বিবিধ প্রসঙ্গ

নভেম্বর ১৫, ২০১৪
‘বিস্ময়-মহিলা’ মায়া এঞ্জেলো ১ ২
শেখর বসু
জীবনের শুরু থেকেই দুর্যোগ
ভাই-বোনের জীবনে। মায়ার যখন মাত্র আট বছর বয়স তখন ওর মায়ের বয়ফ্রেন্ড
ফ্রিম্যান ধর্ষণ করেছিল ওকে। দাদা বেইলি এক বছরের বড়, দাদাকে সব
কথা জানাত মায়া। ভয়ংকর এই ঘটনাটির কথাও জানাল। ক্ষুব্ধ দাদা কিন্তু
গোপন কথাটি গোপন রাখতে পারল না, আত্মীয়দের কয়েকজনকে বলে দিয়েছিল।
তারপরেই থানা-পুলিশ। জবানবন্দি নেওয়া হল মায়ার। বিচারে জেল হল
ফ্রিম্যানের,কিন্তু খুব অল্প মেয়াদের। তবে জেল থেকে বেরুবার পরেই
খুন হয়ে গেল ধর্ষক। পাঁচজনের মুখে শোনা যায়, মায়ার কাকারাই খুন
করে ফেলেছে ওই বদ লোকটাকে।
ঘটনাটির তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ছোট্ট মেয়েটির ওপর। মায়ার
ধারণা হল—লোকটার খুন হয়ে যাওয়ার জন্যে ওই-ই দায়ী। ও মুখ না খুললে
লোকটাকে এ ভাবে মরতে হত না। ঠিক করল, ও আর মুখই খুলবে না। কথা
বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মায়ার, মাঝে মাঝে দাদার সঙ্গে দু-একটা কথা; বাকি
সময় চুপ। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিত না। প্রায় নির্বাক-হয়ে-যাওয়া
মায়ার মুখে আবার কথা ফুটিয়েছিলেন বার্থা ফ্লাওয়ার্স। ইনি একজন
কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা। কালো মেয়ে মায়াকে তিনি দিলেন সাহিত্যের সন্ধান।
বললেন, সাহিত্যজীবন এমন এক জীবন যা তোমাকে অনেক দুঃখকষ্ট ভুলিয়ে
দেবে। হলও তাই। সাহিত্য পড়ে ব্যক্তিগত জীবনের ভয়ংকর আঘাতের কথা
কিছুটা ভুলতে পারল মায়া। তারপর এক-এক করে পড়ে ফেলল চার্লস ডিকেন্স,
শেকসপিয়র, এডগার অ্যালেন পো প্রমুখের লেখা। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক
জীবনে ফিরে এসেছিল মায়া।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী ছিল মায়া। গান-বাজনা, নাচ, নাটক,
শিল্প-সাহিত্য সব দিকেই তুখোড়। কিন্তু ঠিক করে উঠতে পারছিল
না কোন্টাকে ও মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু করে তুলবে! একটি অস্থিরতাও
ওকে সবসময় তাড়া করে বেড়াত—সেটি ছিল আমেরিকার কালো মানুষদের যন্ত্রণা।
আজ থেকে ৭৫-৮০ বছর আগেকার কথা। বর্ণবিদ্বেষ তখন আমেরিকায়, বিশেষ
করে আমেরিকার দক্ষিণ অঞ্চলে, খুব তীব্র আকারে ছিল। সাদা মানুষরা
তখন কালো মানুষদের প্রায়ই হেনস্থা করত। মারধর করত, মেরেও ফেলত
কখনও-কখনও। সাদা মানুষদের আইন সাদা অপরাধীদের দোষ দেখত না প্রায়ই।
এই বৈষম্য কিছুতেই মেনে নিতে পারত না মায়া। প্রতিবাদ করত,রুখেও
দাঁড়াত। এর ফলে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই লাঞ্ছিত হতে হত ওকে। সাদাদের
অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য একবার ওর কালো দিদিমা
সপাটে ওকে চড় মেরেছিলেন।
অবাক হয়ে মায়া জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি আমাকে মারলে কেন?’
চড় মারার পরে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে ছিলেন দিদিমা, তারপর ধরা গলায়
বললেন, ‘কালো মানুষদের ওপর অত্যাচার বহুকাল ধরে চলে আসছে। এটা
নতুন কিছু নয়। এটাকে ভবিতব্য ভেবে চুপ করে থাকো।’
কিন্তু দিদিমার কথা মায়া মেনে নিতে পারেনি। তারা তো এ দেশের নাগরিক।
নাগরিকদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত কেন হবে তারা?
সাহিত্যের সঙ্গে নিজেকে খুব বেশি করে জড়িয়ে ফেলেছিলেন মায়া। এর
পেছনে ছিল মায়ার লেখক-বন্ধু বলড্উইন। মায়ার ঝোঁক ছিল
কবিতা
লেখার দিকে, কিন্তু ওই লেখক-বন্ধুই তাঁকে টেনে এনেছিলেন গদ্যসাহিত্যের
দিকে। আত্মকথা লিখতে শুরু করেছিলেন মায়া। এইটুকু একটা জীবন,কিন্তু
এই জীবনেই বলার মতো বহু ঘটনা ঘটে গিয়েছে। একদিকে দুঃখ-কষ্ট-লাঞ্ছনা,
অন্য দিকে সামান্য কিছু প্রাপ্তি। এই সব কথা অকপট ভাবে উঠে এসেছে
তাঁর আত্মজীবনীর পাতায়। আট বছর বয়সে ধর্ষিতা হওয়ার কথা আছে। শিশুবয়স
থেকে বর্ণবিদ্বেষের শিকার হওয়ার কথাও আছে। কিছুই তিনি গোপন করেননি
তাঁর
আত্মকথায়। ক্রীতদাসদের আত্মকথা লেখার বিশেষ একটি ধারা ছিল আফ্রিকান-আমেরিকান
আত্মজীবনীমূলক রচনায়। এখানে ‘আমি’র বদলে লেখা হত ‘আমরা’। অত্যাচারী
সাদাদের নামধাম গোপন রাখা হত সাবধানতার সঙ্গে। ভুল করে আসল নামধাম
বেরিয়ে পড়লে কালো লেখকদের লাঞ্ছনার আর শেষ থাকত না। খুন হয়ে যাওয়ার
আশঙ্কাও থাকত।
মায়ার আত্মচরিতের নাম ‘আই নো হোয়াই দি কেজ্ড বার্ড সিংস।’ কেন
খাঁচার বন্দি পাখি গান গায় জানতেন তিনি। খাঁচার গায়ে ঠোক্কর মেরে
খাঁচা ভাঙতে পারে না পাখি। তখন তার মর্মযন্ত্রণা বেরিয়ে আসে গলা
থেকে। সুরেলা সেই কণ্ঠের আকুতিকেই সবাই গান ভেবে নেয়। পাখির মুক্তি
আকাশে, কিন্তু সেই আকাশে উড়ে বেড়াবার স্বাধীনতা নেই খাঁচার পাখির।
কালো মানুষদের প্রতীক এই খাঁচার পাখি। ‘খাঁচার পাখি’ আমেরিকার
কালো মানুষদের কথাই শুনিয়েছেন মায়া তাঁর আত্মকথায়। বইটি অসাধারণ
জনপ্রিয়তা পায়। শুধু কালো নয়, সাদা মানুষদের হৃদয়েও সাড়া ফেলেছিল
বইটি। এই একটি বইতেই লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান মায়া এঞ্জেলো।
কিন্তু শুধুমাত্র নিরাপদ লেখক বৃত্তিকেই বেছে নেননি তিনি, কালো
মানুষদের
নাগরিক
অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতেও নেমে পড়েছিলেন পুরো মাত্রায়। মহামতি
প্রেসিডেন্ট লিংকন মারা যাওয়ার একশো বছর পরেও আমেরিকার কালো মানুষরা
নাগরিক অধিকারের পূর্ণ প্রয়োগ ও বর্ণবৈষম্য দূর করার দাবিতে একজোট
হয়েছিলেন। কালো মানুষদের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন ড মার্টিন লুথার কিং
জুনিয়র। আরও অনেকের সঙ্গে মায়াকেও তিনি গভীরভাবে উজ্জীবিত করেছিলেন।
মায়া তাঁর সভা-সমাবেশে যোগ দিতেন। তাঁর হয়ে প্রত্যক্ষভাবে কাজেও
নেমেছিলেন। আর এক নেতা ম্যালকম X(এক্স)-এর সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
কিন্তু ম্যালকম X (এক্স) বর্ণবিদ্বেষীদের হাতে হঠাৎ খুন হয়ে যাওয়ায়
তাঁর সংস্থাটি ভেঙে পড়েছিল পুরোপুরি। কিং মায়ার ওপরে নতুন একটা
দায়িত্ব চাপিয়েছিলেন। সাদার্ন ক্রিশ্চিয়ান লিডারশিপ কনফারেন্সের
নর্দার্ন কোঅর্ডিনেটর হতে হবে তাঁকে। ১৯৬৮ সাল। কিন্তু গুরুদায়িত্ব
পালনের মুখে খুন হয়ে গেলেন কালো মানুষদের প্রিয়তম নেতা কিং। এই
ধাক্কায় রীতিমত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন মায়া।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিণী ছিলেন মায়া এবং তাঁর জীবনও ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। মায়া তখন তরুণী,বয়স মাত্র চোদ্দ। গান-বাজনা-অভিনয়ে খুব ঝোঁক। নাচ ও নাটক চর্চা করার জন্য বৃত্তি পেয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সানফ্রানসিসকোর লেবার স্কুলে। কিন্তু কোর্স শেষ করতে পারলেন না। কেবল কার কন্ডাকটরের চাকরি নিলেন। এই চাকরিতে তিনিই ছিলেন প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান মহিলা।
পরে হাইস্কুলের পড়াশোনা শেষ করেন। এই সময় হঠাৎই একটা অঘটন ঘটে গেল। বিচিত্র এক মানসিক অবস্থার শিকার হয়েছিলেন মায়া। মনে হয়েছিল,উনি বোধহয় সমকামী। সেই সময় কী ভাবে ওঁর মাথায় ভর করেছিল—সমকামী আর নপুংসক আদতে একই। মানসিক এই সংকট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে অল্পবয়সী একটি ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেন। কিছুদিন যৌনজীবনও যাপন করেন ছেলেটির সঙ্গে। তার ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়েন। দাদার কাছে কোনও কথাই লুকোতেন না বোন। এই ঘটনাটির কথাও বলেন। দাদা পরামর্শ দিলেন, এখন কাউকে কিছু জানাবার দরকার নেই। পরীক্ষা এসে গিয়েছে, গ্রাজুয়েট হয়ে নাও, তারপরে যা করার কোরো।
আট মাসের পরে অবশ্য সব জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। আত্মকথায় এই বৃত্তান্তটি অকপটে জানিয়েছেন মায়া। ছেলের জন্ম হল, গ্রাজুয়েটও হলেন মায়া। কুমারী মা ছেলের নাম রাখলেন ‘গাই’। ছেলে মানুষ করার জন্যে তিনি ওয়েট্রেসের নিয়েছিলেন, রাঁধুনির কাজও করেছিলেন কিছুকাল। কিন্তু মন পড়ে থাকত গান-বাজনা-নাচ আর অভিনয়ের দিকে। কবিতা ওঁর প্রথম প্রেম, সেই কবিতার টানও অনুভব করতেন গভীর ভাবে।
বাঁধা জীবনের ছক ভেঙে এবার বেরিয়ে এলেন মায়া। ১৯৫৪-৫৫ সালে একটি অপেরা দলের সঙ্গে
ইউরোপ সফরে যান। সফরে প্রশংসা ও অর্থ দুটোই এসেছিল অল্পবিস্তর। ফিরে এসে আধুনিক নাচের তালিম নেন। কিছুদিনের মধ্যে বিনোদন জগতের একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেছিলেন মায়া। টেলিভিশন ভ্যারাইটি শো-তে তাঁকে দেখা যেতে লাগল নিয়মিত। বার হল তাঁর প্রথম অ্যালবাম—‘ক্যালিপ্সো লেডি’। তারপরেই চলে গেলেন নিউ ইয়র্ক। যোগ দিলেন হার্লেম রাইটার্স গিল্ডে। অভিনয় করলেন অফ-ব্রডওয়ে প্রোডাকশনে। নাটকটি ছিল জঁ জেনের ‘দি ব্ল্যাক্স’। শুধু অভিনয় নয়,নাটক ও চিত্রনাট্য রচনাতেও দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পূর্ণ দৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্রও পরিচালনা করেছেন তিনি।
তাঁর প্রতিভা বিচ্ছুরিত হয়েছে নানা পথে। তবে কালো মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে সরে আসেননি কখনও। জনপ্রিয় কবি, লেখিকা, নাট্যকার,সঙ্গীতজ্ঞ এবং আজন্মসংগ্রামী মানুষটি সর্বস্তরেই হয়ে উঠেছিলেন শ্রদ্ধাভাজন এক ব্যক্তিত্ব। প্রেসিডেন্ট ক্লিন্টনের অনুরোধে যে কবিতাটি লিখেছিলেন, সেটি পাঠ করেন প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠানে। ওয়েক ফরেস্ট ইউনিভার্সিটির আমেরিকান স্টাডিজের রেনল্ডস অধ্যাপক পদে যোগ দেন মায়া এঞ্জেলো। সর্বজনস্বীকৃত এই মানুষটি পঞ্চাশটিরও বেশি অনারারি ডিগ্রি পেয়েছেন।
যে মানুষ পাঁচজনের এত ভালোবাসা,এত শ্রদ্ধা, এত স্বীকৃতি পান; তাঁর মধ্যে হয়তো নিজের ভাবমূর্তি ধরে রাখার কিছু সচেতন চেষ্টা দেখা যায়। ব্যক্তিগত জীবনের দীনতা,তুচ্ছতা গোপন করার ঝোঁকও বুঝি চাপে ওই সঙ্গে। কিন্তু মায়ার ক্ষেত্রে ঠিক তার উলটোটাই ঘটেছিল। কিছুকাল তিনি ক্লেদাক্ত,ঘৃণ্য এক জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছিলেন; লুকনোর বদলে সেই সব কথা খোলামেলা ভাবে তুলে ধরেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে।
(চলবে)
লেখক পরিচিতি - শেখর বসু (http://sekharbasu.com/) – প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ছোটগল্পকার। কর্মজীবনে আনন্দবাজার পত্রিকার গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহু বছর। এখন পুরো সময়টাই লেখালেখির কাজ করছেন। গত চল্লিশ বছরে উনি বহু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গোয়েন্দাকাহিনী লিখেছেন। এযুগের যুবক সম্প্রদায়ের অনেকেই বড় হয়েছেন ওঁর লেখা ছোটদের বই পড়ে ।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।