চীনের
প্রাচীরে হাফ-ম্যারাথন

“এই যে আসছেন নম্বর
১৩৯৫, ইউ…. এস ….এ…-র শ্যাম আধিকারী” ফিনিশ লাইন ছুঁতে
ইন ইয়্যাং স্কোয়ারে ঢোকার মুখেই ঘোষণা শুনলাম। আর মাত্র
১০০ ফুট। আমি দু হাত তুলে শেষ পথটুকু দৌড়ে যখন লাল কার্পেট
পা দেওয়া মাত্র আমার জুতোর ফিতেতে বাঁধা চ্যাম্পিয়ান চিপ
বেজে উঠল, সেখানে সময় দেখাচ্ছে ৩ ঘণ্টা ৩৩ মিনিট ৫৩ সেকেণ্ড
(আহা, যদি আগে জানতাম, তাহলে আরেকটু দ্রুত ছুটে সব কটাকেই
৩ করে দিতে পারতাম!)। আমার স্বপ্ন সার্থক। নীল আকাশের
দিকে মাথা তুলে ভগবানকে ধন্যবাদ দিলাম। এক ডজন ফটোগ্রাফার
সামনে জটলা করে দাঁড়িয়ে। দৌড় শেষ করা মাত্র প্রত্যেক প্রতিযোগীর
ছবি তুলছে। আমারও তুলল।

আমি
দু হাত তুলে শেষ পথটুকু দৌড়ে যখন লাল কার্পেট পা দেওয়া
মাত্র ..
দূরে ভীড়ের মধ্যে
আমার স্ত্রী দাঁড়িয়ে। সেদিকে তাকিয়ে আমি একগাল হাসলাম।
সেই হাসি প্রায় দুসপ্তাহ মুখ থেকে অদৃশ্য হয় নি! কিন্তু
মাত্র পাঁচ ঘণ্টা আগেও আমায় যদি কেউ দেখতো! আমার বুক তখন
ধড়ফড় করছে, মনে নিদারুণ ভয় - শেষরক্ষা হবে কি? মুখ দেখাবো
কি করে!
আমার স্ত্রী ও অন্যান্যদের
সঙ্গে করে আমি বেইজিং পৌঁছেছিলাম ২০১০ সালের মে মাসের
১১ তারিখে। উঠেছিলাম শহরের মাঝখানে রেনেসাঁ হোটেলে। পরের
দিন বেড়াতে বেরিয়েছিলাম – দেখলাম স্বর্গের মন্দির (টেম্পল
অফ হেভেন), নিষদ্ধ শহর (ফরবিডেন সিটি) এবং তিয়েন মিয়েন
স্কোয়ার। সারাদিন অনেকটা পথ হেঁটে সবাই ক্লান্ত।
তার পরের দিন (মে
১৩) সকাল বেলা ভোর সাড়ে পাঁচটায় হোটেল থেকেই থেকে বাসে
করে রওনা দিলাম চীনের প্রাচীররের (গ্রেট ওয়াল) উদ্দেশ্যে।
সব প্রতিযোগীকেই ওখানে গিয়ে ম্যারাথনের পুরো পথটা দেখে
নিতে হয় – এটাই নিয়ম। প্রতিটি দৌড়বীরকে একটা বিশেষ জায়গায়
গিয়ে এক নাগাড়ে ২৫৮১ সিঁড়ি ভেঙ্গে (সিঁড়ির উচ্চতা অসমান
- কয়েক ইঞ্চি থেকে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত) দুমাইল হাঁটতে
বা দৌড়তে হয়। এ জায়গাটি একদিন থেকে অপূর্ব সুন্দর, কিন্তু
দৌড়বার দিক থেকে সবচেয়ে কঠিন এবং ভয়াবহ। এই দৌড় করানোর
উদ্দেশ্য যাতে প্রতিযোগীরা কী ভাবে পুরো পথটা দৌড়বে তার
স্ট্র্যাটেজি স্থির করে নিতে পারে। এই সুযোগে প্রতিযোগীরা
বিশাল উঁচু প্রাচীর সামনা সামনি দেখার সুযোগ পায়। এঁকে
বেঁকে সর্পিল ভাবে পাহাড়ের খাঁজের মধ্যে দিয়ে কী ভাবে
এই প্রাচীর বিস্তৃত সেটা উপলব্ধি করতে পারে। উদ্দেশ্য
হল, দেখার পর কেউ যদি নাম প্রত্যাহার করতে চায়, অথবা পুরোটা
না দৌড়ে অল্প পথ দৌড়তে চায়, সেটা স্থির করার সুযোগফ দেওয়া।
এটাও বলে নি, যে পথটুকি আমরা বাসে গিয়েছি, আসল রেসের দিন
সেই পথাটা আমাদের দৌড়তে হবে। তারপর দৌড়ানোর জন্যে সিঁড়ি
ভেঙ্গে উঠতে হবে প্রাচীরের ওপর।

এ যেন এক
রোলার কোস্টার রাইড
শুরু হল আমাদের ট্ট্রায়াল
২ মাইল দৌড়! এ যেন এক রোলার কোস্টার রাইড – তফাৎ শুধু
আমরা আরাম করে সিটে বসে নই, দৌড়োতে গিয়ে আমরাই উঠছি নামছি
– আঁকাবাঁকা পথের সঙ্গে তাল রেখে একবার বাঁদিকে একবার
ডানদিকে হেলছি। সামনের সিঁড়িগুলো অসমান - উঁচু নীচু; অনেক
জায়গায় শুধু উঁচু মেঠো রাস্তা। চীনের প্রাচীর ইঁট এবং
পাথর দিয়ে তৈরি।

প্রাচীরের অনেকটা অংশ ২০ ফুটের মত চওড়া - দু-পাশে পাঁচিল।

মুশকিল হল
সিঁড়িগুলো সমান উঁচু নয়...
মোটামুটি ভাবে ২০
ফুট চওড়া, দুপাশে দুটো পাঁচিল। মুশকিল হল সিঁড়িগুলো সমান
উঁচু নয়, কয়েক ইঞ্চি থেকে প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। অর্থাৎ
কোনও মতেই নির্দিষ্ট গতি বজায় রেখে দৌড়নো সম্ভব নয়। আবার
কোনও কোনও জায়গায় বাঁদিকের পাঁচিলের চিহ্ন মাত্র নেই,
অর্থাৎ তাল সামলাতে না পারলে – পপাত নীচে ধরণীতলে!

সেই
সব জায়গায় মোটা নাইলনের দড়ি ডানদিকে পাঁচিলে আটাকানো রয়েছে...
কয়েকটা জায়গা আছে
যেখানে পথ খুবই ঢালু আর সরু, বড়জোর চার ফুটের মত চওড়া।
সেখানে পাথরের সিঁড়িগুলো নানান সাইজের। সেই সব জায়গায়
মোটা নাইলনের দড়ি ডানদিকে পাঁচিলে আটাকানো রয়েছে, ভারসাম্য
রক্ষা করে যাতে চলতে পারা যায়। ওই জায়গাগুলোতে সবাইকেই
আস্তে আস্তে যেতে হয়, দড়িতে হাত কাটার বা স্লিপ খাবার
প্রভূত সম্ভাবনা। ভীড় সেই জায়গাগুলোতেই সবচেয়ে বেশী হয়।
শেষ পথটুকু খুবই ঢালু – দীর্ঘ ও লম্বা। লাইন না বেঁধে
যাওয়া যায় না। যদিও পথগুলো আগেই পরিষ্কার করা হয়েছে, তাও
দেখলাম কিছু কিছু নুড়ি এদিক ওদিক ছড়িয়ে আছে। সতর্ক না
হলেই হোঁচট। এরপর আরও একমাইল মত চীনের প্রাচীরের পাশে
ঘুরে আমরা ইন ইয়্যাং স্কোয়ারে এসে ঢুকলাম। এখানেই হল আমাদের
আবশ্যিক দৌড় প্র্যাক্টিসের সমাপ্তি। নিরাপদে ফিরে আসতে
পেরেছি বলে সবাই খুসী। তখন বুঝি নি রেসের দিন এর জন্যে
একটা সমস্যা হবে।
শুক্রবার ১৪ই মে,
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলাম দুটো পায়েই ব্যথা, নড়াতে কষ্ট
হচ্ছে। আগের দিন চীনের প্রাচীরে প্র্যাক্টিস দৌড়নোর ফল!
সকাল আটটায় চীন দেশের রাজার গ্রীষ্মের প্রাসাদ দেখতে যাবার
জন্যে বাস ধরতে এসে দেখি, শুধু আমি নই – সবারাই এক অবস্থা!
গাইডরা কি বলছে কারোরই শোনার অবস্থা নেই – নিজেদের কার
কত ব্যথা হয়েছে এবং কী ভাবে এর মোকাবিলা করা যায় - তার
আলোচনাতেই আমরা মগ্ন। আমাদের দৌড়ের আর মাত্র ২৪ ঘণ্টা
বাকি! তখন বুঝলাম প্রাসাদ দেখতে এসে ভুলই করেছি। হোটেলে
থেকে পায়ের পরিচর্যা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হত! শেষে
ট্যুর গাইডকে বলেই ফেললাম, আমাকে হোটেলে পৌঁছে দিতে। সবাই
সেটা সমর্থন করল। বিকেল ৪-টের সময় আমাদের হোটেলে নামিয়ে
দেওয়া হল। হোটেলে ফিরে সঙ্গে সঙ্গে আমি বাথ টাব-এ গরম
জল দিয়ে সেখানে বসে প্রায় এক ঘন্টা পা ম্যাসাজ করলাম।
তাড়াতাড়ি ডিনার খেয়ে সাতটা নাগাদ শুয়ে পড়লাম।
শনিবার ১৫-ই মে।
আজকেই হল বিরাট দিন। আমি ভোর দুটোর সময় উঠে পড়লাম। ভোর
সাড়ে তিনটের সমপয় বাস এসে আমাদের নিয়ে যাবে তিয়াঞ্জিন,
হুয়ান্গ্যাগুয়ানের ইন ইয়্যাং স্কোয়ারে। বাসে প্রায় তিন
ঘন্টার পথ। ম্যারাথন দৌড় শুরু আর শেষ হয় ইন ইয়্যাং স্কোয়ারে।
এটা চীনের প্রাচীর ঘেঁষে একটা চৌকো মাঠ, অন্য তিনদিকে
কংক্রিটের চেয়ার দেওয়া গ্যালারি।
দৌড় শুরু সাড়ে সাতটার
সময়। তার এক ঘণ্টা আগে গিয়ে গন্তব্য স্থলে পৌঁছলাম। গ্রুপ
ছবি তোলা, স্ট্রেচিং এক্সার্সাইজ এবং মেয়েদের তত্ত্বাবধানে
সবাই মিলে এয়ারোবিক এক্সারসাইজ করতে করতেই সময়টা কেটে
গেল। একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান হল সেখানে সেই প্রদেশের মেয়র
এবং অন্যান্য ভি আই পি-রা দর্শকদের সঙ্গে উপস্থিত থেকে
আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।
আবহাওয়া ঠাণ্ডা –
৫০ ডিগ্রী ফারেনহাইট। দৌড়ের আগে আমাদের সবার গলা থেকেই
নানান উৎসাহ ব্যাঞ্জক কথা বেরোচ্ছে - সবাই সবাইকে উৎসাহ
দিচ্ছি। ভাবটা এটা কিছুই নয়। দৌড়োতে হবে তো অর্ধেক ম্যারাথন,
অর্থাৎ মাত্র ১৩.১ মাইল। মনে মনে অবশ্য আমার চিন্তা কি
ভাবে পথাটা পার হব। পায়ে, বিশেষ করে ডানদিকের পায়ে তখনো
ব্যথা।
ঠিক সাড়ে সাতটায়
বন্দুকের আওয়াজে দৌড় আরম্ভ করার সঙ্কেত দেওয়া হল। তার
কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই অল্প বিস্তর হাঁফাতে শুরু করলাম।
এর আগে বৃহস্পতিবার প্রথম তিন মাইল গিয়েছিলাম বাসে চড়ে,
তাই বুঝি নি যে গ্রেট ওয়ালের নীচ পর্যন্ত যাওয়ার পথটা
কতটা চড়াই – প্রায় ৫০০ ফুট উঁচুতে উঠতে হয়! পাহাড়ি রাস্তা
সাপের মত এঁকেবেঁকে চলেছে। আমার মত বেশীর ভাগ প্রতিযোগীই
দেখলাম কিছুক্ষণ দৌড়বার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে হেঁটে হঁটে
চলেছে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে চীনের প্রাচীর বা গ্রেট ওয়ালে
পৌঁছনোর আগেই দম ফুরিয়ে গেলে তো মুশকিল! প্রায় ৪৫ মিনিট
লেগে গেল প্রাচীরের নীচে পোঁছতেই। দেখলাম বড় করে সাইন
‘প্রাচীরের প্রবেশ পথ’। অর্থাৎ এবার শুরু হচ্ছে আসল দৌড়!
আমার
ডান পায়ে ব্যথা। তাই বাঁ পায়ে জোর দিয়ে ডান পাটাকে টেনে
টেনে নিয়ে এগোলাম। সিঁড়ি ভাঙবার সময়ে – ওঠাই হোক বা নামাই
হোক - আমার একটাই স্ট্র্যাটেজি শ্রেফ হাঁটা। আর যেখানে
সরু রাস্তার জন্যে সবাই লাইন দিয়ে আস্তে আস্তে যাচ্ছে,
সেখানে পা-টা একটু বিশ্রাম পাচ্ছে, আমিও দম নিয়ে নিচ্ছি।

আমার
একটাই স্ট্র্যাটেজি শ্রেফ হাঁটা
প্রায় এক ঘন্টা
ধরে ২৫৮১-টা সিঁড়ি ভেঙ্গে ১৬০০ ফুট উঁচুতে ওঠার পর নীচে
নেমে আমরা একটা সমতলে বেইজিং হাইওয়ে এসে পড়লাম। এবার ২
মাইলের মত পাকা রাস্তা। তবে রাস্তায় গাড়ি, ট্র্যাক্টর,
সাইকেলের ভীড় – সেগুলো দেখে দৌড়তে হবে।

এবার ২ মাইলের
মত পাকা রাস্তা।
হাইওয়ের শেষে খালের
পাশ দিয়ে খোয়া আর কাঁকর বিছানো এক মাইলের মত ধূলো ভরা
পথ। আস্তে আস্তে গাড়িগুলো সেখান দিয়ে গেলেও বাতাস ধূলোয়
ভরে যায়। ধূলো খেতে খেতে খানিকটা গিয়ে বাঁ দিকে ৯০ ডিগ্রী
ঘুরে আমরা ডুয়ানজুয়াং গ্রামের ভেতর দিয়ে একটা এবড়ো খেবড়ো
রাস্তায় পড়লাম। ইঁট আর পাথর দেওয়া রাস্তা – প্রতিটি পদে
হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়াও আশঙ্কা। রাস্তা সরু দু-পাশ
ঘেঁষে গ্রামের বাড়ি। সেখান থেকে আবার মাঝে মধ্যে মুরগি
বা হাঁস বেরিয়ে আসছে। কিছুটা পথ চড়াই। এই পথ দিয়েই গ্রামের
লোকেরা মাঠে কাজ করতে যায়। তবে তখনো যায় নি। রাস্তার দুধারে
লাইন করে দাঁড়িয়ে আমাদের উৎসাহ দিচ্ছে। হাত তুলে ‘হাই
ফাইভস’ দেখালো বেশ কয়েকটা ছোটো ছেলে। গ্রামের মধ্য দিয়ে
দুমাইলের মত দৌড়ে আবার আমরা বেইজিং হাইওয়েতে এসে পড়লাম।
এবার যাচ্ছি উলটো দিকে - ইন ইয়াং স্কোয়ারের দিকে।...
আর দুমাইল গেলেই
ফিনিশিং লাইন। স্কোয়ারের কাছাকাছি আসতেই লাউড স্পিকার-এ
যারা স্কোয়ারের দোর গোড়ায় পোঁছে গেছে তাদের নাম ঘোষণা
করা হচ্ছে শুনতে পাচ্ছি, সেই সঙ্গে জনতার উচ্ছাস। অবশেষে
আমি আমি স্কোয়ারের মাঠে পা রাখলাম, কানে ভেসে এলো আমার
নাম। ফিনিশিং লাইন পার হয়ে মনে হল সব পরিশ্রম সার্থক।
সময় লাগলো ৩ ঘণ্টা ৩৩ মিনিট ৫৩ সেকন্ড। যতটা সময় লাগবে
ভেবেছিলাম, তার থেকে কিছুটা বেশী। আমি যদি নিজে রিপোর্টার
হতাম, তাহলে প্রথমেই বড় বড় অক্ষরে লিখতাম - চীনের প্রাচীরের
৫১৮২ সিঁড়িকে দুদিনে দুবার মাথা নত করতে হয়েছে ৬৯ বছর
বয়সের ঘনশ্যাম অধিকারীর কাছে!
মাওসে তুং একবার
বলেছিলেন, যে ব্যক্তি চীনের প্রাচীর আরোহন করে নি, সে
ব্যক্তি মনুষ্য নয়। মাও বোধহয় ২০১০ সালের ১৫-ই মে কি ঘটবে
জানতেন না। জানলে কথাটা একটু পালটে বলতেন। শুধু আরোহন
নয় ৫৩ টা দেশের ২৫০০ প্রতিযোগী চীনের প্রাচীরে ম্যারাথন
দৌড়ও দৌড়েছে। বেশীর ভাগ লোকের কাছে চীনের প্রাচীর দেখাটাই
একটা বিরাট ব্যাপার, তবে বছরে অন্তত একটা দিন কিছু লোক
কয়েক ঘণ্টা দৌড়ে ২০০০ বছরের ইতিহাসের অনেকাংশ উপভোগ করার
সুযোগ পায়।
ঘনশ্যাম
অধিকারী