গিজার
পিরামিড
ছোট বেলায়
যখন পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করা
হত তখন মিশরের পিরামিডই প্রথমে মনে ভেসে উঠত।
পিরামিডের দেশ এই মিশর– এখানে সারা দেশে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে ১৩৮ টির মত পিরামিড আছে। এর বেশীর ভাগই
দেশের রাজা – ফারাওদের এবং গণ্যমান্য ব্যক্তির
কবর স্থান। ফারাওগন আশা করতেন মৃত্যু-পরবর্তী
জীবনে তাঁরা দেবতুল্য বা দেবতা হয়ে যাবেন। তাই
মৃত্যু-পরবর্তী জীবনের প্রস্তুতির অঙ্গ হিসাবে
তাঁরা দেবতাদের জন্যে মন্দির ও নিজেদের জন্যে
পিরামিড তৈরি করাতেন। এই পিরামিড গুলোতে মৃত্যু-পরবর্তী
জীবনে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সমস্ত রকম প্রয়োজনীয়
জিনিষ পত্র সাজিয়ে রাখতেন।
সব থেকে
পুরনো পিরামিডগুলো আছে সাক্কারাতে। এদের মধ্যে
পুরনো পিরামিডটি তৈরি হয়েছিল খৃঃ পুঃ ২৬৩০ থেকে
খৃঃ পুঃ ২৬১১ সালে। এটা জোসারের স্টেপ্ট পিরামিড
নামে খ্যাত, কারণ এতে আমাদের দোল-মঞ্চের মত
অনেক গুলো ধাপ আছে। এটাকেই পৃথিবীর প্রাচীনতম
উল্লেখ যোগ্য সৌধ বলে মানা হয়।
মিশরের
প্রাচীন পিরামিড গুলোর নির্মাণ-স্থান/কাল পরীক্ষা
করলে দেখা যাবে কিছু বিশেষ অঞ্চলে একাধিক পিরামিড
তৈরি করা হয়েছিল যেমন-
১। সাক্কারাতে আছে জোসার পিরামিড (ক্ষৃঃ পুঃ
২৬৩০ -২৬১১), উসেরকাফ পিরামিড (খৃঃ পুঃ ২৪৯৪-
২৪৮৭) এবং খেন্দজের পিরামিড (খৃঃ পুঃ ১৭৬৪-১৭৫৯)।
২। আবু সিরে আছে সাহুরে পিরামিড (খৃঃ পুঃ ২৪৮৭
-২৪৭৭), নেফারির কাকাই পিরামিড (খৃঃ পুঃ ২৪৭৭
-২৪৬৭) এবং ন্যুসেররে ইনি পিরামিড (খৃঃ পুঃ
২৪১৬ -২৩৯২)।
৩। লিশ্তে আছে আমেনেমহাত পিরামিড (খৃঃ পুঃ ১৯৯১
-১৯৬২) এবং সেনুস্রেত পিরামিড (খৃঃ পুঃ ১৯৭১
-১৯২৬)।
৪। গিজাতে আছে খুফু পিরামিড (খৃঃ পুঃ ২৫৮৯ -২৫৬০),
খাফ্রে পিরামিড (খৃঃ পুঃ ২৫৫৮ -২৫৩২) এবং মেঙ্কাউরে
পিরামিড (খৃঃ পুঃ ২৫৩২ -২৫০৪)।
(সন-তারিখ নিয়ে কিছু মতভেদ এখনও আছে।)
এই পিরামিড
গুলোর মধ্যে গিজার পিরামিড সব থেকে বিখ্যাত
এবং প্রাচীন। এখানকার পিরামিড গুলোর নির্মাণ
কাল লক্ষ করলে দেখা যাবে পিরামিড গুলো একটার
পর একটার ক্রমান্বয়ে তৈরি করা হয়েছে। এই কালজয়ী
পিরামিড গুলো এখনও প্রায় অটুট হয়ে সদর্পে দাড়িয়ে
আছে।
গিজা কয়রোর
খুব কাছে (২৫ কিঃ মিঃ) – বলা যায় কয়রো নগরীর
উপকণ্ঠে। তাই খুব সহজেই আমরা গিজায় পৌঁছে গেলাম।
পিরামিডের কাছা কাছি রাস্তাঘাট বেশ সুন্দর।
বুলেভার্ড ও পার্ক সুন্দর করে সাজান (১ নং ছবি)।
নং
১ – গিজার সুন্দর রাস্তার বুলেভার্ড গাছ দিয়ে
সুন্দর করে সাজানো।
যাওয়ার
সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। পিরামিড চত্বরের বেশ
দূর থেকেই (আনুমানিক ৫০০ মিঃ) পিরামিড গুলো
খানিকটা দেখা যায়। আমি তাই দেখছিলাম। হঠাৎ একটা
আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি আমাদের গাড়ীর বনেটে
এক যুবক। আঁতকে উঠে ভাবলাম একটা দুর্ঘটনা ঘটে
গেল। ভাবলাম তখনই ঝামেলা শুরু হবে এবং আমাদের
উপর হামলা হবে। আমার মিশরীয় বন্ধু বললেন এটা
দুর্ঘটনা নয়। গাইড ও ঘোড়ার জন্যে খদ্দের ধরতে
এরা এই ভাবে গাড়ী ‘ধরে’। অবশ্য যুবকের চেষ্টা
বিফলে গেল। গাইডদের কোলাহল আর ঘোড়া (২ নং ছবি)
দেখে আমরা আর গাইড বা ঘোড়া ভাড়া করার দিকে যাইনি
কারণ আমাদের সঙ্গে যে স্থানীয় লোকজন ছিলেন তারা
এই পিরামিড চত্বর সম্বন্ধে ভাল ভাবেই জানেন।
একই কারণে আমরা উটও (নং ছবি) ভাড়া করিনি।
নং
২ – গিজার পিরামিডের প্রবেশ পথে ঘোড়াওয়ালা ও
গাইডদের ভিড়।
নং
৩ – উট - পর্যটকদের জন্যে সেজে গুজে তৈরি হয়ে
আছে।
পূর্ব
দিক থেকে তোলা ৪ নং (প্যানারোমা) ছবিতে এই চত্বরের
তিনটি পিরামিডই দেখা যাচ্ছে। ডান দিকের বড় পিরামিডটির
নাম খুফু এবং গিজার এই চত্বরের প্রথম পিরামিড।
নং
৪ - গিজার পিরামিডের চত্বরের প্যানারোমা - পূর্ব
দিক থেকে তোলা।
ডান দিকে
বাড়ীর ছাদের ওপর দিয়ে এর মাথা দেখা যাচ্ছে।
মাঝে যে বড় পিরামিডটি
দেখা যাচ্ছে সেটার নাম খাফ্রে। প্রায় মাঝামাঝি
দেখা যাচ্ছে বিখ্যাত স্পিনক্স। তার বা দিকে
যে পিরামিডটি আছে সেটার নাম মেঙ্কাউরে। একদম
বাঁদিকের ছোট ছোট পিরামিড গুলো ধর্তব্যের মধ্যে
নয়। নীল নদ এই চত্বরের থেকে বেশি দূরে ন্য।
গিজার এই চত্বরের সবকটি পিরামিড, স্পিনক্স ইত্যাদি
খালের সাহায্যে নীল নদের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
গিজার
প্রথম পিরামিডটি তৈরি করান ফারাও খুফু এবং তারই
নাম অনুসারে একে খুফু পিরামিড বলা হয় (পশ্চিম
দিক থেকে তোলা ৫ ও ৬ নং ছবি)।
নং
৫ - ফারাও খুফুর তৈরি পিরামিড। এই পিরামিডটিকে
তারই নাম অনুসারে খুফু পিরামিড বলা হয়।
নং
৬ - খুফু পিরামিডের মাথায় অ্যান্টেনার মত কিছু
একটা দেখা যাচ্ছে।
এটি গিজার
সব থেকে বড় পিরামিড - একে গ্রেট পিরামিডও বলা
হয়। এর উচ্চতা ১৪৭ মিঃ ও নিচের এক একটি বাহু
২০৩ মিঃ। পিরামিডটির দেওয়াল তৈরি হয়েছে বিশাল
পাথরের চাঁই দিয়ে তৈরি। এক একটা ২ ১/২ থেকে
১৫ টন ওজনের- ৭ নং ছবিতে দেখা যাবে পাথরের চাঁই
গুলো মানুষের কাঁধ সমান উঁচু। বাইরে
গাটা চুনা পাথরের মসৃণ প্রলেপ দিয়ে ঢাকা ছিল।
নিচের অল্প অংশ ছাড়া বেশির ভাগ প্রলেপই এখন
আর নেই । চুনা পাথর আনা হয়ে ছিল নীল নদের অপর
পারের খনী থেকে। অবশ্য কিছু গ্রানাইট পাথর এসেছিল
সুদূর অসওয়ান এলাকা থেকে।
নং
৭ – পর্যটকরা পিরামিডের অনেক উপরে উঠে গেছে।
পাথরের চাই গুলো প্রায় তাঁদেরই সমান।
ফারাও
খুফুর পুত্র ফারাও খাফ্রে দ্বিতীয় পিরামিডটি
তৈরি করান এবং তাঁরই নামে এই পিরামিডটি নাম
করণ হয়। অনেকে এটিকে ছেফ্রেঁ পিরামিডও বলেন
(৮ নং ছবি)।
নং
৮ - ফারাও খুফুর পুত্র ফারাও খাফ্রের তৈরি দ্বিতীয়
পিরামিডটিকে খাফ্রে বা ছেফ্রেঁ পিরামিড বলা
হয়।
এর উচ্চতা
১৩৬ মিঃ এবং নিচের বাহু ২১৫ মিঃ। খুফু পিরামিড
থেকে এটা একটু বেশি খারা। এর পাথরের ভিত খুফু
পিরামিড থেকে ১০ মিঃ বেশি উঁচু তাই একে একটু
বেশি উঁচু মনে হয়। খাফ্রে পিরামিডের উপরের দিকে
পলেস্তারা এখনও খানিকটা আছে তাই একে বেশি সুন্দর
দেখায়।
ফারাও
খাফ্রের আরেকটি অবদান গিজার বিখ্যাত স্পিনক্স।
এটি দ্বিতীয় (খাফ্রে) পিরামিডটি বরাবর অনেকটা
পূর্ব দিকে (ক্ষ্রীঃ পুঃ ২৫৫৮-২৫৩২) তৈরি করা
হয়েছিল। সিংহের দেহ ও মানুষের মুখ বিশিষ্ট চুনা
পাথরের এই মূর্তিটি ৭৩ মিঃ লম্বা, ১৯ মিঃ চওড়া
ও ২০ মিঃ উঁচু (৯ ও ১০ নং ছবি)।
ন
৯ – স্পিনক্স তার লম্বা থাবা মেলে বসে আছে।
নং
১০ – স্পিনক্সটির মুখ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে
এর নাকটি ভাঙ্গা।
পৃথিবীতে
এটাই একটা আস্ত পাথরের তৈরি সর্ববৃহৎ মূর্তি।
ইউরোপে স্পিনক্স বলতে বোঝাতো সিংহের দেহ, নারীর
মুখ ও ঈগলের ডানা বিশিষ্ট একটি জীব। কিন্তু
মিশরীয় স্পিনক্সের ডানা নেই, নারীর মুখের বদলে
আছে পুরুষের মুখ। গিজার চত্বরটি পরিত্যক্ত হওয়ার
পর স্পিনক্সটি আস্তে আস্তে কাঁধ পর্যন্ত বালিতে
ডুবে যায়। আবার ক্ষ্রীঃ পুঃ ১৪০১ থেকে ১৩৮৮
সালের মধ্যে কোন এক সময় স্পিনক্সের থাবা পর্যন্ত
বালি সরান হয়। স্পিনক্সটি
ভাল করে দেখলে বোঝা যাবে স্পিনক্সের ১ মিঃ চওড়া
নাকটা উধাও। লম্বা ছেনি দিয়ে নিচে থেকে ও পাশ
থেকে যেন ভেঙ্গে বের করা হয়েছে। কেও কেও বলেন
যে নেপোলিয়নের সৈনিকদের ছোড়া কামানের গোলা লেগে
নাকটি ভেঙ্গে গেছে। যাই হোক স্পিনক্স এখন নাক-বিহীন।
নং
১১ – গিজার এই তৃতীয় পিরামিডটি তৈরি করান ফারাও
মেঙ্কাউরে। তাই এর নাম মেঙ্কাউরে পিরামিড। এটা
অন্য দুটির তুলনায় বেশ ছোট।
গিজার
তৃতীয় পিরামিডটি তৈরি করান ফারাও মেঙ্কাউরে
ক্ষৃঃ পুঃ ২৫৩২ -২৫০৪ সালে। এটা আগের দুটো পিরামিডের
থেকে বেশ ছোট (১১ নং ছবি)। এর উচ্চতা ৬৫ মিঃ
ও নিচের এক একটি বাহু ১০৮ মিঃ। এটি প্রধানত
তুরার চুনাপাথর ও গ্রানাইটের তৈরি। বাইরের চুনাপাথরের
মসৃণ প্রলেপ আগে ছিল কিন্তু এখন নেই। এই পিরামিডের
দক্ষিণ দিকে তিনটে খুব ছোট পিরামিড আছে (১২
নং ছবি)। বিশেষজ্ঞদের মতে এই তিনটে ছোট পিরামিড,
এমনকি মেঙ্কাউরে পিরামিডটিরও কিছু কাজ অসমাপ্ত
ছিল।
নং
১২ - মেঙ্কাউরে পিরামিডের কাছে তিনটি ছোট ছোট
অসমাপ্ত পিরামিড।
গিজার
পিরামিড গুলো এবং স্পিনক্স দেখে আমি অভিভূত
ও বিস্মিত। মনে হল আমি যেন ইতিহাস বইয়ের ভিতরে
কিংবা স্বপ্নের দেশে ডুকে পরেছি। আমার বিস্ময়ের
রেশ কাটতে সময় লাগবে।
*৭ ও ১২ নং
ছবি আমার সহযাত্রী শ্রী রঞ্জন গুহর থেকে সংগ্রহ
করা।
বিমল
কুমার বসাক
আগের
অংশের জন্যে ক্লিক করুন...
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।