পুরনো
দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ
(সূচী)
প্রেম
: প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য ১
২
বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর
[ লেখক
পরিচিতি : ১৮৭০ খৃষ্টাব্দের ৬ই নভেম্বর কলকাতার জোড়াসাঁকোয়
জন্ম । পিতা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের চতুর্থ পুত্র বীরেন্দ্রনাথ
ঠাকুর । বলেন্দ্রনাথ ছিলেন বীরেন্দ্রনাথের একমাত্র সন্তান।
মাতা প্রফুল্লময়ী দেবী । ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে বলেন্দ্রনাথ হেয়ার
স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । ছাত্রাবস্থাতেই
তার সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় মেলে । তার রচিত প্রবন্ধ ছাড়াও
ছোট গল্পেরও সাহিত্য মূল্য অসাধারণ । জ্ঞানদানন্দিনী দেবী
সম্পাদিত 'বালক' পত্রিকার ১২৯২ বঙ্গাব্দের জৈষ্ঠ্য সংখ্যায়
তার প্রকাশিত 'একরাত্রি' প্রবন্ধ এবং ফাল্গুন সংখ্যায় প্রকাশিত
'সন্ধ্যা' কবিতাই তার প্রথম গদ্য ও পদ্য রচনা । তার জীবিতাবস্থায
মাত্র তিনখানি গ্রন্থ প্রকাশিত হযেছিল : প্রবন্ধ সংকলন 'চিত্র
ও কাব্য' (১৮৯৪ খৃষ্টাব্দ) এবং কাব্যগ্রন্থ 'মাধবিকা' (১৮৯৬
খৃ) ও শ্রাবনী (১৮৯৭ খৃ) । তিনি সংস্কৃত কাব্যও সমালোচনা করেছেন
। 'ভারতী' , 'বালক' , 'সাহিত্য' ইত্যাদি পত্রিকায় তিনি নিয়মিত
লিখতেন । তার কাকা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও তিনি সাহিত্যকর্মে
যুক্ত ছিলেন । স্বদেশী বস্ত্রের কারবারেও তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন
; এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথও ছিলেন তার সহযোগী ।
২৬ বছর বয়সে ডক্টর ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা সাহানা
দেবীর সঙ্গে বলেন্দ্রনাথের বিবাহ হয় । তিনি নিঃসন্তান ছিলেন
। শেষ জীবনে আর্য্যসমাজের সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের মিলনের জন্যও
তিনি সচেষ্ট হয়েছিলেন । এই ধারাবাহিকে প্রকাশিত মাতা প্রফুল্লময়ী
দেবী রচিত 'আমাদের কথা'য় তার ব্যক্তিজীবনের কিছু খণ্ডচিত্রের
পরিচয় মেলে । স্বল্পায়ু বলেন্দ্রনাথ ছিলেন ঠাকুরবাড়ীর একটি
বিস্ময়কর প্রতিভা । তার রচিত বার্তমান প্রবন্ধটি প্রকাশিত
হয়েছিল 'ভারতী ও বালক' পত্রিকায় । এই রচনায় তার মননশক্তি ,
চিন্তার গভীরতা ও বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণ ক্ষমতার কিছুটা পরিচয়
পাওয়া যাবে । মাত্র ২৯ বছর তিনি জীবিত ছিলেন । ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দের
২০শে অগাষ্ট তার মৃত্যু হয় । ..
দীপক সেনগুপ্ত]
|| ২ ||
বৈষ্ণব কবিদিগের
কল্যাণে আমাদের প্রেম-সাহিত্য বজায় রহিয়া গেল বটে, কিন্তু পাশ্চাত্ত্য
দেশের প্রেমের যেরূপ স্বাধীন চর্চা হইয়াছে, আমাদের সেরূপ কোন
কালে হয় নাই। আমাদের সামাজিক রীতিনীতি সকলই স্বাধীন প্রেমচর্চার
বিরোধী। প্রেমের সম্যক স্ফূর্তির পূর্বেই আমাদের দাম্পত্য বন্ধন;
সুতরাং স্বাধীন প্রেমচর্চার আবশ্যকই থাকে না। প্রাচীন কালে এ
দেশে স্বয়ম্বর প্রথা ছিল, স্বেচ্ছাপূর্বক অভিলষিত ব্যক্তির সঙ্গে
পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হওয়া যাইত; কিন্তু তাহাতে যে পাশ্চাত্ত্য
দেশের ন্যায় প্রেমবৃত্তির এ দেশে সম্যক্ অনুশীলন হইয়াছে, তাহা
নহে। স্বয়ম্বর প্রথায় রূপ এবং গুণ মূল উপাদান। কিন্তু পরস্পরের
হৃদয়ে স্ব স্ব প্রেমের সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করিতে কত যত্ন কত
অনুষ্ঠান। এই সকল আশা নৈরাশ্য উদ্যম অনুষ্ঠানের মধ্যে প্রেমচর্চা
না হইয়া থাকিবার জো নাই। স্বয়ম্বরে গুণের সহিত, হৃদয়বৃত্তির
সহিত সংঘর্ষে আসিতে হয় না, তাহা কেবল শ্রুত মাত্র। পাশ্চাত্ত্য
দেশের সমাজ-গঠন স্ত্রী এবং পুরুষের স্বাস্থ্যজনক সম্মিলনের অনুকুল,
বিশেষতঃ প্রেমের উপরেই সেখানে দাম্পত্য-বন্ধন অনেকটা নির্ভর
করে, প্রেমের স্বাধীন চর্চা এই কারণে অপরিহার্য্য। আর প্রেমের
স্বাধীন চর্চায় বাধা দিতে না পারিলেই হিব্দু সমাজের ভিত্তি ভাঙ্গিয়া
যায়। প্রেম ত আর জাতি কূল বিচার করিয়া আসে না। তবে দৃঢ় সমাজ-বন্ধনে
বাঁধিয়াও নাকি মানব-প্রবৃত্তিকে একেবারে চাপিয়া রাখা যায় না,
সেই জন্য শৃঙ্খলজর্জ্জর বদ্ধ সমাজ-হৃদয়ের মধ্য হইতেও প্রেমের
মুক্ত ভাবের সঙ্গীত উঠিয়াছে। এই মুক্ত ভাব আমাদের বৈষ্ণব কবিদিগের
রচনায়। প্রেম প্রধান বৈষ্ণব ধর্ম হিন্দু সমাজের নিগড়বদ্ধ সঙ্কীর্ণতার
বিরুদ্ধে স্বাধীনতাপ্রয়াসী উদার হৃদয়ের প্রবল বিদ্রোহ। যেখানে
ব্রাহ্মণ শূদ্রস্পর্শে আপনাকে কলঙ্কিত বোধ করিতেন, সেখানে বৈষ্ণব
ধর্ম চিররুদ্ধদ্বার মুসলমানকে পর্য্যন্ত প্রেমালিঙ্গন দিতে কুণ্ঠিত
হইল না। বৈষ্ণব ধর্ম যে মুক্ত প্রেমের আধার হইবে, তাহাতে আশ্চর্য্য
কি? প্রেমানুশীলনেই ত সে হিন্দু সমাজের অন্তরে অন্তরে আঘাত দিয়াছিল।
ভাগবতের কবি বোধ করি, প্রেমের মুক্ত ভাবে আবশ্যিকতা প্রথম অনুভব
করিয়াছিলেন; বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রভৃতি বৈষ্ণব কবিরা তাঁহার
কার্য্য অগ্রসর করিয়া দেন, চৈতন্যে আসিয়া সেই মুক্ত ভাবের সম্পূর্ণ
বিকাশ হইল - সে ভাব আকার প্রাপ্ত হইয়া কার্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ
হইবার অবসর পাইল। পূর্বে যাহা অসম্পূর্ণ অবস্থায় বীজভাবে লুকায়িত
ছিল, চৈতন্যে তাহার পূর্ণ প্রকাশ। আমাদের সমাজে বা সাহিত্যে
আদিরসের প্রাবল্য সত্ত্বেও প্রেমের বৈষ্ণব অনুশীলন কোথায়? ইদানীন্তন
কবিরা মধ্যে মধ্যে সমাজ নিয়মের ব্যতিক্রম করিয়াছেন বটে, কিন্তু
মুক্ত ভাবে অনভ্যাসে কেবল একপ্রকার অস্বাস্থ্যকর হীন ভাব রহিয়া
গিয়াছে মাত্র। আর বৈষ্ণব প্রেমচর্চাও ত চলিল না। এখানে সেই যন্ত্র-নিয়ম।
সুতরাং প্রেমের গঠনকার্য্য এবং শিক্ষা সম্বন্ধে পাশ্চাত্ত্য
জাতির মত অভিজ্ঞতা আমাদের সম্ভব নহে। সে সমাজের গঠন প্রণালীই
প্রেমচর্চার অনুকুল।
কিন্তু তথাপি
পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যকে আমরা কিছু দিয়া যদি ধরিতে পারি ত সে প্রেম।
এমন কি, সময়ে সময়ে মনে হয় যে, বৈষ্ণব কবিদিগের সাহায্যে পাশ্চাত্ত্যকে
আমরা ছাড়াইয়া উঠিতে পারি বা। ইহা দুরাশা এবং শূন্যগর্ভ কল্পনা
হইতে পারে, কিন্তু এমন দুরাশাও মধ্যে মধ্যে হৃদয়ে জাগে। বোধ
করি, এক দিক্ দিয়া দেখিলে আমাদের এ কল্পানাও কতকটা সত্য হইয়া
দাঁড়ায়। সে দিক্ প্রেমভাবের সাধারণ বৈচিত্র্য। সাধারণ বৈচিত্র্য
কাহাকে বলে, বুঝান কিন্তু সুকঠিন। বৈষ্ণব কবির প্রেমচর্চায় স্ত্রীপুরুষের
প্রণয় ব্যতীত প্রেমের সখ্য এবং বাৎসল্য রস আলোচিত হইয়াছে, এমন
কি, পশুজগৎ সে প্রেম হইতে বঞ্চিত হয় নাই। এ হিসাবে অবশ্য প্রেমের
সাধারণ বৈচিত্র্য কতকটা বুঝান যায়। কিন্তু স্ত্রীপুরুষের প্রেমের
সাধারণ বৈচিত্র্য কিছু স্বতন্ত্র। বৈষ্ণব কাব্যে বিশেষ বিশেষ
সাধারণ অবস্থার স্বতন্ত্র ভাব লইয়া যে আলোচনা আছে, তাহাতেই সাধারণ
বৈচিত্র্য সমধিক ব্যক্ত বলিয়া বোধ হয়। শুধু, অবস্থাভেদ অবশ্য
সর্বস্ব নহে, প্রেমের একটা সাধারণ ভাবও ইহার মধ্যে থাকা চাই।
প্রেমের এই সাধারণ ভাব - সাধারণ বৈচিত্র্য নহে - পাশ্চাত্ত্য
কাব্যে বহুল। বৈষ্ণব কাব্যেও ইহার অভাব নাই। সাধারণ বৈচিত্র্যের
সংজ্ঞা নির্দেশ করিতে না পারিলেও আমরা তাহার উদাহরণ দেখাইতেছি।
রাধাকৃষ্ণের প্রেমালোচনায় বিরহ, ভূত-বিরহ, ভাব-বিরহ, মান, অভিসার,
এই সকল প্রেমের সাধারণ বৈচিত্র্যের সমকক্ষতা স্পর্দ্ধা করি।
কিন্তু প্রেমের আর এক দিকে আমরা বড় অগ্রসর নহি। মোটামুটি তাহাকে
কাহিনী-বৈচিত্র্য বলা যাইতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কাহিনী-বৈচিত্র্য
সে দিকের গভীরতা এবং বিস্তৃতির ভাব প্রকাশ করিতে অক্ষম। পাশ্চাত্ত্য
কবিরা বিবিধ চরিত্রগঠনে প্রেমের নানা দিক দেখাইয়াছেন। তাঁহাদের
প্রেমের সহিত সংসারের নানাবিধ জটিল সম্পর্ক, মানব-চরিত্রের নিগুঢ়
রহস্য। অনেক সময়ে যৌবনের একটা ব্যক্তিবিশেষবদ্ধ নহে, এমন তীব্র
আকাঙ্খা পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে বিশেষ পরিস্ফুট দেখা যায়। বৈষ্ণব
কবিদের এরূপ ব্যক্তিসম্পর্কশূন্য অথচ মানবপ্রেম বোধ করি নাই।
ইহা ভিন্ন প্রেমের আরম্ভের বিবিধ জটিল রহস্য পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে
যেরূপ সুব্যক্ত, আমাদের সেরূপ বোধ হয় না। কিন্তু এ সকল কথার
দুই চারি কথায় মীমাংসা অসম্ভব। বর্তমান লেখকের এ বিষয়ে মীমাংসার
ক্ষমতা নাই। সত্যের অনুরোধে বলিতে হয় যে, ব্যুৎপত্তি অভাবে বিষয়টি
তাঁহার সম্পূর্ণ আয়ত্ত নহে। বিশেষতঃ পাশচাত্ত্য দেশ সম্বন্ধে
পদে পদে ভ্রম সম্ভাবনা।
পূর্ব প্রবন্ধে
আমরা দেখাইয়াছি, পাশ্চাত্ত্য দেশে মানবপ্রকৃতিগত বিরহ, অভিমান
প্রভৃতি থাকিলেও এদেশের সাহিত্যের মত পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে এ
সকল বিষয় তেমন প্রাধান্য লাভ করে নাই। বিরহ সে দেশেও আছে, এবং
অবিকল প্রতিশব্দের অভাব থাকিলেও কাব্যে বিরহভাব পাওযা যায়। কিন্তু
আমাদের দেশের মত বিরহ-কাব্য পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে দুর্লভ। তাহার
কারণ, সামাজিক অবস্থার প্রভেদ। অন্যান্য বিবিধ কারণও হয় ত ইহার
মূলে অল্পনিস্তর কার্য্য করে; যেমন, প্রকৃতির প্রভাব, জাতির
চরিত্রগত বিশেষত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। বিরহজ্বালা কিন্তু মানবপ্রকৃতির
স্বভাবসিদ্ধ। প্রিয়জনকে আমরা কাছে কাছে রাখিতে চাই। যখন আমরা
দর্শন স্পর্শন শ্রবন হইতে বঞ্চিত হই, তখন স্বভাবতই কাতর হইয়া
পড়ি। প্রাচ্য হৃদয়ের সহিত পাশ্চাত্ত্য হৃদয়ের এখানে প্রভেদ হইতে
পারে না। তবে নানা অবস্থাভেদে আমাদের বিরহ পাশ্চাত্ত্য বিরহ
হইতে স্বতন্ত্র এবং দারুণ। কেহ কেহ বলেন, পাশ্চাত্ত্য হৃদয় অবিশ্রান্ত
উদ্যমে প্রকৃতিকে দমন করিয়া রাখে - সম্পূর্ণ জোর করিতে দেয় না,
আর আমরা তাহার প্রভাবে খানিকটা ভাসিয়া যাই, এই কারণে আমাদের
সহিত পশ্চিমের বিরহ বিষয়ে এত প্রভেদ। এ কথা অভ্রান্ত কি না জানি
না, কিন্তু নিতান্ত অশ্রাব্য নহে।
মানাভিমানের
ব্যাপার আলোচনা করিয়া দেখিলে বিভিন্ন সামাজের প্রভাব আরও সুস্পষ্ট
বুঝা যায়। সামান্য খুঁটিনাটি লইয়া কৃত্রিম অভিমান সকল দেশেই
আছে। কিন্তু অভিমানের বিষয়ে হাত নাই। স্বামী ইচ্ছা করিলে পুনর্বার
দারপরিগ্রহ করিতে পারেন, সুতরাং অন্যের প্রতি তিনি অনুরক্ত জানিলেও
স্ত্রীর কিছু বলিবার অধিকার নাই। দুই দিন গৃহকোণে নয়নজলে তাহার
অভিমান সমাপন করিতে হয়। অধিক দূর গড়াইলে হয় ত দুইটি মিষ্ট বচন
এবং স্বামীদর্শনসুখলাভ হইতেও বঞ্চিত হইয়া সধবাবস্থায় বৈধব্য
যন্ত্রণা বহন করিতে হইবে। অগত্য দুই দিনের সাধনাতেই পরিতৃপ্ত
হইয়া আবার পূর্ববৎ ভাব অবলম্বন না করিলে চলে না। অভ্যাসবশতঃ
পুরুষের অন্যানুরক্তি স্ত্রীর নিকট তেমন গুরুতর কিছুই নহে। ইংরাজ
স্ত্রীর আমাদের স্ত্রী অপেক্ষা স্বাধীনতা এবং ক্ষমতা আছে। তাঁহাদের
প্রেমের সহিত বিশেষরূপে সম্মানের ভাব জড়িত। প্রেমের মূল নিয়মে
আঘাত এই জন্য ইংরাজ স্ত্রীর অসহ্য। সেখানে আঘাত পড়িলে তাঁহার
সমস্ত সম্মানে আঘাত পড়ে। পাশ্চাত্ত্য দেশে অবরোধপ্রথা ত সম্মান-প্রমাণ
নহে, প্রেমের একনিষ্ঠতা পুরুষের পক্ষেও নিতান্ত আবশ্যক। এই নিয়ম
ভঙ্গ করিলে দম্পতির দৃঢ় বন্ধনও ছিঁড়িয়া যায়। সুতরাং আমাদের অভিমানে
চোখের জলের যেটুকু রস থাকে, পাশ্চাত্ত্য অভিমানে সকল সময়ে তাহা
না থাকিতেও পারে। এ দেশে ভাঙ্গা মান দুই চারিটি মিষ্ট কথায জোড়া
লাগে। পাশ্চাত্ত্য দেশে ভাঙ্গিলে গড়া তত সহজ নহে। স্ত্রী পুরুষ
কাহার পক্ষে কোনটা কত দূর সুবিধা অসুবিধা, স্বতন্ত্র কথা; কিন্তু
ইহা হইতে সামাজিক অবস্থাভেদে প্রেম-ভাবের বিভিন্নতা সহজেই উপলব্ধি
হয়। বিভিন্ন সমাজের কাব্যও তাই স্বতন্ত্র ভাবের।
পাশ্চাত্ত্য সমাজের সহিত আমাদের সমাজের খুঁটিনাটি কোথায় কিরূপ
প্রভেদ জানি না, কিন্তু প্রধানতঃ মুক্ত ভাবেই বোধ করি, এ দেশের
সহিত পশ্চিমের অনৈক্য। আমাদের বদ্ধ অবরোধ এবং নিশ্চেষ্ট সুখই
জীবনের প্রধান উপভোগ। পাশ্চাত্ত্য দেশে অবিশ্রান্ত স্বাধীন জাতির
প্রেমে সুগভীর সম্মানের প্রতিষ্ঠা - প্রেমকে সে জাতি লঘু ভাবে
দেখিতে পারে না। আমরা প্রেমকে ততটা সম্মান দিই না। তবে বৈষ্ণব
কবির নিকট প্রেমের মর্য্যাদা আছে।
তাহা হইলে
বৈষ্ণব কবির রাধাকৃষ্ণের প্রেম আলোচনা করিয়া দেখা যাইতে পারে।
দাম্পত্য প্রণয় না হইলেও প্রেমের সম্মানের তারতম্য কতকটা বুঝা
যায়। রাধিকা কৃষ্ণের প্রতি একান্ত অনুরক্তা, কৃষ্ণের জন্য তাঁহাকে
কূলে শীলে জলাঞ্জলি দিতে হইয়াছে, কিন্তু কৃষ্ণ ত সেরূপ একনিষ্ঠ
নহেন। বার বার প্রেমের নিয়ম লঙ্ঘন করিয়া তিনি রাধার নিকট অপরাধী
হইয়াছেন, তবুও রাধা ক্ষণিক অভিমানের পর কথা না কহিয়া থাকিতে
পারেন না। রাধার কথাবার্তায় বা ভাবভঙ্গিতে মর্মাহত পাশ্চাত্ত্য
রমণীর তেজভাব বড় নাই। তবে বৈষ্ণব কবির প্রেমে সম্মানের গভীরতা
কোথায়? কিন্তু এইখানে একটি কথা আছে। রাধাকৃষ্ণের প্রেম বৈষ্ণব
কবি কি ভাবে দেখিতেন? বৈষ্ণব কবির কৃষ্ণ এই বিপুল সংসারের পালনকর্ত্তা।
রাধা তাঁহার সৃষ্টি। অসীমের প্রেম পরিমিত আত্মার মধ্যে বদ্ধ
থাকিতে পারে না, বিপুল সংসারে সর্বত্রই ত তাঁহাকে প্রেম বিতরণ
করিতে হইবে। রাধার কিন্তু কৃষ্ণে সম্পূর্ণ তৃপ্তি। রাধার অভিমান
কেবল কৃষ্ণকে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিতে না পারিয়া। কিন্তু এ আধ্যাত্মিক
ভাবে দেখিলে কিছুই বুঝা যায় না। একটু নামাইয়া দেখিতে হইবে তাহা
হইলে আবার বৈষ্ণব কবির উদ্দেশ্যের অবমাননা করা হয়। সকল বৈষ্ণব
কবিই যে আধ্যাত্মিক ভাবে তন্ময় হইয়া রাধাকৃষ্ণের প্রেম বর্ণনা
করিয়াছেন, তাহা নাও হইতে পারে, কিন্তু তাঁহারা হয় ত পূর্বকবিদিগের
পদানুসরণ করিয়াছেন মাত্র। কিন্তু এ ভাবেও প্রেমের সম্মানভাব
কতকটা বুঝা যায়। সসীমের ঐকান্তিক নিষ্ঠায় অসীমও বাঁধা পড়িয়াছে;
ইহা কি সমান্য মর্য্যাদা? তবে প্রেমের ত্রুটি করিয়া কৃষ্ণ সমস্ত
জগৎ উপেক্ষা করিয়া রাধার মধ্যে সঙ্কুচিত হইয়া থাকিতে পারেন না।
রাধার তাহাতে তৃপ্তি না হইতেও পারে, নাচার।
কিন্তু অসীম
না গিয়াও বৈষ্ণব কবির প্রেমের সম্মনভাব দেখা যায়। বৈষ্ণব সাহিত্যে
ঈশ্বরপ্রেমের মানবীকরণ হইয়াছে। সম্মানভাব এ সাহিত্যে যদি না
থাকিবে, তবে এত প্রেমের গান কেন? আমরা চণ্ডীদাসের একটি গান হইতে
বৈষ্ণব প্রেমসম্মান দেখাইতেছি। রজকিনীকে তিনি যখন প্রেম জানাইয়াছেন,
তখন বিশেষ করিয়া বুঝাইয়াছেন, কামগন্ধ নাহি তায়। এইখানেই প্রেমের
সম্মানভাব পরিস্ফুট। যেখানে আধ্যাত্মিকতা এমন প্রবল, সেখানে
একনিষ্ঠতার অভাব হইতেই পারে না। সুতরাং বৈষ্ণব কবি প্রেমের একনিষ্ঠ
সম্মান বিষয়ে অনভিজ্ঞ নহেন। একনিষ্ঠতাই তাঁহার লক্ষ্য।
রাধাকৃষ্ণের
কাহিনী সমাজক্ষেত্রে কতকটা হয় ত লাগান যাইতে পারে। রমণীর প্রেমে
বদ্ধ হইয়া সংসারের সকল কাজকর্মে পুরুষ উদাসীন হইতে পারে না।
বাস্তবিক প্রেমের ধর্ম সঙ্কীর্ণতা নহে। কিন্তু সে কথা অস্বীকার
করিতেছে কে? পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সহিত এ কথার যোগই
বা কোথায়? একনিষ্ঠতা আবাশ্যক। তাহা ত সঙ্কীর্ণতা নহে। প্রেম
বিতরণে একনিষ্ঠতার হানি হয় না। প্রেমের ছলনা করিয়া যথেচ্ছাচারিতা
অবলম্বনই একনিষ্ঠতার হানিকর। এইখানেই প্রেমের সম্মান লোপ। আমাদের
সামাজিক নিয়মে ইহার বাধা নাই |
কিন্তু সমাজ-নিয়মের
বাধা না থাকিলেও প্রাচীন ভারতে পুরুষের একনিষ্ঠতার মহত্ত্ব উজ্জ্বল
চিত্রে প্রদর্শিত হইয়াছে। ঋষি-কবির রামচন্দ্রের চরিত্রই তাহার
জাজ্বল্যমান প্রমাণ। রামচন্দ্র দায় পড়িয়া সীতাকে বনবাস দিয়াছিলেন
বটে, কিন্তু সাধ্বী পতিব্রতার অকপট প্রেমের প্রতি ভুলিয়াও অবজ্ঞা
প্রকাশ করেন নাই। তিনি যজ্ঞ করিলেন - সুবর্ণের সীতা নির্ম্মান
করাইয়া। তপোবনের নীরবতার মধ্যে এই সংবাদ জানকীর নিরাশ হৃদয়ে
কি সান্ত্বনা দিয়াছিল ! রামায়নে প্রেমের অন্যান্য দিকও প্রদর্শিত
হইয়াছে; যেমন - স্নেহ, ভক্তি, সৌহার্দ। সে সকল দিক্ আলোচনায়
আমাদের এখন তেমন আবশ্যক নাই। আমরা কেবল বলিতে চাহি যে, মহৎভাবের
প্রতি সম্মান সর্বত্রই। প্রাচ্য বলিয়াই মানব চরিত্র অধঃপতিত
নহে।
স্ত্রীজাতির
প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ভাব হইতেই বোধ করি প্রেমের সম্মানভাবের
উৎপত্তি। পাশ্চাত্ত্য দেশে রমণীর প্রতি সম্মান-প্রদর্শন বহুদিন
হইতে বিবিধ উপায়ে অনুশীলিত হইয়া আসিতেছে। আমরা স্ত্রীজাতিকে
অর্ধাঙ্গ বলিয়া দেখি, পাশ্চাত্ত্যজতি উত্তমার্দ্ধ বলিয়া গণ্য
করেন। মধ্য যুগে Chivalry-র প্রসাদে পাশ্চাত্ত্যেরা রমণীকে যে
ঊর্দ্ধে উঠাইয়াছেন, শুনিলে আশ্চর্য্য বোধ হয়। কিন্তু তাহাতে
পাশ্চাত্ত্য জাতির হৃদয়ের আন্তরিকতা প্রকাশ পায়। পাশ্চাত্ত্যদেশে
সেই অবধি রমণীর সম্মান বাড়িয়া উঠিয়াছে। তবে মধ্যযুগের অনেক বাহ্য
অনুষ্ঠান এখন সরিয়া গিয়াছে। আমাদের দেশে অন্ধকূপে অসূর্য্যস্পশ্যা
করিয়া রাখার উপরেই রমণীর সম্মান নির্ভর করে। পুরুষ জাতির সহিত
মুখ দেখাদেখি না থাকায় সমাজের অর্ধাঙ্গের সম্মান বিষয়ে আমরা
নিশ্চিন্ত। পাশ্চাত্ত্য সমাজে স্ত্রীপুরুষে মিশামিশি আছে, উভয়েরই
তাহাতে সংযত হইয়া চলিতে হয়। বলবান পুরুষ রমণীকে সমধিক সম্মান
করিতে, স্ত্রীজাতিও পুরুষের সহিত আলাপাদিতে অনেক উন্নত শিক্ষা
লাভ করে। স্ত্রীর প্রতি বিশেষ সম্মান পাশ্চাত্ত্য সমাজের শিরায়
শিরায় না প্রবেশ করিলে সেখানে প্রেমের সংযত স্বাধীন চর্চা এত
দিন চলিত না। আমাদের সমাজে শুভদৃষ্টি পর্য্যন্ত রূপ, গুণ, ধর্ম,
কর্ম, সকলই ত পরের মুখে। পূর্বরাগমূলক দাম্পত্ত্যবন্ধন যে সমাজের
অস্থিমজ্জায়, সে সমাজে স্ত্রীপুরুষের স্বাস্থ্যকর সম্মিলন অপরিহার্য্য।
ভাল মন্দের কথা হইতেছে না - ইহা আবশ্যক, না হইলে নয়।
পূর্বরাগ মানব-প্র্কৃতির অস্বাভাবিক ধর্ম নহে। বোধ করি, অসূর্য্যস্পশ্যারাও
প্রেম-বিষয়ে স্বাধীনতা ভাল লাগে। এই প্রাচ্যদেশেও ত কাব্যে পূর্বরাগবাহুল্য
দেখা যায়। কিন্তু সামাজিক অবস্থাভেদে পূর্বরাগের ভাবভঙ্গী পাশ্চাত্ত্য
হইতে আমাদের স্বতন্ত্র। স্ত্রীপুরুষের মেলামেশার উপর সে সকল
খুঁটিনাটি প্রভেদ অনেকটা নির্ভর করে। বৈষ্ণব কবির কতকগুলি পূর্বরাগের
গান আছে - বড়ই সুন্দর, ভাবময়। ইদানীন্তন কবিরাও পূর্বরাগ বর্ণনা
করিয়াছেন। তাহা যেমনই হউক, মানবপ্রকৃতির পরিচয় প্রদান করে। দাম্পত্ত্য-বন্ধন
পূর্বরাগমূলক না হইলেও প্রেম গভীর হইতে পারে দেখাইয়া যাঁহারা
পূর্বরাগকে সামাজিক শিক্ষার ফল বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে চাহেন,
দৃঢ় সমাজবন্ধনের বহিঃক্ষেত্রে দৃষ্টিপাত করিলেই পূর্বরাগের স্বাভাবিকতা
উপলব্ধি করিতে পারিবেন। এ বিষয়ে বাহুল্যু প্রমাণের আবশ্যক নাই।
প্রাচ্য
সাহিত্যের সম্পূর্ণ নিজ-সৃষ্টি অভিসার। পাশ্চাত্ত্য দেশে অভিসার
নাই। সঙ্কেতস্থানে প্রণয়ী প্রণয়ীনির মিলন পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে
মিলিতে পারে, কিন্তু আমাদের অভিসার এ শুষ্ক সম্মিলন নহে। আকাশ
মেঘাচ্ছন্ন, ধরণী অন্ধকার, ক্ষণে ক্ষণে বিজলী হানিতেছে, একাকিনী
রাধা বিজন বনের মধ্য দিয়া চঞ্চলচরণে চলিয়াছেন। আমাদের কবির অভিসারে
সমস্ত প্রকৃতি ঘনাইয়া আসে, অন্তরের উপর বহিঃপ্রকৃতির ঘন নিবিড়
ছায়া পড়ে। এ কবিত্ব প্রস্ফুটিত করিতে প্রাচ্য কবিই পারদর্শী।
এ শ্রাবনের অবিশ্রান্ত বারিধারা, মেঘের উপর মেঘ, অন্ধকারের উপর
অন্ধকার, প্রবল বর্ষা অন্য দেশের কবি বুঝিবেন কিরূপে? আমাদের
বর্ষায় আকুলতাময় কদম্ব-সৌরভ, সচকিত হরিণ-দৃষ্টি, মধুর কেকাধ্বনি;
তাহার আনন্দ আমাদের প্রাচ্য কবিই বুঝেন। এমনটি কি আর অন্য দেশে
আছে? সেই জন্যই ত আমাদের বিরহ, আমাদের অভিসার পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে
দুর্লভ।
কিন্তু কেবল মাত্র প্রকৃতিই কি আমাদের অভিসারের কারণ? সমাজের
সহিত ইহার কোন সম্বন্ধ নাই? এ সম্বন্ধে নিঃসংশয়ে কিছু বলা সুকঠিন।
এই পর্য্যন্ত বলা যাইতে পারে যে, প্রকৃতির প্রভাব নিতান্ত উপেক্ষণীয়
নহে। আমাদের জাতীয় ভাব এবং সামাজিক অবস্থাও হয় ত অভিসার ভাবের
কতকটা অনুকূল। নহিলে, শুধু প্রকৃতির প্রভাবে যে এই বিষয় দেশ্যীয়
কাব্যে এত প্রাধান্য লাভ করিয়াছে, তাহা বিশ্বাস করিতে একটু সময়
লাগে এবং সন্দেহ বোধ হয়। বিরহের মত অভিসার ত সার্বজনীন নহে।
জানি না, অভিসারের মধ্যে সমাজ-নিয়মের ব্যতিক্রম-প্রয়াস লক্ষিত
হয় কি না। কিন্তু ইহাতে ত স্বাধীন প্রণয় কতকটা মনে হয়। আর অভিসারে
রমণীর প্রাধান্য দিয়া কবিত্ব অনেকটা ফুটিয়াছে। বৃষ্টি বজ্র বিদ্যুতের
মধ্যে অন্ধকার পথে একাকিনী রমণীর ভীত চকিত ভাব বড়ই সুন্দর। পাশ্চাত্ত্য
সমাজের অবস্থায় এ ভাব কিরূপ খুলে না খুলে, বলা সহজ নহে।
এখন সে কথা
থাক। কাব্যে যে দেশের যাহা যত থাকুক না থাকুক, বিরহ অভিমান প্রভৃতি
বিবিধ ভাব অল্পবিস্তর আছে সকল দেশেই। প্রেমের এ সকল অবস্থা আলোচনা
কিন্তু পাশ্চাত্ত্য অপেক্ষা প্রাচ্য দেশে খুব ভালরূপ হইয়াছে।
পাশ্চাত্ত্য কাব্যে প্রেমের অপর কতকগুলি অবস্থা সমালোচিত হইয়াছে।
যে অবস্থাগুলি সাধারণতঃ কাহিনী-বৈচিত্র্যের দিকে। প্রেমের দিক
দিয়া মান-চরিত্রের রহস্য উদ্ঘাটনচেষ্টা এ দেশে যে হয় নাই, এমন
নহে; সংস্কৃত কাব্য এবং নাটকে তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। পাশ্চাত্ত্য
সাহিত্যে কিন্তু তাহার সমধিক বৈচিত্র্য সম্পাদিত হইয়াছে সন্দেহ
নাই। তবে ভারতের প্রাচীন কবিরা প্রেমের যে গুটিকত আদর্শ চরিত্র
গড়িয়াছেন, তাহা কোন দেশের কোন চরিত্র অপেক্ষা হীন নহে। কিন্তু
পাশ্চাত্ত্য বিবিধ বৈচিত্র্য আমাদের সাহিত্যে নাই স্বীকার্য্য।
কত বিভিন্ন অবস্থার মানবের মনে কত বিভিন্ন ভাব হইতে প্রেম জন্মায়,
পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে তাহা সুচিত্রিত। এই প্রেম সংঘটনের মধ্যে
পুরুষ এবং স্ত্রীপ্রকৃতি নীরবে কি ভাবে কার্য্য করে, উভয় জাতির
নিজের মধ্যেও কত প্রকৃতিগত শিক্ষাগত বৈষম্য নানা দিক হইতে আসিয়া
নানা ভাবে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার অপর জাতির সহিত সম্মিলিত হয়,
এ সকল পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে বিচিত্র বর্ণে পরিস্ফুট। স্ত্রীপুরুষে
সিক্ষাগত এবং স্বাভাবিক মনোবৃত্তি সেখানে তন্ন তন্ন বিশ্লেষিত।
আমাদের এ বিশ্লেষণ পাশ্চাত্ত্য অপেক্ষা বিশেষ অসম্পূর্ণ |
পাশ্চাত্ত্য
প্রেমচর্চার সহিত আমাদের কোথায় যেন মূল প্রণালীগত প্রভেদ আছে
মনে হয়। নিশ্চিত বলিতে পারি না, কিন্তু আমার বোধ হয়, পাশ্চাত্ত্য
প্রেমচর্চা অনেকটা ইংরাজীতে যাহাকে Ideal বলে। আমাদের প্রেমচর্চাকে
সে হিসাবে কতকটা অনুভূতিমূলক বলা যাইতে পারে বোধ করি। পাশ্চাত্ত্য
সাহিত্যেও অনুভূতির অভাব নাই, তবে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্ত্য সাহিত্য
তুলনা করিলে প্রাচ্যকেই বিশেষরূপে অনুভূতিমূলক বলা যায়। এ সম্বন্ধে
সকল খুঁটিনাটি আমরা লক্ষ্য করিয়া দেখি নাই; মোটামুটি বাহিরে
বাহিরে যাহা মনে হয়, বলিয়াছি মাত্র। বৈষ্ণব কবির সহিত তুলনা
করিলে আরও দেখা যায়, পাশ্চাত্ত্য প্রেমে এ দেশের মত সাধনার কথা
বড় নাই। আমাদের বৈষ্ণব কবির প্রেমের বিশেষ সাধনা আছে, তাহাতে
অনেকটা ধর্ম| পাশ্চাত্ত্য প্রেমের কবিতা আর এক ধরনের। তাহা ধর্ম
নহে।
কিন্তু পাশ্চাত্ত্য
সাহিত্যে আমাদের শারীরিক মানসিক এবং আধ্যাত্মিক বৃত্তিগুলির
কাহার সহিত প্রেমের কিরূপ সম্বন্ধ, তাহা যেরূপ সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে
বিশ্লেষিত হইয়াছে, আমাদের সাহিত্যে তাহা হয় নাই। পাশ্চাত্য সমালোচনাপ্রণালীর
সূক্ষ্মদর্শিতা বাস্তবিক প্রশংসনীয়। প্রেমের এই বিশ্লেষণ ব্যাপারের
মধ্যে বিজ্ঞান দর্শনের কতটুকু কি সংস্রব আছে না আছে জানি না,
কিন্তু বিজ্ঞান এবং দর্শনশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি না থাকিলেও প্রেমের
এ জটিল সম্বন্ধ সাধাসিধা একরূপ বুঝা যায়। প্রেম সম্পূর্ণ একই
বৃত্তির সঙ্গে সম্বন্ধ নহে। তাহা কতকাংশে অনুভূতিমূলক, কতক বা
অন্যান্য মনোবৃত্তির সহিত জড়িত, আধ্যাত্মিক দিকও একটা আছে। ব্যক্তিবিশেষের
প্রেমে আবার প্রকৃতি অনুসারে বিশেষ বিশেষ বৃত্তির সমধিক প্রাধান্য
দেখা যায়। কাহারও প্রেম হয় তা ইংরাজীতে যাহাকে emotional বলে,
কাহারও বা intellectual| অবিকল ভাবপ্রকাশক বাংলা প্রতিশব্দ অভাবে
ইংরাজী কথাই আমাদিগকে ব্যবহার করিতে হইল।
প্রাচীন
ভারতে প্রেমের Intellectual অনুশীলন অনেকটা হইয়াছিল বোধ হয়।
কিন্তু এ দেশে প্রেমানুশীলন ঈশ্বর সম্বন্ধে। সেই জন্যই বহু পূর্বে
অন্য্যন্য দেশ যখন অরণ্যের স্তব্ধ অন্ধকারমধ্যে বিলীন হইয়া ছিল
. তখন ভারতের কবি নিষ্কাম প্রেমের নাম লইয়া অমর সঙ্গীত রচনা
করিয়া গিয়াছেন। বৈষ্ণব সাহিত্যে যে প্রেমের বিশ্বজনীনতা দেখা
যায় তাহাও ধর্মের সহিত যুক্ত বলিয়াই। দেবতাবর্জিত অথচ দেবভাবময়
প্রেম পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে সুপরিস্ফুট। পাশ্চাত্ত্য প্রেম মানব-সন্তানকে
মনুষ্যত্বে টানিয়া তুলে। ঈশ্বরপ্রেম আমাদিগকে অনন্তের দিকে ত
টানেই। বৈষ্ণব সাহিত্যে ঈশ্বরপ্রেমের মানবীকরণ হইয়াছে বলিয়াই
আমাদের প্রাচ্য সাহিত্যে এমন প্রেমানুশীলন। কিন্তু ঈশ্বরপ্রেম
আমাদের বর্তমান প্রবন্ধের বিষয় নহে। সেই জন্য তাহার চর্চা সম্বন্ধে
আমরা কিছু বলিতে পারি না। আমরা প্রধানতঃ স্ত্রী-পুরুষগত প্রেম
লইয়াই আলোচনা করিয়া আসিয়াছি |
মানবপ্রেমের
মধ্যেও স্নেহ ভক্তি প্রভৃতি নানা বিভাগ উপবিভাগ আছে। সে সকল
আমরা এ প্রবন্ধে বাদ দিয়াছি। বৈচিত্র্য এবং রহস্য স্ত্রীপুরুষের
প্রেমের মধ্যেই সমধিক ব্যক্ত। সেই জন্যই সম্ভবতঃ এ প্রেম সম্বন্ধে
যত কাব্য রচিত হইয়াছে, স্নেহ ভক্তি বিষয়ে তত হয় নাই। বাস্তবিক
স্ত্রীপুরুষ-প্রেমের প্রগাঢ়তা, সুখ দুঃখ, জ্বালা, ভয়, ভ্রান্তি
সকলই চুড়ান্ত। মনোবৃত্তির এরূপ অনুশীলন প্রেমের অন্যান্য বিভাগে
বোধ করি নই। এই এক প্রেমাকর্ষণে অতি ক্ষুদ্রভাবের মধ্যে হইতে
ধীরে ধীরে যেরূপ সুবৃহৎ আধ্যাত্মিকতার বিকাশ হইযাছে, দেখিলে
আশ্চর্য্য বোধ হয়। সমগ্র মানবজাতির সভ্যতার ইতিহাসের সহিতও ইহার
ঘণিষ্ঠ সম্পর্ক। সে সকল বিস্তারিত আলোচনার স্থান অবশ্য এ নহে।
প্রেমের
ঐতিহাসিক বিকাশ আলোচনা সম্পূর্ণ পাশ্চাত্ত্য। মানব জাতির বিবিধ
অবস্থার মধ্য দিয়া প্রেমের আদর্শ ক্রমে ক্রমে কত কত পরিবর্তিত
হইয়া আসিয়াছে এবং এই ধারাবাহিক পরিবর্তনের মধ্যে অন্তর্নিহিত
কি ভাবের ক্রমাভিব্যক্তি দেখা যায়, তাহা প্রাচ্য সাহিত্যে কোথাও
পরিস্ফুট নহে। পাশ্চাত্ত্য জগতে ক্ষুদ্রতম কীটানুর প্রেম পর্য্যন্ত
আলোচিত হইয়া মনবপ্রেমের ভাব বিশ্লেষিত হয়। ইহাতে বিজ্ঞানের সম্পর্ক
থাকিতে পারে, কিন্তু ভাব আলোচনার পক্ষে সুবিধা বৈ অসুবিধা হয়
না।
সেখানে এখন
প্রতি দিন নানা দিক্ প্রেমভাবের নূতন নূতন বিশ্লেষণ হইতেছে।
আমরা হয় ত এক দিক্ দিয়া মাত্র দেখিয়াছি; আর কত দিক্ আছে। আমরা
ত আর প্রেমকে সম্পূর্ণ আয়ত্ত করিয়া বসিয়া নাই। প্রেমের রহস্য
নিঃশেষ করা অসম্ভব। পুরাতনের মধ্য হইতে দিন দিন নব নব বৈচিত্র্য
বিকশিত হইযা তাহাকে চিরনবীন করিয়া রাখিয়াছে। বৈজ্ঞানিক এক দিক্
দিয়া তাহার অনুশীলন করিতেছেন, দার্শনিক আর এক পথে, কবির আবার
স্বতন্ত্র পথ। বর্তমান প্রবন্ধে সেরূপ কোনও পথই হয় ত অবলম্বিত
হয় নাই। কতকটা সমাজ এবং কতকটা সাহিত্য মিলাইয়া প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্ত্য
প্রেমালোচনার তুলনা এবং চেষ্টা করা হইয়াছে মাত্র। নানা কারণে
বিস্তর অসম্পূর্ণতা এবং ত্রুটি রহিয়া গিয়াছে। বিশেষতঃ দার্শনিক
আলোচনার এ প্রবন্ধে সম্পূর্ণ অভাব। সুখী পাঠকেরা নিজগুণে সম্পূর্ণ
করিয়া লইবেন ভরসায় এইখানেই উপসংহার করি।
( ‘ভারতী
ও বালক’ পত্রিকার ১২৯৬ বঙ্গাব্দের চৈত্র ও ১২৯৭-এর আষাঢ় সংখ্যায়
প্রকাশিত )|
( সমাপ্ত )
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)