাড়ার অফিস
যেতেন মেসের পেল্লাই কড়াই চেপে, বড় খুন্তির দাঁড় টেনে| আমি বহুকাল
জেসপ কোম্পানীর হেড-অফিস গিয়েছি, বর্ষাকালে অফিসে এক সেট শার্ট,
প্যান্ট, মোজা ও জুতা রেখে দিতাম, প্রয়োজনে পাল্টানোর জন্য|
ছাতা ব্যবহার করতাম না| কারণ, শিব্রাম চক্রবর্তীর মতে, ছাতা
তিন পুরুষ চলে-- আপনি কিনে পরিচিতকে দিলেন সে নিয়ে আসেনি ব'লে,
আর তিনি আর একজনকে দিলেন|
আর
দেখা যায় না, বর্ষাকালে কাগজের নৌকো| এখন কেউ বানাতে জানে ব'লেও
মনে হয় না| কারণ কাউকে বানিয়ে ভাসাতেও দেখি না| চোখে পড়ে না,
নানান রকমের ঘুড়ি| আগে ময়দানে, মনুমেণ্টের কাছে বহু ওস্তাদ ঘুড়ি
ওড়ানো চাম্পিয়নরা পাল্লা দিত কে অন্যের কটা ঘুড়ি কাটতে পারে|
ঘুড়ির নামও ছিল রকমারি-- চাঁদিয়াল, ময়ুরপঙ্খী, পেটকাট্টি, গ্লাসি
ইত্যাদি| দোকানেও পাওয়া যেত আবার অনেকে বাড়ীতে নিজে বানাত| মাঞ্জা
সুতো অবশ্যই বাড়ীতে বানানো হ'ত| এখনও ঘুড়ি ওড়ে, তবে সংখ্যায়
আগের তুলনায় অনেক কম| আর ওড়াবে কি, গগন-ঝাড়ু বাড়ীর ভীড়ে আকাশে
ঠাঁই কোথায়? ঘুড়ি ওড়ানোর পালা শেষ হ'ত বিশ্বকর্মা পূজোর দিন|
তার পর আর কেউ ঘুড়ি ওড়াতো না| বিশ্বকর্মা পূজো শেষ মানে শরত
কাল এসে গেল, মা দুগ্গা আসার পালা এবার|
তবে বর্ষার
আরও একটি অনুষ্ঠান ছিল, রথযাত্রায় রথ টেনে ঘোরা-- যা আজও চ'লে|
বাঙ্গালী ফুর্তিপ্রাণ জাত; 'সাহেব-বিবি-গোলাম' উপন্যাসের নটে
দত্ত, বাবার মৃতদেহ সৎকারে নিয়ে যেতে বাইজী সহযোগে শোভাযাত্রা
ক'রে নিয়ে যাচ্ছে, পথে উল্টো দিক থেকে আসা ছটুক বাবুর বিয়ের
শোভাযাত্রা| নটে দত্ত পথ ছাড়বে না-- 'আই নটে দত্ত, সন অফ ছেনো
দত্ত, মাই ফাদার ডাই; আমরা ফুর্তি ক'রতে জানি না'? তাই পাড়ায়,
পাড়ায় রথের সারি আজও বেরোয়| রথের চোঙ্গা বাঁশী দেখতে তথা শুনতেও
পাওয়া যায় আগের মতন| মঠ-মার্কা মিষ্টি, পাঁপড়-ভাজা এ সব খাওয়াও
চ'লে আগের মতনই|
গ্রীষ্ম আর
বর্ষা, অকারণ দীর্ঘ ব'লে মনে হ'ত (যদিও এখনও হ'য়)| বছরের প্রায়
ছ' মাস ধ'রে লেগে থাকে| সব চেয়ে খারাপ ব্যাপার, কিছু ক'রার থাকে
না এই দীর্ঘ সময়টা| বৃষ্টি আস্তে আস্তে ক'মে আসে, পরিমাণ এবং
সময় দু-এরই বিচারে| মেঘের ঘন ঘটা কমে আসে| আকাশের অবস্থা ছানা
কাটা দুধের মত| কিন্তু, আকাশের দিকে তাকাব তার উপায় এখন আর নেই,
উঁচু উঁচু বাড়ীর ঠেলায়| ক্যালেন্ডার দেখে ঠিক ক'রতে হয় পূজোর
মরশুম-ভরা শরতের আর ক'ত দেরী| আগে অবশ্য আকাশে মেঘের পাতলা হ'য়ে
আসা বোঝা যেত| বাড়ীগুলি এত উঁচু ছিল না| ছাদে না চড়েও আকাশ দেখতে
পাওয়া যেত| দেখা যেত 'নীল আকাশে, কে ভাসালে সাদা রোদের ভেলা'|
অফিসের বাবুদের মনে আশার আলো- এবার বোনাসটা ভালোই দেবে কোম্পানী|
পুষ্পেন্দু
সুন্দর মুখোপাধ্যায়
(চলবে)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।