প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

নারী

এপ্রিল ১৫, ২০১৫

 

আমার স্বাস্থ্য, আমার সত্তা

নিজের যত্ন (৫)

(আগের অংশ) নারী-নির্যাতন

নারী-নির্যাতন শুধু ভারতবর্ষের সমস্যা নয়, সারা বিশ্বের সমস্যা। বেশির ভাগ সময়েই মেয়েদের নির্যাতন করে তাদেরই ঘরের লোক, আত্মীয় স্বজন। ফলে নিজের বাড়িতেও অনেক মহিলাকে ভয়ে ভয়ে বাস করতে হয়। এই ধরণের নির্যাতনের মধ্যে শুধু শারীরিক মারধোরই নয়, যৌন-নির্যাতন,  হুমকি ও ভীতি প্রদর্শন, বা মানসিক ভাবে কষ্ট দেওয়াও পড়ে। মহিলাদের ওপর এ ধরণের অত্যাচার অনেক সময়ই ভয়াবহ রূপ নেয়।
আগে মহিলাদের নির্যাতন সম্পর্কে সমাজে সচেতনতা ছিল না বললেই চলে। আজকাল খবরের কাগজে প্রায় প্রতিদিনই বধূহত্যার খবর প্রকাশিত হয়। মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে মহিলারা আত্মহত্যা করছেন, সে খবরও আমরা পাই।

অনেক সময় আর্থিক কারণে মহিলাদের ওপর অত্যাচার করা হয়। বৃদ্ধা মহিলাকে মেরে ধরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া,  না খেতে দেওয়া বা অন্যভাবে অত্যাচার করার খবর আমরা টিভি এবং পত্রিকায় দেখি। গ্রামে মহিলাদের ডাইনী আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর অত্যাচার করা এখনও চলছে। বাড়িতে যেসব অল্পবয়সী মেয়েরা কাজ করে,  তাদের কারণে অকারণে লাঞ্চনা বা মারধোর আকছারই করা হচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্ক হলেও নারীকে নিজের পছন্দমত জীবন সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার থেকে সমাজ এখনও বঞ্চিত করে চলেছে। সমকামিতার কারণে বাড়িতে,  কর্মক্ষেত্রে,  এবং সমাজে মহিলাদের ওপর নির্যাতন এখনও চলে। সমকামী মহিলাদের ওপর সমাজের বিভিন্ন স্তরে চলে বৈষম্যমূলক ব্যবহার ও অত্যাচার ।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন) যৌন নির্যাতন, পারিবারিক নির্যাতন, এবং শিশু ও নারী নির্যাতনকে ব্যাপক সামাজিক সমস্যা বলে ঘোষণা করেছে। এই সংস্থা মেয়েদের প্রতি সব রকম হিংসাত্মক আচরণ বন্ধ করার জন্যে প্রতি দেশকে আহবান জানিয়েছে। তবে প্রধানত পুরুষেরা মেয়েদের ওপর নির্যাতন করলেও,  কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্য মহিলারাও এ রকম অত্যাচারে অংশ নেন।

মেয়েদের ওপর নানান ধরণের নির্যাতন বহুকাল ধরে সমাজে চলে আসছে,  তাই অনেকে এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তাঁরা ধরে নেন সংসারে এইই স্বাভাবিক। বহু নির্যাতিতা নারীও বিশ্বাস করেন যে নিজের দোষেই তিনি মার খাচ্ছেন বা তাঁর কপালে সুখ লেখা নেই। পরিবারের মধ্যে নির্যাতনে বাধা দেওয়া বা এর প্রতিবাদ করার কোন অধিকার তাঁর নেই। আর যাঁরা নির্যাতন করেন, তাঁদেরও বিশ্বাস যে ধর্ষণ,  মারধোর,  আর যৌন-নির্যাতন করা,  কিংবা শিশুদের গায়ে হাত তোলার অধিকার সমাজ পুরুষকে দিয়েছে। হয়তো আইনের বইপত্রে এ সব লেখা নেই, কিন্তু দরকার মত মহিলাদের, বিশেষত স্ত্রীকে মারধোর করে শাসন করা কোন অপরাধ হতে পারে না।

মিনার কথা
বাড়ি থেকে সম্বন্ধ করে আমার বিয়ে দিয়েছিল ১৯ বছর বয়সে। লোকটি আমার চেয়ে প্রায় কুড়ি বছরের বড় ছিল। তার নিজের অনেক সমস্যা ছিল - মানসিক সমস্যাও। দেড় বছর আমাদের বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু কোনদিন যৌন সম্পর্ক হয় নি। সে আমাকে যখন তখন মারত,  অত্যাচার করত। দেড় বছর পরে আমি আর পারলাম না,  ছেড়ে চলে এলাম। আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেল। তার অল্প দিন পরেই বাড়ি থেকে আমাকে আবার বিয়ে দেয়। এই স্বামীর আগে বিয়ে হয়েছিল এবং দুটি সন্তান আছে। বিয়ের ছ'দিনের মাথায় সে বলল যে তার আর আমাকে ভালো লাগছে না। কেন এমন হল জানতে চাওয়াতে বলল,  সে নাকি ভুল করে আমাকে ফর্সা ভেবেছিল - আসলে আমি কালো। তাছাড়া আমি নাকি প্রকৃত নারী নই, আমার কোন স্ত্রী লিঙ্গ নেই। এই অপবাদ চরমে উঠল যখন সে দু দুবার সকলের সামনে জোর করে আমাকে উলঙ্গ করে দাঁড় করাল এই প্রমাণ করতে যে আমার স্তন নেই! সকলের সামনে আমাকে বলল ১ কেজি করে দুটি স্তন না হলে সে আমাকে নেবে না। এরপর আমার ওপর প্রচণ্ড অত্যাচার আরম্ভ হল। আমাকে একটা ঘরে বন্ধ করে রেখে দু দিন পানি পর্যন্ত দেয় নি। তারপর আমার চাচা এসে ব্যাপারটা পঞ্চায়তে নেবার ভয় দেখাতে আমাকে পানি আর খাবার দেয়। আমার আব্বা আম্মা আর আমাকে সেখানে রাখতে রাজি হয় নি,  বাড়ি নিয়ে আসেন। সে বলেছে আমি যদি আর তার কাছে যাই, তাহলে আমাকে পুড়িয়ে মারবে। আমার নিজের কানে শোনা, সে তার আম্মাকে বলছে যে আমার সঙ্গে শোবার আগে সে তার মেয়ের সঙ্গে শোবে। আমার বিয়ের শখ মিটে গেছে। কিন্তু আমরা ছ'বোন - ভাই নেই। আমার বিয়ে ভেঙে গেলে আমার বোনেদের বিয়ে হবে না। একটা যদি চাকরী পেতাম,  নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাড়ির ভার কিছুটা হালকা করতে পারতাম।

মানুষ যা দেখে তাই শেখে। শিশু যদি বাড়িতে মা-বাবা বা বড়দের মধ্যে নারীর প্রতি অবহেলা বা অত্যাচার দেখে তাহলে সে তাই শিখবে। যদি টিভি বা ছায়াছবিতে দেখি পুরুষের হাতে মেয়েরা যখন তখন চড়-থাপ্পড় খাচ্ছে,  তাদের চুল টেনে শাসন করা হচ্ছে, বা তারা অন্যভাবে নির্যাতিত হচ্ছে,  তাহলে আমরাও এ ধরণের ব্যবহার স্বাভাবিক বলে ভাবতে শিখি। মনে করি আমাদের সমাজের এইই নিয়ম,  এতে কোন দোষ নেই।

নারী নির্যাতন নিয়ে একটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে যে নারী নির্যাতন শুধু মহিলাদের শারীরিক ভাবে আঘাত করাই নয়,  তার ব্যক্তিসত্তাকে ক্ষুণ্ণ  করা ও ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা। গোটা সমাজ ব্যবস্থা নারী নির্যাতন মেনে নেয় বলে পুরুষেরা এমন ব্যবহার করে পার পেয়ে যায়। নারী নির্যাতনের মধ্যে মারধোর,  বিভিন্ন রকমের অত্যাচার,  ধর্ষণ,  যৌন নির্যাতন,  গালিগালাজ,  পর্দা-প্রথা,  মানসিক অত্যাচার,  হত্যা সবই পড়ে। তথাকথিত 'অনার কিলিং',  অর্থাৎ পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে নিকট আত্মীয়েরা যখন কোন মেয়েকে খুন করে তাও এই নির্যাতনের অন্তর্গত।  অনার কিলিং ঘটে যখন কোন পরিবারের সদস্যেরা মনে করে যে তাদের কোন আত্মীয়ার ব্যবহারে পরিবারের সম্মান ক্ষুণ্ণ  হয়েছে এবং সেই হারানো সম্মান খুঁজে পেতে তারা 'দোষী'  মেয়ে বা মহিলাকে খুন করে। পুরুষেরা ঘাতক হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিবারের মহিলারাও খুনের চক্রান্তের শরিক হন। এছাড়া অন্যান্য নির্যাতন, যেমন জোর করে গর্ভপাত বা বন্ধ্যা করানো,  কন্যা ভ্রুণহত্যা,  নারী ও শিশু পাচার, চাপ দিয়ে বেশ্যাবৃত্তিতে নিয়োগ, যৌন অত্যাচার দেখানো হচ্ছে বা যৌন অত্যাচারে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে এমন পর্ণোগ্রাফি, কাজে যৌন হেনস্থা,  যৌনাঙ্গে আঘাত করা,  যৌন-চিহ্ন  বিকৃত করা - সব কিছুই নারী নির্যাতনের বিভিন্ন রূপ।

যে কোনও হিংসাত্মক কাজই ভয়াবহ এবং তা আমাদের সুস্থ জীবন যাপনে বাধা সৃষ্টি করে। যৌন নির্যাতন বিশেষ ভাবে বেদনাদায়ক কারণ যৌনাচরণ শুধু সন্তানসৃষ্টির জন্যে নয়,  প্রিয়জনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ ভাবে মিলিত হয়ে ভালবাসার এক প্রকাশ। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে যৌনতা এবং হিংসা এক সঙ্গে সমাজে যুক্ত হয়ে গেছে। হিংসাত্মক যৌনাচরণ বা যৌন-নির্যাতন এখন অনেক পুরুষের কামোদ্রেক করে। আত্মসুখের জন্যে পুরুষেরা নারীদের কষ্ট দিতে এতটুকু অসুবিধা বোধ করে না।

আমাদের সমাজে শিশু ও মহিলাদের ওপর অত্যাচার বহু দিন ধরেই চলে আসছে। আগে এ সব লুকোনো থাকত চার দেয়ালের মধ্যে,বাড়ীর বাইরে এ নিয়ে আলোচনা হত না। ইদানীং এ ব্যাপারে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়ছে। নারী নির্যাতন যে একটা ব্যাপক সামাজিক সমস্যা তা বিভিন্ন দেশের প্রশাসনও মেনে নিয়েছে। ফলে সমস্যাটি মোকাবিলার জন্য বিধায়কেরা বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেছেন। নির্যাতিতা মেয়েদের সহায়তার জন্য বহু সমাজ কল্যাণমূলক সংস্থা বা এন.জি.ও স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু সমস্যাটি এত ব্যাপক এবং গভীর যে এটি দূর করা সহজ নয়। এর জন্যে সবাইকেই সচেতন ভাবে দীর্ঘ সংগ্রাম করতে হবে।

নারী নির্যাতনের স্বরূপ

(সূত্র: ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ চক্রটি তৈরি করেছে ডোমেস্টিক অ্যাবিউস ইণ্টারভেনশন প্রোজেক্ট,  ড্যলুথ,মিনেসোটা, ইউ এস এ)

অনেকে ভাবেন মেয়েদের উপর কোন পুরুষের অত্যাচারের মূলে রয়েছে তাদের ব্যক্তিগত মানসিক সমস্যা,  যৌন অক্ষমতা,  ছেলেবেলায় অত্যাচারিত হওয়া,  মানসিক চাপ,  মদ্যপান বা মাদকদ্রব্যের প্রভাব,  ক্রোধ,  অথবা আগ্রাসনে আসক্তি। এ সবই পুরুষের আগ্রাসী ব্যবহারে ইন্ধন যোগাতে পারে,  কিন্তু এগুলোকে মূল কারণ মনে করলে নারী নির্যাতনের মত গূঢ় সমস্যার ব্যাখ্যা সঠিক হবে না।

নারীর প্রতি পুরুষের আগ্রাসনের মূল কারণ হল পুরুষের ক্ষমতা স্থাপন ও নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছা। এই সমস্যার মূলে রয়েছে পুরুষ ও নারীর সামাজিক ক্ষমতার পার্থক্য। শুধু আমাদের নয়, পৃথিবীর প্রায় সব সমাজেই পুরুষপ্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত। মেয়েরা পুরুষের ওপর নির্ভরশীল এবং সমাজে তাদের ভূমিকা গৌণ। শৈশব থেকেই ছেলেদের উৎসাহ দেওয়া হয় যে তাদের বিজয়ী হতে হবে,  পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় রাখতে হবে। ছেলেরা বিশেষ করে শিক্ষা পায়,  যে প্রয়োজন মত বলপ্রয়োগ করে শত্রু দমন করতে হবে,  নিজের অধিকার স্থাপন করে সকলকে দাবিয়ে রাখতে হবে। যখন নির্যাতনকারী তার স্ত্রী বা সঙ্গিনীকে ঘরে আটকে রাখে,  তার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে দেয় না,  বা তাকে বাইরে বেরোতে বাধা দেয়,  তখন সে সোজাসুজি তার প্রভুত্ব স্থাপন করছে।

এক দিক থেকে মনে হতে পারে এইভাবে মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করে বা হিংসাত্মক আচরণে দাবিয়ে রেখে পুরুষেরা লাভবান হচ্ছে। কিন্তু একটু ভেবে দেখলে বোঝা যাবে নারীকে দাবিয়ে রাখলে পুরুষেরও ক্ষতি। স্ত্রীর উষ্ণ সান্নিধ্য বা ভালোবাসা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। নারীর মধ্যে পুরুষ সঙ্গিনী পাচ্ছে না,  ভীত ত্রস্ত এক দাসী পাচ্ছে। এই সচেতনতা এখন পুরুষের মধ্যে ধীরে ধীরে আসছে। নারী নির্যাতন আর মানবিক অধিকার হরণ যে একই ব্যপার তাও অনেকে উপলব্ধি  করছেন। তবে এখনও যুদ্ধ বা দুটি গোষ্ঠির দ্বন্দ্বের সময়ে প্রতিপক্ষকে ঢিট করার সহজ উপায় হল তাদের আত্মীয়া নারীদের ধর্ষণ করা। তাই আন্তর্জাতিক ফৌজদারি ট্রাইব্যুনালে (ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল ট্রাইব্যুনাল) ধর্ষণকে এখন যুদ্ধাপরাধ (ওয়ার ক্রাইম) বলে গণ্য করা হচ্ছে। ধর্ষণ এখন আর শুধু পুরুষের হাতে একজন নারীর লাঞ্ছনা নয়,  শত্রুকে বিধবস্ত করার এক অস্ত্র হিসেবে ধরা হচ্ছে। যুদ্ধ বা গোষ্ঠী সংঘর্ষের সময় গণধর্ষণ এখন সংগঠিত ভাবে মানবিক অধিকার লুণ্ঠন বলে ধরা হচ্ছে।

জাত,  শ্রেণী,  কুসংস্কার,  এবং নারী নির্যাতন

নারী নির্যাতনের সঙ্গে জাতবিদ্বেষ ঘনিষ্ট ভাবে যুক্ত। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা যুদ্ধ বিগ্রহের সময়ে বিধর্মী বা বিজাতীয় নারীদের ধর্ষণ করে শত্রুপক্ষকে জব্দ করার বহু কাহিনীই ইতিহাসে লেখা আছে। এই অত্যাচার নারী নির্বিশেষে ঘটে। নারী বলেই আমরা অত্যাচারের শিকার হতে পারি। তবে অত্যাচারিত হবার সম্ভাবনা নির্ভর করে আমাদের জাত,  ধর্ম,  বয়স,  চেহারা,  সামাজিক অবস্থান ইত্যাদির ওপর। যে কোন দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের,  নিচু জাতের,  নিম্ন বিত্ত নারীর ধর্ষিতা হওয়ার সম্ভাবনা সব চেয়ে বেশি। এছাড়া যারা সহায় সম্বলহীন,  বস্তিতে বা রাস্তায় থাকে,  যারা আদিবাসী,  যারা অল্পবয়সী বা যুবতী,  যাঁরা থাকেন প্রতিবন্ধী,  তাঁরা তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশী ধর্ষণের শিকার হন।

নির্যাতনের ফলে মহিলাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া

নির্যাতন ব্যাপারটা সমাজে প্রায় ব্যক্তিগত সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। অথচ সারা বিশ্বের নারীদের এই একই অবস্থা। বেশির ভাগ সময় নির্যাতন হয় পরিবারের মধ্যে, গোপনে। ফলে অনেক নির্যাতিতা মহিলা মনে করেন এ শুধু তাঁরই সমস্যা এবং এ ব্যপারে একা বোধ করেন। ইচ্ছে থাকলেও কার কাছ থেকে সাহায্য চাইবেন তাঁরা বুঝতে পারেন না। প্রিয়জনের হাতে নির্যাতিত হওয়ার সঙ্গে লজ্জা,  অপমান,  এবং দুঃখ জড়িত থাকে। অনেক সময় শারীরিক মারধোরের সঙ্গে যৌননির্যাতনও চলে। নির্যাতিত হওয়ার ফলে কোন মহিলার কি রকম প্রতিক্রিয়া হবে তা নির্ভর করে সে কি ধরণের আগ্রাসনের শিকার তার ওপর - ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন,  যৌন হেনস্থা,  না শ্লীলতা হানি ও ছিনতাই। কোন নির্যাতিত মহিলার প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসা সৈন্য বা গুম (কিডন্যাপ) হয়ে আটকে থাকার পর মুক্তি পাওয়া মানুষের প্রতিক্রিয়ার খুব একটা তফাৎ হয় না। যুদ্ধক্ষেত্রে বা ভয়াবহ বিপদের মুখে পড়লে মানুষের যা প্রতিক্রিয়া হয় তাকে ইংরেজিতে 'ট্রমা'  বলে।

 এই ধরণের মিল আছে বলে স্বাস্থ্যকর্মীদের নির্যাতিতার প্রতিক্রিয়া বুঝতে সুবিধা হয়। এই প্রতিক্রিয়াগুলিকে বলা হয় 'পোস্ট-ট্রমাটিক ডিস-অর্ডার',  অর্থাৎ ট্রমা-র পরবর্তী সমস্যা। 'পোস্ট-ট্রমাটিক ডিস-অর্ডার' সংক্রান্ত লক্ষণগুলি হল পুরনো অভিজ্ঞতার ভয়াবহ অনুভূতি হঠাৎ হঠাৎ ফিরে আসা,  ঘটনাটির স্মৃতি ফ্ল্যাশব্যাক বা বারবার ছবির মত মনে পড়ে যাওয়া,  ক্রমাগত দুঃস্বপ্ন  দেখা,  ঘুমোতে অসুবিধা হওয়া,  হঠাৎ হঠাৎ প্রচণ্ড রেগে ওঠা,  মনঃসংযোগে অসুবিধা,  সব সময়ে ভয়ে পাওয়া,  আর অল্পেই চমকে ওঠা।
নির্যাতিতাদের মধ্যে যে-সব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়
• নিজেকে দোষ দেওয়া
• ক্রমাগত অপমান এবং লজ্জায় ভোগা
• তীব্র ভীতি এবং নিরাপত্তার অভাব বোধ করা
• রাগ ও বিদ্বেষ প্রকাশ পাওয়া। রাগ সাধারণত নিজের ওপর হয় বলে মানসিক অবসাদ এবং আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে
• মাদকদ্রব্য ব্যবহার আরম্ভ করা
• খাওয়া-দাওয়া নিয়ে সমস্যা
• নানান শারীরিক অসুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া,  বিশেষ করে পেটের গোলযোগ এবং ব্যথা
• নিজেকে অহেতুক কষ্ট দেওয়া
• মনের মধ্যে সবসময় কিছু হারানোর কষ্ট জেগে থাকা
• অত্যাধিক অসহায় বোধ করা
• সবসময়ে একা বোধ করা
• বারবার দুঃস্বপ্ন  দেখা,  ফ্যাশব্যাক বা পুরনো ঘটনার স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়া
• অল্প সময়ের জন্যে হলেও বাস্তবের সঙ্গে যোগ হারানো
• যৌন সম্পর্ক বা ঘনিষ্ট সম্পর্ক স্থাপনে অসুবিধা
• অন্যান্য আত্মিক বা আধ্যাত্মিক সমস্যা

সবার মধ্যে এই প্রতিক্রিয়াগুলো সমান ভাবে প্রকাশ পায় না। বিভিন্ন মহিলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে এবং কম-বেশি এ লক্ষণগুলি দেখা দেয়।


নিজের জীবনকে পুনরুদ্ধার বা স্বাভাবিক অবস্থায় কী ভাবে ফিরিয়ে আনা যায়?

অত্যাচারের ফলে আমাদের যে মানসিক বা শারীরিক বিপর্যয় ঘটে, তার থেকে চট করে মুক্তি পাওয়া যায় না। সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে নিজেদের ওপর আমাদের আস্থা ফিরে আসে। নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরে সুস্থ জীবন ফিরে পেতে কতগুলো বিশ্বাস মাথায় রাখতে হবে:
‣ যে অত্যাচার আপনার ওপর ঘটেছে, তার জন্য আপনি কখনই দায়ী নন। মেয়েদের গায়ে হাত তোলার স্বপক্ষে অনেক যুক্তি শোনা যায় যেমন,  মেয়েটা নিশ্চয় কোন অন্যায় কাজ করেছে,  স্বামীকে রাগিয়ে দিয়েছে,  মেয়েটা খুব বাজে পোষাক পরেছিল,  বা এমন কোন জায়গায় গিয়েছিল যা কেউ বরদাস্ত করবে না,  ইত্যাদি। এর কোনোটাই কারোর গায়ে হাত তোলা বা তার ওপর অত্যাচার করার পক্ষে গ্রহণযোগ্য যুক্তি হতে পারে না।
‣ মনে রাখতে হবে মানুষ নিজের বিচার বুদ্ধি অনুসারে কাজ করে। অন্যের তা পছন্দ না হতে পারে কিন্তু তা নিয়ে মারধোরের অবকাশ নেই। কোন কিছু অপছন্দ হলে তা নিয়ে কথা বলে সমঝোতায় আসা সব সময়েই সম্ভব। আমাদের সমাজ মেয়েদের স্বাধীন ইচ্ছে বা ভালো লাগা সব সময় দাবিয়ে রাখতে চায়।
‣ মনের অনুভূতিগুলি আমাদের নিজস্ব। এর মধ্যে ঠিক বা ভুল বলে কিছু নেই। শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয়ের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার রাস্তা প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ভিন্ন। সুস্থ জীবনে ফিরে যাওয়া নির্ভর করে আমাদের সংস্কৃতি,  অর্থনৈতিক অবস্থান, ইত্যাদির ওপর। এক একজন নারী এক এক ভাবে নিজেকে ফিরে পায়।
‣ নির্যাতনের পরে সব সময়েই সাহায্যের দরকার হতে পারে। সে জন্যে উদ্যোগী হয়ে এ ব্যপারে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এঁরা মনের ক্ষত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করতে পারেন। এ ব্যাপারে নারী নির্যাতন নিয়ে যে সমস্ত মহিলা সংস্থা কাজ করছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। অনেক সময় পরিবারের মধ্যেই কাউকে পাওয়া যায় যিনি এ ব্যাপারে সহায়তা করতে পারেন।
‣ নির্যাতনের ক্ষত সহজে মিলিয়ে যায় না, সময় লাগে। আপনাকে ধৈর্য ধরতে হবে ।

(পরের অংশ)


২০০৯ সালে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের অনুদানে শমীতা দাশ দাশগুপ্তের সম্পাদনায় 'মানবী' ও 'সংলাপ'-এর যৌথ উদ্যোগে 'আমার স্বাস্থ্য, আমার সত্তা' বইটি প্রকাশিত হয়। অনুবাদে সহযোগিতা করেন সুজন দাশগুপ্ত ও অলোক গোস্বামী, আলোকচিত্রে সুবীণ দাশ ও চিত্রাঙ্কনে সাগরিকা দত্ত । ১৫০০ কপি ছাপা হয়েছিল বিভিন্ন এনজিও-র মাধ্যমে বিনামূল্যে বিতরণের জন্যে, এখন এটি দুষ্প্রাপ্য। বইটিতে অবসর-এ পূর্ব-প্রকাশিত কিছু কিছু লেখাও অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। বইটি প্রকাশ করার অনুমতি আমরা পেয়েছি। এর আগে মেয়েদের যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ক অলোচনার একাংশ প্রকাশিত হয়েছিল। গত কয়েকটি সংখ্যা থেকে পুরো বইটাই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছে।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।