প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরনো দিনের পত্রিকা ও বই থেকে নির্বাচিত প্রবন্ধ (সূচী)

পাগলের কাণ্ড
নারায়ণ ভট্টাচার্য্য

[ লেখক পরিচিতি : নারায়ণচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে হুগলি জেলার খানাকুলস্থ কৃষ্ণনগরের পোলগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম পীতাম্বর ভট্টাচার্য্য। কাব্য, ব্যাকরণ, স্মৃতি ও বেদান্ত পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে তিনি সরকার থেকে তিনবার বৃত্তি লাভ করেন। 'স্বদেশী' মাসিক পত্রিকার (১৩১৩ - ১৩১৫) সম্পাদক ও পরিচালক ছিলেন। 'বিদ্যাভূষণ' উপাধি ও যোগেন্দ্র রিসার্চ পুরস্কারও লাভ করেছেন নারায়ণচন্দ্র। তত্‍‌কালীন বহু পত্রিকাতে তিনি রচনা প্রকাশ করেছেন। তার রচিত উপন্যাস : 'কুলপুরোহিত' ; 'পরাধীন' ; 'মতিভ্রম' ; 'পরাজয়' ; 'মানরক্ষা' ; 'ডিক্রিজারী' ; 'ভবঘুরে' ; 'বিয়েবাড়ি' ; 'নিষ্কর্মা' ; 'স্বামীর ঘর' ; 'গরীবের মেয়ে' ; 'বন্ধুর মেয়ে' ; 'অপরাধী' ; 'নিষ্পত্তি' ; 'নাস্তিক' ; 'প্রেমিকা' ; 'প্রবঞ্চক' ; 'সুরমা' ; 'গিনির মালা' ; 'ঘরজামাই' ; 'একঘরে' ; 'কালোবউ' ; 'রাঁধুনী বামুন' ; 'পূজা' ; 'বন্ধন মোচন' ; 'রাঙা কাপড়ের মূল্য' ; 'সঙ্গীহারা' ; 'স্নেহের জয়' ; 'বারবেলা' ; 'প্রায়শ্চিত্ত' 'মনের বোঝা' ; 'মেয়ের বাপ' ; 'বিধবা' ; 'হিসাব নিকাশ' ; 'পরের ছেলে' ; 'পতিতা' ; 'নিরাশ প্রণয়' ; 'পরাজয়' ; প্রতিদান' ; 'গঙ্গারাম' ; 'গ্রহের ফের' ; 'সতীন পো' ; 'পূজার আমোদ' ; 'অনুরাগ' ; 'অপবাদ' ; 'অভিমান' ; 'মায়ার অধিকার' ; 'ব্রহ্মশাপ' ; 'মণির বর' ; 'দাদা মহাশয়' ; 'জেল ফেরত্‍‌' ; 'ঠাকুরের জন্য' ; 'সুখের মিলন' ; 'বৈরাগী' ; 'ত্যাজ্যপুত্র' ; 'আকালের মা' ; 'উত্তরাধিকারী' ; 'নববোধন' ; 'দুর্বাসা ঠাকুর' ; 'গুরু মহাশয়' ; 'কথাকুঞ্জ' ; 'কণ্ঠিবদল' ; 'মাণিকের মা' ; 'হিন্দু স্ত্রী-ধনাধিকার'। তিনি জৈন পুরোহিত হেমচন্দ্রের 'অভিধান চিন্তামণি' বঙ্গানুবাদ সহ প্রকাশ করেছেন। ১৯২৭ খ্রীষ্টাব্দে নারায়ণচন্দ্রের মৃত্যু ঘটে। ] দীপক সেনগুপ্ত ।

[১]

তারণ ভট্‌চাজ্যির ভাই সারদা ভট্‌চাজ্যি মেডিক্যাল কলেজ হইতে এল. এম. এস. উপাধি লইয়া যখন দেশে আসিয়া বসিল, তখন সাপ্তাহিক আড্ডাটা দৈনিক ভাবে জমিবে বলিয়া যজ্ঞেশ্বর দত্ত এক জোড়া নূতন ছক্‌ কিনিয়া আনিল। তারণ ভট্‌চাজ্যি কিন্তু পাঁয়ত্রিশ টাকা মাহিনার কেরাণীগিরি এবং ডেলী প্যাসেঞ্জারির মায়া ত্যাগ করিয়া দৈনিক পাশার আড্ডার দিকে আদৌ মনোযোগ দিল না।
বন্ধুবান্ধবেরা বলিল, "আর কেন ভট্‌চাজ, কষ্ট ক'রে ভাইকে মানুষ কর্‌লে, এখন দিন কতক ব'সে তার রোজগার খাও।"
তারণ হাসিয়া উত্তর করিল, "খাব বৈকি ভায়া, খাব বৈকি; তবে যে কয়টা দিন চলে চলুক।"
লোকে তারণ ভট্‌চাজ্যিকে শুধু একটু মাথা-পাগলা বলিয়াই জানিত, এখন তাহাকে কৃপণ স্বভাব বলিয়াও জানিতে পারিল।
কেবল বাহিরের লোকে নয়, বাড়ীর ভিতর স্ত্রীও সাতটায় ভাত তৈরী করিয়া দিতে অসমর্থ জানাইয়া তিরস্কারের ছলে স্বামীকে বলিল, "ভাল চিরকালটাই কি সাতটায় নাকে মুখে ভাত গুঁজে গাড়ী ধত্তে ছুটবে? ঠাকুরপো যখন দু'পয়সা আন্‌বে, তখন তোমার আর এই ক'টা টাকার তরে ছুটাছুটি কেন?"
তারণ ইহাতে উত্তর দিল, "কি জান বড় বৌ, ছ্যাকরা গাড়ীর ঘোড়া আর কেরাণী ছুট্‌লেই ভাল থাকে।"
বড় বৌ রাগিয়া বলিল, "স্বচ্ছন্দে ছুটাছুটি কর, আমি কিন্তু আর সাতটায় ভাত দিতে পার্‌বো না। কেন, আমার কি বেঁচে সুখ নাই।"
তারণ হাসিয়া বলিল, "তা হ'লে এক কাজ করা যাক, এই টাকা দিয়ে একজন রাঁধুনি আর একটা ঝি রাখা যাক্‌। এতকাল রেঁধে খাওয়াচ্চ, দিনকতক রান্নাভাত খাও।"
ভ্রূভঙ্গী করিয়া বড় বৌ বলিল, "ইস, আমার উপর আর এত দরদ দেখাতে হবে না। তার অর্দ্ধেক টাকা দিয়ে নিজের জামা কাপড়গুলো পাল্‌টাও দেখি।"
তারণ গম্ভীর ভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, "এইবার পাল্‌টাব বড়বৌ, এইবার পাল্‌টাব। দিনকতক যাক্‌, তারপর সক্কলকে দেখাব, বাবুয়ানি কি রকমে কত্তে হয়।"
বড় বৌ হাসি চাপিয়া বলিল, "কে বাবুয়ানি কর্‌বে, তুমি? বাবুয়ানির কপাল!"
তারণ হাসিয়া বলিল, "আচ্ছা, দেখবে-দেখবে।"
পঁচিশ টাকা মাহিনার রেলভাড়া পাঁচ টাকা বাদে বাকী কুড়ি টাকায় সংসার চালাইয়া তারণ যে কিরূপে ছোটভাই সারদার পড়ার খরচ যোগাইত, তাহা অনেকেই বুঝিয়া উঠিতে পারিত না। কিন্তু সাধারণের বিবেচনায় এই অসাধ্য কাজটাকে দুসাধ্য করিয়া আনিতে তারণকে কতটা কষ্টভোগ করিতে হইয়াছিল, তাহা বড় বৌ ছাড়া আর কেহ জানিতে না। কেন না স্বামীর আফিসের জামা কাপড়ে তালি দেওয়া তাহার নিত্যকার্য্য মধ্যে পরিগণিত ছিল, বাড়ী হইতে ষ্টেশন পর্য্যন্ত জুতাটা পায়ের পরিবর্ত্তে হাতে যাইত বলিয়া মধ্যে মধ্যে তারণের পায়ে যে কাঁটা ফুটিত, প্রতি রবিবারে সেই কাঁটা বাহির করিয়া দিতে হইত। আফিসে জলখাবারের পাঠ ছিল না; সুতরাং সকাল সাতটার পর রাত্রি নয়টায় খাইতে বসিয়া তারণ যখন হাঁড়ীর দিকে ঘন ঘন দৃষ্টিপাত করিত, এবং হাঁড়িতে অন্নের অভাব দেখিয়া বড়বৌয়ের সনির্ব্বন্ধ অনুরোধ সত্ত্বেও আপনার ক্ষুধায় অল্পতা জানাইয়া পাতে কতক ভাত রাখিয়া উঠিয়া পড়িত, তখন বড় বৌ চোখের জল রাখিতে পারিত না। হায়, এ কষ্ট কবে ঘুচিবে? ভগবান্‌ মুখ তুলিয়া চাও।
মাহিনা পাঁচ টাকা বাড়িল। সঙ্গে সঙ্গে সারদা এফ এ পাশ করিয়া মেডিকেল কলেজে প্রবেশ করিল। কলেজের বেতন এবং বই-এর খরচ এত বাড়িল যে, তাহার নিকট বর্দ্ধিত বেতনের পাঁচটা টাকা কিছুই নয়। তাহার কষ্ট দেখিয়া লোকে পরামর্শ দিল, কলেজের পরিবর্ত্তে সারদাকে একটা আফিসে ঢুকাইয়া দিলে খুব ভাল হয়। তারণ কিন্তু লোকের এই সৎপরামর্শ হাসিয়া উড়াইয়া দিল। লোকে বলিল, বামুনটা মাথা পাগলা।
এত কষ্টের মধ্যেও তারণ রবিবারে যখন যজ্ঞেশ্বর দত্তের বৈঠখানায় পাশার আড্ডায় যোগ দিত, তখন তাহার 'ছ'তিন নয়' পোয়া বার'র জন্য উৎসাহপূর্ণ চীৎকার শুনিয়া কেহই বুঝিতে পারিত না, এই লোকটাকে মাসের অর্দ্ধেক দিন অর্দ্ধাশনে দিনপাত করিতে হয়। তারণ প্রায়ই যজ্ঞেশ্বর দত্তকে আশ্বাস দিয়া বলিত, "থাম না দত্তজা, আর তিনটে বছর। সেরো ছোঁড়া একবার পাশটা কত্তে পারলে রোজ সকাল হ'তে সন্ধ্যা পর্য্যন্ত ছ'তিন নয় চালাব।"
সারদা আসিয়া দেশে বসিল, দত্তজা নূতন পাশার ছক আনাইল, তারণ কিন্তু রবিবার ব্যতীত আর কোন দিনই পাশার আড্ডায় যোগ দিল না। সে তালি দেওয়া জুতা, ছেঁড়া জামা, ময়লা কাপড়ের ভিতর দিয়া কেরাণী-জীবনের দৈন্য প্রকাশ করিতে করিতে সপ্তাহের অবশিষ্ট ছয়টা দিন নিয়মিতরূপে ষ্টেশনে যাতায়াত করিতে লাগিল। মাহিনা তখন আরও পাঁচ টাকা বাড়িয়াছিল, সারদা শ্বশুরের প্রদত্ত দুই হাজার টাকায় ডাক্তারখানা খুলিয়া বেশ দু'পয়সা ঘরে আনিতেছিল, এবং সে পয়সার শেষ আধলাটী পর্য্যন্ত দাদার হাতে তুলিয়া দিতেছিল। তথাপি কিন্তু তারণ ভটচাজ্যির কিছুমাত্র আগ্রহ দেখা গেল না। কাজেই লোকে ভাবিল, লোকটা হাড় কৃপণ।
দাদার কার্য্যে সারদারও যে আপত্তি ছিল না, তাহা নহে। কিন্তু তারণ তাহাকে বুঝাইয়া বলিত "ওরে ভাই, পঁয়ত্রিশ টাকা মাইনের কেরাণীর কি বাবুয়ানি সাজে? চাকরী ছেড়ে যখন ডাক্তারবাবুর দাদা হ'য়ে ঘরে বস্‌বো, তখন দেখবি তারণ ভট্‌চাজ্যি, কি রকম বাবুগিরি কত্তে পারে।"
বড় বৌ বলিত, "দেখ, তুমি ও রকম চালে চল্‌লে, ঠাকুরপোর মাথা হেঁট হয়। হাজার হোক, ও হ'লো একজন বড় ডাক্তার।"
তারণ হাসিয়া বলিল, "কিন্তু আমি যে তারণ ভট্‌চাজ্যি, তা সকলেই জানে।"
কনিষ্ঠের সম্মান রক্ষার জন্য বড়বৌয়ের নিতান্ত অনুরোধে সেই মাসকাবারে তারণ একখানা জামা এবং এক যোড়া জুতা কিনিয়া আনিল।

[২]

সে দিন খাইতে একটু দেরী হইয়া গিয়াছিল। তাড়াতাড়ি কাপড় জামা পড়িয়া তারণ বাটীর বাহির হইতেই দেখিল, রসিক মোড়লের ছেলে গৌর ডাক্তারখানা হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিতেছে। তারণ ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, "কিরে গৌর, কোথায় গিয়েছিলি?"
গৌর বলিল, "ডাক্তারবাবুর কাছে।"
"কার আসুখ।"
"বাবার।"
"কি অসুখ রে?"
"জ্বর, সর্দ্দি, বুকে বেদনা।"
একটু চিন্তিতভাবে তারণ বলিল, "তাইতো, সারু কি বল্‌লে?"
গৌর ম্লানমুখে বলিল, "বললেন, এখন ফুরসৎ নাই।"
"আচ্ছা, তুই দাঁড়া" বলিয়া তারণ দ্রুতপদে ডাক্তারখানায় উপস্থিত হইল এবং সারদাকে সম্বোধন করিয়া বলিল, "হাঁরে সারু, রসিক মোড়লের অসুখ, একবার দেখতে যেতে পারবি না?"
সারদা গম্ভীরভাবে বলিল, "দেখে হবে কি? ভিজিট তো দিতেই পার্‌বে না; তার উপর ওষুধের দাম দেবারও ক্ষমতা নাই।"
তারণ বলিল, "ক্ষমতা নাই ব'লে লোকটা বেঘোরে মারা যাবে রে?"
সারদা বলিল, "তা আমি কি কর্‌বো। ওষুধ তো আমার ঘরের নয়।"
তারণ মাথা নাড়িয়া বলিল, "তা হোক্‌, তুই দেখে আয়, ওষুধ দে। আহা, গরীব লোক!"
সারদা বিরক্তির সহিত বলিল, "অমন গরীব দেশে লক্ষ লক্ষ আছে। তা হ'লে তো ব্যবসা কত্তে হয় না।"
বিস্ময়ে দৃষ্টি বিস্ফারিত করিয়া তারণ বলিল, "ব্যবসা কত্তে হবে ব'লে গরীবে এক ফোঁটা ওষুধ পাবে না? না না, তুই ওষুধ দে, রসিক এরপর খেটে দাম শোধ দেবে। তুই জানিস না সারু, পাঠশালে ক্ষিদে হ'লে রসিকের মায়ের কাছে যেতাম, বুড়ী কোঁচড় পুরে মুড়ী দিত। সে কি চমৎকার মুড়ী। তেমন মুড়ী আজকাল আর দেখতেই পাই না।"
মুড়ীর চমৎকারিত্ব স্মরণেই হউক বা বুড়ীর দয়ার কথা মনে করিয়াই হউক, তারণের স্বরটা গাঢ় হইয়া আসিল। সে আরও কি বলিতে যাইতেছিল, কিন্তু দূরে গাড়ীর শব্দ দ্রুত হওয়ায় আর বলা হইল না। "যাঃ, আটটার গাড়ী বুঝি ধত্তে পারলাম না।" বলিয়াই তারণ ঊর্দ্ধশ্বাস ছুটিয়া চলিল।
সন্ধ্যার পর অফিস হইতে ফিরিবার পথে রসিক মোড়লের বাড়ীতে উপস্থিত হইয়া তারণ ডাকিল, "রসিক কোথায় হে, কেমন আছ?"
বলিতে বলিতে তারণ বাড়ীর ভিতর ঢুকিয়া ঘরের দাবায় উঠিল। রসিক ব্যস্ত-সমস্ত-ভাবে স্ত্রীকে আসন আনিতে বলিল, তারণ বলিল, "আসন থাক্‌, পায়ে এক হাঁটু কাদা। কেমন আছ? সারু এসেছিল? ওষুধ দিয়েছে?"
রসিক কষ্টে বিছানার উপর বসিয়া বলিল, "দু'পুর বেলা এসেছিলেন। ওষুধ আন্‌তে ব'লে গেছেন, কিন্তু দামের-"
বাধা দিয়া তারণ একটু জোর-গলায় বলিল, "দামের জন্য কি আটকাচ্চে? পাগল আর কি! ওষুধটা আনালেই তো হ'তো।"
রসিক কি উত্তর দিবে ভাবিয়া ইতস্ততঃ করিতে লাগিল। তারণ পকেট হইতে চারিটা টাকা বাহির করিয়া তাহার বিছানার উপর ফেলিয়া দিয়া বলিল, "দাম নিয়ে ওষুধটা আনতে পাঠিয়ে দাও। গৌর কোথায় গেল? দেরী ক'রো না। হাতে ছিল না, আফিসে দারোয়ানের কাছ হ'তে ধার করে নিয়ে এলাম।"
রসিক হাঁ করিয়া দাদাঠাকুরের মুখের দিকে কিয়ৎক্ষণ চাহিয়া রহিল। তারপর সজল-কণ্ঠে বলিল, "আমার তরে টাকা ধার ক'রে আন্‌লে দাদাঠাকুর?"
তারণ মাথা নাড়িয়া বলিল, "তাতে আর হ'য়েচে কি? একেই বলে পাগল। এ টাকা তো আমারই বাক্সে যাবে। শুধু হাত-ফেরতা বৈ তো না।"
কথা শেষ করিয়াই তারণ দ্রুতপদে বাড়ীর বাহির হইয়া গেল।
ঘরে আসিয়া তারণ বড়বৌকে চুপি চুপি বলিল,"সেরোটার একটুও চক্ষুলজ্জা নাই বড় বৌ, রসিক মোড়লের ব্যারাম, তা ব'লে, দাম না দিলে ওষুধ দিতে পারবো না!"
বড় বৌ বলিল, "ঠিক কথাই তো বলেছে। তোমার মত চক্ষুলজ্জা রাখতে হ'লে ব্যবসা চলে না।"
তারণ হাসিয়া বলিল,"দেখছি, তুমি শুদ্ধ ব্যবসাদার হ'য়ে উঠেছে। ওগো, ব্যবসা কত্তে হ'লেই দয়া-ধর্ম্মগুলো পুড়িয়ে খেতে হয় না।"
ঈষৎ রাগত ভাবে বড় বৌ বলিল, "না, দানছত্র বসাতে হয়।"
তারণ বলিল, "এই দেখ এক পাগল! আমি কি দানছত্র বসাতেই বলছি। তবে গরীব দুঃখী যাদের উপায় নাই, তাদের এক আধ ফোঁটা ওষুধ দিলে তেমন ক্ষতি হয় না। আর ওষুধই বা কত, এক শিশি ওষুধে দুই-দশ ফোঁটা ওষুধ, বাকী জল।"
বড় বৌ বলিল, "কিন্তু সে দু'দশ ফোঁটা ওষুধেরই দাম কত জান?"
ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে তারণ বলিল, "জানি গো জানি, দুশ হাজার টাকা। বেশ এক এক শিশি ওষুধ বেচে তোমরা কোঠা বালাখানা কর। ।
বড় বৌ হাসিয়া বলিল, "আর তুমি লক্ষু-লজ্জা নিয়ে চিরকাল তালি দেওয়া জুতো আর ছেঁড়া কাপড় জামা নিয়ে বেড়াও।"
তারণ হাহা করিয়া হাসিয়া উঠিল; হাসিতে হাসিতে বলিল, "সেই ভাল, আমি পাগল মানুষ, শেষে কোন্‌ দিন তোমাদের কোটা বালাখানা ভেঙ্গে চুরে দেবো?"

[৩]

মাস দুই পরে তারণ যখন পাঁচ টাকা বেতন বৃদ্ধির সংবাদ লইয়া ঘরে ফিরিল, তখন বড় বৌ সে সংবাদে কিছুমাত্র আহ্লাদ প্রকাশ না করিয়া বরং একটু বিষণ্ণ ভাবেই বলিল, "তা হলে দেখচি, যদিও দু'মাস ছ'মাস পরে চাকরী ছাড়তে, এখন আর তাও ছড়াবে না।"
তারণ হাসিয়া বলিল, "এই দেখ, মাইনে বেড়েচে, কোথায় হরির লুট দেবে, তা নয় আক্ষেপ কর্ত্তে বস্‌লে। ভাল, আমার চাকরী বেচারীর উপর তোমাদের এত রাগ কেন বল দেখি?"
বড় বৌ একটু ঝঙ্কার দিয়া বলিল, "রাগ হয় সাধে! বার মাস তিরিশ দিন শীত নাই, বর্ষা বাদল নাই, সকালে সাতটায় একমুঠো খেয়ে ছুট্‌ ছুট্‌। আচ্ছা, তোমার ব্যাজারও হয় না?"
ঘাড় নাড়িয়া তারণ বলিল, "ব্যাজার হোলে, দরজায় ডাক্তার এস, সি্‌, ভট্‌চার্য্য এল্‌, এম্‌, এস সাইনবোর্ডটা উঠতো কি রকমে বল তো?"
বড় বৌ গম্ভীর ভাবে উত্তর করিল, "সে কথা একশোবার স্বীকার করি। কিন্তু এখন ঠাকুর পো শত্রুর মুছে ছাই দিয়ে যখন দশ টাকা ঘরে আন্‌চে তখন আর তোমার এ ছুটাছুটি কেন? বয়সও তো চল্লিশ পার হ'য়েচে, এখন পূজো আহ্নিক তপ জপ-"
বাধা দিয়া মৃদু মস্তক সঞ্চালন করিতে করিতে সহাস্যে তারণ বলিল, "সে সব ঠিক করে রেখেছি বড় বৌ, আর একটা বছর যেতে দাও। তর পর দেখবে, তারণ ভট্‌চাজ্যি সকালে উঠে যে পূজোয় বসবে, এগারটার আগে আর উঠচে না। তার পর আহার, একটা কি দেড়টা পর্য্যন্ত নিদ্রা। দেড়টার পর থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্য্যন্ত দত্তজা বৈঠকখানায়-"
একটা অবজ্ঞাপূর্ণ কটাক্ষপাত করিয়া বড় বৌ প্রস্থানোদ্যত হইল। তারণ ব্যস্তভাবে তাহাকে ডাকিয়া বলিল, "ও কি, চ'লে যাও যে, শোন শোন।"
বড় বৌ ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, "তোমার এই গাঁজাখুরি গল্প শুনলে তো চলবে না আমার কাজ আছে।"
তারণ বলিল, "কাজ তো বার মাস তিরিশ দিনই আছে। ভাল, একদিন না হয় দু'দণ্ড বসলে।"
ঈষৎ হাসিয়া বড় বৌ বলিল, "বারমাস তিরিশ দিনের মধ্যে খাওয়াটা যদি দু' একদিন বন্ধ দেবার হতো, তা হ'লে না হয় দু'দণ্ড বস্‌তাম। কিন্তু তা যে হবার যো নাই। ঐ জিনিসটি রোজ চাই।"
সহাসো তারণ বলিল, "রোজ কেন, দিনে দু'বেলা। আর আজ বিশ বছর তো সেই দু'বেলা হেঁশেল ঠেলে আসচো। ভাল, দশটা দিন না হয় জিরেন নাও না।"
বড় বৌ বিস্ময়ে গালে হাত দিয়া বলিল, "কও কথা, আমি জিরেন নেব? করবে কে? "
তারণ বলিল, "কেন, ছোট বৌমা তো আছেন। দিনকতক রান্নার ভার তাঁর হাতেই দাও না।"
বড় বৌ উচ্চ হাস্য করিয়া উঠিল। বলিল, "অবাক্‌ করলে তুমি। ছোট বৌ রাঁধবে? সে একঘটি জল গড়িয়ে খেতে পারে না, আর রেঁধে তোমাদের ভাত দেবে!"
হঠাৎ তারণের মুখখানা গম্ভীর হইয়া আসিল; জিজ্ঞাসা করিল, "কি বল্‌লে, তিনি এক ঘটি জল গড়িয়ে খেতে পারেন না? কেন, তাঁর কি কোন অসুখ আছে?"
বড় বৌ আরও একটু জোরে হাসিয়া বলিল, "এইতেই লোকে তোমাকে পাগল বলে। অসুখ থাকতে যাবে কেন, বালাই! তবে পারে না, এই আর কি।"
উগ্রস্বরে তারণ বলিল, "কেন পারে না, তাই আমি শুনতে চাই। তুমি মেয়েমানুষ, তিনিও মেয়েমানুষ। তুমি যা পার, তিনি তা পারেন না কেন?"
স্বামীর ক্রোধের আবির্ভাব দেখিয়া বড় বৌ একটু কুণ্ঠিত হইয়া পড়িল। বার বার পশ্চাতে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করিতে করিতে বলিল, "সব্বাই কি সব পারে। বিশেষ ছেলেমানুষ।
ক্রুদ্ধ কণ্ঠে তারণ বলিল, "কিসের ছেলেমানুষ? আঠার উনিশ বছরের মেয়ে, ছেলেমানুষ? তুমি তেরো বছরে এসে আমাকে আফিসের ভাত দিয়েছিলে, তা জান?"
বড় বৌ কি বলিতে গেল; কিন্তু তাহাতে কর্ণপাত না করিয়াই তারণ চীৎকার করিয়া বলিল, "সেটি হচ্চে না বড় বৌ, এই আমি বলে দিচ্চি, আমার সংসারে সক্কলকে সমান খাট্‌তে হবে। তুমি কেরাণীর স্ত্রী, আর তাঁর স্বামী বড় ডাক্তার, এ তফাৎটুকু যেন আর না দেখতে পাই।"
রাগে পান না লইয়াই তারণ বাহির হইয়া গেল। বড় বৌ শঙ্কিতচিত্তে ঘর হইতে বাহিরে আসিতেই সারদা উঠান হইতে জিজ্ঞাসা করিল, "কি হ'য়েছে বৌঠান, দাদা এত চীৎকার কচ্ছিলেন কেন?"
ব্যস্তভাবে বড় বৌ বলিল, "ওর কথা ছেড়ে দাও, কখন কি মেজাজে থাকে, তা তো বলা যায় না। একটুতেও আগুন, আবার একটুতেই জল।"
জুতার আগাটা মাটিতে ঠুকিতে ঠুকিতে বলিল, "কি বলছিলেন না, কেরাণীর স্ত্রী-ডাক্তারের স্ত্রী?"
বড় বৌ হাসিয়া বলিল, "কে জানে কত কথাই বকে গেল, আমার কি সব কথায় কান দেবার সময় আছে? যাই, উনুনটা ধরিয়ে দিই।"
বলিয়া বড় বৌ তাড়াতাড়ি রন্ধনশালায় ঢুকিয়া পড়িল। সারদা ক্ষণকাল চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে বাহিরে চলিয়া গেল।


[৪]

পরদিন সকালে ঘরের দরজা খুলিয়া বাহির হইতেই বড় বৌ দেখিল, রন্ধনশালা হইতে ধূম উত্থিত হইতেছে। সে কতকটা শঙ্কিত এবং কতকটা বিস্মিত ভাবে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দরজায় গিয়া যাহা দেখিল, তাহাতে আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া পড়িল। দেখিল, ছোট বৌ উনান ধরাইয়া রান্না চাপাইয়া দিয়াছে। দেখিয়া সে কতকক্ষণ নিতান্ত বিস্ময়াবিষ্টের ন্যায় গালে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া রহিল; তার পর ছোট বৌকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, "ও মা, তুই এরি মধ্যে উঠে রান্না চাপিয়েছিস্‌ ছোট বৌ?"
ছোট বৌ শিল পাতিয়া দরজার দিকে পিছন ফিরিয়া মশলা পিষিতেছিল; সে মুখ না ফিরাইয়াই গম্ভীরভাবে উত্তর করিল, "কাজেই; এতটা বেলা হয়ে গেল-"
বাধা দিয়া বড় বৌ বলিল, "হ'লেই বা বেলা। আজ রবিবার, আফিসের ভাতের তো তাড়া নাই।"
ছোট বৌ মৃদু অথচ পরুষকণ্ঠে বলিল, "আফিসের তাড়া নাই ব'লে কি কাউকে খেতে হবে না?"
বড় বৌ দুই হাত তুলিয়া আলস্য ভাঙ্গিতে বলিল, "তাই বুঝি তুই তাড়াতাড়ি রাঁধতে গিয়েছিস্‌? আচ্ছা, আজ তুই রেঁধে খাওয়া দেখি, কেমন রাঁধুনি।
বলিয়া বড় বৌ হাসিয়া উঠিল। ছোট বৌ কিন্তু হাসিল না; সে স্বরটা একটু চড়াইয়া বলিল, "এর আবার দেখাদেখি কি? যে যেমন পারবে রাঁধবে। দুজনের ঘর যখন, তখন পারি না পারি, আমাকে কত্তেই হবে।"
বড় বৌয়ের মুখের হাসি সহসা নিবিয়া গেল; সে ম্লানদৃষ্টিতে ছোট বৌয়ের দিকে চাহিয়া বলিল, "বেশ তো, মেয়েমানুষের এই তো কাজ। আর আমার গতরই কি চিরদিন বইবে? তবে আগে সব দেখে শুনে নে, নয় তো সদ্যসদ্য পাকা রাঁধুনী হতে গেলে পারবি কেন?"
বড় বৌ চেষ্টা করিয়া আর একটু হাসিল। ছোট বৌ যেন ঝঙ্কার দিয়া বলিল, "আমি অত পাকা কাঁচা জানি না। উনি বল্‌লেন, শঙ্করপুরে ডাক আছে, এক মুঠো খেয়ে যাবেন। এ দিকে তোমারও ঘুম ভাঙ্গেনি, কাজেই-"
বড় বৌয়ের মুখখানা যেন কালি হইয়া গেল। ক্ষুব্ধস্বরে বলল, "ঠাকুরপো সে কথা কই আমাকে কিছু বলেনি তো?"
ছোট বৌ উত্তর না দিয়া দ্রুতহস্তে মশলা পিষিতে আরম্ভ করিল। বড় বৌ একটু দাঁড়াইয়া থাকিয়া আস্তে আস্তে মুখ হাত ধুইতে গেল। মুখ-হাত ধুইয়া আসিয়া সে স্নানে যাইবার জন্য তাড়াতাড়ি ঘরের কাজ শেষ করিতে লাগিল। ছোট বৌ রন্ধন কার্য্য আরম্ভ করিলেও কিরূপে যে তাহার উপসংহার করিবে, তাহা তাহার অজ্ঞাত ছিল না; সুতরাং সে খুব ব্যস্ত ভাবেই কাজ শেষ করিয়া স্নানে চলিল। তাহার বুকের যে একটা রুদ্ধ অভিমান ফুলিয়া উঠিবার চেষ্টা করিতেছিল, এই ব্যস্ততার মধ্যে সেটাকে যেন সে সম্পূর্ণ চাপা দিয়া ফেলিল।
তাড়াতাড়ি স্নান শেষ করিয়া বড় বৌ বাড়ী ঢুকিয়া দেখিল, উপসংহারটা বাস্তবিকই খুব করুণরসাত্মক হইয়াছে। ভাতের হাঁড়ির ফেনসমেত ভাতগুলা কতক ছোট বৌয়ের পায়ের উপর পড়িয়াছে, কতক উনানের ভিতর গিয়াছে, কতক উনানের আশে পাশে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। হাঁড়িটা খণ্ড খণ্ড হইয়া পড়িয়াছে। আর ছোট বৌয়ের চীৎকারে পাড়ার যত মেয়ে উঠানে আসিয়া জড় হইয়াছে। বড় বৌ তাড়াতাড়ি কলসীটা নামাইয়া ভিজা কাপড়েই ছুটিয়া গেল এবং জ্বালা নিবারণের জন্য প্রতিবেশিনীদিগের কথিত বিভিন্ন প্রকার ঔষধের মধ্যে কোন্‌টা দিবে, তাহাই ভাবিয়া অস্থির হইয়া পড়িল।
তাহাতে বেশী ভাবিতে হইল না; সংবাদ পাইয়া সারদা অবিলম্বে আসিয়া ক্ষতস্থানে ঔষধ লাগাইয়া দিল, জ্বালা কতকটা কমিল। তখন প্রতিবেশিনীরা এই কচি মেয়েটাকে গুরুতর রন্ধনকার্য্যে নিযুক্ত করার জন্য আক্ষেপ প্রকাশের সহিত ইঙ্গিতে বড় বৌয়ের উপর দোষারোপ করিতে লাগিল। বড় বৌ বলিতে গেল, "ওগো, ও আবাগী নিজে ইচ্ছা করেই রাঁধতে এসেছে।" কিন্তু হিতৈষিণীদিগের সহানুভূতির স্রোতে তাহার প্রতিবাদ কোথায় ভাসিয়া গেল। তাহারা প্রস্থানকালে সারদাকে উদ্দেশ করিয়া উপদেশ দিয়া গেল, যদি ভাগের কাজই করিতে হয় তবে সারদার উচিত একটা রাঁধুনী রাখা। তাহার অর্থের অভাব কি? আর রাঁধিতে গিয়া স্ত্রী যদি পুড়িয়া মরিল, তবে তাহার অর্থেই বা কি হইবে?
তারণ স্ত্রীকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, "তুমি কি ছোট বৌমাকে রাঁধতে বলেছিলে?" বড় বৌ বলিল, "আমি কোন কথাই বলি নাই।"
"তবে উনি রাঁধতে গেলেন কেন?"
"তা কেমন করে জানবো। তবে ঠাকুরপো বোধ হয় তোমার কালকার কথাগুলো শুনেছিল, সেই বোধ হয় ব'লে থাক্‌বে। তোমার তো রাগলে জ্ঞান থাকে না।"
"কিন্তু আমি কি মন্দ কথা বলিছিলাম বড় বৌ?"
বড় বৌ বলিল, "লোকে অনেক সময় ভাল কথাতেও আঁচে মন্দ ধ'রে নেয়।"
তারণ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল।
আয় যথেষ্ট বাড়িলেও বাজার-হাটের ব্যবস্থা ঠিক পূর্ব্বেই হিসাবেই চলিতেছিল। সেটা সারদা বা ছোট বৌ উভয়েরই মনোনীত না হইলেও আগে এ সম্বন্ধে কোন কথাই উঠিত না, কিন্তু এখন এ সম্বন্ধে অনেক কথাই উঠিতে লাগিল। স্নানের ঘাটে, বোসেদের বাড়ীতে, দাসেদের খিড়কী ঘাটে ইহা লইয়া যে সকল জল্পনা চলিত, তাহার কথাই বড় বৌয়ের কানে আসিত, এবং তারণ ভটচাজ্যি যে ভায়ের উপায়ের টাকাগুলো হস্তগত করিয়া তাহা আপনার স্ত্রীর পরিণামের উপায়ের জন্য রাখিয়া দিতেছে, আর ভাই ভাদ্রবধূকে আধপেটা খাওয়াইয়া মারিয়া ফেলিতেছে, এমন সব কথাও শোনা যাইত। বড় বৌ আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া ভাবিত, ঘরের হাঁড়ির খবর কিরূপে বাহিরে যায়।
কিন্তু ছোট বৌ যখন ইদানীং প্রায় তরকারীর জন্য অনিচ্ছা প্রকাশ করিত, এবং সারদাও এক এক দিন তরকারীগুলাকে ছাই-পাঁশ নামে অভিহিত করিয়া অর্দ্ধেক ভাত ফেলিয়া উঠিয়া যাইত, তখন ঘরের খবর কোথা হইতে বাহিরে যায়, তাহা বুঝিতে বড় বৌয়ের বিলম্ব হইল না। বুঝিলেও সে স্বামীকে এ সম্বন্ধে কিছুই বলিল না; শুধু বাজার-হাট সম্বন্ধে একটু মুক্তহস্ততা দেখাইবার জন্য অনুরোধ করিতে লাগিল। তারণ কিন্তু স্ত্রীর অনুরোধে কর্ণপাত করিল না। শেষে একদিন বিরক্ত হইয়া জবাব দিল, "গরীব গেরস্ত ঘরে এর চেয়ে ভাল খায় না। যার ভাল খেতে ইচ্ছা হবে, সে নিজের পয়সা ভেঙ্গে খাবে। আমার এর বেশী যোগাবার শক্তি নাই।"
বড় বৌ রাগিয়া বলিল, "তুমি, যদি লোকের রোজগারের সব পয়সা হাত কর, তবে সে নিজের পয়সায় খায় কি ক'রে?"
"উগ্রস্বরে তারণ বলিল, "কি ক'রে, তার আমি কি জানি? আমি কারো কাছে ভিক্ষা নিতে যাই? না খেয়ে না দেয়ে লেখাপড়া শিখিয়েছি, তার পয়সা আমি একশো বার নেব।"


[৫]

যজ্ঞেশ্বর দত্ত জিজ্ঞাসা করিল, "হাঁ হে ভটচাজ, চাকরী ছাড়চো কবে?"
তারণ বলিল, "আর দু'টো মাস দত্তজা।"
দত্তজা বলিল, "তোমার এ দু'টো মাস বোধ হয় বার মাসের ভিতর নাই?"
তারণ নীরবে মৃদু হাসিল। দত্তজা বলিল, "তোমার কৃপণ স্বভাবটা একটু ছাড় ভট্‌চাজ।"
তারণ হাসিয়া বলিল, "স্বভাব যায় মলে।"
দত্তজা বলিল, "কিন্তু গাঁয়ে তোমার নিন্দায় যে কান পাতা যায় না।"
তারণ বলিল, "সেটা নিন্দুকদেরই দোষ।"
দত্তজা গম্ভীরভাবে বলিল, "দোষ কি তোমারও নাই? যে ভাই এত টাকা রোজগার কচ্চে, সেই ভাইকে ভাইয়ের স্ত্রীকে খেতে দেবে না, এটা কি ভাল কাজ হোচ্ছে?"
তারণ বিস্মিত ভাবে দত্তজার মুখের দিকে চাহিল। দত্তজা বলিল, "তা ছাড়া ছোট বৌটাকে খাটিয়ে মেরে ফেল্‌চো।"
তারণ বলিল, "মেয়েমানুষ খাটবে না তো ব'সে থাকবে?"
দত্তজা বলিল, "যার স্বামী মাসে দু'শো টাকা রোজগার করে, সে খাটতে যাবে কেন?"
এ কথার উত্তর তারণ দিতে পারিল না। দত্তজা বলিল, "সাবধান ভট্টচাজ, কাল বড় খারাপ। ঘর না ভাঙ্গে।"
বিস্ময়ের সহিত তারণ বলিল, "ঘর ভাঙ্গবে?"
দত্তজা বলিল,"শুনছি ত সেই রকম। ভাই হ'লেও তোমার পেট ভরাবার জন্য তো সে লেখাপড়া শেখেনি, আর রোজগারও কচ্চে না।"
তারণ শুনিয়া এমনই জোরে হাসিয়া উঠিল যে, তাহাতে দত্তজা বিস্মিত না হইয়া থাকিতে পারিল না।
তারণ এটাকে খুব মজার সংবাদ মনে করিয়া বড় বৌকে শুনাইবার জন্য উৎসুক ভাবে ছুটিয়া আসিল। কিন্তু বাড়ীর ভিতর পা দিবামাত্র তাহার এই কৌতুকজনক সংবাদটা যেন একটা ভীষণ দুঃসংবাদে পরিণত হইল। বাড়ী ঢুকিতেই শুনিতে পাইল, ছোট বৌ গলা ফুকারিয়া বলিতেছে, "কেন বল তো আমি তোমার কথা শুনবো? আমার সোয়ামীর রোজগারের পয়সা খাচ্চ, আমাকে বল্‌তে লজ্জা করে না। আমি মনে করলে তোমার মত দশটা মাগীকে দাসী-বাঁদী করে রাখতে পারি, তা জান। আসুক আজ হাঁড়ী আলাদা না করলে যদি আমি জলগ্রহণ করি, তবে আমি বামুনের মেয়েই নই।"
হায়, যে হতভাগিনী আজ বিশ বৎসর দাসীর অধম হইয়া এই সংসারে খাটিয়া আসিতেছে, নিজে না খাইয়া সকলকে খাওয়াইয়াছে, তাহার কৃতকর্ম্মের এই পুরস্কার! ক্রোধে ক্ষোভে তারণের পা হইতে মাথা পর্য্যন্ত রি রি করিতে লাগিল। সে অগ্রসর হইয়া বজ্রগম্ভীর স্বরে বলিল, "তাই কর ছোট বৌমা, তুমি যদি পৃথক্‌ না হয়ে জলগ্রহণ কর, তবে তোমার বাপের মুখে-।"
বড় বৌ ছুটিয়া সম্মুখে আসিল; তিরস্কারের স্বরে বলিল, "মেয়েতে মেয়েতে কথা কাটাকাটি হচ্ছে, তুমি তার মাঝে কথা কইতে এলে কেন? ছি ছি, কি কর্‌লে?"
গম্ভীর স্বরে তারণ বলিল, "স্ত্রীর উপর স্বামীর যেটুকু কর্ত্তব্য, তার বেশী একটুও করি নাই।"
সারদা বাড়ী আসিলে ছোট বৌ তাহাকে সকল জানাইল। শুনিয়া সারদা ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিল। একেই সে ভ্রাতার স্বার্থপরতায় যার পর নাই বিরক্ত হইয়াছিল, তাহার উপর স্ত্রীর প্রতি এই অভদ্র ব্যবহারে সে আর ধৈর্য্যধারণ করিতে পারিল না; তৎক্ষণাৎ বাহিরে গিয়া গ্রামের পাঁচজন ভদ্রলোকের নিকট ভ্রাতার আচরণ সম্বন্ধে অভিযোগ করিল এবং স্ত্রীকে ত্যাগ করিবে অথবা ভায়ের সঙ্গে পৃথক্‌ হইবে, উভয়ের মধ্যে কোন্‌টা শ্রেয়স্কর, তাহার পরামর্শ চাহিল। পাঁচজনে পৃথক্‌ হইবার পরামর্শই দিল।


[৬]

যজ্ঞেশ্বর দত্ত জিজ্ঞাসা করিল, "হাঁ হে ভটচাজ, চাকরী ছাড়চো কবে?"
তারণ বলিল, "আর দু'টো মাস দত্তজা।"
দত্তজা বলিল, "তোমার এ দু'টো মাস বোধ হয় বার মাসের ভিতর নাই?"
তারণ নীরবে মৃদু হাসিল। দত্তজা বলিল, "তোমার কৃপণ স্বভাবটা একটু ছাড় ভট্‌চাজ।"
তারণ হাসিয়া বলিল, "স্বভাব যায় মলে।"
দত্তজা বলিল, "কিন্তু গাঁয়ে তোমার নিন্দায় যে কান পাতা যায় না।"
তারণ বলিল, "সেটা নিন্দুকদেরই দোষ।"
দত্তজা গম্ভীরভাবে বলিল, "দোষ কি তোমারও নাই? যে ভাই এত টাকা রোজগার কচ্চে, সেই ভাইকে ভাইয়ের স্ত্রীকে খেতে দেবে না, এটা কি ভাল কাজ হোচ্ছে?"
তারণ বিস্মিত ভাবে দত্তজার মুখের দিকে চাহিল। দত্তজা বলিল, "তা ছাড়া ছোট বৌটাকে খাটিয়ে মেরে ফেল্‌চো।"
তারণ বলিল, "মেয়েমানুষ খাটবে না তো ব'সে থাকবে?"
দত্তজা বলিল, "যার স্বামী মাসে দু'শো টাকা রোজগার করে, সে খাটতে যাবে কেন?"
এ কথার উত্তর তারণ দিতে পারিল না। দত্তজা বলিল, "সাবধান ভট্টচাজ, কাল বড় খারাপ। ঘর না ভাঙ্গে।"
বিস্ময়ের সহিত তারণ বলিল, "ঘর ভাঙ্গবে?"
দত্তজা বলিল,"শুনছি ত সেই রকম। ভাই হ'লেও তোমার পেট ভরাবার জন্য তো সে লেখাপড়া শেখেনি, আর রোজগারও কচ্চে না।"
তারণ শুনিয়া এমনই জোরে হাসিয়া উঠিল যে, তাহাতে দত্তজা বিস্মিত না হইয়া থাকিতে পারিল না।
তারণ এটাকে খুব মজার সংবাদ মনে করিয়া বড় বৌকে শুনাইবার জন্য উৎসুক ভাবে ছুটিয়া আসিল। কিন্তু বাড়ীর ভিতর পা দিবামাত্র তাহার এই কৌতুকজনক সংবাদটা যেন একটা ভীষণ দুঃসংবাদে পরিণত হইল। বাড়ী ঢুকিতেই শুনিতে পাইল, ছোট বৌ গলা ফুকারিয়া বলিতেছে, "কেন বল তো আমি তোমার কথা শুনবো? আমার সোয়ামীর রোজগারের পয়সা খাচ্চ, আমাকে বল্‌তে লজ্জা করে না। আমি মনে করলে তোমার মত দশটা মাগীকে দাসী-বাঁদী করে রাখতে পারি, তা জান। আসুক আজ হাঁড়ী আলাদা না করলে যদি আমি জলগ্রহণ করি, তবে আমি বামুনের মেয়েই নই।"
হায়, যে হতভাগিনী আজ বিশ বৎসর দাসীর অধম হইয়া এই সংসারে খাটিয়া আসিতেছে, নিজে না খাইয়া সকলকে খাওয়াইয়াছে, তাহার কৃতকর্ম্মের এই পুরস্কার! ক্রোধে ক্ষোভে তারণের পা হইতে মাথা পর্য্যন্ত রি রি করিতে লাগিল। সে অগ্রসর হইয়া বজ্রগম্ভীর স্বরে বলিল, "তাই কর ছোট বৌমা, তুমি যদি পৃথক্‌ না হয়ে জলগ্রহণ কর, তবে তোমার বাপের মুখে-।"
বড় বৌ ছুটিয়া সম্মুখে আসিল; তিরস্কারের স্বরে বলিল, "মেয়েতে মেয়েতে কথা কাটাকাটি হচ্ছে, তুমি তার মাঝে কথা কইতে এলে কেন? ছি ছি, কি কর্‌লে?"
গম্ভীর স্বরে তারণ বলিল, "স্ত্রীর উপর স্বামীর যেটুকু কর্ত্তব্য, তার বেশী একটুও করি নাই।"
সারদা বাড়ী আসিলে ছোট বৌ তাহাকে সকল জানাইল। শুনিয়া সারদা ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিল। একেই সে ভ্রাতার স্বার্থপরতায় যার পর নাই বিরক্ত হইয়াছিল, তাহার উপর স্ত্রীর প্রতি এই অভদ্র ব্যবহারে সে আর ধৈর্য্যধারণ করিতে পারিল না; তৎক্ষণাৎ বাহিরে গিয়া গ্রামের পাঁচজন ভদ্রলোকের নিকট ভ্রাতার আচরণ সম্বন্ধে অভিযোগ করিল এবং স্ত্রীকে ত্যাগ করিবে অথবা ভায়ের সঙ্গে পৃথক্‌ হইবে, উভয়ের মধ্যে কোন্‌টা শ্রেয়স্কর, তাহার পরামর্শ চাহিল। পাঁচজনে পৃথক্‌ হইবার পরামর্শই দিল।

নারায়ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য

( 'নারায়ণ' পত্রিকা, জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৬ )

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 

 







অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।