প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বাংলাদেশে দু সপ্তাহ

১। ঢাকা -- রঙ ও নান্দনিকতা

প্লেনটা কলকাতা থেকে উড়তে না উড়তেই ঢাকায় নেমে পড়ল। এক ঘন্টাও লাগলো না। নীচে বাংলার প্রকৃতি ছিল মাঘের কুয়াশায় ঢাকা; ওপর থেকে “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি” একেবারেই বলতে পারলাম না। তবে ভাগ্য ভাল ঢাকা পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেখি সূর্যদেব উঠে গেছেন কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে। চারিদিক ঝকঝকে পরিষ্কার। সেই শুরু হল আমার দু সপ্তাহের বাংলাদেশ সফর – যার মাধ্যমে আমার সে দেশ সম্বন্ধে অনেক অজ্ঞতা এবং আবছা অথবা ভ্রান্ত ধারণা আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে গেল।

সাইকেল রিক্সার চাঁদোয়ায় রঙের বাহার    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

ঢাকায় বেরিয়ে প্রথমেই যেটা চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে রঙের বাহার। বিশেষ করে সাইকেল রিক্সার চাঁদোয়ায় বা হুডে। পশ্চিম বাংলায় যেগুলো দেখতে ধুলোটে ধুসর, বাদামী বা খাকি, ঢাকায় (বা বাংলাদেশের অন্যান্য শহরে) সেগুলো কখনো গাঢ় নীল, কখনো বা রক্তিম বর্ণ -- আর তার মাঝে আছে সোনালী বা কালো বা অন্য কোনো রঙের সুদৃশ্য ডিজাইন। অটোরিক্সগুলো আবার গাঢ় সবুজ। আর সেগুলোকে বলে সি এন জি, কারণ তেনারা কম্প্রেসড ন্যাচারাল গ্যাসে চলেন। কারু কারুর চোখে এটা বর্ণাঢ্যতার বাড়াবাড়ি বলে মনে হতেই পারে। কিন্তু পারিপার্শ্বিক বৈচিত্রহীনতার একঘেয়েমি কাটানোর পক্ষে এটা খুবই আকর্ষণীয় বলে আমার মনে হল।

রঙের বাহার নতুন রঙ করা বড় বড় বাড়ীতে     ছবিঃ ধৃতি বাগচী

আর শুধু সাইকেল রিক্সায় নয়, রঙের বাহার ছিল অন্যত্রও – যেমন দোকানের সাইনবোর্ডে, ফুটপাথের হকারের পসরায়, অধুনাপরিষ্কৃত দেয়ালচিত্রে অথবা নতুন রঙ করা বড় বড় বাড়ীতে। এই নান্দনিকতার পেছনে গভর্মেন্টের চাপ নিশ্চয় কিছুটা ছিল, কারণ কিছুদিন পরেই শুরু হচ্ছিল ওয়ার্ল্ড কাপ অফ ক্রিকেট – যার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নিয়ে ঢাকা ছিল উত্তাল এবং প্রস্তুত হচ্ছিল প্রভুত বিদেশীদের শহরে আগমন ও অভ্যর্থনার জন্য।

এই সাইকেল রিকশাগুলোতে চড়ে ওয়ার্ল্ড কাপ ক্রিকেটের উদবোধনের দিন যোগদানকারী দেশগুলির আধিনায়করা এসেছিলেন...    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

কিন্তু সেটাই বর্ণাঢ্যাতার একমাত্র কারণ নয়; একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় এটার পেছনে রয়েছে সাধারণ নাগরিকদের উৎসাহ, মননশীলতা ও বিচক্ষণতা। আমার থাকাকালে ঢাকা শহর পহেলা ফাল্গুন উদযাপন করল উজ্জ্বল হলুদ রঙে নিজেকে মুড়ে দিয়ে। চারিদিকে সেদিন ছিল হলুদ শালুর ঢাল, আর অল্পবয়সী মেয়েরা বেরিয়ে পড়েছিল বাসন্তী শাড়ী পরে। ছোট ছোট জিনিষের মধ্যেও প্রস্ফুটিত হচ্ছিল রঙের প্রতি আকর্ষণ ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গী – দোকানের ব্যাগ থেকে শুরু করে আরো বিভিন্ন জায়গায়।

রমনা অঞ্চলে রাখা সোনালি শকট, চালক ও আরোহী    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

যে জিনিষটা নান্দনিক কারণে আমাকে সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করল সেটা হচ্ছে ঢাকার অধিকাংশ যান বৃত্তের (ট্রাফিক সার্কেলের) মধ্যে রাখা স্থাপত্য। সম্ভবত: ইসলাম ধর্মে জীব-জন্তুর মূর্তি গঠনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় বেশীরভাগ স্থাপত্যের গড়নেই ছিল মূলত: জ্যামিতিক আকৃতি অথবা কাল্পনিক ডিজাইন। যেমন ধরুন -- অনেকগুলি লোহার বলয়ের সমন্বয়ে তৈরী গোলকরূপী খাঁচা; অথবা প্রস্থচ্ছেদ-দৃশ্য বাঁকা করে কাটা ফাঁপা পাইপ বা সিলিণ্ডার; রকেট যান; কিংবা ধাতব প্লেট ও তার দিয়ে তৈরী অতিবাস্তব ও স্বপ্নালু কোন অবয়ব। এর কিছু ব্যতিক্রম ছিল অবশ্য – যেমন ধরুন ঢাকা ইউনিভার্সিটির কাছে উড্ডীয়মান বকপাঁতি (“বলাকা”); শহীদ মিনারের কাছে একদল মুক্তিযোদ্ধা; বা রমনা অঞ্চলে রাখা সোনালি শকট, চালক ও আরোহী। পরে চট্টগ্রাম এবং অন্যান্য শহরে গিয়েও আমি ওইরকম শহুরে স্থাপত্যের নিদর্শন দেখেছি।

শহীদ মিনারের কাছে একদল মুক্তিযোদ্ধা    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

ঢাকার সবচেয়ে বড় অসুবিধে দেখলাম ট্রাফিক ও যানজট। বাংলাদেশের বেশিরভাগ গাড়ীই শুনলাম সি এন জি তে চলে। এই দাহ্যবস্তুটির দুটি বড় গুণ – বাংলাদেশে এটি পেট্রলের থেকে সস্তা এবং এটার আবহাওয়া দূষণ কম। এই দুটি কারণে ঢাকায় গাড়ীর সংখ্যা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে; কিন্তু সে তুলনায় রাস্তা যথেষ্ট পরিমাণে বাড়েনি। কাজে কাজেই যানজট সর্বত্র এবং রাস্তায় ঘন্টার পর ঘন্টা সময়ের অপচয় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।

যানজট সর্বত্র     ছবিঃ ধৃতি বাগচী

কিছু উড়ালপুল তৈরী হচ্ছে ঠিকই, রাস্তার গাড়ীর ভীড় ও জট কমানোর জন্য, কিন্তু এ সমস্যার পুরো সমাধান করতে হয়তো ভূগর্ভরেলপথ দরকার হবে। যানবাহন সম্পর্কিত আরেকটা দুর্বলতা দেখলাম লোকাল বাস ও বিশেষকরে ট্যাক্সির ভীষণ অভাব। দূরপাল্লার বাস অবশ্য রাস্তায় ছিল প্রচুর। ঢাকার ট্রাফিক নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ও মিউনিসিপাল গভর্মেন্টের পক্ষে সমীক্ষা, পর্যালোচনা ও যথাশীঘ্র সমাধানের প্রয়োজন রয়েছে।

ঢাকা - রাতের একটা দৃশ্য     ছবিঃ ধৃতি বাগচী


২। সিলেট – ধর্ম ও সহিষ্ণুতা

ঢাকার প্রথম প্রত্যুষে আমার ঘুম ভাঙল আজানের শব্দে। বাড়ীর কাছেই ছিল রমনার জামা মসজিদ; সেখান থেকে লাউড স্পীকারে জানান দিল ফজরের নামাজের সময় হয়ে গেছে।প্রথম দিন ভোরে চমকে গিয়ে উঠে পড়েছিলাম। তার পরে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম; ভোরের আজান হয়ে গেল আমার নিত্যসঙ্গী – এলার্ম ক্লকের মত। যদিও ইন্দোনেশিয়ায় বালক প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছে আজানধ্বনি যতটা সুরেলা ও শ্রুতিমধুর ঠেকত, আমার কাছে ঠিক ততটা মনে হয়নি।

প্রথম সকালে যেমন আজানের ডাক মনে করিয়ে দিল যে বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ, প্রথম সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের চত্বরে সরস্বতী পূজার ধুমধাম বুঝিয়ে দিল যে সেদেশে অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও স্থান আছে। জগন্নাথ হলের সরস্বতী পূজো এক এলাহি ব্যাপার – সবিশেষ আড়ম্বর সহ উদযাপিত হয়। কাতারে কাতারে লোক। পুলিশ অনেকখানি জায়গা কর্ডন করে রেখেছে; গাড়ী চলাচল নিষিদ্ধ – পায়ে হেঁটে যেতে হবে। চারিদিকে ফেরিওয়ালা, বেশ একটা মেলা-মেলা ভাব। ভেতরে ঢুকে প্রথমেই চোখে পড়ল পুকুরের মাঝখানে বিশাল দেবীমূর্তি ও জলে তার প্রতিবিম্ব। তার ওপরে নানা রঙের আলো পড়ছে ও পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। একটু এগিয়ে অডিটোরিয়াম; সেখানে স্টেজের ওপরে আরেকটি বড় দেবীমূর্তি -- পূজার সামগ্রীসহ -- এবং তার সামনে অনেক লোক বসার ব্যবস্থা। সেটা ছাড়িয়ে এগোলে একটা বিশাল খেলার মাঠ, যেটার চারিধার দিয়ে বসানো প্রায় একশটা প্যান্ডেল – যার মধ্যে রয়েছে প্রতি ডিপার্টমেন্টের নিজস্ব সুসজ্জিত প্রতিমা। এ এক সত্যিই অভিনব দৃশ্য। পরিষ্কার বোঝা গেল দর্শকবৃন্দ শুধু হিন্দুই নন, মাঝে অনেক উদারচেতা মুসলমানও রয়েছেন।

শেখ মুজিবের বাড়ি এখন মিউজিয়াম    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

ঢাকার একটি প্রাঙ্গণে সরস্বতী পূজো বর্ণনা করার অর্থ এই নয় যে বাংলাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা উবে গেছে। ওদেশে সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব সময় এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নির্ভর। দুহাজার এক সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৮৯.৭% মুসলমান, ৯.২% হিন্দু, ০.৭% বৌদ্ধ, ০.৩%খৃষ্টান, এবং ০.১% অন্যান্যেরা। ১৯৪৭-এ ভারত বিভাজনের সময় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুর সংখ্যা ছিল এক-তৃতীয়াংশ। বিগত চৌষট্টি বছরে অনেক রায়ট ও সংখ্যালঘুদের ওপর ধর্মভিত্তিক নির্যাতনের পরিণতি হয়েছে হিন্দুদের সংখ্যার দ্রুত হ্রাসপ্রাপ্তি। রাজনীতিতে দেশটি আদর্শ হিসেবে একবার (বঙ্গবন্ধু মুজিবের সময়) গ্রহণ করেছে ধর্মনিরপেক্ষতা আবার অন্যসময়ে (জিয়া এবং এরশাদের আমলে) আঁকড়ে ধরেছে ইসলামিসত্ত্বা। আপাতত: বাংলাদেশ শাসন করছে মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ, যারা সংখ্যালঘুদের প্রতি মৈত্রীভাবাপন্ন। কাজেই আপাতদৃষ্টিতে অন্তত: সাম্প্রদায়িক ঐক্য বজায় রয়েছে। কিন্তু বিরোধীপক্ষ ক্ষমতায় এলে কি হবে বলা শক্ত, কারণ বিএনপির জোটের মধ্যে বিদ্যমান মৌলবাদী ও হিন্দুবৈরী পার্টি জামাত-এ-ইসলামি।

সরস্বতী পূজোর পরের দিন আমি বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেটের পথে রওনা দিলাম ডিলাক্স বাসে চেপে। বাস টার্মিনাসটি দেখলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন; ভেতরে বেশ আরাম করে সোফায় বসা যায় বাস ছাড়ার আগে। গ্রীণলাইন কোম্পানি চালিত শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ভোলভো বাসটিও মন্দ ছিল না – একটু চাপাচাপি ছাড়া। বাংলাদেশে এখন দূরপাল্লার যাত্রায় বাসই বিশেষকরে জনপ্রিয় হয়ে পড়েছে।

বাস টার্মিনাসটি দেখলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। স্বভাবতই ঢাকার পাশে শীতলক্ষ্যা থেকে শুরু করে বাস একের পর এক নদী পার হতে লাগল। ভৈরবে এসে মেঘনা পেরিয়ে আমরা “হোটেল রাজমণি”তে লাঞ্চ খেতে থামলাম।

ভৈরবের কাছে ব্রিজ থেকে মেঘনা নদী...     ছবিঃ ধৃতি বাগচী

হোটেল রাজমণি     ছবিঃ ধৃতি বাগচী

রাস্তার ধারে মুখ্যত: উচ্চবিত্ত ট্যুরিষ্টদের জন্য তৈরী এরকম খাবারের জায়গাগুলো খুব কেতাদুরস্ত ও ঝকঝকে পরিষ্কার। আর শুধু খাবারই নয়, এসব জায়গায় স্থানীয় প্রসিদ্ধ মিষ্টান্নও গর্বের সঙ্গে বিক্রি করা হয়।

গ্রামের দৃশ্য - সিলেট যাবার পথে    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

সিলেটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। সুরমা নদীর ধারে মাঝারি সাইজের শহর সিলেট, কিন্তু তুলনামূলকভাবে দ্রষ্টব্য বিষয় বেশ কিছু সুউচ্চ অট্টালিকা। স্থানীয় লোকেরা জানাল উঁচু বাড়ী তৈরীর পেছনে হাত রয়েছে বিশেষত: লন্ডনে অধিবাসী সিলেটীদের। তারা সেখানে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় বিশেষ কৃতি হয়েও পৈতৃক শহরকে ভোলেনি; বরং সেখানে টাকা ঢেলে সিলেট শহরকে ধনাঢ্য করেছে।

সিলেট শহরের কেন্দ্রস্থলের একটা দৃশ্য    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

শহরটায় বেশ কিছু সুন্দর বেড়াবার জায়গা রয়েছে। সুরমা নদীর কিনারে অনেকখানি জায়গা প্রশস্ত করে বাঁধিয়ে ও ডোম লাইট লাগিয়ে পদচারীদের হাঁটার জন্য মনোরম করে তোলা হয়েছে। আগে যে পুরোনো ব্রিজটা ছিল – যেটা তৈরী করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানী ফ্রন্টকে সাপ্লাই করার জন্য – সেটা ভেঙ্গে করা হয়েছে সুরমার ওপরে নতুন ব্রিজ। শহর থেকে বিশেষ করে ভারতবর্ষের মেঘালয় যাবার দিকে রয়েছে অনেক ছোটবড় পাহাড় ও টিলা, যার ঢালু গায়ে আছে চা-বাগান, আর যার ওপরে কোথাও কোথাও তৈরী হয়েছে যাত্রীনিবাস, পার্ক বা ছোটদের জন্য আমোদোদ্যান। শহরের মধ্যে ওই রকম একটা টিলার ওপরে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় সেনাবাহিনী প্লেন থেকে প্যারাশুট করে সৈন্য নামিয়েছিল। এখন সেখানে রয়েছে আবহাওয়া দপ্তরের অফিস।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এইখানে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্লেন থেকে প্যারাশুট করে সৈন্য নামিয়েছিল     ছবিঃ ধৃতি বাগচী

শাহ জালালের মাজারে প্রজ্বলিত প্রদীপরাশি    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

সিলেট ও তার আশেপাশে দুটো জায়গা দেখলাম যা ধর্মীয় কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হল শাহ্‌ জালালের মাজার বা পবিত্র গোরস্থান। উত্তরভারত থেকে স্বল্পসংখক যে ক’জন ধর্মপ্রচারক বা আউলিয়া এসে বাংলাদেশকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, তাদের অন্যতম শাহ্‌ জালাল এসেছিলেন সিলেটে। তাঁর মাজার একটি তীর্থস্থান বিশেষ – সেখানে রয়েছে প্রজ্বলিত প্রদীপরাশি, দানগ্রহণের কলসী আকৃতির পাত্র ও পিছনে বাঁধানো ও দেয়ালে ঘেরা ছোট পুকুর। দ্বিতীয়টি হল সিলেট থেকে অল্প দূরে ঢাকা দক্ষিণ। সেখানে শ্রীচৈতন্য শচীমাতার গর্ভে এসেছিলেন এবং সেই অবস্থায় জগন্নাথ মিশ্র সস্ত্রীক সিলেট থেকে বসবাস তুলে নদীয়ায় চলে যান। ঢাকা দক্ষিণে মিশ্র পরিবারের ভিটের পাশে রয়েছে শ্রীচৈতন্য ও রাধা-কৃষ্ণকে নিয়ে বিরাট বৈষ্ণব মন্দির। এই মন্দিরের অধুনা সংস্কার করা হয়েছে মুসলমান বাংলাদেশিদের দাক্ষিণ্যে, যেটা ধর্মসহিষ্ণুতার পক্ষে একটা প্রকৃতই বড় নিদর্শন।

ঢাকা দক্ষিণে শ্রীচৈতন্য মন্দিরের প্রবেশদ্বার     ছবিঃ ধৃতি বাগচী


৩। কুষ্টিয়া ও শিলাইদহ – নদী আর সেতু

বাংলাদেশ বলতেই যে ছবি মনের মধ্যে আসে তা হল নদীর ও জলের। আসলে ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি প্রধান নদীর মধ্যে দুটি – গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র – বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে সমুদ্রে (অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরে) মেশার আগে। নদী দুটিরই বাংলাদেশে ঢুকে নাম পালটে যায় – গঙ্গা হয়ে যায় পদ্মা আর ব্রহ্মপুত্র হয়ে যায় যমুনা। নদী দুটি ঢাকার কাছে যুক্ত হয়ে পদ্মা নামে প্রবাহিত হয়। কিন্তু কিছু পরে উপনদী মেঘনার সঙ্গে মিশে আশ্চর্যজনকভাবে তার নাম হয়ে যায় মেঘনা। আমার যাত্রাপথে এক ড্রাইভার খুব গর্বের সাথে বলেছিল যে তার দেশে আড়াই শ’টি নদী আছে। (গণনা কে করেছিল, সে প্রশ্ন আমি তাকে অবশ্য করিনি।)

গাড়ি ভর্তি ফেরিবোট - নারায়ণগঞ্জের আরিচা ঘাটে    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

আমার পরবর্তী গন্তব্যস্থল কুষ্টিয়া, বাংলাদেশের পশ্চিম দিকে মাঝামাঝি জায়গায়। এবার রওনা হলাম ঢাকা থেকে বড় গাড়ী করে। (বাংলাদেশের বাকি ট্রিপটা আমি গাড়ী করেই বেড়িয়েছিলাম।) ঘন্টা দুয়ের মধ্যে পৌঁছে গেলাম নারায়াণগঞ্জের আরিচা ঘাটে – পদ্মা ও যমুনার সংযোগস্থলের কাছে। কুয়াশা কাটার জন্য খানিকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। তারপর বড় ফেরী করে (যাত্রী এবং গাড়ী সহ) পদ্মা পার হয়ে চলে এলাম গোয়ালন্দ ঘাটে। এই নদী পার হওয়াটা একটা স্মরণীয় অভিজ্ঞতা – অনেক বাঙালি উপন্যাসে পাওয়া যায়। মাঝগাঙ্গে এপার ওপার দেখা যায় না; মনে হয় সমুদ্রে বা বিশাল হ্রদে ভাসছি।

লেখকের পেছনে পদ্মা - মাঝগাঙ্গে এপার ওপার দেখা যায় না।     ছবিঃ ধৃতি বাগচী

কুষ্টিয়া খুবই ছোট শহর; গ্রামীণ অর্থে বর্ধিষ্ণু বলে মনে হল। চারিদিকে শস্যশ্যামল চষা খেত। পুরোনো যুগের পর্ণকুটিরের খড়ের চাল আর নেই; নতুন যুগে সেটা হয়ে গেছে করোগেটেড টিনের। মাটির দেয়ালের জায়গায় এসেছে বাঁশের ওপরে চাটাই অথবা কোথাও কোথাও টিন। অধিকাংশ বাড়ীতেই পরিষ্কার নিকোনো উঠোন, পাশে ছোট পুকুর, কয়েকটা ফলের গাছ ও গুটিকয় পোষা প্রাণী – বেশীরভাগই ছাগল ও মুরগি এবং কখনো কখনো একটা কি দুটো গরু বা মোষ। বাঙালি জীবনের পটচিত্র বলা চলে – বহু কবির কবিতায় যা আমরা পড়ে থাকি।

পুরোনো যুগের পর্ণকুটিরের খড়ের চাল আর নেই; নতুন যুগে সেটা হয়ে গেছে করোগেটেড টিনের।    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

কুষ্টিয়ার এক বড় দ্রষ্টব্য লালন ফকিরের (বা লালন শা’র) মাজার। লালন ছিলেন বাউল সম্প্রদায়ের লোক – যারা গানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিকতা ব্যাখ্যা করে হিন্দু বৈষ্ণবধর্ম ও ইসলামি সুফিধর্মের সমন্বয় ঘটিয়ে।

লালন ফকিরের (বা লালন শা’র) মাজার    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

ভক্ত এবং পর্যটকরা লালন শা'র মাজারে ঢুকছে    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

লালন শা'র মাজারে ঢোকার মুখে চোখে পড়ার মত দোকান    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

অন্য বড় আকর্ষণ হচ্ছে (রবীন্দ্রনাথ) ঠাকুর পরিবারের কুঠিবাড়ী (নাম “টেগোর লজ”)। আসলে ঠাকুর পরিবারের বড় কুঠিবাড়ী ছিল কুষ্টিয়া থেকে একটু দূরে শিলাইদহে – যেখানে তাঁদের অনেক জমিজমা ছিল। এখানে পদ্মার ওপরে নৌগৃহে (বোটহাউসে) থাকাকালে রবি ঠাকুর তাঁর প্রথমদিকের অনেক মহৎ কবিতা রচনা করেছিলেন।

ঠাকুর পরিবারের কুঠিবাড়ী (নাম “টেগোর লজ”)    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

আনন্দের কথা কুষ্টিয়া ও শিলাইদহ, এই দুই জায়গার কুঠিবাড়ীরই সুসংস্কার করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবার্ষিকি উপলক্ষে এবং ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম সহযোগিতায় ও আর্থিক সাহায্যে।

টেগোর লজে ঢোকার মুখে রবীন্দ্রনাথের মূর্তির পাশে ধৃতি বাগচী     ছবিঃ লেখক

টেগোর লজের ভেতরে একটি ঘরে লেখক    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

 

কুষ্টিয়া থেকে যাত্রা শিলাইদহের প্রতি। পথে চোখে পড়ল পদ্মার ওপরে সেই বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, যেটা ব্রিটিশ আমলে তৈরী হয়েছিল কলকাতার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের রেলপথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য। নদীর খাত সেই সময় থেকে অনেক পালটে গেছে; পুরোনো ধারা অনেক জায়গায় শুকিয়ে গেছে।

বিখ্যাত হার্ডিঞ্জ ব্রিজ    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

নতুন সেতুও অনেক তৈরী হয়েছে, মুখ্যত: গাড়ী চলাচলের জন্য – যেমন পদ্মার ওপরে কুষ্টিয়ার কাছে লালন সেতু। শিলাইদহর কুঠিবাড়ী দেখাটা স্বভাবতই চিরস্মরণীয় ব্যাপার। কবিগুরুর ব্যবহৃত অনেক আসবাব-পত্র রাখা আছে। পদ্মা অবশ্য অনেক দূরে সরে গেছে। তবে শিলাইদহে পদ্মার প্রধান স্রোত যে খাতে বয়, সেটা এখনো বিশাল – উল্টো পার দেখা দুষ্কর।

কবিগুরুর শিলাইদহর কুঠিবাড়ী     ছবিঃ ধৃতি বাগচী

রবীন্দ্র কুঠিবাড়ি ঢোকার মুখে সাইন বোর্ড    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত খাট    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় ঠাকুরদের কাছারিবাড়ি     ছবিঃ ধৃতি বাগচী

দরজা জানলা চুরি হয়ে যাওয়া কাছারিবাড়িতে ছোটরা পড়াশুনো করছে    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

এটি একসময়ে ছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাতব্য চিকিৎসালয়    ছবিঃ ধৃতি বাগচী

ঢাকা ফেরার পথে আমরা গোয়ালন্দে ফেরীপার না হয়ে একটু ঘুর রাস্তা নিয়েছিলাম দেশ দেখার অছিলায় – পাবনা ও নাটোর হয়ে। বঙ্গবন্ধু সেতু ধরে যমুনা পার হয়ে এসে গেলাম টাঙ্গাইলে। করটিয়ার সাদত কলেজ (যেখানে আমার দাদামশায় দীর্ঘদিন পড়িয়েছিলেন বাংলা ও সংস্কৃত) দেখে অবশেষে ফিরে এলাম ঢাকায়। পরে শুনলাম বঙ্গবন্ধু সেতু নাকি দৈর্ঘ্যে এশিয়ার বৃহত্তম, যদিও পার হবার সময় দেখলাম নদীর অনেকটাই চরা পড়েছে বা শুকিয়ে গেছে।

করটিয়ার সাদত কলেজ

নদীর জলবন্টন নিয়ে বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের সমস্যা রয়েছে। বাংলাদেশের (এবং পশ্চিমবঙ্গেরও) অধিকাংশ জমি অপেক্ষাকৃত নিচু। কাজেই প্রতি বর্ষায় বন্যা ও নদীর ভাঙ্গন ও খাত পরিবর্তন লেগেই থাকে – স্থানীয় লোকদের বিভীষিকার মত। তা সত্বেও আমার মনে হল বাংলাদেশীরা যেন চায় তাদের নদী সব সময় কানায় কানায় ভরা থাকে। (অবশ্য উপচে পড়ে বান ডাকাটা সম্পূর্ণ অকাম্য। যদিও বন্যার একটা সুফল পলিমাটির আস্তরণ ফেলে জমিকে উর্বর করে দেয়া।) তাদের অনেক কথাতেই ক্ষোভের আভাস থাকে ভারত ওপরদিকে বাঁধ দিয়ে (ফারাক্কা ব্যারেজ, তিস্তা ব্যারেজ, ইত্যাদি) দেশটাকে মরুভূমিপ্রায় করে দিচ্ছে বলে। বাংলাদেশে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি শীতকালে। দেখে মনে হয়েছে – বর্ষার বেশ কয়েক মাস পরেও – চাষের জমি ভেজা, কাদাটে বা পুরোপুরি জলমগ্ন। এ দৃশ্য কিছুটা সেচের ফল হলেও দেখে মনে হয়নি যে মরুপ্রায় উষরতার আশু সমস্যা দেশটার সামনে রয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, একটা উল্টো ধারণা আমার মাথায় এল। বাংলাদেশে গিয়ে আমি যে এত বিভিন্ন নামের জলা জায়গা দেখলাম ও অর্থ জানলাম – যেমন সিলেটের হাওর (বড় হ্রদের মত) বা পাবনা ও নাটোরের বিল (যেখানে বর্ষার জল শীতকালে নেমে গেলে চাষ-আবাদ করা যায়), ইত্যাদি – অত রকমের জলা জায়গার নাম পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় আছে কি?

(শেষাংশ)

অমিতাভ বাগচী

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।