প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

কান পেতে রই...

অবসর (বিশেষ) সংখ্যা , ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪

 

কলকাতার রেডিও -- ম্যাজিক লণ্ঠনের পেছনে

সুজন দাশগুপ্ত

 

আমাদের ছেলেবেলায় বাড়িতে বসে নামিদামি শিল্পীদের গান বাজনা শুনতে হলে রেডিও চালাতে হত। সে রেডিও এখনকার যুগের FM রেডিও নয়। আদ্যিকালের খরখর আওয়াজের রেডিও। অনেকেরই রেডিও কেনার সামর্থ্য ছিল না। প্রতিবেশীর বাড়িই ছিল ভরসা। যাদের বাড়িতে রেডিও আছে, প্রায়ই দেখতাম তাদের ছাদে লম্বা দুটো বাঁশে আটকানো তারের এরিয়াল ( অ্যান্টেনা) ঝুলছে -- সেটা না থাকলে রেডিওতে ঠিকমত আওয়াজ আসত না! সবাইকে, বিশেষ করে কাজের লোকদের সতর্ক করা হত সেই তারের ওপর যেন কাপড় শুকোতে না দেওয়া হয়। দিলেই নাকি মৃত্যু! ট্রানজিস্টর তখনও বাজারে আসে নি। ভ্যাকুয়াম টিউব বা (থারমিওনিক) ভালভ ব্যবহার করা হত। সেগুলো আবার ঠিকমত গরম না হলে কাজ করতে পারত না। অর্থাৎ, রেডিও ‘অন’ করলেই যে আওয়াজ আসবে তা নয় – একটু ধৈর্য ধরতে হবে! খর খর আওয়াজ, যাকে বলা হয় ‘স্ট্যাটিক’ প্রায় সব রেডিওতেই অল্পবিস্তর শোনা যেত – বিশেষ করে কলকাতার একটু বাইরে গেলেই সেই বিরক্তিকর আওয়াজ কথা আর গানের সঙ্গে পাল্লা দিত। দূরত্বটা খুব বেশী হলে আবার লোকাল রেডিও (মিডিয়াম ওয়েভ) একেবারেই কাজ করত না। দরকার পড়ত অল ওয়েভ (যাতে শর্ট আর মিডিয়াম ওয়েভ – দুটোই আছে) রেডিওর। অর্থাৎ বেশ কিছু পয়সার ধাক্কা!

এটা পড়ে কেউ যদি ভাবেন আমরা খুব দুঃখে ছেলেবেলা কাটিয়েছি – সেটা সম্পূর্ণ ভুল । এটা ঠিক ছেলেবেলায় FM রেডিওর শ্রুতি মধুর আওয়াজ শোনার সুযোগ পাই নি - টিভিও দেখি নি। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট, স্মার্ট ফোন, স্মার্ট টিভি – এগুলো যে কী বস্তু – আমাদের চিন্তার অগোচরে ছিল। বিনোদন জগতে ডিজিটাল টেকনোলজির এই বিস্ফোরণের অনেক আগেই আমরা আমাদের ছেলেবেলা পার করে ফেলেছি। আমাদের ছেলেবেলায় রেডিওই ছিল রানী। সেখান থেকেই ভেসে আসত গান বাজনা, দেশ-বিদেশের খবর, খেলার ধারা বিবরণী, নাটক, কি নয়! বিশাল পৃথিবীটা এই রেডিওর মধ্যে দিয়েই ধরা পড়ত! গ্রামোফোন অবশ্য ছিল। তাতে 78 RPM-এর রেকর্ড বাজানো যেত হ্যাণ্ডেলে দম মেরে। কিন্তু হাত খরচের পয়সা বাঁচিয়ে পছন্দসই কটা রেকর্ডই আর কিনতে পারতাম! ফিরে আসতে হত সেই রেডিও-রানীর কাছেই। ভোর হতে না হতেই বহু বাড়িতে রেডিও চালিয়ে দেওয়া হত। খানিক বাদেই ভেসে আসত.. অতি পরিচিত একটি সুর। স্টেশন চালু হলে ঘড়ির সময় মেলানোও ছিল একটা রুটিন।

আমি জন্মেছিলাম রেডিও যুগে। আমার বাবা-মায়ের ছেলেবেলা কেটেছে রেডিও যুগের আগে। রেডিও কলকাতায় প্রথম এসেছিল ১৯২০ সালে। ওই বছরই মুম্বাই, চেন্নাই ও কলকাতায় বিভিন্ন বেসরকারি উদ্যোগে রেডিও স্টেশন চালু হয়। কিন্তু বেশীর ভাগই পাততাড়ি গোটায় শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই। ইংল্যান্ডের মার্কোনি সংস্থা কলকাতায় রেডিও নিয়ে কিছুদিন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তাদের একটা ট্রান্সমিটার ক্যালকাটা রেডিও ক্লাবকে ধার দেয় ১৯২৩ সালে। আরেকটা ট্রান্সমিটার দেয় স্থানীয় সরকারকে। ১৯২৭ সালে দুটো রেডিও স্টেশনই বন্ধ হয়ে যায় যখন ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে মুম্বাইয়ের (তখনকার বম্বে) একটি বেসরকারি সংস্থা, ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি (Indian Broadcasting Company), রেডিও সম্প্রচারের দায়িত্ব নেয়। সরকারি ভাবে কলকাতার রেডিও অফিসের উদ্বোধন হয় ১৯২৭ সালের ২৬ শে অগাস্ট। অফিসের ঠিকানা ১ নম্বর গারস্টিন প্লেস। গারস্টিন প্লেস-এর এই বাড়িটার এক কালে কুখ্যাতি ছিল ভূতের বাড়ি বলে। ওখানে নাকি রাত্রে ভূত দেখা যেত! তবে কিনা, রেডিও তো তখন ছিল একটা ভৌতিক ব্যাপারই! অতএব, ভূতে ভূতক্ষয়!

কলকাতা রেডিও স্টেশনের প্রথম ডিরেক্টর ছিলেন একজন সাহেব - বিবিসি থেকে আগত সি সি ওয়ালিক (C.C. Wallick)। ভারতীয় প্রোগ্রামের প্রযোজক ছিলেন নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। তাঁকে সাহায্য করতেন দুজন – একজন হলেন বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়াল আর দ্বিতীয়জন হলেন, রাজেন্দ্রনাথ সেন – যিনি এক কালে মোহন বাগানের হাফ-ব্যাক ছিলেন। শুধু নতুন নাম নয়, নানা দিক থেকেই ১৯২৭ ছিল কলকাতা রেডিও-র ইতিহাসে স্মরণীয় বছর। সেই বছরই কলকাতা রেডিও থেকে শিশির ভাদুড়ীর নাট্যমন্দির সংস্থার একটি ছোট নাটিকা ‘বসন্তলীলা’ প্রচারিত হয়। ক্ষীরোদ প্রসাদ বিদ্যাবিনোদের লেখা একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘নরনারায়ণ’ প্রচারিত হয় বছরের শেষে। তার পরিচালকও ছিলেন শিশির ভাদুড়ী। ১৯২৭ সালেই স্বনামখ্যাত পঙ্কজ মল্লিক রেডিও স্টেশনে আসেন সঙ্গীত পরিবেশন করতে। এর কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কলকাতা রেডিওর সঙ্গীত বিভাগে যোগ দেন।

কলকাতা রেডিওর নিজস্ব পত্রিকা বেতার জগৎ-এর প্রকাশনা শুরু হয় ১৯২৯ সাল থেকে। প্রথম কার্যনির্বাহী সম্পাদক ছিলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। মাসে দুবার করে প্রকাশিত হত। আমি যখন দেখেছি, তখন এতে থাকত কলকাতা রেডিওর অনুষ্ঠান-সূচী আর সেই সঙ্গে গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, বিজ্ঞাপন ও অন্যান্য টুকিটাকি খবর। রম্য গীতি অনুষ্ঠানটি যখন চালু হয়, সেই গানগুলির কথা আর স্বরলিপি পাওয়া যেত এই বেতার জগৎ-এ।

১৯৩০ সালে যেটা ঘটে, সেটা অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন ঘটবে। ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যায়। তখন ভারত সরকার এগিয়ে এসে একটা নতুন সরকারি সংস্থা - ভারতীয় রাজ্য ব্রডকাস্টিং সার্ভিস (Indian State Broadcasting Service) সৃষ্টি করে কলকাতা ও অন্যান্য রেডিও স্টেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ভারত সরকারের রেডিও সম্প্রচার ব্যবসায় নামার উদ্দেশ্য ছিল রেডিওকে প্রচার ও জনহিতকার কাজে লাগানো। লাভজনক ব্যবসায় এটা ছিল না - আয় হত শুধু রেডিও পিছু প্রিমিয়াম বা চাঁদা থেকে (বিজ্ঞাপনের যুগ এসেছে অনেক পড়ে)। রেডিও কেনার সামর্থ্য তখন ক'টা লোকেরই বা ছিল! রেডিও-র চাঁদাও নিশ্চয় বেশি ছিল না - আশি দশকের প্রথম দিকেও একটা রেডিওর জন্যে বছরে মাত্র ১৫ টাকা দিতে হত! বিজ্ঞাপনের দৌলতে পরে এই চাঁদার ব্যাপারটা তুলে দেওয়া হয়। আর একটা কথা লিখে এই প্রসঙ্গটা শেষ করি - ১৯৩৬ সালে ভারতীয় রাজ্য ব্রডকাস্টিং সার্ভিস-এর নতুন নামকরণ হয় 'অল ইন্ডিয়া রেডিও'। ১৯৫৬ সাল থেকে 'অল ইন্ডিয়া রেডিও'র ভারতীয় নাম হয় 'আকাশবাণী'।

১৯২৭ সালে কলকাতা রেডিওর সম্প্রচার সকালে ঠিক কখন আরম্ভ হত তার খোঁজ কোথাও পাই নি। তবে ১৯২৯ সালে রেডিও স্টেশন চালু হত সকাল ৮-টায়। প্রথমেই ঘড়ি মেলানোর পালা। তারপর শুরু হত মূল অনুষ্ঠান। থাকত রেকর্ডের গান - ভারতীয় এবং পাশ্চাত্য সঙ্গীত। (তখন শ্রোতাদের অনুরোধে রেকর্ড বাজানোর ব্যাপারটা ছিল না। রেডিওর সংখ্যা ছিল খুবই কম - শ্রোতার সংখ্যাও। অনুরোধের আসর, মিউজিক্যাল ব্যান্ডবক্স – এসেছে অনেক পরে।) বাংলায় ছোটদের একটা প্রোগ্রাম (ছোটোদের বৈঠক) থাকত। ইংরেজি সংবাদ, আবহাওয়ার খবর, বাজারের দর। বাংলায় সংবাদ তখনো সুরু হয় নি। আর থাকত একক সঙ্গীত, যন্ত্রসঙ্গীত - দেশী, বিদেশী, ইত্যাদি। শেষ হত, ‘গড সেভ দ্য কিং’ দিয়ে। প্রসঙ্গত, পঞ্চাশ দশকে যখন রেডিও শুনতে আরম্ভ করেছি, যদ্দুর মনে পড়ে তখন ভোর সাড়ে ছ'টায় রেডিও চালু হত; আর শেষে স্বাভাবিক ভাবেই ‘গড সেভ দ্য কিং’ থাকত না।

শ্রোতাদের কাছে কলকাতা রেডিওর একটা মস্ত বড় আকর্ষণ ছিল বাংলা নাটক। এই বিভাগটির অন্যতম রূপকার ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ কলকাতা রেডিও স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহুবছর নাটক প্রযোজনার দায়িত্ব নিয়ে। ওঁর উদ্যোগে চমৎকার চমৎকার সব বেতার নাটক প্রচারিত হয়েছে কলকাতা থেকে। সে যুগের বিখ্যাত নাট্য ও চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব – বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ছাড়াও অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গাঙ্গুলী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সরযূবালা, শম্ভু মিত্র, বসন্ত চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, মঞ্জু দে ও বিকাশ রায়ের মত অভিনেতারা সেগুলোতে নিয়মিত অংশগ্রহণ নিয়েছেন। ১৯৩১ সালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র পঙ্কজ কুমার মল্লিককে নিয়ে বাণীকুমার রচিত বিখ্যাত ‘মহিষাসুর-মর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি শুরু করেন। সেই অনুষ্ঠান বহু বছর ধরে চলেছিল। (পাঠকরা ইচ্ছে করলে নীচে ক্লিক করে সেটা শুনতে পারেন।)

প্রসঙ্গত ৭০ দশকে নতুন করে এই অনুষ্ঠানটি নতুন করে রেকর্ডিং করা হয়েছিল। তাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন উত্তমকুমার, লতা মুঙ্গেশকর এবং গোবিন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায়। নীচে সেই রেকর্ডের লিঙ্কও দেওয়া হল।

কিন্তু শ্রোতাদের অনুরোধে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পুরনো অনুষ্ঠানটিকেই আবার ফিরিয়ে আনা হয়।

বাংলায় সংবাদ পরিবেশন শুরু হয় ১৯৩৩ সালে। রাজেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন স্থানীয় সংবাদের দায়িত্বে। অল্পদিনের মধ্যেই সেই দলে যোগ দেন ছিলেন বিজন বসু, বিভূতি দাস ও অন্যান্যরা। পরে এটি আর শুধু স্থানীয় সংবাদ থাকে না, যুক্ত হয় দেশ-বিদেশের খবর পাঠ। প্রসঙ্গত, বিজন বসু ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত বাংলা সংবাদ পড়েছেন – প্রথমে কলকাতা পরে দিল্লী থেকে। অবসরের বয়স্ক পাঠকদের সেকথা হয়ত মনে আছে। আরও বহু খ্যাতনামা লোক রেডিওর সঙ্গে ছিলেন। তিরিশ দশকের শেষদিকে কলকাতা রেডিওতে মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। চল্লিশ দশকের শেষ দিকে যোগ দেন বুলবুল সরকার (‘কলিং অল চিলড্রেন’ অনুষ্ঠানের পরিচালিকা) এবং বেলা দে (‘মহিলা মহল’ খ্যাত)।

সে যুগে রেডিওই প্রতিবেশীদের একটা ছাদের নীচে টেনে আনত।। সবার বাড়িতে রেডিও ছিল না। বিশেষ কোনও খবর, ভালো নাটক বা খেলার ধারাবিবরণী শোনার জন্যে যাদের বাড়িতে রেডিও আছে সবাই সেখানে এসে ভিড় করত। বাস্তব জগতে তো বটেই রূপালী পর্দাতেও এই দৃশ্য মাঝে মাঝে দেখা গেছে। রেডিওতে ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী শোনা ছিল বাঙালীদের একটা বিরাট আকর্ষণ। প্রথম দিকে ধারাবিবরণী হত শুধু ইংরেজিতে। ১৯৩০ সাল থেকে সেটা শুরু হয়েছিল। তিরিশ দশকে বাংলা ধারাবিবরণীরও একটা গল্প আছে ইন্টারনেটে (সত্যি কি না - জানি না)। ১৯৩৪ সালে মোহনবাগান আর ক্যালকাটা ক্লাবের খেলা... ঠিক হল কলকাতার রেডিওতে তার ধারাবিবরণী বাংলাতে দেওয়া হবে। একটাই মুশকিল, সেটা দেবার যোগ্যতা যাঁর ছিল, সেই রাজেন্দ্রনাথ সেন তখন ছুটিতে। খেলার মাঠে গেছেন দুজন - সঙ্গীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়াল, যিনি খেলা ভালোবাসেন, কিন্তু দ্রুত কথা সাজানোতে পটু নন। দ্বিতীয়জন হলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। নাটক ভালো জমাতে পারেন, কথাবার্তাতেও দারুণ, কিন্তু খেলা বিশেষ বোঝেন না। এঁদের দিয়েই নাকি সে যাত্রা পার করা হয়েছিল! মনে হয় এটা গল্পই।

পঞ্চাশ-ষাট দশকে ইংরেজিতে ক্রিকেট খেলার ধারাবিবরণী দিতেন বেরি সর্বাধিকারী আর পিয়ার্সন সুরিটা – পরে অবশ্য মহারাজ কুমার অফ ভিজয়নগরম (ভিজি), দেবরাজ পুরি, শরদিন্দু সান্যাল, বিজয় মার্চেন্ট, প্রমুখ যোগ দেন। ভিজি বলতেন ভালো, কিন্তু খেলার বিবরণী দিতে দিতে হঠাৎ গল্প জুড়ে দিতেন - পুরনো দিনের গল্প।। সেই গল্প যখন শেষ হত, তার মধ্যেই এক আধটা ওভার বাউন্ডারি হয়ে গিয়েছে বা উইকেট পড়ে গেছে... ভারি বিরক্তিকর!

বাংলা ধারাবিবরণী নিয়মিত শুরু হয় ফুটবল (এখনকার সকার) খেলা দিয়ে। ১৯৫৭ সালে মোহনবাগান আর রাজস্থানের খেলার ধারাবিবরণী দেন অজয় বসু এবং পুষ্পেন সরকার। এই জুটির জনপ্রিয়তা একসময়ে তুঙ্গে ওঠে। পরে এঁরাই কমল ভট্টাচার্যের সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটের ধারাবিবরণী দেওয়া আরম্ভ করেন। ‘বল আস্তে করে ঝুলিয়ে দেওয়া, ‘ব্যাটে বলে না হওয়া’, ‘মাটি কামড়ে সোজা চার’, ‘সপাটে মারা’ ও ‘সোজা বাউন্ডারি’ খেলার এই সব চমৎকার বর্ণনাগুলো বাংলাতে এঁদেরই আমদানি। এখন কথাগুলো শুনলেই চোখের সামনে পুরো ব্যাপারটা ভেসে ওঠে। শুধু ওঁদের একটা মন্তব্যে এখনও আমার ধোঁয়াশা আছে। গৌরবর্ণ সুপুরুষ আব্বাস আলী বেগ যখন প্রথম ভারতের হয়ে খেলতে নেমেছিলেন, তখন ওঁর ব্যাট চালানো দেখে একজন মন্তব্য করেছিলেন, ‘উনি দেখতে সায়েবের মত, খেলেনও সায়েবের মত।’ ‘দেখতে সায়েবের মত’ কথাটা বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু ‘খেলেনও সায়েবের মত’ কথাটার অর্থ এখনো ধরতে পারি নি। প্রসঙ্গত, এই আব্বাস আলী বেগ যখন ১৯৬০ সালে মুম্বাইয়ের ব্রেবোর্ন স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আধা সেঞ্চুরি করে প্যাভেলিয়ানে ফিরে আসছেন, তখন কোত্থেকে এক সুন্দরী তরুণী ছুটে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খেয়েছিলেন। আমি বহুদিন দেশ ছাড়া... এখন এসব ব্যাপার নিশ্চয় জলভাত। কিন্তু যে যুগে আমাদের দেশে সিনেমাতেও চুমু খাচ্ছে দেখানো যেত না... সেই সময়ে কিনা হাজার হাজার লোকের সামনে এই ভাবে চুমু খাওয়া ... ভাবা যায়! এক কালের খ্যাতনামা ক্রিকেট খেলোয়াড় বিজয় মার্চেন্ট ইংরেজি ধারা বিবরণীর দিচ্ছিলেন। তিনি তো হতবাক! পরে সামলে উঠে যা বলেছিলেন, তার মর্মার্থ - কোথায় ছিল এইসব উদ্যোগী তরুণীরা যখন আমি সেঞ্চুরি, ডাবল সেঞ্চুরি – এসব করেছি!

কলকাতার পুরনো কালের রেডিও নিয়ে তথ্যমূলক একটা নিবন্ধ লিখবো বলে বসেছিলাম, কিন্তু দেখুন কোত্থেকে কোথায় চলে এলাম! হাবিজাবি এইসব দেখে পাঠকরা বিলক্ষণ চটবেন, তাই কয়েকটা তথ্য অন্তত শেষে জুড়ে দিই (জেনে কি লাভ হবে জানি না!)... রেডিও সম্প্রচারিত হয় বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে (ওয়েভ-ব্যান্ড বা চ্যানেলে)। প্রত্যেকটি রেডিও স্টেশনের জন্যে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়, যাতে করে কাছাকাছি দুটো রেডিও স্টেশন থাকলেও তাদের আলাদা ভাবে শোনা যায়। অল ইন্ডিয়া রেডিও, কলকাতা প্রথম দিকে শুনতে পাওয়া যেত ৩৭০.৪ মিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যে। পরে শর্ট ওয়েভ চ্যানেল (যার তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অনেক কম) যোগ করা হয়েছিল। রেডিও ট্র্যান্সমিটারের শক্তিও খেপে খেপে বাড়ানো হয়েছিল। পঞ্চাশ দশকে কলকাতার দুটো চ্যানেল দেখেছি – কলকাতা-ক (৪৪৭.৮ মিটার) আর কলকাতা-খ (৩০০ মিটার)। সঙ্গে দুটো শর্ট ওয়েভ ব্যান্ডও (৪১.৬১ ও ৩১.৪৮ মিটার) ছিল। ঠিক কবে থেকে এই দুটো চ্যানেল শুরু হয়েছিল বলতে পারব না। কলকাতা ক-তে হত বাংলা অনুষ্ঠানগুলো। ইংরেজি অনুষ্ঠানও 'ক'-তে কিছু থাকত, তবে সেগুলো বেশি থাকত 'খ'-তে। রেডিও সিলোনের হিন্দি গানের রমরমা কমানোর জন্যে সুরু হয়েছিল বিবিধ ভারতী প্রোগ্রাম – প্রচুর গান থাকত সেখানে। ১৯৫৭ সালে বিবিধ ভারতীর অনুষ্ঠান প্রচার আরম্ভ হল কলকাতা-গ থেকে।

কলকাতায় যাঁরা থাকতেন তাঁদের কথা আলাদা - কিন্তু পঞ্চাশ দশকে দেখেছি কলকাতার থেকে একটু দূরে গেলেই সমস্যা! আমি থাকতাম কলকাতা থেকে ২৮ মাইল দূরে - বানীপুর বলে একটি জায়গায়। সেখানে কলকাতা স্টেশন ধরা যেত ঠিকই – কিন্তু অনেক বিরক্তিকর খরখর আওয়াজ শুনতে হত। হয়তো আমাদের রেডিওটা তেমন জোরদার ছিল না। আমি সে সময়ে ক্লাস থ্রি বা ফোর-এ পড়ি - হাতের লেখা তখনো তেমন করে রপ্ত হয় নি। আঁকাবাঁকা অক্ষরে কলকাতার স্টেশন ডিরেক্টরকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলাম – অনুরোধের আসর শুনতে পাই না বলে। উত্তর পাই নি। প্রশংসা-সূচক কিছু লিখলে হয়তো উত্তর পাওয়া যেত। সেদিন ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখি সুদূর নিউজিল্যাণ্ড থেকে এড শ্যাকেল নামে এক ব্যক্তি ১৯৩৫ সালে কলকাতার রেডিও শুনতে পেয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। খবরটা জেনে কলকাতার স্টেশন ডিরেক্টর তাঁকে একটা সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দেন! ধরে নিচ্ছি এরকম সার্টিফিকেট দেবার চল ছিল। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের দূরত্বটা ২৮ মাইলের থেকে অনেক অনেক বেশী, আর ভদ্রলোকের রেডিওটা আমাদের রেডিও থেকে অন্তত ২০ বছরের পুরনো। সেগুলো না হয় বাদ দিলাম, তিরিশ দশকে কলকাতার রেডিও ট্র্যান্সমিটারের কতটুকুই বা শক্তি ছিল!

এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিশ্চয় কিছু একটা আছে। নিউজিল্যান্ডের সেই ভদ্রলোক সম্ভবত কলকাতার কোনও শর্ট ওয়েভ চ্যানেল ধরেছিলেন। রেডিওর শর্ট ওয়েভ তির্যক ভাবে ওপরে গিয়ে আয়নোস্ফিয়ারে বার বার ধাক্কা খেতে খেতে এগোয় - সেই যাত্রাপথ সুদীর্ঘ হলেও অনেক সময় তেমন বাধা (interference) পায় না। পৃথিবীর বুক ঘেঁসে রেডিও ওয়েভ যাওয়াতে অনেক হ্যাপা! এই সহজ ব্যাখ্যার শুধু একটাই সমস্যা... কলকাতার শর্ট ওয়েভ চ্যানেল শুরু হয় এই ঘটনার তিন বছর পরে - ১৯৩৮ সালে! 'picking us up' কথাটার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, পরিষ্কার ভাবে সব কিছু শুনতে পাওয়া গিয়েছিল। তবু ভাবতে ভালো লাগে কলকাতার রেডিও থেকে মিডিয়াম ওয়েভে প্রচারিত অনুষ্ঠানও সাগর পাড়ি দিয়ে ১৯৩৫ সালে নিউজিল্যান্ডে পৌঁছেছিল!


AM রেডিও থেকে আসা নানারকমের বিরক্তিকর শব্দ (static) FM রেডিও-র উন্নততর প্রযুক্তিতে প্রায় পুরোটাই দূর হয়ে গিয়েছিল। এ নিয়ে দুচার কথা বলা বোধহয় অসঙ্গত হবে না... এই দুই প্রযুক্তির তফাৎ হল মডুলেশনের পদ্ধতির । যে কোনও মাধ্যমের সহায়তায় যখন বার্তা প্রেরণ করা হয় তখন বার্তার প্রকৃতি অনুযায়ী মাধ্যমের মধ্যে একটা কিছু পরিবর্তন সাধন করাকেই বলা হয় মডুলেশন । বেতারে অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রেও মডুলেশন প্রয়োজন । কথাবার্তা বা গানবাজনায় যে শব্দতরঙ্গের উদ্ভব হয় তাকে প্রথমে মাইক্রোফোনের সাহায্যে বৈদ্যুতিক তরঙ্গে রূপান্তরিত করা হয় । বেতারের বাহক তরঙ্গের ( carrier wave) কোনও একটি বৈশিষ্ট্যকে এই বৈদ্যুতিক তরঙ্গের প্রকৃতি অনুযায়ী পরিবর্তন করে প্রেরক যন্ত্রের মাধ্যমে পাঠানো হয়। অন্য প্রান্তে রিসিভার বা গ্রাহক যন্ত্রে বাহক তরঙ্গটি আলাদা করে নিতে পারলে সেই বৈদ্যুতিক তরঙ্গটিকে আবার উদ্ধার করা যায়। বাকি কাজ হল সেই বৈদ্যুতিক তরঙ্গকে আবার শব্দতরঙ্গে রূপান্তরিত করা।

AM হল অ্যাম্পলিচুড মডুলেশন । অর্থাৎ, বার্তা বহন করতে বাহকের বিস্তার (amplitude)-এর পরিবর্তন বা মডুলেশন করা হয় । বিস্তার ছাড়া তরঙ্গের কম্পন-সংখ্যার (frequency) বৈশিষ্ট্যের উপরেও মডুলেশন করা যেতে পারে - সেটা হল FM । FM রেডিও দিয়ে অনেক দূরে বার্তা প্রেরণ করা যায় না, কিন্তু এতে অনেক কম-শক্তির ট্র্যান্সমিটার লাগে; সুতরাং ট্র্যান্সমিটার ও রিসিভার পাশাপাশি রাখা এবং একসঙ্গে তাদের ব্যবহার করা সম্ভবপর। এটিই পরে কাজে লেগে যায় মোবাইল ফোনের প্রযুক্তিতে। AM আর FM-এর গুণমানগত পার্থক্যের মূল কারণ হল বেতার সম্প্রচারের সময় বিভিন্ন   বৈদ্যুতিক শব্দ-দূষণের (static noise) প্রভাব  Amplitude বা বিস্তারের ওপর পড়লেও Frequency বা কম্পনসংখ্যার ওপর তা প্রায় নেই বলেই চলে। সেই কারণে FM তরঙ্গে প্রেরিত সংকেতবার্তা  (Signal) যেভাবে প্রচারিত হয়েছিল, প্রায় সেই একই ভাবে শ্রোতার কাছে পৌঁছতে পারে। কম দূরত্বের মধ্যে এই বেতারবার্তা প্রায় সম্পূর্ণভাবে দূষণ-মুক্ত (Noise-free)। এ ছাড়া চলমান অবস্থার জন্য রেডিও তরঙ্গের যেসব সমস্যা হয়, যেমন 'ফাস্ট ফেডিং', এফএম রেডিওতে সেগুলি দেখা গেল অনেক কম । শেষের এই গুণটির জন্যে গাড়িতে চলাকালীনও এই রেডিও ভালো ভাবে শোনার কোনও অসুবিধা রইল না। বেতারের জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধারের পেছনে প্রযুক্তির এই অবদান অনস্বীকার্য।

তখন জানতাম না। পরে শুনেছি, ভারতীয় ও বিদেশী সুরের মিশ্রণে অতি পরিচিত এই signature tuneটি কার সৃষ্টি

সে নিয়ে মতভেদ আছে।। কারো কারো মতে এটি হল মুম্বাই রেডিও স্টেশনের পাশ্চাত্য সঙ্গীতের ডিরেক্টর ওয়াল্টার কফম্যান (Walter Kaufmann) সৃষ্ট একটা সুরের অংশ বিশেষ। কিন্তু পাল্লায় ভারী অন্য একটি মত। সেই মত অনুসারে দিল্লী রেডিও স্টেশনের জন হার্বার্ট ফাউল্ডস (John Herbert Foulds) এটিকে রচনা করেন অল ইন্ডিয়া রেডিওর-ই জন্যে। বেহালা, ভাওলা এবং তানপুরা সহযোগে এই সুরটি কে বাজিয়েছেন – সে নিয়েও নানান লোকের নানান মত। যাচাই করে দেখার উপায় নেই।


লেখক পরিচিতি - বহু বছর ধরে আমেরিকা প্রবাসী। এক সময়ে পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন - এখন মাঝে মধ্যে। ধাঁধা ও রহস্যকাহিনীর ওপর গোটা বারো বই আছে। অবসর.নেট ও বাংলা মিস্ট্রি.কম-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।