প্রথম
পাতা
শহরের তথ্য
বিনোদন
খবর
আইন/প্রশাসন
বিজ্ঞান/প্রযুক্তি
শিল্প/সাহিত্য
সমাজ/সংস্কৃতি
স্বাস্থ্য
নারী
পরিবেশ
অবসর
|
পুরনো
দিনের বই - লৌহকপাট
বিশ্ববিদ্যালয়ের
পর্ব শেষ করে এক তরুণ যুবক চাকরির সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে শেষপর্যন্ত
যে কাজটি পেলেন, সেটি হল কারা বিভাগে। ছোটখাটো একটি জেলের ডেপুটি
জেলারের পদ। সম্পূর্ণ একটা নতুন জগতের সঙ্গে পরিচয় ঘটল সেখানে।
পরিচয়
হল বদর মুন্সীর মত ভয়ঙ্কর ডাকাতের সঙ্গে - খুন,জখম, নারীধর্ষণ
যার কাছে ছেলেখেলা। কিন্তু সেই লোকটিই একবার ডাকাতি করার সময়ে
গৃহস্বামীকে কথা দিয়েছিল, শুধু টাকা-গয়নাই নেবে - নারীর সম্মান
নষ্ট করবে না। কিন্তু দলের একজন সেই হুকুম মানে নি বুঝতে পেরে,
নিজেই ধরা দিল সেই অপবাদের বোঝা নিজের মাথায় নিয়ে।
আলাপ হল মৃত্যু দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত পঞ্চাশোর্ধ্ব আসামী কাশিম ফকিরের
সঙ্গে। কাশিম ফকির নাকি টাকা ডবল করে দিতে পারে। সেই লোভে লোকে
তার নির্জন কুঠিতে যেতো। কাশিম আর তার যুবতী বিবি কুটী টাকাটা
নিয়ে তাদের বিষ মাখানো খাবার দিতো। তারপর মৃতদেহটা টিলার ধারে
গর্ত খুঁড়ে কবর দিতো। একদিন এলো এক স্বাস্থ্যবান যুবক। মুগ্ধ
হল সে কাশিম ফকিরের সুন্দরী যৌবনবতী বিবির সৌন্দর্যে। কুটীবিবিরও
মনে লাগলো দোলা। একে মেরো না, বলল সে কাশিম ফকিরকে। কাশিমের
রোখ চেপে গেলো। কুটীকে না জানিয়ে গভীর রাত্রে বিষ খাইয়ে মারল
সেই যুবককে। সকালে উঠে জানতে পেরে কুটীই ধরিয়ে দিল কাশিম ফকিরকে।
তারপর
চাকরি সূত্রে বদলি হতে হয়েছে নানান জেলে। জেল-জীবনকে দেখার সুযোগ
পেয়েছেন খুবই কাছ থেকে। কয়েদিদের কাছে শুনেছেন তাদের কাহিনী।
সহকর্মীরাও শুনিয়েছেন নানা বিচিত্র ঘটনা।। সেইসব খণ্ড-কাহিনী
সুনিপুণ ভাবে জোড়া দিয়ে লেখা হয়েছে 'লৌহকপাট'। 'লৌহকপাটে'র অবতরণিকাতে
জরাসন্ধ লিখেছেন,
'জীবনে এমন একটা পথে চলতে হয়েছে, যেটা প্রকাশ্য রাজপথ নয়। সে
এক নিষিদ্ধ জগত। সেখানে যাদের বাস, তাদের ও আমাদের এই দৃশ্যমান
জগতের দাঁড়িয়ে আছে লৌহদণ্ডের যবনিকা। তার ওপরে পাষাণ-ঘেরা রহস্যলোক।
কিন্তু তারাও মানুষ। তাদেরও আছে বৈচিত্র্যময় জীবনকাহিনী - সুখে
সমুজ্জ্বল, দুঃখে পরিম্লান, হিংসায় ভয়ঙ্কর, প্রেমে জ্যোতির্ময়!
সেই পাষাণ পুরীর দীর্ঘ প্রকোষ্ঠের স্তব্ধì বাতাসে জমে আছে অলিখিত
ইতিহাস, সভ্য পৃথিবী তার কতটুকু জানে? আমি যে সেখানে বিচরণ করেছি,
এই দীর্ঘ জীবন ধরে, প্রভাতে. সন্ধ্যায়, নিভৃত রাত্রির অন্ধকারে
- আমিই বা কতটুকে দেখেছি, কতখানিই বা শুনেছি। ----- আহরণ যা
করেছি, তোলা আছে স্মৃতির মণিকোঠায়। এখানে যেটুকু দিলাম, সে শুধু
আভাস কিংবা তার ব্যর্থ প্রয়াস।'
কারাজীবন
নিয়ে এর আগেও অনেক ভালো বই বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে, সাহিত্য-গুণে
সেগুলিও উজ্জ্বল। কিন্তু তাদের লেখকরা ছিলেন প্রধানত: রাজনৈতিক
বন্দী। তাঁদের লেখায় যে কারাজীবনের যে চিত্র ফুটে উঠেছে - সেটা
কারাজীবনের একটা দিক। 'লৌহকপাট' সেদিক থেকে স্বতন্ত্র। এর লেখক
কারা-শাসনের সঙ্গে যুক্ত - তাই এর পটভূমি অনেক বিস্তৃত। লেখক
কারাজীবনকে দেখেছেন পরম ঔৎসুক্য ও গভীর অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে। কিন্তু
জীবনকে জানলেও তার কাহিনী শোনানো সব সময়ে সহজ হয় না। তারওপর
সরকারী দপ্তরখানার অনেক বাধানিষেধ থাকে। লেখকের নিজের কথায়,
"অনেক মুখরোচক তথ্যের স্বাদ থেকে পাঠককে বঞ্চিত করেছি।"
তা হয়তো করেছেন, কিন্তু ওঁর প্রসাদগুণে পাঠকদের রস-তৃপ্তির তাতে
বিশেষ ব্যাঘাত ঘটে নি।
জরাসন্ধ
ছদ্মনামের আড়ালে আসল মানুষটি হলেন চারুচন্দ্র চক্রবর্তী (১৯০২
- ১৯৮১)। অর্থনীতিতে এম.এ পাশ করে দার্জিলিং-এ ডেপুটি জেলার
হিসেবে কর্মজীবন সুরু করেন। তিরিশ বছর নানা জায়গায় কাজ করার
পর ১৯৬০ সালে আলীপুর সেণ্ট্রাল জেলের সুপারিন্টেনডেন্ট হিসেবে
অবসর গ্রহণ করেন। চারখণ্ডের 'লৌহকপাটে'র তিনটি খণ্ডই ওঁর চাকুরিজীবনে
লেখা। চতুর্থ খণ্ডটি লেখেন অবসর নেওয়ার পরে এবং কারো কারো মতে
সেটিই সর্বশ্রেষ্ঠ খণ্ড। 'লৌহকপাট' ছাড়াও আরও প্রায় কুড়িটি উপন্যাস
উনি লিখেছেন, 'তামসী', 'পাড়ি', 'মসীরেখা', 'ন্যায়দণ্ড', 'উত্তরাধিকার',
প্রভৃতি। ওঁর আত্মজীবনীমূলক লেখা হল 'নিঃসঙ্গ পথিক' । এছাড়া
ছোটগল্প এবং ছোটদের জন্য লেখা গল্পও ওঁর বেশ কিছু আছে।
'লৌহকপাট'
সম্পর্কে একটা খবর হয়তো কিছু কিছু পাঠকের জানা নেই। দেশ
পত্রিকার এককালের সম্পাদক সাগরময় ঘোষ তাঁর 'হীরের নাকছাবি' বইয়ে
এটির উল্লেখ করেছেন। সাগরময় ঘোষের স্কুলের এক বন্ধু তাঁর ঊর্ধ্বতন
কর্তার একটি পাণ্ডুলিপি এক সময়ে দেশ পত্রিকার অফিসে এসে জমা
দিয়ে যান। এক্সারসাইজ বুক বাঁধানো মোটায় রচনার নাম 'লৌহযবনিকা',
লেখক 'বিশ্ববন্ধì'। লেখা বা লেখকের নাম কোনটাই সাগরময়বাবুর কৌতূহল
জাগায় নি, পাণ্ডুলিপিটিকে তিনি ড্রয়ারে চালান করেন। এর চার-পাঁচ
মাস বাদে বন্ধুর একটা চিঠি পান। একটু কাতরভাবেই বন্ধু লিখেছেন
যে, যদি লেখাটা ছাপার অযোগ্য মনে হয়, তাহলে সেটা যেন রেজিস্ট্রিযোগে
ওঁর কাছে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে লেখাটার কথা সাগরময়বাবু
বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। বন্ধুর চিঠি পেয়ে একটু লজ্জিত হয়েই
খাতা খুঁজেপেতে বার করলেন। ফেরত পাঠানোর আগে দুয়েকপাতা পড়তে
গিয়ে কখন এক ঘণ্টা সময় কেটে গেছে খেয়ালও হয় নি। খাতাটা সেদিন
বাড়ি নিয়ে রাত একটা পর্যন্ত পড়ে শেষ করলেন। তার পনেরো দিন পরেই
'লৌহযবনিকা' 'লৌহকপাট' নামে আর 'বিশ্ববন্ধু'র বদলে 'জরাসন্ধ'
নাম দিয়ে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে আরম্ভ করে। এর কিছুদিন
পরে ১৯৫৪ সালে 'লৌহকপাটে'র প্রথম খণ্ড গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশিত
হয়। ১৯৫৮ সালে তপন সিংহ সেটি চিত্রায়িত করেন।
বন্ধìর
তাগাদা না পেলে 'লৌহকপাট' প্রকাশিত হত কিনা, আর হলেও এতজন লোক
সেটি পড়তো কিনা, সেটা অবশ্যই একটা প্রশ্ন। তবে 'লৌহকপাট' অবহেলিত
হয়ে পড়ে থাকলেও অমনোনীত হয় নি। শোনা যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
'পথের পাঁচালী'র পাণ্ডুলিপি প্রবাসী পত্রিকায় ছ'মাস পড়ে থাকার
পর অমনোনীত হয়ে ফেরত গিয়েছিল। পরে নিতান্ত ভাগ্যচক্রে সাহিত্যিক
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় পাণ্ডুলিপিটি পড়েন, যার প্রচেষ্টার
ফলে আমরা বিভূতিভূষণকে পাই।
সুজন
দাশগুপ্ত
Copyright
© 2011 Abasar.net. All rights reserved.
|
|