উর্দু
সাহিত্যের এক দিকপাল সাদাৎ হাসান মাণ্টো (১৯১২-১৯৫৪)

উত্তর-দেশবিভাগ
রচনা ১৯৫১-৫৪
প্রাক্-দেশবিভাগ
রচনায় মাণ্টো লিখেছিলেন পরাধীন দেশের আর্থ-সামাজিক অবিচারের কথা,
লিখেছিলেন বিতর্কিত প্রেম, যৌন কাহিনী, স্বজনকাম, বেশ্যাবৃত্তি
আর সেকালের পুরুষ-শাসিত সমাজের ভণ্ডামির কথা। দেশবিভাগ মাণ্টোর
চিন্তায় আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে গেল। সেসময়ের লেখায় আমরা পাচ্ছি সেই
হত্যাকাণ্ড ও অমানুষিকতার এক বিধবস্ত সাক্ষীর সাক্ষ্য। মানুষকে
নিয়ে তাঁর কিছু যদি মোহ থেকে থাকে, তা ভেঙে গেছে, তিনি ক্লান্ত,
লক্ষ্যে পৌঁছোবার ক্ষমতা আর নেই তাঁর। ব্যঙ্গ হয়েছে আরো কটু, হতাশা
আর তিক্ততার ভারে তিনি জর্জরিত। তবুও সতর্ক ও সন্ধানী অন্তর্দৃষ্টির
ঝলক আর ব্যঙ্গের আড়ালে শাণিত বুদ্ধির ছোঁয়া তখনও দেখা যাচ্ছে,
একটু বেশী খোঁজার অপেক্ষা।
প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রের
মধ্যেকার সঙ্ঘর্ষমূলক সম্পর্ক মাণ্টোর নজর এড়ায়নি। 'তীথ্ওয়াল কা
কুত্তা' গল্পে এক নেড়ি কুকুরের কথা লিখেছেন, সে পাক-ভারত সীমান্তের
এপারে ওপারে দুই রাষ্ট্রের শিবির থেকেই খাবার চুরি করে। দুদিকের
লোকেরাই ভাবে এই কুকুরটা অপর পক্ষের গুপ্তচর, অবশেষে দুপক্ষের
গুলিযুদ্ধে সে মারা পড়ে। "একটা কুকুরকেও জানাতে হবে সে পাকিস্তানী
না হিন্দুস্থানী" -- লিখলেন মাণ্টো। এমনই আরেক গল্পে, 'আখিরী
স্যালুট' (শেষ স্যালুট), দেখালেন "গতকালের বন্ধু... কেমন
করে আজকের শত্রু হয়ে দাঁড়ালো"।
রাজনীতি বা রাজনীতিকদের নিয়ে
মাণ্টোর বিশেষ আগ্রহ বা কোনো মোহ দেখা যায়নি আগে। এইসময়ের কিছু
লেখায় কিন্তু তিনি এ ব্যাপারে আশ্চর্য দূরদৃষ্টি দেখিয়েছেন। আমেরিকার
দূতাবাস থেকে একজন এসে তখন মাণ্টোকে পাঁচশো টাকা দিয়ে লেখার বায়না
দিয়ে যান। কী লেখা, কেন লেখা, তা কিছু তিনি বলেননি, কিন্তু মাণ্টো
তাও লেখেন-- খোলা চিঠির ছাঁদে, প্রথমে 'চাচা স্যামকে নাম খত্'
(Letters to Uncle Sam), পরে ভারতের প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে
(শীর্ষনাম নেই, 'বাকিয়ৎ' নামের বইতে সংগৃহীত)। নেহরুকে লেখা চিঠিগুলিতে
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের কিছু গঠনমূলক ইঙ্গিত আছে কিন্তু স্যাম
চাচার চিঠিগুলির অন্তর্দৃষ্টিতে মাণ্টো অনাগতবিধাতা। ব্যঙ্গ আর
তিক্ততায় ভরা এ লেখাগুলি পড়লে বোঝা যায় যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির
ব্যাপারটা মাণ্টো ভালোই বুঝেছিলেন।
পাকিস্তান আর আমেরিকার মধ্যে
যে "সুরক্ষা চুক্তি" (Security Pact) করা হয়, মাণ্টো
তার সমর্থক ছিলেন না। 'চাচা স্যামকে নাম খত্' হোলো এক মামাকে লেখা
এক দেশোয়ালী ভাগ্নের চিঠি; তার থেকে কিছু উদ্বৃìতি দেওয়া গেলো।
"ভারতবর্ষ যতোই লাফালাফি
করুক না কেন, আপনি পাকিস্তানের সঙ্গে একটা সামরিক চুক্তি নিশ্চয়
করবেন, কেননা পৃথিবীর সবচয়ে বড়ো ইস্লাম রাষ্ট্রের স্থিতি নিয়ে
আপনি অবশ্যই বিশেষ উদ্বিগ্ন। এদিকে আমাদের মোল্লারা আবার রুশ কম্যুনিজমের
সবচেয়ে ভালো প্রতিষেধক। চুক্তির টাকা হাতে এলেই আগে এই মোল্লাদের
সশস্ত্র করতে হবে ...।"
"এই যে সামরিক চুক্তিটা
হোলো এ অতি মনোহর, একে টিঁকিয়ে রাখতেই হবে। আমি বলি কি, আপনি ভারতের
সঙ্গেও এমনই এক চুক্তি করুন আর আমাদের দুই রাষ্ট্রকেই আপনার গত
যুদ্ধের যা ঝড়তি-পড়তি অস্ত্রশস্ত্র আছে তা বেচে দিন। তাহলে সে
বোঝা আপনার ঘাড় থেকে নেমে যাবে আর আপনার অস্ত্র তৈরীর কারখানাগুলোও
সব চালু থাকবে...।"
"আমার কিন্তু একটা এই
অ্যাত্তোটুকু ছোট্টো একটা অ্যাটম বোমা চাই, সেটা দিয়ে আমার একটা
পুণ্যকর্ম করার ইচ্ছে বহুদিনের..।"
"আরেকটা কথা। আমরা কিছুতেই
একটা কন্স্টিটিউশন লিখতে পারছি না, আপনি দয়া করে কয়েকজন বিশেষজ্ঞকে
পাঠিয়ে দিন। একটা জাতির জাতীয় সঙ্গীত না হলেও চলে কিন্তু কন্স্টিটিউশন
না হলে কী করে চলে? অবশ্য তা যদি আপনার মর্জিমাফিক হয় তবেই না...।"
নিজের জন্মভূমিতে ভিন্দেশী
বোধ নিয়ে নিঃসঙ্গ মগ্নআশ মাণ্টো অতিরিক্ত মদ্যপান করে নিজেকে শেষ
করে দিলেন। তাঁর লেখা বেঁচে রইলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
শিল্পী মাণ্টো
মাণ্টো যখন লেখা শুরু করলেন
তখনকার উর্দু সাহিত্য ভাষার অলঙ্করণ আর কৃত্রিমতার ভারে নুয়ে পড়েছে--
কথ্য উর্দুর সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই বললেই চলে। তখনকার চলিত কথ্য
উর্দুতে মাণ্টো খুঁজে পেলেন গতি, আবেগ, স্বতস্ফূর্ত উচ্ছলতা। মাণ্টো
বরণ করলেন সেই ভাষাকে, তাই তাঁর লিখিত ভাষা গেরেম্ভারী নয়, নয়
কৃত্রিম, কিন্তু তাতে জটিল ঘটনাবিন্যাস আর গূঢ় ভাব, দুইই স্বচ্ছন্দে
প্রকাশ করা যায়। তাঁর চরিত্রেরা আসল জগতে যে ভাষা ব্যবহার করতো,
মাণ্টো তাদের সেই ভাষাই দিলেন তাঁর রচনায়, তাতে যে অযত্নের অগোছালো
ভাবটা এলো তা তাঁর রচনাকে করলো অতি স্বাভাবিক, নিরলঙ্কার সত্যের
মতো। দৈনন্দিন ব্যবহারের বাচন তিনি আশ্চর্য মুন্সীয়ানায় বেছে বেছে
এনে অপরূপ কথার মালা গাঁথলেন। তাঁর শিল্পের এই উৎকর্ষ বুঝতে অনুবাদকদের
অনেক সময় লেগেছে, তাই তাঁর লেখার প্রথমদিকের অনুবাদগুলি দুর্বল।
আশ্চর্যের কথা মাণ্টো তাঁর লেখার সংশোধন বা কাটছাঁট করতেন না একেবারেই--
মুক্তোর মতো হস্তাক্ষরে তাঁর লেখা যেন মুক্তোর মালা, অনেকগুলি
আবার একেবারেই একাসনে বসে লেখা।
মাণ্টো অবশ্যই কাহিনীর বিষয়বস্তুতে
অদৃষ্টপূর্ব এবং রীতিবহির্ভূত নতুনত্ব এনেছেন। কিন্তু অনেকে মনে
করেন যে মাণ্টোর গদ্যের ভাষার অভিঘাত বিষয়বস্তুর চমৎকারিত্বের
চেয়ে বেশী। আসলে হয়তো এই দুই কৃতি একত্র হয়ে মাণ্টোর রচনাকে আরো
গৌরবমণ্ডিত করেছে। কেননা মাণ্টোর বিষয়বস্তুকে কিছুটা সেই সময়ের
ঘটনাপ্রবাহের দান বলে মনে করা যায়, কিন্তু তাঁর ভাষার স্বচ্ছতা
আর সারল্য না থাকলে সেসব বিষয়কে এমন মহৎ সাহিত্য হিসাবে উপস্থাপনা
করা যেতো না। ভাবতে মজা লাগে যে উর্দু ভাষার এই পথিকৃৎ দুবার স্কুলে
উর্দু পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন!
মাণ্টোর চিত্রিত চরিত্রগুলির
মধ্যে কোথাও স্বর্গের পরী বা দেবদূতের দেখা পাওয়া যাবে না। তাঁর
গল্পের নায়িকারা একেবারে এই মাটির পৃথিবীর মেয়ে, তাদের মধ্যে কিছু
আবার সমাজে পতিতা বলে আখ্যাত। এদের সবায়ের কথা তিনি লিখেছেন মানবিক
দৃষ্টি থেকে সহানুভূতির সঙ্গে-- তাদের মহীয়সীও করেন নি, পাপীয়সীও
করেন নি। আজকের নারীবাদী আন্দোলনের পঞ্চাশ থেকে ষাট বছর আগে তিনি
নারীনির্যাতনের যন্ত্রণা উপলব্ধি করে নারীমুক্তির কথা লিখেছিলেন।
এই পুরুষশাসিত সমাজ যে ভাবে নারীর মনুষ্যত্ব অবহেলা করে তাদের
শুধু যৌনক্ষুধার উপকরণ হিসাবে দেখে তার কথা বারবার ফুটে উঠেছে
তাঁর গল্পের চরিত্রগুলির মাধ্যমে: 'হাটক' গল্পের মাধো আর সৌগন্ধী,
'মাহ্মুদা'র মুস্তাকিম আর মাহ্মুদা, 'মাম্মি'র স্টেলা জ্যাকসন,
'বাবু গোপীনাথ'এর জিন্নৎ।
মাণ্টোর পুরুষ চরিত্রগুলির
সম্পর্কে পাকিস্তানী লেখিকা মুমতাজ শিরিন সবচেয়ে খাঁটি কথা বলেছেন।
তিনি বলছেন: "জ্যোতিষ্মান দেবদূতের প্রতি মাণ্টোর কোনো আকর্ষণ
ছিলো না, কেননা তারা কোনো পাপকর্মে লিপ্ত হতে পারতো না। মাণ্টো
চেয়েছিলেন পাপীতাপী মানুষ, এই মাটির পৃথিবীর রক্তমাংসের ক্লেদাক্ত
মানুষ, who has the potential of original sin, of mischief, of
murder, of mayhem "। ['নুরি না নারী']
মাণ্টোর লেখায় বিদেশী লেখকদের
প্রভাব কতোটা, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। নানা সময়ে নানা সমালোচক
মাণ্টোর লেখায় ডি,এইচ লরেন্স, কার্ল মার্ক্স, হেগেল, পুশকিন, ও.
হেনরি বা চেকভের প্রভাব আবিষ্কার করেছেন। তাঁর গল্পগুচ্ছ ছিলো
সহজ ও জীবনমুখী, তার সঙ্গে এসব তুলনা আসতেই পারে। কিন্তু তাঁর
সব রচনা ভালো করে ঘেঁটে দেখলে পাকাপাকি ভাবে কিছু বলা যায়না। তাঁর
কিছু কিছু গল্পে মপাসাঁর (যথা নারীসৌন্দর্য বর্ণনায়) অথবা ও. হেনরি
বা চেকভের (শেষ পঙ্ক্তির চমৎকারিত্বে) ছোঁয়া পাওয়া যায়। কিংবা
সামাজিক বৈষম্য নিয়ে মার্ক্সের চিন্তার। মাণ্টোর রচনার মূর্ত মানবিকতাবোধ
খতিয়ে দেখলে অবশ্য প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য, কোথাকার কোনো লেখক বা
দার্শনিক তাঁকে প্রভাবিত করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। ঠাট্টার
ছলে মাণ্টো লিখেছিলেন: " আমি হলাম সব-অজান্তা; আমি মার্ক্স
পড়িনি, ফ্রয়েডের লেখায় চোখও বোলাইনি। হেগেল আর হ্যাভলককে কেবল
নামেই চিনি। আর লোকে বলে যে এইসব চিন্তাশীলেরা আমাকে পথ দেখিয়েছেন।
হাসির কথা!" যাঁরা আমাদের পার্থিব জগতের রহস্য বোঝাতে চান,
তাঁদের সম্পর্কে মাণ্টোর মন্তব্য: " এরা সব মূর্খ। জগতের
রহস্য কেউ কাউকে বুঝিয়ে দিতে পারে না, ও নিজে নিজেই বুঝে নিতে
হয়।"
(আগের
অংশ) (পরের
অংশ)
সমর
সাহা
সুমিত রায়ের সৌজন্যে
উৎস:
Stephen Alter, "Madness and Partition", J. of Comparative
Poetics, vol.14
Ayesha Jalal, "Curator of Hollowed Conscience", The
Hindu, May 11,2012
Ayesha Jalal, Pity of Partition, Princeton U. Press.
Mumtaz Shirin, Manto - Noori Na Nari, Dawn, 1985.
M. Umar Memon, "The Historian of the Individual",
Herald, May 2012.
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)