প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

নভেম্বর ৩০, ২০১৪

 

‘বিস্ময়-মহিলা’ মায়া এঞ্জেলো

শেখর বসু


ভয়ংকর এক ঘটনার শিকার হয়ে কিছুকাল বেশ্যাবৃত্তি নিতে হয়েছিল মায়াকে। অসহনীয় ছিল সেই দিনগুলো! কিন্তু মনের জোরে সেই সংকট কাটিয়ে উঠেছিলেন তিনি। শুধু কাটিয়ে ওঠাই নয়,জীবনের মূল স্রোতে ফিরে এসেছিলেন আবার। ফের শুরু করেছিলেন কালো মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড ‘গ্যাদার টুগেদার ইন মাই নেম’ লেখার সময় মায়া সবার প্রিয় মানুষ, শ্রদ্ধাভাজন এক ব্যক্তিত্ব। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছিলেন বারবার। তাঁর ওই অন্ধকার অতীতের কথা কি পাঠকদের জানানো ঠিক হবে? দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না কিছুতেই। ওঁর একটি অমলিন ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে জনসাধারণের মধ্যে। কালো মানুষদের আত্মপরিচিতি,আত্মপ্রতিষ্ঠা,সমানাধিকার পাওয়া, বর্ণবিদ্বেষ দূর করা ইত্যাদি ব্যাপারে ওঁর ভূমিকা স্বীকৃতি পেয়েছে সর্বস্তরে। ভাবগম্ভীর এই রূপটি বহু মানুষের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত। এই অবস্থায় কলঙ্কিত ওই বেশ্যাবৃত্তির কথা আত্মকথায় লেখা ঠিক হবে কি? মায়ার দ্বিধাদ্বন্দ্ব দূর করলেন ওঁর স্বামী। বললেনঃ না লেখার কী আছে? তুমি তো তোমার পাঠকদের সব কথাই জানাচ্ছ--। এটাই বা জানাবে না কেন? পাঠকদের কাছে সৎ থাকার দায়িত্ব আছে তোমার। জানিয়ে দাও সব কথা। মায়া জানালেন। জানালেন—কী ভাবে এক প্রেমিক তাঁকে ঠকিয়ে ক্লেদাক্ত ওই পথে ঠেলে দিয়েছিল। পরিবেশের শিকার হয়েছিলেন তিনি। তাঁর দারিদ্র্য,অসহায়তা চেপে ধরেছিল তাঁকে। ওখানকার রোজগারের টাকায় শিশুপুত্রের খাওয়াপরার দায় মেটাতে হয়েছিল তখন। সামনের সব দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর কাছে। কিন্তু মনের জোরে ওই সংকট কাটিয়ে উঠে ফিরে এসেছিলেন আবার সুস্থ,স্বাভাবিক জীবনে। তবে জীবনকে সুন্দর,সহজ,মসৃণ করে তোলার জন্যে লড়াই চালাতে হয়েছিল প্রতি মুহূর্তে। সে লড়াই তিনি জিততেও পেরেছিলেন। কালো মানুষদের মুক্তির দূত মায়া এবার হয়ে উঠলেন আমেরিকার কালো মেয়েদের ‘রোল মডেল’।

মায়ার প্রথম কবিতার বই ‘জাস্ট গিভ মি আ কুল ড্রিংক অব ওয়াটার বিফোর আই ডাই’। এখানে ‘ডাই’ শব্দটিকে তিনি দীর্ঘায়ত করেছেন বাড়তি দুটি বর্ণ ঢুকিয়ে। ‘die’ হয়ে উঠেছে ‘diiie । এটিই তাঁর প্রথম কবিতার বই, প্রকাশিত হয়ে ছিল ১৯৭১ সালে। তাঁর সাত-খণ্ড আত্মস্মৃতি সিরিজের পঞ্চম বইটির নাম “অল গড’স চিলড্রেন নিড ট্রাভেলিং শুজ”। বইটির নামের মূলে আছে একটি নিগ্রো ধর্মগ্রন্থ। এই বইটি নানা কারণে গভীর ভাবে স্পর্শ করেছে আমাকে। গত শতকের পাঁচের দশকের প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছে বইটি। ঘানা এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশ তখন সবে স্বাধীন হয়েছে। কালো মানুষদের জনপ্রিয় নেতা নক্রুমা। আফ্রিকার সাংস্কৃতিক নবজাগরণের কেন্দ্রে ছিল ঘানা। মাতৃভূমি দর্শনের টানে আমেরিকা থেকে ঘানায় ছুটে এসেছিলেন মায়া। এ সেই দেশ যেখান থেকে বহুকাল আগে তাঁর পূর্বপুরুষদের সাদা মানুষরা ধরে নিয়ে গিয়ে আমেরিকার দাসবাজারে বিক্রি করে দিয়েছিল। আফ্রিকা মায়ার মাতৃভূমি। মাতৃভূমি আর তীর্থভূমির মধ্যে বুঝি কোনো ভেদ নেই। মায়া গভীর ভাবে অনুভব করেছিলেন কালো মানুষদের আপন দেশটিকে। এ-দেশে বর্ণবৈষম্যের কোনও বিষ নেই। শিকড়ের সন্ধানে মায়া ছুটে এসেছিলেন ঘানার আক্রায়। গোটা আফ্রিকাই তাঁর মাতৃভূমি—‘মাদার আফ্রিকা’। এ দেশ নিজের দেশ। কালো মানুষদের অনেকেই ছিন্নমূল হয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে সুদূর আমেরিকায়। সে এক ভয়ংকর গ্লানির জীবন। সে জীবনে ছিল শুধুই দাসত্ব আর নিরবচ্ছিন্ন অত্যাচার। সেই আমেরিকা থেকে এতকাল বাদে কিছু কালো আমেরিকান ফিরে এসেছেন নিজেদের দেশে। মায়া আছেন তাঁদের মধ্যে। তাঁর রোমাঞ্চ আর আনন্দের মাত্রা তিনি যেন আর ধরে রাখতে পারছিলেন না। এ ছিল একেবারে শুরুর দিকের অভিজ্ঞতা। কিন্তু কিছুকাল আফ্রিকাবাসের পরে টের পাচ্ছিলেন—কোথায় যেন একটা ব্যবধানও গড়ে উঠেছে। তিনি কালো আমেরিকান, বেড়ে উঠেছেন আমেরিকান সংস্কৃতিতে। আফ্রিকার নিজস্ব সংস্কৃতি তার থেকে একেবারেই আলাদা। তবে বাইরের এই ব্যবধানটকু ঘুচিয়ে ফেলতে পারলেই দেশের উত্তাপ পাওয়া যায় পুরোপুরি। মায়া পেরেছিলেন। তাঁর আকৃতি ও গঠনের সঙ্গে আফ্রিকার বিশেষ এক উপজাতির মিল আছে—এই আবিষ্কারের বিহ্বলতাও কম নয়! মায়ার মনে হয়েছিল তিনি তাঁর হারানো পুর্বপুরুষদের মধ্যে ফিরে এসেছেন আবার। এ এক চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা!

মোটর দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়েছিল মায়ার ছেলে গাই। সুস্থ হওয়ার পরে ভর্তি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ধীরে ধীরে নিজস্ব জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল ও। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উনিশ বছরের গাই যখন আমেরিকান এমব্যাসির ছত্রিশ বছরের এক মহিলার প্রেমে পড়ল তখন মা কেমন যেন ক্ষেপে উঠেছিলেন। ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যা শুনছি তা কি ঠিক?’ সাবালক ছেলে একটু হেসে জবাব দিয়েছিল, ‘হ্যাঁ মা, ঠিক। তুমি কি চাও না আমি আমার নিজস্ব জীবন কাটাই?’ মা অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। এই ছেলে-মায়ের সম্পর্ক, মাতৃত্বের প্রকাশ, নানা ভাবে দেখা গিয়েছে আত্মচরিতের সাতটি খণ্ডেই। চমৎকার রসবোধও ছিল মায়ার। বিশাল চেহারার এক আফ্রিকাবাসী মায়াকে তার ‘দ্বিতীয় পত্নী’ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। সে বর্ণনার অম্লমধুর দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে আত্মচরিতের পাতায়। নিজে কবি হয়েও কবিদের নিয়ে সরস মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন সময়। একটি হলঃ কবিরা প্রধানমন্ত্রীর চাইতেও খারাপ, শ্রোতা ধরার জন্য সব সময় ওঁত পেতে থাকে। শিকড়ের সন্ধানে আফ্রিকায় এসেছিলেন মায়া। সেই শিকড়ের খোঁজ পেয়েছিলেন তিনি। পেয়ে আপ্লুত হয়েছিলেন। চাকরি করেছিলেন আক্রায়। আফ্রিকার সংস্কৃতিতে যত দূর সম্ভব মিশে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমেরিকার বৃহত্তর কর্মক্ষেত্র তাঁকে ডাক দিচ্ছিল বারবার। সে ডাকে তিনি সাড়া দিলেন শেষ পর্যন্ত। বেশ কয়েকজন বন্ধু ও সহকর্মী তাঁকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন বিমানবন্দরে। ছেলে গাইও ছিল তাঁদের সঙ্গে। একটু অভিভূত হয়ে পড়েছিলেন মায়া। মনে হয়েছিল, মাতৃভূমি থেকে এ-ভাবে চলে যাওয়াটা কেমন যেন রূপকের মতো। দূর অতীতে তাঁর পুর্বপুরুষদের দাস হিসেবে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আমেরিকায়। দেশের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল বরাবরের মতো। গাই,স্বজন ও স্বদেশের সঙ্গে তাঁরও কি এবার সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হতে চলেছে? এমন একটি প্রশ্ন তুলেই শেষ হয়েছে আত্মস্মৃতির পঞ্চম খণ্ডটি। আমেরিকায় ফিরে বিশাল এক কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কালো আমেরিকান মায়া এঞ্জেলো। তাঁর দীর্ঘমেয়াদি লড়াই ছিল সর্বস্তরে কালো মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। বর্ণবৈষম্য দূর করার কাজে তিনি প্রাণের ঝুঁকি নিয়েছিলেন বারবার। আমেরিকার কালো মানুষদের মুখপাত্র, ‘কালো মেয়েদের আদর্শ’ মায়া কালো,সাদা সব বর্ণের মানুষের কাছ থেকেই বিপুল শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। তাঁর অনুরাগীর মধ্যে দেশের দুই প্রেসিডেন্টও ছিলেন। মায়ার কাজের পরিধিটিও ছিল বিশাল। কবি,লেখক,আত্মচরিতকার,নাট্যকার,গায়িকা, নর্তকী,অভিনেত্রী,চলচ্চিত্র পরিচালক, টি ভি-শো প্রযোজক,সমাজকর্মী মায়ার বহুমুখী প্রতিভার বিচ্ছুরণে বিস্মিত হয়েছেন দেশ-বিদেশের বহু মানুষ। আজ থেকে মাত্র সাড়ে-পাঁচ মাস আগে(২৮ মে,২০১৪) ছিয়াশি বছর বয়সে মায়া এঞ্জেলো প্রয়াত হয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনায়। প্রাণের মানুষ এই ‘বিস্ময়-মহিলা’র মৃত্যুতে চোখের জল ফেলেছেন সব বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ।
(সমাপ্ত)

 


লেখক পরিচিতি - শেখর বসু (http://sekharbasu.com/) – প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ছোটগল্পকার। কর্মজীবনে আনন্দবাজার পত্রিকার গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহু বছর। এখন পুরো সময়টাই লেখালেখির কাজ করছেন। গত চল্লিশ বছরে উনি বহু গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ ও গোয়েন্দাকাহিনী লিখেছেন। এযুগের যুবক সম্প্রদায়ের অনেকেই বড় হয়েছেন ওঁর লেখা ছোটদের বই পড়ে ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।