প্রবাসী ও রামানন্দ (২)
দীপক সেনগুপ্ত
( প্রথম অংশ)
‘প্রবাসী’র কথায় ফিরে আসা যাক। অবশ্য ‘প্রবাসী’ ও রামানন্দ এমন অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পৃক্ত যে একের প্রসঙ্গে অন্যের কথা এসে যায়। রামানন্দের ‘প্রবাসী’ প্রকাশের ইচ্ছর কথা আগেই বলা হযেছে। কিন্তু তিনি তো ‘প্রদীপ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন, তা হলে অন্য একটি পত্রিকার প্রয়োজন কেন ? কারণ –“ প্রদীপ পরিচালনাকালেই তিনি দেখিয়াছিলেন যে, অনেক বিষয়ে, বিশেষতঃ রাজনৈতিক মতপ্রকাশে, সম্পাদককে সত্বাধিকারীর উপর নির্ভর করিতে হয়। সম্পূর্ণ স্বাধীন ভাবে সকল বিষযে সমালোচনার অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখিবার অভিপ্রায়ে তিনি স্বয়ং সত্বাধিকারী এবং সম্পাদক হইয়া পত্রিকা প্রকাশের সঙ্কল্প করেন।” কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থ তার হাতে ছিল না। তিনি ও তার সুযোগ্য সহধর্মিনী অসাধারণ কৃচ্ছসাধন দ্বারা সাংসারিক ব্যয় সঙ্কোচ করে পত্রিকার জন্য অর্থ যোগাড় করেন। প্রথম সংখ্যা মুদ্রিত হয়েছিল ৫ হাজার। কর্মী তখন মাত্র একজন। রামানন্দ পত্নী মনোরমা দেবী গ্রাহকদের পাঠাবার জন্য নিজের হাতে পত্রিকার প্যাকিং করতেন এবং দুজনে মিলে ঠিকানা লিখতেন।
‘প্রবাসী’র প্রচ্ছদ প্রথম চার মাস কলকাতায় ছাপা হয়েছিল, ভাদ্র সংখ্যা থেকে ছাপা হত এলাহাবাদ ইণ্ডিয়ান প্রেসে। বিজ্ঞাপন ছিল মাত্র দুটি। কার্যাধ্যক্ষ ও প্রকাশক ছিলেন বাবু আশুতোষ চক্রবর্তী। প্রথম ‘প্রবাসী’ ছাপা হয়েছিল বেলজিয়ামে তৈরী Grand Jesus Machine-এ। ১৩০৮ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ প্রকাশিত প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত রচনাগুলি ছিল -
সূচনা; আবাহন (কবিতা )-শ্রী দেবেন্দ্রনাথ সেন; প্রয়াগধামে কমলাকান্ত - শ্রী কমলাকান্ত শর্মা; আদর্শ কবি (ক্রমশঃ )-শ্রী কমলাকান্ত শর্মা; অজণ্টা-গুহা-চিত্রাবলী (সচিত্র )-সম্পাদক ; প্রবাসী (কবিতা )-শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; জীববিদ্যা -শ্রীযোগেশচন্দ্র রায়; ক্ষীরাৎকুম্ভ (সচিত্র)- শ্রীজ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস; শর্করা বিজ্ঞান (ক্রমশঃ )-শ্রীনিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়; বিবিধ প্রসঙ্গ – সম্পাদক; ভিতরে পূর্ণপৃষ্ঠার ছবি - জয়পুরের মহারাজা ও দেয়ান কান্তিচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ।
সূচনায় সম্পাদক লিখেছেন -
প্রথম ২/৩ বছর পরে পত্রিকার মুখবাণী ছিল কবি টেনিসন লিখিত কবিতার পংক্তি -
কিন্তু পরে ১৩১৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা থেকে এটি পরিবর্তিত হয়ে ছাপা হত সংস্কৃত দুটি নীতি বাক্য -‘সত্যম শিবম্ সুন্দরম’ ও মুণ্ডকোপনিষদের ‘নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য’। শেষ পর্যন্ত এটিই চালু ছিল।
১৯০৮ খৃষ্টাব্দের মার্চ মাসে রামানন্দ এলাহাবাদ ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন এবং তখন থেকে পত্রিকা কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হতে থাকে। প্রথম বছর লোকসান হয় দেড় হাজার টাকা। টাকার অঙ্কে লোকসান হলেও 'প্রবাসী' প্রথম সংখ্যাটি দ্বিতীয় বার ছাপাতে হয়, অতএব পত্রিকা জনপ্রিয় হযেছিল প্রথম থেকেই। কলকাতায় ‘প্রবাসী’ ছাপা হত ৫নং শিবনারায়ণ দাস লেনের কুন্তলীন প্রেসে। প্রবাস (এলাহাবাদ)থেকে প্রবাসীর দ্বারা প্রকাশিত, তাই নাম হয়েছিল ‘প্রবাসী’। আবার প্রথম সংখ্যাতেই ‘প্রবাসী’ নামক কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখলেন – “ প্রবাস কোথাও নাহি রে নাহি রে জনমে জনমে মরণে।” ১৩২২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হল গোবিন্দ চন্দ্র রায়ের কবিতা -
পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ জাতির বেদনা এই কবিতার মধ্যে ফুটিয়ে তুলে 'প্রবাসী' অর্থ আরও ব্যাপক করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ‘প্রবাসী’ পরাধীন জাতির মুক্তির উপায় খুঁজেছে, নানা রচনা প্রকাশের মাধ্যমে প্রেরণা জুগিয়েছে, স্ব-নির্ভর হতে উৎসাহিত করেছে।
‘প্রবাসী’র অলঙ্করণ ও চিত্র :
‘প্রবাসী’ বিভিন্ন দিক থেকেই উৎকর্ষ ও নতুনত্বের দাবে করতে পারে। তবে এর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল পত্রিকার অলংকরণ। এত রঙিন ও একবর্ণের ছবি এর আগে আর কোন পত্রিকায় ছাপা হয় নি। এই পত্রিকাতেই অবনীন্দ্রনাথের ছবি প্রথম প্রকাশিত হয়। রামানন্দের সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয় এলাহাবাদে । রামানন্দ প্রথম সাক্ষাতেই অবনীন্দ্রনাথের ছবি চাইলেন ‘প্রবাসী’র জন্য। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন -
একটু দীর্ঘ হলেও ‘প্রবাসী’র চিত্র প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া ও একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য -
ছবির ক্ষেত্রে শিল্পী এবং রচনার ক্ষেত্রে লেখক নির্বাচনে রামানন্দ ছিলেন নিরপেক্ষ। নামী এবং অখ্যাত দু’ধরণের লোককেই তিনি সুযোগ দিয়েছেন। দেশী ও বিদেশী সব ধরনের ছবিই স্থান পেয়েছে তার পত্রিকায় । দীর্ঘ রচনাপঞ্জী তৈরী করা উদ্দেশ্য না হলেও ‘প্রবাসী’র বিস্তৃতি ও বৈচিত্র তুলে ধরতে বিভিন্ন বিভাগে প্রকাশিত বেশ কিছু রচনার উল্লেখ করা হবে । তালিকা একটু দীর্ঘায়ত হলেও রচয়িতা ও বিষয়বস্তুর ব্যাপকতা ফুটিয়ে তুলতে এর প্রয়োজন আছে।
‘প্রবাসী’ সূচীপত্র ছ’মাস অন্তর প্রকাশিত হত। বৈশাখ সংখ্যার সঙ্গে বৈশাখ থেকে আশ্বিন এবং কার্তিক সংখ্যার সঙ্গে কার্তিক থেকে চৈত্র। চিত্রসূচী পৃথকভাবে উল্লেখিত থাকত; আর মাঝে মাঝে থাকত ‘চিত্র পরিচয়’ - চিত্রের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা সহ। কয়েকটি চিত্রের নাম এবং প্রকাশকাল দেখা যাক। প্রথমে চিত্রের নাম, পরে শিল্পীর নাম এবং শেষে যে সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে তার উল্লেখ করা হল।
‘মেঘদূতের বিরহী যক্ষ’ – অবনীন্দ্রনাথ ( বৈশাখ ১৩১৩ ); ‘শকুন্তলার পুত্র ভরত সিংহের দাঁত গণিতেছে’ - মহাদেব বিশ্বনাথ ধুরন্ধর ( বৈশাখ ১৩১৩ ); ‘শিশুকৃষ্ণের মুখে যশোদার বিশ্বরূপ দর্শন’ - রাজা রবিবর্ম্ম ( আশ্বিন ১৩১৩ ); ‘রাম পঞ্চায়তন’ - মহাদেব বিশ্বনাথ ধুরন্ধর ( চৈত্র ১৩১৩ ); ‘সেন্ট জেনভীভ (Sainte Genevieve)’ - পিউভিস ডি স্যাভান্নিস (Puvis de Chavannes) ( কার্ত্তিক ১৩১৩ ); ‘বুদ্ধদেব’ - যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায় ( কার্ত্তিক ১৩১৩ ); ‘মাতৃমূর্ত্তি’ - দাগনান্ বুভারেট ( চৈত্র ১৩১৩ ); ‘উপাসনার ঘন্টাধ্বনি শ্রবণে’ – মিলে ( অগ্রহায়ণ ১৩১৩ )। কিছু ছবি একান্তভাবে ‘প্রবাসী’র জন্যই অঙ্কিত। ১৩১৩ সালেই এত ছবি ছাপা হযেছে; এ ছাড়া ছিল অজস্র ফটোগ্রাফ। তবে অবনীন্দ্রনাথের চিত্রশৈলী তখন অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি। এ প্রসঙ্গে রথীন্দ্রনাথ তার ‘পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন – “চিত্রিত মানুষদের লম্বা হাত, পা, ক্ষীণ কটি, লতানো আঙুল ইত্যাদি তখন অত্যন্ত হাসির জিনিস ছিল। প্রবাসীতে ‘বজ্রমুকুট ও পদ্মাবতী’, ‘বিরহী যক্ষ’, ‘দীপান্বিতা’, ‘সুজাতা ও বুদ্ধ’ ইত্যাদি দেখিয়া নানা জায়গায় মজলিসে হাসিতামাশা হইত, কাগজেও বিরুদ্ধ সমালোচনা চলিত।”
খ্যাত অখ্যাত বহু শিল্পী তাদের সৃষ্ট শিল্পকর্ম দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ‘প্রবাসী’র পাতা অলঙ্কৃত করেছেন। নীচে আরও কিছু নমুনা দেওয়া হল।
বিভিন্ন সময়ে ‘প্রবাসী’র প্রচ্ছদ এঁকেছেন নম্দলাল বসু,সমরেন্দ্রনাথ গুপ্ত ,শৈলেন্দ্রনাথ দে, সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ।
বিবিধ প্রসঙ্গ
‘প্রবাসী’র একটি মূল্যবান ও জনপ্রিয় বিভাগ ছিল ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’। প্রথম সংখ্যা থেকেই এই বিভাগটি সংযোজিত হয়। সমসাময়িক সাহিত্য, শিক্ষা, বিজ্ঞান, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে রচিত সম্পাদকের মন্তব্য বা অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের দ্বারা রচিত সংক্ষিপ্ত আলোচনা বা সংবাদ পরিবেশিত হত এই বিভাগে। এতে প্রকাশিত বিষয়গুলি পড়লে সেই সমযের জনজীবন,সংস্কৃতি ও ইতিহাসের রূপটি সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে। মুলতঃ ‘বিবিধ প্রসঙ্গে’ প্রকাশিত বিষয় নিয়েই শঙ্করীপ্রসাদ বসু ও সুদীপ বসু তিন খণ্ড গ্রন্থ রচনা করেছেন। ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ থেকে নমুনা হিসাবে কিছু বিষয়ের উল্লেখ এখানে করা হল -
এখানে একটি কুদ্র ভগ্নাংশমাত্র নমুনা হিসাবে দেওয়া হল। কিন্তু এরই মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি আলোচ্য বস্তুর ব্যাপকতা ও বহু-বিস্তৃত দিক নির্দেশ করে।
পঞ্চশস্য
অপর একটি জনপ্রিয় ও তথ্যসম্বৃদ্ধ বিভাগ ছিল ‘পঞ্চশস্য’। ১৩২০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস থেকে শুরু হয় এই বিভাগটি। বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার থেকে আহৃত তথ্য ও সংবাদ পরিবেশনা বা সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা দিয়েই তৈরী হয়েছিল এটি। প্রথমে বিভিন্ন সংবাদপত্রে পরিবেশিত তথ্য থেকেও বিষয় নির্বাচিত হত। ১৩৪৫ বঙ্গাব্দের পরে সম্ভবতঃ এই বিভাগটি বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রাসঙ্গিক বিষয় তখন অন্যভাবে পরিবেশিত হয়েছে। এই বিভাগে প্রকাশিত কিছু নির্বাচিত বিষয় দেওয়া হল উদাহরণ হিসাবে।
অমাদের দক্ষিণ হস্ত ব্যবহারের কারণ - পৌষ ১৩২১; মৌমাছি কি জ্যামিতিজ্ঞ? - আশ্বিন ১৩২৫; কংক্রিট-তক্তার বাড়ী - আশ্বিন ১৩২০; প্রাচীন মুদ্রা - বৈশাখ ১৩২৯; সাবান ব্যবহারে ময়লা দূর হয় কেন? - আশ্বিন ১৩২৭; গতিমানী আলোর রঙ - বৈশাখ ১৩২৮; প্রবল বাতাসে প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ লইয়া যাইবার কৌশল -বৈশাখ ১৩২৯; মেরু আবিষ্কার - বৈশাখ ১৩৩১; সবচেয়ে ছোট এবং সবচেয়ে পুরাণো বই - ভাদ্র ১৩৩১; পোকাদের স্থাপত্য-বিদ্যা - ভাদ্র ১৩৩১; জলে-চলা জুতা -আশ্বিন ১৩৩১; প্রথম সাবমেরিন নৌকা - আশ্বিন ১৩৩১; টেলিফোনের আবিষ্কর্ত্তা গ্রাহাম বেল - আশ্বিন ১৩৩৩; সুমেরিয়ান সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ - কার্ত্তিক ১৩৩৬; অভিনব যুদ্ধ জাহাজ - কার্ত্তিক ১৩৩৬; যানের বিবর্তন - বৈশাখ ১৩৩৭; নূতনতম এরোপ্লেন - বৈশাখ ১৩৪০; চিংড়ির জীবনযাত্রা প্রণালী - জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪ ইত্যাদি।
কষ্টিপাথর
অপর একটি বিভাগ হল ‘কষ্টিপাথর’। ১৩১৬ বঙ্গাব্দ থেকে শুরু হয় এই বিভাগটি। সম-কালীন পত্র-পত্রিকা থেকে নির্বাচিত বিবিধ রচনার পুনর্মুদ্রন বা তার সংক্ষিপ্তসার প্রকাশিত হত এই বিভাগটিতে। সে সময়ে প্রকাশিত যে সব পত্রিকা থেকে বিষয়বস্তু নির্বাচিত হত, তার কয়েকটির নাম দেওয়া হল। বর্তমান ধারাবাহিকে যখন সাময়িক পত্র নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তখন তৎকালীন সাময়িক পত্রিকার নাম পাঠকদের নিশ্চয়ই কৌতূহল নিরসনের কিছুটা সহায়ক হবে।
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা; ভারত মহিলা; নব্যভারত; কোহিনূর; প্রতিভা; মানসী; বিজ্ঞান; আর্যাবর্ত্ত; বঙ্গদর্শন; ভারতী; সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা; ব্যবসা ও বাণিজ্য; ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলন; ব্যবসায়ী; প্রতিভা; প্রজাপতি; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য; ভারতবর্ষ; গৃহস্থ; বিক্রমপুর; বিজয়া; সবুজপত্র; নারায়ণী; কৃষক; উপাসনা; স্বাস্থ্য-সমাচার; প্রতিভা; আল্-এসলাম্; প্রাচী; শান্তিনিকেতন-পত্রিকা; ইস্লাম-দর্শন; পরিচারিকা; পল্লীশ্রী; মানসী ও মর্ম্মবাণী; সৌরভ; তরুণ; মাধবী; প্রবর্ত্তক; নমঃশূদ্র-হিতৈষী; ভাণ্ডার; যমুনা; শিক্ষক; সুবর্ণবণিক সমাচার; মৌচাক; ইতিহাস ও আলোচনা; বঙ্গীয় মুসলমান-সাহিত্য-পত্রিকা; বামাবোধিনী পত্রিকা; সন্দেশ; বেতাল; প্রভাতী; বিকাশ; বঙ্গবাণী; ভাণ্ডার; উত্তরা; বাঁশরী; মাসিক বসুমতী; বঙ্গলক্ষ্মী; মাতৃমন্দির; প্রকৃতি; আরতি; পাবনা; আর্থিক উন্নতি; শিক্ষা-সেবক; আবাদ; পল্লী-স্বরাজ; শতদল; জয়শ্রী; বিচিত্রা; মাসিক মহম্মদী; আয়ুবিজ্ঞান ইত্যাদি।
দেশ বিদেশের কথা
‘দেশ বিদেশের কথা’ (সচিত্র)বিভাগটির শুরু ১৩২৮ থেকে। ১৩২৫ বঙ্গাব্দ থেকে ‘দেশের কথা’ নামে বিভাগটি চালু হয়েছিল; পরে বিদেশের খবরও এর অন্তর্ভুক্ত করে নাম হয় ‘দেশ বিদেশের কথা’। দেশের এবং বিদেশের বিভিন্ন বিষয়ের খবর থাকত এই বিভাগে। আমাদের দেশের নানা অব্যবস্থা, দারিদ্র, বিভিন্ন কর্মসূচী ইত্যাদি নিয়ে খবর ও আলোচনাও থাকত। কয়েকটি নমুণা দেওয়া যাক।
ইউরোপে অশান্তি - অগ্রহায়ণ ১৩২৮; কোছিনে সত্যাগ্রহ - বৈশাখ ১৩৩১; পুলিশ পোষণের খরচ -বৈশাখ ১৩৩১; হিব্দু মুসলমান সমস্যা - শ্রাবণ ১৩৩১; পরলোকে মহরাজা স্যর মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী - অগ্রহায়ণ ১৩৩৬; বাংলার পাট- চাষী সাবধান - বৈশাখ ১৩৩৮; ভারতে বিলাতী কাপড়ের আমদানী - আষাঢ় ১৩৩৮; পরলোকে মার্কনি - ভাদ্র ১৩৪৪; পুনর্মুদ্রিত বঙ্কিমচন্দ্রের বঙ্গদর্শন - আষাঢ় ১৩৪৮ ইত্যাদি। সংবাদ সংগ্রহকারীদের মধ্যে ছিলেন চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অমলচন্দ্র হোম, হেমেন্দ্রলাল রায়, প্যারীমোহন সেনগুপ্ত, প্রভাত সান্যাল, প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, শৈলেন্দ্রমোহন বসুঠাকুর প্রমুখ।
সংক্ষিপ্ত গ্রন্থসমালোচনা
‘প্রবাসী’র একটি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা হল সমসাময়িক পত্রিকা ও গ্রন্থের সমালোচনা প্রকাশ। ১৩০৯ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে রসায়নবিদ আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় রচিত ইংরাজী গ্রন্থের সমালোচনা ‘হিন্দুরসায়নের ইতিহাস’ নামে বেরিয়েছে। গ্রন্থটির প্রশংসাসূচক বিশদ আলোচনা করা হয়েছে এই সংখ্যাটিতে। ১৩১৩ আশ্বিন সংখ্যায় ‘সমালোচনা’ শিরোনাম দিয়ে কিছু পুস্তকের সমালোচনা প্রকাশ করা হয়েছে। এই ধরণের সমালোচনা তখন মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়েছে, নিয়মিত হয় নি। ‘পুস্তক পরিচয়’ নামে নিয়মিত বিভাগের শুরু ১৩১৮ বঙ্গাব্দ থেকে। সমালোচকদের মধ্যে ছিলেন সম্পাদক স্বয়ং, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহেশচন্দ্র ঘোষ, অমলচন্দ্র হোম, শৈলেশচন্দ্র মজুমদার, বিধুশেখর শাস্ত্রী, অজিতকুমার চক্রবর্ত্তী, অমৃতলাল গুপ্ত, রমেশ বসু, চিন্তাহরণ চক্রবর্ত্তী, রামপদ মুখোপাধ্যায়, নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ইন্দুমাধব মল্লিক প্রমুখ। উদাহরণ হিসাবে সমালোচিত কয়েকটি গ্রন্থের নাম ও সংখ্যার নির্দেশ দেওয়া হল।
পরিব্রাজক - স্বামী বিবেকানন্দ (ভাদ্র ১৩১৩); রবীন্দ্রনাথ – অজিতকুমার চক্রবর্তী (আষাঢ় ১৩২০); প্রাচীন ইতিহাসের গল্প -প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (ভাদ্র ১৩২০); মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনচরিত -ভবসিন্ধু দত্ত (ফাল্গুন ১৩২১); মহাভারত –রাজকুমার চক্রবর্ত্তী (চৈত্র ১৩২১); আলেয়ার আলো - হেমেন্দ্রকুমার রায় (জ্যৈষ্ঠ ১৩২৫); ভারতবর্ষে কৃষি-উন্নতি - নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (আষাঢ় ১৩২৫); মিতা-মাসিক শিশু সাহিত্য -সম্পাদক অক্ষয়চন্দ্র সরকার (জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯); রোবাইয়াৎ - বিজয়কৃষ্ণ ঘোষ (জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯); আমেরিকা ভ্রমণ - সত্যশরণ সিংহ (শ্রাবণ ১৩২৯); পল্লীচিত্র - দীনেন্দ্রকুমার রায় (শ্রাবণ ১৩২৯); যশোহর-খুলনার ইতিহাস - সতীশচন্দ্র মিত্র কবিরঞ্জন (বৈশাখ ১৩৩১); লক্ষ্মী (উপন্যাস)- শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায (আষাঢ় ১৩৩১); মুক্তির ডাক - মন্মথ রায় (ভাদ্র ১৩৩১); অরবিন্দের গীতা - অনিল বরন রায় (শ্রাবন ১৩৩২); আনন্দমঠ – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (ভাদ্র ১৩৩২); গঙোত্তরী ও যমুনোত্তরী - দ্বিজেন্দ্রনাথ দত্ত (ভাদ্র ১৩৩২); কারাজীবনী - উল্লাসকর দত্ত (আষাঢ় ১৩৩১); বাংলার নদনদী - নীহাররঞ্জন রায় (বৈশাখ ১৩৫৬); রবীন্দ্র নাট্যপ্রবাহ - প্রমথনাথ বিশী (পৌষ ১৩৫৬); চিরদিনের রূপকথা - দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার (বৈশাখ ১৩৫৬); ইরাবতী – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় (ভাদ্র ১৩৫৬); সংবাদপত্রে সেকালের কথা - ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (চৈত্র ১৩৫৬); মার্ক্সবাদ - হুমায়ুন কবির (ফাল্গুন ১৩৫৫); জেলে ত্রিশ বছর – ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্ত্তী (বৈশাখ ১৩৫৫); অপরাধ বিজ্ঞান (২য় খণ্ড) - পঞ্চানন ঘোষাল (জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৫); হুতোম প্যাঁচার নক্সা ও অন্যান্য সমাজচিত্র - ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত (আষাঢ় ১৩৫৫); সুভাষচন্দ্র ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র – সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় (কার্ত্তিক ১৩৫৫); ক্যামেরার ছবি - পরিমল গোস্বামী (চৈত্র ১৩৪৯); বার্ষিক শিশুসাথী, আশুতোষ ধর সম্পাদিত (কার্ত্তিক ১৩৪৯); রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে - রেণু মিত্র (চৈত্র ১৩৫১); কালিদাসের মেঘদূত - মূল, অনুবাদ ও অন্বয়সহ ব্যাখ্যা (পৌষ ১৩৫১); স্বর্গাদপি গরীয়সী - বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (মাঘ ১৩৫৪); লে মিজারাবল - ভিক্টর হিউগো -অনুবাদক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় (মাঘ ১৩৫৪); বিজ্ঞানী ও বীজানু - খগেন্দ্রনাথ মিত্র (পৌষ ১৩৫৪); ফেরে নাই শুধু একজন - অনুবাদক নেপালশঙ্কর সরকার (খাজা আহম্মদ আব্বাসের 'And one who did not come back'-এর বঙ্গানুবাদ)(অগ্রহায়ণ ১৩৫৪); দৃষ্টিপাত - যাযাবর (কার্ত্তিক ১৩৫৪); সাহিত্য সাধক চরিতমালা নং ৬৯,৭১ - ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় (কার্ত্তিক ১৩৫৪)ইত্যাদি। পুস্তকের সঙ্গে মাসিক পত্রের সমালোচনাও হয়েছে এই বিভাগে। এর বেশ কিছু গ্রন্থ আজও পাঠকের প্রিয়; সহায়ক গ্রন্থ হিসাবেও প্রয়োজনীয়। প্রবাসীর নিয়মিত পাঠকেরা সে সময়ে প্রকাশিত বহু বইয়ের নাম ও বিষয়বস্তু সম্বন্ধে ধারণা করতে পারতেন।
বেতালের বৈঠক
'বেতালের বৈঠক' শুরু হয় ১৩৩০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা থেকে । উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে বলা হযেছে "এই বিভাগে চিকিৎসা ও আইন সংক্রান্ত প্রশ্নোত্তর ছাড়া সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়ক প্রশ্ন ছাপা হইবে। প্রশ্ন ও উত্তরগুলি সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্ছণীয়, একই প্রশ্নের উত্তর বহুজনে দিলে যাঁহার উত্তর আমাদের বিবেচনায় সর্ব্বোত্তম হইবে তাহাই ছাপা হইবে .... ইত্যাদি। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। বৈশাখ সংখ্যায় ৫নং প্রশ্ন রয়েছে - "ধৃতরাষ্ট্রের পিতামহ ও পিতামহীর নাম কি ?" উত্তর দেওয়া হয়েছে জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। উত্তর - "ব্যাসদেবের ঔরসে বিচিত্রবীর্য্যের ক্ষেত্রে অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম। বিচিত্রবীর্য্য সত্যবতীর গর্ভজাত শান্তনুরাজার পুত্র। সুতরাং ধৃতরাষ্ট্রের পিতামহের নাম শান্তনু রাজা এবং পিতামহীর নাম সত্যবতী; পরন্তু জন্মদাতা পিতা হিসাবে ব্যাস-পিতা পরাশর মুনি ধৃতরাষ্ট্রের পিতামহ; পিতামহী সর্ব্বাবস্থাতেই সত্যবতী।" উত্তরদাতা শ্রীরমেশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী।
মহিলা মজলিশ
১৩২৮ বঙ্গাব্দ থেকে শুরু হয় 'মহিলা মজলিশ'। দেশ বিদেশের নারীদের কথা এতে থাকত। মহিলা কবিদের রচিত কবিতাও মাঝে মাঝে প্রকাশিত হত। তবে এই বিভাগটির প্রকাশ নিয়মিত ছিল না। কোন কোন সংখ্যায় 'মহিলা-সংবাদ' (সচিত্র ) শিরোনামেও বেরোত। কয়েকটি বিষয় ও প্রকাশ-সংখ্যার উদাহরণ :
নারী-সমস্যায় আমেরিকা ও ইউরোপ (কার্ত্তিক ১৩২৮); দেশ বিদেশের মেয়েদের কথা (কার্ত্তিক ১৩২৮); আন্তর্জাতিক নারী-সম্মেলন (অগ্রহায়ণ ১৩২৮); স্বাধীনতা লাভে নারীর সাহায্য (পৌষ ১৩২৮); সাহিত্যে মহিলার কৃতিত্ব (পৌষ ১৩২৮); মেয়েদের দেহচর্য্যা ও বেশভূষা (ফাল্গুন ১৩২৮); শিশুশিক্ষায় মহিলা (বৈশাখ ১৩২৯); সঙ্গীত শিক্ষায় মহিলা (বৈশাখ ১৩২৯); সোভিয়েট রুশিয়ায় নারী (বৈশাখ ১৩২৯); চিত্র-শিল্পে বালিকার কৃতিত্ব (বৈশাখ ১৩২৯); চীনদেশের নারী (বৈশাখ ১৩২৯); চরকা ও বস্ত্র সমস্যায় বঙ্গমহিলার কর্তব্য (জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯); ইজিপ্টের নারী (জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯); নারী প্রগতি (জ্যৈষ্ঠ ১৩২৯ ); বৈষ্ণব যুগে নারীর শক্তি (ভাদ্র ১৩২৯) ইত্যাদি। পরে ‘মহিলা সংবাদ’ (সচিত্র )বেরোয় ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের কাছাকাছি সময়ে। এতে মহিলাদের নানা কৃতিত্ব ও সফলতার বিষয়ে সংবাদ পরিবেশিত হত। শোকসংবাদও বেরোত।
ছোটদের পাততাড়ি
‘ছোটদের পাততাড়ি’ বিভাগে ছোট ছেলেমেয়েদের জন্য দেশ বিদেশের নানা গল্প, রূপকথা, বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা, জীবজন্তুদের খবর, কবিতা, শরীর ও স্বাস্থ্য প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা ও আরো অনেক জ্ঞাতব্য বিষয় থাকত। তবে এই বিভাগটি পত্রিকার প্রতি সংখ্যাতে থাকত না।
আলোচনা
রামানন্দ সম্পাদিত ‘প্রদীপ’ পত্রিকার মতই ‘প্রবাসী’র আলোচনা বিভাগে পত্রিকায় প্রকাশিত যে কোন রচনা সম্বন্ধে পাঠকের মতামত ছাপান হত। অনেক সময় মূল লেখকের উত্তরও সঙ্গে দেওয়া হত। এ প্রসঙ্গে জানান হয়েছে "কোন বিষয়ে যাঁহার লেখা সমালোচিত হয়, তিনি জবাব দিলেই সে-বিষয়ে বাদ প্রতিবাদ শেষ হইয়া যায়।"
হারামণি
‘হারামণি’ ‘প্রবাসী’র নতুন একটি বিভাগ। ১৩২২ থেকে শুরু। বহু পুরনো ও হারিয়ে যাওয়া গান এখানে প্রকাশিত হত। এ বিষয়ে বিজ্ঞাপিত হয়েছে - " এই বিভাগে আমরা অজ্ঞাত অখ্যাত প্রাচীন কবির বা নিরক্ষর স্বল্পাক্ষর গ্রাম্য কবির উৎকৃষ্ট কবিতা ও গান ইত্যাদি সংগ্রহ করিয়া প্রকাশ করিব। প্রবাসীর পাঠকপাঠিকারা এই বিষয়ে আমাদের সহায় হইবেন আশা করি। অনেক গ্রামের এমন নিরক্ষর বা স্বল্পাক্ষর কবি মাঝে মাঝে দেখা যায় যাঁহারা লেখাপড়া অধিক না জানা সত্ত্বেও স্বভাবতঃ উৎকৃষ্ট ভাবের কবিত্বরসমধুর রচনা করিয়া থাকেন। কবিওয়ালা, তর্জ্জাওয়ালা, জারিওয়ালা, বাউল, দরবেশ, ফকির প্রভৃতি অনেকে এই দলের। প্রবাসীর পাঠক-পাঠিকারা ইাঁহাদের যথার্থ কবিত্বপূর্ণ বা রসভাবপূর্ণ রচনা সংগ্রহ করিয়া পাঠাইলে আমরা সাদরে প্রকাশ করিব।" মাঝে মাঝে ভুলও হত। ‘হারামণি’তে প্রকাশিত একটি গান প্রকৃতপক্ষে অজানা শিল্পীর বা হারিয়ে যাওয়া গান নয়, ১৩২৯-এর আষাঢ় সংখ্যায় একটি গান সম্বন্ধে একথা জানাচ্ছেন নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।
সঙ্গীতের জন্য নির্দিষ্ট কোন বিভাগ না থাকলেও রবীন্দ্রনাথের অজস্র গান স্বরলিপিসহ বা স্বরলিপি বাদ দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় নিয়মিত, তা ছাড়া অন্যান্যদের রচিত গান ও স্বরলিপিও প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রবাসী’তে। রবীন্দ্রনাথের গানের স্বরলিপি তৈরী করেছেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শান্তিদেব ঘোষ, শৈলারঞ্জন মজুমদার, সাহানা দেবী, অনাদি দস্তিদার, অরুন্ধতী দেবী প্রমুখ। শুধু ‘প্রবাসী’র জন্য রচিত জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দু’খানি ইংরাজী গান স্বরলিপি সহ প্রকাশিত হয়েছে ১৩২২-এর কার্ত্তিক সংখ্যায়। বিশেষজ্ঞদের দ্বারা রচিত সঙ্গীত বিষয়ক রচনাও স্থান পেয়েছে ‘প্রবাসী’র পাতায়; যেমন, ‘রূপ ও আলাপ’ - গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় (বৈশাখ ১৩৩৫); ‘রাগ-রাগিনীর রূপ ও আলাপ’ - গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় (ভাদ্র ১৩৩২); ‘গীতাঞ্জলি ও অতিন্দ্রীয় তত্ত্ব’ - শিবকৃষ্ণ দত্ত (ভাদ্র ১৩৩৩)ইত্যাদি।
এতক্ষণ ‘প্রবাসী’র বিভিন্ন বিভাগ ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। পত্রিকার প্রসঙ্গে অন্যান্য বিষয় আলোচনা করার আগে ‘প্রবাসী’ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব ও রচনা প্রকাশ নিয়ে দু-একটি কথা বলতেই হবে। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘প্রবাসী’র প্রাণপুরুষ। সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সুযোগ্য সম্পাদনা ও তার অসামান্য কর্মক্ষমতা এবং পাণ্ডিত্য থাকলেও রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে ‘প্রবাসী’র উৎকর্ষ ও সাফল্য কল্পনা করা যায় না। রামানন্দের জীবনী আলোচনায় রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতা, ছোট গল্প, নাটক, গান নিয়মিত ‘প্রবাসী’তে ছাপা হয়েছে। একমাত্র ১৩২৪ বঙ্গাব্দে তার কোন লেখা বেরোয় নি; তখন তিনি ‘সবুজপত্র' নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। রামানন্দ রবীন্দ্রনাথকে ‘প্রবাসী'তে লেখা পাঠাবার জন্য বহু তাগাদা দিয়েছেম, মাঝে মাঝে অগ্রিম চেক পাঠিয়ে দিয়েছেন। লেখা আদায় করার জন্য রামানন্দর নিরন্তর প্রয়াস নিয়ে লোকে অনেক কথা বলত। রামানন্দ সেটা কবিকে জানালে, তিনি উত্তরে লেখেন -"আপনি আমার কাছ থেকে প্রবাসীতে প্রবন্ধ আদায় করার জন্য নানা কৌশলে চেষ্টা করে থাকেন এরকম জনশ্রুতি আমার কানে পৌঁছয় নি। কিন্তু যদি করতেন তাহলে আমার দুঃখিত হবার কারণ থাকত না। আমি যদি প্রবাসীর সম্পাদক হতুম তাহলে রবীন্দ্রনাথকে সহজে ছাড়তুম না - ভয়, মৈত্রী, প্রলোভন প্রভৃতি নানা উপায়ে লেখা বেশী না পাই ত অল্প,অল্প নাই ত স্বল্প আদায় করে নিতুম। বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথের দোষ হচ্ছে এই যে, খেজুর গাছের মত, উনি বিনা খোঁচায় রস দেন না। আপনি যদি আমাকে সময় মত ঘুস না দিতেন তাহলে কোন মতেই ‘গোরা’ লেখা হত না। নিতান্ত অতিষ্ঠ না হলে আমি অধিকাংশ বড় বা ছোট গল্প লিখতুম না। যদি জিজ্ঞাসা করেন আমার মেজাজ এমন বিশ্রী কেন তবে তার উত্তর এই যে, আজ পর্য্যন্ত নানা প্রমাণ পেয়েও আমার সত্য বিশ্বাস হয় নি যে, আমি লিখতে পারি।" রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য রচনার মধ্যে ‘গোরা’ বেরিয়েছে ১৩১৪-র ভাদ্র থেকে ১৩১৬-র ফাল্গুন অবধি-প্রায় দু'বছর ধরে। বেরিয়েছে নাটক রক্তকরবী, শেষের কবিতা (ভাদ্র ১৩৩৫ ), মুক্তধারা (বৈশাখ ১৩২৯ ), রাজা, অচলায়তন, গৃহপ্রবেশ ইত্যাদি। ছোট গল্পের মধ্যে আছে ‘তোতাকাহিনী’, ‘বাঁশি’, ‘প্রথম চিঠি’, ‘অতিথি’, ‘পণরক্ষা’, ‘কর্ত্তার ভূত’ ইত্যাদি। দীর্ঘসময় ধরে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য গগনে দীপ্যমান ছিলেন, তার প্রভাবে ছোট বড় বহু লেখক আবিষ্ট হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ‘প্রবাসী’র পাতায় অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে। যেমন : রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও দেশচর্য্যা কি বস্তুতন্ত্রহীন – অজিতকুমার চক্রবর্ত্তী (আষাঢ় ১৩১৯); রবীন্দ্র নাথের ‘জীবনদেবতা’ – অজিতকুমার চক্রবর্ত্তী (আশ্বিন ১৩১৯); রবীন্দ্রনাথের প্রতি (কবিতা, সচিত্র)- সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (জ্যৈষ্ঠ ১৩২১); রবীন্দ্র-পরিচয় - অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ (মাঘ ১৩২৮); রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প - শ্রীশ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (মাঘ ১৩৩৬); রবীন্দ্রনাথ - নলিনীকান্ত গুপ্ত (জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৮); রবীন্দ্রনাথ ও পল্লীসংগঠনের আদর্শ – বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায় (ফাল্গুন ১৩৪৪); রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনে চন্দননগরের স্থান - হরিহর শেঠ (আশ্বিন ১৩৪৮); নির্ভীকতার কবি রবীন্দ্রনাথ - অনুরূপা দেবী (বৈশাখ ১৩৪৮); রবীন্দ্রনাথের মতে নারীর সাধনা - ক্ষিতিমোহন সেন (বৈশাখ ১৩৪৮); নৃত্যনাট্যের পুনরুজ্জীবনে রবীন্দ্রনাথ - মণি বর্দ্ধন (আশ্বিন ১৩৪৮); রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ কয়দিন - শ্রীসেবিকা (আশ্বিন ১৩৪৮); রবীন্দ্রনাথ ও মৃত্যু - শান্তা দেবী (অগ্রহায়ণ ১৩৪৮); রবীন্দ্রকাব্যে প্রেমের অভিব্যক্তি - সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র (মাঘ ১৩৪৮); নবযুগের রবীন্দ্রনাথ – বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায় (আশ্বিন ১৩৪৮); রবীন্দ্রনাথের কথা সাহিত্যের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য - ডক্টর সুকুমার রঞ্জন দাশ (অগ্রহায়ণ ১৩৫১); রবীন্দ্র সাহিত্যে মৃত্যুর স্বরূপ - প্রফুল্লকুমার দাস (পৌষ ১৩৫১); রবীন্দ্রনাথের কাব্যে সৃষ্টির রূপ - যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (বৈশাখ ১৩৫৩); রবীন্দ্র-চিত্রের ভূমিকা – বিমলচন্দ্র চক্রবর্ত্তী (মাঘ ১৩৫৪) ইত্যাদি। স্বাভাবিক কারণেই ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের পর তাকে নিয়ে লেখা বেরিয়েছে অনেক বেশী।
আরও কয়েকজন প্রথিতযশা সাহিত্যিকের কিছু রচনার কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। এদের মধ্যে সকলেই তখন অবশ্য সাহিত্যক্ষেত্রে তেমন প্রতিষ্ঠিত হন নি, পরে নাম করেছেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যক’, ‘অপরাজিত’, ‘মেঘমল্লার’, ‘পুঁইমাচা’, ‘নাস্তিক’, ‘উপেক্ষিতা’, ‘মৌরীফুল’ ; শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহু ঐতিহাসিক উপন্যাস; বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমোদ’, ‘অবিচার’, ‘অকাল বোধন’ ; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কালিন্দী’; বনফুলের ‘আত্মপর’, ‘বাড়তি মাশুল’, ‘অজান্তে’; প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রসময়ীর রসিকতা’, ‘ফুলের মূল্য’, ‘বলবান জামাতা’, ‘উকিলের বুদ্ধি’ ইত্যাদি; মণীন্দ্রলাল বসুর ‘রমলা’; জগদীশ গুপ্তের ‘তৃষিত আত্মা’ প্রভৃতি। এখানে মাত্র কয়েকটির কথা উল্লেখ করা হল।
বহু সাময়িক পত্রিকা তখন বছরের যে কোন সময়েই আত্মপ্রকাশ করত। রামানন্দ কিন্তু বৈশাখ মাসে প্রথম দিনটিকেই বেছে নিয়েছিলে ‘প্রবাসী’ত প্রথম সংখ্যা প্রকাশের জন্য। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের কার্ত্তিক সংখ্যার ‘পরিচয়’ পত্রিকায় এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - "প্রথম যখন রামানন্দবাবু প্রথমে প্রদীপ ও পরে প্রবাসী বের করলেন, যাঁর কৃতিত্ব ও সাহস দেখে মনে বিস্ময় লাগল। আকারে বড়, ছবিতে অলংকৃত, রচনায় বিচিত্র, এমন দামী জিনিস যে বাংলাদেশে চলতে পারে তা বিশ্বাস হয় নি। তা ছাড়া এর আগে বাংলা সাময়িকপত্রে সময় রক্ষা করে চলার বাঁধাবাঁধি ছিল না। সেকালে মধ্যাহ্ণ ভোজনের নিমন্ত্রণ যেমন অপরাহ্ণে বা সায়াহ্ণে যাত্রা শুরু করতে লজ্জিত হত না, মাসিকপত্র তেমনি ললাটে মলাটে বৈশাখ মাসের তিলক কেটে অগ্রহায়ণ মাসে যখন অসংকোচে আসরে নামত সহিষ্ণু পাঠকের কাছে কোন কৈফিয়তের দরকার হত না। পাঠকদের ক্ষমাগুণের উপর নির্ভর করে এমনতর আটপৌরে ঢিলেমি করার সুযোগ প্রবাসী-সম্পাদক স্বীকার করেন নি - নিজের মান রক্ষার খাতিরেই, সময়রক্ষার স্খালন হতে দিলেন না।"
প্রকাশিত রচনার উৎকর্ষ সম্বন্ধে যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি তার স্মৃতিচারণায় সম্পাদক রামানদের সঙ্গে পত্রে মত বিনিময় প্রসঙ্গে বলেছেন – “একবার আমি এক পত্রে প্রবাসীতে প্রকাশিত গল্প সম্বন্ধে সমালোচনা করেছিলাম। যে গল্পে দুগ্ধ আছে কি না সন্দেহ, শুধু জল, সে গল্প ছাপিয়ে প্রবাসীর কলেবর বৃদ্ধি না করাই ভাল। তৎকালে সাহিত্য নামক বারমাসিক পুস্তকে প্রকাশিত ‘আগন্তুক’ নামে একটি গল্পের উল্লেখ করে লিখেছিলাম, সেরূপ গল্প ছাপালে প্রবাসীর গৌরব বৃদ্ধি হবে। উত্তরে তিনি লিখেছিলেন – “সে সব বুঝি, ভাল গল্প পাই না এই দুঃখ। নির্দোষ মনোরঞ্জন গল্পের লেখক অতি অল্প। গল্প না ছেপে শুধু জ্ঞানের ও শিক্ষার প্রবন্ধ ছাপালে প্রবাসী টিকতে পারবে না। বহু গ্রাহক শুধু গল্প ও উপন্যাস পড়েন সে যেমনই হোক। যদি তাঁরা প্রবাসীর অন্য পাতা দৈবক্রমে পড়েন তা হলেও আমার উদ্দেশ্য কিছু সিদ্ধ হবে।”
নামী ও অনামী বহু লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়েছে ‘প্রবাসী’তে। কেউ লেখার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী হলে এবং ধৈর্যশীল হলে ‘প্রবাসী’ তার সহায়ক হয়েছে। রামানন্দ নতুন লেখক ও শিল্পীদের সুযোগ দিয়েছেন যথেষ্ট। প্রথমে আসা যাক কবিতার কথায়। অজস্র কবিতা ছাপা হয়েছে ‘প্রবাসী’র পাতায়। কিছু রচয়িতার নাম এখানে দেওয়া হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া ছিলেন মোহিতলাল মজুমদার; সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত; করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়; কুমুদরঞ্জন মল্লিক; বিজয়রত্ন মজুমদার; চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়; প্রিয়ম্বদা দেবী; কালিদাস রায়; রমণীমোহন ঘোষ; যতীন্দ্রমোহন বাগচী; সুরেশানন্দ ভট্টাচর্য্য; দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ বাগচী; বিমানবিহারী মুখোপাধ্যায়; কৃষ্ণদয়াল বসু; হেমলতা দেবী; নগেন্দ্রনাথ চন্দ্র; যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য; সজনীকান্ত দাস; প্যারীমোহন সেনগুপ্ত; চণ্ডীচরণ মিত্র; বনফুল; নীহারিকা দেবী; সুরেশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী; হেমেন্দ্রলাল রায়; কাজী নজরুল ইসলাম; সুনীতি দেবী; স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়; নরেন্দ্র দেব; দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুনির্ম্মল বসু; গোলাম মোস্তাফা; পরিমলকুমার ঘোষ; লীলা দেবী; কালিদাস নাগ; কান্তিচন্দ্র ঘোষ; হেমেন্দ্রকুমার রায়; মনীশ ঘটক; মৈত্রেয়ী দেবী; সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত; বুদ্ধদেব বসু, ক্ষেত্রপ্রসাদ সেনশর্ম্মা প্রভৃতি।
প্রকাশিত বহু উপন্যাসের মধ্যে কয়েকটির লেখকের নাম এবং শুরুর সংখ্যা দেওয়া হল শুধু উদাহরণ হিসাবে।
জ্যোতির্নির্ব্বাণ - হরিসাধন মুখোপাধ্যায় (ভাদ্র ১৩১৩ );আগুনের ফুলকি -চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (বৈশাখ ১৩২০ );অরণ্যবাস-অবিনাশচন্দ্র দাস (বৈশাখ ১৩২০ ); দিদি - নিরুপমা দেবী (বৈশাখ ১৩১৯ ); উদ্যানলতা - সংযুক্তা দেবী (বৈশাখ ১৩২৫); ধর্ম্মপাল - রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (বৈশাখ ১৩২১ ); মনের বিষ - জানকীবল্লভ বিশ্বাস (কার্ত্তিক ১৩২২); শ্যামলী - নিরুপমা দেবী - (বৈশাখ ১৩২৫ ); দুই তার - চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (বৈশাখ ১৩২৪ ); স্মৃতির সৌরভ - শান্তা দেবী (বৈশাখ ১৩২৪ ); সেখ আন্দু - শৈলবালা ঘোষজায়া - (বৈশাখ ১৩২২ );বেনো জল - হেমেন্দ্রকুমার রায় (বৈশাখ ১৩৩০ ); রাজপথ - উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (বৈশাখ ১৩৩০); জীবনদোলা - শান্তা দেবী (বৈশাখ ১৩৩৩); নষ্টচন্দ্র - চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (বৈশাখ ১৩৩২ ); প্রবাল - সরসীবালা বসু (বৈশাখ ১৩৩৩); মৃত্যু-দূত - সেলমা লাগর্লফ্ (বৈশাখ ১৩৩৩ ); অপরাজিত - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (পৌষ ১৩৩৬ ); পোর্ট আর্থারের ক্ষুধা - সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (বৈশাখ ১৩৩৮ ); আরণ্যক - বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায় - (কার্ত্তিক ১৩৪৪ ); দৃষ্টি-প্রদীপ - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (ফাল্গুন ১৩৪০ ); নীলাঙ্গুরীয় - বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (বৈশাখ ১৩৪৭ ); শাশ্বত পিপাসা - রামপদ মুখোপাধ্যায় (বৈশাখ ১৩৪৮ ); নব সন্ন্যাস - বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় (বৈশাখ ১৩৫৩)ইত্যাদি।
গল্প যারা লিখেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়; মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়; প্রভাত মুখোপাধ্যায়; গোপাল হালদার; শরৎচন্দ্র ঘোষাল; নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়; শান্তা দেবী; নরেন্দ্রনাথ মিত্র; নীহারবালা দেবী; প্রিয়কান্ত সেনগুপ্ত; কিরণশঙ্কর রায়; সীতা দেবী; সুনির্ম্মল বসু; মনীন্দ্রলাল বসু; পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়; বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়; মাণিক ভট্টাচার্য্য; প্রমথনাথ বিশী; মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়; প্রেমেন্দ্র মিত্র; জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর; রামপদ মুখোপাধ্যায়; প্রবোধকুমার সান্যাল; আশালতা সিংহ; শৈলজা মুখোপাধ্যায়; স্বর্ণলতা চৌধুরী; শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়; সজনীকান্ত দাস; মালতী রায; বিধায়ক ভট্টাচার্য্য; দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায; মোহিতলাল মজুমদার; পরিমল গোস্বামী; ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
রামানন্দ প্রসঙ্গে আলোচনার সময় উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ও এলাহাবাদ হাই কোর্টের ফেলো রামানন্দ দীঘদিন শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি উৎকর্ষ সাধনে তিনি সচেতন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়েও শিক্ষা বিষয়ক বহু লেখা ‘প্রবাসী’তে ঠাঁই পেয়েছে; যেমন : পরীক্ষার বয়স নির্দ্দেশ - সম্পাদক (জ্যৈষ্ঠ ১৩১৩)(এর প্রতিবাদ বেরিয়েছে আষাঢ় ১৩১৩-তে ); শিক্ষার আদর্শ - সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত (ফাল্গুন ১৩২১); শিক্ষার ভাষা - সম্পাদক (পৌষ ১৩২২) - শিক্ষা বিষয়ক কয়েকটি কথা - বিজ্ঞানাচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় (পৌষ ১৩২৪ ); শিক্ষার বাহন ও ইংরাজী শিক্ষা - সম্পাদক (পৌষ ১৩২৪); বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা – সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী (শ্রাবণ ১৩২৫ ); শিক্ষার আলোচনা কেন আবশ্যক - অধ্যাপক যদুনাথ সরকার (চৈত্র ১৩২৮); কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রভৃতির নিয়োগ - সম্পাদক (ভাদ্র ১৩২৭ ); শিক্ষকদের শিক্ষা - সম্পাদক (ফাল্গুন ১৩২৯); বাংলায় বর্ত্তমান শিক্ষা-পদ্ধতি ও অর্থ-ব্যবস্থা – সম্পাদক ? (চৈত্র ১৩৪৭); উচ্চ শিক্ষার অবস্থা - বিমলচন্দ্র ভট্টাচর্য্য (বৈশাখ ১৩৫৬ ); স্বাধীন ভারত ও ছাত্র সমাজ - যোগেশচন্দ্র বাগল (জ্যৈষ্ঠ ১৩৫৬ ) ইত্যাদি।
ভ্রমণ-পিপাসু বাঙালীর ইচ্ছা পূরণের জন্য ‘প্রবাসী’তে ভ্রমণ কাহিনীও ছাপা হয়েছে যথেষ্ট। কয়েকটি নিদর্শন : কাশ্মীর দর্শন - নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত (আষাঢ় ১৩০৮); পাণ্ডুয়া-ভ্রমণ - রজনীকান্তচক্রবর্ত্তী (আষাঢ় ১৩০৯); পচ্মঢ়ি শৈল - সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (শ্রাবণ ১৩০৯ ); নেপালযাত্রা - হেমলতা দেবী (জ্যৈষ্ঠ ১৩১৩); কামাখ্যা দর্শন - মৃত্যুঞ্জয় রায়চৌধুরী রায় বাহাদুর (শ্রাবণ ১৩১৯ ); লণ্ডনে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভাদ্র ১৩১৯ ); বাদামি গিরিগুহা - নলিনীমোহন রায়চৌধুরী (ভাদ্র ১৩২০ ); কবরের দেশে দিন পনর - শ্রীপর্যটক (অগ্রহায়ণ ১৩২১ ); তিব্বতরাজ্যে তিন বৎসর - হেমলতা সরকার (বৈশাখ ১৩২৪ ); আবু পর্ব্বত - লেফ্টেনাণ্ট নলিনীমোহন রায়চৌধুরী (ভাদ্র ১৩২৫ ); বার্লিনের পথে - বিনয়কুমার সরকার (ফাল্গুন ১৩২৮); পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারী ? (বৈশাখ ১৩৩২); যবদ্বীপের পথে – সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (বৈশাখ ১৩৩৫ ); সুইট্জারল্যাণ্ডে গিরি-অভিযান – অশোক চট্টোপাধ্যায় (কার্ত্তিক ১৩৩৬); হিমালয়ের পারে কৈলাস ও মানস সরোবর; জাপান যাত্রা (সচিত্র)- শান্তা দেবী (কার্ত্তিক ১৩৪৪); কাশ্মীর ভ্রমণ - শান্তা দেবী (আশ্বিন ১৩৪৯); নাগপুরের পাহাড়-পর্ব্বতে - সুষমা বিদ (বৈশাখ ১৩৪৯ ); অরণ্যপথের ডায়ারি - পরিমল গোস্বামী (ফাল্গুন ১৩৫৩ ); প্রতিবেশী চীনের রাজ্যে - ধীরেন্দ্রনাথ রায় (বৈশাখ ১৩৫১ ); ব্রিষ্টলের কথা - চিত্রিতা দেবী (ফাল্গুন ১৩৫৬) ইত্যাদি। সে সময়ের বিভিন্ন স্থানের ভৌগলিক বিবরণ, মানুষের জীবনচর্যা, আচার আচরণ, ব্যবহার সম্বন্ধে একটি সুস্পষ্ট ছবি ফুটে ওঠে এসব কাহিনীর সচিত্র বর্ণনায়।
দীর্ঘজীবী ‘প্রবাসী’র যাত্রাপথে অনেকেই এর সান্নিধ্যের প্রত্যাশী ছিলেন। অন্য সাময়িক পত্রে লেখা প্রকাশিত হলেও ‘প্রবাসী’তে ছাপা না হলে যেন যথার্থ লেখকের মর্যাদা লাভ হল না এমন মনোভাব বিরল ছিল না। এমন কি ‘প্রবাসী’ মানে ‘প্রকৃষ্টরূপী বাসী’ বিশেষণ আরোপকারী কবি নজরুলও ‘প্রবাসী’তে তার কবিতা প্রকাশ করেছেন। বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ ‘কল্লোল’-এর লেখকদের রচনাও ‘প্রবাসী’ ছেপেছে। সবাইকে নিযেই ‘প্রবাসী’ এগিয়েছে। সমসাময়িক নামী লেখকদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম শরৎচন্দ্র।
‘প্রবাসী’ প্রসঙ্গে ইতি টানার আগে শরৎচন্দ্র প্রসঙ্গে কিছু লেখা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের পরেই শরৎচন্দ্রের খ্যাতি তখন সুতুঙ্গ। তার লেখা জনমানসে স্থায়ী আসন লাভ করেছে। অথচ ‘প্রবাসী’তে শরৎচন্দ্রের লেখা কখনও প্রকাশিত হয় নি, এটা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম এবং কিছুটা আশ্চর্যজনক। এর সঠিক কারণ জানতে অনেকেরই ঔৎসুক্য থাকতে পারে। শরৎচন্দ্র কেন ‘প্রবাসী’তে লেখা পাঠান নি অথবা ‘প্রবাসী’ কর্তৃপক্ষ কেন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের লেখা প্রকাশে আগ্রহ প্রকাশ করে নি তার কারণ আজ শুধু অনুমান করা যায়, কিন্তু অকাট্য প্রমাণ নেই। শরৎচন্দ্রের রচনা প্রকাশ নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল, ঘটনাচক্রে রবীন্দ্রনাথের নামও তাতে জড়িয়ে পড়েছিল; সংক্ষেপে সেটা দেখে নেওয়া যাক।
নরেন্দ্র দেব তার ‘সাহিত্যাচার্য শরৎচন্দ্র’ নামক পুস্তকে যে ঘটনা লিপিবদ্ধ করেছেন তাতে বলা হয়েছে - স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্রকে ‘প্রবাসী’তে লেখা পাঠাতে অনুরোধ করেন। সেই অনুসারে শরৎচন্দ্র লেখা পাঠালে ‘প্রবাসী’ থেকে বলা হয় যে মূল উপন্যাস পাঠানোর আগে একটি চুম্বক যেন পাঠানো হয় এবং মনোনীত হলে তখনই মূল লেখাটি পাঠাতে হবে। এতে শরৎচন্দ্র অপমানিত বোধ করেন এবং রবীন্দ্রনাথের নজরে সেটি আনলে কবি তাকে 'প্রবাসী'তে লেখা পাঠাতে বারংবার নিষেধ করেন। শরৎচন্দ্র তাই ‘প্রবাসী’তে কখনও লেখা পাঠান নি। লেখাটি পড়ে ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ ১৩৪৬-এর শ্রাবণ সংখ্যায় ‘প্রবাসী’তে যে উত্তর লেখেন সেটা তুলে দেওয়া হল - "ইতিপূর্ব্বে এই বহিখানি ও ইহাতে লিখিত এই কথাগুলি আমি দেখি নাই। এইজন্য ইতিপূর্ব্বে এগুলির প্রতিবাদ করি নাই। ২৩শে আষাঢ় ইহার প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। আমি চিঠি লিখিয়া বা মৌখিক শরৎ বাবুকে কস্মিন কালেও ‘প্রবাসী’তে লিখিতে অনুরোধ করি নাই। তাঁহার উপন্যাস ‘প্রবাসী’তে প্রকাশের জন্য কখনও আগ্রহ প্রকাশও করি নাই। সুতরাং "তিনি যা লিখবেন তার একটি চুম্বক করে পূর্ব্বাহ্ণে " আমাকে পাঠাইতে কখনও বলি নাই। রবীন্দ্রনাথ যে তাঁহাকে ‘প্রবাসী’তে লিখিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন ও পরে বারংবার নিষেধ করেন, ইহা আমি পূর্ব্বে কখনও শুনি নাই। সেই জন্য, এই খবর সত্য কিনা জানিবার নিমিত্ত কবিকে আমি চিঠি লিখিয়াছিলাম। তাহার উত্তরে লিখিত তাঁহার চিঠিটি নীচে মুদ্রিত হইল।
স্বভাবতই এর উত্তর দেবার দায় নরেন্দ্র দেবের উপর বর্তায়। তিনি ১৩৪৬-এর ভাদ্র সংখ্যার আলোচনা বিভাগে লিখেছেন যে, শরৎচন্দ্র নিজের মুখে একথা তাকে বলেছিলেন এবং সেটা চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা সমর্থিত। শরৎচন্দ্রের সুখদুঃখের সাথী, সম্পর্কে মাতুল, সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন যে প্রবাসী কর্ত্তৃপক্ষের চুম্বক চাওয়া নিয়ে শরৎকে চারুচন্দ্রের চিঠি এবং রবীন্দ্রনাথের চিঠি দুটোই তিনি নিজে দেখেছেন। বাদানুবাদ, পক্ষে এবং বিপক্ষে যুক্তির বিশদ বিবরণে না গিয়ে নরেন্দ্র দেব পাঁচজন বিশিষ্ট ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন যারা নরেন্দ্র দেবের প্রকাশিত তথ্যের সত্যতা স্বীকার করেছেন। এরা হ’লেন - সতীশচন্দ্র সিংহ (অধ্যাপক, গভর্ণমেণ্ট আর্ট স্কুল ); সুধীরচন্দ্র সরকার (সম্পাদক, 'মৌচাক'); কালিদাস রায় (কবিশেখর ); উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (সম্পাদক 'বিচিত্রা'); অবিনাশ ঘোষাল (সম্পাদক 'বাতায়ন')।
পরিশেষে এর উত্তর রামানন্দ দিযেছেন এবং জানিয়েছেন যে এ বিষয়ে আর কোনো আলোচনা ‘প্রবাসী’র জন্য গৃহীত হবে না। সত্যাসত্য এখন আর জানবার কোন উপায় নেই। তবে রামানন্দর মত সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তির একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য ; সেটি হল - "এই ঘটনাবলীর উৎপত্তি সম্বন্ধে কিছু সত্য কথা লিখিতে পারিতাম। কিন্তু লিখিতে গেলে যাঁহাদের নাম উল্লেখ করিতে হয়,তাঁহারা পরলোকে, সুতরাং তাঁহাদের সহিত মোকাবিলার উপায় নাই। অতএব এইখানেই ইতি।"
এ ত গেল অবাঞ্ছিত বাদানুবাদের বিষয়টি। কিন্তু শরৎচন্দ্র কোন লেখা ‘প্রবাসী’তে পাঠিয়েছেন এবং ‘প্রবাসী’ তা ফেরৎ পাঠিয়েছে এমন তথ্য জানা নেই। আবার ‘প্রবাসী’ সম্পাদকও, যিনি রবীন্দ্রনাথের লেখা প্রকাশের জন্য উদগ্রীব, তিনি কখনও জনপ্রিয় শরৎচন্দ্রকে লেখা পাঠাতে অনুরোধ করেন নি, তার সন্তোষজনক ব্যাখ্যাই বা কি হতে পারে ? মনে হয় শরৎচন্দ্রের ব্যক্তিজীবনের নানা ঘটনা নীতিনিষ্ঠ ও ধর্ম্মানুরাগী রামানন্দ মন থেকে মেনে নিতে পারেন নি। তার উপন্যাসে বর্ণিত বিষয়বস্তু সম্বন্ধেও রামানন্দ উৎসাহী ছিলেন না। সে সময়ে শরৎচন্দ্রের লেখার বিরূপ সমালোচনা করে বহু লেখা ‘প্রবাসী’তে পাঠানো হয়েছে কিন্তু ‘প্রবাসী’তে সেগুলি প্রকাশিত হয় নি। এ সম্বন্ধে সম্পাদকের বক্তব্য (প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৬) "শরৎ বাবুর কোন কোন বহির প্রতিকূল সমালোচনা আমাদের না-ছাপিবার আর একটি কারণ এই যে, তাঁহার যে যে বহির নিন্দা আমরা শুনিয়াছি সে বহিগুলি বাস্তবিক নিন্দনীয় কি না প্রত্যক্ষ জ্ঞান হইতে তাহা বলিতে পারি না, কারণ সেগুলি আমরা পড়ি নাই।" এ হল রামানন্দর ঔদাসীন্যের সম্ভাব্য কারণ। পক্ষান্তরে শরৎচন্দ্র কেন ‘প্রবাসী’তে লেখা পাঠান নি ? হতে পার এর একটি কারণ অভিমান। ‘প্রবাসী’ সম্পাদক যে রবীন্দ্রনাথের লেখা পেতে বিশেষ আগ্রহী এ কথা তখন সবাই জেনেছেন, কিন্তু শরৎচন্দ্রের কাছে কখনও ‘প্রবাসী’ থেকে লেখা চাওয়া হয় নি - এটা আপাতভাবে ক্ষোভের কারণ হতেই পারে - বিশেষ করে শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তা যখন অসাধারণ। এটাও হতে পারে যে শরৎচন্দ্র মনে করেছেন ‘প্রবাসী’ যে ধরণের রচনা প্রকাশ করে তাতে একটু বিদগ্ধতা ও আভিজাত্যের ছাপ রয়েছে, মাটির কাছের পরিত্যক্ত দুর্দ্দশাগ্রস্ত লোকের দৈনন্দিন সুখ দুঃখের নিরাবরণ বিবরণ সে অর্থে ঠিক হয় ত ‘সাহিত্যপদবাচ্য’ হবে না। এ সবই অবশ্য অনুমান সাপেক্ষ। তবে শরৎচন্দ্র, রামানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে অন্যান্য বহু ব্যক্তি কারণে অকারণে জড়িয়ে গিয়ে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে গিয়েছে। তবে শরৎচন্দ্রের লেখা প্রকাশ নিয়ে রামানন্দ বলেছেন 'Modern Review' ও 'প্রবাসী'র কর্ত্তৃপক্ষ একই। 'Modern Review' যদি শরৎচন্দ্র রচিত ‘বিন্দুর ছেলে’র অনুবাদ বের করতে পারে তবে শরৎচন্দ্রের লেখা ‘প্রবাসী’তে অগ্রাহ্য হবে কেন ? যাই হোক, সংশ্লিষ্ট সকলেই এখন লোকান্তরিত। এ রহস্য চিরদিন তাই অন্তরালেই রয়ে যাবে। ১৩৪৬-এর ভাদ্র সংখ্যায় ‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও “প্রবাসী”’ নামক আলোচনায় বিষয়টি সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে।
কিছু নির্দিষ্ট বিভাগের আলোচনা করে বা প্রকাশিত কিছু রচনার শিরোনাম উল্লেখ করে কোন পত্রিকার পরিচয় প্রদানের চেষ্টা নিতান্তই যান্ত্রিক ও অসঙ্গত। এদ্বারা বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য কিছুটা অনুধাবন করা গেলেও সামগ্রিক ভাবে রসাস্বাদন সম্ভব নয়। প্রতিমাসে প্রকাশিত ‘প্রবাসী’র পৃষ্ঠা সংখ্যা বিজ্ঞাপন বাদ দিয়ে ছিল ছিয়ানব্বই, অর্থাৎ পত্রিকা নয়, ছোটখাটো একটি বই। ইতিহাস বিষয়ক কত কাহিনী যে ‘প্রবাসী’র পৃষ্ঠায় আকীর্ণ রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। যথার্থই মন্তব্য করা হয়েছে – “ প্রবাসীর ইতিহাস বিষয়ক লেখাগুলির আলোচনা করতে গেলে অরণ্যে পথ হারানো মূঢ় বালকের মতো আঁকুপাঁকু পথ সন্ধান হয়ে দাঁড়াবে। তা করার প্রয়োজন নেই। কেবল বলা চলে, কেউ বাংলায় ইতিহাস চর্চার চর্চা করবেন অথচ প্রবাসীর পৃষ্ঠা ওলটাবেন না তিনি নির্ঘাত ট্রেন থেকে বেণীমাধবের ধ্বজা দেখে কাশীদর্শন সাঙ্গ করেছেন ধরে নিতে হবে।”
দীর্ঘায়ু একটি পত্রিকার বিষয়বস্তুর বিশাল সম্ভার ও বৈচিত্র্য আলোচনা করলেও ( প্রসঙ্গতঃ ‘প্রবাসী’তে মোট লেখক সংখ্যা সাড়ে তিনশ’র বেশি ) সমসাময়িক রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে আলোচনা, মতামত ও পত্রিকার অভিমুখ বহুলাংশে নির্ভর করে সম্পাদকের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গীর উপর। সম্পাদকীয় প্রবন্ধের নির্বাচন ও বিশ্লেষণ তো পুরোটাই সম্পাদক-নির্ভর ( অবশ্য পরিচালক মন্ডলী থাকলে আলাদা কথা )। কি ধরণের লেখা পত্রিকায় স্থান পাবে তার দায়িত্বও সম্পাদকের। ‘প্রবাসী’র ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই তাই পত্রিকার অভিমুখে রামানন্দর চিন্তাধারা ও মননের প্রতিফলন ঘটেছে। কয়েকজন রাজনৈতিক বা অন্য ভাবধারার ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে রামানন্দর মতামত অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য না ও হতে পারে। খুব সংক্ষেপে এরকম কয়েকজনের উল্লেখ এখানে করা হ’ল –
সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধায় – “সরকার-বিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্ব-শিখর থেকে ব্রিটিশ সরকারের তাঁবেদারি মন্ত্রিত্ব-গ্রহণ পর্যন্ত এর রাজনৈতিক জীবনের গতিধারা রামানন্দের চোখের সামনে খোলা ছিল।” কিন্তু তার প্রয়াণে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে সুরেন্দ্রনাথের জীবনের কার্যাবলীর মনোজ্ঞ আলোচনা করে লিখেছেন – “ বাংলা হইতে আরম্ভ করিয়া সুদূর উত্তর ভারত সম্বন্ধে ইহা সত্য যে, সুরেন্দ্রনাথ এই ভূখন্ডে সর্বসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রবর্তক ও অগ্রণী।”
চিত্তরঞ্জন রবীন্দ্রনাথের সামাজিক ধারণার সমালোচক ছিলেন, স্বভাবতই রবীন্দ্রভক্ত রামানন্দ ছিলেন চিত্তরঞ্জন বিরোধী। এছাড়া সাধারণভাবে গান্ধী নীতির সমর্থক রামানন্দ চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ্য দল গঠন সমর্থন করেন নি। তবে রামানন্দ হয়তো প্রথমে চিত্তরঞ্জনের জনপ্রিয়তা সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন নি। পরিশেষে তার প্রয়াণে চিত্তরঞ্জনের নামের আগে ‘দেশবন্ধু’ শব্দটি যুক্ত করে দীর্ঘ সম্পাদকীয় রচিত হয়েছে।
সুভাষ চন্দ্র বসু রামানন্দের পছন্দের লোক ছিলেন না। সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক গুরু চিত্তরঞ্জনকে রামানন্দ খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখেন নি। দ্বিতীয়তঃ ব্রাহ্ম-পরিচালিত সিটি কলেজে হিন্দু ছাত্রদের সরস্বতী পূজার আন্দোলনে সুভাষ চন্দ্রের সমর্থন রামানন্দ মেনে নেন নি, ‘প্রবাসী’তে সুভাষ চন্দ্র এর জন্য সমালোচিতও হয়েছেন।
রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সম্বন্ধে রামানন্দর চিন্তাধারা একটু বিভ্রান্তিকর। কালীভক্ত রামকৃষ্ণ ‘পৌত্তলিক’ হওয়া সত্বেও রামানন্দ তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। ১৩৪২-এর মাঘ সংখ্যায় তিনি লিখেছেন – “রামকৃষ্ণ যে ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, ইহা ভারতবর্ষের পরম গৌরব। হিন্দুজাতির ও ভারতবর্ষের নিন্দুকেরা যাহাই বলুক, এদেশে যে আধুনিক যুগেও মহাপুরুষেরা আবির্ভূত হন, তাহাতেই প্রমাণ হয় যে, ভারতবর্ষ অধম দেশ নহে, হিন্দু জাতি অধম জাতি নহে।” কিন্তু প্রথম দিকে ব্রাহ্মসমাজের সমর্থক বিবেকানন্দ হঠাৎ কালীভক্ত রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করাকে রামানন্দ মেনে নিতে পারেন নি। প্রথম দিকে তিনি ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। তবে বিবেকানন্দ ছিলেন রামমোহন ভক্ত ও সেবাধর্মে নিবেদিতপ্রাণ। তাই বিবেকানন্দকে তিনি শেষ পর্যন্ত সরিয়ে রাখতে পারেন নি। নিবেদিতার “Notes of Some Wanderings with the Swami Vivekananda” বইটি পড়ে ১৩২০-এর বৈশাখ সংখ্যায় তিনি লিখেছেন – “ বহিখানি পড়িয়া মনে হইল, এরূপ একজন অসামান্য ব্যক্তির সহিত ভারত-ভ্রমণ কি সৌভাগ্য। ... বিবেকানন্দ সকল সম্প্রদায়ের লোকেরই গুণগ্রাহী ছিলেন। তিনি হিন্দুধর্মকে ক্রিয়াশীল অধর্মের সহিত সমরপন্থী এবং দীক্ষাদ্বারা অহিন্দুকেও নিজ ক্রোড়ে আশ্রয়দানে যত্নবান করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। তিনি নিজে মুসলমানের, সকল জাতির, অন্ন ও জল গ্রহণ করিতেন, এবং স্পৃশ্যাস্পৃশ্য বিচারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। বুদ্ধদেব তাঁহার প্রধান শিষ্য আনন্দকে এই মর্মে উপদেশ দিয়াছিলেন, ‘তোমরা নিজেই নিজের আলোক হও; নিজের চেষ্টা দ্বারা নিজের মোক্ষ সাধন করো।’ বিবেকানন্দও ভারতবাসীর অন্তর্নিহিত শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। চেষ্টা বিফল হয় নাই।”
দীর্ঘ প্রায় ৪২ বছর রামানন্দ ‘প্রবাসী’ সম্পাদনা করেছেন। তার মৃত্যুর পর পুত্র কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদক হিসাবে ‘প্রবাসী’র হাল ধরেন ১৩৫০-এর অগ্রহায়ণ থেকে। নতুন সম্পাদক লিখেছেন – “ বর্তমান মহা সঙ্কটের সময় ‘প্রবাসী’ পরিচালনার গুরু দায়িত্বভার আমাদের উপর ন্যস্ত হইয়াছে। ঋষিপ্রতিম সেই প্রধান কাণ্ডারীর অভাব প্রতি মুহূর্তে আমরা অনুভব করিতেছি। তাঁহার পদাঙ্ক অনুসরণ করিয়া চলিবার চেষ্টায় আমরা কখনও বিরত হইব না।”
‘প্রবাসী’র শেষ সংখ্যাটি কবে বেরিয়েছিল সে তথ্য এখনই হাতের কাছে নেই। তবে ১৩৭১ বঙ্গাব্দের চৈত্র অবধি অন্তত প্রকাশিত হযেছিল ‘প্রবাসী’। পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের ‘পত্রিকা’ নামক প্রবন্ধ ( ‘পরিচয়’, কার্তিক ১৩৩৮ ) থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়েই ইতি টানা যাক - “প্রবাসী-জাতীয় পত্রিকা দেশের একটা প্রয়োজন সিদ্ধি করেচে। জনসাধারণের চিত্তকে সাহিত্যের নানা উপকরণ দিয়ে তৃপ্ত করা এর ব্রত। এতে মনকে একেবারে জড়তায় জড়াতে দেয় না, নানা দিক থেকে মৃদু আঘাত দিয়ে জাগিয়ে রাখে।”
দীর্ঘ ছয় দশকের বেশি সময় ধরে উৎকর্ষতা বজায় রেখে, বৈচিত্রে ভরপুর বিষয়বস্তু পরিবেশনায় বহু শ্রেণীর পাঠকের মনোরঞ্জন করে ‘প্রবাসী’ সাময়িক পত্র তথা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এবং বাঙালীর মনন ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে রয়েছে। সংযুক্ত প্রতিলিপি পরিচয় - চিত্র ৩ : কার্ত্তিক ১৩৬১ সংখ্যার প্রচ্ছদ। চিত্র ৪ ও ৫ : পত্রিকায় প্রকাশিত দু’টি বিজ্ঞাপন ( ১ম সংখ্যায় ও ১৩৪৮ কার্ত্তিক সংখ্যায় )। চিত্র ৬ : আষাঢ় ১৩১৬ সংখ্যায় নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি।
চিত্র ১ : বৈশাখ ১৩০৮-এ প্রকাশিত ‘প্রবাসী’র প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ।
চিত্র ২ : পত্রিকার ৩য় বর্ষের একটি সংখ্যার আখ্যাপত্র।
চিত্র ৩ : কার্ত্তিক ১৩৬১ সংখ্যার প্রচ্ছদ।
চিত্র ৪ ও ৫ : পত্রিকায় প্রকাশিত দু’টি বিজ্ঞাপন ( ১ম সংখ্যায় ও ১৩৪৮ কার্ত্তিক সংখ্যায় )।
লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.