সেকাল
- একাল থেকে দূরবীনে (১০)
(সূচী)
বছর যায়, বছর আসে: শরৎ: শিউলি-ফোটা ফুরল যে(ই) ফুরল
কথাটা শরৎ কালের পটভূমিতে
প্রলাপ মনে হ'লেও প্রলাপ নয়| কারণ শিউলি ফুলের ফোটা আর দেখতে পাই
কোথায়? আমার কলকাতা শহরে বাস একটানা 28 বছর 1944 সাল থেকে| মাঝে
ছয় বছর হস্টেলে থেকেছি 1954 সালের মাঝামাঝি থেকে, কিন্তু সেই সময়ে
সপ্তাহান্তে বাসায় আস'তাম এবং বাৎসরিক অবকাশ ও ছুটি-ছাটায় আসা
তো ছিলই| ফলে সংযোগটা বিচ্ছিন্ন হয় নি| 1972 সালে কর্মোপলক্ষে
ক'লকাতা ছাড়ি এবং ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কাটিয়ে আবার 1978 সালের
শেষে ফিরে আসি| এসে আর কলকাতাকে চিনতে পারি না| অনেক কিছু নতুন
জিনিষ, সুদৃশ্য ও কুদৃশ্য মিলিয়ে, এসেছে, আর বহু জিনিষ বিদায় নিয়েছে|
বিদায় নিয়ে যাওয়া জিনিষগুলির মধ্যে পড়ে শিউলি গাছ| শরৎকালে আর
সকাল বেলা শিউলি ফুলের রাশি দেখি না মাটিতে; শিউলি গাছই নেই|
শিউলি গাছের অনেক ব্যবহার ছিল| একটি ছিল শিউলি পাতা থেঁত ক'রে
বা বেটে মধু দিয়ে খাওয়া, ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে| আর একটি
ছিল শিউলি ফুলের বোঁটা থেকে রং বা'র ক'রে কাপড় রাঙানো| তবে বেশ
পরিশ্রম-সাপেক্ষ ও ধৈর্য-সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল| পূজাতে শিউলি ফুলের
মালাও লাগ'ত| সে সব পাট বোধ হয় চুকে গেছে|
শরৎ কাল এবং তার পিছু পিছু
হেমন্ত কাল ব'লে আমরা জানি, তার ভিতরে হেমন্ত কালকে শরৎ কালের
শেষ ব'লেই আমার মনে হয়| তবে ব্যাপারটা হ'ল, এই সময়টা ক্যালেন্ডারের
নিরিখে বেশই ছোট হ'লেও বাঙালীর কাছে সব চেয়ে প্রিয় পুজোর মরশুম
হিসেবে| এবং এই মরশুমটা
আরম্ভ হ'ত মহালয়ার সকালে অল ইণ্ডিয়া রেডিওতে 'মহিষাসুর-মর্দিনী'
অনুষ্ঠানটি শুনে| শেষ হ'ত ভাই ফোঁটায়| মাঝে ছিল দুর্গা পূজা আর
কালি পূজা যা ব'লার ম'ত| এ ছাড়াও ছিল লক্ষ্মী পুজো, কিন্তু সেটা
একান্তই ঘরোয়া ব্যাপার, সার্বজনিক রূপ ছিল না|
মানসিক প্রস্তুতি অনেক আগেই লেগে যেত| পুজোর ছুটিতে দেশের বাড়ীতে
যাওয়া হ'বে না, দার্জিলিং-- এই আলোচনা আছে, আর ছিল বোনাস| কোম্পানি
কি রকম বোনাস দেবে এবার, ঘোড়ার মুখের খবর কিছু আছে কি না এই সব
ছিল নিত্য আলোচনার| তার পর সত্যিই যখন বোনাসের টাকাটা পকেটে আসত,
পুজোর পোশাক ছিল কেনা-কাটার লিস্টে সব চেয়ে উপরে| তখন দোকান থেকে
কেনার রেওয়াজ খুব বেশী ছিল না শাড়ী-ধুতি ছাড়া| কাপড় কিনে দর্জির
সেলাই| অনেক বাড়ীতেই বাঁধা দর্জি আস'ত বাড়ীতে| সে পোশাক তৈরি হ'য়ে
বাড়ীতে পৌঁছত পঞ্চমী বা ষষ্ঠীতে| ধোপাকে কাপড় কাচতে দেওয়াও ছিল,
বিশেষ ক'রে শাড়ী ও ধুতি| এখন ধুতি কেনা ও পড়ার চল অনেকটাই কমে
গেছে, তখন শান্তিপুরী ও ফরাসডাঙার ধুতির আভিজাত্য ছিল| সে ধুতি
আবার আড়ং ধোলাই হ'য়ে আসত- পাট ছাড়াতে হ'ত বেশ ধস্তাধস্তি ক'রে
এবং সশব্দে| মিলের ধুতিও ছিল-- সুপারফাইন| পুজোর তত্ত্ব পাঠান
ছিল বেয়াই বাড়ীতে| এখন বেয়াই শব্দটার ব্যবহার কেবল টেলিভিশনের
সিরিয়ালেই পাওয়া যায়|
পুজো
আসার উদ্বোধন ছিল মহালয়ার দিন| ভোর বেলায় রেডিও খুলে বিছানায় শুয়ে-ব'সে
মহিষাসুরমর্দিনী শোনা| জেনে এসেছি যে তখন প্রতি বছরই তাৎক্ষণিক
প্রচারই হ'ত অনুষ্ঠানটির| তৎকালীন সব প্রতিষ্ঠিত-নামী শিল্পীরাই
ভাগ নিতেন-- ব্যতিক্রম হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য|
এই দুই জনপ্রিয় শিল্পী, কেন জানি না, কখনও অংশ গ্রহণ ক'রেন নি|
স্তোত্র পাঠে থাক'তেন বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র| এক বারই মাত্র পরিবর্তন
হয়েছিল সস্তোত্র পাঠকের, এবং শুনেছি বেশ অসন্তোষও প্রকাশ পেয়েছিল|
যা হোক, বেতার অনুষ্ঠান শুনেই ছোটা গঙ্গার ঘাটে ঘাটে ভিড় তর্পণ
নিবেদনের| তখনই দেখা যেত কিছু লোক তেল মেখে, মাসাজ নিচ্ছেন| এখন
আর গঙ্গার ঘাটে যাওয়া হয় না, তবে মহালয়ার তর্পণের ভিড় ঠিকই আছে|
দুর্গা প্রতিমা নির্মাণের
দুটি পাড়া-- উত্তর কলকাতায় কুমোরটুলি আর দক্ষিণ কলকাতায় পটুয়া
পাড়া| মাস খানেক আগে থেকেই কাজ শুরু হ'য়ে যেত| তখনকার নামী পটুয়া
ছিলেন জিতেন পাল ও রমেশচন্দ্র পাল| এনারা মাত্র একটি দু'টি পুজোর
প্রতিমা করতেন| জিতেন পালকে শুধু আশুতোষ কলেজের পশ্চিমে হরিশ মুখার্জী
রোডের ২৩শ পল্লীর প্রতিমা ক'রতে দেখেছি| রমেশ পাল করতেন পার্ক
সার্কাস ও কলেজ স্কোয়ারের পুজোর, এছাড়াও তিনি চিত্তরঞ্জন এভিনিউ-এর
উপর ফায়ার ব্রিগেডের পুজোতে প্রতিমা করতেন-- পরে এই পুজোটি বন্ধ
হ'য়ে যায়| এ ছাড়া 1952 সালে বকুলবাগানের পুজোতে, সম্ভবত ঐ একবারই,
তিনি প্রতিমা নির্মাণ করেছিলেন-- সে বছর বকুলবাগান পুজোর রৌপ্য
বা স্বর্ণ কোন একটা জয়ন্তী ছিল|হাজরা মোড়ের উত্তর-পূর্ব কোণের
বড় বাড়ীটির একতলায় দুটি হেয়ার কাটিং সালুন ছিল-- এখনও আছে| একটির
নাম সালুন-ডি-লুকস, অপরটির নাম কাট ওয়েল সালুন| এই কাট ওয়েল সালুনের
রাখা কাচের শোকেসে ২৩শ পল্লীর 1945 সালের পুজোর প্রতিমার ফটো অনেক
দিন পর্যন্ত দেখেছি| তার অসুর মূর্তি খুবই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল|
স্কুলে যাওয়ার ও ফিরে আসার সময় বেশ কিছুক্ষণ ধ'রে ফটোটি দেখতাম|
সম্প্রতি ও'খানে গিয়ে দেখি ফোটোটি আর নেই; মন খারাপ হ'য়ে গেল|
তখন সালুনের নাম জয় হিন্দ, নেতাজী, স্টার-- এই সবই ছিল| তবে শিব্রাম
চক্রবর্তীর বা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পে সুকেশ কর্তনালয় নামটিও
পেয়েছি| বকুলবাগানের একটি সালুনের নাম ছিল-- সালুন ডি মোরিয়া;
আমার সেজ' কাকা বলতেন আসলে ওটা সালুন দে ময়রা|
দুর্গা পুজোতে পাড়ায় পাড়ায় প্রতিমা দেখে বেড়ানো আগেও ছিল, এখনও
আছে| তবে জনসমাগমের এবং হুল্লোড়ের মাত্রা তখন কম ছিল এখনকার তুলনায়|
পুজোতে মেলা কয়েকটি সীমিত স্থানে ছিল-- যথা বাগবাজার সার্বজনীন,
পার্ক সার্কাস ময়দান প্রভৃতি| প্যাণ্ডাল সজ্জা ও আলোকসজ্জাতেও
এখনকার মতন এত বাহার ও বৈচিত্র্য ছিল না|দুটি পুজোতে তখনও একটু
খরচ ক'রে বাহার ছিল-- ভবানীপুরের সঙ্ঘশ্রী (সুবারবান স্কুল রোডে)
আর হাজরা পার্কের পুজোয়| দ্বিতীয়টি ছিল কর্পোরেশনের কর্মীদের উদ্যোগে
এবং এটি ছিল একমাত্র পুজো যেখানে বাইরের দেওয়ালে এবং উপরের ছাদে
করোগেটেড টিন ব্যবহার ক'রা হ'ত|পুজোটি এখন বন্ধ হ'য়ে গেছে, যেমন
হ'য়ে গেছে চিত্তরঞ্জন অভিনিউএর উপর ফায়ার ব্রিগেডের পুজো| বিবেকানন্দ
রোড ঘেঁসে তিনটি পুজো খুবই প্রসিদ্ধ ছিল-- সিমলা ব্যায়াম সমিতি
ও সিমলা পাড়ার দুটি পুজো| এর মধ্যে একটি পুজো নব দুর্গা নামে খ্যাত;
সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোর প্রতিমা ব্যায়ামবিদদের জন্যই ছিল বোধ
হয়, প্রতিমা এত বড় হ'ত যে সেই ক্লাবের পালোয়ানরাই তা তুলতে পা'রত|
প্রসঙ্গত ব'লে রাখি সে যুগে প্রতিমা নিয়ে আসা ও বিসর্জনের কাজটা
পাড়ার যুবকরাই ক'রত, এখনকার মতন মজুর ভাড়া ক'রা হ'ত না|
বনফুলের একটি কবিতায় আছে--
তার পর বহু কাল গেছে কেটে--
ছিল যারা বেঁটে,
হয়েছে লম্বা তারা বয়স বাড়িয়া|
সময়ের সাথে সমাজে বহু প্রথাই
প্রচুর ব'দলিয়ে যায়, এমন কি বিলুপ্তও হয়| দুর্গা পুজোয় পূজার তিনটি
দিক কিন্তু এখনও নীতিগত ভাবে একই আছে, হয়তো প্রকাশটা কিছু--বেশ
কিছু পরিবর্ধিত হয়েছে| তিনটি দিকই মূল পুজোর ব্যাপার-- পুজোর জোগাড়,
পুজোর সময়নিষ্ঠা এবং পূজারীর প্রতি দক্ষিণার অপ্রতুলতা|
যেমন আমার ছোট বয়স, গড়ে ওঠার
বয়স এবং তরুণ বয়স তথা যৌবনকালে দেখেছি, এখনও পুজোর জোগাড় পাড়ার
কয়েকজন মহিলারাই ক'রে থাকেন| কোন জাদুবলে জানি না, সক্কাল বেলায়
গৃহসংসারের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে তাঁরা পুজো প্রাঙ্গণে পৌঁছে যেতেন
এবং পুজোর যাবতীয় যোগাড় সেরে রাখতেন| সবচেয়ে শেখার ব্যাপার হ'ল
এই সবটাই হ'ত সহাস্য গল্পের সাথে| লাল পাড় গরদের শাড়ী, অবশ্যই
স্নান সেরে, পুজো প্রাঙ্গণে চ'লে আসতেন এবং সবই হ'য়ে যেত নির্দিষ্ট
সময়ের মধ্যে| এই নিষ্ঠা এখনও আছে|
'দিবা ২-৩৩ গতে সন্ধিপূজা আরম্ভ এবং ৩-২৪ মধ্যে সন্ধিপূজা সমাপন
প্রশস্ত|' পাঁজির এই ধরণের বিধান কোন পূজায়, এমন কি সর্বজনীন পূজায়ও
মানা হয় নি ব'লে আজ পর্যন্ত দেখি নি| কোনও পুজোর উদ্যোক্তাকে আজ
পর্যন্ত ঘাড় চুলকে সলজ্জভাবে ব'লতে শুনি নি, 'মেসোমসাই এবারের
নবমী পুজোটা লক্ষ্মী পুজোর পরের দিনের আগে ক'রা গেল না'| যে দেশে
সব পরিকল্পনা দশ-বারো বছর হেসে খেলে বিলম্বায়িত হয়, সেই দেশেই
সব ক'টি দুর্গা পুজো, যার চার দিনে বারো-তেরটি সময়-বাঁধা অনুষ্ঠেয়
থাকে তার সব কটি সঠিক শাস্ত্রোক্ত সময়ে আরম্ভ ও সমাপন হয়, সব কটি
বিধি মেনে, এটি ম্যানেজমেন্ট ইন্স্টিটিউট গুলি তাদের শিক্ষাক্রমে
রাখতে পারে|
'বাঞ্ছারামের বাগান' চলচ্চিত্রে কালীপুজোর পুরোহিত গৃহকর্ত্রীকে
বলেছিল, 'দক্ষিণায় দাক্ষিণ্যটা কিঞ্চিৎ বেশী পরিমাণে দেখিয়ো মা'|
পুজোর সব রকম খরচ বেড়েছে-- প্রতিমা, ডেকোরেশন, থিমের সজ্জা (এবং
বাহুল্য), প্রমোদানুষ্ঠান- এ সবে বরাদ্দ বেড়েই চ'লে| কিন্তু পুরোহিতের
প্রণামী শতকরা এক ভাগও হ'য় না মোট খরচের| অথচ পুজো যথেষ্ট শ্রমসাধ্য
এবং দক্ষতাসাধ্য| এই ব্যাপারটা আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমন আছে|
এত মিল সত্ত্বেও, একটি তফাৎ চোখে পড়ে আজকাল আগেকার পুজোর সঙ্গে|
সেটি হ'ল অনেক সর্বজনীন পুজোর বিসর্জন নির্দিষ্ট দিনে না হ'য়ে
দু-চার দিন পরে হয় এখন| আগে এটি এত দেখি নি|
দুর্গাপুজোর পরে লক্ষ্মী
পুজো; এটি প্রায় সব বাড়ীতেই হ'ত তাই সর্বজনীন পুজোতে নমো নমো ক'রে
সারা হ'ত আবশ্যক ব'লে| পুজোর যবনিকা উঠত পনেরো দিন পরে কালী পুজোয়|
এটি স্মরণীয় ছিল দুটি কারণে| প্রথমটি অবশ্যই দীপাবলির জন্য| কালীপুজোর
আগের সন্ধ্যায় চোদ্দটি প্রদীপ জ্বালানো হ'ত| দোকান থেকে প্রদীপ
কেনা প্রায় কোন বাড়ীতেই হ'ত না, বাড়ীতেই মাটির প্রদীপ তৈরি ক'রা
হ'ত-- কাঁচা ভেজা মাটি দ'লে প্রদীপের আকৃতি দিয়ে, রোদে শুকিয়ে
এবং পর দিন ঢিমে আঁচে পুড়িয়ে নেওয়া হ'ত| পুরনো শাড়ী বা ধুতির কাপড়
ছোট ছোট ক'রে কেটে স'লতে বানানো হ'ত| চতুর্দশীর সন্ধ্যায় প্রদীপ
জ্বালিয়ে বাড়ীর বিভিন্ন অংশে বসিয়ে দেওয়া হ'ত| এখন আর বাড়ীতে প্রদীপ
বানানো হয় না| প্রদীপের তেল অবশ্যই সরিষার ছিল| কালীপূজার সন্ধ্যা
থেকে বাজী ফাটানো হ'ত, এবং এখানেও বিশেষত্ব অনেক বাড়ীতেই বানিয়ে
নেওয়া হ'ত নিজেদের দ্বারা, যা এখন আর হয় না|
আমার ছাত্রজীবনের, প্রাথমিক,
মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষাক্রমের, প্রায় সবটাই কেটে গেছে মোমিনপুরে,
ভাড়াটে হিসেবে| তখন কানাই দাস ব'লে একজন প্রতিবেশী ছিলেন| যখন
শিবপুরে বি ই কলেজে পড়েছি তখন তিন বছর তাঁর বাড়ীতে আমরা ভাড়া ছিলাম|
তাঁকে সবাই 'কানাইদা' ব'লে ডাকত, এবং, মজার কথা তাঁর ছেলেদের,
বয়সে বড় ব'লে, বিজনদা', মধুদা', গগনদা' ব'লে ডাকতাম| তা, সেই কানাইদা'
খুব ভালো বাজী বানাতেন-- বসানো তুবড়ি ও উড়ন তুবড়ি| অনেকের জন্য
তিনি বাজী বানিয়ে দিতেন| মশলাগুলি গহনার দোকানের মত সূক্ষ্ম তুলাযন্ত্রে
মাপ ক'রে মেশাতেন, ওজন প্রক্রিয়া সারতেন লোকচক্ষুর অন্তরালে| খুবই
উচ্চমানের হ'ত তাঁর পদ্ধতিতে ক'রা তুবড়িগুলি এবং স্থানীয় প্রতিযোগিতায়
পুরস্কার পেত| মেশাতেন তিনি নিজেই আর বাকী কাজগুলি তাঁর তত্ত্বাবধানে
ও অনুমোদনসাপেক্ষে হ'ত-- এমন কি কতক্ষণ রৌদ্রে দিতে হ'বে এ সব
নির্দেশ দিয়ে দিতেন| এই রকম অনেক বাড়ীতেই বাজী নিজেরাই তৈরি ক'রে
নিত সেকালে, যা এখন দেখি না| আর দুটি বিশেষ বাজী ছিল| তার একটি
ছিল একটি ছিল চাবি বোমা-- একটি চাবির গর্তে পটকার মশলা ভরে দেওয়া
হ'ত এবং মুখটি একটি লোহার ছিপি দিয়ে বন্ধ থাকত| তার পর ছিপিটি
সজোরে ঠুকে বাজী ফাটানো হ'ত| আর একটি বাজী ছিল ছুঁচো বাজী-- সত্যই
ছুঁচোর মতই গতিপ্রকৃতি ছিল সেটির| কোথায় ঢুকে পড়বে তার ঠিক ছিল
না, তা সে লোকের বাড়ীর উঠানই হোক বা পলায়নপর লোকের লুঙ্গির ভিতরেই
হোক| এটি এখন নিষিদ্ধ হ'য়ে গেছে| উঁচুদরের শিল্পীরা হাউই, রকেট,
ফানুস ইত্যাদি বানাত| এখন আর কোনও বাড়ীতেই বাজী বানানো হয় না|
দ্বিতীয় কারণটি হ'ল কালী
পুজোর সন্ধ্যায় পুজো ব'সার আগে বা দু'-একদিন পরে পাড়ার স্থানীয়
নাট্যপ্রতিভাগুলির অংশগ্রহণে বাৎসরিক নাটক মঞ্চস্থ হ'ত| কোথাও
কোথাও লক্ষ্মী পুজোর সন্ধ্যাতে হ'ত| বন্ধুদের কাছে শুনেছি মহানায়ক
উত্তমকুমার, তিনি মহানায়ক হ'য়ে যাবার পরেও এবং যখন তিনি ভবানীপুরের
বাড়ীতে থাকতেন না, বহুদিন লক্ষ্মী পুজোর সন্ধ্যায় এইরকম সর্বজনীন
নাটক করেছেন| যা হোক, এই সব নাটক বেশীর ভাগই পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক
পালা হ'ত, যাতে ক'রে অনেককেই খুশী রাখা যেত| মোমিনপুরে আমি দীপক
মুখোপাধ্যায়কে একবার অভিনয় ক'রতে দেখেছি| কেউ পার্ট ভুলে গেলে,
বা দ্রব্যবিশেষ কিঞ্চিৎ বেশী মাত্রায় সেবনের ফলে কাপড়ে পা জড়িয়ে
পরে গেলে তা সারা বছরের আনন্দের খোরাক হ'য়ে থাকত| মহিলা চরিত্রে
অবশ্যই পুরুষেরা ভাগ নিতেন; তবে ১৯৫৮-৫৯ সাল থেকে কিছু কিছু মহিলা
শিল্পীদের ক'রতে দেখেছি| তাঁরা অবশ্যই পাড়ার হ'তেন না এবং পারিশ্রমিক
নিতেন|
কালীপূজা পেরিয়ে গেলে, আর
বড় কিছু অনুষ্ঠান থাকে না, তখনও ছিল না| পুজো যদি কার্ত্তিক মাসে
পড়ত, কালী পুজো শেষ হ'লে বাৎসরিক পরীক্ষার দিনগুলি এসে যেত| পরীক্ষার
আগে পাঠ্য বারবার পড়া, মুখস্থ ক'রে ফেলা এই সব পাট চুকিয়ে থাকত
পরীক্ষা হলের প্রস্তুতি| ফাউন্টেন পেন খুব কম ছাত্রেরই থাকত,
বিশেষ ক'রে নীচের ক্লাসের ছাত্রদের একদমই থাকত না| নাইন বা টেনের
ছাত্রদের কারও কারও, বিশেষ ক'রে যাদের পৈতে হয়েছে, ফাউন্টেন পেন
থাকত| তখনও সুলেখা কালি বেরোয় নি, পার্কার কালি ছিল| স্কিপ ব'লে
একটি কালি ছিল-- এটির দোয়াতের ভিতরে উপরের দিকে একটি পকেট থাকত|
দোয়াত বন্ধ অবস্থায একবার উপুড় করে আবার সোজা ক'রে নিলে উপরের
পকেটটিতে কালি জমত, পেনে ভরে নেবার সুবিধে হ'ত| যাদের ফাউন্টেন
পেন নেই, তারা বাড়ীতেই কালি তৈরি করে নিত| জেবিডি কোম্পানীর কালির
বড়ি পাওয়া যেত| বড়িকে থেঁতো ক'রে জলে গুলে কালি তৈরি ক'রা হ'ত|
কলমের হোল্ডারে নিব পড়িয়ে নিতে হ'ত| সেটিও বোধ হয় জেবিডি কোম্পানীরই
ছিল, তবে সঠিক মনে পড়ছে না| হোল্ডারে পড়াবার আগে আগুনে পুড়িয়ে
অল্প টেম্পার ক'রে নেওয়া হ'ত|
নকল ক'রা, অর্থাৎ যাকে টুকলিফাই
বলত, সে যুগেও ছিল| যাদের প্রস্তুতি কম, তাদের পরীক্ষার প্রস্তুতির
মধ্যে বেশ জরুরী ছিল ছোট ছোট কাগজের গুলিতে প্রায় বর্জইস হরফে
সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর টুকে রাখা| মা দুর্গার অস্ত্রসম্ভারের
মতই সব টুকরাগুলি হাতের আস্তিনে, গেঞ্জির ভিতরে, জুতোর হীলের জায়গায়
জমান থাকত সেগুলি| কেউ কেউ আবার, শীতকালের গায়ে খড়ি ওঠার সুযোগে
পায়ে, হাতের কবজিতে (আস্তিনে ঢাকা থাকত) সরু পেন্সিলে লিখে রাখত|
পরীক্ষা শেষ, আঃ মনে নিশ্ছিদ্র
আনন্দ| রেজাল্ট বেরুলে দেখা যাবে ফেলের ধাক্কা লাগল কি না; আপাতত:
চুটিয়ে খেলা আর আনন্দ| পরীক্ষা শেষ হ'লে কালির দোয়াত ছুঁড়ে টিপ
ক'রে বাসের টায়ারে মারার আনন্দও আছে| রেজাল্ট বেরোবার আগে প্রায়
দু' সপ্তাহ ছুটি থাকত| কাজের মধ্যে দুই 'খ'-- খাওয়া আর খেলা|
পুষ্পেন্দু
সুন্দর মুখোপাধ্যায়
(চলবে)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর
ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর
নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।