মমল্লপুরম
(মহাবলীপুরম) ১
- ২ - ৩
ধর্মরাজ
রথ থেকে ফেরার পথে দ্রৌপদী রথের সামনে সিংহের
ভাস্কর্য চোখে পড়ল যা আগে লক্ষ করিনি।
দ্রৌপদী
রথের সামনে সিংহ মূর্তি
একই ছবিতে
ডান দিকে একটি হাতিও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সিংহ
ও হাতি দুটোই এত সুন্দর খোদাই করা মনে হয় এখুনি
ওরা নড়া-চড়া করবে।
পঞ্চরথ দেখা
শেষ করে (আসলে এই দেখা শেষ হবার নয়) আমরা কিছুটা
সমুদ্রের দিকে হেঁটে গিয়ে আর এক শ্রেণীর ভাস্কর্যের
দর্শন পেলাম। যদিও একটি একটি পাথরে খোদাই করেই
এগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, তবে পাহাড়ের মাথা থেকে
কেটে নিচে নামা হয়নি, প্রধানত সামনে থেকেই খোদাই
করে ভাস্কর্য ও গুহা তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ এগুলো
প্রাচীনতর। এই অঞ্চল দিয়ে পাকা রাস্তা এগিয়ে গেছে,
কোথায় তা জানতে পারিনি। তবে পঞ্চরথের অবস্থান
বালির ওপরে, এই জায়গা সবুজ, ঘাস ও মাঝারি আকারের
গাছে ঢাকা। রাস্তার তল থেকে অল্প উঠেই এক লম্বা
গুহায় এলাম। সার দিয়ে কয়েকটা থাম গুহার ছাদ ধরে
আছে। পাহাড়ের গা খোদাই করার সময় থামের আকারে পাহাড়ের
ওই অংশগুলো রেখে দিয়েছে। ভিতরে দেয়ালে সারি সারি
অপরূপ ডাওরামার মতো করে মহাভারত ইত্যাদি থেকে
বিভিন্ন ঘটনা চিত্রিত, আসলে খোদিত হয়েছে। দেখতে
পেলাম শ্রীকৃষ্ণের গোবর্ধনগিরির তুলে ধরার রিলিফ।
শ্রীকৃষ্ণের
গোবর্ধনগিরির তুলে ধরা
গোবর্ধনগিরির
নিচে এক গোয়ালা মাঝারি আকারের জালা দুই হাঁটুর
মাঝে ধরে রেখে গাভীর দুধ দোহন করছে। যেমন এখনও
অনেক গোয়ালা বালতি দুই হাঁটুর মাঝে রেখে দুধ দোহন
করে। গাভীর সামনে দাঁড়ানো বাছুরের গা চাটা, সমস্তই
এত জীবন্ত, মনে হয় গাভী এখুনি হাম্বা বলে ডেকে
উঠবে, আর যেন ঘড়ায় দুধ পড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এই লম্বা
গুহা কৃষ্ণ-মণ্ডপ নামে খ্যাত।
দুই
হাঁটুর মাঝে ধরে রেখে গাভীর দুধ দোহন করছে
এখান থেকে
বেরিয়ে বেশ কয়েকটা গুহা দেখলাম এবং তার পরই ‘অর্জুনের
তপস্যা’ বা ‘Arjun’s Penance’ নামে বেশ বড় অপূর্ব
সুন্দর এক Bas-Relief দেখতে পেলাম। আমার মনে হল
‘অপূর্ব সুন্দর’ কথাটা বোধ হয় খুবই নিচু স্তরের
প্রশংসা হয় এর ক্ষেত্রে। কিন্তু আর কোনও বিশেষণ
খুঁজে পাচ্ছি না এর জন্যে। এই রিলিফের কাজের বর্ণনা
করা বেশ অসুবিধা রিলিফের ধারায় তৈরি মোট ২৭X৯
মিটার বর্গের দুটি পাশাপাশি তিমির আকারে পাথরের
ওপর এর অসংখ্য ভাস্কর্যের জন্যে। পরস্পর মোট পাঁচটি
ছবিতে এই রিলিফ দেখাবার চেষ্টা করছি।
অর্জুনের
তপস্যা -১(বড় করে দেখতে হলে ছবির ওপর ক্লিক করুন)
অর্জুনের
তপস্যা -২ (বড় করে দেখতে হলে ছবির ওপর ক্লিক করুন)
অর্জুনের
তপস্যা -৩ (বড় করে দেখতে হলে ছবির ওপর ক্লিক করুন)
অর্জুনের
তপস্যা -৪(বড় করে দেখতে হলে ছবির ওপর ক্লিক করুন)
অর্জুনের
তপস্যা -৫(বড় করে দেখতে হলে ছবির ওপর ক্লিক করুন)
দুটি পাথরের
মাঝে যে সরু বিভাগ-রেখা আছে, সেই বরাবর প্রণাম
রত ওপর-নিচে নাগ ও নাগীর মূর্তি রয়েছে। এনাদের
মূর্তি রিলিফের প্রায় সব কয়টি ছবিতেই আছে, পাঠক
নিশ্চয় চিনে নিতে পারবেন। রিলিফের প্রধান বিষয়
এর নামেই প্রকাশ পাচ্ছে, অর্থাৎ (পাশুপত অস্ত্র
শিবের কাছে পাবার জন্যে) অর্জুনের তপস্যা। রিলিফের
মধ্যে শিবের উপস্থিতি বেশ পরিষ্কার, অর্জুনের তপস্যা -২-র
উপরের ডান কোনে চার হাত যুক্ত ত্রিশূল-ধারী শিব
মহিমময় ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন। ঠিক তাঁর ডান পাশে
যোগাসন রত এক দণ্ডায়মান সাধু। শিবের পাশে কয়েকজন
বামন গণ। কিন্তু কোথায় অর্জুন, আমি খুঁজে পাইনি।
হয়তো গাইড থাকলে তিনি ‘পরিচয়’ করিয়ে দিতেন তাঁর
সঙ্গে। নাগ ও নাগীর মূর্তির কাছেই বাঁ দিকে ছোট
এক মন্দির। মন্দিরের ভিতরে দণ্ডায়মান বিষ্ণু।
অর্জুনের তপস্যা -৪-এর মাঝামাঝি ও নিচের দিকে দুটি বড় হাতি
ও বেশ কয়েকটি শিশু হাতি লক্ষণীয় তাদের স্বাভাবিক
রূপের প্রতিফলনের জন্যে। মনে হয় আসল হাতির পরিবার
স্ট্যাচু-স্ট্যাচু খেলছে। প্রতিটি হাতির শারীরিক
গঠন সম্পূর্ণ সুসমঞ্জস। এইখানেই আর একটি মণ্ডলী
বা গ্রুপ আছে ভাস্কর্যের যা অতি কৌতূহলোদ্দীপক।
বাঁদিকের দাঁতাল হাতির দাঁতের নিচে লক্ষ করুন।
সামনের পা দুটো উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তপস্যারত
এক বিড়াল (বিড়াল-তপস্বী?)। আশপাশে অনেকগুলো ইঁদুর
বিভিন্ন ভঙ্গিমায় অবস্থান করছে। এই রকম সৃষ্টি
ছাড়া সৃষ্টির কারণ খুঁজতে গেলে সম্পূর্ণ বাস-রিলিফটিই
এক সঙ্গে অনুধাবন করতে হবে। অনেক সংখ্যক সাধু
বিভিন্ন যোগাসন করা অবস্থায় ফ্রিজ হয়ে আছেন যেমন
আছে অনেক হিংস্র ও মাংসাশী এবং নিরীহ ও নিরামিষাশী
পশু (না, কেন পাখি নেই, জানিনা। হ্যাঁ, গাছের
অভাবও লক্ষণীয়) পাশাপাশি। বলা হয় এই রিলিফ কোনও
এক তপোস্থলীর ছবি, অর্থাৎ সর্বদাই সেখানে শান্তি
বিরাজ করছে। শিব ও বিষ্ণু ছাড়া আরও কয়েকজন দেবতার
উপস্থিতিও রয়েছে, যেমন চন্দ্র ও সূর্য। গন্ধর্ব,
অপ্সরা, কিন্নর, সিদ্ধ, সকলকেই এখানে দেখা যায়।
এখানে অবশ্য কয়েকজন অস্ত্রধারী বা যোদ্ধাও আছেন।
মনে হয় সম্ভাব্য বহিরাগত আক্রমণ প্রতিরোধ করার
জন্যে। আশা করি বিড়াল ও ইঁদুরের পাশাপাশি বাসের
কারণ বোঝা গেছে।
এবার এই
রিলিফের বিষয় আসলে কি হতে পারে তা নিয়ে কিছু আলোচনা
করি। অর্জুনের অনুপস্থিতি আমার মনে অস্বস্তি জাগিয়েছে,
যদিও এও মনে হয়েছে আমি হয়তো তাঁকে এখানে খুঁজে
পাইনি, আসলে তিনি আছেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন
যে শিকারির ছদ্মবেশে শিব নেই কেন এখানে। কারণ
পাশুপত অস্ত্র অর্জুনকে দান করার আগে তাঁর সঙ্গে
যুদ্ধ করেছিলেন শিব। লক্ষ করলে দেখবেন যে বিষ্ণুর
মন্দিরের বাঁদিকের নিচে বেশ কয়েকজন সাধু জল বা
নদীতে স্নান করার পর সূর্য নমস্কার, কাপড় নিংড়ানো,
ইত্যাদি করছেন অর্জুনের তপস্যা -৪ ও ৫-এর নিচের দিকে
সাপের ফণার বাঁদিকে লক্ষ করুন)। উল্লেখ্য যে নাগের
উপস্থিতি সাধারণত জল বা নদীর চিহ্ন বা symbol-রূপে
গণ্য করা হয়ে থাকে। এই কারণে অনেকে এই রিলিফটি
ভগীরথের তপস্যার ফলে শিবের দ্বারা নিজের জটা থেকে
গঙ্গার মুক্তি দান বোঝাচ্ছে। অর্থাৎ, এটি ‘গঙ্গাবতরণ’-এর
রিলিফ (The Illustrated History of South India,
Nilkantha Sastri, K.A., O.U.P., New Delhi, 2009,
p298)।
যাই হোক
‘অর্জুনের তপস্যা’ না ‘ভগীরথের তপস্যা’ বা ‘গঙ্গাবতরণ’
হিসাবে রিলিফটি বিচার করবেন কি না আপনি চিন্তা
করুন, আমি এই অপরূপ ভাস্কর্যের পাশেই এক ‘হনুমান
পরিবার’-এর ভাস্কর্য দেখতে পেলাম, তার কথা বলি। পরিবারের দুজনে
যেমন একে অপরের গা থেকে উকুন বেছে দেয়, ভাস্কর
সেই নিত্যনৈমিত্তিক ‘বাঁদরামি’ অতি প্রাঞ্জল ভাবে
বুঝিয়ে দিয়েছেন।
হনুমান
পরিবার
‘বাঁদরামি’
দেখার পর, যদিও কিছু গুহা ইত্যাদি রয়েছে, তবে
কেন জানি না ছবি তুলি নি, তাই সেগুলোর বর্ণনা
করার চেষ্টা করলাম না। দ্বিতীয় মহেন্দ্রবর্মনের
পুত্র প্রথম পরমেশ্বরবর্মন (খ্রী. ৬৭২-৭০০) দ্বারা
একটি মাত্র পাথর বা ছোট পাহাড় খোদাই করা ‘গণেশ
রথ’ দেখলাম
যা হয়তো নির্মাণের সময় ‘শিব রথ’ নামে পরিচিত ছিল।
গণেশ
রথ(বড় করে দেখতে হলে ছবির ওপর ক্লিক করুন)
এই ধারণার
কথা বললাম এই জন্যে, যে কোনও অজ্ঞাত কারণে স্থানীয়
গ্রামবাসীদের দ্বারা পিতার মূর্তির স্থানে পুত্রের
মূর্তি মাত্র চার পাঁচ দশক আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে
এই গুহায়। এই রথের সঙ্গে ভীম রথের বেশ সাদৃশ্য
আছে যদিও ভীম রথের আকার এর থেকে বেশ বড়। রথের
ভিতরে প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি, কারণ অন্যান্য রথের
মতো দরজা-হীন অন্দর নয়, এর অন্দরের দরজা আছে এবং
তা তালা বন্ধ ছিল। হয়তো গণেশ এখানে পূজা পেয়ে
থাকেন। রথের শীর্ষ বা ছাদের ও বাইরের দেয়ালের
শিল্প অর্থাৎ ভাস্কর্যের বর্ণনা করলাম না। পাঠকের
প্রতি অনুরোধ রইলো উপস্থিত ছবিটি zoom করে দেখতে,
আমার বর্ণনার থেকে তা বেশি কার্যকর হবে। অবশ্য
প্রত্যেক ছবিই zoom করে দেখার মতো।
গণেশ রথের
খুব কাছেই ডিম্বাকার এক বিরাট পাথর পড়ে আছে, মনে
হয় খুব সহজেই নড়ানো যাবে। লোকে এর নাম দিয়েছে
কৃষ্ণের ‘মাখন পিণ্ড।‘ এই পিণ্ড দেখে জবলপুরের
‘Balancing Rock’-এর কথা মনে পড়ে গেল।
জবলপুরের
‘Balancing Rock’
গণেশ রথের
পাশ দিয়ে পথ অল্প ওপর দিকে উঠে বাস-রিলিফ অর্জুনের
তপস্যার পিছন দিকে চলে গেছে। বাঁ দিকে দেখলাম
গুহা মন্দির ‘বরাহ-মণ্ডপ’।
বরাহ-মণ্ডপ
মণ্ডপের
মধ্যে বিষ্ণুর বরাহ অবতার রূপের ভাস্কর্য ছাড়া আরও তিনটি অপূর্ব ভাস্কর্য
বা ডাওরামার প্যানেল আছে।
বিষ্ণুর
বরাহ অবতার
যেমন, ঢুকতেই
ডান দিকে ‘ত্রিবিক্রম’,
এর সামনে ‘দুর্গা’,
ও তার পাশে ‘গজ-লক্ষ্মী’।
ত্রিবিক্রম
দুর্গা
গজ-লক্ষ্মী
এই প্যানেলগুলি
সম্পর্কে দু-চার কথা না বললেই নয়। প্রথমে বরাহ
প্যানেলের সম্পর্কে বলি। অবতার তাঁর খড়্গের সাহায্যে
ধরিত্রী বা পৃথিবীকে সমুদ্র থেকে উত্থান করেছেন।
তাঁকে ভক্তি প্রদর্শন করছেন সূর্য, ব্রহ্মা, ঋষিগণ
এবং পৃথিবী রূপী দেবী। বরাহের ডান পা শেষনাগের
ফণার ওপর রাখা। চিত্র-২১-এর নিচের দিকে পদ্ম পাতা
ও তরঙ্গ লক্ষ করুন। জলের মধ্যে পদ্মের ওপর দেবী
বসে আছেন। দেবীর মুকুট অদ্ভুত প্রকারের, এই অদ্ভুত্বের
কোনও বিশেষ তাৎপর্য আছে কিনা তা আমার অজানা। দুই
পাশে দুই পরী ঘড়ায় জল নিয়ে আছে যা ওপর থেকে দেবীর
মাথায় ঢেলে দেবে দুই দিকে দুই হাতি। দেবীর দুই
হাত কিছু (সম্ভবত পদ্ম) ধরার জন্যে তৈরি। দুর্গার
কথা অনেক আগেই বলা হয়েছে। এখানে বলি যে দেবীর
মাথার ওপর ছত্র তাঁর জগতের সর্বময় কর্তৃত্বের
বার্তা জানাচ্ছে। ওপরে একদিকে তাঁর বাহন সিংহ
আর অন্য দিকে হরিণ দেখানো হয়েছে। ত্রিবিক্রম বা
বিষ্ণুর এই রকম মূর্তি আর কোথাও আছে কিনা আমার
সন্দেহ হয়। শঙ্খ, চক্র ও গদা ছাড়া ধনুক, ঢাল আর
তরোয়ালও ধারণ করে আছেন। স্বাভাবিক ভাবেই এখানে
উনি অষ্টভুজ। ডান দিকে শূন্যে ত্রিশঙ্কুকে দেখিয়ে
ভাস্কর বোঝাতে চাইছেন যে বিষ্ণুর সমগ্র বিশ্বে
অবাধ গতি। ডান কাঁধের ওপরে ঢোল বাজানো অবস্থায়
জাম্বুবানকে দেখানো হয়েছে। বরাহ-মণ্ডপ থেকে ওপরের
দিকে উঠে যাবার সিঁড়ি সহ পায়ে চলা রাস্তা রয়েছে
দেখলাম। আমরা সেই পথে এগোতে গিয়ে সিঁড়িতে এদের
বসে থাকতে দেখলাম এমন ভাবে যে মনে হল যেমন ‘অর্জুনের
তপস্যা’-য় দেখেছিলাম দুই হরিণ কাছাকাছি বসে বিশ্রাম
নিচ্ছে, ঠিক তেমনই দুই ছাগল পাশাপাশি বিশ্রামরত।
ড.
শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী
(চলবে)
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)