প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিজ্ঞান

জুলাই ৩০, ২০১৫

 

তবে কেমন হতো--

সুমিত রায়


"তুমি বলোতো", গাইলেন উত্তমকুমার, আদুরে আদুরে গলায় সুচিত্রা বললেন, "তুমিই বলো"। ব্যাপারটা এমন হলে চমৎকার হতো, বাঙালী তো রোম্যান্সের পোকা। কিন্তু এবারে তা নয়, এবারে ব্যাপারটা একটু ঘোরালো। র‌্যাণ্ডাল মুনরো ফিজিক্‌স নিয়ে পড়াশোনা করে নাসায় রোবোটিক্স নিয়ে কাজ করেন। মুনরো সাযেবের আবার কার্টুন আঁকার হাত আছে, তার ওপর ভরসা করে তিনি ইন্‌টারনেটে একটা সাইট খুলে ফেলেছেন। সেখানে তিনি উদ্ভট উদ্ভট সব "তবে কেমন হতো" ধরণের প্রশ্ন পোস্ট করেন, তাঁর ব্লগের পাঠকরা তার উত্তর দেয়, আর মুনরো সায়েব ফিজিক্‌সের জ্ঞান ফলিয়ে সেই সব উত্তর ঘসেমেজে একটা কিছু খাড়া করেন। সকার্টুন সেসব উত্তর বেশীর ভাগ সময়েই অপ্রত্যাশিত আর ভারী মজার। সায়েব এ নিয়ে একটা বইও ছেপেছেন, নাম What If?, Houghton Miflin. সেখান থেকে আমরা মাঝে মাঝে কিছু মজার প্রশ্নোত্তর অবসরের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পেশ করবো। এমন কিছু আহামরি ফিজিক্‌স জানার দরকার হবে না, সাধারণ জ্ঞান একটুআধটু থাকলেই চলবে।

এবারের প্রশ্নটা হলো: এই যে "দুরন্ত ঘূর্ণীর এই লেগেছে পাক, এই দুনিয়া ঘোরে বনবন বনবন" -- যদি এই ঘোরাটা হঠাৎ থেমে যায় তবে কেমন হতো? উত্তর: প্রায় সবাই টেঁসে যেতো। ব্যাপারটা চিত্তাকর্ষক হতে শুরু করতো সেটা হবার পর।

 

বিষুবরেখার কাছে পৃথিবীর এই ঘূর্ণনের গতি সেকেণ্ডে চারশো সত্তর মিটার, ঘণ্টায় হাজার মাইলের সামান্য কম। এখন পৃথিবীটা যদি থমকে থেমে যায়, তাহলে বায়ুমণ্ডল কিন্তু থামবে না, ফলম্‌ পৃথিবীর বুকে উঠবে ঘণ্টায় হাজার মাইলে বেগের ঘূর্ণীঝড়। বিষুবরেখার কাছে এই ঝড়ের গতি হবে সবচেয়ে বেশী কিন্তু বিয়াল্লিশ ডিগ্রী উত্তর আর দক্ষিণে শব্দের চেয়ে দ্রুতগামী, supersonic ঝড় উঠবে। এই দুই অক্ষাংশের মধ্যে পৃথিবীর ৮৫ শতাংশ লোক বাস করে।

এই জোরালো হাওয়া অবশ্য বেশীক্ষণ থাকবে না, মাটির সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে আস্তে হয়ে যাবে, কিন্তু যতোক্ষণ থাকবে সে সময়টুকুই ভূপৃষ্ঠে মানুষের তৈরী যা কাঠামো আছে, সব ধূলিসাৎ করার পক্ষে যথেষ্ট। বস্টনের মতো কোনো উত্তুরে শহরে বাস করলে এই শব্দভেদী হাওয়া থেকে নিস্তার পাওয়া য্তে পারে কিন্তু হাওয়ার বেগ আমাদের জানাশোনা সবচেয়ে ওঁচা টর্ণাডোর দ্বিগুণ হতে পারে। বাড়ী, সে কুঁড়ের থেকে আকাশচুম্বী বহুতল, যাই হোক না কেন ভিত্তি থেকে উৎখাৎ হয়ে চিঁড়ে চ্যাপ্টা চেহারা নিয়ে সারা মানচিত্রে হাঘরের মতো কেঁদে বেড়াবে। দুই মেরুর কাছে অবশ্য এতোটা বিপর্যয় হবে না কিন্তু সে অঞ্চলে আবার মানুষ বেশী দেখা যায় না, বোধহয় ঠাণ্ডার জন্য। সবচেয়ে উত্তরে নরওয়ের যে শহর, লংইয়ারবেন তার নাম, সেখানে হাওয়া চলবে পৃথিবীর হিংস্রতম সাইক্লোনের মতো বেগে।

যদি কোনোরকম করে বেঁচে থাকাটা উদ্দেশ্য হয় তাহলে ফিনল্যাণ্ডের হেলসিঙ্কি শহরটা ভালো জায়গা। শহরটা প্রায় ষাট ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশে, তাতে হাওয়ার হাতে ঝামার মতো ঘষে দেওয়াটা রোধ করা যাবে না, কিন্তু এই শহরের নীচে পাথরের ভিত্তিটা বেশ মজবুত আর অনেক সুড়ঙ্গ আছে, সেখানে বাজার, হাট, সুইমিং পুল এমনকি স্কেটিং রিঙ্ক পর্যন্ত সব আছে। ভূপৃষ্ঠে অবশ্য কোনো বাড়ীই যে নিরাপদ তা বলা যাবে না, কথায় বলে না যে কী হাওয়া বইছে সেটা খুব জরুরী কথা নয়, আসল কথা হচ্ছে হাওয়া কী বইছে।

এখন ধরা যাক আপনার অনেক পয়সাকড়ি আছে, আপনি এক বায়ুপ্রতিরোধক বাড়ী বানালেন, বাঙ্কার স্টাইলে। কিন্তু আপনার প্রতিবেশীদের সবায়ের অতো রেস্ত নেই, কাজের তাদের বাড়ী উড়ে এসে আপনার বাঙ্কারের বারোটা বাজাতে পারে এবং বাজাবে। মানুষ জাতি একেবারে ধ্বংস হবে না, জমির তলায় যারা থাকবে তাদের বহাল তবিয়তে থাকার সম্ভাবনা বেশ ভালোই। দক্ষিণ মেরুতে অ্যামুণ্ডসেন-স্কট রিসার্চ সেণ্টারে যে সব বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন, তাঁরা বেঁচে যাবেন, সেখানে হাওয়ার কোনো উপদ্রবই হবে না। তবে তাঁরা লক্ষ্য করবেন যে বহির্বিশ্ব হঠাৎ একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেছে। ব্যাপার দস্তুরমতো ঘোরতর হতে শুরু করবে এখন থেকে।

আমরা বলেছি যে মাটির সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে হাওয়ার বেগ আস্তে আস্তে কমে আসবে। কিন্তু ঘর্ষণ উত্তাপ সৃষ্টি করে, অতএব হাওয়ার বেগ যতো কমে আসবে, হাওয়া ততো গরম হতে থাকবে। যেখানে হাওয়া শুকনো, সেখানে গরম হবে অসহ্য, যেখানে হাওয়াতে জলকণা আছে, সেখানে শুরু হবে ঝঞ্ঝাবাত আর বৃষ্টি। এদিকে যে হাওয়া সাগর-মহাসাগরের ওপর দিযে বইছে সে হাওয়া সাগরতল মথিত করে জল শুষে নিতে থাকবে -- বস্তুত কিছুকাল সাগরতল বলেই কিছু থাকবে না।

সাগরের জল ঠাণ্ডা। ওপরের খুব পাতলা একটা স্তর বাদ দিলে সাগরজলের উষ্ণতা একেবারে চার ডিগ্রী সেণ্টিগ্রেড বরাবর। এখন ওই প্রাণহরা হাওয়া এসে এই ঠাণ্ডা জল ফেনিয়ে ওপরে নিয়ে আসবে, সেখানে ওই বিপর্যয় গরম হাওয়ার সঙ্গে হবে তার মোলাকাৎ।

আর তার ফল হবে এমন এক আবহাওয়া যা পৃথিবীতে আগে কখনো দেখা যায়নি -- হাওয়া, কুয়াশা, ঝিরঝির বৃষ্টি আর তড়িঘড়ি তাপমাত্রার পরিবর্তন। এই যে সাগরের জল ঘুলিয়ে উঠলো তার ফলও হবে মজার। সাগরের গভীর থেকে পুষ্টিকর সব উপাদান ওপরে উঠে আসবে, তাতে নানা সামুদ্রিক জীবরূপের জন্ম আর প্রকাশ সম্ভব হবে। এদিকে আবার সাগরগর্ভের জলে অক্সিজেনের খামতি, কাজেই সেই জলের কারণে মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপাদি অক্সিজেনভোগী প্রাণীদের মড়ক লেগে যাবে। যেসব প্রাণীর পক্ষে নিঃশ্বাস নেওয়া অপরিহার্য, যেমন হাঙর বা শুশুক, তাদের এই বিক্ষুব্ধ স্তরে প্রাণধারণ করা হবে খুব কষ্টের ব্যাপার। সাগরে ঢেউ উঠবে খুব, পূর্ব থেকে পশ্চিমগামী ঢেউ, পূর্বমুখী যে সব তটভূমি তাদের ওপর সে ঢেউ ৎসুনামির মতো আছড়ে পড়ে মাইলের পর মাইল ভেতরে চলে যাবে। ঘূর্ণীঝড়ে ওড়াবে ধূলো আর জঞ্জাল, সূর্য ঢাকা পড়বে তাতে, আর সাগর থেকে উঠে আসবে ঘন কুয়াশা। -- এই দুই ঘটনার ফলে তাপমাত্রা হ্রাস পাবে খুব।

অন্তত পৃথিবীর একদিকে।

মনে রাখতে হবে যেই ক্ষণে পৃথিবীর ঘূর্ণন বন্ধ হয়ে গেলো, সেই ক্ষণ থেকে আমরা চব্বিশ ঘণ্টার দিনরাত্রি বলে যা জানি, তার ইতি। তার মানে এই নয় যে সূর্য আকাশ পরিক্রমা করবে না, তবে তার গতি হবে খুব কম -- ছমাস লাগবে একদিক থেকে অন্যদিকে যেতে, অর্থাৎ আমাদের দিন আর রাত্রি হবে ছমাস দীর্ঘ। যেদিকে দিন সেদিক সূর্যের তাপে ঝলসাবে আর যেদিকে রাত সেদিকে অপরিমেয় শৈত্য। এর ওপর বায়ুমণ্ডলের যে অংশ সূর্যের একেবারে মুখোমুখি, সেখানে পরিচলনের (convection) কারণে তুমুল ঘূর্ণীঝড় হতে থাকবে। আমাদের পৃথিবীর অবস্থা হবে অনেকটা শুক্রগ্রহ শৈশবে যেমন ছিলো তেমন। শুক্রগ্রহের ঘূর্ণন গতির কারণে শুক্রগ্রহ অনেক মাস ধরে সূর্যের দিকে একমুখী হয়ে থাকে, যেমনটি আমাদের স্থাণু পৃথিবী থাকবে। তবে শুক্রগ্রহের বায়ুমণ্ডল বেশ গাঢ়, তার ফলে চট করে হাওয়া সারা শুক্রগ্রহ ঘুরে আসে আর দিনের আর রাতের অঞ্চলের মধ্যে তাপমাত্রার তারতম্য খুব বেশী থাকে না।

মজার কথা হচ্ছে যে যদিও আমাদের দিন-রাতের দৈর্ঘ্য বেড়ে গেছে, মাসের দৈর্ঘ্য কিন্তু একই থাকবে, কেননা আমাদের চাঁদ তার পুরোনো প্রথা মতোই পৃথিবীর চারধারে ঘুরে যাবে। তফাৎ হবে এই যে পৃথিবীর ঘূর্ণনের ফলে চাঁদে জোয়ার-ভাঁটার (tidal) কিছু শক্তি সঞ্চারিত হয়, যার ফলে এখনকার চাঁদ আস্তে আস্তে পৃথিবীর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। পৃথিবী স্থাণু হয়ে গেলে সেটি আর হবে না, ফলে চাঁদ আস্তে আস্তে আমাদের কাছে চলে আসতে আরম্ভ করবে।

কবে, কোন যুগ থেকে চাঁদ আমাদের বন্ধু, ছায়ার মতো আমাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। আমাদের এই দুর্দিনে চাঁদই আমাদের রক্ষা করবে। "চাঁদের মতন অলখ টানে জোয়ারে ঢেউ তোলাবো", গেয়েছিলেন আমাদের কবি। এবারও চাঁদ তাই করবে, চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের অলখ টান আস্তে আস্তে আমাদের পৃথিবীকে ঘোরাতে শুরু করবে। এবং আবার আমাদের দিন-রাত ছোটো হয়ে বারো ঘণ্টা হয়ে যাবে, সূর্য উঠবে ডুববে, চাঁদ উঠবে "বাঁশবাগানের মাথার ওপর", হয়তো কাজলাদিদিরাও আবার জন্ম নেবেন! আমরা অবশ্য তখন আর থাকবো না। (পরের লেখা)

 

সূত্রঃ Randall Munroe, What If :  Serious Scientific Answers to Absurd Hypothetical Questions, Houghton Mifflin, New York 2014


লেখক পরিচিতি - পাঁচ দশক হোলো আমেরিকাবাসী। চাকরীজীবনে তথ্য- ও সংযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবী, যদিও পদাতিকমাত্র। অবসর নেবার পর কিছু লেখালেখি করে থাকেন। ঘোর রবীন্দ্রপ্রেমী, নিউ জার্সিতে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল ও তিনটি সফল রবীন্দ্রমেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গীতবিতান.নেট রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর জ্ঞানকোষ মাত্রার এক বিস্ময়কর ওয়েবসাইট, সার্ধশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি। "অবসরের" সঙ্গে জন্মকাল থেকে নানাভাবে যুক্ত।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।