নারী
মার্চ ১, ২০১৫
আমার স্বাস্থ্য, আমার সত্তা
[আমাদের জীবনের কথা
মেয়েদের জীবনের কথা, তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের কথা বলতে গেলে পরিবার তথা সমাজে তাদের সঠিক অবস্থান কোথায় তা বোঝা দরকার। সেই পরিপ্রেক্ষিত থেকে উঠে আসে মেয়েদের অধিকারের কথা, যে অধিকার মানুষকে মানুষের মত বাঁচতে শেখায়। সেই অধিকার মেয়েদের নিজেদের লড়ে নিতে হবে।
প্রাচীন ভারতে মেয়েদের নিজস্ব সত্তা ছিল না। মেয়েদের মতামত জানানোর পরিধি ছিল সীমিত, তার বাইরে তাদের কণ্ঠস্বর থাকতো অশ্রুত, উপেক্ষিত। মেয়েদের ব্যক্তিত্ব প্রকাশের অধিকার সমাজে মর্যাদা পেত না। নিজেদের ইচ্ছেয় বিয়ে করা, সঙ্গী পছন্দ করা তাদের পক্ষে ছিল অনৈতিক, অন্যায়। মেয়েরা ছিল অন্যের সম্পত্তি। বিয়ের পর মালিকানা বদলাত বাপের বাড়ী থেকে শ্বশুর বাড়ী। তারা ছিল যৌন যন্ত্র, পুত্রার্থে . . .। নিজের ইচ্ছের মূল্য তাদের দিতে হত 'চরিত্রহীনা', 'কুলত্যাগিনী' বিশেষণে ভূষিত হয়ে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হলে সমাজ তাদের ঘৃণার চোখে দেখত, এমনকি নিজের পরিবার কোন দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করত। এখনও সেই ঐতিহ্য অনেকটাই বজায় আছে।
এখন মেয়েদের শুভার্থে কিছু আইন হয়েছে - মেয়েদেরই লড়াইয়ের ফসল। সমাজের কিছু অংশের মহিলারা অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা স্বাধীনও হয়েছেন। তবুও মেয়েদের নিজস্ব ইচ্ছে এখনও স্তিমিত রাখতে হয়। এখনও নিজেদের শরীর ও যৌনতা অস্বীকার করে তাদের 'ভাল মেয়ে' হতে হয়। মেয়েদের শিক্ষা, কর্মজীবন, স্বাস্থ্য এখনও পরিবারে ও সমাজে গৌণ হয়েই আছে। মেয়েদের মূল্য তাদের রূপে, এবং প্রচলিত সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে তার পরিমাপ।
আমার স্বাস্থ্য, আমার সত্তা মেয়েদের শরীর, যৌনতা, সুস্থ জীবনের তথ্য তাদের হাতে পৌঁছে দেবে। বইটিতে মানসিক, শারীরিক সুস্থতা, ও সার্বিকভাবে প্রতিজন মেয়ের নিজেকে একজন সুস্থ নারী হিসেবে তৈরি করার প্রয়াস রইল।
আমার স্বাস্থ্য, আমার সত্তার উৎস ১৯৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত মেয়েদের স্বাস্থ্য ও যৌনতা নিয়ে প্রামাণ্য বই আওয়ার বডিজ, আওয়ার সেলভস। প্রথম প্রকাশের পর থেকে আওয়ার বডিজ, আওয়ার সেলভস এখন ৩৫তম বার্ষিকী সংস্করণে দাঁড়িয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাষায়, বইটির পঁচিশটি অনূদিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ার বডিজ, আওয়ার সেলভস-এর মাত্র দুটি পরিচ্ছেদ বাংলায় প্রকাশিত হল - 'নিজের যত্ন' এবং 'যৌন স্বাস্থ্য'। বাঙালী মেয়েদের জীবনের তথ্য ও ছন্দ দিয়ে যতটা সম্ভব বইটিকে বাঙালী সংস্কৃতির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আমরা করেছি। আমাদের আশা, আমার স্বাস্থ্য, আমার সত্তা থেকে মেয়েরা নিজেদের যত্ন নিতে শিখবেন, নিজেদের শরীরকে চিনবেন, আর সহায়তা খুঁজতে হলে প্রশ্ন করতে ভয় পাবেন না।]
আমার স্বাস্থ্য, আমার সত্তা আমাদের সকলের বই, আমাদের জীবনের কথা।
নিজের যত্ন
সুস্থ শরীর, সুস্থ মন
ছোটবেলা থেকে চেহারা সম্পর্কে নানান আলোচনা ও মতামত মেয়েদের শুনতে হয়। কে কার থেকে বেশি সুন্দর, কার চেহারা অপূর্ব, কে দেখতে বিশ্রী, কে সাদামাটা - এই ধরণের আলোচনা চারদিকে সবসময় চলে। আমরা ধরে নিই নারী হয়ে জন্মানো মানে তার সৌন্দর্য নিয়ে বিচার চলবে, সে কোন মেয়ে চাক বা না চাক।
'কি মিষ্টি মেয়ে', 'লাল টুকটুকে ফ্রকটা ওকে কি সুন্দর মানিয়েছে' - ছোট মেয়ে দেখলে এমন মন্তব্য অনেকেই করেন। কিন্তু বাচ্চা ছেলেদের বেলায় শোনা যায়, 'বাঃ, বেশ লম্বা চওড়া শক্তপোক্ত ছেলে তো! দেখেছো','কি বুদ্ধি ধরে'!
ছোটবেলা থেকেই এগুলো শুনে আমাদের, মানে মেয়েদের মনে গেঁথে যায় যে আমরা কে বা কি তা নির্ভর করে আমাদের চেহারার ওপর। আমরা কি কাজ করি বা আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি কতটা সে সব কিছুই আসে যায় না। শুধু আমরা নিজেরা নই, মিডিয়া বা জনসংযোগের মাধ্যম, সমাজ, এমন কি আমাদের আপনজনেরাও এই ভাবেই চিন্তা করেন।
শিশু বয়স থেকে নিজেদের চেহারা সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে উঠি বলে শরীর নিয়ে কেউ কোন বাঁকা মন্তব্য করলে আমরা দুঃখ পাই। কেউ আমাদের কালো বা মোটা বললে আমরা নিজেদের দেহটাকেই ঘেন্না করতে শুরু করি। অনেক সময়ে চেহারার 'ত্রুটি' ঢাকতে আমরা ফর্সা হবার মলম খুঁজি, কিংবা না খেয়ে রোগা হবার চেষ্টা করি। অনেক সময়ে এ সব না পারলে, নিজেদের 'বিশ্রী' শরীরটাকে নানাভাবে কষ্ট দিই - মদ খেয়ে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করি, আজে বাজে খেয়ে অসুখ ঘটাই, অথবা পুরুষের মন পেতে লাগাম ছাড়া যৌনজীবন যাপন করি। নানান ভাবে আমরা দেহ ও মনের সর্বনাশ ডেকে আনি।
এই সমাজে এখন ধীরে ধীরে মেয়েদের শরীর যৌন উত্তেজনা বা 'সেক্স সিম্বল' হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। পত্রপত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখলেই তা বোঝা যায়। এ সবের মধ্যে বাস করে শরীর সম্পর্কে অত্যধিক সচেতনতা থেকে কি করে আমরা মুক্ত হতে পারি? সমাজের মাপকাঠিতে যদি আমরা সুন্দরী বলে গণ্য না হই? অর্থাৎ আমরা যদি ফর্সা, তন্বী, সুগঠিত বুক, লাবণ্যময়ী, বা আকর্ষণীয় নারী না হই, তাহলে কি নিজেদের দেহ নিয়ে সুখে জীবন কাটাতে পারব না? আমরা যদি কালো, বেঁটে বা প্রতিবন্ধী হই, তাহলে কি সমাজে আমাদের কোন স্থান নেই? আমরা মেয়েরা একে অন্যের থেকে ভিন্ন হলেও এক দিক থেকে আমরা সবাই সমান। আমাদের শরীর যথেষ্ট সুন্দর বা মনোমতো নয় এ ধারণা আমাদের সকলেরই অল্প বিস্তর থাকে।
সৌন্দর্য নিয়ে এই অসন্তোষ, এই প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে আশাকরি এই পুস্তিকাটি কিছুটা সাহায্য করতে পারবে।
সৌন্দর্য আর ব্যবসায়
একজন মেয়ের কথা
ছোটবেলা থেকে নাক নিয়ে আমার খুব দুঃখ ছিল। সবাই আমাকে বোঁচা, নাক নেই, ইত্যাদি ডাকত, ফলে আমার খানিকটা হীনমন্যতা জন্মে গিয়েছিল। ভাবতাম বড় হয়ে একটু সঙ্গতি হলেই আমি প্লাস্টিক সার্জেনের কাছে গিয়ে নাক সোজা আর উঁচু করিয়ে নেব। তারপর বড় হয়ে, পড়াশুনো করে, সে ইচ্ছেটা আমার একদম চলে গেল। মনে হত বেশ নাক, দিব্যি কাজ চলে যাচ্ছে! নাক নিয়ে আমার কোন দুশ্চিন্তা আর কোনদিন হয় নি। নিজেকে নিয়ে স্বচ্ছন্দ জীবন কাটিয়ে চলেছি।
নিজেদের চেহারার ওপর আমাদের কোনও হাত নেই। কিন্তু সেটা মেনে নিতে অনেকেরই খুব অসুবিধা হয়। ফলে যা স্বাভাবিক তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা প্রচুর সময় আর অর্থ ব্যয় করি। অনেকে কম খেয়ে ওজন কমায়, নানান ভাবে মোটা হতে চায়, বা দামী প্রসাধনী মেখে সৌন্দর্য বাড়াতে চেষ্টা করে।ধনী মেয়েরা অপারেশন বা প্লাস্টিক সার্জারি করে নিজেদের অঙ্গ সৌষ্ঠব আরও আকর্ষণীয় করতে চায়। কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয় মেয়েদের বিদ্যা শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্যে নয়, তাদের শারীরিক সৌন্দর্য বাড়াবার জন্যে।
লক্ষ্মীর কথা
আমার বয়স তিরিশের কাছাকাছি, বেশি দূর পড়তে পারি নি। আমার বোন, ভাই সকলের বিয়ে হয়ে গেছে কিন্তু আমার হয় নি। প্রায় দশ বছর ধরে আমার বিয়ের সম্বন্ধ হচ্ছে কিন্তু কেউ আমাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না, কারণ আমি খুব রোগা। তাছাড়া আমার রঙ কালো। আর যারা বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে তারা অনেক টাকা পণ চায়। এছাড়া সোনার গয়না, খাট আলমারি আসবাব, বাসন কোসন তো আছেই। আমরা গরীব ঘরের মানুষ তার ওপর বাবা রিটায়ার করেছেন, অত দেবেন কোত্থেকে? বারবার বিয়ে ভেঙে যায় বলে আমার মন খারাপ লাগে। মা-বাবাও খুবই রাগারাগি করেন, বলেন আমি কেন খেয়ে দেয়ে মোটাসোটা হচ্ছি না। গ্রামের লোকেরাও এত বয়স অবধি বিয়ে হয় নি বলে আজেবাজে কথা কানাকানি করে, আমাকে দোষারোপ করে। সম্ভব হলে আমি বিয়ে না করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।
আমাদের এই মানসিকতার সুযোগ নেয় পত্রপত্রিকা, প্রসাধন ব্যবসায়ী, ফ্যাশন ডিজাইনার, কিছু ডাক্তার, নানান ডায়েট বিশেষজ্ঞ, এবং খাদ্য প্রস্ততকারকেরা। এদেরই সমবেত প্রচেষ্টায় বিজ্ঞাপন মারফৎ এক সুসজ্জিতা অপরূপ সুন্দরী নারীর ভাবমূর্তি তুলে ধরা হয় আমাদের সামনে, যার কাছাকাছি পৌঁছনোর জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাই। আমাদের এই চেষ্টার দৌলতে প্রসাধন ব্যবসায় বহু কোটি টাকা লাভ করে। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয় বিজ্ঞাপনে - চুলের রঙ থেকে, পাউডার, ক্রিম, শ্যাম্পু, লিপস্টিক - কিসে নয়। এসবেও যদি শরীরের 'খুঁত' ঢাকা না পড়ে, তাহলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে অপারেশন বা কসমেটিক সার্জারি করে মুখশ্রী ও শরীর আরও সুন্দর করার ব্যবস্থা রয়েছে। বিদেশে কসমেটিক সার্জারির এখন রমরমা ব্যবসায়। আমাদের দেশে গরীব মেয়েদের কাছে হয়ত নয়, কিন্তু ধনী মহিলারা আজকাল এ সব করতে আরম্ভ করেছেন। প্রচুর খরচ করে অস্ত্রোপচার করিয়ে কেউ কেউ নিজের বুক সুন্দর করছেন। বিজ্ঞানের দৌলতে আজকাল সব কিছুই সম্ভব এই মনে করে আমরা যা স্বাভাবিক, প্রকৃতি আমাদের যা দিয়েছে, তা পাল্টে ফেলতে চাই। কিন্তু যা আমাদের সহজাত রূপ, যে ভাবে আমরা সৃষ্ট হয়েছি, কৃত্রিমতা দিয়ে ঢাকলে তাতে ফাঁক থেকে যায়। শরীর ও মন কিছুর পক্ষেই তা স্বাস্থ্যকর নয়।
কুহু দাস
চারদিকে এখন সৌন্দর্য্য প্রতিযোগিতার ছড়াছড়ি। বহুক্ষেত্রেই এসব আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ব্যবসায়িক
চিন্তার ভিত্তিতে চলে। কোন দেশের মেয়ে সেরা সুন্দরীর মুকুট পাবে তা নির্ভর করে সেখানে বড় বড় প্রসাধন সংস্থাগুলি ব্যবসায় জমাতে চায় কি না তার ওপর। কিন্তু এই প্রতিযোগিতাগুলি আমাদের দেশে যে ধরণের সৌন্দর্যের মাপকাঠি প্রতিষ্ঠা করছে তা প্রতিবন্ধী সমাজের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। সক্ষম শরীরী মহিলা ছাড়া এই প্রতিযোগিতায় অন্য কারোর স্থান নেই। ফলে প্রতিবন্ধীরা সকলেই কুৎসিতের দলে পড়ে যাচ্ছে।
সুন্দর পোষাক, ফ্যাশনেবল জুতো বা চটি আমাদের মত প্রতিবন্ধীদের জন্যে তৈরি করা হয় না। যেন আমাদের এ সব কিছুতে অধিকার নেই। আমার মত যাদের হাঁটা চলায় অসুবিধে, পায়ে ক্যালিপার পরতে হয়, তাদের জন্যে রয়েছে শুধু এক বিশাল কালো বুটজুতো। জিজ্ঞেস করে দেখুন, আমরা সকলেই সেই ভয়ঙ্কর কালো বুটজুতো প্রবল ভাবে ঘৃণা করি।
সৌন্দর্যের ব্যাপারে আরেকটা কথা আমাদের মনে রাখা উচিত। সুন্দর বা অসুন্দর সম্পর্কে যে আধুনিক ধারণাগুলো আমাদের মনে গেঁথে গেছে তার বেশির ভাগই এসেছে পাশ্চাত্যের শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের সৌন্দর্যবোধ থেকে। পত্রপত্রিকায় দেখা শ্বেতাঙ্গ মেয়ে-মডেলরা লম্বা আর রোগা হয় (টল এন্ড হ্যান্ডসম)। এর কিছু দিন আগে পর্যন্ত আমাদের দেশে মেয়েদের গোলগাল স্বাস্থ্যবতী হওয়াই ছিল সৌন্দর্যের লক্ষণ। এখন এই ধারণা পাশ্চাত্যের প্রভাবে পাল্টাতে আরম্ভ করেছে । শ্বেতাঙ্গ মেয়েরা শাদা বলে ফর্সা হওয়াটাও আমাদের দেশে সৌন্দর্যের মস্তবড় মাপকাঠি। 'পাত্রপাত্রী চাই' বিজ্ঞাপনে ফর্সা রঙের উল্লেখ বারবার চোখে পড়ে। মেয়ে কালো হলে আমরা বলি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, পাছে কালো লিখলে, পাত্রপক্ষ পালিয়ে যায়! কালো মেয়েদের ফর্সা করতে বহু ক্রিম এখন বাজারে পাওয়া যায়। এ সমস্ত ক্রিমে পারদ বা মার্কারি থাকে। সেগুলো কিছুদিন ব্যবহার করলে বিষক্রিয়ায় কিডনি (বৃক্ক) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, এমনকি মানসিক রোগও দেখা দিতে পারে। হয় এ ব্যাপারে বেশির ভাগ মেয়ে অজ্ঞ, নয় রঙ ফর্সা করার লোভে এই ঝুঁকি নিতে তারা দ্বিধাবোধ করে না।
ভারতের প্রসাধন ব্যবসায়
অস্ট্রেলিয়া সরকার প্রকাশিত একটি তথ্য
অনুযায়ী ২০০৬ সালে ভারতে প্রসাধন দ্রব্য বিক্রির পরিমাণ ছিল
প্রায় ৩.৪ বিলিয়ন ইউরো (অর্থাৎ প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।
২০০৫ সালে যে পরিমাণ প্রসাধন বিক্রি হয়েছিল তার থেকে এই সংখ্যা
২৫ শতাংশ বেশি। তবে অ্যাসোসিয়েটেড চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি
অফ ইন্ডিয়ার-র (ASSOCHAM)
হিসেব অনুসারে ভারতের প্রসাধন-ব্যবসায় অতটা বড় নয়। তারা বলে
এটি এখনও ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। কনফেডারেশন অফ
ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ (CII)-এরও
তাই মত। বিউটি সার্ভিস-কে যদি এই ব্যবসায়ের মধ্যে ধরা হয়,
তাহলে CII
-এর মতে এটি প্রায় ২.৭ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায়। তবে এই ব্যবসায়
যে বছরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে সে বিষয়ে প্রায়
সবাই একমত ।
ভারতের প্রসাধন-ব্যবসায় ঠিক কতটা বড় তা সঠিক ভাবে হিসেব করা একটু কঠিন কারণ
অসংখ্য ছোট ছোট সংস্থা এই ব্যবসায়ে যুক্ত এবং এদের আয়-ব্যয়ের
সঠিক মূল্যায়ন করা দুষ্কর। নামীদামী কোম্পানীর জিনিস যেরকম বিক্রি
হয়, তেমনি ছোটখাটো কোম্পানি, ঘরে তৈরি আয়ুর্বেদিক, বা ভেষজ প্রসাধন
দ্রব্যের চলও প্রচুর। ASSOCHAM
-এর হিসেবে ভেষজ প্রসাধনদ্রব্যের প্রস্তুতকারী কোম্পানীর সংখ্যা
প্রায় তিন হাজারের কাছাকাছি। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে রেজিস্টার্ড
নয় এমন সংস্থাগুলিকে। আর্থিক সচ্ছলতার সঙ্গে সঙ্গে এবং টেলিভিশন
ও পত্রপত্রিকার বিজ্ঞাপনের দৌলতে আমাদের দেশেও কৃত্রিম প্রসাধন
দ্রব্যের ব্যবসায় ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছে।
প্রসাধন ব্যবসায়ের এই অস্বাভাবিক প্রসারের মূলে আছে ইদানীংকালে ভারতের অর্থনৈতিক সাফল্য এবং যে বয়সী নারীরা সাধারণত প্রসাধন ব্যবহার করে তাদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা। ভারতের ৭০ শতাংশ মানুষের বয়স ৩৫ বছরের কম এবং ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা প্রতি বছর ৩০ লক্ষ করে বাড়ছে। তুলনামূলক ভাবে সচ্ছল সম্ভাব্য ক্রেতার ক্রমবর্ধমান সংখ্যার কথা বিবেচনা করে প্রসাধন ব্যবসায়ের বড় বড় বিদেশী কোম্পানিগুলি এখন ভারতের প্রতি মনোযোগী হয়ে উঠেছে। এই কোম্পানিগুলির প্রচার ও বিজ্ঞাপন প্রচেষ্টার ফলে আধুনিক ভারতের নারীরা এখন ফ্যাশন সচেতন হয়েছে এবং তথাকথিত সুন্দরী হবার দিকে বিশেষভাবে ঝুঁকেছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে রঙ ফর্সা করার প্রবণতার জন্যে ত্বক সাদা করার ক্রিম এখন বিশেষ ভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এছাড়া বয়স্ক মহিলারাও নিজেদের কমবয়সী দেখানোর জন্যে নানান প্রসাধন ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছেন।
আমরা শুধু মুখেই বলি বাইরের সৌন্দর্য আসল সৌন্দর্য নয়, মনটাই বড় কথা। কিন্তু এও সত্য যে সৌন্দর্যের একটা আকর্ষণ আছে। সুন্দরী মেয়েদের প্রতি অনেক পুরুষ আকৃষ্ট হয়। এমন কি স্কুলে শিক্ষকেরা সুন্দর ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার প্রতি বেশি মনোযোগ দেন। সমীক্ষায় দেখা গেছে বিচারকেরাও সুন্দর চেহারার দোষীদের শাস্তি কম ধার্য করেন, তাদের সততার প্রতি বেশি বিশ্বাস রাখেন। এ সব থেকে আমাদের মনে হতেই পারে যে যদি সত্যিই নিজেকে সুন্দর করে তোলা যায়, তাহলে জীবন সুখের হবে। সেইখানেই হয় সমস্যা। সৌন্দর্যের সঙ্গে সুখের কোন সোজাসুজি সম্পর্ক নেই। কে সুখী আর কে অসুখী হবে তা নির্ভর করে জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব, নিজের প্রতি আস্থা, এবং অন্যের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহৃদয় আচরণ করা সুখী হবার পক্ষে অত্যন্ত জরুরী। যাঁরা সুন্দরী হওয়ার জন্যে প্রাণপাত করছেন তাঁরা অনেক সময়েই নিজেদের মানসিক সমস্যার শিকার হচ্ছেন। এখানে বিদেশের একটা গবেষণার কথা না বলে পারছি না। ফিনল্যান্ডে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে মহিলারা বুক সুন্দর করার জন্যে অস্ত্রোপচারের সাহায্যে সিলিকন ভরা থলি বসিয়ে (ইমপ্ল্যান্ট) স্তন বৃদ্ধি করেছেন, তাঁদের মধ্যে আত্মহত্যা করার প্রবণতা অন্যান্য মেয়েদের থেকে তিন গুণ বেশি।
সে কি আমায় ভালবাসবে?
অনেক মেয়েদের ক্ষেত্রেই সুন্দর হবার চেষ্টার পেছনে রয়েছে পুরুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ইচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই আমাদের শেখানো হয় যে পুরুষের বা স্বামীর মন জয় করতে অন্যান্য মেয়েদের থেকে ভালো হওয়া চাই; অর্থাৎ তাদের সঙ্গে আমাদের প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। পুরুষদের আকৃষ্ট করে অন্য মেয়েদের মনে হিংসা জাগিয়ে তোলার মধ্যে অনেকে বেশ একটা তৃপ্তি পান। অনেক নারীবাদীরা বিশ্বাস করেন এমন দৃষ্টিভঙ্গি হল পুরুষ শাসিত সমাজে বাস করার ফল। পুরুষের হাতে সমাজ চালানোর ক্ষমতা থাকে বলে মেয়েদের সামাজিক স্থান নির্ভর করে কোন পুরুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক রয়েছে তার ওপর। কথায় আছে দারোগার বৌয়ের বোলচাল বেশি। নিজের শক্তি দিয়ে নয়, বাবা, স্বামী, বা ছেলের মানের ওপর মেয়েদের সামাজিক পদ নির্ধারিত হয়। ফলে পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যে বা স্বামীকে নিজের আঁচলে বেঁধে রাখার জন্যে মেয়েদের প্রাণপাত করতে হয়।
আমরা ধরে নিই সামাজিক নিয়ম অনুসারে পুরুষেরাই সক্রিয় হবে আর মেয়েরা হবে নির্ভরশীল, নিষ্ক্রিয়, লাজুক, ও সুন্দর। ব্যাপারটা এত স্বাভাবিক বলে মনে করা হয় যে এ নিয়ে কেউ বিশেষ প্রশ্ন তোলেন না। ব্লু ফিল্ম, পর্নোগ্রাফি, অশ্লীল পত্রপত্রিকা, বা ডিভিডি ইত্যাদি তৈরি করা হয় পুরুষের মনোরঞ্জনের জন্যে। যে সব ছবিতে লেখা থাকে 'প্রাপ্তবয়স্কদের বিনোদনের জন্যে' তা শুধু পুরুষের বিনোদনের জন্যেই তৈরি করা হয়। দেখা যায় সেখানে সুন্দরী অল্পবয়সী মেয়েরা পুরুষের কামনা বাসনা পূর্ণ করছে, পুরুষের কাছে সম্পূর্ণভাবে নিজেদের দেহ নিবেদন করছে। আজকের ইন্টারনেটের যুগে চব্বিশ ঘণ্টাই কম্প্যুটারে এইসব অশ্লীল ছবি সকলে দেখতে পায়। এইসব দেখে বহু কমবয়সী ছেলেমেয়েরা নিজের চেহারা কেমন হওয়া উচিত আর নারী পুরুষ উভয়ের প্রতি উভয়ের ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত তা শিখছে।
এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে এতদিন
সকলের ধারণা ছিল অশ্লীল ছবি, সিনেমা ছেলেরা বেশি দেখে কারণ এতে
তারা বেশি উত্তেজিত হয়। ইদানীংকালের গবেষণায় দেখা গেছে এ ব্যাপারে
পুরুষ এবং নারীর মধ্যে খুব একটা তফাৎ নেই। তবে ছোটবেলা থেকে মেয়েদের
শেখানো হয় যে এ ধরণের ছবি ইত্যাদি দেখা তাদের পক্ষে অন্যায়,
এতে মেয়েদের নৈতিক অধঃপতন ঘটে। তাই তারা এ বিষয়ে উত্সাহ দেখান
না।
আমরা সবাই নিজেদের আকর্ষণীয় করে তুলতে চাই। এতে দোষের কিছু নেই। তবে এর জন্যে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করা কিংবা সিনেমা আর সংবাদ মাধ্যমে দেখানো মেয়েদের নকল করা কখনই স্বাস্থ্যকর নয়। নিজেদের স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেললে আর আমাদের রইল কি!
প্রচার মাধ্যমে মিথ্যে প্রচার
দৈনন্দিন জীবনে আমরা যা দেখি বা শুনি তার ওপর ভিত্তি করে আমাদের বাস্তব ধারণা গড়ে ওঠে। সত্যি কথা বলতে কি, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছবি এবং টিভি ছাড়া আর কোথায় আমরা এত কম জামা কাপড় পরা বা এমন অদ্ভুত সাজগোজ করা নারী পুরুষ দেখি! বাস্তব জীবনে ক'জন আর অমন সেজে ঘুরে বেড়ায়! কিন্তু যদি ছেলে বা মেয়েরা সব সময় ফ্যাশন পত্রিকা দেখে বা সিনেমা-টিভির অদ্ভুত সাজ দেখে, তাহলে তাদের মনে ঐ ধরণের সৌন্দর্যের ছবিই গেঁথে যায়। মনে রাখতে হবে যে সিনেমা বা পত্রিকায় দেখা সুন্দরীদের ছবি আদৌ স্বাভাবিক নয়। এইসব ছবির অনেকগুলিই ফটোগ্রাফার অদলবদল করে দেয়। ছবিতে দেখা অনেক নারীর সুগঠিত শরীর বা সুন্দর বুকের পেছনে থাকে কসমেটিক সার্জারি। অর্থাৎ এই ছবিগুলো দেখে মেয়েদের শরীর সম্পর্কে ধারণা করলে তা ভুল হবে। ফলে বাস্তবে মেয়েদের যৌনকেশ বা স্তন দেখলে মনে হবে সেই দেহ খুঁতে ভরা, বিশ্রী।
আমাদের দেশে নারী উন্নয়ন নিয়ে যখন ভাবা হয়, তখন সমাজের নানান প্রান্তিক গোষ্ঠীর কথা মাথায় রাখলেও প্রতিবন্ধী মেয়েদের কথা প্রায় কেউই চিন্তা করেন না। এমনকি বেসরকারি নারী সংস্থাগুলিও নিজেদের কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী মেয়েদের উপেক্ষা করে চলে। নির্যাতিত মেয়েদের জন্যে যে সমস্ত আবাসন তৈরি করা হয়েছে, সেখানে সাধারণত প্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্যে কোন সুযোগ সুবিধা থাকে না। ২০০৫ সালে ভারত সরকার যে পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধ আইনটি পাশ করেছে তাতে প্রতিবন্ধী নারীর বিশেষ প্রয়োজনের কোন উল্লেখ নেই। অথচ তাঁরা সংখ্যায় কিছু কম নন!
বেশির ভাগ সময়ে ছবি, সিনেমা,
বা ভিডিওতে যেসব মেয়েদের আমরা দেখি তারা নিখুঁত নিটোল সুন্দরী
সুস্থ যুবতী। প্রতিবন্ধী নারীদের আমরা দেখার সুযোগই পাই না। ফলে
প্রতিবন্ধী মেয়েদের শরীর ও জীবন আমাদের কাছে রহস্য হয়েই থেকে
যায়। যে দু-একজন প্রতিবন্ধী নারীকে সংবাদ মাধ্যম আমাদের সামনে
তুলে ধরে, তাদের দেখানো হয় অসহায় ও করুণার পাত্রী হিসেবে। তারা
যেন আমাদের দয়ার অপেক্ষায় বসে আছে। অথবা দেখানো হয় তারা বীরাঙ্গনা,
আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। প্রতিবন্ধী মেয়েদের স্বাভাবিক সৌন্দর্য
আমরা বেশির ভাগ সময়েই প্রচার মাধ্যমে দেখতে পাই না।
আসলে প্রচার মাধ্যম বা মিডিয়া মেয়েদের পুরুষের ভোগ্যবস্তু হিসেবে দেখায়। ধরা যাক ক্যামেরার লেন্স হল পুরুষের চোখ। সেই চোখ যে ভাবে মেয়েদের দেখবে সে ভাবেই ছবি তোলা হয়। তাই টিভি বা সিনেমায় মেয়েদের দেখানো হয় লাজুক, অসহায়, পুরুষের উপর নির্ভরশীল, এবং কাম্য বস্তু হিসেবে। আমরা মেয়েদের সেই ভূমিকা আর ভাবমূর্তি মনের মধ্যে গেঁথে নিই। নিজেদের অজান্তে নিজেকে যৌন বস্তু বলে মনে করা শুরু করি। কোন পুরুষের সঙ্গে বাস করলে তার মন পেতে উঠে পড়ে লাগি। কেবলই মনে করি আমার পুরুষ সঙ্গীর আমাকে ভাল লাগছে তো? বিশেষত অল্প বয়সী মেয়েরা হাঁটতে চলতে সব সময়েই মনে করে আমায় কেমন দেখতে লাগছে? অর্থাৎ নিজের সত্তা ভুলে তারা নিজেদের শুধু উপভোগ্য বস্তু হিসেবে ভাবতে আরম্ভ করে।
আমি কি খুব মোটা?
আমাদের দেশে কে রোগা কে মোটা এ সব নিয়ে এত মাতামাতি আগে হত না। কবি ও লেখকদের চোখে তখন সুন্দরীর রূপ ছিল কেশবতী, বুক পাছা ভারী, অর্থাৎ স্থূলকায় নারী যে আস্তে ধীরে চলে আর নিজের স্তনের ভারে ঝুঁকে পড়েছে। আগেকার দিনে সুন্দরীরা কখনই রোগা হত না। আজকাল পশ্চিমী প্রচার মাধ্যমের দয়ায় মোটা হওয়া নিয়ে আমাদের মধ্যে দুর্ভাবনা ঢুকেছে। পত্রপত্রিকায় যে সব ফ্যাশন মডেলদের আমরা দেখি তারা সবাই রোগা। সিনেমা টিভির নায়িকারাও আজকাল খুব রোগা। তাই রোগা হওয়াটাই ধীরে ধীরে সমাজে আদর্শ হয়ে উঠছে। এককালে পাশ্চাত্যেও মেয়েদের মোটা হওয়াটা মন্দ ভাবা হত না। কিন্তু নারী-পুরুষের সমানাধিকারের আন্দোলনের সময়ে পুরুষের সমকক্ষ হতে চেষ্টা করে মেয়েরা শরীর থেকে নারীর স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, নিতম্ব আর স্তন চাপা দিতে আরম্ভ করে। তারপর এই নতুন রূপই পুরুষের চোখে আকর্ষণীয় হয়ে দাঁড়াল আর পাশ্চাত্যে মেয়েরা রোগা হতে সচেষ্ট হয়ে উঠল। সিনেমা আর প্রচার মাধ্যমের দৌলতে সৌন্দর্যের এই মাপকাঠি ধীরে ধীরে আমাদের দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। বিত্তবান বাড়ীর মেয়েরা অনেক সময়ে কম খেয়ে ডায়েট করে নিজেদের রোগা রাখার চেষ্টা করে। 'হ্যাঁরে, বড্ড মোটা হয়ে গেছি নাকি রে?' বন্ধুদের এই প্রশ্ন আমরা অনেক সময়েই করে থাকি। 'কিছুতেই ওজন কমাতে পারছি না। মুটকি হয়ে যাচ্ছি' - এই আফসোস মেয়েদের মুখে অনেক সময়েই শোনা যায়। রোগা হওয়াটা সমাজে সৌন্দর্য হিসেবে ধরলে মোটা মেয়েদের সুন্দরীর তালিকা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে, যেন সৌন্দর্য শুধু এক সাইজেই ধরা পড়ে - রোগা এবং পাতলা।
জীবনের স্বাভাবিক ছন্দেই বার্ধক্য আসে
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরের পরিবর্তন হয়। পড়তে চশমা লাগে, মুখের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে, চুল পাকে, সন্তানধারণের ক্ষমতা আর থাকে না। আমাদের মধ্যে অনেকেই এই বুড়ো হওয়া নিয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। বয়স্ক না লাগার জন্যে আমরা অনেকেই ভীষণ লড়াই করি। চুলে কলপ লাগাই, ত্বকের ভাঁজ কমানোর জন্যে ক্রিম লাগাই, লোকের কাছে বয়স লুকোই। বয়স ব্যাপারটা কোন খারাপ অসুখ না, কিন্তু তা নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেকের চিন্তার শেষ নেই। অর্থবানেরা অনেক সময় যৌবন বেঁধে রাখতে নানান রকমের ওষুধ, বড়ি, আর টোটকা খায়, মুখের চামড়া টান রাখতে নানান রকমের মলম আর ফেসক্রিম মাখে। বার্ধক্য রোধ করা অসম্ভব জেনেও আমরা তা সহজ ভাবে গ্রহণ করতে পারি না।
বার্ধক্যের প্রতি ভয় আধুনিক যুগে বেড়ে গেছে। মনে রাখতে হবে প্রত্যেক বয়সেরই একটা সৌন্দর্য আছে। বয়স মানুষকে অভিজ্ঞতা দেয়, পৃথিবীকে অন্য আলোকে দেখতে সাহায্য করে। বয়স না লুকিয়ে আমরা তা নিয়ে গর্ব করতে পারি। নিজের উদাহরণ দিয়ে ছোটদের বোঝাতে পারি যে বয়সটা বড় কথা নয়, জীবনে কি করতে পেরেছি সেটাই বড়। বয়স নিয়ে নিজের প্রতি আমাদের সন্তুষ্টি আনতে হবে।
নিজের শরীরের প্রতি যত্নশীল হওয়া
মানবজন্মে একবারই আমরা শরীর পাব। আমাদের প্রত্যেকের একটিই শরীর। নিজের হাত, পা, পেট সব কিছুর দিকে ভাল করে তাকান। চোখ বুজুন। মন দিয়ে অনুভব করুন আপনার শ্বাস প্রশ্বাস। এই শরীর নিয়েই আপনি জন্মেছেন, এই শরীর নিয়েই আপনার মৃত্যু হবে।
চারিদিকে তাকিয়ে রক্তমাংসের যেসব মেয়েরা আপনার চারপাশে রয়েছে তাদের দেখুন। মহিলাদের শরীরের বৈচিত্র্য দেখুন। কোন মেয়ে লম্বা, কেউ বেঁটে, কারোর ঢেউয়ের মত শরীর, কারোর শরীরে উঁচুনিচু প্রায় নেই বললেই চলে, কারোর চোখের রঙ বাদামী, কারোর কালো, গায়ের রঙ ফর্সা, বাদামী বা শ্যামবর্ণ, কারোর চুল কোঁকড়া, কারোর সোজা, কটা বা কালো। মেয়েদের মধ্যে অসীম বৈচিত্র্য রয়েছে।
অল্পবয়সী কন্যাকে বাবা-মা কী ভাবে সাহায্য করতে পারেন:
বয়ঃসন্ধিকালে নিজের শরীর সম্পর্কে সব মেয়েদেরই দুশ্চিন্তা হয়। আমি সুন্দর তো! এই সময়ে শরীর সম্পর্কে একটা সুস্থ মনোভাব গড়ে তুলতে বাবা-মায়েরা সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারেন। প্রথমত মায়েদের নিজেদের মনোভাব এবং ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আমাদের সমাজে এখনও মেয়েরা মায়ের কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি শেখে। মায়েরা নিজেরা যদি রোগা থাকা এবং নিজেদের শরীর নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকেন তবে মেয়েরাও তাই শিখবে।
আপনার মেয়ে যদি টিভি, সিনেমার নায়িকা বা প্রচার মাধ্যমের মডেলের চেহারা দেখে নিজেকে সে রকম করে গড়ে তুলতে চায়, তাকে বকুনি দিয়ে লাভ নেই। এতে সে শুধু আপনার কাছ থেকে ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখবে। এ সব ছবি মেয়েকে দেখিয়ে বোঝান যে ক্যামেরার ছবিগুলো পুরুষদের মন রাখার জন্যে তোলা হয়েছে। রক্তমাংসের কোন মানুষই পত্রিকার মডেল বা সিনেমার নায়িকার ছবির মত দেখতে নয়। এমনকি সেই মডেল বা নায়িকাও নয়। অনেক রূপসজ্জা আর ক্যামেরার কারসাজির পরে ছবিগুলো তোলা হয়েছে।
মেয়েকে বোঝান সত্যিকারের শক্তি আসে জীবন গড়ে তুলতে পারলে, কে কেমন দেখতে তা থেকে নয়। মেয়েকে পড়াশোনা শেখান, তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করুন। শুধু ওজন আর রূপের বদলে মেয়েকে নিজের স্বাস্থ্যের উপর নজর দিতে শেখান। খেলাধুলায় উত্সাহিত করুন। মেয়ের সঙ্গে বসে স্বাস্থ্যকর কি খাবার রান্না করা যায় সেই নিয়ে আলোচনা করুন এবং একসঙ্গে রান্না করুন।
খেয়াল করুন, সমাজ ও প্রচার মাধ্যমের তৈরি সৌন্দর্যের মাপকাঠি শুধু গুটিকতক মেয়েই ছুঁতে পারে। ঐ মাপকাঠির থেকে আমরা সকলেই ভিন্ন। আমরা প্রতিবন্ধী হই বা না হই, অল্প বয়সী হই বা বৃদ্ধা হই, মোটা বা রোগা হই, আমরা বিভিন্ন ধরণের। নিজের শরীরকে গ্রহণ করা এবং তাকে ভালবাসতে শেখা মেয়েদের পক্ষে এক দীর্ঘ সংগ্রাম। নিজের সৌন্দর্যকে অনুভব করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। কিন্তু সেটা না করতে পারলে আমরা নিজেরই ক্ষতি করব।
তবে শুধু নিজেকে ভালোবাসা নয়, এ পৃথিবীতে পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের কিছু কাজও করতে হবে। সমাজের প্রতিটি নারীকে আমরা যেন নিজ নিজ রূপে গ্রহণ করতে পারি সে চেষ্টা করতে হবে। আমরা প্রত্যেকে সমাজের অংশ। আমাদের ব্যক্তিগত ব্যবহার অন্যদের প্রভাবিত করে। তাই মনে রাখতে হবে আমরা যদি চুলে রঙ করি বা মোটাদের বিশ্রী বলি, তাহলে আরও অনেকে এ ব্যাপারে প্রভাবিত হচ্ছে। লক্ষ্য রাখতে হবে আমরা যাতে একটা নতুন ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারি যেখানে প্রত্যেকটি মেয়ে তার প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা পায়। সে সম্মান আসবে তার রূপের জন্যে নয় তার কাজের জন্যে। শুধু মেয়ে হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে আমাদের নিজেকে সম্মান দিতে শিখতে হবে।
(পরের অংশ)
২০০৯ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের অনুদানে শমীতা দাশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় 'মানবী' ও 'সংলাপ'-এর যৌথ উদ্যোগে 'আমার স্বাস্থ্য, আমার সত্তা' বইটি প্রকাশিত হয়। অনুবাদে সহযোগিতা করেন সুজন দাশগুপ্ত ও অলোক গোস্বামী, আলোকচিত্রে সুবীণ দাশ ও চিত্রাঙ্কনে সাগরিকা দত্ত । ১৫০০ কপি ছাপা হয়েছিল বিভিন্ন এনজিও-র মাধ্যমে বিনামূল্যে বিতরণের জন্যে, এখন এটি দুষ্প্রাপ্য। বইটিতে অবসর-এ পূর্ব-প্রকাশিত কিছু কিছু লেখাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বইটি প্রকাশ করার অনুমতি আমরা পেয়েছি। এর আগে মেয়েদের যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ক অলোচনার একাংশ প্রকাশিত হয়েছিল। এই সংখ্যা থেকে পুরো বইটিই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হবে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।