উর্দু
সাহিত্যের এক দিকপাল সাদাৎ হাসান মাণ্টো (১৯১২-১৯৫৪)
দেশবিভাগ
ও তৎসম্পর্কিত গল্পগুচ্ছ: ১৯৪৮-৫০
মাণ্টো
দেশবিভাগের অগ্নিকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছেন বোম্বে আর লাহোর-- দুজায়গাতেই।
যারা প্রত্যক্ষদর্শী তাদের অনেকের ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিহ্ন হয়ে
গিয়েছিলো এই অগ্নিকাণ্ডে। মাণ্টো বোধহয় ব্যতিক্রম। লাহোরে চলে
এলেন, স্বস্তি পেলেন না। দাঙ্গায় বিয়োগান্ত যা দেখলেন, যা শুনলেন
তা নিয়ে রচনা করলেন মহৎ সাহিত্য। জাতিবর্ণধর্ম নির্বিশেষে মানব
মনের ভ্রান্তি, দ্বন্দ্ব, আবেগ দেখলেন, তার কথা লিখলেন। তাঁর কলমের
খোঁচায় আমরা জানলাম কী নিদারুণ যন্ত্রণায় সাধারণ নিরীহ ভালোমানুষও
কেমন অবিশ্বাস্য রকমের ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। ঘাতক এবং হত-- সবার
মনের নিভৃত কন্দরে পৌঁছলেন। কী জানতে পারলেন তার কথা লিখছেন তাঁর
নাতনীর কন্যা আয়েষা জালাল (টাফ্ট্স্ ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস বিভাগে
মেরি রিচার্ডসন চেয়ার অধ্যাপক):
"neither human zeal
nor piety but human greed and man’s astonishing capacity for
bestiality that had brought the subcontinent to such a sorry
pass"
শরণার্থী শিবিরে ঘুরে ঘুরে
যে তথ্য পেলেন তার সঙ্গে কথাশিল্পীর কল্পনার মিশেল দিয়ে মাণ্টো
যা তৈরী করলেন তাতে সেসব দিনের সেসব ছবি ধরা রইলো কাল থেকে কালান্তরের
জন্য। চলচ্চিত্রের ভাষায় ফ্রীজ-ফ্রেম। এমনটিই করেছিলেন প্রেমচাঁদ
তাঁর 'দাবাড়ু' ('শতরঞ্জকে খিলাড়ী') বইতে। পেশাদার ঐতিহাসিকরা এই
জাদুটা জানেন না, তাই কেতাবী ইতিহাসে এ জিনিষ পাওয়া যায় না। মাণ্টো
লিখলেন: "দেশবিভাগ মানবসমাজে যে বিশাল আঘাত হানলো, আমি তার
প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছি, এখনো আছি।" কিন্তু হতাশায় ভেঙে
না পড়ে তিনি এই ভয়ঙ্কর বাস্তবের মোকাবেলা করলেন, যার মরলো আর যারা
মারলো, উভয়ের কথা লিখলেন। কিন্তু এর সঙ্গে জড়ো করে রাখলেন "যেসব
মানুষেরা তাদের মানবিকতা বোধকে একেবারে বধ করতে পারলো না, তাদের
কয়েক ফোঁটা অশ্রুজল" [সিয়াহ্ হাশিয়ে -- মাণ্টো]।
মাণ্টোর এসময়কার লেখা নিয়ে
আলোচনা করার আগে জানতে হবে যে ধর্মের ভিত্তিতে এই ভারতভাগের অভিঘাত
সুদূরপ্রসারী এবং তা তখনকার মানুষদের মূক করে রেখেছিলো। লুটতরাজ,
ধর্ষণ আর খুনের কথা শুধু ফিসফিস করে বলা হোতো তখন, খোলাখুলি তা
নিয়ে আলোচনা করার মতো মনোবল কোনো লেখকই সংগ্রহ করে উঠতে পারেন
নি। কেবল মাণ্টো ছাড়া। এবং এই দুর্যোগের কথা তাঁর গল্পের ভাণ্ডার
ভরে রেখেছে। এই সময়কার রচনার পর রচনায় মাণ্টো যে সব মানুষ এই মারণযজ্ঞের
বলি, তাদের মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে দিতে চেষ্টিত হয়েছেন। এমন কি যারা
এই পাপকর্মে জড়িত হয়ে পড়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও মাণ্টো দেখাতে প্রয়াস
পেয়েছেন যে তারা এক সম্পূর্ণ বিকল এক রাজনীতিক অবস্থার বলি মাত্র।
মনে রাখতে হবে যে এই সত্যভাষণের পথে মাণ্টোই পথিকৃৎ। এই কথা মনে
রেখে তাঁর কয়েকটি গল্পের চুম্বক নিয়ে আলোচনা করা যাক।
দেশবিভাগের নামে এই যে সর্বগ্রাসী
উন্মত্ততা মাণ্টো তার চেহারা আমাদের দেখালেন লাহোরের এক পাগলাগারদের
বাসিন্দাদের গল্পমাধ্যমে। গল্পটির নাম 'টোবা টেক সিং'. এটি তাঁর
সবচেয়ে নামকরা গল্প। টোবা টেক সিং পাঞ্জাবের একটি গ্রামের নাম।
সেখনকার মানুষ বিষেন সিং অনেকদিন ধরেই গারদের বাসিন্দা, সে সব
সময় জেগে আছে, দুপায়ে খাড়া, গত পনেরো বছর তাকে কেউ অন্যভাবে দেখেনি।
তো দেশবিভাগের কর্তারা পাগলদের জানালেন যে এবার হিন্দু পাগলদের
ভারতে পাঠানো হবে আর মুসলমানরা থাকবে পাকিস্তানে, এই লাহোর গারদেই।
পাগলরা হতভম্ব, তারা এ গারদ এবং তার বাসিন্দাদের ছাড়া অন্য কাউকে
বা কিছু চেনেও না, জানেও না, বোঝেও না। কিছুদিন পরে ভারতে পাঠাবার
জন্য হিন্দুদের ট্রাকে তোলা হোলো, বিষেন সিং জানলো তার গ্রাম পড়েছে
ভারতে, অতএব তাকেও যেতে হবে। তাকে কিছুতেই ট্রাকে তোলা গেলো না,
সে নাছোড়বান্দা, সে যাবে না, সে খুঁটি গেড়ে রইলো দাঁড়িয়ে। ভোরের
আলো ফুটলে এক মর্মান্তিক চিৎকারে ত্রস্ত পাহারাদারেরা ছুটে এসে
দেখে যে বিষেন সিং পনেরো বছর পরে ভূমিশয্যা নিয়েছে ভারত আর পাকিস্তানের
মধ্যেকার এক চিলতে "নো ম্যান্স্ ল্যাণ্ড" জমিতে। তার
দেহে প্রাণ নেই। চারিদিকের মত্ততার মধ্যে পাগলা গারদেই মাণ্টো
খুঁজে পেলেন সুস্থমস্তিষ্কের লোকদের, কেবল তারাই বুঝতে পেরেছে
যে কী চরম পাপ সঙঘটিত হয়ে চলেছে। যে রাজনীতিকরা দেশবিভাগের প্রস্তাবে
সায় দিয়েছিলেন, তাঁরা কিন্তু সেটা বোঝেননি।
টোবা টেক সিং - ইউ-টিউব
থেকে
মাণ্টো নিহতদের নিয়ে যেমন
লিখেছেন, হত্যাকাণ্ডের কথাও তেমনই লিখেছেন। উদাহরণ 'ঠাণ্ডা গোশ্ত্',
পাকিস্তানের মাটিতে বসে লেখা তাঁর প্রথম গল্প। এই লেখাটির কারণে
পাকিস্তানের নতুন মুসলিম রাষ্ট্রে অশ্লীলতার দায়ে তাঁকে কাঠগড়ায়
দাঁড়াতে হয়। ইশার সিং এক খুনী শিখ, সে রায়টের সময় মুসলমানদের বাড়ী
লুট করে দামী গয়নাপত্র এনে দিতো তার রক্ষিতাকে । এমনই এক লুটের
অভিযানে বেরিয়ে সে মধ্যরাতে বিবর্ণ হয়ে তার রক্ষিতার কাছে ফিরে
এলো, তার হাতপা কাঁপছে, সে সঙ্গমে অক্ষম। সন্দেহগ্রস্তা রক্ষিতাটি
ইশারের কৃপাণ নিয়ে তাকে আঘাত করাতে ইশার স্বীকার করে যে এবার সে
একটি সুন্দরী কিশোরীকে অপহরণ করার জন্য ঐ কৃপাণ দিয়ে ছটি মুসলমানকে
বধ করেছে। তারপর সে যখন কিশোরীটিকে বলাৎকার করতে যায় তখন আবিষ্কার
করে যে মেয়েটি আর বেঁচে নেই, তার কাম চরিতার্থ করার জন্য এতক্ষণ
সে একটি মৃতদেহ, 'ঠাণ্ডা গোশ্ত্', বহন করে এসেছে। ছটি মানুষকে
সে হত্যা করলো 'ঠাণ্ডা গোশ্ত'-এর জন্য, এটা বুঝতে পারার পরে সে
নির্বীর্য। খুব সরল কথ্য উর্দুতে গল্পটি লেখা হয়েছে কিন্তু মাণ্টো
যত্ন নিয়েছেন যাতে ইশার সিংকে নিছকই এক নরপশু বলে চিত্রিত না করা
হয়। গল্পের শেষে ইশার তার রক্ষিতাকে বলছে, " বল জানি, আমি
কি কিছু দোষ করেছি ... এখন সবাই তো এই করছে"। মাণ্টোর বিরুদ্ধে
যাঁরা অভিযোগ এনেছিলেন তাঁরা বুঝতে পারেন নি যে গল্পটিতে কোনো
যৌনবিকৃতির কথা লেখা হয়নি, লেখা হয়েছে সেই দাঙ্গার কথা, তৎসঞ্জাত
এক দুঃসহ মানসিক নিপীড়নের কথা, যার যন্ত্রণা সুস্থ মানুষকেও এই
পশুত্বের পর্যায়ে টেনে নামিয়ে আনতে পারে।
গভীর অনুভূতি নিয়ে মাণ্টো
দাঙ্গার নারী নির্যাতন ও নির্যাতিত নারীদের কথা লিখেছেন খোলা মনে,
অভিজ্ঞতা আর কল্পনার সুন্দর সংমিশ্রণ করে। সীমান্তের দুইপারে শরণার্থীদের
বিরোধ নিয়ে লেখা কাহিনী হোলো 'খোল দো', দাঙ্গায় হারিয়ে যাওয়া একটি
মেয়েকে তার বাবার খুঁজে ফেরার গল্প। স্ত্রীর মৃত্যুর পর বাবা যখন
মেয়েটির হাত ধরে অমৃতসর থেকে পালিয়ে আসছিলো তখন গোলমালে মেয়েটি
হারিয়ে যায়। কয়েকটি তরুণ মুসলমান স্বেচ্ছাসেবককে বাবা মেয়েটিকে
খুঁজে দেখতে অনুরোধ করেন। তারা মেয়েটিকে খুঁজে পেয়েছিলো কিন্তু
বাবাকে সে খবর জানায়নি-- কেন তা মাণ্টো বলেননি। কিছুদিন পরে সেখানের
এক হাসপাতালে একটি অচৈতন্য মেয়েকে কারা ফেলে রেখে গেল, খবর শুনে
বাবা গিয়ে দেখলেন তাঁরই মেয়ে বটে, মনে হোলো আর জীবিত নেই। এমন
সময় এক ডাক্তার এসে বললেন জানলাগুলো খুলে দিতে (খোল দো)। আশ্চর্যের
কথা যে যাকে মৃত বলে মনে হয়েছিল সেই মেয়েটি যেন এই আদেশ শুনতে
পেলো এবং শুনে তার শালোয়ারের দড়ি খুলে ফেললো। মেয়ে বেঁচে আছে দেখে
বাবা আনন্দে আত্মহারা, কিন্তু ঘটনার মর্মান্তিকতা উপলব্ধি করে
বহুদর্শী ডাক্তার স্তব্ধ। কারা মেয়েটির এই অবস্থার জন্য দায়ী বা
মেয়েটির ভবিষ্যতে কী হবে মাণ্টো সে নিয়ে কিছু বলেননি, বলার দরকারও
বোধহয় নেই।
দুপক্ষের সরকার দাঙ্গায় অপহৃতা
মেয়েদের পুনর্বাসনের যে চেষ্টা করেন তা নিয়ে মাণ্টো লিখলেন 'তয়াক্কুন'
('কঠিন সত্য')। হারানো মেয়ের খোঁজে পাগলপ্রায় এক মহিলাকে পুনর্বাসন
কর্মী বোঝায় যে তাঁর সুন্দরী মেয়ে আর বেঁচে নেই, কিন্তু মহিলা
হাল ছাড়েন না। হঠাৎ একদিন মহিলা দেখেন তার মেয়ে এক তরুণ শিখের
সঙ্গে পথ চলেছে। শিখটি মেয়েটিকে ডেকে তার পাগলিনী মাকে দেখালো,
মায়ের ডাকে ভ্রূক্ষেপ না করে চলে গেল মেয়ে। এর পরে যখন পুনর্বাসন
কর্মী মহিলাকে বোঝাতে এলো যে তাঁর মেয়ে আর জীবিত নেই, তিনি ভগ্নহৃদয়ে
হাল ছেড়ে মৃত্যুকেই বরণ করে নিলেন।
'মোজেল' গল্পের নায়িকা এক
সুন্দরী, ফুর্তিবাজ ইহুদী মেয়ে মোজেল। ত্রিলোচন সিংকে বিবাহের
প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে বিয়ের রাত্রেই অন্য লোকের সঙ্গে পালিয়ে গেলো।
ত্রিলোচন তাকে ভুলতে না পারলেও শেষে বোম্বাইতে ঘর বাঁধলো পাঞ্জাবের
গ্রামের কৃপাল নামের এক সাধারণ মেয়েকে বিয়ে করে । তারপর দাঙ্গার
এক রক্তঝরা সময়ে মোজেলের সঙ্গে তার আবার দেখা, মুসলমানদের এক ধবংসোন্মত্ত
দল ত্রিলোচনদের ভাড়াবাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিতে চলেছে। মোজেল তার
ইহুদী আলখাল্লা খুলে ছুঁড়ে দিলো কৃপালের দিকে, তারপরে নগ্নদেহে
ছুটলো দাঙ্গাবাজদের নজর কেড়ে রাখতে যাতে সেই সুযোগে বোরখার মতো
আলখাল্লা পরে কৃপাল পালিয়ে যেতে পারে। পথে সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে
গড়িয়ে পড়ে মোজেল মৃত্যুপথযাত্রী। মোজেলের লজ্জা নিবারণের জন্য
ত্রিলোচন তার পাগড়ী খুলে মোজেলকে ঢেকে দিতে মোজেল তা সরিয়ে দিলো--
"তোমাদের এই মিথ্যে ধর্মের আবরণ নিয়ে দূর হয়ে যাও।"
"আল্লা হো আকবর", "যো বোলে সো নিহাল", বা
"হর হর মহাদেব" গর্জনে প্রকট সে জনতার নগ্ন পাশবিকতার
সামনে দাঁড়িয়ে মোজেল কীই বা বলতে পারতো, কী আবরণই বা ঢাকতে পারতো
তার লজ্জা?
অণুগল্পে আবার দেখা গেল মাণ্টোর
মুন্সীয়ানা। সিয়হ্ হাশিয়ে (কালো মার্জিন) এইরকম চমক-লাগানো ভয়ঙ্করতা
ভরা বত্রিশটি অণুগল্পের সঙ্কলন। হাঙ্গেরিয়ান ইস্তভান ওর্কেনি দ্বিতীয়
মহাযুদ্ধের বীভৎসতা প্রকট করার জন্য এমন গল্পের সাহায্য নিয়েছিলেন।
মাণ্টোর অণুগল্পের একটি নমুনা, গল্পের নাম "মিশ্টেক":
" ছুরি গেঁথে গেল পেটে, তারপর উঠে এলো পাঁজরের দিকে। ওঠার
কালে লোকটির পাজামার দড়িটিও কেটে গেলো। আততায়ীর নজর গেলো নীচের
দিকে, বললে, 'ধুর শালা, মিশ্টেক'।"
উৎস:
Stephen Alter, "Madness and Partition", J. of Comparative
Poetics, vol.14
Ayesha Jalal, "Curator of Hollowed Conscience", The
Hindu, May 11,2012
Ayesha Jalal, Pity of Partition, Princeton U. Press.
Mumtaz Shirin, Manto - Noori Na Nari, Dawn, 1985.
M. Umar Memon, "The Historian of the Individual",
Herald, May 2012.