প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পরিপূর্ণ গ্রহ, কিন্তু থালা শূন্য- খাদ্যাভাবে নূতন ভূমি-রাজনীতি

প্রথম অধ্যায় ।
খাদ্য : একটি দুর্বল যোজক

পৃথিবীতে এখন রূপান্তর ঘটছে খাদ্য-প্রাচুর্যের যুগ থেকে একটি অনটনের যুগে । গত এক দশকে শস্যদানার(grain)ভাণ্ডার নেমে গেছে এক-তৃতীয়াংশে । বিশ্বে খাদ্যের মূল্য বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি- ফলে শুরু হয়েছে এক নূতন 'ভুমি-রাজনীতি' । এখন খাদ্য হল ' নূতন তেল ', জমি এখন ' নূতন সোনা ' ।

২০০৭-০৮ খ্রীষ্টাব্দে বিশ্বে শস্যদানার মূল্য হঠাত্ বেড়ে যাওয়াতে ক্ষুধার্থের সংখ্যা গেল বেড়ে, যা ইতিহাসে আগে কখনও হয়নি । ফলস্বরূপ, আমরা পেলাম প্রতিবাদ ও দাঙ্গা । থাইল্যাণ্ডে চাল এত মূল্যবান হল যে কৃষকদের রাত জেগে পাকা ফসল পাহারা দিতে হল ; ঈজিপ্টে রুটির লাইনে হল মারামারি- ছয়জনের হল মৃত্যু । দারিদ্র্য-পীড়িত হাইতি-তে পাঁচজনের মৃত্যু হল দাঙ্গায়- প্রধান মন্ত্রী বাধ্য হলেন পদত্যাগে ।
এর পরপরই মন্দার কারণে বিশ্বে দানার মূল্য গেল কমে, তবে সেটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি । তিন বছর পরে আবার মূল্যবৃদ্ধি ।

আমরা এখন বর্ধিত খাদ্যমূল্য এবং ক্ষুধার ব্যাপ্তির যুগে প্রবেশ করেছি । খাদ্য-সমীকরণের চাহিদার দিকে আছে জনসংখ্যা-বৃদ্ধি, অর্থ-প্রাচুর্য এবং খাদ্যকে গাড়ীর জ্বালানিতে রূপান্তর । যোগানের দিকে আছে ভীষণভাবে ব্যহত হওয়া খাদ্য-উত্পাদন, চরম ভূমিক্ষয়, ক্রমবর্ধমান জলের অপ্রতুলতা এবং পৃথিবীর বর্ধিত তাপমান । আমরা যদি এই সমস্যাগুলিকে ঘোচাতে না পারি তা' হলে খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি হতে থাকবে ক্রমাগত, ক্ষুধার্থের সংখ্যা বাড়বে দিন দিন এবং অবশেষে সামাজিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে । আমরা কি পারবো ঠিক সময়মতো সমস্যাগুলির মোকাবিলা করতে ?
বিশ্বে খাদ্যের যোগানের এই টানটান অবস্থাকে আমরা তুলনা করতে পারি বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগের সঙ্গে যখন মূল বিচার্য বিষয় ছিল কৃষিতে অতি-উত্পাদন, অতিশয় উদ্বৃত্ত শস্যদানা এবং খাদ্য-রপ্তানীকারকদের বাজারে প্রবেশের সংকীর্ণ পথ । তখন বিশ্বে মোটামুটি দুটো সঞ্চয়-ভাণ্ডার ছিল, এক-শস্যদানার সুবৃহত্ ' হাতে রাখা ' স্টক ( নূতন শস্য-সংগ্রহের পূর্বে ভাণ্ডারের স্টক ) এবং অতি-উত্পাদন ব্যহত করার জন্য ( মার্কিন নীতি অনুযায়ী ) বিশাল চাষের জমি ফেলে রাখা । এই ফেলে রাখা জমির পুনর্ব্যবহার তখনই হবে যদি উত্পাদন অভিপ্সীত না হয় ; অন্যথায়, প্রয়োজনমতো আরও জমিকে অলস রাখা । বর্ধিত উত্পাদন ক্ষমতা ব্যবহৃত হয় বিশ্বের বাজারকে প্রয়োজনে সুস্থিত রাখার । উদাহরণস্বরূপ, ১৯৬৫ খ্রী-তে ব্যর্থ মৌসুমীর কারণে ভারতে দুর্ভিক্ষ-সমস্যা দেখা দিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার গম উত্পাদনের এক-পঞ্চমাংশ দিয়ে সাহায্য করেছিল । স্টক বিশাল থাকার ফলে বিশ্ব শস্যের বাজারে কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি ।

খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকার এই সময়ে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল ২.৫ বিলিয়ন ; আজ ৭ বিলিয়নের বেশি । ১৯৫০ থেকে ২০০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে মাঝে মাঝেই দানার মূল্য বেড়েছে, তবে সেগুলি ছিল আবহাওয়া-জনিত ঘটনা, যেমন রাশিয়ায় খরা বা ইউ. এস. মধ্যপশ্চিমে ভীষণ তাপপ্রবাহ । এগুলির খাদ্যমূল্যের উপর প্রভাব ছিল ক্ষণস্থায়ী- বছর খানেক । বিশাল স্টক এবং 'অলস' কৃষিজমি যৌথভাবে এই সময়টাকে করেছিল বিশ্ব-ইতিহাসের এক সেরা সুরক্ষিত সময় । কিন্তু এ অবস্থা বেশিদিন থাকার নয় । ১৯৮৬ নাগাদ শস্যদানার মূল্য বাড়তে লাগলো বিশ্ব-চাহিদার সঙ্গে তাল রেখে এবং ইউ.এস.-এর কৃষিজমি অলস রাখার নীতি ধাপে ধাপে বর্জিত হল খরচ বেড়ে যাওয়ার জন্য ।
আজ মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে পরিরক্ষিত সংরক্ষণ প্রোগ্রামের(Conservation Reserve Program)খাতিরে কিছু জমি অলস রাখা হয়েছে, তবে তার বেশিরভাগটাই ক্ষয়ী জমি । ফেলে রাখা উর্বর চাষের জমি- যাকে প্রয়োজনে চাষে লাগানো যাবে- এমন অবস্থা আর নেই ।

কৃষি শুরু হবার দিন থেকেই নূতন শস্য-সংগ্রহের আগে স্টক-নির্মাণ প্রথা ছিল খাদ্য-সুরক্ষার একটি অতিপ্রয়োজনীয় নির্দেশক । কৃষকরা অধিক উত্পাদন করতেন কেবলমাত্র আসন্ন সময়ের জন্য নয়, একটা আশ্বাসদায়ক মার্জিন রাখার জন্য । ১৯৮৬ থেকে ২০০১ সনের মধ্যে, যখন বাফার স্টক রাখা বন্ধ হয়ে গেল, তখনও পরবর্তীকালের জন্য স্টক রাখা হত গড়ে ১০৭ দিনের ব্যবহারের মতন ।
এই রক্ষা-কবচও বেশিদিন রাখা সম্ভব হল না । ২০০১-এর পরে দানার স্টক তীক্ষ্ণভাবে কমে গেল উত্পাদনের তুলনায় ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণে । ২০০২ থেকে ২০১১-র মধ্যে বাফার স্টক কমে দাঁড়াল ৭৪ দিনে- খাদ্য-সুরক্ষার দিন বোধ হয় শেষ হয়ে এলো ।

পৃথিবীর এখন 'বছর আনছি-বছর খাচ্ছি' অবস্থা ; সব সময়েই আশা, বর্ধিত চাহিদা পুরিত হবে উত্পাদন দিয়ে । এখন খাদ্য-রপ্তানীকারক দেশগুলি রপ্তানি বেঁধে দিতে ব্যস্ত নিজ নিজ রাষ্ট্রের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে । শস্যদানার আর একটা বড় মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আসতে পারে সেই অনাকাঙ্খিত বিশ্বখাদ্যব্যবস্থার ভাঙ্গন । যদি রপ্তানীকারী দেশগুলি সিদ্ধান্ত নেয় রপ্তানী কমিয়ে দেবার, ছোট ছোট রাষ্টেরা পড়বে বিপদে । তখন কি হবে ? আমরা কিন্তু অদূর ভবিষ্যতের কথা বলছি না- যে কোনও মুহূর্তেই এটা ঘটতে পারে ।

আগের কয়েকটি সভ্যতার পতনের কারণ হয়েছিল খাদ্য-অপ্রতুলতা । উদাহরণস্বরূপ, সুমেরীয় ও মায়া সভ্যতা, যারা কৃষিব্যবস্থায় এমন পথ নিয়েছিল যা' পরিবেশের দিকা্ থেকে ছিল অপরিরক্ষিত । সুমেরীয়দের সেচব্যবস্থায় কৃত্কৌশলের অভাব ছিল না, কিন্তু মৃত্তিকায় লবনের বর্ধিত মাত্রা খাদ্যব্যবস্থায় পতন আনলো, সেই সঙ্গে সভ্যতারও ।
মানব ইতিহাসে সব থেকে নিদারুণ ভূমি-ক্ষয় ছাড়া আমরা ভোগ করছি নিম্নগামী জলস্তর, কৃষিতে এগিয়ে থাকা দেশগুলিতে শস্য উত্পাদনে সীমায় পৌঁছে যাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ।

এই অবস্থায় এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে ইউ.এন. খাদ্য মূল্য-সূচক জুন, ২০১২-তে হয়েছে ২০১, যা ছিল ১০০ ২০০২-০৪ এ । যাদের আয়ের মাত্র ৯ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্যে, তাদের পক্ষে এই অবস্থা কিছুই নয় ; কিন্তু যাদের খাদ্যে ব্যয় হয় আয়ের ৫০-৭০ শতাংশ, তাদের কাছে খাদ্যের মূল্য দ্বিগুণ হওয়া ভয়ঙ্কর ব্যাপার ।
শস্যদানার স্টকে ঘাটতি সহ খাদ্যমূল্যবৃদ্ধি ডেকে এনেছে ক্ষুধিত মানুষের প্রসার । গত শতাব্দীর শেষ দশকে ক্ষুধিতের সংখ্যা যাচ্ছিল কমের দিকে- ১৯৯৭ সলে ৭৮২ মিলিয়ন । তারপর থেকে সংখ্যা বেড়ে চলেছে ১ বিলিয়নের দিকে । আমরা নজর না দিলে এই সংখ্যা বাড়তেই থাকবে ।

নিম্ন আয় ও দ্বিগুণ খাদ্যমূল্যের ফাঁদে পরা মানুষ বাধ্য হচ্ছে কম খেতে । এরা সংখ্যায় হবে প্রায় ১ বিলিয়নের মতো, ছোটখাটো 'পকেট' ছাড়া এদের বসতি হল ভারতীয় উপমহাদেশ এবং আফ্রিকার সাহারা সন্নিহিত অঞ্চলে । অবশ্য ভারত, যার অর্থনৈতিক অবস্থা চাঙ্গা হচ্ছে দিন দিন, সেখানে ক্ষুধার্থ ও অপুষ্ট মানুষের সংখ্যা কমবে দিন দিন ।
ক্ষুধার্থ পৃথিবীতে শিশুরাই হয় মূল শীকার । ঊর্ধমুখী খাদ্যমূল্যের ফলে লক্স লক্ষ শিশু অভুক্ত । অপুষ্টির কারণে কেউ কেউ হেঁটে বিদ্যালয়ে যেতে পারে না, কেউ বা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত । এদের পরিপূর্ণ জীবন কি হতে পারতো তা' এরা ও আমরা কেউই জানিনা । হয়তো আগামী দিনগুলিতে তা বোঝা যাবে ।

অপুষ্টিগত ক্ষুধার ফলে ভারতীয় শিশুদের প্রায় ৪৮ শতাংশ ক্ষীণদেহ, কম ওজনের এবং খর্বীকৃত ও অপরিণত-মস্তিস্ক ।
২০১২ খ্রী-র প্রথম দিকে নিউ ইয়র্ক টাইমসে Adam Nossiter-এর লেখা থেকে জানা গেল ঊর্ধমুখী খাদ্যমূল্যের প্রভাব কঙ্গোর গনতান্ত্রিক রিপাবলিকে । ক্ষুধা এখানে সচরাচর । kinshasa-য় বিভিন্ন পরিবারকে স্বতন্ত্রভাবে জিজ্ঞাসা করে Adam জানলেন যে বছর তিনেক আগেও প্রত্যেকে দিনে অন্ততঃ একবার পরিপূর্ণ খাদ্য পেতো । কিন্তু আজ! স্বামী-স্ত্রী দুজনে কাজ করেও দৈনিক একবার পূর্ণ খাদ্য জোটে না । এখন অনেক গৃহস্থালীই জানে যে কিছুদিন তাদের অভুক্ত থাকতে হবে ; কোন কোন দিন অভুক্ত থাকতে হবে তার হিসাব সপ্তাহের করণীয় কাজের মধ্যে পড়ে ।

খাদ্যের ঊর্ধমূল্যের প্রভাব হিসাব করতে একটি সংস্থা- International charity Save the Children সমীক্ষা করেছিলেন ৫-টি দেশে- ভারত, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, পেরু এবং বাংলাদেশ । তাঁরা জানালেন যে ভারতে ২৪ শতাংশ পরিবার খাদ্যহীন দিবস পালন করতে বাধ্য হয়, নাইজেরিয়া-তে এই সংখ্যা হল ২৭ শতাংশ আর পেরু-তে ১৪ শতাংশ । অবশ্য পরিবারের সাইজ এই হিসাবে একটি বিশেষ ফ্যাক্টর ।

ইতিহাসগতভাবে শস্যদানার চাহিদা বৃদ্ধির উত্স হল দুটি : জনসংখ্যা-বৃদ্ধি এবং খাদকদের খাদ্য-শৃঙ্খল ধরে ওঠা । প্রথমটি পুরাণো, যেমন বর্তমানে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৮০ মিলিয়ন মানুষ যুক্ত হচ্ছে । আজ রাত্রে খাওয়ার টেবিলে বসবে নূতন ২১৯.০০০ মানুষ যারা গতকাল ছিলনা । আগামীকাল যুক্ত হবে আরও ২১৯,০০০ মানুষ । এই জনসংখ্যা-বৃদ্ধি প্রতিনিয়ত অনেক দেশে স্থানীয় জমি এবং জলসম্পদের উপর চাপ সৃষ্টি করছে, যার সঙ্গে তাল রাখা কৃষকদের পক্ষে দিন দিন শক্ত হয়ে উঠছে । দ্বিতীয়টি শিল্প উন্নয়ন ও বৃদ্ধির সঙ্গে যুক্ত, ঘটে চলেছে বলা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে । বিভিন্ন রাষ্ট্রে শিল্পোদ্যগ বাড়ার সঙ্গে সেখানকার কিছু মানুষের আয়বৃদ্ধি ঘটলে বিশেষ বিশেষ খাদ্য যেমন, মাংস, দুধ ও ডিম-এর চাহিদা বৃদ্ধি পায় । বর্তমানে এরূপ মানুষের সংখ্যা বিশ্বে প্রায় ৩ বিলিয়ন । সব থেকে বড় উদাহরণ হচ্ছে চীন, যেখানে বর্তমানে খাদ্য হিসাবে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের দ্বিগুণ মাংস ভোজন হচ্ছে ।

বর্তমানে একটি তৃতীয় উত্স থেকে শস্য্দানার চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেটা হল অটোমোবিল । ২০০৫ খ্রী থেকেই মোটরগাড়ীর জন্য ইথানল জ্বালানি তৈরি হচ্ছে শস্যদানা ব্যবহার করে । এটি মোটামুটি মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে সীমাবদ্ধ । ২০১১ খ্রী-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাষ হয়েছে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টন শস্যদানা । তারমধ্যে ১২৭ মিলিয়ন টন ( ৩২ শতাংশ ) ব্যবহৃত হয়েছে ইথানল উত্পাদনে । ফলে দানার মূল্য বিশেষভাবে যুক্ত হয়ে গেছে তেলের মূল্যের সঙ্গে, যা আগে কখনই হয়নি ।
তেলের দাম বাড়লে দানা থেকে ইথানল তৈরি অনেক বেশি লাভজনক হয়ে ওঠে । এর ফলে বিশ্বের ১ বিলিয়ন মোটরগাড়ীর সচ্ছল অধিকারীদের সঙ্গে বিশ্বের হত-দরিদ্র্য মানুষদের এক অসম প্রতিযোগিতায় নামতে হয় শস্যদানার জন্য ।
জনসংখ্যা-বৃদ্ধি, বেড়ে যাওয়া দুধ, ডিম ও মাংস ভোজন এবং মোটরগাড়ীর জ্বালানি উত্পাদনে শস্যদানার ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে শস্য্দানার গড় বাত্সরিক ব্যবহার ১৯৯০-২০০৫ সালে ২১ মিলিয়ন টন থেকে ২০০৫-১১-তে ৪৫ মিলিয়ন টন । ২০০৫ খ্রী-তে প্রায় রাতারাতিই বলা যায়, শস্যদানার চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে গেল ।

বিশ্বের কৃষকরা যখন এই বর্ধিত চাহিদার মুখোমুখি, তাদের কিন্তু লড়াই চালাতে হচ্ছে চিরাচরিত ভূমি-ক্ষয় নামক ভীতির বিরুদ্ধে । তা'ছাড়া তিনটি নূতন চ্যালেঞ্জ তো আছেই । এক- নিম্নগামী ভূগর্ভের জলস্তর, তার সঙ্গে আছে শুকিয়ে যাওয়া কুঁয়োগুলি- বিশ্বের ১৮-টি দেশে যেখানে মোট মানুষের অর্ধেক বাস করে ; দুই- কিছু কিছু কৃষিতে-অগ্রগামী দেশে একর প্রতি চাল ও গমের উত্পাদন পৌঁছে গেছে ঊর্ধসীমায় ; তিন- ক্রমবর্ধমান বিশ্ব-তাপমান, যা কৃষিকে তর্জন করে চলেছে ভীষণভাবে ।

ভূগর্ভের জলস্তর নেমে যাওয়া দেশগুলির মধ্যে আছে চীন, ভারত ও মাঃ.যুক্তরাষ্ট্র । বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী ভারতে ১৭৫ মিলিয়ন মানুষের খাদ্য যোগান হচ্ছে পাম্পের অতিরিক্ত ব্যবহার দ্বারা । আমার ধরণা একইভাবে চীনদেশে ১৩০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্য উত্পন্ন হচ্ছে । আর মাঃ. যুক্তরাষ্ট্রে- ক্যালিফর্নিয়া ও টেক্সাসের মতন কৃষিতে অগ্রগামী প্রদেশে কৃষিজমি আসছে কমে- চাষের জল শহরে প্রেরণ করার জন্য এবং জলস্তর নেমে যাওয়ার কারণে ।

দ্বিতীয়তঃ, কয়েক দশক ধরে ক্রমাগত বেশি করে শস্যদানা উত্পন্ন করে কিছু কিছু কৃষিতে-অগ্রগামী রাষ্ট্র ঊর্ধসীমায় পৌঁছে গেছে যা আগে চিন্তা করা হয়নি । জাপান, যে একশ বছর আগে চাল-উত্পাদন সংহত করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল, সেখানে বিগত ১৭ বত্সরে চাল উত্পাদন বাড়েনি । জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া হেক্টর-প্রতি ৫ টন উত্পাদনে স্থির হয়ে আছে ( ই হেক্টর = ২.৪৭ একর ) । এক দশক ধরে চীনের ক্রমবর্ধমান চাল-উত্পাদন আজ জাপানের অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে ।

একই অবস্থা গমের ক্ষেত্রে । ইয়োরোপের তিনটি অগ্রগামী গম-উত্পাদক দেশে, ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে, বিগত এক দশকে গম উত্পাদন বাড়েনি । অন্যান্য দেশগুলিও এই অবস্থায় পৌঁছাতে যাচ্ছে ।

কৃষকদের সামনে তৃতীয় নূতন চ্যালেঞ্জ হল বিশ্ব-উষ্ণায়ণ । জীবাশ্ম-জ্বালানির অতি-ব্যবহার বায়ুমণ্ডলে কারবন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়িয়েই চলেছে, ফলে আমরা পাচ্ছি পৃথিবীর বর্ধিত তাপমাত্রা এবং ভঙ্গুর আবহাওয়া । পূর্বে কোনও চরম আবহাওয়ায়- তাপপ্রবাহ অথবা খরা-কে দেখা যেত ক্ষণস্থায়ী, পরবর্তী চাষের পূর্বেই নিয়মিতভাবে ফিরে আসত স্বাভাবিক অবস্থায় । এখন ফিরে আসার কোনও নিয়ম নেই- ফলে কৃষকেরা পড়েন বিপদে ।

চরম উচ্চ তাপমাত্রা ফসল উত্পাদনকে কমিয়ে দিতে পারে । বহুল ব্যবহৃত একটি মোটামুটি হিসাব হল তাপমাত্রা প্রকৃষ্ট মানের ১ ডিগ্রী বেশি হলে শস্যের উত্পাদন কমে যায় ১০-শতাংশ । মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রে শস্যদানা ও সয়াবীন-এর উপর তাপমাত্রার প্রতিক্রিয়া-বিষয়ে একটি অনুসন্ধান থেকে জানা যাচ্ছে যে ১ ডিগ্রী তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে দানার উত্পাদন কমছে ১৭-শতাংশ । অথচ, এ সত্ত্বেও পৃথিবী আবহাওয়া-বিষয়ে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না যদিও আমরা জানি যে এ শতাব্দীতে তাপমান সহজেই বৃদ্ধি পাবে ৬ ডিগ্রী সেলসিয়াস ।

এতদিন পরের বছরের কৃষি ওঠার আগে পর্যন্ত স্টক রাখা হত ৭০ দিনের একটু বেশি । বিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এটিকে নিম্নতম বলে ভাবা হত । এখনকার স্টক কিন্তু নির্ভর করবে উত্পাদনের উপর উচ্চ তাপমানের প্রভাব, আরও প্রখর এবং বিস্তীর্ণ খরা এবং আরও কঠোর তাপপ্রবাহ । এটা পরিষ্কার যে এদের মধ্যে যেকোনও একটি উত্পাদনকে ব্যহত করতে পারে । এই বিপদকে প্রশমিত করতে অন্ততঃ ১১০ দিনের সঞ্চয় রাখা প্রয়োজন, যা' খাদ্য সুরক্ষাকে নিরাপদ করবে ।

খাদ্যের যোগান কমের দিকে হলে খাদ্যের বিশ্ব-রাজনীতি দ্রুত ছাপিয়ে যায় তেলের বিশ্ব-রাজনীতিকে । এই বিপদের টের প্রথম পাওয়া গিয়েছিল ২০০৭ খ্রী-তে, যখন বিশ্বের শস্য-উত্পাদন কম হয়েছিল চাহিদার তুলনায় । শস্যদানা ও সয়াবীনের মূল্য প্রথমে বাড়তে শুরু করে ২০০৮-এর মাঝামাঝি দ্বিগুণ হয়ে গেল । ফলস্বরূপ, অনেক রপ্তানীকারী দেশ নিজ রাজ্যে মূল্য স্থির রাখার প্রয়াসে রপ্তানী সীমাবদ্ধ করে দিল । এদের মধ্যে ছিল দুটি অগ্রণী দেশ- রাশিয়া ও আর্জেন্টিনা । ভিয়েতনাম, পৃথিবীর দু'নম্বর চাল রপ্তানীকারক, রপ্তানী নিষিদ্ধ করে দিল ২০০৮-এর প্রথম কয়েক মাস । অন্যান্য অনেক ছোট রপ্তানীকারক দেশ অল্পবিস্তর রপ্তানী সঙ্কুচিত করে দিল ।

মূল জোগানদাররা রপ্তানী নিষিদ্ধ বা সঙ্কুচিত করলে আমদানী- কারক দেশগুলি আতঙ্কগ্রস্থ হল । বাজারের উপর নির্ভর করতে না পেরে কিছু দেশ রপ্তানীকারক দেশদের সঙ্গে সরাসরি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করলো শস্যদানা পাঠাবার জন্য । ফিলিপিন্স, চাল-এ চির-অভাবগ্রস্থ একটি দেশ, ভিয়েতনামের সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি করলো বছরে ১.৫ মিলিয়ন টন চাল পাঠানোর জন্য । ইয়েমেন-রাষ্ট্রের একটি প্রতিনিধিদল অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিল একই উদ্দেশ্যে, কিন্তু অসফল হয়ে ফিরেছে । একটা বিক্রেতা-বাজারে রপ্তানীকারকরা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে যেতে অপারগ ছিল ।

বাজার থেকে শস্যদানা কিনতে না পেরে কিছু সম্পন্ন রাষ্ট্র যথা, সৌদি আরব, চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়া, একটা বিরল পথ গ্রহণ করেছে- খাদ্য উত্পাদনের জন্য অন্যদেশে জমি কেনা বা দীর্ঘমেয়াদি লীজ (lease) নেওয়া । বেশিরভাগ জমিই আফ্রিকায়- মুখ্যতঃ ইথিওপিয়া, সুদান এবং দক্ষিণ সুদান । এই প্রথা দিন দিন বেড়েই চলেছে । এই রাষ্ট্রগুলিতে বহু মানুষ রক্ষা পাচ্ছে U.N. World Food Programme-এর খাদ্যদান প্রকল্প দ্বারা ।

২০১২ খ্রী-র মাঝামাঝি সময়ে শতশত জমি হয় অর্জিত হয়েছে বা অর্জিত হবার মুখে । এই ধরণের জমি-অধিগ্রহণের উপর বিশ্বব্যাঙ্কের একটি বিশ্লেষণ (২০১১ খ্রী-র) জানাচ্ছে যে, অন্ততঃ ১৪০ মিলিয়ন একর জড়িত ( যা' মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্স্যদানা ও গম চাষের মোট ক্ষেত্র থেকে বেশি ) ।

জমি অধিগ্রহণের কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছে রাষ্ট্রীয় সরকার, জমির দালালরা এবং ব্যাক্তিগত মালিকানা । একটি প্রশ্ন নিয়ে এসেছে 'জলের অধিকার'- যেহেতু নিম্ন অববাহিকার রাষ্ট্রগুলি এর সঙ্গে জড়িত । নীল নদের উচ্চ অববাহিকা থেকে ইথিওপিয়া, সুডান ও দক্ষিণ সুডান-এ কৃষিতে জল দেওয়ার ফলে ঈজিপ্টে জলের অসুবিধা হচ্ছে- ঘনিয়ে উঠেছে এক সূক্ষ জল-রাজনীতি যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে ঈজিপ্ট ।

সংঘাতের সম্ভাবনা খুব বেশি । অনেক লেন-দেনই হয়েছে গোপনে ; অনেক জমিই আগে বিক্রী করা হয়েছে বা লীজ দেওয়া হয়েছে । অনেক ক্ষেত্রেই কৃষকরা জানেন না বা তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি । আবার, অনেক উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের গ্রামে জমির দলিলের প্রথাই নেই, যে কৃষক জমি হারালেন তাদের পক্ষে আদালতে যাওয়ার সম্ভাবনা কম উপযুক্ত কাগজপত্রের অভাবে ।

পরিশেষে বিশ্বের কৃষকদের পক্ষে ক্রমশঃই শক্ত হয়ে উঠছে খাদ্যের বর্ধিত চাহিদার সঙ্গে তাল রাখা । বিশ্বের দানার স্টক স্থির হয়েছিল বছর দশেক আগে ; আমরা এখনও সেটা পুনর্নিমাণ করতে পারিনি । যদি তা' না পারি, তবে আগামি ব্যর্থ-কৃষির সময়ে খাদ্যমূল্য হবে আকাশচুম্বী, ক্ষুধার্থের সংখ্যা বাড়বে ভীষণভাবে এবং খাদ্যের জন্য অশান্তি বিস্তৃত হবে । আমরা একটি বহুকাল স্থায়ী খাদ্য-দুষ্প্রাপ্যতার যুগে প্রবেশ করছি, এমন একটি যেখানে জমি ও জল-এর অধিকারের জন্য প্রতিযোগিতা হবে প্রবল, এক কথায়, খাদ্যে বিশ্ব-রাজনীতির যুগে ।

এপ্রিল ০৯, ২০১৩ লেষ্টার আর. ব্রাউন
(Lester R. Brown)
Earth Policy Release
www.earth-policy.org/books/fpep/fpepch1

অনুবাদক : শঙ্কর সেন

[ পরবর্তী প্রকাশ : দ্বিতীয় অধ্যায় : জনসংখ্যা বৃদ্ধির ইকোলজি ]

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 

 







অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।