প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ভ্রমণ

অগাস্ট ১৫, ২০১৫

মহাকালের সংসার ও একটি নদী

শিবাংশু দে

 

গঙ্গা এখানে উত্তরবাহিনী।

পুরাণে বলে, ধরিত্রী শেষনাগ বাসুকীর ফণার উপর অবস্থিত। সূর্য তাকে প্রদক্ষিণ করে। সত্যপ্রতিষ্ঠা হয়ে যাবার কয়েকশতক পরেও কিছু মানুষ এখনও এরকম বিশ্বাসে স্থির। হয়তো সংখ্যালঘু, কিন্তু তাঁরা রয়েছেন। এঁদের মধ্যে বড়ো অংশ হলেন নীলরক্ত বনারসিবাবুরা। শেষনাগ অংশটির সত্যাসত্য নিয়ে তাঁদের বেশি মাথাব্যথা নেই। কিন্তু তাঁরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন কাশীনগর শিবের ত্রিশূলের উপর অবস্থিত। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল, তিনলোকের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান বারাণসি। এখানে নাকি কখনও ভূমিকম্প হয়না। ক্বচিৎ কখনও কাশী বিশ্বনাথ ক্লান্ত বোধ করলে ত্রিশূলদন্ডে যখন একটু হেলান দিয়ে বসেন, তখন সামান্য মাটি কাঁপলেও কাঁপতে পারে। এটুকু ছাড় শিবকে দেওয়াই যেতে পারে। নদী ও মন্দির কয়েকবার স্থান পরিবর্তন করার পর বর্তমান অবস্থায় তারা কাছাকাছি রয়েছে।

এই স্থানটি ইতিহাসপূর্ব কাল থেকে ছিলো আর্যাবর্তের মহাশ্মশান। তার এই গৌরবময় ঐতিহ্য কালচক্রের সীমানা পেরিয়ে এসেছে।  শ্মশানই মহাকাল, সংহারের দেবতা শিবের প্রিয় ভূমি, এখানেই তাঁর উপযুক্ত অধিষ্ঠান। একটু খেয়াল করলে শিবের সঙ্গীসাথী ভূত-গণ-প্রেত-ভৃঙ্গীদের মধ্যরাত পেরোবার পর কালভৈরবের নেতৃত্বে কচৌড়িগলিতে মিঠাই খেতে আসতে দেখা যায়।

   'হিন্দু' ধর্ম কতো প্রাচীন তা কেউ জানেনা। অথবা সবাই নিজের মতো করে জানে। দশ থেকে এক, যে কোনও সংখ্যার পর তিনটে শূন্য বসিয়ে বক্তব্য রাখার লোকজন চারদিকে গিজগিজ করে। ফরাসি ডাক্তার বের্নিয়েরসাহেব একবার বনারসে এসে পন্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন কতোদিন ধরে 'হিন্দু'ধর্ম পৃথিবীতে রাজত্ব করছে। কাশীর পণ্ডিতেরা তাঁকে এতো রকম সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে এর প্রাচীনত্ব প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে সাহেব কিছু বুঝে, বেশিটাই না বুঝে 'হিন্দুধর্ম বড়ো প্রাচীন' বলতে বলতে বিদায় হয়েছিলেন। দীর্ঘকাল ধরে নানা পন্ডিতেরা এখানকার অসংখ্য পুরাতাত্বিক নিদর্শন পরীক্ষা করে প্রয়াস করেছেন এই শহরের বয়স নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত আসার। কিন্তু কোনও ঐক্যমত্য এখনও হতে পারেনি। কবে হবে কেউ জানেনা।

কিম্বদন্তী বলে, যখন কিস্যু সৃষ্টি হয়নি, তখন ভগবান শংকর তাঁর বাসস্থান কাশীকে নিজের ত্রিশূলের উপর স্থাপন করে ঘুরে বেড়াতেন। তার পর যখন চরাচর সৃষ্টি হলো তখন পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে একটা ভালো জায়গা দেখে তিনি সেই ত্রিশূলটি পুঁতে দিলেন। বনারস শহর তখন থেকে সেই জায়গাতেই বিরাজমান। তা এখন এই বিশ্বচরাচর কবে সৃষ্টি হয়েছে সেটা নিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হলেই বনারসের বয়সের ধাঁধাটা সমাধান হয়ে যাবে।

যেহেতু এই স্থানটি সৃষ্টির আগে থেকেই রয়েছে, তাই একে 'অপুনর্ভবভূমি' বলা হয়। এই জমিতে শিবের মৌরসিপট্টা থাকার সুবাদে একে 'রুদ্রাবাস'ও বলা হয়ে থাকে। পুরাকালে গাঙ্গেয় অববাহিকায় ভূমি অত্যন্ত উর্বর হওয়ার জন্য এই স্থান হরিৎময় ছিলো। তাই 'আনন্দবন' বা 'আনন্দকানন' নামও পাওয়া যায়। সেই সব অরণ্যে প্রচুর মুনিঋষিরা বসবাস করতেন, তাই এ ছিলো 'তপঃস্থলী' । ধীরে ধীরে জনসমাগম বাড়তে থাকায় তাদের অন্তিমসংস্কার যখন বেশ বড়ো মাত্রা নিলো তখন এই স্থানকে 'মহাশ্মশান'ও বলা হতে লাগলো। তখনও পর্যন্ত 'কাশী' নামটি পাওয়া যায়না। কারণ এই স্থানে আর্য বসতি ছিলোনা। ছিলো শুধু অনার্য দেবতা শিবের পুজো আর শিবের চ্যালাচামুন্ডা যতো অরণ্যবাসী ভূত-গণ-যক্ষ-রক্ষ জাতির অনার্য মানবগোষ্ঠীর বসতি। আর্যদের চোখে তারা ছিলো 'অ'মানুষ। শিবের শ্মশানরাজ হবার গপ্পো-ও এখান থেকেই তৈরি হয়।

আর্যযুগে কাশ্য নামে রাজপুত্র এখানে এসে বসবাস করতে শুরু করেন এবং তাঁর নামেই এই নগরীর 'কাশী' নাম নসিব হয়েছিলো। এই কাশ্য উত্তরপশ্চিম থেকে আসা কোনও আর্য নৃপতির সন্তান ছিলেন।কোনও কারণে পিতৃসম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার জন্য পূর্বদিকে এই অরণ্যপ্রদেশে স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছিলেন। এই সময় কাশীতে কোনও কেন্দ্রীয় রাজার শাসন ছিলোনা। অনার্যদের নিজস্ব রীতি অনুযায়ী আদিম গণতান্ত্রিক পদ্ধতির প্রশাসনই এখানে প্রচলিত ছিলো। কাশ্য এখানে আর্যধারার রাজতন্ত্র প্রবর্তন করেন। এভাবেই বহুদিন পরে কাশ্যের প্রপৌত্র কাশী নগরীকে রাজধানী করে একটি রাজ্যের পত্তন করেন।

কাশ্যের বংশধরই ছিলেন দিবোদাস। তিনি নিজেকে মহারাজ বলতেন। একবার হৈহয় বংশের রাজা কাশী আক্রমণ করলে 'মহারাজ' দিবোদাস কাশী থেকে পলায়ন করে পশ্চিমে গঙ্গা-গোমতীর সঙ্গমদেশে বসতি স্থাপন করেন। বেশ কিছুদিন পরে শক্তিসঞ্চয় করে তিনি কাশী ফিরে আসেন এবং হৈহয়দের যুদ্ধে পরাজিত করে কাশী পুনর্দখল করেন। দিবোদাসের ধারণা হয় হৈহয় অধিকারে থাকার জন্য কাশী নগরী অপবিত্র হয়ে পড়েছে। তার থেকে মুক্ত হবার জন্য তিনি দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন। যে স্থানে এই যজ্ঞ করা হয়েছিলো, সেখানেই আজকের দশাশ্বমেধ ঘাট। দিবোদাস বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে কাশীকে সুরক্ষিত করার জন্য নগরীর চারদিকে পরিখা খনন করেন। তাঁর বংশ প্রায় পাঁচশো বছর এখানে রাজত্ব করে। এতোদূর পর্যন্ত লোককথার এলাকা, ইতিহাস এখনও এসে পৌঁছোয়নি কাশীতে। 

ঋগবেদ, স্কন্দপুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত সহ বহু ভারতীয় পুরাণকথায় কাশীর বিশেষ উল্লেখ রয়েছে। সাতশো খ্রিস্টপূর্বাব্দের কিম্বদন্তী অনুযায়ী পরবর্তীকালে বৌদ্ধসাহিত্যে এখানে ব্রহ্মদত্ত বংশের রাজাদের ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়। ষোড়শ মহাজনপদের সময়কাল ৭০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। সেই সময় এদেশে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজত্ব ছিলো কাশী ও কোসল। তৎকালীন ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজার নাম পাওয়া অশ্মক মহাজনপদে। কিন্তু অশ্মক হলো আজকের বিদর্ভদেশ। অতএব কাশীর সঙ্গে মিলছে না। অশোক পিয়দস্সির সময় কলিঙ্গের রাজা ছিলেন আরেক ব্রহ্মদত্ত। তবে এক্ষেত্রে তিনিও সেই রাজা নন। কিন্তু ক্ষান্তি-বন্নন-জাতকে ব্রহ্মদত্ত রাজার নাম পাওয়া যায় কাশীর রাজা হিসেবে। এই ব্রহ্মদত্ত বুদ্ধের পূর্ব এক জন্মের নাম। তবে জাতক ইতিহাস নয়, নেহাৎ গল্পকথা। কিন্তু বুদ্ধের জন্মের দুশো বছর আগে যে কাশীতে কোনও ব্রহ্মদত্ত রাজা ছিলেন না, তাও লেখা নেই কোথাও। ব্রহ্মদত্ত থাকুন বা না থাকুন, বুদ্ধের জন্মের দেড়-দুশো বছর আগে কাশী মহাজনপদ হিসেবে বহাল তবিয়তে ছিলো এটা গ্রহণ করা যায়। সেই সময় থেকেই 'কাশী' রাজ্যের নাম 'বারাণসী' লেখা হতে থাকে। একটি মত অনুযায়ী বরুণা ও অসী নদীর সঙ্গমক্ষেত্র হবার জন্য এই নাম হয়। কিন্তু অন্য মতও রয়েছে। তবে কাশী প্রথম শিরোনামে উঠে আসে যখন শাক্যমুনি বুদ্ধ এখানকার ঋষিপত্তনের মৃগদাবে বসতি করেছিলেন।

বুদ্ধের প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কাশীর প্রসিদ্ধিও বাড়তে থাকে। যার ফলে প্রতিবেশী নাগ, সুঙ্গ ও কন্ব বংশের রাজারা ক্রমাগতভাবে কাশী আক্রমণ করতে তৎপর হয়। সেই সময়ের অন্ধকার ইতিহাস সারনাথের প্রত্নসামগ্রীতে মুদ্রিত রয়েছে।

রাজছত্র ভেঙে পড়ে

সিকন্দর শাহের ফৌজ কাশীতে এসেছিলো কিনা, ঠিক জানা নেই। কাশীর প্রথম উল্লেখযোগ্য বিদেশী অভ্যাগত কুষান সম্রাট কণিষ্ক। কুষাণরা ছিলো পামির আর আমু দরিয়ার দক্ষিণে ব্যাক্ট্রিয়া দেশের লোক। সিকন্দর শাহ যেমন ভারত ইতিহাসে একটা মোড় দিয়ে গিয়েছিলেন, কুষাণ সম্রাট কণিষ্কও ছিলেন সেরকম এলেমদার লোক। কণিষ্কই  প্রথম বিদেশী প্রভাবশালী রাজা, যিনি বুদ্ধ ও তাঁর দর্শনকে ভারতবর্ষের সীমার বাইরে বিস্তারিত ভাবে প্রচার করেছিলেন। এখানে আমি শ্রীলংকাকে বৃহত্তর ভারতবর্ষের অংশই  মনে করছি। প্রথম খ্রিস্টিয় শতকে এদেশে এসে কণিষ্ক ঋষিপত্তনে সারনাথকে বৌদ্ধধর্মের একটি মুখ্য কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলেন। আসলে আর্যাবর্তের মূলরাজপথ যেটা পাটলিপুত্ত হয়ে তক্ষশিলা পর্যন্ত যেতো, বারাণসি ছিলো তার একটা প্রধান কেন্দ্র।  চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত গুপ্তযুগে কাশীর গৌরব শিখর স্পর্শ করে। তারপর সপ্তম শতকে মৌখরি ও বর্ধন রাজত্বেও কাশীর গৌরব অক্ষুণ্ণ থাকে। হর্ষবর্ধন কাশীতে এসেই বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। অষ্টম শতকে প্রথমে পাল রাজারা ও তার পর প্রতিহার রাজারা এসে কাশীতে রাজত্ব করেন। প্রতিহারবংশীয়দের থেকে ক্ষমতা যায় কলচুরি রাজাদের হাতে। নবম শতকে আদি শংকরাচার্য কাশী বিশ্বনাথকে উপলক্ষ্য করে শৈবউপাসকদের একত্র করেন ও তখন থেকে বারাণসি এদেশে শৈবসমষ্টির মূলকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এই সময় কাশীতে সহস্রাধিক মন্দির গড়ে উঠেছিলো। কিন্তু দ্বাদশ শতকের শেষ থেকে মুসলিম শাসকদের দৌলতে কাশীর দুঃসময় শুরু হয়। প্রথমে মুহম্মদঘুরি, তার পর অলাউদ্দিন খিলজি, বারবাক শাহ কালাপাহাড়,  কুতুবুদ্দিন আইবক, ফিরোজ শাহ, সিকন্দর লোদি  বারাণসিকে  ধূলিসাৎ করে দেন। যেহেতু সেই সময় বারাণসি ছিলো সারাদেশে সনাতনধর্মীয়দের প্রধানতম কেন্দ্র, মুসলিম রাজাদের ধারণা ছিলো কাশীকে ধংস করতে পারলে সারাদেশে পৌত্তলিকদের ধর্মকে চূড়ান্ত আঘাত করা যাবে। কাশী অতীতের মতো আবার  'মহাশ্মশান' য়ে পরিণত হলো ।

এই 'মহাশ্মশান' থেকেই আবার ফিনিক্সের মতো জেগে ওঠে ভারতবর্ষের চিরকালীন সমন্বয়ের সাধনা। চতুর্দশ শতকে একজন মানুষ জন্মান বারাণসিতে। তাঁর নাম কবির। তার পরে আসেন রবিদাস এবং সুদূর তালওয়ান্ডি গ্রাম থেকে ভারতাত্মার খোঁজে পরিব্রাজক নানক। ভারতবর্ষের 'সবার উপর মানুষ সত্য' এই বিশ্বাস এই সব মানুষেরা আবার সপ্রমাণ করেন এবং তার কেন্দ্রও ছিলো বারাণসি। একদা সহস্র মন্দিরের শহর কাশীতে কলচুরি রাজা নির্মিত কর্দমেশ্বর শিবের মন্দিরটিই আজ প্রাচীনতম।  এটি দশম-একাদশ শতকের নির্মান। আর যত  কিছু মন্দির/দেবস্থান আজ কাশীতে দেখা যায়, সবই পরবর্তীকালের। ১৩০০ সালে অলাউদ্দিন খলজি থেকে সপ্তদশ শতকে ঔরঙ্গজীব পর্যন্ত সমস্ত সম্রাট কাশীতে বিনাশযজ্ঞ ব্যতীত আর কিছু করেননি। মুঘল আমলেই এই শহরের নাম বনারস হয়ে ওঠে। ঔরঙ্গজীব সর্বদাই নতুন কিছু করতেন। বনারসের সরকারি নাম তাঁর আমলে হয়ে গিয়েছিলো 'মুহম্মদাবাদ'। বারাণসি  ব্যতীত দেশের আর একটি  প্রাচীনতম শহর পাটনাও তাঁর নাতির নামে বদলে 'আজিমাবাদ' করে দিয়েছিলেন। আমাদের দেশের বারাণসি এবং পাটনা আর মিশরের কাহিরা (কায়রো) এবং ফিলিস্তিনের জেরুজালেম, এই চারটি শহরের মধ্যে প্রতিযোগিতা রয়েছে। এদের মধ্যে কোন জনপদটি  প্রাচীনতম জীবিত শহরের দাবি করতে পারে। ইংরেজ আমলে 'বনারস' , 'বেনারস' হয়ে যায়। স্বাধীন ভারতে ডঃ সম্পূর্ণানন্দের উদ্যোগে গৌতম বুদ্ধের ২৫০০তম জন্মদিনে ( যদিও এখনও স্থির হয়নি বুদ্ধের সর্বসম্মত জন্মসাল কী) এই শহরের নামে আবার সরকারিভাবে 'বারাণসি'  ফিরে আসে।

তবে নামে আর কীই বা আসে যায় ? একজন ভারতীয়, সে দেশের যেকোন প্রান্তেই শিকড় রাখুক না কেন, বনারসের টান উপেক্ষা করতে পারেনা।

'খাক ভি জিস জমীঁ কা পারস হ্যাঁয়,
শহর মশহুর  য়হি বনারস হ্যাঁয়।'

ভোর ভই.....

' ত আলল্লা বনারস চশমে বদ দূর
বহিশ্তে খুর্রমো ফিরদৌসে মামুর
ইবাতত খানএ নাকুসিয়াঁ অস্ত
হমানা কাবয়ে হিন্দোস্তাঁ অস্ত'

( হে ঈশ্বর, বনারস কে অশুভ দৃষ্টি থেকে দূরে রেখো। কারণ এ এক আনন্দময় স্বর্গের মতো স্থান। এইখানে ঘন্টাবাদক জাতির( অর্থাৎ হিন্দুদের) পূজাস্থল। এ তো আসলে  হিন্দুস্তানের কাবা।)

এইভাবেই বলেছিলেন নজমুদ্দৌলা, দবির-উল-মুল্ক, নিজাম জং মির্জা অসদুল্লা বেগ খাঁ ওরফে মির্জা ঘালিব, বনারসের মহিমা প্রসঙ্গে।

ভোরটি ছিলো দুর্গাদশমীর তিথি। আগের দিন রাতে শুতে শুতে বেশ দেরি হয়েছিলো। সিগরার ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের পুজোয় নবমীর আরতি খুব জমকালো। বনারসের উৎসবের তালিকায় এই অনুষ্ঠানটি জনতার কাছে অতীব প্রেয়। প্রবল জনসমাগম এবং বর্ণাঢ্য আরতি চলেছিলো অনেক রাত পর্যন্ত। সংযোগবশতঃ আমার অতিথিশালাটি ভারত সেবাশ্রম সংঘের ঠিক উল্টোদিকে। যাঁদের উত্তরাপথের সমস্ত শহরে মহানবমীর রাতে উপচে পড়া  জনস্রোত দেখার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁরা জানেন  জনগণেশের  সেই রুদ্ধশ্বাস উদযাপনের মাত্রা কতোটা বৃহৎ। বনারসও তার কোনও ব্যতিক্রম নয় । সারা রাত সারা শহর রাস্তায় ভ্রাম্যমান। সেই উন্মুখর আবেগ থেকে নিজেদের সরিয়ে এনে গৃহবন্দি হলুম। পরদিন ভোরবেলা যে গঙ্গা থেকে দিন উঠে আসার দৃশ্যকাব্য দেখতে যেতে হবে।

তখনও আলো ফোটেনি ঠিক। বেশ শিরশিরে হিমেল স্নিগ্ধতা ভোর হাওয়ায়। সরাইখানা থেকে বেরিয়ে আসি দুজনে। একটু এগিয়ে সিগরার তিমুহানির মোড়। এতো সক্কালে কি কিছু সওয়ারি পাওয়া যাবে। যাকগে না পাওয়া  গেলে চরণদাস ভরসা। সারা শহর তখন  যেন উৎসব শেষের শ্রান্তি গায়ে জড়িয়ে নিঝুম হয়ে শুয়ে আছে। হঠাৎ একটি অটো এসে দাঁড়ায়। কঁহা জানা হ্যাঁয় সাব? গোদৌলিয়া জাই? জাই, পর মোড় পর উতরনা পড়ি। কো-ই বাত নইখে হো, চলি।

অটোতে হাওয়া বেশ শীতল লাগতে থাকে। রথযাত্রা মোড় পেরিয়ে বাঁদিকে গুরুবাগের রাস্তা ধরে। সেখান থেকে লাক্সা রোড। গড়াতে গড়াতে গোদৌলিয়ার মোড় এসে যায়। ডানদিকে সন্ত থমাস গির্জা। সামনে রাস্তায় পুলিস ব্যারিকেড। এই পথেই গোদৌলিয়া হয়ে বিকেল থেকে প্রতিমার শোভাযাত্রা যাবে দশাশ্বমেধ ঘাটের দিকে। আলো ক্রমে আসিতেছে। আমরা হাঁটতে থাকি  নদীর দিকে।

সেই বহুশ্রুত গোদৌলিয়ার পূর্বমুখী পথ। বনারসের স্নায়ুকেন্দ্র। দুধারে উঁচু সৌধগুলি, ভরা আছে বিপনীসারিতে। তাদের কপাট তখনও খোলেনি, কিন্তু সবজিওয়ালারা বসতে শুরু করেছে রাস্তার ধারে। চায়ের দোকান, পানের দোকান সব নড়ে চড়ে বসছে।   স্নানশেষে ফেরা লোকজন, আবার স্নানযাত্রায় এগিয়ে যাওয়া মানুষের সারি, মন্থর ষাঁড়, অনাবিল আবর্জনা, আশেপাশের  ছোটখাটো মন্দির থেকে ভেসে আসা ঘন্টাধ্বনি, স্পিকারে মারুতিনন্দনের ভজন....

আর একটু এগিয়ে যেতেই বনারসের চিরপরিচিত ঘাটের সিঁড়ি। দশাশ্বমেধ ঘাট, গঙ্গানদীর সব চেয়ে বিখ্যাত তীরভূমি, রঘু রাইয়ের ছবি থেকে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠলো।

ভোর ভই বনারস মা।

ছবি - লেখক

(পরের অংশ)


লেখক পরিচিতঃ শিবাংশু দে'র লেখনী অনায়াসে ছুঁয়ে যায় সঙ্গীত কাব্য ইতিহাস কিংবা উত্তরভারতীয় শিল্পশহরের ধুলোবালি। সূক্ষ্ম নরম অক্ষরে জাগান তুলোট কাগজে লুকিয়ে থাকা ছবি যার পরতে পরতে অপেক্ষা করে পাঠকের নবতর বিস্ময়। ব্যক্তি জীবনে শিবাংশু বিখ্যাত তাঁর সুভদ্র পাণ্ডিত্যের জন্যে। অতিব্যস্ত পেশাগত জীবনের খতিয়ান হয়তো লেখক পরিচয়ে তত প্রাসঙ্গিক নয়, যদি না তজ্জনিত আসমুদ্রহিমাচল ভ্রমণ ও বহু মানুষ দেখাজনিত অভিজ্ঞতা স্মরণ করা হয়।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2015 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।