প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সমাজ ও সংস্কৃতি/ইতিহাস

মার্চ ১৫, ২০১৬

 

প্রাচীন ভারতে গোমাংস

দিলীপ দাস


ইউনিভার্সিটি লেকচার হল ভর্তি। বিষয়টা এমন প্রাসঙ্গিক যে ছাত্রছাত্রী ছাড়াও বহু অধ্যাপক, কর্মচারী ও অভিভাবকরাও হাজির হয়েছেন এই বিতর্কসভায়।

তর্কর শুরুটা হয়েছিল মোক্ষম সময়ে। শনিবারের দুপর, ক্লাসের পরে কিছু ছেলেমেয়ে ইউনিভার্সিটির মাঠে বসে গুলতানিতে ব্যস্ত, ওদিকে একদল ব্যাটবল নিয়ে ক্রিকেট পেটাচ্ছে। উদয়ন ও রুমার মধ্যে যখন আর এক প্রস্থ তক্কাতক্কি লেগে গেল, তখন চেঁচামেচি শুনে সবাই ঘুরে দেখল। তবে এবারের বিষয়টা একটু নতুন - প্রাচীন ভারতের মানুষ গরুর মাংস খেত কি না। এদের দুজনের তর্ক সত্যিই একটা শোনবার মত ব্যাপার। জ্ঞান, বুদ্ধি ও যুক্তির তরবারি ঝলসে ওঠে থেকে থেকে। তক্কাতক্কি শেষ হলেই এদের দুজনের আবার গলায় গলায় ভাব। তাই ক্রিকেট ছেড়ে বল ব্যাট হাতে সবাই তর্ক শুনতে লাগল। তর্ক সবে প্রথম প্রস্থে, জমে উঠবে উঠবে, তখন  যে দুজন সামনে  এগিয়ে এলেন তাদের ভীড়ের মাঝে আগে কেউ খেয়াল করে নি, ডিন সুমিত বাবু ও সংস্কৃতের বিভাগীয় প্রধান সুরময়ীদি। দুজনেরই বক্তব্য, এটা একটা খুব সুন্দর ও বর্তমানে সময়ের পক্ষে প্রাসঙ্গিক বিষয়। এই ধরনের বিতর্ক খেলার মাঠ, চায়ের দোকান, লোকাল ট্রেনের কামরা বা কারো ব্যক্তিগত ব্লগে হওয়া উচিত নয়। এর উপযুক্ত জায়গা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার হল, যেখানে জ্ঞানী ও গুণীজনেরা এবং আরো অনেকে শুনতে পাবেন তোমাদের যুক্তিগুলি। ঠিক হল পরের শনিবার দুপুরে ইউনিভার্সিটি লেকচার হলে এই বিতর্কসভা বসবে।

পরের শনিবার যখন তর্ক আরম্ভ হল, তখন লেকচার হল উপচে পড়ছে।

সভাপতি সুমিতবাবু ছাড়াও বিচারকের আসনে ছিলেন সুরময়ীদি, কেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ও সুলেখিকা কেয়া চট্টোপাধ্যায় ও ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর অধ্যাপক ও ‘উত্তরণ’ পত্রিকার সম্পাদক ভাস্কর বসুরায়। সভার আলোচ্য বিতর্ক হবে ‘প্রাচীন ভারতে গোমাংস খাওয়ার বহুল প্রচলন ছিল’। এর বিপক্ষে প্রশ্ন আনবে উদয়ন ও স্বপক্ষে জবাব দেবে রুমা।

সুরময়ীদি ভূমিকাতে প্রাচীন ভারতে গরু নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে রাখলেন। ঋগ্বেদের যুগে আর্যদের কাছে গরু ছিল খুব মূল্যবান অর্থনৈতিক সম্পদ। বিত্তবানদের গোমত এবং গোষ্ঠীপতিকে গোপ বা গোপতি নামে ডাকা হয়েছে। গরু নিয়ে আর্যদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যে লড়াই হতো তাকে গভিষ্টি, গব্যু বা গবেষণ নাম দেওয়া হয়েছে। প্রাচীন পৌরাণিক উপাখ্যানগুলিতে গরুর দেবত্ব ও তার সাথে অনেক অলৌকিক ঘটনার উল্লেখ আছে। খালি প্রাচীন ভারত নয়, প্রাচীন ইন্ডো-ইউরোপীয়ান সভ্যতাগুলি, যেমন নর্স, আইরিশ ও ইরানীয়ান উপাখ্যানেও পাওয়া যায় গরু এবং বৃষের গৌরব গাথা। আর মহেঞ্জোদারোর সীলে ভীমকায় বৃষের ছবি তো সকলেরই জানা। তাই প্রাচীন যুগের গরুর গুরুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে আজকের বিতর্ক খুব চিত্তাকর্ষক হবে।

হরপ্পার ষাঁড়ের সীল

সুমিতবাবু প্রথমেই বলে দিলেন যে বিতর্কের বিষয়টি জটিল, সংবেদনশীল ও বর্তমান সময়ের পক্ষে খুবই প্রাসঙ্গিক। এই নিয়ে অতীতে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে ও ভবিষ্যতেও আরো হবে। এই বিতর্কের উদ্দেশ্য শিক্ষামূলক ও একাডেমিক আলোচনা, এটা কারো ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দেবার জন্য বা প্ররোচনামূলক বিতর্কসভা নয়।

উদয়ন তার প্রথম যুক্তিবাণেই প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চেয়ে বলল, প্রাচীন ভারতে যে গরু অবধ্য ছিল তার প্রথম ও অকাট্য প্রমাণ ঋগ্বেদে প্রথম মণ্ডল একশো চৌষট্টি সূক্তের চল্লিশ ঋকে গরুকে ‘অঘ্ন’ অর্থাৎ ‘অবধনীয়’  বলা হয়েছে। এছাড়াও ঐ সূক্তেরই সাতাশ ঋকে গরুকে আবার ‘অঘ্না’ বলা হয়েছে। অথর্ব বেদের দশম কাণ্ডে অবধনীয় গরুর গৌরব কথা আছে। এই থেকেই প্রমাণ হয় যে প্রাচীন ভারতে গরু অবধ্য বলে মানা হত।

উদয়নের যুক্তি শুনে সবাই যখন ভাবছে এখানেই বিতর্কের নিষ্পত্তি হয়ে গেল, তখন রুমা বলতে উঠল। তার বক্তব্য, খালি অঘ্ন ও অঘ্না নয়, বেদে গরুকে অনেক গৌরবজনক নামে ডাকা হয়েছে। ঋগ্বেদে অঘ্ন ও অঘ্না কথাগুলি চার বার উল্লেখ আছে ও অথর্ববেদে স্ত্রীলিঙ্গ ও পুংলিঙ্গ মিলিয়ে আরো বিয়াল্লিশ বার এর উল্লেখ আছে। গৌ, উস্র, ধেনু, সুদুগ্ধা, বৃষ ইত্যাদি গরুর মোট একুশটি সমার্থক শব্দ পাওয়া যায় এবং বিভিন্ন শব্দরূপ ও সমার্থক শব্দ মিলিয়ে ঋগ্বেদে গরু প্রায় সাতশো বার উল্লেখিত হয়েছে। এর কারণ খুঁজে বার করতে গেলে আমাদের সুরময়ীদির ভূমিকাতে ফিরে যেতে হয়।

বৈদিক যুগের ভারতীয়রা গরুকে কেবল পশু হিসেবে দেখতেন না। সেই যুগে সমাজ, অর্থনীতি ও ধর্মে গরুর একটা বিশেষ স্থান ছিল, গরুই ছিল অনেক কিছুর মাপকাঠি। তাই গরুকে বৈদিক সাহিত্যে অনেক গৌরবজনক নামে অভিহিত করা হয়েছে, যার কিছু কিছু উদাহরণ দিচ্ছি। যেমন ঋগ্বেদ দশম মণ্ডলের পঞ্চম সূক্তে অগ্নিকে বলা হয়েছে ‘...বৃষভশ্চ ধেনুঃ’, অর্থাৎ তিনি বৃষ ও গাভী দুই-ই। নবম মণ্ডলের বাহাত্তর সূক্তে সোমকে বলা হচ্ছে ‘প্রিয়ঃ পতিগর্বাং’ অর্থাৎ গাভীর স্বামীস্বরূপ, মানে Lord of cows,  অন্যান্য জায়গায় সূর্যকে বলা হয়েছে এক উজ্জ্বল বর্ণধারী বৃষ, ইন্দ্রকে সুদুগ্ধা ধেনুর সাথে তুলনা করা হয়েছে। গোদুগ্ধকে তুলনা করা হয়েছে উজ্জ্বল রশ্মির সাথে। গরুকে অভিহিত করা হয়েছে রুদ্রের মাতা, বসুগণের দুহিতা ও আদিত্যের ভগ্নী বলে, সোহাগভরে ডাকা হয়েছে অদিতি, ঋত, বাক্‌, এই রকম বিভিন্ন নামে। এমনকি কিছু দেবতাকেও ‘গোজাত’ বলে ডাকা হয়েছে - বৃহস্পতিকে বলা হয়েছে গোপতি, মরুৎ-কে বলা হয়েছে গোবন্ধু। আসলে ঋগ্বেদের ঋষিকবিরা এই সবগুলিই ব্যবহার করেছেন আলংকারিক- উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও রূপক অর্থে। সেই রকমই ‘অঘ্ন’ শব্দটির ব্যবহারও আলংকারিক। আর এই ধরণের আলংকারিক ব্যবহার খালি ভারতে নয়, প্রতিটি প্রাচীন সভ্যতাতে, যেমন গ্রীক, রোম, আসিরিয়ান, চীন – এদের সবাইয়ের প্রত্নকথা বা mythology-তে পাওয়া যায়। তাই ‘অঘ্ন’ লেখা সত্ত্বেও সেযুগে গরুকে যজ্ঞে উৎসর্গ বা বলি দেওয়ার চল ছিল ও তার মাংসও খাওয়া হত, এমনকি গরুর চামড়ারও প্রচুর ব্যবহার ছিল, তার প্রমাণ আছে।

রুমা থামতেই উদয়ন তেড়েফুঁড়ে আক্রমণ করে উঠল, মানছি না তোর কথা। তুই নিজেই ভেবে দেখ, গরুর এত গুরুত্ব তাহলে গরুকে যজ্ঞে বলি কেন দেওয়া হবে, তার মাংসই বা কেন খাওয়া হবে?

রুমা হেসে ফেলল উদয়নের আচমকা আক্রমণ দেখে।  বলল, বর্তমানের মতো প্রাচীন বৈদিক যুগের ঋষিরাও দেবতাদের তাঁদের প্রিয় জিনিসটি দিতে ভালবাসতেন। সেই জন্যই বৈদিক যুগে বিভিন্ন যজ্ঞে দেবতাদের উদ্দেশ্যে যে পশুবলি উৎসর্গ করা হতো, সেখানে অন্যান্য পশুদের সাথে গরু বা বৃষের উল্লেখ বারবার পাই। ঋগ্বেদ দশম মণ্ডলের একশো ঊনসত্তর সূক্তটির দেবতাই হচ্ছেন গাবঃ অর্থাৎ গরুগুলি, কিন্তু সেখানেও এক জায়গায় বলা আছে যে গরুরা দেবতাদের যজ্ঞের জন্য নিজেদের শরীর দিয়ে থাকেন। দশম মণ্ডলেরই ছিয়াশি সূক্তে ইন্দ্র, যিনি ঋগ্বেদের অন্যতম প্রধান দেবতা, বড়াই করে ইন্দ্রাণীকে বলছেন আমি পনের বা বিশ বৃষের মাংস খেতে পারি। অষ্টম মণ্ডলের একচল্লিশ সূক্তে ঋগ্বেদের আর এক মুখ্য দেবতা অগ্নিকে ঘিয়ের সাথে যেসব মাংস আহুতি দেওয়া হতো তার মধ্যে আছে ‘অশ্ব, ঋষভ অর্থাৎ বলদ, উক্ষ্ণ অর্থাৎ ষাঁড়, মেষ এবং ‘ভশা’। এই ‘ভশা’ পশুটি যে গরু তাতে সন্দেহ না থাকলেও, এটি কি ধরনের গরু সেই নিয়ে পণ্ডিতের মধ্যে বিতর্ক আছে। অনেক পণ্ডিতের মতে ভশা বন্ধ্যা বা দুগ্ধবতী নয় এমন গরু। যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতাতে  অশ্বমেধ যজ্ঞের শেষে যেসব প্রাণী উৎসর্গ করা হবে তার মধ্যে গরুর নামও দেখা যাচ্ছে। যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণে রাজসূয় ও বাজপেয় যজ্ঞের ‘গোসভ’ নামে যে অংশটি আছে তাতেও একই কথা লেখা। আরো অন্যান্য যজ্ঞ গুলিতেও, যেমন অগ্নিষ্টোম, দর্শপূর্ণমাস, চতুর্মাস্য, সৌত্রামণি, যজ্ঞের ‘পশুবন্ধ’ অংশে গরু বা বৃষ উৎসর্গের উল্লেখ আছে। এতে কোন সন্দেহই নেই যে বিভিন্ন যজ্ঞে অন্য পশুর সাথে গরু এবং বৃষের বলি দেওয়া হতো। কাজেই প্রমাণ হয় যে ‘অঘ্ন’ কথাটা নিশ্চয়ভাবে রূপকার্থে ব্যবহৃত।

উদয়ন হারার পাত্র নয়। সে বলল, তোর যুক্তিতে ফাঁক আছে। যজ্ঞে উৎসর্গ করার অর্থ এই নয় যে সেই গোমাংস খাওয়া হতো।

‘তোদের দেশের বাড়িতে নবমী পূজোতে পাঁঠা বলি হয় না? আর সেই পাঁঠার মাংস তুই পুরো কনুই ডুবিয়ে খাস না?’ রুমার উত্তর শুনে হলশুদ্ধু লোক হেসে উঠল। বিচারকদের মুখেও হাসির রেখা।

হাসি থামলে রুমা খেই ধরল, আসলে এখনকার আচার-ব্যবহার-প্রথাগুলোর অনেকেরই শেকড় আছে প্রাচীন যুগে।  ঐতরেয় ব্রাহ্মণের সপ্তম অধ্যায়ে আছে বলি দেওয়া পশুটি যজ্ঞের পুরোহিতদের মধ্যে কেমনভাবে ভাগ হবে, কে কোন ভাগটা পাবে। তৈত্তিরীয় সংহিতাতে বলির পরে পশুর শরীর কেমনভাবে কাটা হবে তার বর্ণনা দেওয়া আছে। অথর্ববেদের গোপথ ব্রাহ্মণে ‘সমিতার’ অর্থাৎ যিনি পশু বলি দেন, তিনি কিভাবে ছত্রিশ ভাগে পশুটি কাটবেন তার হিসেব আছে। যজ্ঞের পশু যে খাদ্য সেই সম্বন্ধে শতপথ ব্রাহ্মণের তৃতীয় ও পঞ্চম কাণ্ডে দেখতে পাই লেখা আছে ‘পশ্বো বৈ অন্নম’ এবং  ‘অন্নম বৈ পশ্বঃ’।  তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের তৃতীয় অধ্যায়ের এক শ্লোকে পরিষ্কার লেখা ‘অথো অন্নং বৈ গৌঃ’, অর্থাৎ গরু খাদ্যই বটে। মনে পড়ছে শতপথ ব্রাহ্মণের তৃতীয় কাণ্ডে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের সেই বিখ্যাত উক্তি, যে তিনি গোমাংস খেতে ভালো বাসেন, যদি তা ‘অংসল’  অর্থাৎ নরম হয়। যজ্ঞের মাংস যে খাওয়া হতো এবং গরু খাদ্যবিশেষ ছিল এ সম্বন্ধে আর সংশয় কি!

উদয়ন তার আক্রমণ শানালো, অথর্ব বেদের দ্বাদশ কাণ্ডের চতুর্থ ও পঞ্চম সূক্তে গোবধের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় লেখা এবং কেউ গোবধ করলে সে ‘মৃত্যু পাশেষু বধ্যতাম’ হবে সেটা সোজা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর রাজাকেও মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ব্রাহ্মণের গরু ‘অনাদ্যম্‌’ অর্থাৎ খাওয়ার জন্য নয়। তার পরেও বলতে চাস সে যুগে গোবধ প্রচলিত ছিল?

একটু চুপ করে থেকে, রুমা বলল, প্রাসঙ্গিক ভাবে সূত্রের ব্যাখ্যা কর। অথর্ব বেদের ঐ সূক্তগুলি কিসের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছিল জানিস? সেগুলি লেখা হয়েছিল ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা হিসেবে গরু দেবার পবিত্র কর্তব্য ও সেই কর্তব্য থেকে বিচলিত হলে তার ফলাফল মনে করিয়ে দেবার জন্য। মনে রাখিস, অথর্ব বেদ বাকী তিন বেদের অনেক পরে লেখা বা সংকলিত, যার জন্য প্রাচীন কিছু ঋক্‌ মন্ত্রে খালি তিন বেদের নাম পাওয়া যায়, সেখানে অথর্ব বেদ অনুপস্থিত। আসলে ঋগ্বেদের বর্ণভেদহীন সমাজ বদলে যাচ্ছিল। চার বর্ণের মধ্যে ব্রাহ্মণদের শ্রেষ্ঠত্ব আস্তে আস্তে কায়েম হচ্ছিল। তারই ফল এই ধরনের সূক্তগুলি – বাপু হে, বামুনের গরু পবিত্র, ওতে হাত দিও না, দূরে থাকো। মনে রাখতে হবে যে এখানে পবিত্রতার গুণগুলি কিন্তু মূলত ব্রাহ্মণের, গরুর নয়। কাজেই কেবল গরু নয়, ব্রাহ্মণের সবকিছুই পবিত্র। এই সূক্ত আমাদের বোঝাচ্ছে যে বিশেষ কারণে, গোংমাস খাওয়ার বিরুদ্ধে মূলত ব্রাহ্মণদের একটা দৃষ্টিভঙ্গী ধীরে ধীরে গড়ে উঠছিল।

উদয়ন বলে, বেদের ভাষা প্রাচীন, তার বিভিন্ন অর্থ হতে পারে, কাজেই তুই যা অর্থ বলছিস, অন্য এক পণ্ডিত তার থেকে অন্য অর্থ করতে পারেন। যদি আমরা বেদ-পরবর্তী শাস্ত্রে নজর দি, তাহলে দেখি আপস্তম্ব ধর্মসূত্রের প্রথম অধ্যায়ের পঞ্চম পটলে লেখা আছে একক্ষুর বিশিষ্ট প্রাণীদের সাথে গোমাংস খাওয়া নিষিদ্ধ।

রুমা উদয়নকে থামিয়ে দিয়ে বলে, প্রথমে তোর এক নম্বর প্রশ্নের জবাব দি। বেদের ভাষা ও ব্যাকরণ প্রাচীন, পাণিনিরও আগে ও তার বিভিন্ন ব্যাখ্যা অনেকে করে থাকেন তা আমি জানি। কিন্তু বিচারকের আসনে সংস্কৃতের বিভাগীয় প্রধান স্বয়ং সুরময়ীদি বসে আছেন। তিনি জানবেন আমি যে অর্থগুলি তোকে বলছি, বেশির ভাগ স্বদেশী ও বিদেশী বেদ বিশেষজ্ঞ সেগুলিই বলে থাকেন।

এবারে আসি তোর আপস্তম্ব ধর্মশাস্ত্রের সূত্রটিতে। অনেকে দেখেছি তোর মতো পুরো প্রাসঙ্গিক ভাবে বিচার না করে হঠাৎ একটা অসম্পূর্ণ সূত্র তুলে নিজের বক্তব্য সমর্থন করেন।  আপস্তম্ব ধর্মশাস্ত্রের ঐ পরিচ্ছেদটিতে কোন কোন জিনিস খাওয়া নিষিদ্ধ তার তালিকা আছে। ওই সূত্রটিতে লেখা আছে এক ক্ষুরবিশিষ্ট, উট, শূকর, শরভ ও গায়ল নামের এক ধরনের পশু খাওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু তার পরের সূত্রেই ঋষি বলছেন গরু ও বৃষের মাংস খেতে বারণ নেই। এই প্রসঙ্গে আরো বলি যে আপস্তম্ব ঋষি কিন্তু ঐ অধ্যায়েই পেঁয়াজ, রসুন, মাশরুম এবং মুরগী খেতেও মানা করেছেন। আপস্তম্ব মানতে গেলে তাহলে এগুলিও খাওয়া ছাড়তে হয়।

এবারে ধর্মশাস্ত্রের সমসাময়িক, অর্থাৎ বেদের পরে লেখা, গৃহ্যসূত্রগুলি থেকে গোমাংস খাওয়ার কয়েকটা উদাহরণ দি। সেযুগে যে কেবল যজ্ঞের উপলক্ষে গোমাংস ও অন্যান্য পশুমাংস খাওয়া হত, তা নয়। গবাময়ন নামে একটি সামাজিক অনুষ্ঠান ছিল, যার শেষে তিনটি বন্ধ্যা গরু মিত্রবরুণ ও অন্যান্য দেবতাকে উৎসর্গ করা হত। সম্ভবত জানিস যে এখনকার মতো সেযুগেও মধুপর্কের প্রচলন ছিল এবং সেকালে বাড়ীতে শিক্ষক, স্নাতক, পুরোহিত, শ্বশুর মশাই, রাজা, ইত্যাদি বিশেষ অতিথিরা এলে তাঁদের অর্ঘ বা মধুপর্ক খেতে দেবার নিয়ম ছিল। এখন আমরা মধুপর্কে দই মধু এইসব দি, কিন্তু প্রাচীন কালে এই সবের সঙ্গে মধুপর্কে গোমাংস দেওয়া হত। খেতে কেমন লাগত জানি না, কিন্তু আপস্তম্ব, সাঙ্খ্যায়ণ, গোভিল, খাদির, পারস্কার, হিরণ্যকেশী ইত্যাদি ঋষিদের লেখা গৃহ্যসূত্রে মধুপর্কে গোমাংসের কথা স্পষ্ট লেখা আছে। ব্যাকরণের একটি সূত্র থেকেও অতিথিকে গোমাংস দেওয়ার প্রথা বুঝতে পাওয়া যায়। পাণিনি তাঁর সংস্কৃত ব্যাকরণ অষ্টাধ্যায়ীতে একটা সূত্র লিখেছেন, ‘দাশগোঘ্নৌ সম্প্রদানে’। দাশ শব্দের মানে যার উদ্দেশ্যে দান করা হয়, গোঘ্ন শব্দের মানে যার উদ্দেশ্যে গোবধ করা হয়। সূত্রের মানে দাশ ও গোঘ্ন শব্দের ক্রিয়ার উদ্দেশ্য সম্প্রদান অর্থে হয়। এমনকি শ্রাদ্ধে পিতৃপুরুষকে তৃপ্ত করতে যে গোমাংস দেওয়া হত তারও উল্লেখ আছে। এই নিয়ে যদি আরো জানতে চাস তাহলে ভারতরত্ন পণ্ডিত পাণ্ডুরঙ্গ কাণের হিস্ট্রি অফ ধর্মশাস্ত্র বইগুলি পড়ে দেখতে পারিস।

ধর্মশাস্ত্রেরও পরে লেখা প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যেও গোমাংস ভোজের উদাহরণ দেখতে পাই। ভবভূতির নাটক উত্তররামচরিতের চতুর্থ অঙ্কে এই নিয়ে কয়েকটি মজাদার কথোপকথন আছে বাল্মীকির দুই শিষ্যের মধ্যে। বশিষ্ঠ ঋষি বাল্মীকির আশ্রমে এসেছেন, তাই দেখে বাল্মীকির এক শিষ্য অন্য শিষ্যকে জিজ্ঞাসা করছেন, এই দাড়িওয়ালা বুড়োটা কে রে, বাঘ না কি? উনি এসেই মেটে রং-এর বেচারা বাছুরটিকে খেয়ে ফেললেন। অন্য শিষ্য বলছেন, ‘সমাংস মধুপর্ক’ দিয়ে অতিথি সৎকার করতে হয়, এটা ধর্মশাস্ত্রে লেখা আছে। বশিষ্ঠ একখানা পুরো বাছুর কি করে হজম করেছিলেন, তা অবশ্য লেখা নেই! বরাহমিহিরের ভরতসংহিতায় লেখা আছে বিভিন্ন পশুদের সাথে গরুও খাদ্য।

মহাভারত ও রামায়ণ থেকেও একাধিক উদাহরণ দেওয়া যায়, তবে যেহেতু সেগুলি মহাকাব্য, ইতিহাস নয়, তাই খালি একটি উদাহরণ দিচ্ছি। মহাভারতের বনপর্বে আছে রাজা রন্তিদেবের হেঁশেলে রোজ দু-হাজার গরু রান্না করা হত। মহাকবি কালিদাসের মেঘদূতের পূর্বমেঘ ছেচল্লিশ শ্লোকে এই উপাখ্যানের উল্লেখ করে যক্ষ মেঘকে বলছে, গো-নিধনের রক্তে যিনি নদী বইয়ে ছিলেন, সেই রন্তিদেবকে তোমার যাত্রাপথে যোগ্য সম্মান দিও। আশা করি এবারে তুই আমার সাথে একমত হবি।

রুমা এতক্ষণ ঝড়ের বেগে কথা বলে এবার একটু থেমে, আমতা-আমতা করে বলল, ইয়ে, আরো একটা কথা, যদিও বৃহদারণ্যক উপনিষদ গৃহ্যসূত্র বা সংস্কৃত কাব্যের মধ্যে পড়ে না, তবু বলি এই উপনিষদের ষষ্ঠ অধ্যায়ের কিছু অংশ, যেটা রচনাকালের দিক থেকে অপেক্ষাকৃত আধুনিক, তাতেও গোমাংস খাবার কথা লেখা আছে, সেই লেখাগুলোর কথা নিশ্চয় তোর মনে আছে।

উদয়ন একবার আড়চোখে রুমাকে দেখে নীরবে করে মাথা নাড়ে, হ্যাঁ মনে আছে।

কেয়া চট্টোপাধ্যায় বলে উঠলেন, কি ব্যাপার, বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটা লেখা যেটা তোমরা দুজন জানো, অথচ আমরা কেউ জানলাম না, এটা তো বুঝলাম না।

সুরময়ীদি হেসে বললেন, আসলে ওটা বলতে লজ্জা পাচ্ছে। ওতে আছে যে কেউ যদি জ্ঞানী, সর্ববেদবিদ্‌ ও দীর্ঘ পরমায়ু যুক্ত সন্তান চায় তাহলে সেই দম্পতিকে ঘি-দিয়ে বৃষমাংস রেঁধে খেতে হবে।

সভাশুদ্ধু আর একবার হাসির রোল উঠল। রুমা নীচু মুখে গাল লাল করে বসে রইল।

উদয়ন আক্রমণে ঢিলেমি দেয় না, বলে- গোমাংসের বিরুদ্ধ মতের একটা প্রতিফলন দেখি মনুস্মৃতি বা মনু-সংহিতায়। মনুস্মৃতিকে সর্বপ্রথম রচিত হিন্দু আইন বই বা code of law বলা হয়। সেই মনুস্মৃতির পঞ্চম অধ্যায়ে মাংস খাওয়ার বিরুদ্ধে অনেক কথা বলেছেন মনু মহারাজ। এটাও বলেছেন যে সারা জীবন মাংস না খেয়ে থাকলে একশ অশ্বমেধ যজ্ঞ করার পুণ্য হয়। এজন্মে যার মাংস খাবে সেই পশু তার শরীরে যত রোম আছে তত জন্ম ধরে তোমাকে ভক্ষণ করবে। একাদশ অধ্যায়ে গোবধকে অপরাধ বলা হয়েছে। মনু আমিষের যে খাদ্যতালিকা দিয়েছেন তাতে গরু নেই। এর থেকে কি প্রমাণ হয় না, যে সেযুগে গোমাংস খাওয়া বারণ ছিল?

রুমা মুচকি হেসে চেয়ে বলল, এই প্রশ্নের উত্তরের আগে আমাদের শ্রোতাদের সুবিধার জন্য মনুস্মৃতির সময়কাল এবং ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতটা দেখতে হতে। মনুস্মৃতি লেখা হয়েছিল প্রায় পাঁচশো বছর ধরে, ২০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ থেকে ২০০ বা ৩০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে, যখন বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে সুপ্রতিষ্ঠিত। সেজন্য অহিংস চিন্তাধারার কিছু প্রভাব মনুস্মৃতির পঞ্চম অধ্যায়ে দেখতে পাওয়াটাই স্বাভাবিক। তারই প্রভাবে এই অধ্যায়ে নিরামিষ খেতে বলেছেন মনু মহারাজ। এবারে বলি, মনু মহারাজ ঐ পঞ্চম অধ্যায়েই অন্য এক জায়গায় লিখছেন, যজ্ঞে উৎসর্গ করা মাংস খাওয়াতে দোষ নেই, কারণ যজ্ঞার্থং পশবঃ সৃষ্টঃ, অর্থাৎ যজ্ঞের জন্যেই পশু সৃষ্টি। সেই মাংস খাওয়া ‘দৈব বিধিঃ’, বরং না খেলেই বরং পাপ। আবার পরে এক জায়গায় দুম করে বলছেন, মাংস-মদ্য-মৈথুনে দোষ নেই কারণ এগুলিই মানুষের প্রবৃত্তি। মনু দশম অধ্যায়ের এক জায়গায় উদাহরণ দিয়েছেন গভীর জঙ্গলে কেমন করে না-খেয়ে মরণ এড়াতে গরুর মাংস খেয়েছিলেন কোন ঋষি। কাজেই মনুর ওপর ভিত্তি করে তোর তর্ক দাঁড়াচ্ছে না। মনুস্মৃতির সমালোচনা এই বিতর্কের বিষয় নয়, তবু বলি যে এরকম স্ববিরোধী লেখা মনুস্মৃতিতে প্রচুর পাওয়া যায়, কারণ বহু লোকের হাত পড়েছে এই শাস্ত্রে।

উদয়ন একটুও না দমে সঙ্গে সঙ্গে তার মোক্ষম অস্ত্রটি এবার ছুঁড়ল, এবার শোন, প্রাচীন সামাজিক আইন নিয়ে পরাশর মুনি কি বলেছেন। তাঁর রচিত পরাশর স্মৃতিতে গরুর ওপর অত্যাচার, গোবধ বা গোমাংস খাওয়া যে শাস্ত্রবিরুদ্ধ সেটা স্পষ্ট করে লেখা আছে।  নবম অধ্যায়ের প্রায় পুরোটা গরুর সেবা যত্নের ওপর লেখা। সেখানে আছে, কেউ যদি গোবধ করে তাহলে তার কালসূত্র নামের ঘোর নরকভোগ নিশ্চিত। একাদশ অধ্যায়ে লেখা ব্রাহ্মণের গোমাংস খাওয়া নিষেধ। করলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। সেই রকম আর এক মুনি তাঁর ব্যাসস্মৃতিতে লিখেছেন কোনো ব্রাহ্মণ গোমাংস খেলে সে অন্ত্যজ হবে। এর পরেও কি আর সন্দেহ থাকতে পারে তোর?

পুরো সভা নিশ্চুপ। রুমা এতক্ষণ সাথে সাথে উত্তর দিচ্ছিল, এবার চুপ করে রইল। রুমার বন্ধুদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। দর্শক ভাবলো এবারে রুমার মুখে উত্তর নেই, হার অনিবার্য।

রুমা একবার তার বন্ধু-সমর্থকদের দেখে নিয়ে শুরু করল তার জবাব, প্রথমে পরাশরের কথা বলি। পুরাণে ও মহাভারতে পরাশরকে বেদব্যাসের পিতা বলা হলেও, পরাশর স্মৃতির রচয়িতা অনেক পরবর্তী ও অন্য ব্যক্তি ছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। কারণ পরাশর তাঁর স্মৃতিশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায়েই বলছেন যে মনুস্মৃতি যেরকম কৃতা অর্থাৎ সত্যযুগের জন্য, পরাশরস্মৃতি হচ্ছে কলিযুগের জন্য। ত্রেতা ও দ্বাপর যুগের জন্য যথাক্রমে গৌতম ও শঙ্খস্মৃতি। পরাশরস্মৃতিকে তাই সাধারণত মধ্যযুগের রচনা বলে ধরা হয়। পরাশর মুনি প্রথমেই চার বর্ণের কর্তব্য এবং তার সাথে সাথে মনে করিয়ে দিয়েছেন যে ব্রাহ্মণদের স্থান সমাজের একেবারে মগডালে। তাঁর কথা অনুযায়ী দুঃশীল ব্রাহ্মণ জিতেন্দ্রিয় চণ্ডালের থেকে উত্তম, ব্রাহ্মণ চণ্ডালকে হত্যা করলে কেবল স্নান করে গায়ত্রী জপ করলেই সর্বপাপ নাশ। এতেই বোঝা যাচ্ছে যে সমাজে বর্ণভেদ কেমন গভীর শিকড় বিছিয়ে ছিল, এবং এর মধ্যেই আছে পরাশরের গোমাংসের নিষেধাজ্ঞার কারণ।

তুই বললি পরাশর মুনি নবম অধ্যায়ে গরুর সেবার কথা ও অযত্ন হলে পাপ হয় বলেছেন। একটু পিছিয়ে গিয়ে দেখ তিনিই অষ্টম অধ্যায়ে লিখছেন গোবধ করে ব্রাহ্মণ ভোজন করালেই সব পাপ মুক্তি, ‘ব্রাহ্মণান্‌ভোজয়িত্বা তু গোঘ্নঃ শুদ্ধে ন সংশয়ঃ’। গোমাংস খেলে কৃচ্ছ-চান্দ্রায়ণ প্রায়শ্চিত্ত করলেই হল। বুঝতেই পারা যাচ্ছে যে ব্যাপক ভাবে না হলেও সমাজে গোমাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল এবং তার প্রায়শ্চিত্তও ছিল লঘু। যেহেতু গরু ছিল ব্রাহ্মণদের সম্পদ, তাই গোমাংস খাওয়া নিষেধ করে দিয়ে এই ধরনের সূত্রগুলি সেই যুগে সমাজে ব্রাহ্মণকুলের সম্পদ রক্ষা ও আধিপত্য কায়েমের কৌশল। গোমাংস খাওয়া যদি সত্যিই নিষেধ হত, তাহলে আয়ুর্বেদ কেন তাকে ওষুধের মধ্যে ফেলবে? আয়ুর্বেদ চরক সংহিতার সাতাশ অধ্যায়ে চরক ঋষি কিন্তু গরুকে দেবতাদের মধ্যে স্থান দেননি,  দিয়েছেন বাঘ, সিংহ, ঘোড়া, ইত্যাদি  ঊনত্রিশ  রকমের  ‘প্রসহ’ প্রাণীদের মধ্যে যারা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। আবার ঐ অধ্যায়েই, বিভিন্ন রোগের ওষুধ ও পথ্য হিসেবে পষ্টাপষ্টি গোমাংস খাবার উপদেশ দিয়েছেন।

আর তোর যদি মনে হয় পরাশর অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলব, তাহলে গোমাংস বর্জনের সাথে সাথে তাঁর সমস্ত উপদেশ মেনে চলতে হবে, বেছে বেছে যেগুলি সুবিধাজনক সেগুলি মেনে বাকীগুলি অগ্রাহ্য করলে চলবে না। পরাশর মানতে গেলে দক্ষিণ দিকে মুখ করে বা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলে রাক্ষসবৃত্তির পাপ, ছোটো ভাই বড় ভাইয়ের আগে বিয়ে করলে গুষ্টি শুদ্ধু নরকের পাপ, ব্রাহ্মণকে কুকুরে কামড়ালে সোনা ছোঁয়ানো জলে চান করে ঘি খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, চোদ্দখানা ইঞ্জেকশন নেবার দরকার নেই, আর তোর পোষা কুকুরটি যদি তোকে সোহাগভরে শুঁকে বা চেটে দেয় তাহলে তুই ঘোর অপবিত্র। এবারে বল পরাশর মানবি না পথে আসবি?’

এবারে রুমার বন্ধুদের থেকে হাততালির লহরা ছুটল।

রুমা বলল, সত্যি বলতে কি আজকের এই একুশ শতকে মনু বা পরাশরের কথা মেনে চলতে গেলে কাজকর্ম করা মুস্কিল হয়ে পড়ে। প্রথমতঃ স্মৃতিশাস্ত্রগুলি মূলত prescriptive, এগুলি সমাজে ব্রাহ্মণদের হাঁকা বিধান, এগুলি সেই যুগের সমাজের প্রচলিত রীতি-নীতির ব্যাখ্যান বা description মোটেও নয়। এই বিধানগুলি ব্রাহ্মণ, রাজা, উচ্চবর্ণের জনগণ, অন্যান্য উচ্চপদস্থ বা বিত্তবান লোকেদের প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করার করার জন্যই লেখা। এগুলি সমাজের সকলের জন্য নয়। দ্বিতীয়ত মনুস্মৃতি বা অন্যান্য স্মৃতিগুলি কিন্তু কোনোটাই এক ব্যক্তির লেখা নয়, এতে বিভিন্ন লেখকের রচনা বিভিন্ন সময়ে স্তরে স্তরে ছড়িয়ে আছে। তাই এরা বহু জায়গায় পরস্পরবিরোধী, কাজেই এই বিধানগুলির বেশীরভাগই বর্তমান যুগে অবাস্তব।

উদয়ন সহজে দমে যাবার পাত্র নয়। সে বলল, আচ্ছা, এবার কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে উদাহরণ দি। অর্থশাস্ত্রে ছাব্বিশ অধ্যায়ে লেখা রাজার দৈনন্দিন কর্তব্যের তালিকায় আছে যে তিনি সকালে উঠে একটি গরু, বলদ ও বাছুরকে প্রদক্ষিণ ও প্রণাম করে দিন আরম্ভ করবেন। ঊনত্রিশ অধ্যায়ে রাজকীয় কসাই খানার তত্ত্বাবধায়কের প্রতি নির্দেশ করা হয়েছে যে বাছুর, বলদ ও দুগ্ধবতী গরু মাংসের জন্য বধ করা হবে না। রাজকীয় গরুদের তত্ত্বাবধায়কের প্রতি নির্দেশ গরু চুরি বা গরুদের হানি করার জন্য মৃত্যুদণ্ড। তাহলে কি প্রমাণ হয় না যে গোমাংসের বিরুদ্ধে রাজার আদেশ ছিল?

রুমা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ জানালো, না, হয় না। প্রথম কারণ হচ্ছে যে আমাদের আজকের তর্কের বিষয় কিন্তু গরুকে পূজো বা প্রণাম করা নিয়ে নয়। তর্কের বিষয়টা গোমাংস খাওয়া হত কি না, সেই নিয়ে। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, গরু চুরি বা গরুকে হানি করা পর্যন্ত পৌঁছোলে যে মৃত্যুদণ্ডের কথা বলছিস, সেটার প্রসঙ্গ অর্থশাস্ত্রে খতিয়ে দেখ, দেখবি এই গুরুদণ্ড খালি রাজার গরুর জন্যই প্রযোজ্য, প্রজাদের গরুর জন্য নয়। খেয়াল করে দেখ কৌটিল্য বলছেন বাছুর, বলদ ও দুগ্ধবতী গরু মাংসের জন্য বধ করা হবে না, এটা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যুক্তিসম্মত। কিন্তু অন্যান্য গরুর মাংস খাওয়া চলবে। এর প্রমাণ হচ্ছে অর্থশাস্ত্রের ঊনত্রিশ অধ্যায়েই লেখা আছে যে কোনো গরুর যদি প্রাকৃতিক নিয়মে মৃত্যু হয় তাহলে তার চামড়াটা রাজার সম্পত্তি কিন্তু তার মাংস শুকনো বা তাজা, যে কোনো ভাবে বিক্রি করা যাবে। অর্থাৎ গোমাংস খাওয়ার প্রতি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

এবারে প্রশ্ন আসতে আরম্ভ করল বিচারকদের আসন থেকে। প্রথমে বাংলার অধ্যাপক কেয়া চট্টোপাধ্যায় জিজ্ঞাসা করলেন, রুমা, তোমার কাছ থেকে এখনো অবধি যা শুনলাম তা সমস্তই সংস্কৃত সাহিত্য থেকে। এর বাইরে কোনো উদাহরণ নেই বিতর্কের মূল বিষয়ের পক্ষে?

রুমা বলল, নিশ্চয়ই আছে। প্রথমেই বৌদ্ধ পালি সাহিত্য থেকে কিছু কথা বলতে চাই। অহিংসার পূজারী ভগবান বুদ্ধ যে প্রাণীহত্যার বিরোধী ছিলেন সেটা আমাদের সকলেরই জানা। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটকের এক ভাগ সুত্ত পিটক। তার  মজ্ঝিম নিকয় নামের অংশটি আমরা দুটো কথা পাই, ‘দক্ষো গোঘাতকো’ অর্থাৎ দক্ষ গোঘাতক এবং ‘গোঘাতক-অন্তেবাসী’ অর্থাৎ শিক্ষানবীশ গোঘাতক। এদের পেশা কি ছিল বোঝাই যাচ্ছে। সংযুক্ত নিকয় নামের অংশটিতে এক গল্পে আছে যে কোশলরাজ প্রসেনজিৎ এক মহাযজ্ঞে প্রায় হাজার খানেক গরু ও বৃষ উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বুদ্ধের উপদেশে নিবৃত্ত হন।

এবার আসি প্রাচীন তামিল সাহিত্যে। প্রায় দু’হাজার বছর পুরোনো সঙ্গম সাহিত্য ‘অকানানুরু’-র ২৪৯ ও ২৬৫ পদ দুটিতে আছে যে একদল দস্যু মোটাসোটা বাছুরের মাংস আগুনে ঝলসিয়ে খাচ্ছে।

ভাস্কর বসুরায় জিজ্ঞাসা করলেন, দ্যাখো আমি বিজ্ঞানের পূজারী। তোমাদের যুক্তি যা শুনলাম সবই তো কোন মুনি কবে কি লিখে গেছেন তার ওপর নির্ভর। প্রাচীন ভারতে গোমাংস খাওয়ার পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ আছে কি?

উত্তরটা এলো রুমার কাছ থেকে। সে বলল, আধুনিক পুরাতত্ত্ব বা আর্কিওলোজি পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত। তাই এবারে আমি প্রমাণ দেব আর্কিওলোজির থেকে। প্রথমে অশোকের স্তম্ভলিপি। আমরা সকলেই জানি কলিঙ্গ যুদ্ধের পর রাজর্ষি সম্রাট অশোকের ‘ধম্ম’ ছিল অহিংসা। তিনি তাঁর পঞ্চম স্তম্ভলিপিতে কিছু পশুপাখী ও মাছ প্রজাদের খেতে নিষেধ করেছেন। এই পশুপাখীর তালিকাতে অনেক জানা-অজানা পশুর নাম পাওয়া যায়, এমনকি পিঁপড়ের নামও আছে, কিন্তু গরুর নাম অনুপস্থিত। আমার মতে এর কারণ এই যে সম্রাট অশোক জানতেন যে গোমাংস প্রজাদের মূল খাবারের মধ্যে পড়ে ও সেখানে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া অবাস্তব।

কিন্তু প্রাচীন যুগে গোমাংস খাবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ পাওয়া যায় মাটির তলা থেকে।  আর্কিওলোজিস্টরা ভারতবর্ষের মাটি খুঁড়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজার হাজার বছরের পুরোনো বিভিন্ন প্রাণীর প্রচুর হাড়গোড় পেয়েছেন। তার মধ্যে খুব বেশী পাওয়া গেছে, বড়ো ও বাচ্চা গবাদি পশুর হাড়। কিন্তু একটা ব্যাপার পণ্ডিতেরা লক্ষ্য করেছেন যে বেশ কিছু গরুর হাড় কাটা ও পোড়ানো। পণ্ডিতদের মতে এর থেকে নিশ্চিত প্রমাণ হয় যে গোমাংস কেটে ও আগুনে ঝলসিয়ে খাওয়া হত। কেবল কোনো এক জায়গায় বা এক সময়ে নয়, সারা ভারত জুড়ে একের পর এক সাইটে, সেই প্রাচীন কাল থেকে একেবারে ঐতিহাসিক যুগ পর্যন্ত, এই ধরনের কাটা ও পোড়ানো গরু বা বলদের হাড় দেখতে পাওয়া যায়। এই রকমই একটা সাইট প্রাচীন হস্তিনাপুর, যেটা বর্তমান উত্তরপ্রদেশের মেরঠ জেলায় বলে মনে করা হয়। ওখানেও মাটি খুঁড়ে একই রকম হাড় পাওয়া গেছে ও একই সিদ্ধান্তে এসেছেন পণ্ডিতেরা। কাজেই বিজ্ঞানও আমাদের প্রমাণ দেয় যে প্রাচীন ভারতে গোমাংস খাওয়ার বহুল প্রচলন ছিল।

বিচারকদের আসন থেকে ডিন সুমিতবাবু বললেন, আমার একটা প্রশ্ন আছে। প্রথমে বৈদিক যুগে দেখছি গরুকে আদর করে দেবতাদের সাথে তুলনা করা হয়েছে, অথচ গোমাংস খাওয়ার নিষেধাজ্ঞা ছিলনা এবং যজ্ঞে গরুকে উৎসর্গ ও বলি দেওয়া হত। এর প্রায় দুই হাজার বছর কিংবা আরো পরে, বিশেষত মধ্যযুগে, স্মৃতিশাস্ত্রে ও বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে দেখছি গরুতে দেবত্ব  আরোপ হয়েছে, গরুকে রক্ষা করা পুণ্য এবং গোমাংস খাওয়াকে পাপ বলা হচ্ছে। এই বিবর্তনটা কিভাবে হল, এর পেছনে কি কি কারণ কাজ করছে সেটা জানতে চাই।

রুমার উত্তর শুনে সকলে একেবারে আশ্চর্য হয়ে গেল। সে বলল, স্যার, এটার উত্তর আমার থেকে উদয়ন ভালো জানে, ওকেই এটা বলতে অনুরোধ করছি।

সুমিতবাবু অবাক হয়ে বললেন তার মানে? ও তো তোমার প্রতিপক্ষ, এই বিতর্কে তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী, ও তোমার হয়ে উত্তর দেবে কেন?

রুমা হেসে বলল, স্যার, প্রতিদ্বন্দ্বী তো খালি বিতর্কের জন্য। আসলে অনেক দিন ধরে আমরা দুজনে একসঙ্গেই গরু ও গোমাংস নিয়ে পড়াশুনো করেছি, আমার সমস্ত যুক্তি উদয়ন জানে আর ওর সমস্ত যুক্তি আমার জানা। আপনার প্রশ্নটা আমাদের মাথাতেও ছিল, কিন্তু আমার আগেই  উদয়ন এই ব্যাপারে আমার থেকে বেশী পড়াশুনো করে ফেলেছে, তাই ওকেই অনুরোধ করছি এই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য।

দর্শক আর একবার হাততালি দিল রুমার কথা শুনে।

উদয়ন তার গম্ভীর ব্যারিটোন গলায় বলতে শুরু করল, আপনার প্রশ্নটা হাজার বছর আগে মহাপণ্ডিত আল-বেরুণীর মনেও এসেছিল। আজ থেকে এক হাজার বছর আগে আল-বেরুণী পারস্য থেকে ভারতে এসে, সংস্কৃত শিখে, ভারতবর্ষ নিয়ে  লিখেছিলেন ‘তারিখ-আল-হিন্দ’ বইটি। সেই বইয়ের আটষট্টি অধ্যায়ে তিনি হিন্দুদের কাছে কোন মাংস খাদ্য হিসেবে গণ্য ও কোনটা অখাদ্য তার একটা তালিকা দিয়েছেন। তাতে গরু আছে অখাদ্যের তালিকায়। আল-বেরুণী অনেক লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেন যে গরু কেন অখাদ্য। কেউ বলল, আসলে বহু প্রাচীন কালে, ভরত রাজারও আগে, লোকজন যজ্ঞে গো-বলি দিত ও গোমাংস খেত। কিন্তু তার পরে যে কেন বন্ধ হয়ে গেছে কেউ জানে না। কিছু হিন্দু আবার বলল, আসলে আমরা খুব পান খাই তো, আর গরুর মাংস এমনিতেই গরম, গোমাংসের সাথে পান খেলে শরীর শুকিয়ে যায়, তাই আমরা আর ওই মাংস খাই না। আসলে আল-বেরুণী যেমনটি দেখেছেন, শুনেছেন তেমনটি লিখেছেন। তিনি যদি ভারতের ইতিহাসের আর্থ-সামাজিক বিবর্তনটা খতিয়ে দেখতেন, তাহলে বুঝতে পারতেন এই পরিবর্তন কেমন করে হয়েছে।

বৈদিক যুগের পশুপালন ও কৃষিভিত্তিক সমাজের কেন্দ্রে গরুর কি ভূমিকা ছিল সেটা শুরুতেই সুরময়ীদি বলেছেন। গরুই ছিল মুদ্রা, গরুই ছিল অর্থনীতি। ঋগ্বেদে আছে পণি বলে একদল মানুষ ইন্দ্রের গরু চুরি করেছিল। তাতে ইন্দ্র রীতিমত খাপ্পা হয়ে সরমা নামে এক কুক্কুরীকে পাঠিয়ে পণিদের ধমক দেন, গরু ফেরত দাও, নাহলে ইন্দ্র এসে তোমাদের মজা দেখিয়ে দেবে। তাহলেই বুঝুন ইন্দ্রের মতো শক্তিমান দেবতারও গরু চুরি গেলে কি অবস্থা হত। 

উদয়নের গল্প বলার ভঙ্গীতে একটা মাদকতা আছে, সবাই নিশ্চুপ হয়ে শুনছিল।

পরের পাঁচশো থেকে হাজার বছরে ভারতের সমাজে, বিশেষ করে উত্তর ভারতে যে বিবর্তন গুলি হয়েছিল তার মধ্যে দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি হচ্ছে সমাজে বর্ণভেদ প্রতিষ্ঠা এবং চার বর্ণের পেশাগত ভেদাভেদ ও ব্রাহ্মণের উত্থান। আর দ্বিতীয়টি হল, লোহার বহুল ব্যবহার, লোহার তৈরী অস্ত্রের সাহায্যে তাড়াতাড়ি জঙ্গল কেটে চাষ-আবাদ ও জনপদ তৈরী। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে আমরা উত্তর ভারতে ষোলটি জনপদ গড়ে উঠেছে দেখতে পাই। জনপদগুলি গড়ে ওঠার সাথে সাথে বিভিন্ন পেশার উত্থান হল এবং পশুপালন ও কৃষির ওপর নির্ভরতা কমল। মনু মহারাজ তাঁর স্মৃতিশাস্ত্রে দশম অধ্যায়ে চারটি পেশার কথা বলছেন, সূত হচ্ছে রথের ব্যাপারে দক্ষ, অম্বষ্ঠ জনগণ হচ্ছে চিকিৎসার ব্যাপারে দক্ষ, বৈদেহক অধিবাসীরা স্ত্রীকার্যে ও মগধ হচ্ছে ব্যবসায় দক্ষ। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রীক রাজদূত মেগাস্থিনিস চন্দ্রগুপ্ত  মৌর্যের সভায় এসে পাটলিপুত্রে  অনেক বিভিন্ন পেশার লোকজনের কথা বলেছেন। বিভিন্ন পেশা চালু হবার সাথে সাথে অর্থনীতির বৃদ্ধি হতে লাগল এবং সমাজে গরুর গুরুত্ব লঘু হতে লাগল। ইতিমধ্যে, খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে, জনপদগুলি গড়ে ওঠার সাথে সাথে এসেছিল প্রথম পাঞ্চ-মার্ক মুদ্রার প্রচলন, মৌর্য যুগে যার ব্যবহার ব্যাপক হল। এর ফলে গরু আর অর্থনীতির কেন্দ্রে বা সমাজে প্রধান অর্থনৈতিক বিনিময় মাধ্যম রইল না। একে আমরা বলব মুদ্রা-ভিত্তিক অর্থনীতির গড়ে ওঠা। এর ফলে গরু ছাড়াও উপার্জন ও জীবনযাপন সম্ভব হল।  

পাঞ্চ-মার্কড মুদ্রা

অন্যান্য পেশার কাছে গরু প্রধান সম্পদ না হলেও, ব্রাহ্মণ বর্ণের কাছে গরুর অবস্থান বদলালো না। একটু আগে রুমা বলেছে কেমন করে বর্ণভেদের শেকড় গভীর হতে লাগল ও সমাজে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য ততই বাড়তে লাগল। কিন্তু ব্রাহ্মণের কৃষিকাজ বারণ, একথা মনু-পরাশর লিখে গেছেন। এখনো গাঁয়ে-গঞ্জে শোনা যায় বামুনের ছেলে হয়ে হাল চালাবি কি রে? স্মৃতি সাহিত্যগুলিতে অনেক জায়গায় লেখা আছে কিছু পাপ করলে ব্রাহ্মণকে গো-দান করে সেই পাপ স্খালনের কথা। গরু দক্ষিণার প্রচলনটা বৈদিক যুগ থেকেই ছিল। তাই গরু-দক্ষিণা বা গো-দান ব্রাহ্মণদের প্রধান উপার্জন ও সম্পদ হয়ে দাঁড়ালো। সেই থেকে একটা কথা চালু হল ‘গো-ব্রাহ্মণ-হিতায়’। মনুস্মৃতির একাদশ অধ্যায়ে আছে ব্রহ্মহত্যা করেও ‘গোব্রাহ্মণহিতেরতঃ’ হলেই পাপ থেকে মুক্তি। প্রায় দেড়শো খ্রীষ্টাব্দে শক রাজা মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামনের জুনাগড় শিলালিপিতে, যেটি সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রথম শিলালিপি বলে মনে করা হয়, আমরা ‘গো-ব্রাহ্মণ’ কথাটি পাই। কাজেই, প্রথম শতাব্দীতে ‘গো-ব্রাহ্মণ’ যে ওতপ্রোত হয়ে উঠেছিল এবং গরুতে ক্রমে ক্রমে দেবত্ব আরোপ হচ্ছিল এটা অনুমান করা যেতেই পারে। তবে মুখ্য পুরাণগুলিতে গরুর দেবত্বটা পাকাপাকি করা হয়েছে, চতুর্থ থেকে পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে, মোটামুটি গুপ্ত যুগে।  

ব্রাহ্মণদের গরুর প্রয়োজন নিয়ে বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটা গল্প বলতে ইচ্ছে করছে।

দর্শকদের মধ্যে খালি শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ।

বৃহদারণ্যক উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে আছে বিদেহরাজ জনক এক মহাযজ্ঞে সোনায় মোড়া শিং-ওয়ালা এক হাজার গরু দান করতে চাইলেন, সমবেত ব্রাহ্মণদের মধ্যে একজনকে যিনি ব্রহ্মিষ্ঠ অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানী। তখন ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য উঠে দাঁড়িয়ে শিষ্যদের বললেন, ওহে তোমরা গরুগুলি আমার আশ্রমে নিয়ে যাও। বাকী ব্রাহ্মণরা রেগেমেগে সকলে একযোগে যাজ্ঞবল্ক্যকে বললেন, কি হে, তুমি একাই ব্রহ্মিষ্ঠ, আর আমরা সব ফেলনা? তখন যাজ্ঞবল্ক্য বললেন, বাপু ব্রহ্মিষ্ঠকে প্রণাম, বর্তমানে আমার গরুগুলি খুব প্রয়োজন তাই নিয়ে চললাম। এর পর যাজ্ঞবল্ক্যর সাথে বাকী ঋষিদের যে ধুম তক্কো লাগল, সে অন্য গল্প। কিন্তু মোদ্দা কথা প্রমাণ হল যে গরু ব্রাহ্মণের খুব প্রয়োজনীয় সম্পদ।

মুস্কিল হচ্ছে, যে গরুটি ব্রাহ্মণের দক্ষিণা, সেটি খেয়ে ফেললে তার ভাগে ফাঁকা পড়ে যায়। তাই বই-পত্তরে, বিশেষ করে স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে লেখা শুরু হল গরুর মাংস খেয়ো না। গরু হয়ে উঠল ‘কলিবর্জ্য’, কলিকালে গোমাংস নিষেধ এই বিধান শুরু হল। সমাজের শিরে ব্রাহ্মণ, তার বিধান অগ্রাহ্য করলে অমুক পাপ, তমুক নরক, সেটাও লেখা হল স্মৃতিশাস্ত্রে। গরুতে দেবত্ব আরোপ পাকাপোক্ত হয়ে বসল। বিভিন্ন পুরাণে সুরভি ও কামধেনুর মতো পৌরাণিক কাহিনীগুলি লেখা হল গরুর দেবত্বটা পাকাপাকি করতে। পঞ্চগব্য, যা পূজোতে কাজে লাগে, এই প্রচেষ্টারই ফল।

আসল অর্থনৈতিক কারণটা কিন্তু চাপা পড়ে গেল বিধানের তলায়। গোবধের পাপের হিসেব কিন্তু শাস্ত্রমতে ‘উপপাতক’ অর্থাৎ খুচরো পাপ, ব্রহ্মহত্যা বা সুরাপানের মতো ‘মহাপাতক’ নয়। সেই জন্যই আমরা দেখি পরাশর স্মৃতি বলছে গোবধ করলে ব্রাহ্মণভোজন করালেই পাপমুক্তি। এরই সাথে ছিল বিভিন্ন দুষ্কর্মের সাজা হিসেবেও ব্রাহ্মণকে গরু-দানের জরিমানার প্রথা, সেখানেও ব্রাহ্মণের গো-সম্পদ লাভ। প্রাচীন সূত্রসাহিত্যে আছে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা যদি কাউকে হত্যা করত, তাহলে শাস্তি হিসেবে নিহতের পরিবারকে প্রচুর গরুর জরিমানা দিতে হত। শুরুতে জরিমানার গরুগুলি রাজার হাতে দিতে হত, তিনি নিহতের পরিবারকে গরুগুলি দিতেন, তাতে রাজার পক্ষ থেকে কয়েকটি বলদ ফাউ হিসেবে যোগ করা থাকত। পরে পরে এটা বদলে গেল, বিধান হল, গরুগুলি ব্রাহ্মণকে দিলেই পাপ মুক্তি। কাজেই ব্রাহ্মণের গো-সম্পদ বাড়ানোর পন্থাগুলি ভালোই ছিল। এখন ব্যাপার হল, দক্ষিণা বা জরিমানার গরু নিয়ে ব্রাহ্মণ রাখবেন কোথায়? চালু হল মন্দিরের সাথে গোয়াল তৈরীর প্রথা। চতুর্দশ শতকে তিরুবনন্তপুরমের এক লিপি থেকে আমরা দেখতে পাই পদ্মনাভস্বামীর মন্দির সংলগ্ন এক গোশালা তৈরীর কথা। গরুর মালিক যেহেতু বকলমে মন্দিরের দেবতা, তাই গোমাংস খাওয়া হয়ে গেল নিষেধ।

গরু পূজা

গরুর দেবত্ব অর্জনের আরো একটা কারণ আছে। রুমা শুরুতেই বলেছে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে কেমন করে আলংকারিক অর্থে গরুকে বিভিন্ন নামে ডাকা হত, যেমন কবিতায় এখনো আমরা অলংকার ব্যবহার করি। কালে কালে, মানুষ এই আলংকারিক অর্থটা ভুলে গিয়েছিলেন ও বেদে যা লেখা আছে তাকেই সোজাসুজি প্রামাণ্য বলে ধরে নিতে শুরু করল। এর ফলে গরুতে দেবত্ব আরোপণ শুরু হল। কিছু পণ্ডিত এটাকে গরুর দেবত্ব অর্জনের আরো একটা কারণ বলে থাকেন। মনে রাখতে হবে বেদ সম্পূর্ণ ভাবে মৌখিক ভাবে প্রচলিত ছিল, যার জন্য বেদের অপর নাম শ্রুতি।

বেঙ্গালুরু বুল টেম্পল

এত কিছু সত্ত্বেও একটা কথা আমার আশ্চর্য লাগে। গরুকে গোমাতা বলে অনেকে পূজো করেন, কিন্তু আমাদের দেশে কোথাও গোমাতার মন্দির আছে বলে আমার জানা নেই। সেদিক দিয়ে কিন্তু ষাঁড় ভাগ্যবান, বাবা শিবের বাহন বলে, শিবের সাথে ষাঁড়ও পূজো পান। কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু আর মাইসুরু, দুই শহরেই বিশাল বুল-টেম্পল আছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গোমাংস খাওয়ার নিষেধাজ্ঞা কতটা বলবৎ ছিল। আলবেরুণী লিখছেন শূদ্ররা গোমাংস খেত। ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার তাঁর Early India বইটির এক জায়গায় লিখেছেন যে গোমাংস খাওয়ার নিষেধ উঁচু জাতিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কাজেই গোমাংস খাবার নিষেধাজ্ঞা স্মৃতিসাহিত্যে থাকলেও ব্যাপারটা সমাজের সবক্ষেত্রে বলবৎ হত না।

আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে ভারতবর্ষের ধর্মীয় জগতে এসেছিল আরো দুটো বিশাল পরিবর্তন। প্রথমটা হল ভগবান বুদ্ধের অহিংসার বাণী। তিনি যজ্ঞ এবং তাতে যথেচ্ছ পশুবলির ঘোর বিরোধী ছিলেন।  বৌদ্ধধর্ম প্রাণীবধ থেকে বহু পশুকে মুক্তি দিয়েছিল। সারা ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ও অহিংসার জন্য প্রচুর মানুষ মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকত। এটাও ছিল গোমাংসের প্রচলন কমে যাওয়ার একটা অন্যতম কারণ। আর্কিওলোজিও এটা সমর্থন করে।

দ্বিতীয়টা হচ্ছে উপনিষদের নিরাকার ব্রহ্মের আরাধনা, যেখানে যজ্ঞ ও পশুবলির কোনো প্রয়োজন নেই। রুমা একটু আগে বলছিল যে বৈদিক যুগ থেকেই পশুবলিতে একটা চাপা অস্বস্তি চালু ছিল। শতপথ ব্রাহ্মণের প্রথম কাণ্ডের দ্বিতীয় অধ্যায়ে একটা গল্পের রূপকের মাধ্যমে এই ধরনের একটা ইংগিত আছে। গল্পে আছে যে প্রথমে দেবতারা একটি মানুষকে বলি হিসেবে এনেছিলেন, কিন্তু বলির যে মূল গুণ, সেটি মানুষের থেকে বের হয়ে ঘোড়ার মধ্যে প্রবেশ করল, এই রকম ভাবে ঘোড়া থেকে বলদ, ভেড়া, ছাগল ইত্যাদি হয়ে সেই যজ্ঞগুণ মাটিতে প্রবেশ করল। দেবতারা মাটি খুঁড়ে পেলেন ধান ও যব। তাই ধান ও যব উৎসর্গ করে পশু উৎসর্গের পাঁচগুণ বেশী ফল পাওয়া যায়। এজন্যই ঐতরেয় ব্রাহ্মণে, শতপথ ব্রাহ্মণে ও মনুস্মৃতিতে ‘পিষ্টপশু’ অর্থাৎ চাল ও যব দিয়ে তৈরী পশুর মূর্তি বলি দেওয়ার কথা লেখা আছে। যজ্ঞে পশুবলি কমে গেলে তার সাথে গোমাংস খাওয়াও কমে আসাই স্বাভাবিক, যদিও এই নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। সম্ভবত বলির রক্ত দেখে উপনিষদ রচয়িতা কোনো ঋষির প্রাণ কেঁদেছিল, ‘এত রক্ত কেন?’  চিন্ময়রূপে যিনি সর্বজীবে, সর্বভূতে আছেন, তিনিই তো আমি, তাহলে আর নিরীহ পশুর প্রাণ নেওয়ার কি প্রয়োজন?’ তাই তো উপনিষদের ঋষিকবিরা বলির গরিমা নয়, বলেছেন অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে আলোর, মৃত্যুর থেকে অমৃতের পরপারের সাধনার কথা।

উদয়ন থামলে, সুরময়ীদি তার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে চাইলেন। উদয়ন মাথা নাড়লো, আর কিছু বলার নেই। সুরময়ীদি বললেন, আমাদের বিতর্ক সভা এখানেই শেষ। দর্শকদের মধ্যে থেকে একজন প্রশ্ন করলেন, তাহলে হার-জিতের হিসাব কি হল?

সুরময়ীদি উত্তর দিলেন, এখানে হার-জিতের কোনো প্রশ্নই নেই। এই বিতর্ক সভা হার-জিতের জন্য করা হয় নি। এটা ছিল লোকশিক্ষার জন্য, সত্যকে সকলের সামনে আনার জন্য। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় সমাজ কেমনভাবে সব যুগেই বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে এবং এখনো চলছে, সে কথা সকলকে জানানো জন্য। রুমা আমার ছাত্রী, ওর এই বিষয়ে গভীর পড়াশুনো করা আছে, তাই আমাদের প্রাচীন শাস্ত্র ও সাহিত্য ঘেঁটে কিছু তথ্য সকলের বোধগম্য করে পেশ করেছে। শাস্ত্রে বিতর্কের পক্ষে ও বিপক্ষে দু-রকমই যুক্তি আছে, আবার একই শাস্ত্রে পরস্পরবিরোধী যুক্তিও আছে। উদয়ন একেবারে মূলে গিয়ে সুচারু ভাবে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছে বিপক্ষ যুক্তিগুলির প্রধান কারণগুলির উৎস কি ও কোথায়।

গণতান্ত্রিক সমাজে খাওয়াটা মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দের ব্যাপার। এখানে শাস্ত্রের কোনো হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। যদি মিষ্টান্নমিতরেজনাঃ মেনে কেউ ডায়াবেটিস রুগীকে মিষ্টি খাইয়ে দেয় তার ফল নিশ্চয় ভালো হবে না। তাই মানুষ খাবে নিজের রুচি মতো, স্বাস্থ্যের কথা ভেবে এবং অবশ্যই চিকিৎসকের কথা মেনে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য অনেক কিছুর মতোই এই ব্যাপারেও শাস্ত্রের কোনো ভূমিকা দেখিনা।

অধ্যাপক ভাস্কর বসুরায় হাত তুলে উদয়নকে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁরে উদো, তুই আমাদের ইলেক্‌ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র হয়ে এতো সব সংস্কৃত অং বং শিখলি কি করে?

উত্তরটা এলো শ্রোতাদের মধ্যে থেকে,  ‘রুমার সাথে ঘুরে ঘুরে স্যার’। সভা ভরে গেল সকলের মিলিত হাসিতে।


কৃতজ্ঞতা স্বীকার
অধ্যাপক ডরিস মেথ শ্রীনিবাসন ও দীপক ভট্টাচার্য আমার পাণ্ডুলিপি (ইংরেজী অনুবাদ) দেখে তাঁদের মূল্যবান মতামত জানিয়ে আমার অশেষ উপকার করেছেন। লেখার সময় ডরিস বারবার উৎসাহভরে জানতে চেয়েছেন প্রবন্ধটি কতদূর এগোলো। দীপক ভট্টাচার্য আমাকে পাণিনি সূত্রটির সরলার্থ জানিয়ে সাহায্য করেছেন। এঁরা দুজনেই স্বনামধন্য সংস্কৃতজ্ঞ ও ইণ্ডোলজিস্ট, এঁদের গবেষণা/অধ্যাপনার ব্যস্ততার মধ্যেও আমাকে সময় দিয়েছেন এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।
আর্কিওলোজির অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তীর নাম পুরাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে সুপরিচিত। উনি আমাকে বি পি সাহুর বইটির কথা জানিয়েছিলেন, যেটির থেকে আমি আর্কিওলোজির তথ্যগুলি জানতে পেরেছি। এস পালানিয়াপ্পান আমাকে তামিল সূত্রগুলির অনুবাদের খোঁজ দিয়ে সাহায্য করেছেন। এঁদের সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকব।

 

মূল তথ্যসূত্র
1.        D.N. Jha - The Myth of the Holy Cow, Verso, London, 2002
2.        Debiprasad Chattopadhyay -  Science and Society in Ancient India,   B R Grüner B V, Amsterdam, 1978
3.        B.P. Sahu – From Hunters to Breeders – Faunal Background of Early India, Anamika Publication, Delhi, 1988
4.        Doris Meth Srinivasan – Concept of Cow in the RigVeda,  Motilal Banarasidas, Delhi, 1979
5.     W Normal Brown – The Sanctity of the Cow in Hinduism, The Economic Weekly, Feb 1964, Madras

এছাড়া অন্যান্য তথ্যসূত্রগুলি নাম প্রবন্ধের মধ্যেই উল্লেখিত আছ



লেখক পরিচিতি - যাদবপুর ও ব্যাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্‌টিটিউট অফ সায়েন্সের প্রাক্তনী। বর্তমানে আমেরিকার সেন্ট লুইস, মিসৌরী) শহরবাসী। ইতিহাস পেশা নয়নেশা। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও Indology নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালবাসেন।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।