(আগের অংশ) সসিভেকালু গণেশের দালান থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে বিজয়নগর শৈলীর আর এক বিখ্যাত উদাহরণ, ‘কৃষ্ণ মন্দির।’ ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত কৃষ্ণদেবরায়ের অন্যতম কীর্তি এই মন্দির। ইংরাজিতে এই মন্দিরের War Memorial বা Victory Temple নাম দেওয়া যেতে পারতো। কারণ উদয়গিরির রাজা গজপতিরাওকে যুদ্ধে পরাস্ত করে সেখান থেকেই কোনও এক মন্দিরের বাল-কৃষ্ণের বিগ্রহ নিয়ে এসে তিনি এই মন্দির নির্মাণ করে স্থাপন করেন। এও জানা আছে যে গজপতিরাও সন্ধির শর্ত হিসাবে নিজ কন্যা কে কৃষ্ণদেবরায়ের হাতে তুলে দেন। আমার মনে এক প্রশ্নের উদয় হয়। “তুঙ্গভদ্রার তীরে” উপন্যাসে লেখক এই মন্দির নির্মাণের প্রসঙ্গ কেন উল্লেখ করেননি। অবশ্য উপন্যাসে এই প্রসঙ্গের উল্লেখ করা যে বিশেষ প্রয়োজন ছিল তাও নয়। তবে এই উপন্যাসের পটভূমিকার সঙ্গে এই ঘটনার সংস্রব আছেই। Robert Sewell তাঁর বিখ্যাত বই “A Forgotten Empire”-এ কৃষ্ণদেবরায়ের সম্পর্কে লিখেছেন,
“In 1513 A.D. he marched against Udaygiri, in the present district of Nellore, an exceedingly strong hill-fortress then under the king of Orissa, and after the successful termination of the war he brought with him from the temple on the hill a statue of the god Krishna, which he set up at Vijaynagar and endowed with a grant of lands. This is commemorated by a long inscription still in existence at the capital. It was then that the great temple of Krishnasvami was built, which though now in ruins, is still one of the most interesting objects in the city”।
চিত্র-৫২, বর্তমানে চেন্নাই-মিউজিয়ামে রাখা উদয়গিরি থেকে আনা কৃষ্ণ মূর্তি, ছবি ইন্টারনেট থেকে
Sewell-এর লেখা অনুযায়ী আমরা ভাবতেই পারি যে ১৫১৩ খ্রিষ্টাব্দের কয়েক বছরের মধ্যেই এই মন্দির নির্মিত হয়ে যায়। কৃষ্ণের এই মূর্তি যে বালগোপালের তা Sewell লেখেননি তাছাড়া কৃষ্ণ মন্দিরের বদলে নাম লিখেছেন “কৃষ্ণস্বামী মন্দির।”
Sewell-এর বই ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত, কৃষ্ণ মন্দির তখন ভগ্ন অবস্থায় ছিল বলে লিখেছেন। এখনও যে খুব ভাল অবস্থায় তা বলা ঠিক নয়, তবে ‘in ruins’ বলা যায় না। ASI এই মন্দিরের সংস্কার করছেন এখন, তা এখন দেখা যাচ্ছে। আমরা ওনার উল্লেখিত শিলা-লিপি দেখেছি, অবশ্য আমাদের পক্ষে তা পড়া সম্ভব হয়নি। যাক, এবার আমাদের দেখা কৃষ্ণ মন্দিরের যথাসাধ্য বর্ণনা দেবার চেষ্টা করি। ভিডিও ক্লিপ নিশ্চয় এ বিষয়ে আমাদের সাহায্য করবে, যা একটু পরেই দেওয়া আছে।
কৃষ্ণ মন্দিরের গোপুরমের সামনে এলাম। ভিঠঠল দেবের মন্দিরের গোপুরমের সঙ্গে নিচের দিকের আকারের অনেকটা মিল আছে। ওপরের অংশ এরও নেই, মনে হয় ইটের গাঁথনি ছিল বলে। একটু আগেই বলেছি যে এখন গোপুরমের জীর্ণোদ্ধার চলছে, সামনের দিক লোহার পাইপ দিয়ে ভারা বাঁধা রয়েছে। নিচের দিকে লোহার পাইপের ফাঁক দিয়ে আধুনিক ভাস্কর্যের মতো একটি প্যানেল দেখতে পেলাম। কাছে গিয়ে দেখে মনে হল এই তো সেই উদরগিরি দখল করে আসা কৃষ্ণদেবরায়ের সৈন্য-সামন্তের ভাস্কর্য । অর্থাৎ এই ভাস্কর্য নতুন নয়, অল্প সময় আগে সংস্কার করা হয়েছে বলেই এই রকম পরিষ্কার ও সূক্ষ্ম দেখতে লাগছে।
চিত্র-৫৩, উদয়গিরির যুদ্ধজয় করে কৃষ্ণদেবরায়ের সৈন্য
মন্দিরের ভিতরে ঢুকলাম। অসংখ্য থাম। প্রতিটি থামে অপূর্ব ভাস্কর্য। থামের ওপরে চার দিকে কড়ি রয়েছে ছাদ ধরে রাখার জন্যে। প্রতি কড়ির দুই প্রান্তে corbel। কোনও জায়গা ফাঁকা নেই, প্রতি সেমি জায়গায় পাথরের ওপর বিভিন্ন মটিফ। থামগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বৈশিষ্ট্যমূলক ইয়ালি নামের সিংহের মূর্তি, যার মধ্যে ঘোড়ার আকারও কল্পনা করা যায়। মন্দিরের গর্ভগৃহে কেবল মাত্র বেদি রয়েছে, বিগ্রহ নেই। এখানেই উদয়গিরি থেকে আনা ‘বালগোপাল’ বা Sewell-এর মতে ‘statue of god Krishna’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন তা চেন্নাইএর মিউজিয়ামে রাখা আছে (আগেই বলেছি ও ছবি দেখিয়েছি)। বাইরে এখন বৃষ্টি না পড়লেও বেশ অন্ধকার, তাই মণ্ডপের ভিতরেও আলো বেশ কম। জানি না এই আবহাওয়ার জন্যে কি না, ভিতরে খুবই স্যাঁত-স্যাঁতে আর অসংখ্য চামচিকে। বিগ্রহ নেই বলে হয়তো অন্যান্য জায়গার তুলনায় এখানে দর্শনার্থীর উপস্থিতি নেই বললেই চলে।
মন্দিরের ভিতরে ভাস্কর্যগুলো ছিল রিলিফের কাজ, বাইরের দেয়ালের কাজগুলোও রিলিফই কিন্তু দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আমার মতো সাধারণ মানুষেরও চোখে পড়ে। এক একটি আলাদা আলাদা ব্লক গ্রানাইট, তা প্রায় ১মিটার বর্গাকার আকারের হবে, পাশাপাশি ও ওপর নিচে সাজিয়ে দেয়াল গাঁথা হয়েছে। প্রায় প্রতিটি ব্লকে ভিন্ন ভিন্ন কাজ। আর যে পার্থক্যের কথা বলছিলাম তা হল এগুলো সমস্ত হাই-রিলিফের কাজ। ভাষায় বর্ণনা করার চেষ্টা করছি না, সঙ্গের ভিডিও ক্লিপ এই তফাৎ বোঝানোয় সাহায্য করবে আশা করি।
এ পর্যন্ত আমরা দেখেছি ছোট বড় মন্দির আর তার মধ্যে অতি সুন্দর ও অত্যুতকৃষ্ট বিভিন্ন প্রকারের ভাস্কর্য। শুধু তাই নয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে আপাত দৃষ্টিতে একটি মাত্র দ্রষ্টব্য হলেও বিভিন্ন ভাবে দেখলে তার মধ্যেই একাধিক রূপ খুঁজে পাওয়া যায়, যা অভূতপূর্ব। এ ছাড়া গণেশের দুটি মূর্তি তাদের বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রধানত স্বতন্ত্ররূপে নির্মিত অবস্থায় দেখেছি। গণেশের এই দুই মূর্তি দৃষ্টিনন্দন হলেও ভাস্কর্য শিল্পের অপরূপ উদাহরণের পর্যায়ে ফেলা যায় বলে আমার মনে হয় না।
চিত্র-৫৪ নরসিংহ মূর্তি
এবার দেখতে এলাম “নরসিংহ মন্দির।” মন্দির বলা যায় কি না আমার সন্দেহ হয়, কারণ নরসিংহ বা উগ্র-নরসিংহ এখানে সিংহাসনের মতো এক জায়গায় বসে আছেন, ঘেরা কিছুটা থাকলেও ছাদ নেই মূর্তির সঙ্গে। এই মূর্তি ৬.৭০ মিটার উচ্চের আর নির্মিত হয়েছে একটি বিরাট গ্রানাইটের ব্লক থেকে । কৃষ্ণদেবরায়ের রাজত্বকালে ভাস্কর কৃষ্ণভট্ট দ্বারা ১৫২৮ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয় এই মূর্তি লক্ষ্মী-নরসিংহ রূপে। কোনও এক সময়ে নরসিংহ, লক্ষ্মী-হারা হয়ে গেছেন। এখন নাকি লক্ষ্মীদেবীর ডান হাত নরসিংহের বাম কাঁধে দেখা যায়। আমি অবশ্য সেই হাত দেখতে পাইনি। নরসিংহের দুই হাঁটু, পাথরের এক পাটাতনে জোড়া রয়েছে এখন। এই পাটাতন কবে নির্মিত যদিও জানা নেই কিন্তু Sewell-এর বই-এ যে ফটোগ্রাফ আছে তাতে এই ‘বাঁধন’ নেই। এই মূর্তি, বিজয়নগর শৈলীর উৎকৃষ্ট ভাস্কর্যের উদাহরণ হিসাবে বিচার করা হয়ে থাকে।
চিত্র-৫৫, বাদাভী শিব-লিঙ
নরসিংহ মন্দিরের সামনে থেকে ডান দিকে দৃষ্টি পড়ে কাছেই বেশ উঁচু গ্রানাইটের মিটার ১৫ দৈর্ঘ্যের এক মোটা পাঁচিল। পাঁচিলের ওপর দিক ইটে গাঁথা, যে রকম আমরা গোপুরমগুলোর ওপর দিকে দেখেছি। যাই হোক ওই দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে পাঁচিলটা আসলে মন্দিরের দেয়াল। মন্দিরে একটি মাত্র ঘর দেখতে পেলাম আর তার মধ্যে রয়েছে দেড় মিটারেরও বেশি প্রস্থচ্ছেদ যুক্ত এক শিব লিঙ্গ। নিচের অংশ তার রয়েছে জলের মধ্যে। ঘরের দরজার চৌকাঠ থেকে শিব-লিঙ্গ স্পর্শ করার কোনও উপায় নেই জলের মধ্যে না নেমে। জলের গভীরতা কতটা তা বোঝা সম্ভাবনা নেই আলোর অভাবের জন্যে। এই মন্দির বা শিব-লিঙ্গের নাম “বাদাভী শিব-লিঙ্গ,” অর্থাৎ “বড় শিব-লিঙ্গ।” এই লিঙ্গ একটি পাথর থেকে নির্মিত ও ৩মিটার উচ্চতা বৈশিষ্ট্য। কাছেই এক বোর্ডে লেখা আছে যে এই শিব লিঙ্গ নাকি এক গরীব মহিলা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। যে জলের অপর এই শিব লিঙ্গ রয়েছে তা নাকি গ্রামের কৃষি-জল নিকাশি নালার। নরসিংহ মন্দির ও এই বড় শিব-লিঙ্গ দেখতে গেলে গাড়ি থেকে নেমে মেঠো রাস্তা হয়ে আসতে হয়, যদিও গাড়ির রাস্তা থেকে অল্প দূরেই এই দুই-এর অবস্থিতি। গ্রাম্য পরিবেশ, অবশ্য আশপাশে জন-বসতি দেখতে পাইনি।
চিত্র-৫৬, প্রসন্ন বিরূপাক্ষ মন্দির
এবার কয়েক মিনিট গাড়ি চালানোর পরই গঙ্গাধর নামিয়ে দিল আমাদের “প্রসন্ন বিরূপাক্ষ” বা মাটিরতলায় শিব মন্দিরের সামনে। আমাদের মধ্যে দু-তিন জন ছাড়া নিচু নিচু সিঁড়ি দেখে আর নামতে সাহস করলাম না, ঘুরে ঘুরে অবসাদ এসে গেছে, তা ছাড়া শুনলাম নিচে নাকি জলে ভর্তি রয়েছে এবং বিরূপাক্ষ বা শিব-লিঙ্গ এখন আর মন্দিরে নেই । ধারণা করা হয় যে নিকটবর্তী তুঙ্গভদ্রার নদীর জল এখানে চলে আসে, কারণ তুঙ্গভদ্রা বাঁধের জল ছাড়লে মন্দিরের জল তলের উচ্চতা বেড়ে যায়।
মাটির তলায় শিব মন্দির যদিও বলা হচ্ছে, আসলে আশপাশের ভূমির তল থেকে নিচে এর অবস্থান, মন্দিরের সমতল শীর্ষের তল ভূমির তলের সমান। তাই এমন নাম। কয়েক শতাব্দী মাটিতে চাপা পড়েছিল, মাত্র ১৯৮০ সালে নাকি মাটি খুঁড়ে মন্দির বের করা হয়। বলা হয় চতুর্দশ শতাব্দীতে কৃষ্ণদেবরায়ের সিংহাসনে আরোহণ উপলক্ষে এই মন্দির নির্মিত হয়। আবার অনেকে বলেন নির্মাণ নয় কৃষ্ণদেবরায় এই মন্দিরে অনেক দান করেছিলেন। তবে মন্দিরের পাশে এক বোর্ডে লেখা আছে,
“An inscription referring to this temple states that Krishnadevaraya donated Nagalapura and other villages for worship and offering to the god for the merit of his parents Narsanayaka and Nagajidevi”।
চিত্র-৫৮, লোটাস মহল
চিত্র-৫৯, চিত্রাঙ্গী মহলের বারান্দা
চিত্র-৬১, প্রাচীন নিম গাছ
প্রায় সওয়া এগারোটার সময়, অর্থাৎ প্রসন্ন বিরূপাক্ষ মন্দির থেকে মিনিট পনেরো দূরত্বে গঙ্গাধর আমাদের উঁচু পাঁচিল ঘেরা দুর্গের আকারের এক জায়গায় নিয়ে এলো। সামনে এক বোর্ডে তিনটি স্থানের দিক্ নির্দেশ লেখা-লোটাস মহল, হাথিশালা আর রঙ্গ মহল। টিকিট কেটে ঢুকতে হল এই ঘেরা জায়গার মধ্যে যার নাম “জেনানা মহল”। আমার ধারনা হল যে এই নাম নিশ্চয় প্রাচীন নয়, কিছু বছরের মধ্যে দেওয়া হয়েছে। ভারতীয়দের জন্যে জন প্রতি ১০টাকা টিকিটের মূল্য।
বিরাট জায়গা নিয়ে বাগান, মাঝ দিয়ে চওড়া লাল মোরামের রাস্তা। কিছুটা এগোতেই বাঁ দিকে উঁচু বেদি। তার ওপরে এককালে প্রাসাদ ছিল, এখন ফাঁকা। লেখা রয়েছে বোর্ডে, “Basement of Queen’s Palace।” কয়েক পা দূরে ডান দিকে ফাঁকা জায়গার ওপর “লোটাস মহল,” মনে হল এই নামও নতুন দেওয়া। অবশ্য বলা আছে এর আর এক নাম, “চিত্রাঙ্গী মহল।” আমার মনে হয় এইটিই আসল নাম। বিশেষ করে এর ভিতরে প্লাস্টারে দেব-দেবী ইত্যাদির চিত্র রিলিফে করা আছে। যাই হোক, এই মহলের নিচের দিক বিজয়নগরের গঠন শৈলী অনুযায়ী নির্মিত কিন্তু উপরের অংশ ইসলামিক শৈলীর পরিচায়ক। বলা হয় যে ঠাণ্ডা রাখার জন্য এই মহলের ওপরের দিকে জল-বাহি নলের ব্যবস্থা আছে, যদিও আমি দেখে বুঝতে পারিনি। মহলে খিলান সহ বড় বড় থাম, আর তার নিচে প্রশস্ত বারান্দা। খিলানে প্রচুর সুন্দর মটিফ, প্লাস্টারে করা। মহলের সামনে বেশ খানিকটা ঘাসে ঢাকা মাঠ। এদিক সেদিক কয়েকটা বড় ও প্রাচীন গাছ। বিশেষ করে একটা নিম গাছের মনে হল কৃষ্ণদেবরায়ের সঙ্গেও আলাপ ছিল। কেন বলছি? গাছটার ছবি দেখুন, বিশেষ করে গাছের গোড়া । (স্থানাভাবে লেখকের পাঠানো সব ছবি দেওয়া গেল না)