পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
প্রেম
: প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য ১
২
বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর
[ লেখক
পরিচিতি : ১৮৭০ খৃষ্টাব্দের ৬ই নভেম্বর কলকাতার জোড়াসাঁকোয়
জন্ম । পিতা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথ
ঠাকুর । বলেন্দ্রনাথ ছিলেন বীরেন্দ্রনাথের একমাত্র সন্তান।
মাতা প্রফুল্লময়ী দেবী । ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে বলেন্দ্রনাথ হেয়ার
স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । ছাত্রাবস্থাতেই
তার সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় মেলে । তার রচিত প্রবন্ধ ছাড়াও
ছোট গল্পেরও সাহিত্য মূল্য অসাধারণ । জ্ঞানদানন্দিনী দেবী
সম্পাদিত 'বালক' পত্রিকার ১২৯২ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ্য সংখ্যায়
তার প্রকাশিত 'একরাত্রি' প্রবন্ধ এবং ফাল্গুন সংখ্যায় প্রকাশিত
'সন্ধ্যা' কবিতাই তার প্রথম গদ্য ও পদ্য রচনা । তার জীবিতাবস্থায
মাত্র তিনখানি গ্রন্থ প্রকাশিত হযেছিল : প্রবন্ধ সংকলন 'চিত্র
ও কাব্য' (১৮৯৪ খৃষ্টাব্দ) এবং কাব্যগ্রন্থ 'মাধবিকা' (১৮৯৬
খৃ) ও শ্রাবনী (১৮৯৭ খৃ) । তিনি সংস্কৃত কাব্যও সমালোচনা করেছেন
। 'ভারতী' , 'বালক' , 'সাহিত্য' ইত্যাদি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত
লিখতেন । তার কাকা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও তিনি সাহিত্যকর্মে
যুক্ত ছিলেন । স্বদেশী বস্ত্রের কারবারেও তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন
; এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথও ছিলেন তার সহযোগী ।
২৬ বছর বয়সে ডক্টর ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা সাহানা
দেবীর সঙ্গে বলেন্দ্রনাথের বিবাহ হয় । তিনি নিঃসন্তান ছিলেন
। শেষ জীবনে আর্য্যসমাজের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের মিলনের জন্যও
তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন । এই ধারাবাহিকে প্রকাশিত মাতা প্রফুল্লময়ী
দেবী রচিত 'আমাদের কথা'য় তার ব্যক্তিজীবনের কিছু খণ্ডচিত্রের
পরিচয় মেলে । স্বল্পায়ু বলেন্দ্রনাথ ছিলেন ঠাকুরবাড়ীর একটি
বিস্ময়কর প্রতিভা । তার রচিত বার্তমান প্রবন্ধটি প্রকাশিত
হয়েছিল 'ভারতী ও বালক' পত্রিকায় । এই রচনায় তার মননশক্তি ,
চিন্তার গভীরতা ও বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণ ক্ষমতার কিছুটা পরিচয়
পাওয়া যাবে । মাত্র ২৯ বছর তিনি জীবিত ছিলেন । ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দের
২০শে অগাষ্ট তার মৃত্যু হয় । ..
দীপক সেনগুপ্ত]
।। ১ ।।
আমাদের দেশীয় সাহিত্য সাধারণতঃ
যে সকল কাব্যগ্রন্থ দেখিতে পাওয়া যায় , তাহার অধিকাংশই প্রেমের
কথা লইয়া । প্রেমের বৈচিত্র্য , তরঙ্গভঙ্গ এ দেশের কবিরা যেমন
সুন্দররূপে বুঝিয়াছিলেন , পাশ্চাত্ত্য কবিরা বোধ করি সেরূপ বুঝিতে
পারেন নাই । আমাদের কাব্যের বিরহ , অভিসার , মানাভিমান ব্যাপার
পাশ্চাত্ত্য কাব্যে কোথায় ? পাশ্চাত্ত্য দেশে কি প্রণয়-বন্ধনের
মধ্যে বিরহ দেখা দেয় না ? প্রণয়িনী কি ভুলিয়াও মান করিয়া বসিয়া
থাকেন না ? তবে সে দেশের কাব্য বিরহ-বিলাপ-ধ্বনিময় নয় কেন ?
মানভঞ্জনের গুরুতর ব্যাপার লইয়া পাশ্চাত্ত্য কবি গীত রচনা করেন
নাই কেন ? প্রকৃতি , শিক্ষা , স্বাধীনতা , এবং অন্যান্য অবস্থা
ভেদে পাশ্চাত্ত্য দেশে বোধ হয় , বিরহের এরূপ জ্বালাময়ী দারুণতা
নাই । ইংরাজদিগের মধ্যে ভালবাসার অভিনয় খেলা প্রচলিত আছে , তাহাই
আমাদের মানভঞ্জনের কতকটা অনুরূপ । কিন্তু মানভঞ্জন অনুষ্ঠানের
মধ্যে হৃদয়ের অনুরাগ প্রচ্ছন্ন , ইংরাজ জাতির flirtation প্রেমের
অভিনয় মাত্র - তাহাতে সম্পর্ক নাই । সুতরাং মানভঞ্জনে স্বভাবতই
কবিতার প্রতিষ্ঠাভূমি হইতে পারে ।
ইংরাজী সাহিত্যে বিরহের ভাবপ্রকাশক একটিও কথা শুনা যায় না ।
বিচ্ছেদের ইংরাজী প্রতিশব্দ খুঁজিয়া মিলে , কিন্তু বিরহের প্রতিশব্দ
নাই । বিরহের অভাবে মিলনেরও অবিকল প্রতিশব্দের ইংরাজী ভাষায়
অভাব আছে । আমাদের মিলনের হৃদয়ে কতদিনকার বিরহের অশ্রুজল প্রচ্ছন্ন
, কত দীর্ঘ নৈরাশ্যের রুদ্ধ নিশ্বাস সমাহিত । পাশ্চাত্ত্য মিলন
কেবল মিলন মাত্র - তাহার মধ্যে বিরহের কাব্য রচিত হয় নাই , পথ
পানে চাহিয়া কাহার প্রত্যাগমন প্রতীক্ষা জাগিয়া নাই , আমাদের
মিলনের মত সে মিলন অতীতের সমুদ্রমথিত নহে । আমাদের বিরহ মিলনে
এ দেশের প্রকৃতির প্রভাব অনুভব হয় । অপর দেশে সুতরাং ঠিক সেইরূপ
আশা করা যায় না ।
প্রেমবাচক শব্দও আমাদের ভাষায় অধিক
মিলে । স্নেহ , ভক্তি প্রভৃতি বিশেষ ভাবসকল বাদ দিয়াও কত কথা
- প্রেম , প্রণয় , অনুরাগ , ভালবাসা , প্রীতি , পিরীতি । ইহারা
সব যে সম্পূর্ণ এক ভাবই ব্যক্ত করে , তাহা নহে । কিন্তু ইংরাজীতে
একমাত্র প্রতিশব্দ -Love । প্রেম ঈশ্বর বিষয়ে প্রয়োগ না হইলেও
, প্রণয় অপেক্ষা নিষ্কাম প্রেম ইংরাজী Love শব্দের মত বিস্তৃত
এবং সঙ্কীর্ণ , উভয় ভাবেই ব্যবহৃত হয় । প্রণয়ে প্রেমের মত বিস্তৃতি
নাই । প্রণয় মানবের ঊর্দ্ধে উঠিতে পারে না । প্রেমের বিলাইয়াই
সুখ , প্রণয় প্রতিদান চাহে । অনুরাগ প্রণয়ের মূলে । প্রণয় অনুরাগ
অপেক্ষা গাঢ় । প্রীতি হইতে পিরীতির উদ্ভব বটে কিন্তু কালক্রমে
উভয়ের ভাবে বিস্তর প্রভেদ হইয়া পড়িয়াছে । বর্তমানে পিরীতির প্রীতির
মত গাম্ভীর্য্য নাই । প্রেমের প্রত্যেক সূক্ষ্ম ভাবগুলি , আমাদের
ভাষায় সমধিক পরিস্ফুট । ইংরাজী love শব্দ কোথাও অনুরাগ কোথাও
প্রণয় , এমন স্পষ্ট নহে ।
কেহ না মনে করেন যে , পাশ্চাত্ত্য
ভাষার প্রেমের কবিতা নাই । প্রেমের কবিতা সকল ভাষাতেই আছে ।
বিশেষতঃ ইংরাজ কবিরা প্রেমিকের হৃদয় বিশ্লেষণ করিয়া দেখিতে যত্নের
ত্রুটি করেন নাই । কিন্তু প্রেমের কবিতা যথেষ্ট থাকিলেও ইংরাজিতে
আমাদের দেশের মত বিচিত্র প্রেমকাব্যের অভাব আছে বোধ হয় । এ দেশের
কবিরা প্রেমকে সমগ্রভাবে এক করিয়া এবং স্বতন্ত্রভাবে তাহার প্রত্যেক
অঙ্গ ভাগ করিয়া বিশেষরূপে আলোচনা করিয়া দেখিয়াছেন । পাশ্চাত্ত্য
কবিরা প্রেমের প্রত্যেক অধ্যায় সেরূপ ভাবে দেখেন নাই । আমাদের
বৈষ্ণব কবিদিগের সঙ্গীতে প্রেমের অতৃপ্তি , আকুলতা , আকাঙ্ক্ষার
ভাব সুন্দর পরিস্ফুট । শুধু তাহাই নহে , প্রকৃতির সহিত প্রেমের
সম্বন্ধ , প্রেমের উপর প্রকৃতির প্রভাব তাঁহারা সুন্দর বুঝিতেন
। তাঁহারা প্রেমের সুর ধরিয়াছিলেন ; সেরূপ ভাবে কোন পাশ্চাত্ত্য
কবি বোধ করি প্রেমের সুর ধরিতে পারেন নাই । প্রেমকে তাঁহারা
সর্ব্বাঙ্গীন আয়ত্ত্ব করিয়াছেন । সেই জন্যি ত বংশীধ্বনির সহিত
প্রেমভাবের নীরব সম্বন্ধ এমন দক্ষতার সহিত গাঁথিয়া দিতে পারিয়াছেন
। এ দেশে প্রেমের তন্ন তন্ন বিশ্লেষণ হইয়াছে । প্রেমেই আমরা
পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যকে ছাড়াইয়া উঠিতে পারি ।
পাশ্চাত্য সাহিত্যে প্রেমের কাহিনীবৈচিত্র্য
বিস্তর - নানা ঘটনার সমাবেশ । কিন্তু তাহাতে প্রেমভাবের সাধারণ
বৈচিত্র্য তেমন ব্যক্ত হয় নাই । মানবচরিত্রের বিভিন্নতায় প্রেমের
প্রাগাঢ়তার তারতম্যই তাহাতে ভাল বুখা যায় । পাশ্চাত্ত্য প্রেমেও
অধীরতা , উৎকণ্ঠা দেখা যায় ; কিন্তু প্রাচ্য কবির মত সে ভাব
পাশ্চাত্ত্য কবি ব্যক্ত করিতে পারেন নাই । তাহার কারণ বোধ হয়
, অধীরতা উৎকণ্ঠার সহিত বিরহেরই বিশেষ ঘনিষ্ঠতা । বিরহ বিষয়ে
আমাদের কবি অদ্বিতীয় । বিরহবেদনা সকল দেশেই আছে - প্রণয়বিরহে
প্রণয়িনী অধীরা । না থাকিবে কেন ? অন্য দেশেও ত এই মানবেরই বাস
, তাহাদের হৃদয়ও ত মানবেরই মত । কিন্তু আমাদের কাব্য বিরহাচ্ছন্ন
। বিরহকে বিশ্লেষণ করিয়া দেশী কবি তাহার ভিন্ন ভিন্ন অবস্থা
পর্য্যন্ত বাহির করিতে চেষ্টা করিয়াছেন ।
প্রেমের মূলে সৌন্দর্য্য উভয় সাহিত্যে
। আমাদের বৈষ্ণব কবিরা এই সৌন্দর্য্যে তন্ময় । সেই জন্যই ত তাঁহাদের
প্রেমসঙ্গীতে তরঙ্গে তরঙ্গে সৌন্দর্য্য । সৌন্দর্য্যের হৃদয়ে
ডুবিতে ডুবিতে তাঁহাদের আর আশ মিটে নাই - যত ডুবিয়াছেন , ততই
আরও আরও । তাঁহারা কিছুতেই জুড়াইতে পারেন নাই । পাশ্চাত্ত্য
সাহিত্যে সৌন্দর্য্যের গভীর অগাধে এরূপ নিমজ্জন দেখা যায় কি
না সন্দেহ । বৈষ্ণব কবির ভাষা কেবলই সৌন্দর্য্যময়ী , আকুলতাময়ী
। পাশ্চাত্ত্য কবি সৌন্দর্য্যে আকুল হইয়া গাহিয়াছেন বটে , কিন্তু
সে আকুলতা আর এ আকুলতা বিস্তর তফাৎ । সৌন্দর্য্য-প্রেমে বৈষ্ণব
কবি তুলনারহিত । সে গভীরতা এবং বিস্তৃতি অন্যত্র দুস্প্রাপ্য
।
বৈষ্ণব কবির প্রেম জগন্ময় । প্রেমে তাঁহাদের স্থিতি , গতি ,
জীবন । প্রেম জীবনের দৈনন্দিন খুঁটিনাটি । তাঁহাদের প্রেমচর্চায়
প্রেমের সকল রস ধরা দিয়াছে । তাহা কেবলই সুখপ্রধান নহে । বৈষ্ণব
কবির সঙ্গীতে প্রেমের সহিত দুঃখ , জ্বালা , সহিষ্ণুতা । প্রাচ্য
সাহিত্যে এই প্রেমজ্বালা পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে বিরল । আমাদের
কবি প্রেমের সহিত জ্বালার অবিচ্ছেদ্য সম্বন্ধ ব্যক্ত করিয়াছেন
। যত তীব্র জ্বালা , তত গভীর প্রেম । প্রেমকে সহিতে হয় । সে
সুখ চাহে না , বিনিময় নহিলে মরিয়া যায় না , কেবল ভালবাসে । তাহার
আইন আদালত নাই , কুলমর্য্যাদা নাই ; যেখানে তাহার আবির্ভাব হয়
, অনিবার্য্য বলিয়া - না হইলে নয় বলিয়া । পাশ্চাত্ত্য কবিও এ
ভাব অবশ্য বুঝেন । কিন্তু আমাদের কাব্যে ইহা কি পরিস্ফুট !
পাশ্চাত্ত্য কাব্যে প্রেমের একটা
অনির্দেশ্যতা অনুভব করা যায় । এই অনির্দেশ্য অনুভবনীয় ছায়া-ভাব
আমাদের সাহিত্যেও বিরল নহে । আমাদের বংশীধ্বনিময়ী আকুলতায় এ
ভাব তরঙ্গায়িত । শুধু তাহাই নহে , মিলনের পূর্ণতার মধ্যেও একটা
আকুল অনির্দেশ্য কি-জানি-কি ভাব ধরিতে পারিয়াছেন । প্রাচ্য কবিতায়
এ ভাব অনেক স্থলে দেখা যায় । ভারতের কবিই ত প্রথম মিলনের মধ্যে
সুখ কি দুঃখ ঠাওরাইয়া উঠিতে না পারিয়া আকুল হৃদয়ে গাহিয়া উঠিয়াছিলেন
। সে ভাবের প্রতিধ্বনি বর্ত্তমান শতাব্দীর পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যেই
খুঁজিলে মিলিতে পারে । অন্যত্র মিলে কি না জানি না ।
প্রেমের একটা ভাব আমাদের ভাষায়
সুন্দর ব্যক্ত । সে ভাব আধ-আধ চাহনি আধ হাসি , আধ চরণে আধ চলন
। কটাক্ষের তীব্রতা এখানে বিলুপ্ত , হাস্যের ভঙ্গী নাই গমনে
হেলিয়া দুলিয়া ঢলিয়া পড়ার ভাব নাই , অথচ ইহার মধ্যে প্রেমের
ঢল ঢল সৌন্দর্য্য পূর্ণ অভিব্যক্ত । আড় নয়নের অপেক্ষা আধ চাহনিতে
যেন শ্রী আছে , কোমলতা আছে । আভিধানিক সংজ্ঞায় তাহা স্পষ্ট বুঝান
যায় না । আধ হাসির হৃদয়ে তীব্র বিদ্যুচাঞ্চল্য প্রকাশ পায় না
, তাহাতে কেবলই একটি মাধুরার সন্নিবেশ । পাশ্চাত্ত্য ভাষায় এই
ভাবের অবিকল অনুবাদ মিলে কি না , বলা সহজ নহে । তবে প্রেমের
চাহনি , প্রেমের হাসি প্রেমের চলন পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে অনেক
আছে । নহিলে অতবড় সাহিত্য টিঁকে ?
প্রেমের বাঁশী কিন্তু আমাদের মত আছে কাহার ? বাঁশীর প্রেম পাশ্চাত্ত্য
কবি আমাদের মত বুঝেন না । শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনির রাধাময় কাতরতা
তাঁহারা বুঝিবেন কিরূপে ? বৈষ্ণব কবি সে বাঁশীর মর্ম হৃদয়ঙ্গম
করিয়াছেন - কারণ , তাঁহার হৃদয়ে সে বাঁশী বাজিত । বৈষ্ণব কবি
বাঁশীর স্বরে বিষামৃতের একত্রীকরণ অনুভব করিয়াছেন , তাহার রন্ধ্রে
রন্ধ্রে যে ভাব ধ্বনিত হয় , তাহার সন্ধান লইয়াছেন , স্বভাবের
সহিত তাহার মধুর সামঞ্জস্য বুঝিয়াছেন । প্রকৃতির সুর সম্বন্ধে
তাঁহাদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল সন্দেহ নাই । শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনি
লতাকুঞ্জের শিরায় কেমন একটা কম্পিত অধীরতা বিকশিত করিত ; যমুনার
ঘন নীল তরঙ্গে তরঙ্গে কি প্রবাহময় চাঞ্চল্য স্পর্শ দিয়া যাইত
, বৈষ্ণব কবিই তাহা ধরিয়াছেন । আর রাধার হৃদয়ের উপর সে বাঁশীর
প্রভাব ? তাহা আর বলিবার আবশ্যক নাই । প্রেমের শব্দ , স্পর্শ
, সৌন্দর্য্য , রস , সকলই বৈষ্ণব কবি বুঝেন । প্রেমের অতীন্দ্রিয়তাও
তাঁহাদের অজ্ঞাত নহে । বৈষ্ণব কবির কাব্যই প্রেম ।
প্রাচ্য সাহিত্যে প্রেমের সহিত প্রকৃতির ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের পূর্বেই
আভাস দেওয়া হইয়াছে । কোকিল মলয় বসন্ত , মেঘ বৃষ্টি বর্ষা ইত্যাদি
উদাহরণ । পাশ্চাত্য সাহিত্যেও প্রণয়কাল May । May আমাদের বসন্তের
সহিত কতকটা মিলে । আমাদের বর্ষার ব্যাপার পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে
না মিলিবারই কথা । এ দেশের কবিরা ঋতুতে ঋতুতে প্রেমের ভাব আলোচনা
করিয়া দেখিয়াছেন । পাশ্চাত্ত্য দেশে এত ঋতুভেদ বোধ করি নাই ,
সুতরাং ভাবেরও প্রতিদিন পরিবর্তন হয় না । কিন্তু যে কয় ঋতু আছে
, তাহার প্রত্যেক পরিবর্তনে প্রেমের ভাবের পরিবর্তন কি সে দেশে
এরূপ আলোচিত হইয়াছে ? জানি না ত । এ দেশে বসন্ত বর্ষার বিরহের
প্রভেদ অনেকদিন হইতেই আলোচনা হইয়া আসিতেছে । কোন কোন বৈষ্ণব
কবি সকল ঋতুরই ভাব লইয়া আলোচনা করিয়াছেন ।
কালিদাসের মেঘদূতের অত সৌন্দর্য্য
- বাহ্য প্রকৃতির হৃদয়ের ভাবের সম্মিলনে । অত কথায় কাজ কি ,
মেঘকে বিরহের দূত না করিলে তাঁহার সকলই ব্যর্থ হইত । কালিদাসের
মেঘদূতে মধ্যে মধ্যে বহিঃপ্রকৃতিতে প্রেমের অভিব্যক্তি প্রায়ই
দেখা যায় । পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যেও এ ভাব অনেক স্থলেই দেখা যায়
। শেলীর প্রেমতত্ত্ব ত এ ভাব লইয়া রীতিমত তত্ত্ব হইয়া দাঁড়াইয়াছে
। পাশ্চাত্ত্য কাব্যে আরও উদাহরণ মিলিতে পারে । বাহুল্যভয়ে এখানেই
নিবৃত্ত হইলাম ।
প্রেমের স্বাধীন মুক্ত ভাব পাশ্চাত্ত্য
সাহিত্যে যেরূপ মিলে , আমাদেরও কি সেইরূপ ? বৈষ্ণব কবিদিগকে
ছাড়িয়া দিলে আমাদের মুক্তভাব অল্পই । সংস্কৃত কবিরাও দাম্পত্য
প্রণয়ের সঙ্গে অনেক সময়ে মুক্তভাব যোগ করিয়া দিয়াছেন । মুক্তভাবে
বৈচিত্র্য সুব্যক্ত । ইদানীন্তন বঙ্গসাহিত্যের কবিরা প্রেমকে
বদ্ধ করিয়া পঙ্কিল করিয়া তুলিয়াছেন । প্রেমের শিক্ষা হয় নাই
, অথচ তৃষ্ণা প্রবলা ; সুতরাং স্বভাবতই উচ্ছৃঙ্খলতার আবির্ভাব
। উদাহরণ - বিদ্যাসুন্দর । মুক্ত ভাবে যে সুগভীর সংযত শিক্ষা
হয় , প্রাচীরবেষ্টিত বিলাসের মধ্যে তাহা হয় না । বৈষ্ণব সাহিত্যই
আমাদের মুখ রক্ষা করিয়াছে । নহিলে , কেবল সংস্কৃত সাহিত্যের
দুই-চারিখানি প্রেমকাব্য - লইয়াই আমাদের নাড়াচাড়া করিতে হইত
। কৃষ্ণনগরের রাজসভা-বর্দ্ধিত সাহিত্যের ত আর উল্লেখ করিয়া আমাদের
গৌরব করা চলিত না ।
প্রাচ্য সাহিত্যে প্রেমের সহিত
একটা বিশেষ লজ্জার ভাব জড়িত । পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে প্রেম-নির্লজ্জ
নয় বটে , কিন্তু আমাদের দেশের মত তাহা একেবারে লজ্জা-আচ্ছন্ন
কি না , জানি না ত । হয় ত উভয় দেশের লজ্জার প্রকৃতি ভিন্ন ।
সেই জন্য আমাদের প্রেমকে যেরূপ সলজ্জ মনে হয় , পাশ্চাত্ত্য প্রেমকে
সেরূপ মনে হয় না । Blush করা কিন্তু উভয় দেশেরই সাধারণ প্রকৃতি
বলিয়া বোধ হয় ।
পাশ্চাত্ত্য প্রণয়াপেক্ষা আমাদের
প্রণয়ে সহচরী-সান্ত্বনার যেন কিছু আধিক্য দেখা যায় । বিরলবাস
উভয় সাহিত্যেই । সখীসমাগমে আমাদের সাহিত্যে কণ্ঠধ্বনিটা জমে
ভাল । সখীরা থাকায় অনুরাগ ব্যক্ত করিবার সুবিধা মন্দ নয় । তাই
বলিয়া সকল সময়ে সখীসঙ্গ অসহ্য । আমাদের কবিরা কোন্ অবস্থায় সখীকে
রাখিতে হইবে , কোন অবস্থায় বা বিদায় দিতে হইবে বুঝেন । মানসিক
অবস্থার উপরেই তাহা নির্ভর করে । পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে যে একেবারে
সখীবিবর্জ্জিত , তাহা বোধ হয় না , তবে আমাদের সখীসমাগমে কিছু
জমাট্ অধিক । পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে এতটা নহে ।
প্রাচ্য সাহিত্যের কে-জানে-কাহাকে
অভিশাপ ভাব কি পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে আছে ? বোধ হয় না । আমাদের
রাধার এ অনির্দেশ্য অথচ সুস্পষ্ট অভিশাপ অন্যত্র দুস্প্রাপ্য
। কিন্তু পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে প্রেমের কতকগুলি সূক্ষ্ম শিরার
তাড়িত স্পর্শ অনুভব করা যায় । তাহাতে প্রেমের মৃদু অব্যক্ত সৌন্দর্য্য
অনেকটা প্রকাশ পায় । তাহা হইতে অব্শ্য এমন প্রমাণ হয় না যে ,
প্রেমের সূক্ষ্ম ভাবগুলি এ দেশের কবিরা আয়ত্ত করিতে পারেন নাই
। তবে ভাববিশেষ পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যেই সমধিক ব্যক্ত ।
যে তরুণ সাহিত্যে এই প্রাচ্য এবং
পাশ্চাত্ত্য প্রেমবৈচিত্র্যের শুভ সম্মিলন , সে সাগর-সঙ্গম সাহিত্যের
ভবিষ্যৎ না জানি কি উজ্জ্বল । সে সাহিত্য হইতে যে প্রেমস্রোত
প্রবাহিত হইয়া জগতের হৃদয় সিক্ত করিবে , তাহাতে ধরণীর সমস্ত
রক্তচিহ্ণ মুছিয়া দিয়া এক শান্ত আনন্দের আবির্ভাব হইবে । প্রেমের
প্রতিষ্ঠা ভিন্ন আর নব্য সাহিত্যের অভ্যুদয় সম্ভাবনা নাই । এখন
কেবলই সেই প্রেম চাহি - প্রেম আর প্রেম ।
( ক্রমশঃ )
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)