অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

জুন ১৫, ২০১৭

 

প্রবাসী ও রামানন্দ (১)

দীপক সেনগুপ্ত

     অন্য অনেক সাময়িকপত্র প্রকাশনার উদ্যম এবং তৎকালীন চাহিদা ও জনপ্রিয়তাকে সম্মান জানিয়েই বলা চলে প্রবাসী ও তার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সাময়িক পত্রের ইতিহাসে অবশ্যই একটি বিশিষ্ট স্থান দাবী করতে পারে। বিষয়বস্তুর বৈচিত্রে, বহু  প্রতিশ্রুতিবান লেখকের অংশগ্রহণে, অলঙ্করণে ও বর্ণময় চিত্রসজ্জায়, মননশীল রচনা প্রকাশনায়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সংবাদ ও প্রবন্ধ পরিবেশনায় সুদীর্ঘ প্রায় ষাট বছর ধরে উৎকর্ষ বজায় রেখে ‘প্রবাসী’ সাহিত্য জগতে তার পথ চলা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। ১৩৪৭ সালের ‘প্রবাসী’র লেখকগোষ্ঠির যে তালিকা (কিছুটা অসম্পূর্ণ ) প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা গেছে এই সংখ্যা ৩৫৪।  'প্রবাসী' প্রকাশিত হয় ১৩০৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে। ‘ভারতবর্ষ' ছিল সমসাময়িক অপর একটি জনপ্রিয় পত্রিকা ; প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২০-র আষাঢ় মাসে। বিভিন্ন বিভাগ পরিকল্পনায় ও বিষয়বস্তু নির্বাচনে ‘ভারতবর্ষে’ ‘প্রবাসী’র প্রভাব কষ্টকল্পিত নয়। দুটি পত্রিকার একই সঙ্গে সফল ভাবে পথ চলা তৎকালীন জনসাধারণের শিক্ষা, সাহিত্য ও জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতি অনুরাগ ও অনুসন্ধিৎসার পরিচয় বহন করে। ‘প্রবাসী'র অনন্যতার স্বীকৃতি দিয়ে এই পত্রিকা সম্বন্ধে একটু বিশদ আলোচনা করা হবে। সমসাময়িক বিদ্বজ্জন যারা পত্রিকার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত ছিলেন, তাদের লেখার অংশবিশেষ উদ্ধৃতি হিসাবে তুলে দেওয়া হয়েছে ; কারণ, তাদের লেখা পড়ে নিজের মন্তব্য করার থেকে সরাসরি তাদের লেখনী-নিসৃত বক্তব্য ও তথ্য বিষবস্তুর অন্তর্নিহিত ভাবকে অনেক সুস্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে বলে মনে হয়। ‘প্রবাসী’র বিভিন্ন বিভাগ ও অন্তর্ভুক্ত রচনার কিছু উদাহরণ দেওয়া হয়েছে প্রকাশিত রচনার বিষয় ও লেখকদের সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা করার জন্য। তবে যার নিরলস পরিশ্রম ও মনীষার অসামান্য সমন্বয়ে ‘প্রবাসী’র গতিপথ মসৃণ হয়েছিল সেই সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্বন্ধে দু'চার কথা জেনে নেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না।  

   রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়

     বাঁকুড়া শহরে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ বংশে রামানন্দের জন্ম হয় ১৮৬৫ সালের ২৮শে মে (৩১শে মে ? )। মা পুরসুন্দরী ছিলেন এক আদর্শ নারী এবং বাবা শ্রীনাথ চট্টোপাধ্যায় বাঁকুড়া জেলের জেলরের কাজ করতেন। শ্রীনাথ “ভট্টাচার্যকর্ম ও ভট্টাচার্য্য উপাধি ত্যাগ করে কুলোপাধি চট্টোপাধ্যায় ধরেন।" ৫/৬ বছর বয়সে রামানন্দের অক্ষর পরিচয় হয় তার সেজ জ্যাঠামশায়ের টোলে; পরে তিনি বাঁকুড়ার একটি বাংলা স্কুলে ভর্তি হন এবং ইতিহাস, ভূগোল, পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, জ্যামিতি, বীজগণিত ইত্যাদি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। তার মেধা ও স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। দশ বছর বয়সেই তিনি ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চার টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এর পর তিনি বাঁকুড়ার একটি ইংরাজী স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান লাভ করে কুড়ি টাকা বৃত্তি পান। প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেও সেখান থেকে পরীক্ষা দেওয়া হয় নি; পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে পরীক্ষা দিযে ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে ফার্স্ট আর্টস পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে চতুর্থ স্থান লাভ করেন। বি.এ. পড়বার জন্য তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেও অসুস্থতার জন্য পরীক্ষা দিতে পারেন নি। পরের বছর অর্থাৎ ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে সিটি কলেজ থেকে ইংরাজী অনার্স নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে বি.এ. পাশ করেন। ইতিমধ্যেই ১৮৮৬-র ডিসেম্বর মাসে মনোরমা দেবীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তখন তার আর্থিক সঙ্গতি হল সিটি কলেজ থেকে প্রাপ্ত চল্লিশ টাকার রিপণ স্কলারশিপ। এর পর তিনি সিটি কলেজেই অবৈতনিক হিসাবে কাজ শুরু করেন; পরে অবশ্য তিনি নিয়মিত বেতন পান। এলাহাবাদ নিবাসী জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ‘প্রবাসী’র জন্ম লগ্ন থেকেই প্রস্তুতিপর্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তার ভাষাতেই শোনা যাক - "সে আজ ৩১ বৎসরের কথা, ১৮৯৫ অব্দের ২১শে কি ২২শে সেপ্টেম্বর প্রবাসীর ভাবী জন্মদাতা ২৯ বৎসর বয়সে কলিকাতা সিটি কলেজ হইতে এলাহাবাদ কায়স্থ কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হইয়া এখানে আসিয়াছিলেন। প্রথমে তিনি কাটরা-নিবাসী বাবু কেদারনাথ মণ্ডলের গৃহে আসিয়া নামেন ও দিনকয়েক পরে ৬ই অক্টোবর মেয়ো রোডের দুই নম্বর বাড়ী ভাড়া করিয়া বাস করিতে থাকেন। বাড়িটি বাবু বাঁকে বিহারী লালের। ঐ বাড়ীতে রামানন্দবাবুর অনেক পরে স্বনামধন্য গণিতবিদ ডাঃ গণেশপ্রসাদ বিলাত হইতে ফিরিয়া বাস করিয়াছিলেন। এই বাড়ী ছাড়িয়া রামানন্দবাবু কর্নেলগঞ্জের দক্ষিণ মোড়ে পুলিশ ইন্স্পেক্টর হিন্দুস্থানী খৃষ্টীয়ান মিস্টার উইলিয়াম জেমসের বাড়ী ভাড়া করেন। ....যে সময়ের কথা হইতেছে সে-সময় এলাহাবাদে বাঙ্গালা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার দ্বিতীয় যুগ চলিতেছিল। অর্দ্ধ-শতাব্দী পূর্ব্বে ‘প্রয়াগ-দূত' নামক বাঙ্গালা সাপ্তাহিক পত্রের সম্পাদক স্বর্গীয় বাবু অবিনাশচন্দ্র মজুমদার, এংগ্লো-বেঙ্গলী স্কুলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা স্বর্গীয় বাবু শীতলচন্দ্র গুপ্ত, ‘অপচয় ও উন্নতি' প্রণেতা স্বর্গীয় বাবু বিষ্ণুচরণ মৈত্র এবং তাঁহাদের সমসাময়িক সাহিত্যানুরাগী কয়েকজন প্রবাসী বাঙ্গালী প্রথম যুগের প্রবর্ত্তন করিয়াছিলেন। ..... আমার বেশ মনে আছে, বান্ধব সমিতির এক অধিবেশন কর্ণেলগঞ্জে পুর হাউসের প্রশস্ত হলে হইয়াছিল। সেদিন আমি ‘জাতীয় সাহিত্য ও উন্নতি' নামক প্রবন্ধ পড়িয়াছিলাম। প্রবন্ধটি ছিল দীর্ঘ। .......সভা ভঙ্গ হইলে রামানন্দবাবু আমায় অভিনন্দিত করেন। সেই তাঁহার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ। তারপর কর্ণেলগঞ্জে বান্ধব সমিতির আর-এক অধিবেশনে আমরা তাঁহাকে সভাপতিত্বে বরণ করি। এই সময়ে তিনি 'দাসী' নামক মাসিক পত্রখানি সম্পাদন করিতেন। তাহার কিছুদিন পরে 'প্রদীপ' সম্পাদন করেন। আমার মনে পড়ে একদিন Scientific Instrument Company-র প্রবর্ত্তক আমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু বাবু (এক্ষণে রায় বাহাদুর )  বেণীমাধব মুখোপাধ্যায়ের সহিত রামানন্দ-বাবুর বাড়ী যাই। তখন তিনি জেমসের বাড়ীতে বাস করিতেছিলেন। সেদিন বেণীবাবু তাঁহার ‘রঞ্জেন আলোক’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ ‘দাসী’তে প্রকাশ করিবার জন্য দিয়া আসেন। তখন এক্সরে সংজ্ঞার তত প্রচলন হয় নাই। প্রবন্ধটি দাসীতে বাহির হইয়াছিল। 

     "রামানন্দবাবু কর্ণেলগঞ্জ হইতে ব্যারিষ্টার রোষনলালের বাড়ীর নিকট সাউথরোডের ২/১ নম্বর বাড়ীতে বাস করিতে থাকেন। এই বাড়ীতেই প্রবাসীর জন্ম হয়। ইহার এবং আশেপাশের কোন বাড়ীর এখন চিহ্ণ মাত্রও নাই। এই সময় আমি ইণ্ডিয়ান প্রেসের জন্য 'চরিত্রগঠন' নামে একটি পুস্তক লিখিয়াছিলাম। বইখানি 'প্রবাসী' বাহির হইবার এক বছর পরে বাহির হইয়াছিল। এবং রামানন্দবাবু তাহার প্রুফ সংশোধন করিয়া এবং ভূমিকা লিখিয়া দিয়াছিলেন। একদিন ইণ্ডিয়ান প্রেসের সত্ত্বাধিকারী মহাশয়ের নিকট বসিয়া আছি, এমন সময় রামানন্দবাবু কতকগুলি ছবি এবং কাগজপত্র লইয়া আসিলেন। সেদিন জানিলাম, তিনি শীঘ্রই একটি সচিত্র মাসিক পত্র বাহির করিবেন এবং আমাকেও তাহাতে লিখিতে হইবে। পত্রিকার নাম হইবে ‘প্রবাসী'। তারপর এখানকার পাবলিক লাইব্রেরীতে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ হইল। তিনি আমায় ‘প্রবাসী'র প্রথম সংখ্যায় রাণা কুম্ভের জয়স্তম্ভ ‘ক্ষীরোৎকুম্ভ’ সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ লিখিতে বলিলেন এবং Rousselet-এর বই হইতে ‘ক্ষীরোৎকুম্ভে’র চিত্রটি দেখাইয়া বলিলেন, এই চিত্রই প্রথম সংখ্যার পুরশ্চিত্র হইবে।"

উদ্ধৃটি একটু দীর্ঘ হল সন্দেহ নেই; কিন্তু এক শতাব্দীরও আগে কোনো সমসাময়িক ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট বিষয় প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনার ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। জ্ঞানেন্দ্রমোহনের রচনাটি প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছিল।    

বিলাতে উচ্চশিক্ষালাভের জন্য রামানন্দ স্টেট স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। আত্মীয় স্বজনের বহু অনুরোধ সত্বেও তিনি বিলাত যাত্রার লোভ ত্যাগ করে বৃত্তি প্রত্যাখ্যান করেন। এতে জড়িয়ে পড়লে তার দেশের সেবার কাজে ব্যাঘাত ঘটবে এই ভয় তার ছিল। সিটি কলেজের অধ্যাপক পদে তার বেতন ছিল মাসিক ১৪০ টাকা। এলাহাবাদের চাকরীতে তাকে দেবার প্রস্তাব হল ২৫০ টাকা। রামানন্দের শিক্ষক হেরম্বচন্দ্র মৈত্রেয় তার বেতন ২০০ টাকা করার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন, এই বেতন পেলে রামানন্দ এলাহাবাদে যেতেন না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেই অনুরোধ রক্ষা করেন নি। অতঃপর রামানন্দ এলাহাবাদে কায়স্থ কলেজের অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করেন।

     সঠিক ভাবে পরিচালিত একটি পত্রিকায় উপযুক্ত রচনা প্রকাশের মাধ্যমে গণচেতনার উন্মেষ ঘটানো এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে সংস্কার সাধনের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ছিল তার সঙ্কল্প। তিনি যেটা সঠিক মনে করতেন অকপটে সেটা প্রকাশ করতে তার ভয় বা দ্বিধা ছিল না। এজন্য তাকে শাসক শ্রেণীর রোষানলে পড়তে হয়েছে। রামানন্দ ‘ইণ্ডিয়া ইন বণ্ডেজ হার রাইট টু ফ্রিডম’ গ্রন্থের ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন ১৯২৮-এর ২১শে ডিসেম্বর। বইটি ভারতহিতৈষী জে.টি. স্যাণ্ডারল্যাণ্ডের লেখা। বইটি তে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পক্ষে মত প্রকাশ করা হয়েছে। মুদ্রাকর ও প্রকাশক ছাড়াও রাজদ্রোহের অপরাধে রামানন্দকে গ্রেপ্তার করা হয় ১৯২৯ খৃষ্টাব্দের ৬ই জুন। জরিমানা দিয়ে তিনি মুক্ত হন। রামানন্দের স্বদেশ প্রেম ছিল প্রশ্নাতীত। পরাধীনতার গ্লানি তাকে প্রতিনিয়তই পীড়িত করত। এজন্যই ‘প্রবাসী’র মুখবাণীতে মুদ্রিত হযেছিল গোবিন্দচন্দ্র রায়ের কবিতা -

"নিজ বাসভূমে পরবাসী হলে
পর-দাস-খতে সমুদায় দিলে।
পর দীপমালা নগরে নগরে।
তুমি যে তিমিরে সে তিমিরে।"

বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র রামানন্দ প্রায় কুড়ি বছর শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ কারণে শিক্ষা ব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট আইন-কানুন সম্বন্ধে তিনি যথেষ্ট অবহিত ছিলেন। শিক্ষা বিষয়ক বহু রচনা ‘প্রবাসী’তে স্থান পেয়েছে। এক সময়ে তিনি ছিলেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো ও ম্যাকডোনাল্ড শিক্ষা কমিটির সদস্য। ছাত্র ও যুবসমাজের রামানন্দ ছিলেন প্রকৃতই কল্যানকামী। ব্রাহ্মনেতা শিবনাথ শাস্ত্রী ও আনন্দমোহন বসু প্রমুখ মিলে সেকালে ছাত্রদের জন্য 'ছাত্রসমাজ' গঠন করেন। সে সময়ে ছাত্রসমাজে বহু বিখ্যাত ব্যক্তি বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা করে যুবছাত্রদের নৈতিক চরিত্র গঠন, ধর্ম ও জ্ঞান লাভে সহায়তা করতেন। ১৯০৯, ১৯১২ ও ১৯১৩ খৃষ্টাব্দে রামানদ ছাত্রসমাজের সভাপতিত্ব করেন। 

নারী জাতির উন্নতি কামনা ছিল তার আর একটি ব্রত। তিনি 'প্রবাসী'তে লিখেছেন -

"স্ত্রী-শিক্ষার একান্ত আবশ্যিকতা এখন আর নূতন করিয়া প্রমাণ করিবার প্রয়োজন নাই। ..... যে সকল মহিলা অল্প লেখাপড়া জানেন, তাহারাও অপরকে পড়িতে ও লিখিতে শিখাইয়া দিতে পারেন। অল্পশিক্ষিতা বা অধিক শিক্ষিতা প্রত্যেক মহিলা বিদ্যা দানকে একটি ব্রত বলিয়া গ্রহণ করিলে অল্প সময়ের মধ্যে নিরক্ষর স্ত্রীলোকের সংখ্যায় অনেক হ্রাস হইতে পারে।"

দেশী জিনিস ব্যবহার করা, দেশে কলকারখানা গড়ে তোলা ও উৎপাদন বৃদ্ধি করার প্রয়োজনীয়তাও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। এ সম্বন্ধে বহু রচনা 'প্রবাসী'তে প্রকাশিত হয়েছে। রামানন্দ শুধু সাহিত্য সেবক ছিলেন তা নয়, পাঠকদের তিনি বিজ্ঞান মনস্ক করে তোলার প্রচেষ্টায় 'দেশ বিদেশের কথা','বিবিধ প্রসঙ্গ' ইত্যাদি বিভাগে এবং অন্যত্র বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আবিষ্কার সম্বন্ধে বিশেষজ্ঞদের রচিত বিবিধ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন।

     রাজনীতির প্রশ্নে রামানন্দ ভারতীয় কংগ্রেসের সব নীতির সঙ্গে একমত না হলেও সাধারণভাবে তিনি কংগ্রেসের কর্ম পরিকল্পনার সমর্থক ছিলেন। গান্ধীজীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখলেও সত্যাগ্রহ, অসহযোগ, আইন অমান্য আন্দোলন বিষয়ে তিনি সহমত পোষণ করতেন না। বাস্তববাদী রামানন্দ লিখেছেন - "গান্ধী মহাশয় এক বৎসরে স্বরাজ পাইবার আশা করেন। তাহা অপেক্ষাও উৎসাহী আশাশীল কেহ-বা ছয় মাস কেহ বা ছয় দিনে পাইবার আশা রাখেন। ইহাদিগকে স্মরণ করাইতেছি যে, কোন জাতি সশস্ত্র যুদ্ধ করিয়াও এক বৎসরে স্বাধীনতা লাভ করিতে পারিয়াছে, তাহার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নাই। ভারতবর্ষের মত এতবড় একটা সম্পত্তি, সামান্য রকমের সৌখীন সহযোগিতা বর্জন হেতু ইংরেজ ছাড়িয়া দিবে ইহা দুরাশা মাত্র।" ১৮৯৯ খৃষ্টাব্দে মাদ্রাসে কংগ্রেস অধিবেশনে তিনি যোগ দেন। বেশ কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনে তিনি এলাহাবাদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। প্রত্যক্ষ রাজনীতি না করলেও রামানন্দ ছিলেন দার্শনিক ও দূরদর্শী। ১৩১৫ বঙ্গাব্দের 'প্রবাসী'তে তিনি লিখেছেন, - "সভ্য জগতে স্বাধীনতা রক্ষা বা লাভের জন্য যুদ্ধে নরহত্যা বৈধ বলিয়া পরিগণিত। ইহা অপেক্ষাও উচ্চতর আদর্শ সম্পূর্ণ অহিংসামূলক আদর্শ, ভবিষ্যতে মানবসমাজে গৃহীত হইবে বলিয়া বিশ্বাস করি।" এ লেখা যখন তিনি লিখেছেন, তখনও গান্ধীজীর অহিংসা নীতির সূচনা হয় নি।     

নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির রামানন্দ ছিলেন সমালোচনার ব্যাপারে অত্যন্ত আপোষহীন ও কঠোর। কোন কোন বিষযে গান্ধীজী, সুভাষচন্দ্র, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি স্বনামধন্য ব্যক্তিরও সমালোচনা করতে তিনি ছাড়েন নি। রামানন্দ ছিলেন রামমোহন রায়ের একান্ত গুণমুগ্ধ এবং ভক্ত। রামমোহনকে প্রশংসা করে বহু লেখা তিনি ছেপেছেন। একবার ইতিহাসবিদ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পুরাণো কাগজপত্র ঘেঁটে তিনি কিছু তথ্য বের করে আনলেন - যেমন রামমোহনের হিন্দু পত্নীর সঙ্গে মুসলমান পত্নী এবং পুত্র ছিল ইত্যাদি - তখন সত্যনিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে সে সব লেখাও তিনি ছেপেছেন। ব্রজেন্দ্রনাথ ছিলেন 'প্রবাসী’রই কর্মচারী। কিন্তু রামানন্দ নিরপেক্ষভাবে তার সাংবাদিকের কর্তব্য করেছেন, প্রয়োজনে বিরুদ্ধ বক্তব্য খণ্ডনে যুক্তিসহ বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। 'প্রবাসী' ১৩৪০ ফাল্গুন সংখ্যায় তিনি লিখেছেন রামমোহন রায়কে যাঁরা ভক্তি করেন, তাঁরা এরূপ কখনও আশা করতে পারেন না, যে, তাঁহার সমালোচনা হইবে না। তাঁহার সত্যপ্রিয় ভক্তেরা কখনও এরূপ আশা বা অভিলাষ করেন নাই ; কেহ কেহ নিজেই তাঁহার সমালোচনা করিয়াছেন। তাঁহারা ইহাই চান যে, তাঁহার বিরুদ্ধে যাহা কিছু বলিবার আছে সকলই বলা হউক এবং পরীক্ষিত হউক; তাহার ফলে সত্য যাহা তাহাই প্রতিষ্ঠিত ও গৃহীত হউক। তাহাতে রামমোহনের মহত্বের হ্রাস হইবে না।" পক্ষপাতহীন যুক্তিনিষ্ঠ সত্যাশ্রয়ী রামানন্দ এই গুণাবলীর জন্যই ছিলেন বহু লোকের শ্রদ্ধার পাত্র। সাংবাদিক হিসাবে তার অপর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্যে কোন ঘটনাকে নিরপেক্ষ ভাবে বিশ্লেষণ করতেন। 

     রামকৃষ্ণদেব সম্বন্ধে রামানন্দের মনোভাব ১৩৪২-এর ‘প্রবাসী’ মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত রচনার কযেক পংক্তিতেই সুস্পষ্ট –“রামকৃষ্ণ যে ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, ইহা ভারতবর্ষের পরম গৌরব। হিন্দু জাতির এবং ভারতবর্ষের নিন্দুকেরা যাহাই বলুক,এ দেশে যে আধুনিক যুগেও মহাপুরুষেরা আবির্ভূত হন, তাহাতেই প্রমাণ হয় যে,ভারতবর্ষ অধম দেশ নহে।" ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী রামানন্দের পক্ষে আপাতভাবে পৌত্তলিক রামকৃষ্ণদেবের প্রশংসা তার নিরপেক্ষভাবে স্বপ্রতিষ্ঠিত যুক্তির উপর নির্ভরশীলতারই পরিচায়ক।    

  রামানন্দ ছিলেন সেবাব্রতী। মূলতঃ লেখনীর দ্বারাই জ্ঞানভাণ্ডারকে পাঠকশ্রেণীর নিকট উন্মুক্ত করে তাদের চেতনাবোধ উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াসে সচেষ্ট ছিলেন তিনি। এটিও এক অর্থে সেবা।  কিন্তু তিনি যে শুধু সাহিত্যসেবী ছিলেন তা নয়। প্রবাসীতে নেপাল চন্দ্র রায় লিখেছেন – “এলাহাবাদ শহরে যখন প্লেগের দুরন্ত প্রকোপ, চারিপাশে মৃত্যুর দারুণ বিভীষিকা,তাহার মধ্যে রামানন্দবাবু কিছুমাত্র ভীত হন নাই। তখন তাহার পার্শ্বে ছিলেন সেবাব্রতী ইন্দুভূষণ রায়। ......  এই দুরন্ত রোগে নিউ সেন্ট্রাল কলেজের অঙ্কশাস্ত্রের অধ্যাপক উমেশচন্দ্র ঘোষের পত্নীর মৃত্যু হয়। তখন ইন্দুভূষণ ও রামানন্দবাবুই উমেশবাবুর প্রধান সহায় হন। তাঁহার মৃত পত্নীর সৎকারের পর তিনি সপরিবারে রামানন্দবাবুর আতিথ্য গ্রহণ করেন।" নিজের সম্বন্ধে রামানন্দবাবু বলেছেন – “ ব্রাহ্মণত্ব বা ক্ষত্রিয়ত্বের দাবী আমি করি না। বড় জোর আমি শূদ্র। সেবাই আমার কাজ। তাই দাসাশ্রমের কাজ লইয়াছিলাম। ‘দাসী’ পত্রিকা চালনার যে কাজ সেই কাজই আমাকে মানায়।" দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে একবার রামানন্দকে বলেছিলেন –“ বিরাট পুরুষের চারি অঙ্গে চারি বর্ণের মূলাধার। আপনার মধ্যেও তেমনি ব্রাহ্মণের মনীষা, ক্ষত্রিয়ের নির্ভীক সাধনা, বৈশ্যের জ্ঞানভাণ্ডার ও শূদ্রের ঐকান্তিক সেবা আছে। আপনি সেই হিসাবে পরিপূর্ণ মানুষ। শুধু ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় হইলে এমন পরিপূর্ণতা হইত না।”

     রামানন্দের জীবনযাত্রা ছিল সাধারণ ধরণের। কোন আতিশয্য বা জাঁকজমক তাতে ছিল না। তার দুই কন্যা শান্তা দেবী ও সীতা দেবী লেখিকা হিসাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছেন – “ রামানন্দবাবু ও তাহার কন্যাগণ খুবই সহজভাবে জীবন যাপন করিতেন। অনেক সময়ে চাকরের অভাবে কাজকর্ম্ম সবই নিজেরা সারিতেন।”  ১৯১৭ সালের ৮ই পৌষ মধ্যাহ্ণে আহারান্তে কবিগুরু রামানন্দবাবুকে বলিতেছিলেন -

“ এইরূপ সহজভাবে শিক্ষালাভ করাই ছিল ভারতের আদর্শ। আমাদের দেশে আলো-বাতাসের মত জ্ঞানও ছিল সর্ব্বসাধারণের সাধারণ ধন। তাহা গুরুর কাছে পয়সা দিয়া কিনিতে হইত না। শিষ্যের কাছে পয়সা লইয়া তাহা বেচাও চলিত না। ছেলেদের পড়ার ব্যয় পিতা বা অভিভাবককে বহন করিতে হইত না। ছাত্ররা সব ব্রহ্মচারী। যেখানেই সে দাঁড়াইয়া অন্ন চাহিবে সেখানেই তাহার জন্য অন্ন আছে। অর্থাৎ সমস্ত সমাজের হইয়া সে জ্ঞানের সাধনা করিতেছে। জ্ঞান যে ছিল তখন সবারই ধন।” 

     রবীন্দ্রনাথ ও রামানন্দ ছিলেন পরস্পরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল। 'প্রবাসী'র প্রাণপুরুষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেও রামানন্দ এক সমযে মান, অভিমান ও ক্ষোভের জটিল চক্রে জড়িয়ে পড়েন। এর জন্য রামানন্দ-পুত্র অশোক কুমার চট্টোপাধ্যায়ের যৌবন-সুলভ উচ্ছ্বাস-প্রসূত বিতর্কিত মন্তব্যও কিছুটা দায়ী; তবে অন্য কারণও ছিল। ‘অতিঘনিষ্ঠতা বিদ্বেষের জন্ম দেয়’ নীতি অনুযায়ী রামানন্দের এক সময়ে মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে তার শ্রদ্ধা ও স্বীকৃতির উপযুক্ত প্রতিদান তিনি পাচ্ছেন না; রবীন্দ্রনাথ যেন ‘প্রবাসী’কে উপেক্ষা ও বঞ্চিত করে ‘বিচিত্রা’য় লেখা প্রকাশ করছেন। ১৩৩৪-এর ১৫ই আষাঢ় রবীন্দ্রনাথকে লেখা তার চিঠিতে এই মর্মযন্ত্রণা ফুটে উঠেছে – “অনেকদিন আগে আমি আপনাকে একটা উপন্যাস লিখিতে অনুরোধ করিয়াছিলাম। তখন আপনার ইচ্ছা হয় নাই। .... তাহার পর নানা কারণে আপনার ইচ্ছা হওয়ায় আপনি বিচিত্রার জন্য উপন্যাস লিখিতেছেন।" রবীন্দ্রনাথেরও আর্থিক অবস্থা সুখকর কিছু ছিল না। তিনি নিজেই জানিয়েছেন যে তাকে লিখে উপার্জন করতে হয়। এই অবস্থায় ‘বিচিত্রা’র আর্থিক আনুকূল্য যে যথেষ্ট আকর্ষণীয় ছিল সেটা ‘বিচিত্রা’র সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘স্মৃতিকথা’য় জানিয়েছেন - "তিন পুরুষ উপন্যাস (যার নাম পরিবর্তিত হয়ে পরে ‘যোগাযোগ’ হযেছিল ) রবীন্দ্রনাথ আমাদের অনুরোধে লিখেছিলেন। 'নটরাজ' কিন্তু স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই লিখেছিলেন। একটি সমসাময়ক মাসিক পত্রিকার কর্ত্তৃপক্ষ সেটি অধিকার করার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। ৬০০ টাকা পর্যন্ত পারিশ্রমিক দেবার প্রস্তাব করে তাঁরা ইতস্তত করছিলেন অবগত হয়ে আমরা একেবারে এক সহস্র টাকার একখানি চেক নিয়ে গিয়ে ‘নটরাজ’ হস্তগত করি। ‘যোগাযোগ’ উপন্যাস ‘বিচিত্রা’য় প্রকাশ করার জন্য আমরা রবীন্দ্রনাথকে তিন সহস্র টাকা দক্ষিণা দিয়াছিলাম। এই দক্ষিণা প্রসঙ্গে একদিন তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন “ তোমাদের দেওয়া এই দক্ষিণা দেশের পক্ষে decent।”  শুধু ‘বিচিত্রা’ই নয়। ‘বসুমতী’তে ‘নটীর পূজা’ ৬০০ টাকার বিনিময়ে দেওয়া হযেছে। রামানন্দর কাছে ‘বসুমতী’ ছিল ‘নটী’ পত্রিকা। তাই ‘নটীর পূজা’ ‘বসুমতী’কে দেওয়াকে তিনি ‘নটীর পুরস্কার’ বলে একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। রামানন্দর ক্ষোভ এতটাই তীব্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে তিনি রবীন্দ্রনাথকে জানিয়েছেন “ আপনার নিকট আমার বিনীত প্রার্থনা এই যে, আপনি অতঃপর আমাকে বাংলা বা ইংরাজী কোন লেখা দিবেন না।”  তবে সুখের বিষয় এই মানসিক ব্যবধান দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় নি। রামানন্দই রবীন্দ্রনাথকে লিখেছেন "আমি মানসিক অশান্তিতে আছি ; ....  আপনার আশীর্ব্বাদ ও স্নেহ চাহিতেছি।" রবীন্দ্রনাথ ‘শেষের কবিতা’ ‘প্রবাসী’তে পাঠান। সেটা ছাপান হয়। তবে অনেকেই মনে করেন, আর্থিক প্রসঙ্গ ছাড়াও অন্য কারণও ছিল। রবীন্দ্রনাথের মত মুক্তমনা ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ “রবীন্দ্রনাথ কেবল প্রবাসীরই” এই অপবাদ ঘোচাতে হয় ত অন্য পত্রিকায় লেখা ছাপিয়েছেন।    

সামান্য কিছু ‘ভুল বোঝাবুঝি’ বাদ দিয়ে ‘প্রবাসী’র সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।  ১৩১৩-তে ‘বঙ্গদর্শন’-এর সম্পাদক পদ ত্যাগ করার পরে ১৩১৪ থেকে রবীন্দ্রনাথ ‘প্রবাসী’তে লেখা প্রকাশ করতে শুরু করেন। ১৩১৪ বঙ্গাব্দে আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে তিনি ‘মাষ্টার মহাশয়’ গল্প লেখেন, শ্রাবণেই প্রকাশিত হয় তার আর একটি প্রবন্ধ ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’। ১৩২৪-এ ‘প্রবাসী’তে তিনি লেখেন নি, তখন তিনি ‘সবুজপত্র’ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।

     ১৯১১ বঙ্গাব্দে রামানন্দ প্রথম শান্তিনিকেতন যান। সেখানে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত। ১৯১৩ খৃষ্টাব্দের ২৩শে নভেম্বর কবির নোবেল পুরস্কার লাভ করা উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে যখন সম্বর্ধনা সভা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে রামানন্দও উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ যখন কলকাতায় আসতেন,রামানন্দর কর্নওয়ালিস ষ্ট্রীটের বাড়ীতে গিয়ে দেখা করতেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে রামানন্দ বেশ কিছুদিন বাস করার ইচ্ছা নিয়ে শান্তিনিকেতনে যান এবং তখন দুজনের বহু বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। 
   

রবীন্দ্রনাথ যখন মৃত্যুশয্যায়, সংজ্ঞাহীন তখন রামানন্দ তার পাশে দাঁড়িয়ে উপাসনা করেন। ১৩৪৮-এর ‘প্রবাসী’র ভাদ্র সংখ্যায় ‘বিবিধ প্রসঙ্গে’ টেনিসনের কবিতার উল্লেখ করে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চির-বিচ্ছেদকে তিনি ‘বন্ধুবিয়োগ ও বৈধব্য’ নামে চিহ্ণিত করেছেন। ঐ সংখ্যাতেই তিনি লিখেছেন –“ আকাঙ্ক্ষা ছিল কবির আগেই আমার মৃত্যু হবে। রবীন্দ্রবিহীন জগতের কল্পনা কখনও করি নাই। ভাবি নাই রবীন্দ্রবিহীন জগত দেখতে হবে। চোখ কান যাই বলুক,বিশ্বাস হচ্ছে না তিনি নাই। এখনো মনে হচ্ছে শান্তিনিকেতনে গেলেই আবার তার বার্দ্ধক্যের শুচিশুভ্র রূপ দেখতে পাব যার ভিতর দিয়ে তাঁর অন্তরের অনুপম শ্রী বিচ্ছুরিত হোতো।"
ক্ষিতিমোহন সেন লিখেছেন - "ভারতের প্রাচীন শাস্ত্র ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁহার (রামানন্দর) গভীর শ্রদ্ধা ছিল অথচ তিনি একজন খুবই যুক্তিবাদী (rational) মানুষ ছিলেন। জাতিপংক্তি তিনি মানিতেন না। তিনি মনে করিতেন জাতিপংক্তি প্রাচীন ভারতীয সংস্কৃতির বড় কথা নহে, এইজন্য পঞ্চনদ প্রদেশের ‘জাতপাত তোড়কের দল’ তাহাকে সভাপতি করেন। ................

"এই বলিষ্ঠ স্বদেশানুরাগের জন্যই ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে তাঁহার গভীর একটি যোগ ঘটিল। ঠিক সাল আমার মনে নাই, বোধ হয ১৯০৬ সালে ভগিনী নিবেদিতা কিছুদিন কাশী তিলভাণ্ডেশ্বরে একটি বাড়ীতে বাস করেন। তিনি একদিন রামান্দবাবুর 'প্রবাসী'র প্রচুর প্রশংসা করিলেন। ভগিনী নিবেদিতা কেমন করিয়া 'প্রবাসী'র প্রশংসা করিলেন ইহাই ভাবিতেছিলাম, কারণ 'প্রবাসী' ত বাংলা কাগজ।  তবু দেখিলাম 'প্রবাসী'র সব মতামত, সব খোঁজ-খবর তিনি রাখেন এবং রামানন্দবাবুর মহত্ব সম্বন্ধে তিনি বেশ সচেতন। ভগিনী নিবেদিতা একদিন কথা-প্রসঙ্গে বলিলেন -"এই যে ব্যক্তিটি বাংলা ভাষায় বাংলার সুখ-দুঃখের কথা লইয়াই ব্যস্ত আছেন, এমন এক দিন আসিবে যখন তিনি সারা ভারতের বেদনা প্রকাশের ভার লইবেন। বিধাতা তাঁকে সেই যোগ্যতা দিয়াছেন এবং বিধাতার এতখানি দান কখনও ব্যর্থ হইবে না। ইঁহার মনীষা ইঁহার চরিত্র একদিন আরও প্রশস্ততর সাধনাক্ষেত্র খুঁজিবেই খুঁজিবে।" 

'প্রবাসী'তে বিধুশেখর ভট্টাচার্য্য লিখেছেন -

"এখানে আমরা আর একটি কথা বলিতে পারি। জেনিভায় লীগ অফ নেশনস-এর এক বিশেষ অধিবেশনে নানা দেশের প্রতিনিধি নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। ভারতবর্ষে নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন রামানন্দবাবু। লীগ প্রতিনিধিগণকে পাথেয় দিয়াছিলেন। কিন্তু রামানন্দবাবু ইহা এই আশঙ্কায প্রত্যাখ্যান করেন যে, পাছে তাহা নিলে লীগের কার্যকলাপ সম্বন্ধে তাঁহার স্বাধীন অভিপ্রায় অন্যরূপ হইযা পড়ে। ইহা তিনি নিজেই আমাকে বলিয়াছিলেন।"

লীগ অফ্‌ নেশন্‌সের অধিবেশনে যোগদানের জন্য রামানন্দ যাত্রা করেন ১৯২৬-এর ১লা আগস্ট। জার্ম্মানি, ফ্রান্স, ইংল্যাণ্ড, চেকোশ্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া ও ইটালী হযে ৪/৫ মাস বাদে তিনি ফিরে আসেন। জেনিভায় রোমা রঁল্যা তাঁকে নিমন্ত্রণ করেন। রামানন্দকে দেখে রঁল্যা বলেছিলেন, "ইঁহাকে দেখিলে টলস্টয়ের কথা মনে হয়।" রামানন্দের সুযোগ্যা কন্যা শান্তা দেবী লিখেছেন - "পিতৃদেব বলিতেন, ‘সম্পাদক হইতে হইলে jack of all trades and master of at least one হইতে হয।' তিনি যদিও 'jack of all trades'  বলিতেন, কিন্তু বাস্তবিক বহুবিদ্যা ও অগাধ জ্ঞানভাণ্ডার তাঁহার যেন করতলে ছিল। তিনি যাহা লিখিতেন বা বলিতেন অনেকে তাহা অভ্রান্ত মনে করিতেন।" বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতাকামী সংস্কারক ও উদারপন্থী রামানন্দ হিংসাত্মক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পক্ষে না দাঁড়ালেও অসহযোগ আন্দোলনকে কিন্তু সমর্থন করেছিলেন।

     পাক্ষিক 'ধর্ম্মবন্ধু' প্রকাশিত হয় আশ্বিন ১২৮৮-তে। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে এটি মাসিকে পরিবর্তিত হয; ১৮৯০-তে সম্পাদক হন রামানদ। 'দাসী' প্রকাশিত হয আষাঢ় ১২৯৯ বঙ্গাব্দে (১৮৯২ খৃষ্টাব্দ), সম্পাদক রামানন্দ। 'কায়স্থ সমাচার' (ইংরাজী) পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন রামানন্দ ১৮৯৯-এর জুলাই থেকে ১৯০০-এর জুন অবধি। এলাহাবাদ থেকে 'কায়স্থ সমাচার' প্রথমে প্রকাশিত হত উর্দূ ভাষায় ; পরে নাম পরিবর্তিত হয়ে হয 'হিন্দুস্থান রিভিউ'। ইংরাজী 'কাযস্থ সমাচার' বের করেছিলেন রামানন্দ। বি.এ. পরীক্ষায তার অসাধারণ কৃতিত্বে মুগ্ধ হযে তার অধ্যাপক হেরম্বচন্দ্র মৈত্র তাকে সাধারন ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ‘ইণ্ডিয়ান মেসেঞ্জার’-এর সহকারী সম্পাদক পদে নিযুক্ত করেন; সম্পাদক ছিলেন হেরম্বচন্দ্র নিজে। এর পর প্রকাশিত হয 'প্রদীপ', পৌষ ১৩০৪-এ (ডিসেম্বর ১৮৯৭), সম্পাদক রামানন্দ। রামানন্দর সম্পাদনায় 'প্রবাসী'র আত্মপ্রকাশ ১৩০৮-এ (এপ্রিল ১৯০০) এবং ইংরাজীতে 'মডার্ন রিভিউ' বের হয় ১৯০৬ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে, সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এসব দেখেই যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি রামানন্দ সম্বন্ধে স্মৃতিচারণ করেছেন - "তিনি বিষ্ণুপুরে কাপড়ের কল বসাতে উদ্যোগী ছিলেন। সেই উপলক্ষ্যে বিষ্ণুপুরে আসতেন। আর, সুবিধা হলে বাঁকুড়ায় আসতেন। বিষ্ণুপুর থেকে বাঁকুড়া রেলে এক ঘণ্টার পথ। যখনই বাঁকুড়ায় দুদিন থাকতেন, তখনই একদিন এসে দেখা করতেন। আমি বলতাম ‘আপনিই আমাকে বাঁকুড়ায় এনেছেন, কিন্তু আপনাকে দেখতে পাই না। আর ধন্য আপনার ক্ষমতা! এই বয়সে দুখানা বড় বড় মাসিক পুস্তক যথাসময়ে চালিয়ে আসছেন। প্রাপ্ত প্রবন্ধ বাছাই করা কাজ হলে বরং বুঝতে পারতাম। কিন্তু মাসে মাসে ‘প্রবাসী’তে বিবিধ প্রসঙ্গ এবং মডার্ন রিভিউতে notes লিখছেন। সে দুই পুস্তক এক বিষয়ের নয়। একটি অপরটির অনুবাদ নয়। কত বই, সংবাদপত্র, কত সাময়িক পুস্তক পড়তে হয়, ভাবতে হয, ধারণা করতে হয়; তারপর টিপ্পনি করতে পারা যায়। তা ছাড়া, আজ এখানে যাচ্ছেন, কাল সেখানে বক্তৃতা করছেন, সেনসস রিপোর্ট মুখস্থ রেখেছেন, আটঘাট বেঁধে আইন বাঁচিয়ে লিখছেন, মানহানির ধারা মনে রাখছেন, কেমন করে করেন বুঝতে পারি না।"  ..........  উত্তরে রামানন্দ বলেন - "আমার পিতৃপুরুষ ভট্টাচার্য ছিলেন। তাঁদের আলোচালের গুণে ও আশীর্ব্বাদের ফলে চালাচ্ছি।" পণ্ডিত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির বিস্ময়মিশ্রিত মন্তব্য থেকেই বোঝা যায় কি অসাধারণ মনীষিতা ও ধীশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন রামানন্দ। ১৯০৮ সালে রামানন্দ এলাহাবাদ ছেড়ে স্থায়ীভাবে কলকাতায় চলে আসেন।    

  ‘প্রবাসী’ ও তার সম্পাদক সম্বন্ধে হুমায়ুন কবীর বলেছেন - "প্রবাসীর সে যুগের সম্পাদকীয় রচনায় সাহস ছাড়াও প্রতিছত্রে স্বচ্ছবুদ্ধির পরিচয় মিলত। সংস্কার ও পূর্ব সিদ্ধান্ত থেকে মুক্ত হতে না পারলে বুদ্ধি স্বচ্ছ হতে পারে না। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্যে যে প্রাঞ্জলতার পরিচয় মিলত, তারো মূলে তাঁর স্বচ্ছ বিচারবুদ্ধি। ....মাসিক হয়েও প্রবাসী সে যুগে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রশ্নে যে-ভাবে জনমত গঠন করেছে, বহু ক্ষেত্রে বিদেশী সরকারকে অনুসৃত নীতি বদলাতে বাধ্য করেছে, সরকারের অন্যায় আদেশ অথবা জনতার হুজুগ এবং সাময়িক উত্তেজনার বিরুদ্ধে দৃঢ়কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছে, আজকাল তা বিশ্বাস করাও কঠিন। বোধ হয় এই সমস্ত গুণের জন্যই রবীন্দ্রনাথ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে বন্ধু বলে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পত্রিকায় নিজের শ্রেষ্ঠ রচনা প্রকাশ করে তাকে গৌরবান্বিত করেছিলেন।"

       ১৯১৭ সাল থেকে প্রায় দু’বছর সময় আশ্রমের ছাত্র তার কনিষ্ঠ পুত্রের জন্য শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছিলেন রামানন্দ। এই সময়ে তিনি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর,  সি.এফ. এন্ড্রুজ, বিধুশেখর শাস্ত্রী প্রভৃতি স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসেন।  ১৯২৫ সালে বিশ্বভারতীতে কলেজ বিভাগ খোলা হয়। রামানন্দের অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে রবীন্দ্রনাথ তাকে শিক্ষাভবনের ‘অনরারি প্রিন্সিপ্যাল’ পদে নিয়োগ করেন। খুবই অল্প সময়ের জন্য সেই পদে ছিলেন রামানন্দ, কিন্তু তারই মধ্যে তিনি প্রশাসনিক দক্ষতার ছাপ রেখেছিলেন।  

এসব ত গেল কর্মজীবনে তার বহুমুখী প্রতিভার কিছু বিবরণ ও রামানন্দ সম্বন্ধে কিছু বিদগ্ধ জনের সুচিন্তিত মূল্যায়ন। কিন্তু কেমন ছিল তার পারিবারিক জীবন ? রামানন্দর ছিল পাঁচ পুত্র ও দুই কন্যা। কেদারনাথ, শান্তা, সীতা, দেবব্রত, অশোক, অনিল ও প্রসাদ। দেবব্রত, অনিল ও প্রসাদ বেশীদিন বাঁচেন নি। কেদারনাথ, শান্তা, সীতা ও অশোক সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। রামানন্দ সম্বন্ধে সরাসরি শোনা যাক তার জ্যেষ্ঠা কন্যা শান্তা দেবীর বক্তব্য। 'পিতৃ-তর্পণ' প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন - "২১ বৎসর বয়সে অগ্রহায়ণ মাসে বাঁকুড়া জেলার ওঁদাগ্রাম নিবাসী ও ধলভূম রাজ স্টেটের মোক্তার স্বর্গীয় হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বিতীয়া কন্যা শ্রীযুক্তা মনোরমা দেবীর সহিত প্রাচীন হিন্দুমতে তাঁহার বিবাহ হয। মার বয়স তখন সাড়ে বার বৎসর। পিতৃদেব তাঁহাকে  কিছুদিন নিজে লেখাপড়া শিখাইতেন। তিনি বলিয়াছিলেন 'ছাতের সিঁড়ির শেষ ধাপে ছাদের দরজার সম্মুখে টেবিল চেয়ার রেখে আমি তোমাদের মাকে কিছু পড়াতাম।' তিনি যে কি আশ্চর্য পত্নী প্রেমিক স্বামী ছিলেন, কি গভীর অনুরাগ ও শ্রদ্ধার সহিত শেষ দিন পর্যন্ত মা'র উল্লেখ করিতেন তাহা তিনি নিজেই বুঝিতেন না। আমাদের দেশে পাতিব্রত্যের যে উচ্চ আদর্শ আছে তাহার চেয়েও বড় আদর্শ ছিল তার পত্নীপ্রেম। তাহার পরিচয় তিনি শোকে আনন্দে বহুদিন ধরিয়া দিয়াছেন।" কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৩৫ খৃষ্টাব্দে মনোরমা দেবীর মৃত্যু ঘটে।

"তিনি (রামানন্দ) অল্প বয়সে পিতাকে হারাইয়াছিলেন। কিন্তু নিজ মাতার প্রতি তার ভালবাসা আশ্চর্য ছিল। তিনি ব্রাহ্মসমাজে আসিবার বহু পরেও প্রয়াগে নিজমাতার কল্পবাস প্রভৃতির সব ব্যবস্থা স্বয়ং করিতেন। নিজ মাতার মৃত্যুর পর বহুদিন ঘর হইতে বাহির হইতেন না। পূর্বে প্রতি বৎসর ঐ সময়ে ঐ দিনে ঘরে দ্বার বন্ধ করিয়া অনাহারে থাকিতেন ও মাতৃচিন্তা করিতেন। তাঁহার কণিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুর শোক তিনি জীবনে ভোলেন নাই। সেই বালকের প্রিয় কার্যগুলি বহু অর্থব্যয়ে আজীবন রক্ষা করিয়াছেন। সে শৈশবে যেখানে খেলিতে বসিত সেইসব স্থানের ফোটো তুলাইয়া পুস্তকে প্রকাশিত করিয়াছেন। পিতৃদেবের শান্তিনিকেতন বড় প্রিয় স্থান ছিল। তাঁহার আকর্ষণের প্রধান কারণ অবশ্য ছিলেন বন্ধু রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু পিতার অন্তরের নিভৃত কোণে আর একটি কারণ ছিল ; সে কারণ তাঁহার মৃত পুত্র প্রসাদ। প্রসাদের জন্মদিন ও মৃত্যুদিন উপলক্ষ্যে প্রসাদ নৈশ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের তিনি ভোজ দিতেন, তাহার প্রিয় স্থানগুলি দেখিয়া যাইতেন।

“ ভৃত্যদেরও তিনি নিজের পরিজনের মত ভালবাসিতেন। রোগ-শয্যায় অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যেও শুশ্রূষাকারী ও ভৃত্যদের ‘বাবা, তুমি ভাল আছ ত ?' বলিয়া কুশল প্রশ্ন না করিয়া নিজের প্রয়োজনের কথা বলিতেন না।"

রামানন্দ সম্বন্ধে শ্রদ্ধেয় চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন -

"মানুষ মানুষকে যত ঘনিষ্ঠভাবে জানে তত তাহার দোষত্রুটি চোখে পড়ে এবং ততই তাহার সম্বন্ধে ধারণা হীন হয়। তাই ইংরাজীতে প্রবচন হইয়াছে Familiarity breeds contempt, কিন্তু ঘনিষ্ঠ ভাবে যত জানিয়াছি তত আমার শ্রদ্ধা বৃদ্ধি হইয়াছে তিন জনের উপর - তাহাদের দোষ ত্রুটি চোখে পড়া সত্বেও - প্রথম কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, দ্বিতীয় রামানন্দবাবু ও তৃতীয় এক শিক্ষিতা মহিলা।" 

১৯৪০ সাল থেকেই রামানন্দ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৯৪২-এর নভেম্বর অবধি তিনি কষ্ট করেও সম্পাদনার কাজ চালিয়ে গেছেন। ১৯৪৩ খৃষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে পড়ে গিয়ে তার উরুর হাড় ভেঙে যায়; এর পরে তার ভাল হবার আশা সবাই ছেড়ে দেন। তার অসুখের মূল কারণ চিকিৎসকেরা জানতে পারেন নি। অনুমান করা হয় দীর্ঘ ৫৫ বছর নিরামিষ খাদ্য গ্রহণের ফলে এবং খাদ্য নির্বাচনের বিষয়ে অতিরিক্ত কড়াকড়ি করায় তার শরীরে ভিটামিন বা অত্যাবশ্যকীয় কোন দ্রব্যের অভাবই রোগের মূল কারণ। মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগেই তিনি স্বাভাবিকভাবে বড় মেয়ে শান্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। ১৯৪২ খৃষ্টাব্দের ৩০শে অক্টোবর (১৩ই আশ্বিন ১৩৫০)সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে রামানন্দ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
(পরের অংশ )।  



লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.