বিজ্ঞান
তবে কেমন হতো (২) --
সুমিত রায়
(আগের লেখা) ক্রিকেট খেলা নিয়ে সম্প্রতি বঙ্গভূমিতে বেজায় শোরগোল, অন্তত সোশ্যাল মিডিয়াতে যা নজরে আসছে! তাতে আবার দেখি জাতীয় সঙ্গীতের লঙ্কা ফোড়ন পড়েছে,পড়ে উল্লাস বেড়েছে আরো। সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক মজার কথা এই যে জাতীয় সঙ্গীতের কবি এদিকে আবার ন্যাশনালিজম নিয়ে ভারী গেরেম্ভারী বক্তৃতা দিয়ে বেড়িয়েছিলেন। অবশ্য এটা বলতে পারেন ওঁকে দোষ দিচ্ছেন কেন, উনি গান বেঁধেছিলেন পঞ্চম জর্জের প্রশস্তি করে, জাতীয় সঙ্গীত তো আর লিখতে যাননি। যাকগে, হোক না এই কলরব, এ কলরবে অনেকের নাম শুনতে পাচ্ছি, বিরাট সব ধনীদের নাম শুনছি, কিন্তু বাঙালী নাম কিছু শুনলাম বলে মনে হলো না। আমি আবার পাতি প্রাদেশিক মানুষ, আমার তা ভালো লাগলো না মোটেই। এই বাংলার মাটিতে এককালে মুন্কে কৈলাস, আশানন্দ ঢেঁকি, বাঘা যতীনের মতো কৃতী লোকেরা দাপিয়ে গেছেন। ঘনশ্যাম দাসও ছিলেন, অবশ্য তাঁর কর্মক্ষেত্র বাইরের বিশ্বে, বাংলায় নয়। এক ঘনশ্যাম ছাড়া বাকীদের কীর্তিকলাপ নিয়ে তেমন কিছু জানাও যায়না ছাই আজকাল।
তবে ক্রিকেটের কথা যদি তোলা হয় তাহলে আমাদের ব্রজদার কথা বলতেই হবে। ব্রজদা অর্থাৎ ব্রজরাজ কারফরমা। ক্রিকেট ছাড়াও বাঙালীজীবনের অন্য অনেক ক্ষেত্রে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান আছে, সুখের কথা এই যে আমাদের রূপদর্শী সে সব লিপিবদ্ধ করে গেছেন – ব্রজবুলিতে ১। ক্রিকেটের গল্পে আসা যাক, এই ব্রজদার অধিনায়কত্বে ভারত ক্রিকেটে ইংল্যাণ্ডের মোকাবেলা করেছিলো এই ইডেন গার্ডেনেই, সাল উনিশশো তেত্রিশ, সে আমাদের বাপেদের কাল। জার্ডিন সায়েব এমসিসি টিম এনেছিলেন, এই সেই জার্ডিন যিনি বডিলাইন বোলিং চালু করে ক্রিকেট জগতে যায়-যায় রব তুলিয়েছিলেন। যাক, প্রথম দিন জার্ডিন টসে জিতে ব্যাটিং নিয়েছে, নিয়ে ভারতীয় বোলিং ছাতু করে যখন পঁচানব্বই ফর নো উইকেট করেছে, তখন ব্রজদাকে বল ধরতেই হলো। ব্রজদা আবার সব্যসাচী, ডান হাতে ফাস্ট বল আর বাঁ হাতে স্পিন দেন। তা ব্রজদার প্রথম বলটিই লেগ ব্রেক। ব্যাটসম্যান চিৎপাৎ, পায়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে স্ট্রেচারে করে প্যাভিলিয়ানে ফেরৎ যেতে হলো, বলের নামই তো লেগ ব্রেক। নতুন ব্যাটসম্যান পড়লো পরের গুগলি বলে। চটে গিয়ে জার্ডিন টিমের সবচেয়ে গাঁট্টাগোট্টাকে ব্যাট হাতে পাঠালো তারপর। ব্রজদা তাকে উপহার দিলেন ব্রজ স্পেশাল, "ফাস্ট বলের সঙ্গে লেগ স্পিন মিশিয়ে বলটা ঝোলালেন অফ স্টাম্পে।" খাঁটি বডিলাইন, লাইন ধরে গিয়ে লাগলো সায়েবের বডিতে, সায়েব "লাট্টুর মতো পিন পিন করে স্পিন খেতে খেতে সর্ট ফাইন লেগে" পপাত চ মমার চ। লাঞ্চের আগেই পঁচানব্বই রানে জার্ডিনের দল আউট। বিশ্বাস হচ্ছেনা, ছাপার অক্ষরে লেখা আছে, রূপদর্শীর বই খুলে দেখুন।
ব্যাট হাতে ব্রজদার কেরদানীর কথা পরে হবে, এখন যে কারণে এই লেখার শুরু সেটা বলি। লাঞ্চের সময় প্যাভিলিয়নে সায়েবরা সম্বিৎ ফিরে পেতেই মহা জল্পনা শুরু হয়ে গেলো, ব্রজদাকে নিয়ে। দলে সবাই জার্ডিনকে ঘিরে প্রশ্ন করলে -- বল হাতে পেলে এই অসুর কী করতে পারে তা তো অবিশ্বাস্য হলেও স্বচক্ষে দেখা গেলো, এখন এ লোক যে আলোকের গতিতে বল ছুঁড়ে কেউ চোখে দেখার আগেই আমাদের আউট করে দেবে না তার কোনো গ্যারাণ্টি আছে কি? জার্ডিন ইস্কুলে একটু ফিজিক্স পড়েছিলেন, তা থেকে ব্রজদা কেন, ভগবানের বাবাও আলোর গতিতে কিছুই ছুঁড়তে পারবেন না, এই বুঝিয়েসুজিয়ে ওদের মাঠে পাঠাতে পারলেন। ম্যাচের পর কাগজপত্রে এ প্রশ্ন নিয়ে কিছু লেখালেখি হয়েছিলো, তবে সত্যেন বোস তখন ঈশ্বরকণার খোঁজে দেশের বাইরে ছিলেন কাজেই তাঁর মত পাওয়া যায়নি, আর কেউ এগিয়েও আসেননি। ব্যাপারটা তার পর একরকম ধামাচাপা পড়ে যায়।
এই প্রশ্নের একটা কাছাকাছি উত্তর পাওয়া গেলো এই এতোদিন পর, ইন্টারনেটের কল্যাণে। র্যাণ্ডাল মুনরো ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনা করে নাসায় রোবোটিক্স নিয়ে কাজ করেন। মুনরো সায়েবের আবার কার্টুন আঁকার হাত আছে, তার ওপর ভরসা করে তিনি ইন্টারনেটে একটা সাইট খুলে ফেলেছেন। সেখানে তিনি উদ্ভট উদ্ভট সব "তবে কেমন হতো" ধরণের প্রশ্ন পোস্ট করেন, তাঁর ব্লগের পাঠকরা তার উত্তর দেয়, আর মুনরো সায়েব ফিজিক্সের জ্ঞান ফলিয়ে সেই সব উত্তর ঘসেমেজে একটা কিছু খাড়া করেন। সকার্টুন সেসব উত্তর বেশীর ভাগ সময়েই অপ্রত্যাশিত আর ভারী মজার। সায়েব এ নিয়ে একটা বইও ছেপেছেন, নাম What If?, Houghton Miflin.
সে বইতে মুনরো প্রশ্ন তুলেছেন, যদি একজন বেসবল পিচার আলোকের কাছাকাছি গতিতে বল ছুঁড়তো, তবে কেমন হতো? তারপর ফিজিক্স লাগিয়ে তার উত্তর খাড়া করেছেন। তাঁর এক পাঠক আবার সেই উত্তর এমআইটিতে এক কম্প্যুটারে চড়িয়েছেন, যাকে সিমুলেশন বলে আইটির লোকেরা। বেসবল, ক্রিকেট -- আমাদের সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে তো প্রায় একই ব্যাপার, উত্তরটাও একে ওর ঘাড়ে চাপানো যায়। তফাৎ এইটুকু যে মুনরোর বেসবল সাদা আর ব্রজদার ক্রিকেট বল লাল -- তবে আমরা যে ধ্বংসযজ্ঞের কথা বলতে চলেছি, সেখানে লাল-সাদার পার্থক্যটা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়।
এখন দেখা যাক যে ব্রজদা যদি আলোকের গতিতে -- আরে ঠিক আছে, ঠিক আছে, আলোকের নব্বই শতাংশ গতিতে -- বলটা ছোঁড়েন তাহলে কী ঘটতে পারে। ঘটতে পারে অনেক কিছু, কিন্তু অবিশ্বাস্যরকম দ্রুতগতিতে। ব্রজদার করচ্যুত হয়ে হাওয়ার মধ্যে দিয়ে বল ছুটছে ঘণ্টায় ষাটকোটি মাইল বেগে। হাওয়াতে নাইট্রোজেন-অক্সিজেনের যে সব পরমাণু আছে তারা সাধারণত ঘণ্টায় কয়েকশো মাইল বেগে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে, ষাটকোটি মাইলের কাছে তারা স্থাণু। অর্থাৎ সাধারণত হাওয়ার মধ্যে দিয়ে রেলগাড়ী-টাড়ি গোছের কিছু গেলে যেমন হয়, বায়বীয় বেগতত্ত্ব, এয়ারোডাইনামিক্স, মাফিক হাওয়া যেমন পাশ কাটিয়ে বয়ে যায়, তেমনটি হবে না। আগে যে কম্প্যুটার সিমুলেশনের কথা বলেছি, তার মারফৎ দেখা যাচ্ছে যে হাওয়ার কিছু পরমাণু ব্রজবলের যে সব পরমাণু -- কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন -- এদের মধ্যের ফাঁক দিয়ে গলে যাবে। আর হাওয়ার কিছু অণু একেবারে নিরেট দেওয়ালে গুঁতো খাবার মতো বলের অণুতে অণুতে সেঁটে যাবে, যাকে বলে ফিউশন।
এমন প্রতিটি সঙ্ঘর্ষের ফলে উৎপন্ন হবে অজস্র গামা-রশ্মি আর বস্তুকণিকা। রশ্মি আর কণিকাসমগ্র একটা বুদ্বুদের রূপ নিয়ে আলোকের গতিতে ফুলে উঠতে শুরু করবে আর এই ফুলন্ত বুদ্বুদ আরো যতো হাওয়ার পরমাণুর সংস্পর্শে আসবে ততো পরমাণু ধ্বংস করে, অণু থেকে ইলেক্ট্রন ছিঁড়ে ফেলে যে ভাস্বর বস্তুটির সৃষ্টি করবে তাকে বলে প্লাজমা। বলের সামনের দিকে এই বিস্ফোরণ উল্টো চাপ সৃষ্টি করে বলের গতি কিছু কমিয়ে দেবে, কিন্তু পরিমাণে তা নস্যি। তবে এই চাপের চোটে বলটা সামনের দিক থেকে ক্ষয়ে যেতে শুরু করবে, টুকরো টুকরো হয়ে বলের সামনের অংশ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করবে। এইসব টুকরো আবার যখন হাওয়ার পরমাণুতে আঘাত করবে তখন আবার ফিউশনের বিস্ফোরণ হবে, এভাবে ফিউশন হবে আরো দুতিন দফা।
সত্তর ন্যানোসেকেণ্ড (দশমিকের পর সাতটা শূন্য, তার পর সাত) পরে প্রায় আলোকের গতিতে এক্সরে আর গামা-রের বুদ্বুদ এসে ব্যাটসম্যানের কাছে পৌঁছবে। ওদিকে ব্রজদা যে কী কাণ্ড ঘটিয়েছেন, ব্যাটসম্যান বেচারা তার কিছুই জানে না, বল ছোঁড়ার দৃশ্য তার কাছে এসে পৌঁছোচ্ছে আসল বল পৌঁছোনোর মাত্র কয়েক ন্যানোসেকেণ্ড আগে। তখন বলের অবশ্য আর বলত্ব বলে কিছু নেই, সঙ্ঘর্ষণের ফলে তার মালমশলার বেশীর ভাগই প্লাজমায় মিশে গেছে, বাকী যা আছে তার একটা বুলেটের মাপ আর আকৃতি, তা আরো প্লাজমা তৈরী করতে করতে এগিয়ে আসছে। গামা-রের ধাক্কা খাবার কয়েক ন্যানোসেকেণ্ড পরে বলের বুলেট আর টুকরোটাকরা ওদিকে পৌঁছবে -- প্রথমে ব্যাটে, তারপর ব্যাটসম্যানে, তারপর উইকেট, উইকেটকীপার, সারা মাঠ, স্টেডিয়াম, ইডেন উদ্যান, আপিস পাড়া, ... আর বলার দরকার আছে?
ভূশণ্ডীর মাঠে বটগাছে বসে বরম পিচাশ শিবু দেখবে সূর্যের চেয়ে শতগুণ শক্তিশালী আলোর ঝলক, কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে তার তেজ যাবে কমে। তারপর দেখবে একটা আগুনের গোলা বড়ো, আরো বড়ো হচ্ছে, তারপরেই সেই কুখ্যাত ব্যাঙের ছাতা। সামান্য কিছুক্ষণের মধ্যে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঢেউ এসে আছড়ে পড়বে সব কিছু ধূলিসাৎ করে দিয়ে। শিবুর সূক্ষ্ম শরীর, তার ক্ষতি কিছু হবে না, নৃত্যকালীর সঙ্গে বিয়েতেও নতুন কিছু বাধা পড়বে না, কেবল বট গাছের সুন্দর আস্তানাটি আর থাকবে না, এই আপশোস!
ব্রজদায় আবার ফেরৎ যাই। লাঞ্চের পর জার্ডিনের দলের বডিলাইনের গুঁতোয় ভারত পাঁচ উইকেটে তিরিশ রান। ব্রজদা নামলেন, প্রথম ওভারে ছত্রিশ, পরের ওভারে কোনো রান ছাড়াই আরো দুটো উইকেট পড়ে গেলো। পরের ওভারে একত্রিশ, ব্রজদা আবার ফেস করছেন। সে ব্যাটা "বোলার ছাড়লে বাম্পার, ব্রজদা দিলেন জাম্পার" -- ব্যাটের তাড়নে বল সোজা ওপরে উঠে "আকাশের নীলিমায় একেবারে বিলীন হয়ে গেলো।" আর পত্তন হলো প্রথম "ব্রজস্ পাজল" -- এই মারটিকে কতো রান ধরা হবে? শেষে ছয়েই রফা। গোলমালের শেষ এখানেই নয়, কেননা পরের ওভারেই ব্রজদার মারে বল গেলো দুটুকরো হয়ে, তার অর্ধেক হলো ক্যাচ আর অর্ধেক ওভারবাউণ্ডারী। "ব্রজস্ পাজল -২"। লোকে অস্ট্রেলিয়ার কিথ মিলারকে নিয়ে তখন খুব লাফালাফি করে, ব্রজদাকে সবাই বললে মিথ কিলার।
জার্ডিন এমসিসি দল নিয়ে খেলতে এসে এ ম্যাচের পর "টেমসিসি" দল নিয়ে দেশে ফিরে গেলো, ফিরে গিয়েই রিটায়ার! বিশ্বাস না হলে, ওই যে বললাম, স্বচক্ষে যাচাই করে নেবেন, ছাপার অক্ষরে!
১ - ব্রজদার গুল্পসমগ্র, রূপদর্শী, উজ্জ্বল সাহিত্য মন্দির, ১৩৭১
সূত্রঃ Randall Munroe, What If : Serious Scientific Answers to Absurd Hypothetical Questions, Houghton Mifflin, New York 2014
লেখক পরিচিতি - পাঁচ দশক হোলো আমেরিকাবাসী। চাকরীজীবনে তথ্য- ও সংযোগপ্রযুক্তি বিপ্লবী, যদিও পদাতিকমাত্র। অবসর নেবার পর কিছু লেখালেখি করে থাকেন। ঘোর রবীন্দ্রপ্রেমী, নিউ জার্সিতে এক রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার স্কুল ও তিনটি সফল রবীন্দ্রমেলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। গীতবিতান.নেট রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর জ্ঞানকোষ মাত্রার এক বিস্ময়কর ওয়েবসাইট, সার্ধশতবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি। "অবসরের" সঙ্গে জন্মকাল থেকে নানাভাবে যুক্ত।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।