প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ - ব্যক্তিগত স্মৃতি -বিস্মৃতি 

মার্চ ১, ২০১৫

 

নানা রঙের দিন

ঈশানী রায়চৌধুরী

(১)

এই ২০১৫ -র কলকাতা বইমেলায় আমার "ম্যাজিক  লন্ঠন"  প্রকাশিত হল। কিছুই না , বয়স হলে লোকে আবোলতাবোল বকে বেশি। পরবাসে শোনার লোক নেই, তাই নিজের সঙ্গেই কথা বলি কী -বোর্ডে। তা  সেই "ম্যাজিক লন্ঠন " পড়ে আমার এক বন্ধু অভিযোগের সুরে বলল, " সবই ঠিক আছে , কিন্তু আমরা একেবারে বাদ? বা একেবারে না হলেও শুধু সামান্য ছুঁয়ে যাওয়া? আমরা কি ফ্যালনা? ওই এগারো -বারো ক্লাসের দু-বছর, স্কটিশ চার্চ কলেজ, তারপর তোর তো ওখানেই আরও তিন বছর ..শুধু তাই বা কেন, যে কলেজে তোর বলতে গেলে জ্ঞান হয়ে ইস্তক চরে বেড়ানো , সেই পর্ব এত সংক্ষিপ্ত? "
সত্যিই তো! বাবা ওই কলেজে পড়াতেন। আমি পড়তাম বীডন স্ট্রীটের হোলি চাইল্ড -এ (যদিও খুব একটা "হোলি " ছিলাম না )। রোজ প্রায় পুরো রাস্তা বাবার সঙ্গে যাওয়া। আমি স্কুলে ঢুকে যেতাম, বাবা আরও দু'পা হেঁটে বাঁ দিকে ঘুরে যেতেন। স্কুলের পোশাকে বা বাড়ির পোশাকে অজস্রবার কলেজে গেছি। কাজে ও অকাজে। তারপর তো ওখানেই কাটল পাঁচ পাঁচটা বছর। আমার জীবনের সেরা সময়। তাকে ভুলে গেলাম কী করে?
তাই...দেখি ..পোকায় কাটা লাল শালুতে মোড়া পুরোনো কথার পুঁথি কুলুঙ্গি থেকে ঝেরেঝুরে নামিয়ে! কতটুকু মনে আছে!
স্কুলে যাচ্ছি। বাঁদিকের ফুটপাথ ধরে এগোলে স্কুল আর ডানদিকে স্কটিশের ডাফ হোস্টেল। বাবার কলীগ আর ছাত্রদের কল্যাণে সারা উত্তর কলকাতাই তখন বোধহয় আমার ডাকনাম জানত। আমি বাবার পাশে পাশে হেঁটে যাই। তখন পড়ি সেভেনে বা এইটে। স্কুলে সিস্টারদের তর্জন, বাড়িতে গার্জেনদের (বাবা ছাড়া ) গর্জন , অনন্ত অনুশাসন ..সে সব ছাপিয়ে চোখে নতুন রঙিন চশমা , গুনগুন গানের সেই বয়স.."ফুলের বনে যার পাশে যাই, তারেই লাগে ভালো ..." আর উল্টো ফুটের হোস্টেলের বারান্দা থেকে আওয়াজ ওঠে, "টুকটুক , টুকটুক "। তাকালে দেখা যায়, টুপটাপ কতগুলো কালো মাথা ঝপ করে বসে পড়ে রেলিঙের আড়ালে। বাবা নির্বিকার! সেই শুরু। সেই জ্ঞানচক্ষু খুলল যে মনোযোগের মধ্যমণি হতে নেহাত মন্দ লাগে না!
তখন বাড়িতে টেলিভিশন নেই। ইন্ডিয়া ওয়েস্ট -ইন্ডিজ টেস্ট ম্যাচ। আমি ক্লাস টেন। নাকি নাইন? কী জানি! ওয়ান হোস্টেলের সহকারী সুপার তখন প্রফেসর শঙ্করপ্রসাদ নাগ। বাবার বিভাগেই। রসায়ন। হোস্টেলে টিভি আনা হয়েছে। চেয়ার ভাড়া করে সামিয়ানা খাটিয়ে ম্যাচ দেখা হবে। আমিও গেছি। বাবার সঙ্গে। নাচতে নাচতে। বসেছি ..একটু পরেই একটা ভাঁড়ের চা নিয়ে এক ছোঁড়া এসে বলে কিনা, "এই যে , টুকটুক , তোমার চা।'' 
আমি মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বললাম, "খাই না।" 
"সে কী! তোমার জন্য রাজু ( আসল নাম উহ্য থাক!) পাঠাল। স্পেশাল। তুমি খাবে বলে।"
"কে রাজু? রাজু টাজু আমি কাউকে চিনি না।" 
'' রাজু আমাদের লীডার। যুবনেতা।"
"বললাম তো খাব না।"
শঙ্করকাকুকে গিয়ে বললাম, "কে একটা রাজু ...সে চা পাঠিয়েছে ... আমি খাইনি।"
শঙ্করকাকু প্রায় কেঁদে ফেলেন আর কী!
"তুই কি আমায় হোস্টেলছাড়া করবি রে টুকটুক! রাজু কথায় কথায় পেটো মারে , শার্টের আড়ালে কোমরে গোঁজা চেম্বার ..। তুই হয় চা খেয়ে আয় , নয়তো বাড়ি যা।"
চা খেলাম। অগত্যা। আমি একা নই। বাবা আর শঙ্করকাকুও। সে নাকি স্পেশাল চা! সেদিন মনে মনে খুব ইচ্ছে হয়েছিল, এই কলেজে পড়তে হবে। এই কলেজ..যেখানে বহু বহু বিখ্যাত নামের সঙ্গে "রাজু "রাও পড়ে। যেখানে ছাত্র-রাজনীতি তুমুলভাবে বিরাজমান আবার যেখানে রুদ্রপ্রসাদ -কেয়ার "ফুটবল " নাটক হলে ভাড়া করা হলঘর এমন উপচে পড়ে, যে পেছনে দাঁড়িয়ে নাটক দেখতে হয় , যেখানে নাকি ১৫০ বছরের পূর্তিতে প্রধান অতিথি হয়ে আসতে পারেন প্রধানমন্ত্রী!
এই কলেজের প্রতিটি ঘুপচি কোণ আমার চেনা। ল্যাবের বেয়ারারা পর্যন্ত আমাকে ডাকনামে চেনে। মাস্টারমশাইরা কাকু-জ্যেঠু। গাছ, হলঘর, টিনের চাল , জলের কল ..সব চেনা। সেখানে পড়ব না আমি?
কিন্তু পড়ব কী করে? হোলি চাইল্ড থেকে মাধ্যমিক দিয়ে "জেল " খেটে বেরোলেই আমাকে নিশ্চিত অন্য হাজতে অন্য অপরাধে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। ব্রাহ্ম গালর্স , বেথুন ...ওই সব গুডগার্লদের স্কুলে! উচ্চমাধ্যমিক পড়তে। রোজ ভগবানকে ডাকি। প্রাণের দায়ে ডাকি। "হে ভগবান , আর স্কুল ইউনিফর্ম নয় , উইকলি টেস্টের বিভীষিকা নয়। আমাকে বাঁচাও। "
কে বলে "ঈশ্বর " নেই? বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। বাবা বললেন , " স্কটিশে পড়ুক। এগারো-বারো। নতুন সিলেবাস। স্কুলগুলোতে তেমন ল্যাব ফেসিলিটি নেই। "
শুরু হল আমার স্ব-অধীনতা পর্ব।

(২)

মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোলো। নেহাত মন্দ হল না। স্কুলে প্রথম নামটা তো রইলই , মেধা তালিকায় প্রথম পঁচিশজনের মধ্যেও রয়ে গেলাম। একটা জাতীয় বৃত্তিও জুটে গেল। ফলে যদিও ঠাকুমার মোটেই ভেতরে ভেতরে ইচ্ছে ছিল না যে নাতনি ছেলে ছোকরাদের সঙ্গে পড়ুক ( মায়ের কোনও নিজস্ব বক্তব্যও ছিল না, শুধু মার্কশীট দেখে  যে বিষয়গুলোতে মনের মতো নম্বর পাইনি , তা নিয়ে বকাবকি করা ছাড়া ) , বাবা অনড়। সায়েন্স পড়ুক আর তাহলে কলেজে। কী ভাগ্যিস, বেথুন কলেজ তখনও ডিসিশন নিতে দোনোমনা করছিল , নাহলে নির্ঘাত ওখানেই যেতে হত! ঠাকুমার আপত্তি ধোপে টিকল না । আমি বেশি ইন্টারেস্ট দেখালাম না ওপর ওপর , তাহলে পাকা ঘুঁটি কেঁচে যাবে। বাবার সঙ্গে ফ্রকপরা আমি গিয়ে ভর্তি হয়ে এলাম। বাবার কলেজ সেদিন থেকে আমার কলেজ হয়ে গেল।

বাবার কিছু প্রাথমিক শর্ত অবশ্য ছিল।

১. সিঁড়িতে বসে আড্ডা দেওয়া চলবে না
২. স্কটিশে পি সি এল বিল্ডিং-এর আড়ালে একটা "কুঞ্জবন" ছিল (আমি পরে জানলাম , ওর নাম "বৃন্দাবন") সেখানে আড়াল আবডাল খোঁজা যাবে না
৩. লনে ঘাসে বসে ক্লাস কামাই করে গুলতানি করা যাবে না

[এর সঙ্গে বাবা বাড়তি ঘোষণা করলেন, "যতদিন টুকটুক কলেজে থাকবে, আমি ওদের কোনও ক্লাস নেব না। এমনকি প্র্যাক্টিক্যালও  নয়।”  প্র্যাক্টিক্যাল পরীক্ষার দিনগুলোতে কলেজেও যাবেন না। "মেয়ে" বলে যাতে কোনও "পক্ষপাত" না থাকে!] 

প্রশ্নই ওঠে না!  বাবার চোখকে ফাঁকি দিলেও দিতে পারি । কাকু-জ্যেঠু-পিসি -মাসিরা? সবাই তো ওত পেতে আছে। কখন গিয়ে চুকলি কেটে দেবে , ভরসা নেই। রাজি হয়ে গেলাম ইয়া বড় করে ঘাড় কাত করে।

আমারও চুক্তি আছে। একটাই।

বাবার "হাত ধরে গুটিগুটি " আর নয়। এমনকি এক সময়ে ক্লাস  থাকলেও নয়। মানিকতলা থেকে বাকি পথটুকু হন্টন। আমরা এমনভাবে হাঁটব  , যেন কেউ কাউকে চিনি না। মোটমাট আমি আর "বাবার মেয়ে " নই। এখন আমি স্রেফ ছাত্রী। বাবা মজা পেলেন। রাজিও হয়ে গেলেন।

আমার স্কুল থেকে আরও পাঁচজন ওই বিজ্ঞান বিভাগেই ভর্তি হল। শম্পা , তপশ্রী , মৈত্রেয়ী ঘোষ , মৈত্রেয়ী চ্যাটার্জী আর সিপন। প্রথম তিনজনের সঙ্গে আমার হৃদ্যতা অতিমাত্রায়। আর আর্টস-এ অবশ্য অনেকেই। বেশিরভাগ "গুড গার্ল "রা গুটিগুটি গেল অন্য ইস্কুলে। আলিপুর সেন্ট্রাল থেকে তিহার।

ভর্তি হতে গিয়ে শুনি , আমাদের বিজ্ঞান বিভাগে একদিকে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে  বিরানব্বইটি ছেলে। সদ্য গোঁফ ওঠা বা উঠি -উঠি কেস। আর  অন্য দিকে কুল্লে  বারোটি কিশোরী ... টিমটিম করছে।

আশ্চর্যজনকভাবে কলেজে ভর্তি হবার পর ওই হোস্টেলের ঝুলবারান্দা থেকে "টুকটুক টুকটুক" হুল্লাট থেমে গেল। এক হতে পারে, ওরা  ভাবল , এ তো কলেজেই পড়ে। সরাসরি কথা বলা যেতেই পারে। পর্দানসীন তো আর নয়! আর কে পি আর (মানে আমার বাবা ) সব সময় কিছু চৌকিদারিও করবেন না নিশ্চিত।  অথবা, আমাকে একেবারে সামনাসামনি দেখে (আমার বোঁচা নাক তো আমার চব্বিশ ঘন্টার সঙ্গী) তাদের মোহভঙ্গ হল।

তবে কিছু ফালতু ফেউ জুটল। দিন দুই পরেই। হেঁটে আসছি বীডন স্ট্রিট বরাবর। এক ছোকরা দেখি পাশে পাশে হাঁটছে।

" তুমি কে পি আর -এর মেয়ে? আমার নাম মানস ব্যানার্জি (এই নামটাও আসল নয় )। আমি সেকেন্ড ইয়ার। বি.এস সি পাস কোর্সের ছাত্র। আমার বোনও তোমার সঙ্গে পড়ে। অবিশ্যি আর্টস । ভাবলাম আলাপ করি। এটুকু পথ একসঙ্গে যাওয়া যেতেই পারে। "

আমি মিচকি হেসে  নীচু গলায় বললাম, "সে তো যেতেই পারে। তবে কিনা..বাবাও আছে , উল্টো ফুটপাথে।"

ব্যস! ছোঁড়া আমতা আমতা করে কেটে পড়ল। স্কটিশে  ভর্তি হবার পর আমার প্রথম রোমিও।

(পরের অংশ)


লেখক পরিচিতঃ বিজ্ঞানের ছাত্রী । কিন্তু প্রথম ভালোবাসা সাহিত্য । তিন দশক ধরে ভাষান্তরের কাজে যুক্ত । বেশ কিছু অনূদিত বই প্রকাশিত হয়েছে সাহিত্য আকাদেমি, ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ইত্যাদি বিখ্যাত সংস্থা থেকে । ভাষান্তরের পাশাপাশি নিজস্ব লেখালেখির ঝোঁক । তবে খুব নিয়মিত নয় । ভালোবাসেন টুকরো গদ্য, পদ্য লিখতে ।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।