ইতিহাসের কথা
অগাস্ট ১৫, ২০১৫
আমেরিকায় বাঙালী অভিবাসীদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস - দ্বিতীয় অংশ
দেবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়
(প্রথম অংশ) ১৮৯৩ সাল। বছরের সুরুটা ভারতীয় উপমহাদেশের লক্ষ লক্ষ বাঙালী বা তখন উত্তর আমেরিকায় বসবাসকারী গুটিকতক বাঙালী চিকনদারদের কাছে মোটেই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না। কেউই সে সময় কল্পনা করে নি যে সেই বছরে একটা বিশ্ব-আলোড়নকারী ঘটনা ঘটবে । ১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তারিখে স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগোতে বিশ্বধর্ম সম্মেলনের সভায় হিন্দুধর্ম ও বেদান্ত দর্শনের ওপর ভাষণ দিয়ে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করলেন।
তিনি ভারতবর্ষকে ও ভারতীয় সংস্কৃতি, ধর্ম ও দর্শনকে এমন ভাবে আমেরিকাবাসীদের কাছে উপস্থাপন করলেন যা বিবেকানন্দের আগে বা পরে কেউই করেন নি! এর আগে পর্যন্ত ভারত ও প্রাচ্যের অন্যান্য দেশ সম্পর্কে আমেরিকার অধিকাংশ লোকেরই যে ধারণা ছিল – সেগুলো হয় ভ্রান্ত, নয় অস্পষ্ট। তার থেকেও বড় কথা, সেই সময়কার বহু ভারতীয়ই ইউরোপের বাইরে কিছু চিন্তা করতে পারতেন না। রাজনৈতিক, সামাজিক বা মেধা-জগতে আমেরিকার অগ্র-ভূমিকাকে স্বীকৃতি খুব কম ভারতীয়ই দিত। স্বামী বিবেকানন্দের আমেরিকা আগমন পুব-পশ্চিমের মধ্যে বোঝাপড়ার একটা নতুন যুগ আনল ... যার ফলশ্রুতি হল দেশ থেকে আমেরিকায় পাড়ি দেবার একটা নতুন তরঙ্গ। বহু বুদ্ধিজীবী বাঙালী আমেরিকায় আসতে শুরু করলেন। কেউ কেউ এসে থেকেও গেলেন। চিকনদার আর লস্কররা আগে এদেশে এসেছিলেন শ্রমিক কাজ করতে ও জিনিস বেচতে। এখন যাঁরা এলেন, তাঁরা হলেন ধর্ম-প্রচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, অধ্যাপক, গবেষক, লেখক বা কবি সম্প্রদায়ের। এঁরা দল বেঁধে আসেন নি। এসেছিলেন নিজেদের প্রতিভার জোরে ... ব্যক্তিগত বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে।
স্বামীজীদের আগমন – ধর্ম প্রচারের জন্য
স্বামী বিবেকানন্দ এসেছিলেন বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যোগ দিয়ে ফিরে যেতে, কিন্তু মার্কিন দুনিয়ায় তাঁর নতুন ভক্তদের অনুরোধ এড়াতে পারলেন না। থেকে গেলেন প্রায় দুবছর। আমেরিকার বহু শহরে তিনি ঘুরলেন। সেখানে হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম এবং পৃথিবীর সর্বধর্মের মধ্যে ঐক্যতা এবং সুরের মিলের কথা তিনি শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরলেন। ১৮৯৪ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে তিনি স্থাপন করলেন বেদান্ত সোসাইটি। দুবছর বাদে ১৮৯৬ সালে সেই শিশু-প্রতিষ্ঠানটিকে বড় করে তোলার ভার দিলেন গুরুভাই স্বামী অভেনন্দকে ( ১৮৬৬ - ১৯৩৯ ) । স্বামী অভেদানন্দ তখন লন্ডনে আর বিবেকানন্দ লন্ডন ভ্রমণ করছেন। অভেদানন্দ দায়িত্ব নিতে স্বীকৃত হলেন এবং তিনিই সম্ভবত প্রথম বাঙালী বুদ্ধিজীবী যিনি দীর্ঘকালের জন্যে আমেরিকায় এসে বসবাস শুরু করেন।
১৮৯৭ সালে স্বামী অভেদানন্দ (জন্মনাম কালীপ্রসাদ চন্দ্র) নিউ ইয়র্কে এলেন। তখন ওঁর বয়স মাত্র ৩১ বছর। প্রথমে ভেবেছিলেন অল্প সময়ের জন্যেই থাকবেন। কিন্তু সুদীর্ঘ ২৫ বছর আমেরিকাতেই কেটে গেল। স্বামী বিবেকানন্দের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বেদান্ত ও যোগ-দর্শনের প্রচারের জন্যে আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরলেন। অভেদানন্দ ছিলেন বাগ্মী ও সুলেখক। শুধু আমেরিকা মধ্যে নয়, প্রশান্ত মহাসাগরের নানান দেশে এই প্রচার কর্মের জন্যে তিনি পা দিয়েছিলেন। আমেরিকার এই ২৫ বছরের প্রবাসে তিনি সতেরোবার প্রশান্ত মহাসাগর পারাপার করেন! শেষে ১৯২৩ সালে তিনি ভারতবর্ষে ফিরে যান।
১৯০২ সালে বিবেকানন্দের নির্দেশে স্বামী ত্রিগুণানন্দ ( ১৮৬৫ - ১৯১৫ ) স্যান ফ্রান্সিস্কোর বেদান্ত সোসাইটির দায়িত্বভার নিতে এলেন। ওঁর একটা স্মরণীয় সৃষ্টি হল উপাসনার জন্যে সেখানে একটি হিন্দু মন্দির তৈরি করা। ১৯১৫ সালে একটি মানসিক ভারসাম্যহীন ছাত্রের নিক্ষিপ্ত বোমায় আহত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯২৩ সালে স্যান ফ্র্যান্সিস্কোর বেদান্ত সেন্টারে সহকারী মহারাজ হিসেবে যোগ দিতে আসেন স্বামী প্রভানন্দ ( ১৮৯৩ - ১৯৭৬ ) । আসার দুবছর বাদে তিনি অরিগন-এর পোর্টল্যান্ড শহরে গিয়ে একটা নতুন কেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯২৯ সালে তিনি যান লস এঞ্জেলসে। সেখানকার বেদান্ত সোসাইটি অফ সাদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নেতৃত্বে পরে সেটাই পশ্চিম আমেরিকার সবচেয়ে বড় বেদান্ত সোসাইটি হিসেবে পরিণত হয়। হলিউড ও ট্র্যাবুকো ক্যানিয়নের মঠ এবং হলিউড ও সান্টা বারবারার আশ্রম ওঁরই সৃষ্টি। প্রভানন্দ বেদান্ত ও ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ নিয়ে বহু বই লিখছিলেন এবং পণ্ডিত হিসেবে ওঁর সুখ্যাতি ছিল। ওঁর অজস্র অনুরাগীদের মধ্যে ছিলেন অ্যালডুস হাক্সলি এবং ক্রিস্টোফার ইশারউডের মত ব্যক্তিত্ব। ইশারউডের সঙ্গে প্রভানন্দ ১৯৪৪ সালে ‘ভগবদ গীতা’ বইটি অনুবাদ করেন। দীর্ঘ ৫১ বছর আমেরিকায় কাটানোর পর ১৯৭৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডের ওঁর মৃত্যু হয়।
১৯০৫ সালে রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামীজীরা যখন আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তে বেদান্ত কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন, তখন ওয়াশিংটনের সিয়াটেল শহরবাসীরা আরেকজন বাঙালী বেশ খ্যাতিলাভ করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি অন্য, শিক্ষাদীক্ষা অন্য। নাম এ . কে . মজুমদার (১৮৬৫ – ১৯৫৩ )। এঁর জীবন ছিল বৈচিত্র্যে ভরা। আগ্রহী পাঠকরা এই ওয়েবসাইটটি (ক্লিক করুন) দেখতে পারেন।
অক্ষয় কুমার (এ. কে.) জন্মেছিলেন কলকাতার একটি উচ্চবর্ণ সম্ভ্রান্ত পরিবারে। ১৬ বছর বয়সে তাঁর মাতৃবিয়োগ হয়, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত তিনি ধার্মিক হিন্দুমাতার স্নেহচ্ছায়ায় বড় হন। মায়ের মৃত্যুর পর গৃহত্যাগ করলেন। ভারতের নানান অঞ্চল ভ্রমণের পর ১৯০২ সালে চীন ও ১৯০৩ সালে জাপানে যান। সেখানে তিনি গভীর ভাবে খ্রিষ্টধর্ম চর্চা করেন এবং তাতে আকৃষ্ট হন। ১৯০৩ সালে তিনি জাহাজে চেপে সিয়াটেল শহরে চলে এলেন। চলে তো এলেন, এদিকে পকেটে একটা পয়সা নেই, ইংরেজি ভাল বলতে পারেন না। একটি সুইডিশ পরিবার দয়াপরবশ হয়ে ওঁকে আশ্রয় দেন। ইংরেজি শিক্ষা সেখানেই হল। দেখতে সুন্দর, ভাল কথা বলতে পারতেন। শুরু করলেন দর্শন নিয়ে বক্তৃতা দেওয়া। সেই বক্তৃতার বিশেষত্ব হল – খ্রিষ্ট ও হিন্দুধর্মের সমন্বয় – যাঁকে তিনি আখ্যা দিলেন ‘চিরন্তন সত্য’ বলে। ১৯০৬ সালে এ. কে. মজুমদার স্পোকেন শহরে ‘ফার্স্ট সোসাইটি অফ ক্রিশ্চান যোগা’' নাম দিয়ে একটা চার্চ তৈরি করে সেখানে প্রতি রবিবার নিজের দর্শন প্রচার শুরু করলেন। সেই চার্চ আঞ্চলিক জনপ্রিয়তাও পেল। সম্পূর্ণ অন্য এক কারণেও এ. কে. মজুমদার ভারতীয় অভিবাসীদের ইতিহাসে বিশেষ স্থান পেয়েছেন। ১৯১২ সালের জুলাই মাসের ১১ তারিখে উনি মার্কিন নাগরিকত্ব পান, আগে যা কোনও ভারতীয় পান নি। স্থানীয় জেলা আদালতকে তিনি বোঝাতে সক্ষম হন যে তিনি একজন ‘ককেশিয়ান’। আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকার এর বিরুদ্ধে আপিল করে যেহেতু সেই সময়ে মার্কিন আইন অনুসারে ভারতীয়দের নাগরিকত্ব দেওয়া হত না। ১৯২৩ সালে আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালত ইউএস বনাম ভগত সিং থিণ্ড-এর মামলায় ভারতীয়দের নাগরিকত্ব পাবার অধিকার নেই বলেই রায় দেয়। সেই রায়ের ভিত্তিতে মজুমদারের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। এই ঘটনার পরে এ. কে. মজুমদার লস এঞ্জেলস-এ গিয়ে নতুন একটি চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৩ সালে মারা যান।
স্বদেশীদের আগমন – নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে শুধু বাঙালী স্বামীজীরা আমেরিকায় এসেছিলেন তা কিন্তু নয়। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশরাজের বাংলাকে বিভক্ত করার প্রচেষ্টায় বাঙালী যুব সমাজের একটা বড় অংশের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল। শুরু হয়েছিল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই ছিলেন ছাত্র - সচ্ছল পরিবারের ছেলে। গ্রেফতার এড়ানোর জন্যে এঁরা আমেরিকাতে চলে আসেন। তাঁদের কাছে আমেরিকা ছিল ‘স্বাধীনতা ও ন্যায়পরাণয়তার দেশ’ (land of liberty and justice) - সেই দেশ যেটা সর্বশক্তিমান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আইনি আওতার বাইরে। এই সব স্বদেশীরা আমেরিকায় থেকে কয়েক দশক ধরে তাদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম চালিয়ে যান। কেউ কেউ অবশ্য রাজনীতি ছেড়ে অন্য কাজেও মন দেন। এইসব স্বদেশীদের মধ্যে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন তারকনাথ দাস, এম.এন. রায় (মানবেন্দ্র নাথ রায়), ধনগোপাল মুখার্জি, শৈলেন্দ্র নাথ ঘোষ, প্রমুখ।
তারক নাথ দাস ( ১৮৮৪ - ১৯৫৮ ) । জন্ম বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলায়। কম বয়সেই এই মেধাবী ছাত্র স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেন। পুলিশ যখন ওঁকে ধরার চেষ্টা করে, তখন হিন্দু সাধু সেজে জাপানে পালিয়ে যান। ব্রিটিশ রাজ যখন ওঁকে প্রত্যাপর্তন করার জন্যে জাপানকে চাপ দেয়, তখন তিনি পালিয়ে ১৯০৬ (বা ১৯০৭) সালে আমেরিকার সিয়াটেল শহরে (ওয়াশিংটন স্টেট) চলে আসেন। আরম্ভ করেন কৃষিক্ষেতে মজুরের কাজ দিয়ে। পরে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে ক্যাম্পাসে ছাত্র হিসেবে পড়াশুনো করে ১৯০৮ সালে তারকনাথ ভানক্যুবারe আমেরিকার অভিবাসন দপ্তরে দোভাষীর কাজ নেন। ওঁর দায়িত্ব ছিল দেখা যাতে কোনও মতেই ইস্ট ইন্ডিয়া (ভারত) থেকে কেউ আমেরিকায় ঢুকতে না পারে। কিন্তু নিজের রাজনৈতিক বিবেকের তাড়নায় তিনি গোপনে ভারতীয়দের ক্যানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকবার পথ বাতলে দিতেন। এর ফলে তিনি শিখ সম্প্রদায়ের অনেকের সঙ্গে - যাঁরা আমেরিকাতে এসে বসবাস করতে ইচ্ছুক - সংস্পর্শে আসেন। এইভাবেই তিনি রাজনৈতিক ভাবে আবার অতি-সক্রিয় ওঠেন। শুরু করেন একটা মাসিক পত্রিকা ‘ফ্রি হিন্দুস্থান’ প্রকাশ করা। সেই পত্রিকায় ব্রিটিশদের ভারতীয়দের ওপর অত্যাচার ও অবদমন করে রাখার প্রক্রিয়াগুলোর কঠোর সমালোচনা করা হত। কিছুদিনের মধ্যেই ওঁকে সরকারী কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য করা হয়। উনি তখন আবার সিয়াটেল-এ ফিরে আসেন, কিন্তু পত্রিকা চালানো বন্ধ হয় না। এর পর তারকনাথ ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটন থেকে রাষ্ট্র-বিজ্ঞানে বি.এ. এবং এম. এ পাশ করেন। পড়াশুনো শেষ করে তিনি বার্কলেতে-তে ফিরে আসেন এবং ‘ঘাদার’ (শব্দার্থ ‘বিদ্রোহ’) দল প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নেন। পরে এদের দিয়ে ভারতে একটা বিদ্রোহ শুরু করার প্রচেষ্টা করেন।ভারতে বিদ্রোহের জন্য টাকা তুলতে তিনি জার্মানিতে যান। সুয়েজ ক্যানালে বেশ কয়েকটি ব্রিটিশ-বিরোধী অসফল গরিলা আক্রমণেও অংশ নেন। ১৯১৭ সালে তিনি যখন আমেরিকায় ফিরে আসেন, তখন তিনি ও আরও কয়েকজন অন্তর্ঘাতমূলক কর্মে জড়িত (হিন্দু-জার্মান কনস্পিরেসি কেস অফ স্যান ফ্র্যান্সিস্কো) ছিলেন বলে সাজা পান। ২২ মাসের জন্য তাঁর কারাবাস করতে হয়। ১৯২৩ সালে এ. কে. মজুমদারের মত ওঁর নাগরিকত্বও কেড়ে নেওয়া হয় আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের সে সময়কার রায়ের ভিত্তিতে। ১৯২৪ সালে তিনি ওঁর বহুদিনের বন্ধু ও আর্থিক সাহায্যকারিনী মেরি কিটিং মোর্সকে বিয়ে করেন। মেরি নিজে NAACP-র (ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ অ্যাডভান্সমেন্ট অফ কালার্ড পিপল) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯২৫ সালে তারকনাথ জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচ.ডি পান এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র-বিজ্ঞানের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি একজন সফল শিক্ষাবিদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৩৫ সালে স্ত্রীর সঙ্গে যৌথভাবে তিনি তারকনাথ দাস ফাউন্ডেশন স্থাপন করেন – যার উদ্দেশ্য ভারতীয় ছাত্রদের আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর বিষয়ে পড়াশুনো করতে আর্থিক সাহায্য করা। সেই ফাউন্ডেশন এখনও চলছে। ১৯৪৬ সালে একটি অম্লমধুর পরিস্থিতিতে তারকনাথ তাঁর নাগরিকত্ব ফিরে পান। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান লুস-সেলার অ্যাক্ট সই করে ভারতীয়দের হারানো নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার পালা শুরু করেন। দেশ ছাড়ার পর একবারই তিনি ভারতবর্ষে গিয়েছিলেন - ১৯৫২ সালে। সেখানে ওঁকে সসম্মানে বরণ করা হয়। ১৯৫৮ সালে নিউ ইয়র্কে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এম . এন . রায় (১৮৮৭ – ১৯৫৪ ) । মানবেন্দ্র নাথ রায়কে অনেকেই চেনেন এম. এন. রায় হিসেবে। উনি কিন্তু জন্মেছিলেন বাংলার ২৪ পরগণা জেলায় নরেন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য নামে। আমেরিকাতে ছিলেন মাত্র দশ মাস। সেক্ষেত্রে আমেরিকাতে অভিবাসন নিয়েছিলেন হয়ত বলা যায় না। যদিও ওই স্বল্প সময়ের মধ্যেই আমেরিকা ওঁর ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের ওপর একটা গভীর প্রভাব ফেলেছিল যার জন্যে স্বাদেশীকতার কেন্দ্র বিন্দু থেকে সরে গিয়ে উনি আন্তর্জাতিক বিপ্লবী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। শুধু সেই কারণেই আমেরিকায় যেসব স্বদেশী এসেছিলেন, তঁদের মধ্যে ওঁর নামও চলে আসে।
তরুণবয়সে মানবেন্দ্রর স্থির বিশ্বাস ছিল একমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবই ব্রিটিশদের হটাতে পারে। টাকা তোলার জন্যে উনি বেশ কিছু দুঃসাহসী ব্যাঙ্কলুটের কাজে যুক্ত হন। ২০১৫ সালে উনি বিপ্লবী যতীন মুখোপাধ্যায়ের (বাঘা যতীন নামে খ্যাত) সংস্পর্শে আসেন এবং জার্মানি ও জাপান থেকে অস্ত্র জোগাড় করার দায়িত্ব নেন। ওঁর চেষ্টাগুলো ব্যর্থ হয়, কিন্তু উনি আশা ছাড়েন না। একটি জাপানী জাহাজে লুকিয়ে থেকে ১৯১৬ সালে উনি স্যান ফ্রান্সিস্কোতে আসেন। নিজের পরিচয় দেন রেভারেন্ড চার্লস মার্টিন বলে। এখানে ওঁর যোগাযোগ হয় আরেক স্বদেশী ধনগোপাল মুখার্জির সঙ্গে; এবং বন্ধুত্ব হয় স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির একজন স্নাতকোত্তর ছাত্রী এভলিন টেন্টের সঙ্গে – যাঁকে উনি পরে বিয়ে করেন। মানবেন্দ্র আশা করেছিলেন আমেরিকায় থাকলে ব্রিটিশদের চোখ এড়িয়ে জার্মানদের সঙ্গে উনি গোপনে যোগাযোগ করতে পারবেন। কিন্তু সেটা আশাই রয়ে গেল। নিজের নাম পালটে এবার মানবেন্দ্র নাথ রায় করলেন। আমেরিকার সোশালিস্ট পার্টির খাতায় নাম লেখালেন। সেই সময়ে আমেরিকায় এই পার্টির বেশ কিছু সমর্থক ছিল।
১৯১৭ সালে আমেরিকার কর্তৃপক্ষ যখন মানবেন্দ্র রায়কে গ্রেফতার করতে যাচ্ছে, তখন উনি ডঃ ডেভিড স্টার জর্ডান নামে এক ভদ্রলোকের চিঠি নিয়ে মেক্সিকোর জেনারেল আলভারেজের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সমর্থ হন। জেনারেল আলভারেজ ও মেক্সিকোর অন্যান্য উচ্চপদস্থ অফিসারদের সাহায্যে উনি মেক্সিকোতে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন। মেক্সিকোতে উনি সোশালস্ট পার্টি শুরু করেন যেটা পরে কম্যুনিস্ট পার্টি অফ মেক্সিকো হয়। প্রথম দিকে রাশিয়ার বাইরে যেসব কম্যুনিস্ট পার্টি হয়েছিলে এটা ছিল তার অন্যতম। বলশেভিক দলের নেতা ভ্ল্যাদমির লেনিনের সঙ্গে ওঁর অন্তরঙ্গতা হয়। ১৯২০ সালে মস্কোতে আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় বিশ্বসম্মেলনে লেনিন ওঁকে আমন্ত্রণ করেন। সেখানে উনি আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট পার্টির প্রেসিডিয়ামের সদস্য নির্বাচিত হন। এর কার্যনির্বাহী সংস্থার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে উনি ছিলেন। ১৯২০ সালে তাসখন্দে উনি ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। স্ট্যালিন মানবেন্দ্র রায়কে সুনজরে দেখতেন না। তিনি ক্ষমতায় এলে ১৯২৯ সালে সালে মানবেন্দ্র রায়কে আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত করেন। ভগ্নোৎসাহ হয়ে ভগ্নদেহে মানবেন্দ্র রায় রাশিয়া ছেড়ে ভারতে ফেরেন ১৯৩০ সালে। সুভাষ বসু আর জওহরলালের নেহরুর সঙ্গে দেখা করেন। ১৯৩১ সালে ব্রিটিশ সরকার ওঁকে গ্রেফতার করে এবং ছয় বছরের কারাদণ্ড দেয়। জেল থেকে বেরোলে নেহরু ওঁকে কংগ্রেসে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু গান্ধীজীর সঙ্গে মতপার্থক্যের জন্যে উনি কংগ্রেস ত্যাগ করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মানী ও অক্ষশক্তি সম্পর্কে ওঁর মনোভাব ছিল স্পষ্ট - জার্মানী যুদ্ধে জিতলে গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটবে এবং ভারতের পক্ষে সেটা হবে সর্বনাশ। জীবনের শেষ দিকে মানবেন্দ্র নাথ রায় একটা নতুন রাজনৈতিক মতবাদ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেন – যাকে তিনি আখ্যা দেন ‘র্যা ডিক্যাল হিউম্যানিজম’। সমরেন রায় মানবেন্দ্র রায়ের একটি তথ্যপূর্ণ জীবনী লিখেছেন। আগ্রহী পাঠক সেটা পড়ে দেখতে পারেন।
ধনগোপাল মুখার্জী (১৮৮০ - ১৯৩৬): তারকনাথ দাস এবং মানবেন্দ্র রায়ের মত ধনগোপাল মুখার্জীকেও ভারতবর্ষ ছাড়তে হয়েছিল পুলিশী হয়রানি থেকে আত্মরক্ষা করতে। জন্মেছিলেন কলকাতার কাছে এক গ্রামে। পুলিশ দাদাকে ধরে নিয়ে আটকে রাখে কোনও বিচার ছাড়াই। পাছে ধনগোপালের ভাগ্যেও তাই ঘটে সেই ভয়ে পরিবারের লোকেরা তাঁকে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। প্রথমে জাপানে গিয়ে কিছুদিন কষ্টে কাটান, সেখান থেকে মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৯১০ সালে স্যান ফ্র্যান্সিস্কোতে এসে পৌঁছোন। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে ক্যাম্পাসে ছাত্র হিসেবে ঢোকেন। পড়াশুনোর টাকা জোগাড় করতে ছোটখাটো নানান কাজ করতে করতে আবিষ্কার করেন নিজের লেখার ক্ষমতা। ছোটদের গল্প লেখক হিসেবে শীঘ্রই স্বীকৃতি জুটে যায়। ১৯২৮ সালে ‘গে নেকঃ দ্য স্টরি অফ এ পিজিয়ন’ বইটি লেখার জন্যে বিশেষ সন্মাজনক পুরস্কার "জন নিউবেরি মেডেল" পান। এই মেডেলটি প্রতি বছর আমেরিকান লাইব্রেরি অ্যাসোসিয়েশনের লাইব্রেরি সার্ভিসেস অফ চিলড্রেন বিভাগ থেকে দেওয়া হয়। উনিই প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত লেখক যিনি ইংরেজিতে লিখে আমেরিকার একান্ত কাম্য এই সাহিত্য পুরস্কারটি লাভ করেন।
তিন বছর বার্কলেতে পড়াশুনো করার পর ধনগোপাল স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। ১৯১৪ সালে উনি মেটাফিজিক্স বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। অল্প কিছুদিন স্ট্যানফোর্ডে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপকের কাজ করেন। এরপর বেশ কয়েকটি বই উনি লেখেন। ১৯১৪ সালে গিরিশ ঘোষের একটা নাটককে ভিত্তি করে লেখেন ‘চিন্তামণি, এ সিম্বোলিক ড্রামা’। ১৯১৬ সালে লেখেন ‘লায়লা মজনু’, দুটি কাব্য সংকলন ‘রজনীঃ সংগস অফ দ্য নাইট’ (১৯১৬) এবং ‘সন্ধ্যাঃ সংস অফ টোয়াইলাইট’ (১৯১৭)। ১৯১৮ সালে যখন প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়, উনি ভারতে ফিরে আসেন এবং কয়েক বছর কাটান। দেশে এসে উনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, কিন্তু সেইসঙ্গে সাহিত্য-চর্চাও চলতে থাকে। ১৯২২ সালে ধনগোপাল আবার ছোটদের জন্যে লেখার দিকে মন দেন। ১৯২২ সালে প্রকাশিত ওঁর আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘কাস্ট এন্ড আউটকাস্ট’-কে অনেকের মতে ধনগোপালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা। ২০০২ সালে এই বইটির পুনর্মুদ্রণের সময়ে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস ভূমিকার এক জায়গায় লেখে “an exercise in both cultural translation and cultural critique”। ধনগোপালের জীবন ও কর্মে সম্পর্কে নতুন করে আগ্রহের সৃষ্টির মূলে এই বইটির অবদান যথেষ্ট। বইটির ভূমিকায় আরও ছিল - “In the first half of the book, Mukerji draws upon his early experiences as a Bengali Brahmin in India, hoping to convey to readers an intimate impression of eastern life; the second half describes Mukerji's coming to America and his experiences as a student, worker, and activist in California.” বইটির সমালোচনা করতে গিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে প্রকাশিত ইন্ডিয়া ওয়েস্ট পত্রিকা ধনগোপাল সম্পর্কে লিখেছে -: "A man who, through his writing, offered one of the earliest glimpses into the complexity of an educated immigrant's life in America. Through his observations and even through what he does not say, Mukerji at once lends his readers a sense of darkness and alienation, as well as great insight and literary skill.” শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনী অবলম্বনে লেখা ধনগোপালের আরেকটি বই ‘ফেস অফ সাইলেন্স’"-কে দ্য লিগ ইফ নেশনস ১৯২৬ সালে প্রকাশিত চল্লিশটি উল্লেখযোগ্য বইয়ের একটা হিসেবে বেছেছিল এবং জেনিভা-তে ইন্টারন্যাশেনাল লাইব্রেরিতে বইটির স্থান হয়েছিল। এম. এন. রায়ের জীবনী-তে লেখক সমরেন রায় লিখেছেন রোমা রোঁলা শ্রী রামকৃষ্ণ সম্পর্কে আগ্রহী হন ‘ফেস অফ সাইলেন্স’ ' বইটি পড়ে। পরে তিনি স্বয়ং ‘দ্য লাইফ অফ রামকৃষ্ণ’ এবং ‘দ্য লাইফ অফ বিবেকানান্দ এন্ড দ্য ইউনিভার্সাল গসপেল’ বই দুটি লেখেন।
নাটক, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও জীবনী নিয়ে দুই ডজনের বেশী বইয়ের লেখক ধন গোপাল ছিলেন একজন আদর্শবাদী। বঞ্চিত ও নিপীড়িত লোকদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ছিল প্রবল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির টানা-পোড়ানে তাঁর জীবন ছিল অস্থির। শেষের ছয়মাস মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় কাটিয়ে ১৯৩৬ সালে নিজের নিউ ইয়র্ক অ্যাপার্টমেণ্টে তিনি আত্মহত্যা করেন।
শৈলেন্দ্র নাথ ঘোষ ( ? -?): আরেকজন স্বদেশী যিনি তারকনাথ দাসের এবং এম, এন. রায়ে সঙ্গে কাজ করেছিলেন। উনি ঘাদার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯১৭ সালের হিন্দু-জার্মান কনস্পিরেসি মামলায় তারক নাথ দাস, অ্যাগনেস স্মেডলি, প্রমুখের সঙ্গে উনিও দোষী সাব্যস্ত হন। ওঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ভারতীয় বিপ্লবীদের হাতে জার্মান যুদ্ধাস্ত্র চোরা চালান করার। আমেরিকা যখন অভিযুক্তদের তাড়িয়ে দেবার কথা ভাবছে, তখন আইনি সহায়তার ব্যাপারে শৈলেন্দ্র নাথের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। শৈলেন্দ্র নাথের প্রতিষ্ঠিত ফ্রেন্ডস ওফ ফ্রিডম ফর ইন্ডিয়া (FFI) গড়ে উঠেছিল বহু শ্রমিক ইউনিয়ন ও উদার মতাবলম্বী লোকেদের সহায়তায়। তাঁদের লড়াই ছিল আমেরিকায় বসবাসকারী বিদেশীদের রাজনৈতিক অধিকারকে রক্ষা করা। ক্ষমতাশালী লোকদের কাছে গিয়ে ‘লবি’ করা বা বোঝানো এবং তাঁদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্যে জনমত গড়ে তুলতে FFI নানান ধরণের বই ও পুস্তিকা প্রকাশ করত। তার একটি ছিল – ‘ইন্ডিয়া’স ফ্রিডম ইন অ্যামেরিকান কোর্টস। এই পুস্তিকাটিতে যে সব ভারতীয় ও তাদের সহযোগীদের সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর জন্যে বিচার চলছে ও তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেবার কথা ভাবা হচ্ছে – সেটা যে আমেরিকার ‘নিউট্রালিটি’ বা নিরপেক্ষ থাকার আইনের পরিপন্থী সেটা স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়েছিল। পাঠকদের কাছে আবেদন করা হয়েছিল - তাঁরা যেন লেবার ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারির কাছে এই নির্বাসন করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন।
এক সময়ে শৈলেন্দ্র ঘোষকে বলা হত আমেরিকার আন-অফিশিয়াল কমিশন টু প্রমোট সেলফ গভার্ননেস ইন ইন্ডিয়া-র অধিকর্তা অর্থাৎ ভারতীয় স্বরাজের সপক্ষে আমেরিকার বেসরকারি কমিশনের কার্যাধ্যক্ষ। এই সময়ে (২৯শে নভেম্বর, ১৯২১)নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি নিবেদনের হেডিং ছিল – 'এস. এন. ঘোষ ভবিষ্যতবাণী করছেন ভারতে বিপ্লব আসছে'। সেখানে আরও বলা হয়েছিল: 'দেশী আন্দোলনকারীর বক্তব্য ব্রিটিশদের জাতীয় সংস্থাগুলোকে বেআইনি ঘোষণা করার প্রবণতা চলতে থাকলে, এটা ঘটবেই।'
এক সময়ে শৈলেন্দ্র ঘোষকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের আমেরিকা শাখার প্রধান করা হয়। দুর্ভাগ্যের কথা এঁর সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু এই প্রতিবেদকের চোখে পড়ে নি। দেশে কি করতেন, কবে জন্মেছিলেন, কোথায় মৃত্যু হয় – কোনটাই জানতে পারা যায় নি।
তারকনাথ ও শৈলেন্দ্রনাথের আরও কয়েকজন সহযোগীর কথা ঘাদার আন্দোলন ও অন্যান্য রাজনৈতিক প্রসঙ্গে এসেছে। এঁদের মধ্যে তিনজনের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে - রজনী কান্ত দাস (আমেরিকায় ও ভারতে ভারতীয় শ্রমিকদের নিয়ে কয়েকটি বইয়ের রচয়িতা), খগেন্দ্র চন্দ্র দাস এবং অধর চন্দ্র লস্কর (ক্যালিফোর্নিয়াতে সম্ভবত ১৯০৭ সালে ইন্ডিয়া ইন্ডিপেন্ডেন্স কমিটি-র স্থাপক)। এঁদের সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানা যায় না।
প্রফুল্ল চন্দ্র মুখার্জী ( ১৮৮৫ – ১৯৮২ )- ইনিও একজন জাতীয়তাবাদী ছিলেন। ছাত্র হিসেবে ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গে এসেছিলেন। পরে মেটালার্জির গবেষক হিসেবে বহু বছর ইউ এস স্টিল এবং ফিফথ স্টার্লিং স্টিল কোম্পানিতে কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে অবসর নিয়ে নিউ ইয়র্ক শহরে বাস করা শুরু করেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্ম-শতবার্ষিকী কমিটির তিনি ছিলেন এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি। ১৯৭১ সালে রামমোহনের দুশো বছর পূর্তি উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান হয়েছিল তাতেও তিনি বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। ওঁর স্ত্রী রোজ এখনও জীবিত এবং নানান প্রতিষ্ঠানে সং যুক্ত।
অন্য ধরণের রাজনৈতিক ভূমিকা
যেসব বাঙালী বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে এসেছিলেন – তাঁরা সবাই হিন্দু বুদ্ধিজীবী স্বদেশী ছিলেন না। কেউ কেউ ছিলেন উচ্চশিক্ষা-আকাঙ্ক্ষী ছাত্র, কেউ কেউ এসেছিলেন অধ্যাপনা বা গবেষণার কাজে। এছাড়া কিছু শ্রমজীবী মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকও এসেছিলেন। তাঁরা আমেরিকায় নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে আজীবন লড়াই করে গেছেন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন ইব্রাহিম চৌধুরী।
ইব্রাহিম চৌধুরী ( ? - ?) - ইব্রাহিম না বলে পরে নিজেকে আব্রাহাম বলে পরিচয় দিতেন। জন্মেছিলেন শ্রী-হট্টে (বর্তমানে বাংলাদেশের অংশ)। কোনও একটা কারণে পুলিশের চোখ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে জাহাজের সারং হয়ে আমেরিকা পাড়ি দেন। ১৯২০ সালের প্রথম দিকে উনি নিউ ইয়র্কে আসেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার পৃথিবীর বিভিন্ন বন্দরে ইংরেজ নাবিকদের জন্যে ক্লাব তৈরি করেছিল। নিউ ইয়র্কেও এরকম একটা ক্লাব ছিল। ক্লাবগুলোতে প্রবেশাধিকার ছিল শুধু ব্রিটিশ বাণিজ্য জাহাজের শ্বেতাঙ্গ নাবিকদের। চৌধুরী ব্রিটিশ কনসাল জেনারেলকে বুঝিয়ে নিউ ইয়র্কে একটা ইন্ডিয়ান সিমেন’স ক্লাব তৈরি করান। দেশী নাবিকদের প্রিয় এই ক্লাবে চৌধুরীর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভারত থেকে আসা নাবিকদের নানা ভাবে তিনি সাহায্য করতেন। এমন কি জাহাজ থেকে পালানো লস্কররাও ওঁর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হতেন না – তাঁদের ব্যক্তিগত ও আইনগত সমস্যা মেটাবার চেষ্টা করতেন। পরে চৌধুরী নিউ ইয়র্ক শহরের থিয়েটার অঞ্চলে ‘বেঙ্গল গার্ডেন’ নামে একটা রেস্টুরেন্ট খোলেন। বহু বাঙালী মুসলিম এখানে খেতে আসতেন এবং নানান রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মের এটা ছিল অন্যতম কেন্দ্রস্থল। চৌধুরী নিজে আমেরিকান সরকারকে বোঝাবার চেষ্টা করেন যেসব ভারতীয় এদেশে বসবাস করছে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হোক। ১৯৪৫ সালে উনি ইমিগ্রেশন এবং ন্যাচেরালাইজেশনের কংগ্রেস কমিটির কাছে একটি জোরদার চিঠিও পাঠান। ওঁর মূল লক্ষ ছিল আমেরিকার বাঙালী মুসলিমদের ন্যায্য দাবিগুলো যেন পূরণ করা হয়। শেষের দিকে ওঁর একাত্মতা পাকিস্তানের সঙ্গে হয়।
গবেষক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আগমন
স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুভাইরা আমেরিকা এবং ভারতের মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের দরজা খুলে দেবার পর বহু স্বদেশীর সঙ্গে পণ্ডিত ও ছাত্রদের আগমনও কম হয় নি। সিয়াটেল শহরে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনের এক রিপোর্ট অনুসারে ১৯০৮ থেকে ১৯১৫-র মধ্যে জনা কুড়ি হিন্দু ছাত্র সেখানে পড়তে আসে। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মুসলমান, যাঁকে ভুল করে হিন্দুদের দলে ঢোকানো হয়েছিল। এই কুড়ি জনের মধ্যে দশজন ছিল বাঙালী। এঁদের প্রত্যেকের নাম রিপোর্টে রয়েছে এবং কবে তাঁরা ক্লাসে যোগ দিয়েছিলেন সেই তথ্যও রয়েছে। এঁদের মধ্যে একজন অবশ্যই তারক নাথ দাস। অনুমান করা যেতে পারে ক্যালিফোর্নিয়ার অন্যান্য কলেজ ক্যাম্পাসে, যেমন বার্কলে, লস এঞ্জেলস, স্ট্যানফোর্ড ইত্যাদিতে কিছু বাঙালী পড়তে এসেছিলেন। কিন্তু সেই সংখ্যা সহজলভ্য নয়।
আমেরিকার পশ্চিম দিকের ইউনিভার্সিটিতে আসা বাঙালী ছাত্রদের পক্ষে সহজ ছিল, কারণ জাপান হয়ে সোজা আসা যেত। কিন্তু কিছু কিছু ছাত্র পুব-দিকের, এমনকি মধ্য-পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়তে এসেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৮৮-১৯৬১) পড়াশুনো করেছিলেন ইলিনয়ের আর্বানা শহরে – ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়-তে। কবিগুরু বিশ্বাস করতেন যে গ্রাম-ভারতের প্রয়োজন ছিল প্রযুক্তিবিদ ও ইঞ্জিনিয়ারদের – বুদ্ধিজীবী রাজনৈতিক তার্কিকদের নয়। ১৯০৬ থেকে ১৯০৯ পর্যন্ত থেকে পড়াশুনো শেষ করে রথীন্দ্রনাথ দেশে ফেরেন। শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতনে কবিগুরুর স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করার ব্যাপারে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। চার দশক শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। বিশ্বভারতীর তিনিই ছিলেন প্রথম উপাচার্য।
রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে আরও দুজন আমেরিকায় পড়তে এসেছিলেন – এঁরা হলেন নগেন গাঙ্গুলী ও সন্তোষ চন্দ্র মজুমদার। দেশে ফিরে পল্লী উন্নয়নের কাজে এঁরা যোগ দেবেন সেই উদ্দেশ্যেই রবীন্দ্রনাথ এঁদের বিদেশে পাঠিয়েছিলেন। সন্তোষ মুজমদার ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়ে পড়াশুনোর পর দেশে ফিরে প্রবল উদ্যমে শ্রীনিকেতনে পল্লি উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে যোগ দেন, কিন্তু অল্প বয়সেই ওঁর মৃত্যু হয়। নগেন গাঙ্গুলী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের কন্যা মীরা দেবীর স্বামী। ১৯২০ সালে ওঁদের ছাড়াছাড়ি হয়। যে উদ্দেশ্যে নগেন গাঙ্গুলীকে রবীন্দ্রনাথ পড়াতে পাঠিয়েছিলেন, সে উদ্দেশ্য সফল হয় নি।
রথীন্দ্রনাথ, নগেন গাঙ্গুলী ও সন্তোষ মজুমদারের মত বসন্ত কুমার রায়ও ( ?- ১৯৪৯ ) মধ্য-পশ্চিম আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন। ১৯১০ সালে উইসকনসিনের ম্যাডিসন শহরে ইউনিভার্সিটি অফ উইসকন্সিন-এ বি এ পাশ করেন এবং ঠিক করেন সাংবাদিকতা নিয়ে পড়বেন। তখন আমেরিকার সংবাদপত্রগুলো ভারতকে দেখত ব্রিটেনের দৃষ্টিভঙ্গিতে। ফলে যে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল সেটা উনি দূর করেছিলেন। ওঁর উদ্দেশ্য ছিল ভারতকে সঠিক আলোয় আমেরিকার কাছে আনা। এই চিন্তা থেকে উনি প্রথমে রবীন্দ্রনাথের লেখার সঙ্গে আমেরিকার পরিচয় ঘটানোর চেষ্টা শুরু করলেন। ওঁর প্রথম বই ‘রবীন্দ্রনাথ টেগোরঃ দ্য ম্যান এন্ড হিস পোয়েট্রি’ প্রকাশিত হল ১৯১৫ সালে – রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাবার দুবছর পরে। এটাই ইংরেজিতে লেখা রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনী। প্রচুর বিক্রি হয় বইটি। বসন্ত কুমারের জীবন সম্পর্কে লেখা একটা প্রবন্ধে রয়েছে: সমালোচকরা বইটাকে পছন্দ করলেন কারণ এটা একজন বাঙালীর লেখা যিনি মাতৃভাষায় রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন, অনুবাদের মাধ্যমে নয়। এরপর বসন্ত কুমার রবীন্দ্রনাথের ওপর আরও তিনটি বই লেখেন। ঐ একই প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছিল – ‘যাঁরা পাশ্চাত্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটিয়েছেন – তাঁদের তিনজনের একজন। অন্য দুজন হলেন ওয়াই বি ইয়েটস এবং এজরা পাউন্ড।’
বসন্ত কুমারের রবীন্দ্রনাথকে জনপ্রিয় করে তোলার এই প্রচেষ্টার কথা বন্ধুদের সূত্রে রবীন্দ্রনাথের কানেও পৌঁছোয়। রবীন্দ্রনাথ প্রথমে খুশি হলেও, সেই সন্তুষ্টি বেশীকাল স্থায়ী হয় নি। কারণ অজ্ঞাত। রবীন্দ্রনাথের অসন্তোষের কথা জানার পর, সাংবাদিক বসন্ত কুমার রবীন্দ্রনাথকে ছেড়ে দিয়ে ভারতে ব্রিটিশদের কুকীর্তির কথা পত্র পত্রিকায় প্রকাশ করতে থাকেন। নানান জায়গায় বক্তৃতা দিয়েও বেড়ান। পরে তারক নাথ দাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমেরিকায় ভারতীয় বসবাসকারীদের অধিকার নিয়েও লেখালেখি শুরু করেন।
অভিবাসী স্রোত মন্দীভূত
ভারতবর্ষ থেকে ছাত্র, গবেষক, স্বামীজীদের আসার মন্দা শুরু হয় ১৯২০ সাল থেকে। কেন? সে উত্তর স্পষ্ট নয়। প্রথম মহাযুদ্ধের ফলে অর্থনৈতিক সমস্যা হয়ত একটা কারণ। ১৯২৩ সালে আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালতের রায় – যার ফলে আমেরিকার নাগরিকত্ব ভারতীয়র পাবে না – সেটাও আর একটা কারণ হতে পারে। এ সত্বেও দুজন বাঙালীর কথা আমরা জানি যাঁরা বিংশ শতাব্দীর বিশ দশকে আমেরিকায় এসেছিলেন।
হরিদাস মজুমদার ( ১৯০০ - ?): ১৯২০ সালে উনি এসেছিলেন গান্ধীজীর বার্তা আমেরিকার লোকদের কাছে পৌঁছে দিতে। পড়াশুনো শুরু করেছিলেন কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে, কিন্তু স্নাতক হন নর্থ ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পান ইউনিভার্সিটি অফ উইসকনসিন থেকে। পাশ করার পর পরই উনি চাকরি পান ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে হেনরি মিলারের দপ্তরে। হেনরি মিলার হলেন বিখ্যাত মার্কিন লেখক – ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’, ‘ট্রপিক ক্যাপ্রিকর্ন’-এর রচয়িতা। ওঁদের দুজনের মধ্যে যে বন্ধুত্ব হয় - সেটা আজীবন ছিল। ১৯২৩ সালে হরিদাস মজুমদার ওঁর প্রথম বই ‘গান্ধী দ্য আপস্টলঃ হিস ট্রায়াল এন্ড হিস মেসেজ’ প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালে। গান্ধীর ওপর আরও বেশ কয়েক বই উনি লেখেন এবং অনেকে ওঁকে ভারত ও গান্ধীর প্রবক্তা আখ্যা দেন। ১৯২৯ সালে হরিদাস দেশে ফিরে যান এবং লবণ সত্যাগ্রহে যোগ দেন। কিন্তু মতিলাল নেহরুর বিশেষ ইচ্ছায় গান্ধীর বাণী প্রচারের জন্যে আবার আমেরিকায় ফিরে আসেন। আরকানসার লিটল রক শহরে উনি গান্ধী ইনস্টিট্যুট অফ আমেরিকা স্থাপন করেন। ১৯৪৭ সালে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে আয়ওয়া থেকে আমেরিকার কংগ্রেস-এ আসন পাবার জন্যে রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন চান। কিন্তু প্রাইমারীর ভোটেই হেরে যান – জাতীয় ইলেকশনে দাঁড়াবার সুযোগ আর পান নি।
১৯২০ সালে আরেকজন বাঙালী ননী গোপাল বোস ( ? - ?) আসেন। তাঁর সম্পর্কে আমরা যেটুকু জানি সেটা হল তাঁর বিখ্যাত পুত্র অধ্যাপক ও ব্যবসায়ী অমর গোপাল বোসের দৌলতে। অমর গোপাল হলেন বিখ্যাত বোস স্পিকার সিস্টেম-এর উদ্ভাবক। অমর গোপালের বয়ান থেকে এটুকু আমরা জানি যে ননী গোপাল এলিস আইল্যান্ডে মাত্র পাঁচ ডলার পকেটে নিয়ে এসেছিলেন। বেশ কষ্টের মধ্যে তিনি ফিলাডেলফিয়াতে আস্থানা নেন এবং একজন আমেরিকান শিক্ষয়িত্রীকে বিয়ে করেন। অমর গোপালের বয়ানে –
“ফিলাডেলফিয়ার শহরাঞ্চলে একটি ছোট্ট বাড়িতে আমরা থাকতাম। অনেক ভারতীয় এসে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস সেখানে কাটিয়ে যেতেন। বাড়িতে আমরা ভারতীয় খাবার খেতাম। বাবা-মা দুজনেই প্রাচীন ভারতের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতেন। বলতে গেলে ওটা ভারতীয় বাড়িই ছিল। কিন্তু সমস্যাও ছিল। বর্ণবিদ্বেষ তখন এত তীব্র যে একজন কালো চামড়ার লোককে সাদা চামড়ার সঙ্গে দেখলে রেস্টুরেন্টে খাবার দিত না। বাবা, মা আর আমি মাঝেমধ্যে চেষ্টা করতাম। আমরা বসে থাকতাম, কিন্তু খাবার আসত না। বাবা ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করত। বাবা ভাব দেখাতেন যে উনি আফ্রিকান আমেরিকান, কারণ বিদ্বেষটা মূলত: তাদের প্রতি, ভারতীয়দের প্রতি নয়। তখন উনি শান্তস্বরে বলতেন, ‘আমি দেখছি যে আমরা টাকা রোজগার করার ব্যাপারে উপযুক্ত, টাকা রোজগার করে খাবার কেনার ব্যাপারে উপযুক্ত, দেশের জন্যে যুদ্ধে জীবন দান করার ব্যাপারে উপযুক্ত। আমাকে কি একটু বুঝিয়ে বলবেন, কেন আমরা টাকা দিয়ে খেতে পাবার উপযুক্ত নই?’
যখন উনি শান্ত স্বরে এই কথাগুলো বলতেন, তখন সারা রেস্টুরেন্ট চুপ হয়ে গিয়ে শুনত। তারপর উনি মাকে বলতেন, ‘আমার মনে হয় আমাদের এখন যাবার সময় হয়েছে।’”
অমর গোপালের কাছে আমরা জানতে পারি যে ননী গোপাল ১৫ বছর ধরে ফিলাডেলফিয়া থেকে ওয়াশিংটিন ডি সি – নানান জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেন। ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচারের কথা লোকদের শোনাতেন... যা এক দিক থেকে নাৎসি জার্মানির মতোই।
১৯২০ সালে আগত আরেকজন অবশ্য উল্লেখ্য বাঙালী হলেন স্বামী যোগানন্দ গিরি ( ১৮৯৩ – ১৯৬২ ) । ইনি পরে পরমহংস যোগানন্দ নামে পরিচিত হন। স্বামী যোগানন্দের রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে কোনও যোগ ছিল না। ওনার জন্ম হয়েছিল উত্তর প্রদেশের গোরখপুরে; জন্মনাম মুকুন্দ লাল ঘোষ। ছেলেবেলা থেকেই ওঁর মন আধ্যাত্মিক দিকে ঝুঁকেছিল। বহু বছর গুরু্র খোঁজ করে শেষে স্বামী যুক্তেশ্বর গিরির শিষ্যত্ব নেন। তিনি মুকুন্দের নাম দেন যোগানন্দ। মাত্র ২৭ বছর বয়সে বস্টনে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশেনাল কংগ্রেস অফ রিলিজিয়াস লিবারেল-এর কাছ থেকে উনি আমন্ত্রণ পান। সেখানে এসে সায়েন্স অফ রিলিজিয়ন নিয়ে বক্তৃতা দেন। ঐ বছরই ক্যালিফোর্নিয়ার এনসিনাটাস শহরে সেলফ-রিয়্যালাইজেশন ফেলোশিপ প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্দেশ্য ভারতীয় আধ্যাত্মিক চিন্তা ও যোগের সঙ্গে ওঁর অনুগামীদের পরিচয় ঘটানো। ১৯৪৬ সাকে স্বামী যোগানন্দ ওঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় বই ‘আটোবায়োগ্রাফি অফ এ যোগী’ প্রকাশ করেন। ক্রিয়া যোগের ‘বিজ্ঞান’-এর সঙ্গে তিনি অনুগামীদের পরিচয় করান। স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকাবাসীদের শুধু অবহিত করেছিলেন যোগেশক্তির ক্ষমতা সম্পর্কে। স্বামী যোগানন্দ সারাজীবন ব্যয় করেছিলেন আমেরিকাবাসীদের যোগশিক্ষা দিতে এবং সেটিকে জনপ্রিয় করে তুলতে। উনি আরও বেশ কয়েকটি বই লেখেন। ওঁর সেলফ রিয়্যালাইজেশন ফেলোশিপ প্রতিষ্ঠান এখনো ওঁর বাণী প্রচার করে যাচ্ছে।
আমেরিকা সম্পর্কে নতুন আগ্রহ : ১৯৪৭ – ১৯৬৭
১৯২০ সালে যদিও বা কয়েকজন বাঙালী এসেছিলেন, ৩০ আর ৪০ দশকে তাদের সংখ্যা একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছল। ১৯২৩ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্টের ভারতীয়দের নাগরিকত্ব পাবার বিরুদ্ধে রায় এবং তারকনাথ দাস, এ কে মজুমদার, ভগৎ সিং প্রমুখের নাগরিকত্ব হারানোর সংবাদ নিশ্চয় অনেককে প্রভাবান্বিত করেছিল। তার ওপর আমেরিকার গ্রেট ডিপ্রেশনের সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এদেশে আসার পক্ষে যা মোটেই অনুকূল ছিল না। ১৯৪৬ সালে লুস-সেলার অ্যাক্ট-এ ভারতীয়দের নাগরিকত্ব পাবার অধিকার জন্মাল (যদিও সংখ্যাটা মাত্র ১০০-র মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল)। তারওপর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আমেরিকার জয় এবং অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত দিক থেকে ‘সুপার পাওয়ার’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ...ভারত থেকে ছাত্র শিক্ষক সবার মধ্যেই আমেরিকা আসার আগ্রহ বাড়ল। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হল। স্বাধীন ভারতীয় হিসেবে বিদেশ যাওয়াও সুবিধাজনক হল।
অমিয় চন্দ্র চক্রবর্তী ( ১৯০১ – ১৯৮৬ ): ১৯৪৮ সালে আমিয় চন্দ্র ওয়াশিংটন ডিসির হাওয়ার্ড ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে যোগ দিলেন। অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন কবি, বহু বছর রবীন্দ্রনাথের আপ্ত সহায়ক এবং বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি। ওঁর ডিফিল ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির। গান্ধীজীর সঙ্গে ওঁর গভীর যোগাযোগ ছিল। ১৯৫৩ সালে উনি বস্টনে ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিলেন তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে। সারা জীবন বহু সম্মান উনি পেয়েছেন – শিক্ষাজগতে ও দেশের কাজের জন্যে। ১৯৭০ সালে উনি পদ্মভূষণ সম্মান পান। শেষ জীবন দেশে ফিরে শান্তিনিকেতনে কাটান।
রাজ চন্দ্র বসু (১৯০১ -১৯৮৭) । ১৯৪৭ সালে দেশে এসে প্রথমে নিউ ইয়র্কের কলুম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পরে ইউনিভার্সিটি অফ নর্থ ক্যারোলিনার (চ্যাপেল হিল) স্ট্যাটিসটিক্স বিভাগে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। রাজ চন্দ্র কম্যুনিকেশনএর কোডিং থিওরি-তে অনেক অবদান রেখে গেছেন। ভুল-সংশোধনকারী BCH কোড-এর উনি অন্যতম উদ্ভাবক। স্ট্যাটিস্টিকসের ডিসাইন অফ এক্সপেরিমেন্ট শাখায় ওঁর উদ্ভাবিত অনেক কাজ এখনো ব্যবহৃত হয়।
রুস্তম রয় ( ১৯২৪ - ২০১০ ): ১৯৪৮ সালে সেরামিকস-এ পিএইচডি করেন পেনসিলভানিয়ার কলেজ পার্কে পেন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে। মেটিরিয়াল সায়েন্টিস্ট হিসেবে জগৎজোড়া খ্যাতি পান। ওর লেখা গবেষণ পত্রের সংখ্যা হাজারেরও বেশী। ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। ছেলেবেলাতে পাটনাতে বড় হবার সময়ে মহাত্মা গান্ধী ) ও অন্যান্য ভারতীয় নেতৃত্বের সংস্পর্শে আসেন। রয় বিশ্বাস করতেন ‘ইন্টিগ্রেটিভ সায়েন্স’-এ এবং বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে ওঁর জ্ঞান ছিল গভীর। শিক্ষক হিসেবে উনি শ্রদ্ধা কুড়িয়েছেন এবং অনেকেই ওঁকে 'নাগরিক বিজ্ঞানী' বলে সম্বোধন করতেন।
পঞ্চাশ দশকে উচ্চশিক্ষার জন্যে আমেরিকায় আসার সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে। এঁদের অনেকেই পড়াশুনোর শেষে এদেশেই থেকে যান এবং লেখক, অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী বা ব্যবসায়ী হিসেবে স্ব- স্ব-ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হন। সবাই অবশ্য পড়াশুনো করার জন্যে আসেন নি। শ্রীচিন্ময় ( ১৯৩১ – ২০০৭ ) ( চিন্ময় কুমার ঘোষ ) এদেশে আসেন ১৯৬৪ সালে। উদ্দেশ্য আধ্যাত্মিকতার প্রচার। ওঁর অনুগামীদের উনি বললেন, মনের শান্তি ও ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্ম হবার জন্যে সন্ন্যাসজীবন যাপন করার প্রয়োজন নেই – দরকার হল ধ্যান ও ব্যায়ামের। বাংলা ও ইংরেজিতে কবিতা ও গাথা গেঁথে, নানান জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে, প্রতি সপ্তাহে দুবার ইউনাইটেড নেশনসে প্রার্থনা মিটিং করার সুযোগ পাওয়ায় ওঁর অনুগামীদের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকল। সঙ্গীত জগতের বেশ কিছু লোকের, যেমন কার্লোস সান্তানা, জন ম্যাকলাফলিন এবং রবার্টা ব্ল্যাক-এর সঙ্গে ওঁর অন্তরঙ্গতা হয়েছিল। যৌবনে শ্রীচিন্ময় ছিলেন শ্রী অরবিন্দের অনুগামী। সেই শ্রীঅরবিন্দ, যিনি বিপ্লবের পথ ছেড়ে আধ্যাত্মিক জগত বেছে নিয়ে পণ্ডিচারীতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শ্রী অরবিন্দের মত শ্রীচিন্ময়ও বিশ্বাস করতেন শরীরের শক্তি ও দেহের সুস্থতা আধ্যাত্মিক জীবনের মতই প্রয়োজনীয়। নিউ ইয়র্কের কুইন্সে শ্রী চিন্ময়ের একটি প্রার্থনা সেন্টার এখনো আছে। তবে ওঁর দেহের শক্তি নিয়ে প্রচলিত গল্পগুলির সত্যতা নিয়ে পরে অবশ্য প্রশ্ন তোলা হয়েছে, শ্রীচিন্ময়ের কিছু অনুগামী নারী যৌনভাবে ওঁদের হেনস্থা করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন।
১৯৬৮ : অভিবাসনের আর এক নতুন অধ্যায়
এই লেখা শুরু হয়েছিল ১৮৯৩ সালে শিকাগোর পার্লামেন্ট অফ রিলিজিয়নে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা দিয়ে। বলা হয়েছিল সেটা ছিল অভিবাসনের একটা নতুন অধ্যায়। আমেরিকায় বাঙালী অভিবাসীদের আরেকটা নতুন অধ্যায় শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। সেই বছর প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন ইমিগ্রাশন এন্ড ন্যাশেনালিটি অ্যাক্ট অফ ১৯৬৫-তে সই করে সেটাকে আইন হিসেবে অনুমোদন দেন। এই আইনের জোরে আগে অশ্বেতকায় লোকদের আসার পথে যেসব বাধা আরোপ করা ছিল সেগুলো অন্তর্হিত হয়। আগে ভারতীয়দের অভিবাসের উদ্দেশ্যে আমেরিকাতে ঢুকতে দেওয়া হত না। এখন সেটা উঠে গেল। আমেরিকার অভিবাসন নীতির এই পরিবর্তনের ফলে বহু ভারতীয় ও বাংলাদেশী এদেশে আসার সুযোগ পেল। সেই আইনের দৌলতে এখন আমেরিকায় দু-লক্ষেরও বেশী অভিবাসী বাঙালীরা অভিবাসী।
মূল লেখাটি ইংরেজিতে Immigrant Bengali-তে প্রকাশিত হয়েছিল।
(সুজন দাশগুপ্তের সৌজন্যে)
REFERENCES
(1) Ramkrishnavedantamath.org
(2) “Photo Gallery/Monastic Disciples of Sri Ramakrishna”, Vedanta Society of St Louis
(3) “A.K. Mozumdar: Yesterday's Evangelist from India” by David H. Howard
(4) “New, Thinking, Agile and Patriotic: Hindu Students at the University of Washington,1908-1915”, Tarak Nath Das, University of Washington Libraries
(5) “M.N.Roy: A Political Biography”, by Samaren Roy, Orient Longman Limited, Hyderabad, India,1997
(6) “Dhan Gopal Mukerji”, Encyclopedia of World Biography
(7) “Caste and Outcast” by Dhan Gopal Mukerji, Stanford University Press, 2002 )
(8) “Across the Nation: Indian Freedom Fighters in the United States,” Indo-American Heritage Museum
(9) “India's Freedom in American Courts”, Friends of Freedom for India, New York
(10) “S.N. Ghose Predicts Revolution in India,” New York Times, Nov 29, 1921
(11) “Prafulla Mukherji, 97, Research Metallurgist”, New York Times, April 23, 1982
(12) “Bengali Harlem” by Vivek Bald, pp 180-188, Harvard University Press, Cambridge, MA, 2013
(13) ibid, pp 4-8
(14) “Hindu Students at the University of Washington, 1908-2015”, University of Washington Libraries (seehttp://www.lib.washington.edu/exhibits/southAsianStudents/students.html)
(15) “Rabindra Smaraka Grantha”, Nov 9, 2011, Unknown author
(16) “Basanta Koomar Roy – The First Indian-American Journalist,” Sudipta Bhawmik, NYNJBengali.com, April 12, 2012
(17) “When India Fights for England”, by Basanta Koomar Roy, The Independent, April 19, 1915 (for reprint, see)
(18) “Pacifists Rebel Against British Rule in India”, by Basanta Koomar Roy, The Pittsburg Press, Sept 11, 1921
(19) “Basanta Koomar Roy, A Lecturer with a Prophetic Message”, Promotional pamphlet
(20) “Colonial Displacements: National Longing and Identity among Early Indian Intellectuals in the United States”, by Paromita Biswas, PhD Dissertation, University of California, 2008
(21) “Haridas Muzumdar – Miller's Hindu Connection”, Cosmodemonic Telegraph Company: A Henry Miller Blog”, March 20, 2006
(22) “Gandhi Aide in G.O.P.”, New York Times, Feb 26, 1956
(23) “Amar Gopal Bose (1929-2013)”, July 13, 2013
লেখক পরিচিতি - ছেলেবেলা কেটেছে পুরী শহরে। খড়গপুর আই আই টি-র স্নাতক।
পার্ডিউ ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট করে কিছুদিন জেনারেল ইলেক্ট্রিক কোম্পানিতে কাজ করেছিলেন। পরে বিওসি- গ্রুপে যোগদান করেন এবং
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে ২০০০ সালে সেখান থেকে অবসর নেন। নিউ জার্সির 'আনন্দ মন্দির' প্রতিষ্ঠানের একজন সক্রিয় কর্মী এবং
ইমিগ্রেন্ট বেঙ্গলি.কম-এর প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম-সম্পাদক।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।