প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ছবিতে ভ্রমণ

অক্টোবর ৩০, ২০১৫

 

আবার মায়াবতী

শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী

প্রথম বার মায়াবতী এসেছিলাম ২০০৩ সালে। প্রায় ১২ বছর পর আবার এলাম এই অদ্বৈত আশ্রমে। ব্রিটিশ শিষ্য-যুগল সেভিয়ার দম্পতি দ্বারা স্থাপিত উত্তরাখণ্ডের চম্পাবত জেলায় স্থিত স্বামী বিবেকানন্দের মানস আশ্রম এই মায়াবতীতে, যার প্রাচীন নাম ‘মাঈ-কি-পেট’ বা মায়ের স্থান। সেবার আশ্রমে আমরা স্থান পাইনি রাত্রিবাসের। সকালে এসে বিকালে প্রায় ৯ কিমি দূরের পাহাড়ি শহর লোহাঘাট ফিরে যেতে হয়েছিল। ফেরার সময় আমি আবার কি আসতে পারবো এমন চিন্তা করে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম। এবার এখানে আসবার সময় বার বার সেই কথাই মনে আসছিল। আশ্রমের গেস্ট হাউসে দুই রাত কাটাবার অনুমতি পেয়েছি এবার আমার স্ত্রী ভারতীর রামকৃষ্ণ মিশনে শিষ্যা হবার আর কন্যা শুভ্রমালার সারদা মিশনের রশিক ভিটায় শিক্ষকতা করার সুবাদে। আমার নিজের এখানে নিবাস করার কোনও যোগ্যতা অবশ্য নেই। 

পাতাল ভুবনেশ্বর থেকে সকালে বেরিয়ে এবট মাউন্ট ও তার পর লোহাঘাট হয়ে ১লা এপ্রিল বিকালের আগেই আশ্রমে এসে গেলাম। অনুমতি পত্র দেখিয়ে নাম নথিভুক্ত করে আশ্রম থেকে বেরিয়ে কিছুটা নিচের দিকে নেমে গেস্ট হাউসে আমাদের জন্যে নির্দিষ্ট ঘরে এসে  ঢুকে পড়লাম (চিত্র-১, আশ্রমের গেস্ট হাউস, চিত্র-২, গেস্ট হাউসের একটি ঘর, চিত্র-৩, মাদারের বাংলোর স্কেচ)।


চিত্র-১, আশ্রমের গেস্ট হাউস, আলোকচিত্রি- ড. ভিনয় মিশ্র


চিত্র-২, গেস্ট হাউসের একটি ঘর, আলোকচিত্রি- ড. ভিনয় মিশ্র


চিত্র-৩, মাদারের বাংলোর স্কেচ, শিল্পী – শুভ্রমালা


চিত্র-৪ আশ্রমের আদি রূপ, ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত

কিছু পরে আবার আশ্রমে এলাম। আশ্রম স্থাপনের কালে যে বাংলো ক্যাপ্টেন সেভিয়ার কিনে ছিলেন, সেই বাংলোই এখনও ব্যবহার হচ্ছে। এত দিনে কিছু ছোট খাট কস্মেটিক টাচ দেওয়া আর প্লাস্টার করা ছাড়া গঠনের কোনও বড় ধরণের পরিবর্তন করা হয়নি (চিত্র-৪ আশ্রমের আদি রূপ, ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত, Early picture of Ashrama.jpg)। তবে এখন এর বাঁদিকে সংযোজন করা হচ্ছে। এই কারণে অনেক রাজমিস্ত্রির উপস্থিতি ও তাদের কর্মব্যস্ততা দেখা গেল। এ ছাড়া চারিদিকে পাথরকুচি, বালি ইত্যাদি জমা করে রাখা রয়েছে। অবশ্য বাংলোর সামনের সুসজ্জিত বাগান যেন আরও সুন্দর অবস্থায় ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে। আকাশ মেঘে ঢেকে থাকার জন্যে বাংলোর পিছনে আশ্রমের হাসপাতালের ওপর দিকে যে হিম শীর্ষ-শ্রেণী আগে দেখেছিলাম তার চিহ্ন মাত্র আকাশে নেই। বেশ কিছুটা সময় আমরা আশ্রমের শান্ত পরিবেশে কাটিয়ে, সান্ধ্য চা পান সেরে নিচে গেস্ট হাউসে ফিরে আসলাম। পরে আবার আশ্রমে গিয়ে রাতের আহার সারা গেল।  

সকালে নিয়ম মাফিক ব্রেকফাস্ট সেই আশ্রমের ডাইনিং হলে। আমার চলাফেরার কষ্ট, বাতের ব্যথা। আমার পক্ষে গেস্ট হাউস থেকে আশ্রমে যাতায়াত, ভাবতেই ভয় করে। তা ছাড়া চা পান আমি করি না। তাই ভাবলাম নাই বা গেলাম ব্রেকফাস্টে। অন্যান্যরা প্রায় সকলেই সময় মতো আশ্রমে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ভাই ফোন করে আমায় জানালো যে আশ্রমের প্রেসিডেন্ট মহারাজ আমার অনুপস্থিতি লক্ষ করেছেন আর ওখানে আমার উপস্থিতি আশা করছেন। বাধ্য হলাম। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে আশ্রমে উপস্থিত হলাম। আলাপ হলো বর্তমান অধ্যক্ষ অনিকেতানন্দ বা জগন্নাথ মহারাজের সঙ্গে। জানালেন যে উনি মাত্র কয়েক দিন আগেই কার্যভার গ্রহণ করেছেন। আর জানতে চাইলেন আমরা এই আশ্রম সম্পর্কে কতটা জানি। আমি এই বিষয়ে আমার জ্ঞান উদ্গীর্ণ করতে উদ্‌গ্রীব ছিলামই, সুযোগ পেয়ে অতি উৎসাহী হয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করার আগেই উনি তাঁর বক্তব্য পেশ করতে আরম্ভ করলেন আমার মুখ বন্ধ করে। যা শুনলাম, পরে মনে হলো ভালই হলো আমার পুস্তক-লব্ধ আর আগের বার এখানে আসার উপলক্ষে অর্জিত জ্ঞান পরিবেশিত না করে। কারণ উনি যা বললেন তা যদিও আমার সবই জানা কিন্তু উনি যা করলেন, অর্থাৎ আশ্রমের আশপাশ ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেওয়া, তার বেশ কিছুই আমার ঘোরা ছিল না আগের বারের অল্প সময়ের এখানে থাকার জন্যে।  আমায় যদি উনি বলতে দিতেন তাহলে বোধ হয় আমাদের দর্শন করাতে নিয়ে যেতেন না।

যাই হোক, আশ্রমের সামনে যে সুন্দর বাড়িটায় Prabuddha Bharat পত্রিকার ছাপা আর প্রকাশনার কাজ হতো, তা বললেন আর বর্তমানে সেখানে যে পাঠাগার ও পুস্তক বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে তা দেখালেন। এই বাড়িটি ডান দিকে রেখে সামনে এগিয়ে গিয়ে রাস্তা পার হয়ে ওপর দিকে আমাদের নিয়ে গেলেন। এই স্থান মায়াবতী নামে খ্যাত হবার আগে ‘মাঈ-কি-পেঠ’ নামে পরিচিত ছিল তা প্রথমেই উল্লেখ করেছি, মহারাজ সেই বিশেষ ‘পেঠ’ আমাদের দেখালেন (চিত্র-৫, মাঈ-কি-পেঠ, চিত্র-৬, মাঈ-কি-পেঠের অবস্থান)। স্থানীয় প্রাচীন অধিবাসীরা এখনও বিশেষ বিশেষ দিনে পূজার উদ্দেশ্যে এখানে এসে থাকেন বলে মহারাজ জানালেন।


চিত্র-৫, মাঈ-কি-পেঠ


চিত্র-৬, মাঈ-কি-পেঠের অবস্থান

চিত্র-৬-এর মধ্যে লক্ষ করলে আশ্রমের বাড়ি দেখতে পাবেন যা আপনাকে এই পেঠের অবস্থিতি বোঝাতে সাহায্য করবে। এখান থেকে আমাদের নিয়ে গেলেন আশ্রমের চাষের জমি দেখাতে। প্রথমেই সবুজের মাঝে একটা সুন্দর সরোবর দেখালেন।


চিত্র-৭, পলিথিনের ওপর সরোবর

আপনি মনে করতেই পারেন যে সরোবরের আবার দেখবার কি থাকতে পারে। আসলে সম্পূর্ণ সরোবরটি কালো রঙের পলিথিন শিটের ওপর রয়েছে (চিত্র-৭, পলিথিনের ওপর সরোবর)। এর কারণ যেহেতু এই জায়গাটা একটু উঁচুতে অবস্থিত, সরোবরের জল পাশের নিচের মাটি শুষে নিয়ে নরম করে ধসিয়ে দেওয়ার সম্ভাবনা হতে পারে তাই সেই ধস থেকে পাশের জমি বাঁচাবার জন্যে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই সরোবরটির ইতিহাস বেশ চিত্তাকর্ষক। এই সরোবর যা এখানে লেক নামেই পরিচিত ছিল, আশ্রম স্থাপনার আগে থেকেই ছিল। স্বামীজী এই লেকের ধারে বেড়াতে ভালবাসতেন। মাদাম সেভিয়ারের সঙ্গে এরই পারে বেড়ানর সময় একদিন বলেন, “জীবনের শেষ ভাগে আমি সমস্ত প্রকারের জনহিতকর কাজকর্ম থেকে বিরত হয়ে এই লেকের পাড়ে সময় কাটাবো পুস্তক রচনা করে আর শিস দিয়ে আনন্দময় সঙ্গীত গেয়ে”। বর্ষায় বেশ কয়েক বারই লেকের জল উপচে গিয়ে পাড়ের বড় বড় গাছ সহ ধস নেমে জায়গার ক্ষতি সাধন হয়েছে। তাই আগে থেকেই প্রায়ই লেকের জল বার করে দিয়ে সেখানে গমের চাষ করা হয়েছে। শেষে এখন আবার বৃষ্টির জল ধরে রেখে লেকের নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে বিশেষ উপায়ে যা আগেই বলা হয়েছে। আমরা এর পারেই পাশাপাশি গম ও ধানের চাষ দেখলাম, যা সাধারণত পশ্চিম বঙ্গে এক সঙ্গে দেখা যায় না (চিত্র-৮, পাশাপাশি গম ও ধানের চাষ)। চিত্র-৮-এর মধ্যে সাদা ছোট ছোট ফুল ফোটা দুটো গাছ দেখা যাচ্ছে, যেগুলো আপেলের। পরেই রয়েছে স্ট্রবেরির চাষ, স্ট্রবেরি ফলে আছে ছোট ছোট গাছে বেশ কিছু যার মধ্যে চোখে পড়লো কেবল মাত্র একটিই পাকা (চিত্র-৯, গাছে পাকা স্ট্রবেরি)। পাশাপাশি দুটি ঘর, পলিথিনের, নার্সারি বা বীজতলা পাশেই রয়েছে (চিত্র-১০, নার্সারি, আলোকচিত্রি- ড. ভিনয় মিশ্র)।


চিত্র-৮, পাশাপাশি গম ও ধানের চাষ


চিত্র-৯, গাছে পাকা স্ট্রবেরি


চিত্র-১০, নার্সারি, আলোকচিত্রি- ড. ভিনয় মিশ্র

এখান থেকে কিছুটা এগিয়েই আশ্রমের ‘গোশালা।’ হৃষ্ট-পুষ্ট গরুর দল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেকটা জায়গা জুড়ে এবং বিভিন্ন তলে। স্বাভাবিক, জায়গা তো পাহাড়ি। এরই মাঝে গোয়াল ঘর, পাকা ঝক্‌ঝকে বাড়ি (চিত্র-১১, গোশালা ও চিত্র-১২, গোয়াল ঘর, আলোকচিত্রি- ড. ভিনয় মিশ্র)।


চিত্র-১১, গোশালা


চিত্র-১২, গোয়াল ঘর, আলোকচিত্রি- ড. ভিনয় মিশ্র

শুনেছিলাম যে এই অঞ্চলে নেকড়ে বাঘ নাকি অনেক সময়ই এদিক সেদিক ঘোরে। গরু গুলো কাঁটা তার দিয়ে বেশ নিচু বেড়ায় ঘেরা জায়গায় চরে বেড়াচ্ছে, নেকড়েরা কি গো মাংস মুখে দেয় না? এখানে আসার পথে আর এখান হয়ে যাবার সময়ে তোলা চলচ্চিত্র আশা করি ভালই লাগবে আপনাদের

এখান থেকেই এলাম সেই বিখ্যাত ধ্যানের স্থানে, আশ্রমের প্রথম অধ্যক্ষ, স্বামী স্বরূপানন্দের। স্বামীজী এখানে এসে ধ্যানে বসতেন প্রায়ই। এক দিন ধ্যানরত অবস্থায় চোখ খোলেন, দেখেন এক বাঘ সামনে বসে তাঁকে নিরীক্ষণ করছে। উনি আবার চোখ বন্ধ করে বসে থাকেন। কিছু পরে চোখ মেলে বাঘের আর দেখা পান না। নিচে নেমে এসে মাদার (সেভিয়ার)-কে অভিজ্ঞতার কথা বলেন। ফলে মাদারের আদেশে ওই স্থানে তাঁর ধ্যান করা বন্ধ হয়ে যায়। এখন সেই স্থানটি উঁচু বেদি করে লোহার জাল দিয়ে ঘিরে দিয়ে আশপাশে বেশ কিছুটা অঞ্চল জঙ্গল মুক্ত করা হয়েছে (চিত্র-১৩, স্বামী স্বরূপানন্দের ধ্যান কক্ষ)।


চিত্র-১৩, স্বামী স্বরূপানন্দের ধ্যান কক্ষ

ইতিমধ্যে জগন্নাথ মহারাজ আমাদের নিচের, অর্থাৎ আশ্রমের রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে গেছেন। আমরাও স্বরূপানন্দের ধ্যানের স্থান দেখে আশ্রমে চলে আসলাম। আশ্রমের সামনের বাগানে অজস্র মরশুমি ফুল ফুটে আছে। শুনলাম এখন জাপানি মহারাজের তত্ত্বাবধানে এই বাগান তার এই সুন্দর রূপ ধারণ করেছে। জাপানি মহারাজের আশ্রম দত্ত নাম আছে, কিন্তু সেই নাম জানা হয়নি। তাঁর শরীর জাপানি তাই সকলের কাছে জাপানি মহারাজ বলেই পরিচিত। আমরা ওনার কাছ থেকে গাছের চারা কিনলাম, ক্যাকটাসের এক বিশেষ ভ্যারাইটি। অনেক রকমের লিলি ফুল ফুটে রয়েছে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটা আমার কাছে অচেনা লাগলো। মহারাজের কাছে রাইজোম চাইলাম। উনি দিতে রাজি হলেন না, বললেন আমাদের এখানে নাকি ওগুলো বাঁচবে না (চিত্র-১৪, লিলি)। প্যান্সি (Pansy) এমনিতেই অত্যন্ত সুন্দর দেখতে হয়, স্বাভাবিক এখানেও সুন্দর ফুটেছে (চিত্র-১৫, প্যান্সি ১ ও চিত্র-১৬, প্যান্সি ২)। পিটুনিয়া গুলোই বা কম কিসে। গাছ গুলো যেন একটু বড় হয়ে গেছে, বোধ হয় জল হাওয়ার গুণে (চিত্র-১৭, পিটুনিয়া)।


চিত্র-১৪, লিলি


চিত্র-১৫, প্যান্সি ১


চিত্র-১৬, প্যান্সি ২


চিত্র-১৭, পিটুনিয়া

মাঈ-কি-পেঠ, গোশালা ইত্যাদি দেখতে যাবার সময়, পাঠাগার খোলা ছিল না, এখন খোলা রয়েছে দেখে ঢুকলাম। রামকৃষ্ণ সম্পর্কীয় কত যে সাময়িকী প্রকাশিত হয় আমার জানা ছিল না। একসঙ্গে সেগুলো দেখে খুব আনন্দ হলো, আনন্দ শত গুণ বেড়ে গেল যখন দেখলাম আমার মহাবিদ্যালয়ের গ্রাম থেকে যে সাময়িকী, ‘বিবেক ভারতী’ প্রকাশিত হয় তাও এখানে রয়েছে (চিত্র-১৮, সাময়িকীর সংগ্রহ)।       


(চিত্র-১৮, সাময়িকীর সংগ্রহ)
 

ইউটিউবের এই ভিডিও ক্লিপে স্বরূপানন্দের ধ্যানের স্থান ও তার সঙ্গে আশ্রমের বাগানে আমাদের সঞ্চরণের সময়ের দৃশ্য দেখতে পাবেন। ক্লিপের শেষের দিকে পরের দিন সকালে আশ্রমের গেস্ট হাউসের সামনে দেওদারের জঙ্গল আর সেখান থেকে আশ্রমের দিকে আসার পথের ধারের নৈসর্গিক শোভা আশা করি উপভোগ করতে পারবেন।

আশ্রম স্থাপনের কিছু পর থেকেই আশ্রমবাসীরা আশপাশের মানুষের সেবা করার জন্যে এগিয়ে আসেন। এর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা হলো স্থানীয় রোগীদের আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ১৯০৩ সালের নভেম্বর মাসে যে মায়াবতী দাতব্য চিকিৎসালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল তা এখন পাহাড়ের ওপরে এমন জায়গায় এক আধুনিক ব্যবস্থাপনা সহ আশ্রম সংলগ্ন হাসপাতালে পরিণত হয়েছে, তার যে কোনও প্রশংসা অসম্পূর্ণ হবে (চিত্র-১৯, আশ্রমের দিক থেকে হাসপাতাল, ঘর, আলোকচিত্রি- ড. ভিনয় মিশ্র)।


চিত্র-১৯, আশ্রমের দিক থেকে হাসপাতাল, ঘর, আলোকচিত্রি- ড. ভিনয় মিশ্র

উল্লেখ করার অপেক্ষা রাখে না, যে এখানে চিকিৎসা সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে হয়ে থাকে। আশ্রমে আমাদের অবস্থানকালে সপ্তাহকাল ব্যাপী দাঁতের চিকিৎসার শিবির চলছিল। আমার এক সহকর্মী, যে নিজে একজন হোমিওপ্যাথ, অত্যন্ত উৎসাহ সহকারে হাসপাতাল দেখতে গিয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে কয়েকজন রোগীর চিকিৎসাও করে এলেন। ফিরে এসে হাসপাতালের অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও ব্যবস্থাপনার প্রভূত প্রশংসা করলেন। 

ক্যাপ্টেন সেভিয়ারের মর দেহ, তাঁরই ইচ্ছায় হিন্দু মতে দাহ করা হয় আশ্রমের অনেক নিচে সারদা নদীর তীরে। সেখানে যাতায়াত বেশ কষ্টকর, আমার মতো মানুষের। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কয়েকজন ছিলেন যাঁদের পক্ষে সেটা কোনও ব্যাপার নয়। সেখানে যাবার জন্যে মহারাজের কাছে নির্দেশ চাইলেন তাঁরা। মহারাজ বললেন যে তিনি সেখানে যেতে দিতে রাজি নন, কেন না রোজই বৃষ্টি পড়ছে (আমাদের ঘোরার সময়েও বৃষ্টি পড়েছিল) এবং বৃষ্টিতে সেই পাহাড়ি পথ খুবই বিপজ্জনক হয়ে আছে। ঠিক তেমনি ‘ধরমগড়’, যা আশ্রমের বেশ কিছুটা ওপরে, আসলে ওখানকার সর্বোচ্চ স্থান, সেখানকার রাস্তাও এখন অগম্য। এটিও স্বামীজী মায়াবতীতে অবস্থানকালে খুবই পছন্দ করতেন এবং কয়েকবারই ধ্যান করার জন্যে বেছে নিয়েছিলেন। 
মায়াবতীর আশ্রম সম্পর্কে  অদ্বৈত আশ্রম একটি ভিডিও ইউটিউবে ভাসিয়েছেন, যে হেতু এটি Public domain-এ তাই এটি আপনাদের দেখতে অনুরোধ করছি ।     

এ পর্যন্ত আমার এই বর্ণনায় আশ্রম ও আশপাশের প্রাকৃতিক সম্পদের বিষয়ই রয়েছে। আশ্রমে আসা ভক্তদের মানসিক বা চারিত্রিক সম্পদের উন্নতির জন্যে এখানকার মহারাজেরা অহরহ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভক্তরা বা সাময়িক অধিবাসীরা কতটা গ্রহণ করছেন বা চেষ্টা করছেন আমার এই সীমিত ধীশক্তিতে বলা বেশ কঠিন। প্রথমেই মনে করে নেওয়া ভাল যে এই আশ্রমে কেমন মানুষেরা এসে থাকেন। এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দিলে ঠিক হবে না। আশ্রম যদিও প্রাইভেট প্রপার্টি, যে কেউ ইচ্ছে করলে আশ্রম দেখতে চলে আসতেই পারেন। তবে এখানকার গেস্ট হাউসে, গেস্ট ছাড়া কেউ থাকতে পারবেন না। গেস্ট হবার জন্যে আপনি কিন্তু অনুরোধ জানাতেই পারেন। আপনার হয় রামকৃষ্ণ মিশন বা সমগোত্রীয় কোনও সংস্থার সুপারিশ থাকতে হবে আর নয়ত আপনার নিজের সেই প্রকার সংগঠনের সদস্য হতে হবে, যা আপনার রামকৃষ্ণ-সারদামা-বিবেকানন্দের ভাবধারার সঙ্গে একাত্মতা প্রমাণ করবে। পাঠকের নিশ্চয় মনে পড়বে যে আমার প্রথম বার এই আশ্রমের গেস্ট হাউসে থাকার অধিকার ছিল না, কেন না আমি আমার রামকৃষ্ণ-সারদামা-বিবেকানন্দের ভাবধারার সঙ্গে একাত্মতার কোনও প্রমাণ দিতে পারিনি, তা সত্ত্বেও এবারে কেন এখানে রাত্রিবাসের আনুমটি পেয়েছি তা তো আগেই জানিয়েছি। আসল কথা এখানে যাঁরা এসে গেস্ট হাউসে থাকবেন তাঁরা সকলেই এক বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত হতে হবে।

তাই স্বাভাবিক ভাবেই সেই ভক্তরা এই মতবাদে অভিষিক্ত হয়ে থাকবেন এটাই কাম্য। তবে পূজাদি করা এখানে কিন্তু চলে না। স্বামী গম্ভীরানন্দ “যুগনায়ক বিবেকানন্দ,” তৃতীয় খণ্ডে (উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, নভেম্বর ১৯৬৬, পৃ.১৫৯) ‘আদর্শের বাস্তব রূপ’ পর্বে মায়াবতীতে অদ্বৈত আশ্রম স্থাপনের সম্পর্কে  লিখেছেন, “স্বামীজীর ইচ্ছা ছিল, হিমালয়ের কোন নিভৃত স্থানে এমন একটি অদ্বৈতভাবমূলক আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হইবে যেখানে অনুষ্ঠান ও ক্রিয়াকলাপাদি-বিরহিত শুদ্ধ অদ্বৈতসাধনা চলিতে থাকিবে....।” এই খণ্ডেরই ‘হিমালয়ে শেষবার’ পর্বে স্বামীজীর মায়াবতীতে অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখেছেন (পৃ. ৩০৩),  “মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম অদ্বৈতসাধনার কেন্দ্ররূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল এবং সেখানে দ্বৈতভাবে পূজানুষ্ঠানাদি অবাঞ্ছিত ছিল। ইহা জানিয়া-শুনিয়াও আশ্রমবাসী কেহ কেহ একখানি ঘরে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতিকৃতি স্থাপনপূর্বক পুষ্প, ধোপ, দীপ প্রভৃতি উপচারে সাদাসিদাভাবে পূজা শুরু করিয়া দিয়াছিলেন।” স্বামীজী কোনও ব্যক্তি বিশেষকে কিছু না বলে যথার্থ প্রধানের মতই আশ্রম পরিচালক, মাদার সেভিয়ার ও স্বামী স্বরূপানন্দকে তিরস্কার করেন। যদিও আমি আমার আগের বারের রচনায় এই বিষয়ে লিখেছি সেই সময়ের আশ্রম অধ্যক্ষের বয়ান, তা হলেও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে ইচ্ছে করছে, স্বামীজী বেলুড় মঠে ফিরে এসে “ঐ ঘটনা স্মরণপূর্বক সখেদে বলিয়াছিলেন, “আমি ভেবেছিলুম অন্তত: একটি কেন্দ্রেও তাঁর (শ্রীরামকৃষ্ণের) বাহ্যপূজাদি বন্ধ থাকবে। কিন্তু হায়, হায় গিয়ে দেখি বুড়ো সেখানেও জেঁকে বসে আছেন।”   

তা হলে সাময়িক আশ্রমবাসীরা অর্থাৎ ভক্তরা কি করবেন? সেই জন্যে বিশেষ করে রাতে আহারের পরে কিছুক্ষণ আশ্রমের কোনও একজন মহারাজ রামকৃষ্ণ-সারদামা-বিবেকানন্দের সম্পর্কিত লেখার কিছুটা অংশ পাঠ করবেন যা ভক্তরা শুনবেন। অবাঙালি অনেক ভক্তই উপস্থিত থাকেন, তাই সব সময়ই পাঠ হয় ইংরাজিতে। এই পাঠ হয় একটি বিশেষ ঘরে যেখানে স্বামীজী মায়াবতীতে নিবাসকালে প্রথম কয়েকদিন ছাড়া বাকি দিনগুলো অতিবাহিত করেছিলেন (চিত্র-২০, মায়াবতী নিবাস কালে স্বামীজীর থাকার ঘরের ফলক)। এটি এখন একটি পুস্তকাগার হিসাবে ব্যবহার হয়। বিভিন্ন বিষয়ে হাজার তিরিশের কাছাকাছি বই আছে। আগেরবার দেখেছিলাম ভক্তরা সেই বই এখানে বসে পাঠ করতে পারতেন, কিন্তু এ বারে দেখলাম কোনও কারণে এই পাঠের সময় ছাড়া পুস্তকাগার তালা বন্ধ থাকছে। 


চিত্র-২০, মায়াবতী নিবাস কালে স্বামীজীর থাকার ঘরের ফলক

এই পাঠের কিছু বিষয় নিয়ে আমার মনে এক প্রশ্নের উদয় হয়েছে। আসলে আমাকে আমার কন্যা বিষয়টি নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করে যার সদুত্তর আমি দিতে পারিনি। কন্যার প্রশ্ন আপনাদের জানাবার আগে কিছুটা উপক্রমণিকার প্রয়োজন আছে। আমরা শ্রীরামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দের মহিলা সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা, বক্তব্য ও তাঁদের

মহিলাদের সঙ্গে ব্যবহারের কথা জেনে এসেছি। কোন সময়ই এমন পড়িনি যে তাঁদের মহিলাদের সম্পর্কে দুর্বলতা ছিল বা তাঁরা মহিলাদের থেকে অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয় ভাবে দূরে থাকবার চেষ্টা করতেন। এই বিষয়ে সারদামার বক্তব্য আমার মনে হয় স্বাভাবিক ভাবে অপ্রয়োজনীয়। আমরা জানি শ্রীরামকৃষ্ণ মহিলাদের এমনকি তথাকথিত নষ্ট মহিলাদেরও মাতা রূপে দেখতেন এবং স্বামীজী পুরুষ ও মহিলাদের পাখির দুটি পাখনা রূপে ভাবতেন অর্থাৎ যে কোনও একের অভাবে পাখি উড়তে পারবে না। তাই কেউ যদি মনে করেন মহিলার উপস্থিতি জীবনের পথে বাধা স্বরূপ তা হলে সেই পুরুষের নিশ্চয় মানসিক রোগ, বা মানসিক ক্রুটি আছে। সেই পুরুষ নিশ্চয় আদর্শ হতে পারেন না, বিশেষ করে তাঁর জীবনী বা কার্যপ্রণালী মহিলাদের জন্যে অনুকরণীয় তো কখনই নয়। অবশ্য যদি সেই মহিলা চিকিৎসক, বিশেষ করে মানসিক চিকিৎসক হন সে ক্ষেত্রে অন্য কথা। পুরুষ যদি মনে করেন যে নারী সাধন মার্গে বাধা সৃষ্টিকারী তা হলে নিশ্চয় বলা যায় যে তার কারণ পুরুষের নিজের মধ্যেই নিহিত, তাদের মানসিক ক্রটি, তাতে নারীর কী দোষ? নারীও কি বলতে পারে না যে তাদের সাধন মার্গে পুরুষের উপস্থিতি বাধা স্বরূপ? আমার মনে হয় পুরুষের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে সাধন মার্গের সিঁড়ি কেবল মাত্র তাদের জন্যই।

আশ্রমের কোনও এক মহারাজ প্রথম রাতে ভোজনের পরে নিয়মমাফিক পাঠ করছিলেন (কে পাঠ করছেন তা বলা হয় না, আর আমার প্রত্যেকের সঙ্গে পরিচিতিও নেই)। কোথা থেকে পাঠ করছিলেন, সম্ভবত তা বলেননি, বা বলে থাকলেও আমার মনে নেই। সেই পাঠে ছিল সাধন মার্গে নারীর বাধা এবং নারীদের উপস্থিতি, লক্ষ করবেন কেবল মাত্র উপস্থিতিই কেমন ভাবে লেখকের মনে ব্যাঘাত ঘটাতো তার বর্ণনা। আমার ভাল লাগছিল না, কেন না মনে হচ্ছিল উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীর বৌদ্ধিক স্তরের নিরিখে বিষয়টির নিম্নমান। তবে কোনও শ্রোতা কিছুমাত্র বিরক্তি প্রকাশ করেননি, যা আমার শ্রোতৃমণ্ডলীর বৌদ্ধিক স্তর সম্পর্কে ধারণা দৃঢ় করে। কন্যার প্রশ্নর পর আমার মনে হয় সত্যই, শ্রোতার মধ্যে অন্তত ৪০% মহিলা ছিলেন, তাঁদের এই পাঠ শুনে কী মনে হচ্ছিল? কন্যার প্রশ্ন আমি তার জবানীতেই বলি,
“আচ্ছা বাবা, মহারাজ যে বিষয়ে পাঠ করলেন, আমরা এত জন মহিলার উপস্থিতিতে, এটা কী তাঁদের কাছে অপমানজনক নয়? নারীর কী পুরুষদের সাধন পথ থেকে সরিয়ে আনাই একমাত্র কাজ?” 
আমি কোনও উত্তর দিতে পারলাম না, আমতা আমতা করা ছাড়া। ভোজনের পর, গেস্ট হাউসে ফেরার পথে ভেবে একটা উত্তর ঠিক করলাম কন্যাকে বলার জন্যে, যা আসলে উত্তর নয়, একটা স্বীকারোক্তি, বা confession। আমি বললাম,
“জান কি মা, আসলে এই সব মানুষ যতই উচ্চ মার্গে উঠুক না কেন, অন্তরের অন্তঃস্থলে পুরুষের প্রাধান্যের ভাব লুকিয়ে আছে। আর তাদের নিজের মনের ওপর কোনও কর্তৃত্ব নেই, একটু ঠোকা খেলেই সমস্ত কিছু গুঁড়িয়ে যাবে এই ভয়। সেই ভয় থেকেই এই সব বক্তব্য বেরিয়ে আসে।”
“না, না বাবা, আমি ওই লেখার বিষয় বস্তুর কথা বলছি না, আমি বলছি এই লেখা থেকে পাঠ করা, যেখানে এত জন মহিলা, এবং সম্ভবত প্রায় সকলেই সমাজের উচ্চ স্তরের, তাঁদের সামনে এই পাঠ কী যুক্তিযুক্ত? তাঁদের হেয় করা নয়? তাঁদের কাছে এটা অপমানকর নয়? বিশেষ করে মহারাজেরা শ্রীরামকৃষ্ণ-সারদামা-বিবেকানন্দের আদর্শে উদ্বুদ্ধ, অন্তত এই কথা বলে থাকেন?”

আমি নতুন করে কিছু বলার কথা খুঁজে পেলাম না। বলতে গেলে পূর্বের কথারই পুনরাবৃত্তি করতে হয়। এই প্রসঙ্গের এখানেই ইতি করলাম। কোনও পাঠক যদি এর উপযুক্ত উত্তর উপস্থিত করতে পারেন, তার অপেক্ষায় রইলাম। অনেক কাল আগে থেকেই রামকৃষ্ণ-সারদামা-বিবেকানন্দের আদর্শ সম্পর্কিত লেখা আমরা পড়ে আসছি। মানুষে মানুষে কেমন ব্যবহার হবে সে বিষয়েও এই আদর্শ অনেক জায়গাতেই দিক্‌নির্দেশ করেছে। তা হলেও এই বিষয়ে একেবারে নতুন এক লেখার উল্লেখ করছি। যদিও যে ঘটনার কথা এতে আছে তা ১০০ বছরেরও আগে ঘটিত হয়েছিল। “উদ্বোধন”, আষাঢ় ১৪২২, ষষ্ঠ সংখ্যায় “কথাপ্রসঙ্গে” লেখক (পৃ. ৩৮৭র দ্বিতীয় কলমে) লিখছেন,
“শ্রীরামকৃষ্ণ একত্বকে অনুভব করিয়াছিলেন বলিয়া তিনি অন্যের বেদনা নিজের বলিয়া বোধ করিয়া ক্রন্দন করিয়াছিলেন এবং তাঁহার পিঠে বেদনার চিহ্ন ফুটিয়া উঠিয়াছিল।”
লেখকের এই ব্যাখ্যার পটভূমি না জানলে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বোধগম্য হবে না। তাই এই উদ্ধৃতির কিছু আগের অংশের উল্লেখ করি। ওই পৃষ্ঠারই আগের কলমে লিখছেন,
“একদিন দক্ষিণেশ্বরে কালীবাড়ির চাঁদনিযুক্ত গঙ্গার ঘাটে দাঁড়াইয়া শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট অবস্থায় গঙ্গার দিকে তাকাইয়াছিলেন। ঘাটে তখন দুইটি নৌকোর মাঝিরা কি লইয়া যেন নিজের মধ্যে ঝগড়া করিতেছিল। সহসা অপেক্ষাকৃত সবল মাঝিটি দুর্বল মাঝির পিঠে সজোরে চপেটাঘাত করিল। শ্রীরামকৃষ্ণ হঠাৎ যন্ত্রণায় কাতর হইয়া কাঁদিয়া উঠিলেন। তাঁহার ঐ কাতর ক্রন্দন শুনিয়া কালীমন্দির হইতে ভাগিনেয় হৃদয় ছুটিয়া আসিয়া দেখিলেন, তাঁহার পিঠ আরক্ত হইয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে।”
এই প্রকার অভিজাগতিক এমপ্যাথি আমরা কারও মধ্যে আশা করতেই পারি না, কিন্তু পরের দুঃখে বা কষ্টে অন্তত একটু সহানুভূতি প্রকাশ করে তার যথাসাধ্য কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা নিশ্চয় আমরা আশা করব মানুষের কাছে। আর তিনি যদি শ্রীরামকৃষ্ণ-সারদামা-বিবেকানন্দের আদর্শে উদ্‌বুদ্ধ হয়ে থাকেন, তা হলে তো কথাই নেই।
কেন এই প্রসঙ্গের উত্থাপন করলাম? আশ্রমে রাত কাটানোর জন্যে আমরা যে কজনের জন্যে অনুরোধ করেছিলাম, তার মধ্যে মোট ৮ জনের অনুমতি পাইনি। কাজেই তাঁরা নিচে লোহাঘাটে ছিলেন আর দ্বিতীয় দিন সকালে আশ্রম দর্শন করতে এলেন। ওঁরা যখন এলেন, আমাদের তার আগেই গোশালা, স্বামী স্বরূপানন্দের ধ্যানের স্থান ইত্যাদি দেখে ফিরে আসা হয়ে গেছে। অনিকেতানন্দজী তাঁদের সেখানে যাবার পথ দেখিয়ে দিয়ে বলে দিলেন যে পথ বেশ পিছল, যেন সাবধানে হাঁটেন। ওঁদের মধ্যে কয়েকজন ভয়ে ওই পথ মাড়ালেন না, বাকিরা এগিয়ে গেলেন। আমরা আশ্রমেই সময় কাটাতে লাগলাম। প্রায় আধ ঘণ্টা পরে একটা ফোন এলো। দেখলাম যে যাঁরা গোশালা ইত্যাদি দেখতে গিয়েছিলেন তাঁদের একজনের। কথা বলতেই তিনি উত্তেজিত ভাবে বললেন যে তাঁর স্ত্রী রাস্তায় পড়ে গেছেন এবং সম্ভবত পা ভেঙ্গে গেছে। আমাদের মধ্যে কয়েকজন তাড়াতাড়ি  ওইদিকে ছুটে গেলেন। আমার নিজেরই পায়ের অবস্থা ভাল নয় কাজেই আমি না গিয়ে দেখলাম কাছাকাছি অনিকেতানন্দজী একজনের সঙ্গে কথা বলছেন, তাঁর কাছে গিয়ে দুর্ঘটনার কথা বললাম। শুনেই তাঁর যে প্রতিক্রিয়া হল তা দেখে ও শুনে আমি দুর্ঘটনার কথা শুনে যত না বিচলিত হয়েছিলাম তার থেকেও বেশি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কোনও প্রতিযোগিতায় জয়লাভ করলে বা কোনও আনন্দ সংবাদ পেলে সাধারণ মানুষ যেমন উল্লাস বা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে তেমনই উচ্ছলতা দেখিয়ে বলতে লাগলেন, “কীইইই, আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম নায়ায়ায়া।” 
উনি স্বাভাবিক হলে আমি জানতে চাইলাম যে নিচে নিয়ে আসবার জন্যে কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে বা আশ্রমের হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার সুযোগ হবে কি না।
উনি আঁতকে উঠে বললেন, “না, না, এক্ষুনি নিচে (অর্থাৎ লোহাঘাটে) নিয়ে চলে যান।”

আমি চিন্তিত মনে আশ্রমের প্রবেশ পথের পাশে গাড়ি রাখার জায়গায় চলে এলাম। এখান থেকেই ওপর দিকে বেশ কয়েকজন চলে গেছেন আর অন্যান্যরা অপেক্ষা করছেন। লোহাঘাট থেকে ওনাদের নিয়ে আসা ও আমাদের গাড়ির চালক দুজনেও ওপরে উঠে গেছে। আমার ডাক্তার সহকর্মীও ওপরে গেছেন, কিছুক্ষণ পরে ফোন করে জানালেন যে গোড়ালির ওপর দিকে সম্ভবত ভেঙ্গেছে, ওনাকে নিয়ে নিচে নামছেন। অনেকটা সময় পরে নিচে পৌঁছে গাড়িতে শোয়ানো হলো। ওপরেই ওনার ভাঙ্গা পা আমার কন্যার ওড়না দিয়ে বেঁধে দিয়েছিলেন উনি। উনিই ছুটে গিয়ে অনিকেতানন্দজীর কাছে হাসপাতাল থেকে একটা ক্রেপ ব্যান্ডেজ পাওয়া যাবে কি না জিজ্ঞাসা করলেন। পূর্বের মতই আঁতকে উঠে তিনি বললেন,
“না, না, ক্রেপ ব্যান্ডেজ আছে কি না জানি না, আর এখন তো হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি নিচে নিয়ে চলে যান।”

এই হলো শ্রীরামকৃষ্ণ-সারদামা-বিবেকানন্দের আদর্শে উদ্‌বুদ্ধ, সেবা পরায়ণ সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর এক রোগীর প্রতি ব্যবহার।
যাই হোক, আমরা ভ্রমণে বেরোলে কিছু সাধারণ চিকিৎসার সরঞ্জাম সঙ্গে রেখে থাকি, তাই গেস্ট হাউসে আমাদের কাছে ক্রেপ ব্যান্ডেজ ছিল, ওড়না খুলে নিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে রোগীকে নিয়ে আমার ডাক্তার সহকর্মী সহ কয়েকজন লোহাঘাটে নেমে গেলেন। 
সুন্দর একটি তীর্থ-ভ্রমণের মধ্যে এই অসুন্দর অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে আমার ভাল লাগলো না, কিন্তু মনে হলো এটা জানানো উচিত। এখানে ইতি করতে পারলেই ভাল হতো, কিন্তু ওই রাতেই আরও একটি ঘটনা আমাদের খুবই নাড়া দিল। সেই ঋণাত্মক মন আলোড়নকারী ঘটনার বর্ণনার আগে, এর বিপরীত আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক ঘটনার বর্ণনা করলে জীবনের অভিজ্ঞতার সঠিক মূল্যায়ন হবে।     

আমরা ২১ জন মিলে গুজরাটের ধোলাভিরা থেকে বিকেল প্রায় ২:৩০ মিনিটে দ্বারকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম ২০১১ সালে ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে। জানতাম যে সেই দিনেই দ্বারকা পৌঁছানো যাবে না তবে পথে সুবিধা মতো হোটেল পাব না ভাবতে পারিনি। প্রায় রাত এগারোটা বেজে গেল, কিরীটভাই, আমাদের গাড়ির চালক রাজ্য সড়ক ২২ এ ট্যাঙ্কারার (Tankara) মোড় থেকে অল্প এগিয়েই ডানদিকে এক পাঁচিল ঘেরা জায়গায় খোলা গেট দেখে সেখানে গাড়ি ঢুকিয়ে দাঁড় করালো। দেখলাম এ হলো “প্রভুচরণ আশ্রম।”  কিরীটভাই বলল এখানে আশা করি রাত কাটানো যাবে। এই বলে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে দারোয়ানের সঙ্গে কিছু কথা বলে গাড়িতে উঠে আরও কিছুটা ভিতরে নিয়ে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাকে নিয়ে একটা ঘরে গেল। সেখানে এক মধ্য বয়স্ক গুজরাটি মহিলা আমাদের সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করে বললেন যে, “স্বামীজী এখন নেই, আপনাদের একটা হল ঘর খুলে দিতে পারি আর কিছু কম্বল ইত্যাদি রয়েছে তাতেই আপনারা চালিয়ে নিতে পারেন কি না দেখুন”। মানে, চালিয়ে নিতে পারব কি না? পারতেই হবে। আমার আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো অবস্থা হলো। যাই হোক, হলে শতরঞ্চি ও কম্বল বিছিয়ে শুয়ে বসে পড়লাম। সেই ভদ্রমহিলা এসে আমাদের ভোজনের ব্যবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করে জানলেন যে সঙ্গের মুড়ি চিড়ে দিয়ে আমরা তা সারবো। সে কি হয় বলে জানালেন যে তিনি ভাত আর আলু-জিরা করে দিচ্ছেন। সঙ্গের মহিলারা আলু-জিরার বদলে আলুভাতের কথা বলে সাহায্যের জন্যে এগোতে চাইলেন। ভদ্রমহিলা তাও কি হয় বলে এনাদের নিবৃত্ত করে রান্নাঘরে চলে গেলেন। যথা সময়ে অসীম তৃপ্তি সহ ঘি দিয়ে গরম আলুভাতে ভাত খেয়ে কম্বলের ওপর কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভোর বেলা প্রাতঃকৃত্য সারতে না সারতেই চা এসে গেল আর আশ্রম-অধ্যক্ষ স্বামীজী (ইতি মধ্যে উনি আশ্রমে ফিরে এসেছেন) এসে আমার সঙ্গে দেখা করে ধন্যবাদ জানালেন গত রাতে ওনার আশ্রমে আতিথ্য গ্রহণ করার জন্যে। আমাকে অনেক চেষ্টা করে সুযোগ খুঁজে বলতে হল যে ধন্যবাদ তাঁদেরই প্রাপ্য যে ওনারা আশ্রমে আমাদের অত রাত্রে কষ্ট করে শুধু স্থানই দেননি, খাদ্যও দিয়েছেন। এর পর স্বামীজী যা করলেন সে কথা জানানোর জন্যেই এত কথা। উনি কিরীটভাইকে ডেকে তার গলায় উত্তরীয় পরিয়ে দিয়ে বললেন,
“তুমি সারথি, এনাদের এখানে নিয়ে এসে কৃষ্ণ-সম কাজ করেছ, তাই তোমাকে আমি সম্মান জানাচ্ছি, আর প্রার্থনা করি তুমি যেন এমনই ভাল কাজ করে যাও”।
এত বড় সম্মানের অধিকারী হয়ে কিরীটভাইয়ের অশ্রু বাঁধ মানল না। আমাদেরও এই অভূতপূর্ব ও অপার্থিব দৃশ্য দেখে একই অবস্থা হলো। আমরা সকলেই ভাবলাম মানুষ কতটা উচ্চস্তরের হলে এই ধরণের মনের অধিকারী হতে পারে। পরবর্তী সময়ে এই আশ্রম সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য পাইনি, কেবল ঠিকানা, Prabhucharan Ashram, Tankara, Gujarat, Pin: 363650 ও Cell phone: 09925984801 ছাড়া।  আর হ্যাঁ, ট্যাঙ্কারা, ধোলাভিরা থেকে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে প্রায় ২৩০কিমি. আর দ্বারকা থেকে এই আশ্রমের অবস্থান উত্তর দিকে প্রায় ২২০কিমি. দূরে।

এই বার ফিরে আসি মায়াবতীতে। আশ্রমে পৌঁছবার আগেই আমি ফোনে জানিয়েছিলাম যে আমাদের সঙ্গে গাড়ি ও গাড়ির চালক থাকবে। জানতে চেয়েছিলাম যে সে আমাদের আশ্রমে পৌঁছে দিয়ে নিচে লোহাঘাটে নেমে যাবে না কি। যে মহারাজ ফোন ধরেছিলেন তিনি বলেন যে সে বিষয়ে আমাকে চিন্তা করতে হবে না, তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তাঁরা করে দেবেন। দ্বিতীয় রাতে আমাদের সঙ্গেই চালক ভোজনে বসে। এক মহারাজ এসে তাকে বলেন যে সে যেন পরে ভোজনে বসে, ওখানে আর এক জন বসবে। ও চেয়ার ছেড়ে মুখ নিচু করে উঠে যায়। পরে ও ভোজনের জন্যে আর আসে না। আমি অনুরোধ করলে বলে যে সে কী ভিখারি, পরে আসবে যে, তার জন্যে যে বসে আছে তাকে তুলে দেবে। আমি অনিকেতানন্দজীকে গিয়ে ভিখারি ইত্যাদি কথা চেপে রেখে বলি যে আমাদের ড্রাইভরের দুঃখ হয়েছে, চেয়ার থেকে ওকে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে, আর ও কিছুতেই ভোজনে আসতে রাজি হচ্ছে না। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার একবার মহারাজের প্রতিক্রিয়া আমাকে হত-চকিত করে দিল। উনি বেশ উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “কে সেই ড্রাইভার, নাম বলুন তো, ওর মায়াবতীতে আসা বন্ধ কর দেব, ওর এত মান, ও কী মনে করেছে, একজন ড্রাইভারকে খেতে দেব এক জন ভক্তকে না দিয়ে? আমরাও তো এখনও খাইনি”। 

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।


লেখক পরিচিত - শিক্ষাবিদ। পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন বহু বছর। নেশা হচ্ছে ভ্রমণ। অবসর-এর একজন নিয়মিত লেখক।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।