উর্দু
সাহিত্যের এক দিকপাল সাদাৎ হাসান মাণ্টো (১৯১২-১৯৫৪)

মানুষ
মাণ্টো
আয়েষা
জালাল যাকে আখ্যা দিলেন "ফোঁপরা বিবেকের যাদুঘর-কর্তা"
(Curator of Hollowed Conscience), সেই মাণ্টো রক্তমাংসে কেমন
ছিলেন? কী শক্তি তাঁকে চালনা করতো? তাঁর গল্পের মধ্যে কি তাঁকে
কোথাও পাওয়া যাবে? সহজ উত্তর-- না। তাঁর পাঠকরা যাতে তাঁর সৃষ্ট
চরিত্রদের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে সেই কারণে মধ্যস্থ মাণ্টোকে তিনি
মুছে দিলেন। এদিকে কিন্তু যে করুণা, যে সহানুভূতি তাঁর গল্প জুড়ে
দেখা যায়, সেসব শতকরা একশোভাগই মাণ্টো। বোম্বাইবাসিনী উর্দু লেখিকা
ইসমত চুগতাই ছিলেন মাণ্টোর কাছের লোক, তিনি লিখছেন: "তাঁর
ক্রুরতম কাহিনীতে, তিক্ততম বিষের মধ্যেও এই করুণার দেখা পাই। তারই
জোরে অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত স্থানে হঠাৎ গভীর মানবিকতা আবিষ্কার
করে আমরা বাধ্য হই আমাদের নিজেদের মনের পবিত্রতার আবরণটি সরিয়ে
ভিতরের কুসংস্কার, ক্রোধ, ঘৃণা, যৌনবিকৃতি আদির মোকাবেলা করতে।
তাতে করে আর কিছু না হোক, আমরা অন্যদের সঙ্গে একাত্ম বোধ করি,
সহন- আর ক্ষমাশীলতার মূল্য আর প্রয়োজন হঠাৎ প্রতিভাত হয় আমাদের
কাছে"। মাণ্টোর অস্থিরমতিত্বের সঙ্গে চুগতাইয়ের পরিচয় ছিলো।
তিনি এও লক্ষ্য করেছিলেন যে মাণ্টো কেমন অনায়াসে অন্যদের অনুভূতি
আর আবেগের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিতে পারেন।
তাঁর রচনায় মাণ্টো কখনো জানালেন
না তাঁর নিজের প্রকৃতি, কিন্তু শেষে বোধহয় নিজেই নিজের কল্পনার
এক মানুষ হয়ে গেলেন। নামহারা হয়ে একদিন হারিয়ে যাবেন, এ নিয়ে মাণ্টোর
ভয় ছিলো। তাঁর পর্বতপ্রমাণ অহমিকা, প্রচলিত বিশ্বাসে আঘাত হানার
প্রবৃত্তি, দর্পী ধৈর্যহীনতা-- এসবই সেই ভীতির মূলোচ্ছেদের চেষ্টা
বলে মনে করেন অনেকে। মানুষ মাণ্টোর বিবর্তন নিয়ে আরেক সমালোচক
লিখেছেন: " ... যে দ্বন্দ্বের আঘাতে তিনি হলেন জীবনের তিক্ত
সত্যের ব্যাপারী, খুলে দিতে পারলেন বঞ্চনা আর মিথ্যে ভদ্রতার মুখোশ,
সেই দ্বন্দ্বই শেষ পর্যন্ত তাঁর নিজের জীবনের শান্তি আর স্থৈর্য
অপহরণ করে নিলো। একের পর এক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর সৃষ্ট
শত শত চরিত্রের সঙ্গে আস্তে আস্তে একাত্ম হয়ে যেতে শুরু করলেন,
আপন করে নিতে থাকলেন তাদের ভ্রম ও সঙঘাত, ব্যথা ও ব্যর্থতা, নৈরাশ্য
ও ক্রোধ। এই করতে করতে আসল মানুষ মাণ্টো একদিন হারিয়ে গেলেন।"
এক নিয়োজিতপ্রাণ লেখকের ব্যক্তিত্ব থেকে ব্যক্তিটিকে হারিয়ে ফেলা,
সে তো ঘটতেই পারে। প্রসঙ্গত, পঞ্চাশের দশকে অধঃপতন শুরু হবার আগে
পর্যন্ত পোশাকে-আষাকে আর বহিরঙ্গে মাণ্টো খুব শৌখীন মানুষ ছিলেন,
তাঁর সেসময়ের ছবিতে তার সাক্ষ্য আছে।
মাণ্টো-- অভিঘাত ও প্রাসঙ্গিকতা:
গত শতাব্দীর মাঝামাঝি উর্দু
সাহিত্য যখন মধুর বাণীতে অভিজাত সমাজের নকল মানুষদের কেতাদুরস্ত
রোজনামচা শোনাতে ব্যস্ত, সাহিত্যজগতে তখন মাণ্টোর আবির্ভাব। এসেই
তিনি আসল মানুষদের কথা বলতে আরম্ভ করলেন তাদেরই ভাষায়। তাঁর গল্পে
নিয়ে এলেন সেইসব চরিত্র যারা হয় পাঁড় মাতাল, নয় জুয়াড়ী বা বেশ্যা
বা ধর্মধবজী মোল্লা, বেশ্যার দালাল, কুহকিনী ছেনাল, বা অসৈরণ,
নির্বীর্য অথচ কামাতুর বৃদ্ধের দল। অপরাধী, পাগল, সমাজের এই প্রত্যন্তবাসীদের
দল, যাদের কথা মাণ্টো লিখলেন, তারা কিন্তু সমাজের আর পাঁচজনের
মতোই দৈনদিন রুটির জোগাড়ে ব্যস্ত, মেয়েরা হয়তো আরেকটু বেশী ঝাঁজালো,
পাগলেরা হঠাৎই বলে ওঠে অত্যন্ত গভীর তত্বের কথা-- তারা মাণ্টোর
কলম বেয়ে উর্দু সাহিত্যের ক্যানভাসে ঢুকে গেলো চিরকালের জন্য।
উর্দু সাহিত্যের এই যে "স্বর্গ হইতে বিদায়', সেখানে আর তার
ফিরে যাওয়া হোলো না।
জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে
মাণ্টোর যে নতুন মূল্যায়ন হয়েছে, তাতে উর্দু সাহিত্যে তাঁকে তাঁর
প্রাপ্য স্থান দেওয়া হয়েছে, সে স্থান অনেক উঁচুতে, অগ্রণী কথাকারদের
সারিতে। তাঁর পার্টিশনের গল্পগুলিতে তিনি পাক-ভারত ইতিহাসের সূচনার
এই কলঙ্কময় অধ্যায়ের প্রত্যক্ষদর্শীর সোচ্চার সাক্ষ্য রেখেছেন।
কোনো অনুসন্ধিৎসু মন যদি আজকের এই দুই দেশের সঙ্ঘাতময় সম্পর্ক
ও তজ্জনিত সঙ্কট এবং বিপদের মূল সন্ধান করতে চান তাহলে দুই দেশের
জাতীয়তাবাদের গিল্টি লাগানো আজকের পাঠ্য ইতিহাস না পড়ে মাণ্টোর
সেই সাক্ষ্যলিপি পড়তে পারেন।ধর্মের প্রয়োজন ব্যক্তিগত বিশ্বাস
এবং সুনীতির ধারক হিসেবে। তার বাইরে ধর্মকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার
করার ফল যে কী ভয়াবহ হতে পারে, মাণ্টো তা দেখেছেন এবং তা নিয়ে
লিখেছেন। গত তিন দশক ধরে মুসলিম দুনিয়ায় সেই ভয়াবহতা আবার দেখা
দিচ্ছে, তার বিষময় ছোঁয়াচ অন্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপরেও পড়ছে। সে
পরিপ্রেক্ষিতে মাণ্টোর লেখা আর কিছু না হোক, সে বিভীষিকার কথা
আবার আমাদের মনে করিয়ে দিতে বাধ্য। সেদিনের পরিপ্রেক্ষিতে মাণ্টো
লিখেছিলেন: "আমাদের বিচূর্ণিত সংস্কৃতি আর সভ্যতা, আমাদের
খণ্ড খণ্ড প্রত্যঙ্গ যা আজ পশ্চিমী রাজনীতির ভস্মস্তুপে চাপা পড়ে
রয়েছে-- সেসব আমাদের উদ্ধার করে, ঝাড়পোঁছ করে, সারাই করে নবীকরণ
করতে হবে। তবে যদি এই দুর্বার ঝড়ে আমরা যা হারিয়েছি তা ফিরে পাই।"
এই অনুজ্ঞা আজও সমানভাবে প্রযোজ্য। মাণ্টোর জন্মজয়ন্তীতে পাকিস্তানী
এবং ভারতীয়েরা মাণ্টোর ঘোর বাস্তববাদিতা স্মরণে আনতে পারেন। তাতে
উভয় রাষ্ট্র শুরু থেকেই পরস্পরের মধ্যে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের যে
বেড়া গড়ে তুলেছে তাতে ভাঙন ধরাতে পারে, অতীতের ভুল শোধবোধ করে
সুস্থ ও সবল সৌহার্দে্যর সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। একবিংশ শতাব্দীর
ইতিহাস তার পথ চেয়ে আছে।
মাণ্টোর বেশ কিছু বইয়ের ইংরাজীতে
অনুবাদ আছে, নতুন করে কয়েকটি প্রকাশও হয়েছে সম্প্রতি--Selected Stories
of Manto; Bitter Fruit - the Very Best Manto; Mottled Dawn- 50 Sketches and
Stories of Partition -- all by Penguin Global: Black Margin। বাংলায় 'দাঙ্গা ও দেশবিভাগের গল্প'-তে
কয়েকটা গল্প আছে, অন্য কিছু অনুবাদও পাওয়া যেতে পারে। সব অনুবাদের
মান গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে, সতর্ক পাঠক এ কথা স্মরণ রাখবেন।
মাণ্টোর উর্দুভাষার বইয়ের একটা তালিকা (সম্পূর্ণ নয়) দেওয়া হোলো:
আতিশপারায়, চুগাদ, মাণ্টো
কে আফসানে, ধুয়াঁ, আফসানে অওর ড্রামায়, লাজ্জৎ--এ-সাং, সিয়াহ্
হাশিয়ে, বাদশাহাত কা খাতিমাহ, খালি বোতলেঁ, লাউড স্পীকার, নিমরুদ
কি খুদাই, ঠাণ্ডা গোশ্ত্, য়াজিদ, পর্দে কি পিছে, সড়ক কি কিনারে,
বগৈর উনওয়ান কে, বগৈর ইজাজৎ, বুরকে, ফুনদুনে, সরকন্দে কি পিছে,
শয়তান, শিকারি অওরতেঁ, রত্তি-মাসা-তোলা, কালি সালওয়ার, মাণ্টো
কি বেহতারীন কহাঁনিয়াঁ, তাহিরা সে তাহির।
(আগের
অংশ)
সমর
সাহা
সুমিত রায়ের সৌজন্যে
উৎস:
Stephen Alter, "Madness and Partition", J. of Comparative
Poetics, vol.14
Ayesha Jalal, "Curator of Hollowed Conscience", The
Hindu, May 11,2012
Ayesha Jalal, Pity of Partition, Princeton U. Press.
Mumtaz Shirin, Manto - Noori Na Nari, Dawn, 1985.
M. Umar Memon, "The Historian of the Individual",
Herald, May 2012.
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)